#নিবিদ্রিতা_কাহন—-৪৫
®মেহরুমা নূর
★সবগুলো ফার্মহাউসে এসে হাজির হয়েছে মাত্রই। তাসান এসেই হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে। সাথে আদ্রিতাতো আছেই। ফাইজার সাথে ওর এক ননদ,রুমা এসেছে। তাসানতো আসার পর থেকেই তার সাথে লাইন মেরে যাচ্ছে। সুইমিং পুলের পাশে বারবিকিউ পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। নিবিড় বারবিকিউ-এর আগুন সেট করছে। তাসানকে দেওয়া হয়েছে মাংস কেটে সাইজ করার দায়িত্বে। তার মাংস কাটার ধরন দেখে অপরাহ্ন বলে উঠলো,
“কীভাবে কাটছিস মাংস! এভাবে কেউ মাংস কাটে! মনে হচ্ছে পান খেয়ে পানির পিক ফেলেছে কেউ। আরে সুন্দর করে কাটনা।”
তাসান বিরক্তির সুরে বলল,
“মাংস আবার সুন্দর করে কেমনে কাটে। এখন কি এইটারে ফেসপ্যাক লাগিয়ে ফেসিয়াল করে তারপর কাটমু! তুইও আজব আইটেম। আরে মাংস হলো বাসর ঘরে বউয়ের মতো। প্রথমে যতই সুন্দর হোক পরেতো সব উজাড় হয়ে যায়। মাংসও তেমন। এদের শেষমেশ দাঁতের নিচে পিষে পাকস্থলীতেই যেতে হবে তাহলে আর এতো সাজসজ্জার আজাইরা প্যারা নেওয়ার কি দরকার!। ”
“তাহলে সোজা গরু খেয়ে ফেললেই পারিস।রান্না করার কি দরকার!”
“হ্যাঁ, খেলে খাওয়াই যায়।সেটা কোনো ব্যাপার না। ব্যাপার হচ্ছে, পেটের ভিতর গিয়ে হাম্বা হাম্বা শুরু করলে তখন মুশকিল হয়ে যাবে তাইনা!”
এদের কথায় হাসলো সবাই। তাসান আবার বলল,
“আচ্ছা বলতো,এইডারে বারবিকিউ কেন কয়? এটা বারো ক্লাস পাস করেছে নাকি যে বারবিকিউ বলে? তেরোকিউ কেন বলেনা!”
“কারন হতে পারে এটা তোর মতো বারোভাতারি।”
আবারও হাসলো সবাই।
আদ্রিতা পুলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে বসে চিপস খাচ্ছে। সাথে তানহা আর সানভিও আছে৷ নিবিড় বারবিকিউ রান্নার ফাঁকে ফাঁকে বারবার চোখ রাখছে আদ্রিতার উপর। এখনো যেন তার মনে ভয় থেকেই গেছে। আদ্রিতাকে হারানোর ভয়। যে ভয় হয়তো আজীবন থাকবে তার। তাইতো চোখের আড়াল হলেও এখন অন্তর কাঁপে তার।একটু পর আদ্রিতারাও উঠে এলো বারবিকিউ রান্না দেখতে। আদ্রিতা নিবিড়ের কাছে এসে উৎসুক কন্ঠে বলল,
“আমিও করি একটু!”
“পারবিনা, হাতে ছ্যাঁকা লাগবে।”
“আরে পারবো, দিন না একটু প্লিজ! ”
“আচ্ছা ঠিক আছে, একটা কর। তবে সাবধানে।”
আদ্রিতা খুশি হয়ে বলল,
“আচ্ছা।”
আদ্রিতা নিবিড়ের পাশে একটা বারবিকিউ করতে লাগলো। নিবিড় ওকে দেখিয়ে দিলো কীভাবে করতে হয়। আদ্রিতা সেটা করতে খুব খুশি। যেন কত বিশাল একটা কাজ করতে পেরেছে সে। নিবিড় আদ্রিতার সেই হাসিমাখা মুখটা দেখেই খুশি। সবকিছুর বিনিময়ে এই হাসিমাখা মুখটাইতো সে দেখতে চয়। আদ্রিতা একটা বারবিকিউ করতে পেরেই খুশিতে লাফিয়ে নেচে নেচে সবাইকে বলল,
“দেখ দেখ, এটা আমি বানিয়েছি। আমি বারবিকিউ করতে পেরেছি।”
তাসান হাত তালি দিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে বলল,
“ওয়াহ,কেয়া বাত, কেয়া বাত। তুইতো কামাল করে দিয়েছিস। ধুতি ফেড়ে রুমাল বানিয়ে দিয়েছিস। শাহরিয়ার পরিবারের নাম উজ্জ্বল করে দিয়েছিস আজ। লোকে বলবে ওই যাচ্ছে শাহরিয়ার পরিবার, ওই বাড়ির মেয়ে বারবিকিউ বানাতে পেরেছে। এইজন্য স্বর্ণপদক দেওয়া হবে তোকে। মামা,মামী তার মেয়ের সফলতা দেখে গর্বে বেলুন হয়ে উড়ে যাবে আকাশে।”
আদ্রিতা বোকার মতো গর্ব করে বলল,
“থ্যাংক ইউ,থ্যাংক ইউ…
রান্নার পর ছেলেরা সুইমিং পুলে নামলো সবাই।পাশেই মিউজিক সিস্টেমে গান বাজছে। তাসান পানিতে নেমে উড়াধুড়া নাচতে লাগলো। ফাইজার ননদ রুমাকে নিজের উন্মুক্ত বডি শো করতে লাগলো। আদ্রিতারাও সুইমিং পুলের পাশে বসে আড্ডা দিচ্ছে।তবে আদ্রিতার বেহায়া নজর ফিরেফিরে তাকাচ্ছে নিবিড়ের পানে। ফর্সা,সুঠাম উন্মুক্ত শরীরে সুইম করছে সে। পুলের পানিতে যেন চকচক করছে তার বডি। আদ্রিতার লোলুপ দৃষ্টি চেয়েও যেন আটকাতে পারছেনা। তানহাও আরচোখে কয়েকবার তাকালো অপরাহ্নের পানে। তবে অপরাহ্ন হঠাৎ চোখ মারতেই তানহা লজ্জায় চোখ সরিয়ে নেয়। সুইম শেষে সবাই বারবিকিউ খেতে বসলো। পুলের পাশেই সবাই একেকজন একেক জায়গায় বসে খাচ্ছে। আদ্রিতা বরাবরের মতোই খেতে চাচ্ছে না। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে যেন আরও বেশি খাবারে অনিহা হয়ে গেছে তার। তাই নিবিড় নিজের হাতেই আদ্রিতাকে খাইয়ে দিলো। এখন এটাও যেন আদ্রিতার অভ্যাস হয়ে গেছে। নিবিড়ের হাতে খেতেই ভালো লাগে তার। আদ্রিতা খেতে খেতে বলল,
” আপনি অনেক ভালো রান্না করতে পারেন। কত গুণ আপনার। আমারতো কোনো গুনই নেই। আস্ত একটা বেগুন আমি। এমন বেগুন বউ আপনার সাথে বেমানান লাগে না! ”
নিবিড় নানরুটির সাথে মাংস নিয়ে আদ্রিতার মুখে দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, তাতো লাগেই। কিন্তু কি আর করার! বিয়েতো হয়েই গেছে। আমি আবার খুব ভদ্র ছেলে কিনা।তাই বউ যেমনই হোক মানিয়ে চলি।”
আদ্রিতার হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল। গলার খাবার যেন আর গলা দিয়ে নামলোনা। সে মলিন মুখে বলল,
“আর খাবোনা আমি।”
বলেই আদ্রিতা উঠে যেতে চাইলো। নিবিড় তার হাত ধরে টান দিয়ে আবারও বসিয়ে দিয়ে মুচকি হেঁসে বলল,
“তুই আসলেই একটা বলদি।কখনো বুঝলি না আমাকে। আরে এসব গুণ হলো বাহ্যিক গুণ। এসব যেকোনো মানুষ চাইলেই আয়ত্ত করতে পারে। এটা মহৎ কিছু না। কিন্তু তোর মতো নিষ্পাপ, সরল মনের যে গুণ আছে সেটা চাইলেও কেও পারবেনা।কারণ এটা হাতে বানানো যায় না। এটা ব্যক্তির নিজস্ব গুণ। আর এত গুণ দিয়ে কি করবো আমি! ঘরের খুটি দিবো! বউয়ের বেশি গুণ থাকলে আবার জামাইকে দাম দিবে না। আর আমি তা মোটেও চাইনা। আমারতো বলদিই চাই। বুঝলি পাগলি!”
খাওয়ার পর আরও অনেকক্ষণ আড্ডা দিলো সবাই। আড্ডা দিতে দিতে প্রায় রাত দশটার বেশি বেজে গেল। তখনই নিবিড়ের ফোন এলো। ফার্মহাউসের সিকিউরিটি গার্ড নাকি এক্সিডেন্ট করেছে। তেমন গুরুতর না। তবে এখানে তার কেউ নেই। তাই নিবিড় সেটা শুনে সেখানে গেল। সাথে ফাইজার হাসব্যান্ডও গেল সাথে। নিবিড় সবাইকে বলে গেল সে ঘন্টাখানিক পড়েই চলে আসবে। নিবিড় যাওয়ায় আড্ডা আর জমলো না। সানভি তার বিউটি স্লিপ নিতে চলে গেল। সাথে ফাইজাও গেল শুতে। নিবিড় না থাকাই আদ্রিতারও মুত অফ হয়ে গেল তাই সেও রুমে চলে গেল। তানহাও উঠে গেল, তার দেখাদেখি অপরাহ্নও উঠে গেল। থাকলো শুধু ফাইজার ননদ রুমা আর তাসান থেকে গেল। সুযোগ বুঝে তাসান উঠে গিয়ে রুমার কাছে বসলো। বসে দুষ্টু সুরে বলল,
“আপনার কেমন লাগছে এখন? আমার না কেমন প্রেম প্রেম পাচ্ছে। চলেন না দুজন প্রেম প্রেম খেলি। খেলায় যে জিতবে সে চুম্মা পাবে।”
রুমা চোখ গরম করে বলল,
“আপনি এত অসভ্য কেন ? লুচু একটা।”
“আরে রাগছেন কেন? যান, সব চুমু আপনি একাই নিয়েন৷ তাইলে খুশিতো! আমার আবার এত অহংকার নেই। আপনি যত চান তত চুমু দেবো। তাও রাগ কইরেন না।”
“আপনি যাবেন এখান থেকে? না, ভাবিকে ডাকবো! এত বেশরম লোক জীবনেও দেখিনি আমি।”
“এইতো দেখছেন! জীবনে না দেখা জিনিসটা আপনাকে দেখানোর ভাগ্য করে দিলাম। তাও রাগ করেন। এমন করতে নেই। মন নরম করতে হয়। জানেন আমি উপরে উপরে যতই হাসিখুশি থাকি, ভেতরে আমার অনেক কষ্ট। যা কাউকে দেখাতে পারিনা।আমার কষ্টের কথা শুনলে আপনি কেঁদে ফেলবেন, এতো কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি আমি।”
ন্যাকা স্বরে দুঃখী ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল তাসান। রুমা ভাবলো ছেলেটার হয়তো সত্যিই কোনো কষ্ট আছে। তাই জিজ্ঞেস করলো,
“কি কষ্ট আপনার?”
“শুনবেন আপনি? সইতে পারবেন তো?”
“হ্যাঁ পারবো,আপনি বলুন।”
তাসান অতি দুঃখী ভঙ্গিতে ন্যাকা কান্নার সুরে বলল,
“আমাকে না, আমাকে আজ পর্যন্ত কেউ লিপ কিস করেনি। কেউনা। এই মাছুম ছেলেটা চুমুর জন্য দার দার ঘুরলো।কিন্তু কেউ মায়া করে এই ছেলেটাকে একটু কিস করলোনা। এত কষ্ট নিয়ে কি বেঁচে থাকা যায় বলুন! তবুও বেঁচে আছি আমি। এই আশায় যে,আপনার মতো মহৎ নারীর কৃপাদৃষ্টি হবে আমার ঠোঁটের উপর।”
রাগে কটমট করে রুমা বলল,
“আপনি সত্যিই একটা ফালতু লোক। ডিসকাস্টিং।”
বলেই ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেল রুমা। পেছন থেকে হো হো করে হাসতে লাগলো তাসান।
তানহা রান্নাঘরের দিকে এসেছিল পানি খাওয়ার জন্য। পানি খেয়ে ফিরতে নিলেই হঠাৎ কেউ তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিলো। তানহা চমকে উঠে চিৎকার করতে নিলেই অপরাহ্ন ফিসফিস করে বলল,
“হুঁশ, আমি।”
তানহা কিছুটা ভীতু গলায় ফিসফিস করে বলল,
“আপনি এখানে কি করছেন?”
“আগে এসো আমার সাথে।”
বলেই তানহার হাত ধরে চুপিসারে বাইরে নিয়ে গেল। বাইরে এসে বাগানের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। তানহা একটু ভীতু গলায় বলল,
“আরে কোথায় যাচ্ছেন? কেউ দেখে ফেললে কি হবে!”
“আরে কিছু হবেনা।তুমি আসোতো।”
অপরাহ্ন তানহাকে নিয়ে বাগানের একেবারে অন্য পাশে চলে গেল। যেখানে সামনে বিশাল জলাশয়। তার কিনারায় কাশফুলে ভরে আছে। চাঁদের রুপালী আলোয় তা দেখতে অপূর্ব সুন্দর লাগছে। সবচেয়ে মুগ্ধ হলো যখন কাশফুলের ভেতর থেকে ঝাঁক ধরে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা জোনাকির দল উড়ে বেড়াতে দেখলো৷ তানহা তা দেখে অবিস্মরণীয় নজরে তাকিয়ে রইলো। এত সুন্দর দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে গেল সে। বিস্ময়ে মুখে হাত চেপে ধরলো সে। অপরাহ্ন পেছন থেকে তানহার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে তানহার কাঁধে থুতনি রাখলো। থমকিত হলো তানহা, কম্পিত হলো ভেতর বাহির। অপরাহ্ন নাক ডুবাল তানহার চুলের ঘ্রাণে। এবার নিঃশ্বাসই বুঝি আঁটকে গেল তানহার। দুই হাতে নিজের জামা খামচে ধরলো সে। অপরাহ্ন তানহার কানের কাছে লো ভয়েসে বলল,
“এই অপূর্ব প্রকৃতিতে আমার শ্যামকন্যা নাহলে কি মানায়! সে যে এই প্রকৃতিরই নিপুণ রুপ। তাইতো তোমাকে এখানে আনা থেকে নিজেকে আটকাতে পারলাম না। অধম কি খুব বেশি গোস্তাকি করে ফেলেছে তাতে?”
তানহা লাজুক হেঁসে মাথা নিচের করে ডানে বামে নাড়াল। মানে অপরাহ্ন ভুল করেনি। অপরাহ্ন মুচকি হেঁসে বলল,
“হ্যাঁ এভাবে লাজে রাঙা মুখ দেখিয়ে শুধু আমাকে ঘায়েলই করে যাবে। এই মাছুম ছেলেটাকে আর কত জ্বালাবে। মা বিয়ের করার জন্য মাথা খেয়ে ফেলছে। কবে বিয়ে করবে আমাকে! তুমি বললে কালই মা বাবাকে তোমার বাড়ি পাঠাই? ”
“একদম না ডাক্তার সাহেব। আমাকে বউ হিসেবে পেতে আরও চারপাঁচ বছর ওয়েট করতে হবে আপনাকে।আমার এডুকেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত। এর আগে না।”
“এরচেয়েতো গলায় ফাঁ,সিই দিয়ে দিতে। পিচ্চি মেয়েকে ভালোবাসার এই কুফল। যৌবনের জলাঞ্জলি।”
হাসলো তানহা। তারপর বলল,
“কে বলেছিল বাসতে! নিজের বয়সের কাউকে খুঁজে নিতেন!”
অপরাহ্ন হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে বলল,
“কি করবো! এই পিচ্চিটাইযে ডাক্তারকে পেশেন্ট বানিয়ে দিয়েছে। এখনতো আর অন্য কোনো পথ নেই।”
বলেই অপরাহ্ন তানহার কাঁধে আলতো করে চুমু খেল। তানহা লজ্জার কবল থেকে বাঁচতে অপরাহ্নকে ছেড়ে জোনাকি পোকা ধরতে লাগলো। ছুটে ছুটে ধরতে লাগলো বাচ্চাদের মতো। অপরাহ্ন দাঁড়িয়ে মুগ্ধ নয়নে তা দেখতে লাগলো। সময়টাকে এই মুহূর্তে তার থামিয়ে দিতে মন চাচ্ছ।যে মুহূর্তে শুধু তাট শ্যামকন্যা থাকবে তার সাথে। তবে তা আর হলো কই! হঠাৎ চাঁদ কালো মেঘে ঢেকে গেল। আর দেখতে দেখতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। তা দেখে অপরাহ্ন দ্রুত তানহার হাত ধরে দৌড়ে বাসার দিকে চলে গেল।
___
রুমে বসে মোবাইল টিপছিল আদ্রিতা। নিবিড় না থাকায় তার ভালো লাগছে না। তার কাছে আসা দেখলে হাত পা কাঁপে, আবার তাকে ছাড়া কিছুতে মনও বসেনা। হঠাৎ বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ শুনতে পেল আদ্রিতা। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলো খুব জোরে বৃষ্টি নেমেছে। উৎসুক হয়ে আদ্রিতা দৌড়ে বেলকনিতে এলো। বেলকনির গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বের করে দিয়ে বৃষ্টির পানি হাতে নাচাতে লাগলো। বৃষ্টি তার খুব পছন্দ। বৃষ্টি এলেই তার ভিজতে মন চায়। কিন্তু সোনা মা আর নিবিড় ভাইয়ার কারণে সে ভিজতে পারেনা। তাদের মতে বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা জ্বর হবে। কিন্তু আদ্রিতার যে ভিজতে খুব করে মন চায় তা একটুও বুঝতে চায়না তারা।সাদা শাড়ি পরে বৃষ্টিতে ভিজে “টিপটিপ বারসা পানি” গানটার মতো নাচতে মন চায়।এটা তার অনেক দিনের ইচ্ছে। সেই ইচ্ছে আজপর্যন্ত পূরণ হলোনা তার। হঠাৎ একটা খেয়াল আদ্রিতার। আজকেতো আটকানোর কেউ নেই। সবাই শুয়ে পড়েছে। আর উনিতো হসপিটালে। বৃষ্টি ছাড়ার আগেতো আর আসতে পারবেনা নিশ্চয়। তারমানে আজই সেই মোক্ষম সুযোগ। আজ আদ্রিতা ওর ইচ্ছে পূরণ করতে পারবে।ইয়েস! ভেবেই খুশিতে লাফিয়ে উঠলো সে। দৌড়ে রুমে এসে কাবার্ড খুলে সাদা রঙের শাড়ি খুঁজতে লাগলো। এখানে নূরের অনেক শাড়ি রাখা আছে। মায়ের শাড়িগুলোর মাঝ থেকে সাদা শাড়ি আছে নাকি তা খুঁজে দেখতে লাগলো। অতঃপর সে পেয়েও গেল।শাড়ি পেয়ে আরও খুশি হয়ে গেল সে। তবে পড়তে গিয়ে হলো ঝামেলা। সেতো শাড়ি পড়তেই পারে না। অন্যদেরও বলতে পারছেনা এই বিষয়ে। নাহলে সবাই উল্টো পাল্টা কথা বলে খেপাতে থাকবে।তাই অগত্যা আদ্রিতা আয়নার সামনে গিয়ে কোনোরকমে যা পারলো তাই পড়ে নিলো। শাড়ি পরা শেষে ফোন হাতে নিয়ে বেড়িয়ে ছাঁদের দিকে দৌড়াল। ছাঁদের দরজায় এসে ফোনে টিপটিপ বারসা পানি গানটা চালালো। তারপর ফোনটা দরজার কাছে সেফ জায়গায় রেখে বৃষ্টির মাঝে নেমে পড়লো। বৃষ্টিতে ভিজে গানের তালে তালে নাচতে লাগলো।
আদ্রিতা ছাঁদে যাওয়ার পাঁচ/ছয় মিনিট পরই নিবিড় ফার্মহাউসে ফিরে এলো। ওখানকার কাজ শেষ হওয়ায় দ্রুত বৃষ্টির মাঝেই ফিরে এসেছে সে। আদ্রিতার জন্যই এত জলদি এসেছে।মেয়েটাকে বেশিক্ষণ একা রাখলেই তার চিন্তা হতে থাকে। গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ঢুকলো ভেতরে। মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে রুমে ঢুকলো সে। কিন্তু রুমে আদ্রিতাকে না দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো তার। পরক্ষণে ভাবলো হয়তো তানহা আর সানভির রুমে আছে। এই ভেবে রুমের বাইরে আসতেই হঠাৎ মিউজিকের শব্দ কানে এলো তার। এতরাতে গান কে বাজাচ্ছে! তাও ছাঁদ থেকে আসছে! কৌতূহলী হয়ে নিবিড় এগিয়ে গেল ছাঁদের দিকে। ছাঁদের দরজায় আসতেই আদ্রিতার ফোনটা দেখতে পেল সে। কপাল আরও কুঁচকে এলো তার। এবার ছাঁদের মাঝে তাকালো সে। এবং তাকাতেই সর্বস্ব স্থির হয়ে গেল।বৃষ্টিতে সানন্দে ভেজা আদ্রিতাকে দেখে হরণ হলো শরীরের সমস্ত ক্রিয়া প্রক্রিয়া। বৃষ্টির পানিতে সাদা শাড়ি ভিজে লেপ্টে আছে তার কোমল শুভ্র অঙ্গে।পিঠময় লেপ্টানো ভেজা চুল, মুক্তো দানার মতো ভেজা বদনখানি। সে যেন নারী নয়,নিবিড়ের জন্য সে এক জ্বলন্ত আগুন। যে আগুন এই মুহূর্তে নিবিড়ের সর্বস্ব পুড়িয়ে ঝলসে দিচ্ছে। নেশার অতল গহ্বরে তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। নিয়ন্ত্রণহীন করে দিচ্ছে তার সকল আয়ত্ত। বিবশ করে দিচ্ছে তার সকল স্নায়ুতন্ত্র।
নেশার অতলে ডুবে বিমোহিত নিবিড়, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে কদম বাড়াল মহীয়সী নারীর দিকে। চোখের নজরে তার তীব্র নেশার আবাসস্থল এমুহূর্তে। আদ্রিতা নিজের মনে ঘুরে ঘুরে নেচে যাচ্ছে। নিবিড়কে এখনো দেখেনি সে। উল্টো দিকে হয়ে ভিজতে ব্যাস্ত সে। নিবিড় একসময় আদ্রিতার পেছনে এসে দাঁড়াল। আদ্রিতার বাম হাতের বাহু ধরে এক ঝটকায় তাকে নিজের দিকে ঘুরালো। চমকে গেল আদ্রিতা। নিবিড়কে দেখে অনেক ভয়ও পেয়ে গেল প্রথমে। ভাবলো হয়তো আজ আর নিস্তার নেই তার। তবে নিবিড়ের ওই তীব্র নেশা ভরা কঠিন হৃদকম্পিত চাহুনি দেখে থমকে গেল আদ্রিতা।যে চাহুনি ঝংকারিত করে দিলো তার অন্তর্দেশ। আদ্রিতাকে টান দিয়ে ঘুরানোর সময় তার ভেজা চুলগুলো মুখের উপর এসে লেগে গেল। নিবিড় একহাতে আদ্রিতার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। নেশালো একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে অন্য হাতের আঙুল দিয়ে আদ্রিতার মুখের উপর লেপ্টে থাকা চুলগুলো আস্তে করে সরিয়ে দিলো। শিহরণে চোখ বুজে নিলো আদ্রিতা। দুঃসাহসিক বৃষ্টির ফোটা ঠাস ঠাস করে পড়ছে আদ্রিতার চোখে, মুখে আর পড়ছে গোলাপ রাঙা অধর যুগলে। তা যেন নিবিড়ের সর্বস্ব গ্রাস করে নিচ্ছে। ধ্বংস করে দিচ্ছে তার সকল নিয়ন্ত্রণ। যার বশবর্তী হয়ে নিবিড় এক হাতে আদ্রিতার শাড়ীর ফাঁকের উন্মুক্ত কোমড় পেঁচিয়ে ধরলো।অন্য হাত আদ্রিতার কানের নিচে রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে অধর ছোঁয়াল আদ্রিতার অধরে। নেশায় পাগল নিবিড় আরও ভীষণ নিগূঢ় ভাবে আদ্রিতার অধরে হারালো। শিহরণে কম্পন সৃষ্টি হলো আদ্রিতার অঙ্গে। কম্পিত আদ্রিতা নিজেকে টিকিয়ে রাখতে নিবিড়ের বুকের শার্ট খামচে ধরলো। তবুও যেন কম্পনে অবশ হয়ে যাচ্ছে সে। আজ নিবিড়ের স্পর্শে অসীম উন্মাদনা উপলব্ধি করছে সে। এমনটা সে আগে কখনো উপলব্ধি করেনি। যেন আজ সে নিজের মাঝেই নেই।
অধরের ক্রিয়া থামিয়ে নিবিড় আদ্রিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“চারিদিকে এত পানি তবুও কেন এত তৃষ্ণা হচ্ছে আমার! তৃষ্ণায় ভেতরটা খা খা করছে আমার। এই বৃষ্টির ফোটা কেন আগুনের ফোটার মতো আমার সারা শরীর ঝলসে দিচ্ছে! এ কোন আগুন লাগালি তুই! আমি পারছিনা এই দহন সইতে! আমার শীতলতা দরকার পুতুল।একটু শীতলতা। দিবি কি আমাকে একটুখানি শীতলতা!”
নিবিড়ের এমন হৃকম্পিত কথায় আদ্রিতা যেন মৌন হয়ে গেল। তার মৌনতা দেখে নিবিড় বলল,
“তুই রাজি না থাকলে আমি এগুবোনা।”
বলেই নিবিড় আদ্রিতার পিঠ থেকে হাত নামিয়ে সরে আসতে চাইলেই আদ্রিতা তখনই নিবিড়কে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা গুজলো। নিবিড়ের ঠোঁটে প্রাপ্তির হাসি ফুটলো। নিবিড় একটু ঝুঁকে আদ্রিতাকে কোলে তুলে নিলো। আদ্রিতা লজ্জায় নিবিড়ের বুকের মাঝে লুকিয়ে ফেললো নিজের মুখ। নিবিড় আদ্রিতাকে নিয়ে এলো তার রুমে। রুমে এসে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।
__
রাত তখন দুইটা প্রায়। নিবিড় আদ্রিতাকে কোলে নিয়ে বসে আছে বেলকনিতে। নিবিড় খালি গায়ে, শুধু প্যান্ট পড়া। আর তার শার্ট এখন আদ্রিতার গায়ে জড়িয়ে আছে। আদ্রিতার পিঠ নিবিড়ের বুকের সাথে লেপ্টে আছে। নিবিড় পেছন থেকে আদ্রিতাকে কোলের মাঝে জড়িয়ে ধরে আছে। আদ্রিতার চুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হতে ব্যস্ত সে। সাথে আদ্রিতার গলা,কাঁধে অধর ছোঁয়াতে ব্যস্ত। আদ্রিতা লাজুক স্বরে বলল,
“আপনি না গিটার বাজানো শিখাবেন আমাকে! এই বুঝি শেখানো হচ্ছে! প্লিজ শেখান না!”
ফার্মহাউসে ওদের রুমে আদিত্যর গিটার রাখা ছিলো। আদ্রিতা সেটা কোলের মাঝে নিয়ে বসে আছে নিবিড়ের কাছে গিটার শিখবে বলে। কিন্তু নিবিড়ের মোহ থেকে বের হতে পারলেনা নিবিড় অন্য কাজে মন দিবে। আজ আদ্রিতাকে একান্ত করে পেয়ে যেন এই মোহ আরও বেড়ে গেছে তার।তবুও আদ্রিতার জোরাজুরিতে একটু করে গিটার শেখায় তারপর আবারও সেই মোহে হারায় সে। এবারও আদ্রিতার জোরাজুরিতে নিবিড় পেছন থেকে আদ্রিতার হাতের উপর হাত রেখে তাকে গিটার বাজানো শেখাচ্ছে। গিটার বাজাতে পেরে আদ্রিতা খুশি। খুশিমনে সে বলল,
“একটা গান গান না! আমি গিটার বাজাই আপনি গান, গান।”
নিবিড় আদ্রিতার কাঁধে চুমু খেয়ে বলল,
“আমার পুতুল বউয়ের জন্য সব হাজির।”
নিবিড় আদ্রিতার হাতের উপর দিয়ে হাত রেখে গিটার বাজিয়ে গান ধরলো,
♬ এসোনা ভাসি প্রেম সাগরেরই মোহনায়
♬ কতটা দূর নেই জানা
♬ প্রেম সেতো বাধা মানে না, মানে না
♬ প্রেমের সাগর ভেজা চাঁদর
♬ তোমার মাঝে নাও আমাকে
♬ নিবীর করে বাসবো ভাল
♬ ভিষণ আদর দেবো তোমাকে।
♬ আকাশেরই সীমানায় গোধুলীর সাঝ
♬ তোমাকেই বলে দিয়ে যায় ঠিকানা
♬ ঐ চোখে কি নেশা, কেমন ব্যাকুলতা
♬ অসীম আকুলতা এইতো ভালবাসা।
♬ প্রেমের সাগর ভেজা চাঁদর
♬ তোমার মাঝে নাও আমাকে
♬ নিবীর করে বাসবো ভাল
♬ ভিষণ আদর দেবো তোমাকে
♬ তোমারি ভালবাসা দিয়েছে আজ
♬ সুখেরি পালে বয়ে যায় কি হাওয়া
♬ পাল তুলে সে হাওয়া, খুব কাছে চাওয়া
♬ মন ভাবে বলোনা, আরো কাছে আসোনা
♬ পাল তুলে সে হাওয়া, খুব কাছে চাওয়া
♬ মন ভাবে বলোনা, আরো কাছে আসোনা
♬ পাল তুলে সে হাওয়া, খুব কাছে.
♬ আরো কাছে আসোনা…
♬ প্রেমের সাগর ভেজা চাঁদর
♬ তোমার মাঝে নাও আমাকে
♬ নিবীর করে বাসবো ভাল
♬ ভিষণ আদর দেবো তোমাকে
________________________________________
(আমি আগেই বলেছি এই গল্পের নির্দিষ্ট কোনো কাহিনি নেই। এই গল্পের কোনো শেষ নেই। এদের নিয়ে লিখলে অনেক লেখা যাবে। তবে কাহিনি ছাড়া গল্প রোজ রোজ দিলে তখন গল্পে একঘেয়েমি চলে আসবে। তাই ধারাবাহিক উপন্যাস আকারে গল্প এখানেই শেষ করলাম। তবে হ্যাঁ, আপনারা চাইলে মাঝে মধ্যে ওদের নিয়ে স্পেশাল পর্ব নিয়ে আসবো। তবে সেটা একান্তই মন ইচ্ছে। যখন ওদের নিয়ে মাঝে মধ্যে লিখতে মন চাইলে লিখব। তবে সেটা নিয়মিত ধারাবাহিক পর্ব না, শুধুই স্পেশাল পর্ব হবে । আবারও বলে রাখি গল্প ধারাবাহিক আকারে এখানেই শেষ ।)