নিবিদ্রিতা_কাহন (SP-2)

0
1

#নিবিদ্রিতা_কাহন (SP-2)

টুং করে ম্যাসেজ টোন বাজার শব্দে ঘুমের মাঝেই চাদরের মাঝ থেকে হাত বের করে মাথার উপরের দিকে হাতরে বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে মুখের সামনে ধরল আদ্রিতা। ঘুমে জর্জরিত চোখদুটো আঠা লাগিয়ে রাখিয়ে রাখা কাগজের মতো টেনে ছাড়াল অনেক শ্রম লাগিয়ে। ঘোলা-ঘোলা চোখের সামনে মোবাইলের আলো লেগে আবারও কুঁচকে এলো তা। কতক্ষণ পিটপিট করে আলো সয়ে এলে মোবাইলের স্ক্রিনে নজর রাখল আদ্রিতা। বাংলা অক্ষরে টাইপ করা ম্যাসেজটা চোখে পড়ল। যাতে লেখা আছে,
“আট টা বেজে গেছে। এখন আর এক দন্ডও ঘুমাবি না। ঝট করে উঠে পর।”
এতটুকু পড়ে আদ্রিতা ফোন রেখে ঘুমানোর পায়তারা করতেই তার চোখে পড়ল বাকি লেখাটুকু। যেখানে ছিলো,
“একদম ফোন রেখে ঘুমানোর ধান্দা করবিনা৷ নাহলে ফিরে এসে তুলে আছাড় মারা পাক্কা!” এই পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে ভেংচি কাটতে গিয়েও থেমে গেল আদ্রিতা। কারণ ম্যাসেজের পরের লাইনে আছে,
“খবরদার! ম্যাসেজ পড়ে মুখ ভেংচাবিনা। কেঁচি দিয়ে ঠোঁট কেটে দিবো তাহলে। এখন ঝট করে ওঠ। ফ্রেশ হয়ে, নাস্তা খেয়ে পরিক্ষা দিতে যা।”
মুখ মলিন করে ফেলল আদ্রিতা। ম্যাসেজের মাঝেও ধমকায়! এই দৈত্য দানবটা আর ভালো হলোনা কখনো। বউকে এমনভাবে ধমকায় কেউ! যেন আমি ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী আর সে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। আদ্রিতার কখনো কখনো মনে হয় সে কোনো সাধারণ পুরুষের সাথে না। ধমক রাজ্যের মহারাজ, ধমকউল্লাহর সাথে সংসার করছে। মানে বেচারি আদ্রিতার জীবনতো পুরো তেজপাতা হয়ে গেছে। তাও গরম তেলে ভাজা তেজপাতা! মানে বিয়ের পরে কারা পরিক্ষা দেয়! আরে বিয়ের পরেতো বাচ্চা দেওয়ার প্রটোকল থাকে। অথচ এই ধমকউল্লাহর অত্যাচারে আদ্রিতাকে প্রটোকল বাদ দিয়ে অন্য ট্রাকে চলতে হচ্ছে। ছোটোবেলার মতো বই কাঁধে নিয়ে দৌড়াতে হচ্ছে। পরিক্ষা দিতে দিতে মগজের রামধোলাই করতে হচ্ছে। সব ওই ধমকউল্লাহর আতঙ্কে করতে হচ্ছে। মানে এটা কোনো জীবন হলো! হঠাৎ আবারও ম্যাসেজ টোন বাজার শব্দে ভাবনার সুতো কেটে মোবাইলে দৃষ্টি ফেরালো আদ্রিতা। ম্যাসেজ এসেছে,
“এই পুতুল সোনা রাগ করেনা৷ আজইতো শেষ পরিক্ষা। জানি কদিন হলো একটু বেশি হার্শ হয়েছি তোর সাথে। কি করবো তুই যে একেবারেই পড়ায় মনোযোগ দিতে চাস না। আর আমার নতুন প্রজেক্টের কারণে তোকে সময়ও দিতে পারছিনা ঠিকমতো। তবে চিন্তা নেই। আজ আমার প্রজেক্টের কাজও শেষ হবে। আর তোরও ভার্সিটি ছুটি কাল থেকে। তারপর তুই যেখানে বলবি সেখানেই বেড়াতে নিয়ে যাবো ঠিক আছে। এবার লক্ষি মেয়ের মতো পরিক্ষা দিয়ে আয়। আমার ফিরতে একটু রাত হবে।”
কিছু মুহুর্ত পূর্বেও যে মলিনতা ছিলো তার লেশমাত্র রইলো না যেন এখন আর আদ্রিতার মুখে। ঠোঁটে ভেসে উঠল অমায়িক প্রাপ্তিময় হাসির প্রসন্নতা। যাকে মাত্রই মহারাজ ধমকউল্লাহর উপাধি দিয়ে বসেছিলো এখন নিজের সেই ভাববনার জন্য নিজেকেই কপট আঘাত করতে মন চাচ্ছে। সেকি জানে না, মানুষটাতো আদ্রিতার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। মায়াময় নজর রেখে মোবাইলের স্ক্রিনে ঠোঁট ছোঁয়াল আদ্রিতা। এটা যদি নিবিড় দেখতো তাহলে নিশ্চয় বলতো,
“অরি তুই এতো পিশাচ কেন? জানিস ফোনে কতো জার্মস থাকে! আমার শরীর কি কম পড়েছে চুমু খাওয়ার জন্য যে, ফোনে চুমু খেতে হবে? তোর ঠোঁটের ছোঁয়া যেন আমার শরীর ব্যাতিত অন্য কোথাও না যায়। নাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”
কথাগুলো ভেবে আপনমনেই হাসলো আদ্রিতা। হাত বাড়িয়ে নিবিড়ের বালিশটা কাছে টেনে নিলো সে। দুই হাতে বালিশ জড়িয়ে ধরে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ টেনে নিলো। নিবিড়ের ঘ্রাণ লেগে আছে এখনো বালিশে। তাকে ছাড়া সকালটা যেন শূন্যতার বার্তা নিয়ে আসে আদ্রিতার জন্য। মন উদাস হয় তার। এতো মরার মতো কেন ঘুমায় সে! একটু জাগনা পেলেইতো লোকটাকে সকালে একটু দেখতে পারে। আজ প্রায় দু সপ্তাহ হলো নিবিড়ের নতুন প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়েছে। যারজন্য অনেক ব্যাস্ত থাকে সে। কাক ডাকা ভোরে যায় আর অনেক রাতে ফিরে। নতুন প্রজেক্ট সেই গাজীপুর ব্রাঞ্চে। নিবিড় রোজ এত রাস্তা আবডাউন করে। অথচ সেখানেই ওদের ফার্মহাউস রয়েছে। নিবিড় চাইলেই আরামে সেখানেই থাকতে পারে। কিন্তু আদ্রিতা জানে নিবিড় এতটা রাস্তা পেরিয়ে শুধু তার জন্যই আসে৷ রাতের কিছুটা সময় হলেও অরির কাছে থাকতে চায় সে৷ আদ্রিতার ১ম বর্ষের ফাইনাল পরিক্ষা চলছে। নিবিড় পর্যবেক্ষণ না করলে যে আদ্রিতা পড়াশোনা ঠিকমতো করবেনা তা জানে সে। তাইতো হাজার ক্লান্তি নিয়েও রাতে বাড়ি ফেরে সে৷ শুধুমাত্র পুতুলটাকে সময় দিতে। তাকে বুকের উঞ্চতায় জড়িয়ে ঘুমাতে। আদ্রিতার মাঝেই যে নিবিড়ের সকল প্রশান্তির বসবাস তা খুব করে জানে আদ্রিতা। তবে নিজের উপর খুব রাগ হয় আদ্রিতার। সে কেন নিবিড়ের বরাবরই করতে পারে না। লোকটা কত ক্লান্তি নিয়েও শুধু ওরজন্য আসে। অথচ আদ্রিতা কি করে! মরার মতো ঘুমিয়ে থাকে। অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করার কারণে সকালে ঘুমই ভাঙে না ওর। লোকটাকে যাওয়ার সময় উঠে একটু বিদায়ও দিতে পারেনা। কেমন বউ সে! এমন একটা অপদার্থ বউ কি আদৌও উনার যোগ্য! ভাবতেই কান্না পায় আদ্রিতার। নাহ! আবালের মতো বসে-বসে কাঁদলে হবে না। তোকে কিছু করতে হবে আদ্রিতা। মনে মনে কিছু ভাবলো আদ্রিতা। আজ পরিক্ষাও শেষ আর নিবিড়ের প্রজেক্টও শেষ। তাই নিবিড়ের জন্য স্পেশাল কিছু করবে সে। নিবিড়কে সারপ্রাইজ দিবে। রোমান্টিক কিছু করবে তারজন্য। উনি নিশ্চয় খুশি হয়ে যাবে। কিন্তু কি করবে? আদ্রিতা যে এসবে একেবারেই খালি ডিব্বা। কিছুই পারে না। কিছু একটা ভেবে ঝট করে উঠে বসলো আদ্রিতা। ফোন হাতে নিয়ে গুগলে সার্চ দিতে পরলো। গুগল মামার কাছে সব সমস্যার সমাধান অবশ্যই আছে। এই ভেবেই গুগলের সার্চ অপশনে টাইপ করল,”How to arrange a romantic night?” এবং সাথে সাথেই অনেকগুলো ছবি এসে জড়ো হলো স্ক্রিনে। ছবিগুলো দেখতেই চোখের পর্দা টানটান হয়ে ফেটে যাওয়ার উপক্রম। ঝট করে ফোনটা হাত ছুড়ে ফেলল বিছানায়। ছিঃ! ছিঃ! কিসব আসে! নির্লজ্জ গুগল! নাহ এদের দিয়ে কাজ হবে না। আমার নিজেরই বুদ্ধির খাজানা বের করতে হবে। আদ্রিতার কি বুদ্ধির কমতি আছে নাকি! বুদ্ধিতো আদ্রিতার মাথার প্রতিটা চুলের আগায় ঝুলে থাকে। একটা ঝাকানাকা আইডিয়া ঠিকই বের করে নিবে সে। নিবিড় ভাইয়াকে এমন সারপ্রাইজ দিবে যে সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাবে। এই মনোস্তাপ করে আদ্রিতা বিছানা ছাড়ল। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিলো।

ভার্সিটির জন্য রেডি হচ্ছিল নূরান। মাথার লম্বা চুলগুলো রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধতে বাঁধতে বলল,”তনয়া কি হয়েছে বলবা? কাল থেকে ভিডিও কলে আসতে বলছি আসছো না কেন? সমস্যা কি?”
নূরানের কথার প্রতিত্তোরে ড্রেসিং টেবিলের উপরে থাকা ফোনটাতে টুং করে ম্যাসেজ টোন বেজে উঠল। ফোনটা হাতে তুলে দেখলো তনয়া টেক্সট রিপ্লাইয়ে বলছে,
“আরে এমনি, তেমন কিছু না। বাসায় একটু মেহমান আছেতো তাই।”
নূরান ফোনটা হাতে নিয়ে বিছানার উপর রেখে পায়ে জুতো পড়তে পড়তে বলল,
“তো! আমাদের কথাতো তোমার আমার দুই পরিবারই জানে। তাহলে সমস্যা কোথায়? দেখো তুমি আমাকে মিথ্যা বুঝিয়ে ঘুরানোর চেষ্টা কোরোনা। মিথ্যে বলা আমার একদমই পছন্দ না। সত্যি করে বলো কি হয়েছে? এক্সুলি ভিডিও কলে এসে বলো।রাইট নাও।”
কয়েক সেকেন্ড পেরোনোর পরও কোনো রিপ্লাই এলোনা। অগত্যা নূরান নিজেই ভিডিও কল করল। মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে নূরানের সেটা কেন বুঝতে পারছে না ও! তাকে দেখে সব ঠিক আছে আস্বস্ত না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি আসবে না নূরানের। অনেকক্ষণ রিং যাওয়ার পর রিসিভ হলে ওপাশ থেকে। কিন্তু তনয়ার মুখের উপর মাস্কের মতো ওড়না দিয়ে ঢেকে থাকা দেখে ভ্রু কুঁচকে আসলো নূরানের। কপাল কুঁচকে বলল,
“মুখ ঢেকে রেখেছ কেন? খোলো।”
তনয়া মাথা দুই দিকে নেড়ে ইশারায় বুঝালো সে খুলবেনা। নূরান ফোঁৎ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তনয়া আমার অনেক ইম্পর্ট্যান্ট এক্সাম আজ। আজ অনেক বড়ো আর্ট শিল্পী আমাদের আর্ট গুলো দেখবে। যারটা পছন্দ হবে তাকে পুরস্কার হিসেবে উনার পার্সোনাল আর্টগুলো দেখার সুযোগ দিবে। আর আমি এই সুযোগ টা চাই খুব করে। কিন্তু তুমি যদি এমনই করতে থাকো তাহলে তোমার চিন্তা হবে আমার।আর আর্টে মনোযোগ দিতে সমস্যা হবে আমার। তুমি কি তাই চাও?”
তনয়া দ্রুত গতিতে মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে বুঝলো,না সে কিছুতেই এমনটা চায়না। সে’তো সবসময় চায় নূরান অনেক বড়ো আর্টিস্ট হোক। তনয়ার উত্তর পেয়ে নূরান স্মিথ হেঁসে বলল,
“তাহলে বলো কি হয়েছে? সমস্যা কি?”
তনয়া এবার ধীরে ধীরে মুখের উপর থেকে ওড়নাটা সরিয়ে দিলো। নূরান অনেক খেয়াল করে দেখেও কিছু বুঝতে পারল না। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল,
“সমস্যা কি সেটাতো বলো!”
তনয়া ডান হাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে তার গালের মাঝখানে পয়েন্ট করে দেখালো। নূরান অনেক খেয়াল করে দেখার পর কিছু চোখে পড়ল তার। পরক্ষনেই যেন তনয়ার সামনে না আসার কারণটা বুঝতে পারল সে। বিভ্রান্ত কন্ঠে বলল,
“এক মিনিট! তুমি এই পিম্পলের কারণে সামনে আসছোনা?”
তনয়া মলিন মুখে মাথা উপর-নিচ করে হ্যাঁ বুঝালো। নূরান কতক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তনয়ার দিকে৷ এবং পরপরই শরীর কাঁপিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সে। হাসতে হাসতে বলল,
“লাইক রিয়েলি তনয়া! তুমি এই সিলি পিম্পলের জন্য সামনে আসছোনা? বোকা মেয়ে! ”
আবারও হাসতে লাগল নূরান। নূরানকে এভাবে হাসতে দেখে তনয়া বেচারি লজ্জায় পড়ে গেল। হঠাৎ ঠাস করে কিছু পড়ার শব্দে নূরান চকিত নজরে পেছনে ফিরে তাকালো। দরজার সামনে হা করে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকা আদ্রিতাকে দেখতে পেল সে। তার পায়ের কাছে ফ্লোরে প্লেট ভেঙে পড়ে আছে। প্লেটে স্যান্ডউইচ নিয়ে খেতে খেতে এসেছিলো সে ভাইকে ডাকতে নাস্তার জন্য। সেটাই এখন নিচে ভেঙে পড়ে আছে। মুখের ভেতর কামড়ে নেওয়া স্যান্ডউইচটুকু ওভাবেই ধরা আছে। মূর্তির মতো জমে গেছে যেন সে। তাকে ওভাবে দেখে নূরান থতমত খেয়ে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত আদ্রিতার কাছে এসে চিন্তিত স্বরে বলল,
“অরি! কি হয়েছে? এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? প্লেট কিভাবে ভাঙলো? সরে আয় পায়ে লেগে যাবে।”
নূরান আদ্রিতার হাত ধরে ওকে সরিয়ে আনলো। কিন্তু তারমাঝে কোনো হেলদোল নেই। কেমন জড়পদার্থের দাঁড়িয়ে আছে সে। নূরান তাকে আবার ডাকলো। কাঁধ আলতো ঝাঁকিয়ে বলল,
“অরি! এই অরি কথা বলছিস না কেন? কি হয়েছে তোর?”
আদ্রিতা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল নূরানের দিকে। মুখের স্যান্ডুউইচটুকু এই পর্যায়ে মুখ থেকে পড়ে গেল।চোখ পিটপিট করে জিজ্ঞেস করল,
“ভাইয়া আমি এখনো ঘুমিয়ে আছি তাইনা? তুমি আমার স্বপ্নে এসেছো তাইনা?”
নূরান ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি যা তা বলছিস? স্বপ্ন কেন হবে?”
“তাহলে নির্ঘাত আমি মঙ্গলগ্রহে চলে এসেছি। নাহলে এমন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য আমার চোখে পড়ল কিভাবে? আমি দেখলাম তুমি হাসছিলে। শুধু হাসছিলে না। তাসান ভাইয়ার ভাষায় হেঁসে লেটাপেটা করে ফেলছিলে। এটা কি বাস্তব কোনো জিনিস হলো!”
নূরান অসহায় নিঃশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়াল। বুঝতে পারল তার বোনের এমন টাস্কি খাওয়ার কারণ। নূরানের আপনজন গুলো সব একটার থেকে আরেকটা ইউনিক আইটেম। নূরানের হঠাৎ মনে পড়ল ভিডিও কলের কথা। বিছানার উপর থেকে ফোনটা উঠিয়ে দেখলো তনয়া এখনো লাইনেই আছে। মুচক-মুচকি হাসছে ওদের ভাইবোনের কাহিনি দেখে। নূরান ফোনটা আদ্রিতার সামনে ধরে বলল,
“এই অষ্টম আশ্চর্য এই পাগলির জন্য হয়েছে। দেখ একটা পিম্পল হয়েছে বলে সে নিজেকে কারাবন্দী করে রেখেছে। আমার সামনেও আসছিলো না। তো এমন বোকামী দেখে হাসি পাবেনা তুইই বল!”
আদ্রিতা এবার ফোনটা হাতে নিয়ে অবাক সুরে বলল,
“কিউটি ভাবি! তুমি জানো না তুমি আজ কত্তোবড়ো ইতিহাস তৈরী করছ! নূরান ভাইয়াকে হাসিয়েছ! এরজন্য তোমাকে অস্কারের চৌদ্দ গুষ্টি দিলেও কম হবে। তুমি সত্যিই গ্রেট!”
আদ্রিতার কথায় লাজুক হাসলো তনয়া৷ আদ্রিতা কিছু একটা ভেবে নূরানের উদ্দেশ্যে বলল,
“ভাইয়া তুমি যাও নাস্তা করো। সোনা মা,ডাকছে তোমাকে। আমার কিউটি ভাবির সাথে একটু কথা আছে।”
“কি এমন কথা যে আমার সামনে বলা যাবে না? কি সয়তানি পাকাপি আবার দুই পাগল মিলে?”
আদ্রিতা মুখ গোল করে, মুখের উপর হাত চেপে বলল,
“হোহ্ ভাইয়া! তুমি কিউটি ভাবিকে পাগল বলছ! ভেরি ব্যাড! এতো কিউট মেয়েটাকে পাগল বলতে তোমার ফুসফুসে বাঁধল না!”
নূরান আদ্রিতার মাথায় আলতো করে চাটি মেরে হাসিমুখে মাথা নেড়ে বেড়িয়ে গেল। নূরান যেতেই আদ্রিতা ফটাফট বিছানায় পা ভাজ করে আরাম করে বসলো। ফোনটা সামনে ধরে বলল,
“শোনো কিউটি ভাবি,ফটাফট আমাকে একটা আইডিয়া ছুঁড়ে মারোতো।”
তনয়া মাথা নাড়িয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল কি আইডিয়া। আদ্রিতা বলল,
“আরে আমার হ্যান্ডসাম বরটাকে রোমান্টিক একটা সারপ্রাইজ দিতে চাই বুঝছ। একটা ভালো আইডিয়া দাওনা।”
তনয়া ঠোঁট উল্টিয়ে দুই কাঁধ ঝাকিয়ে বুঝালো সে কিভাবে দিবে! তার এসবের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আদ্রিতার ফোঁৎ করে হতাশাজনক নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ব্যাপার না,আমি নিজেই কিছু বের করবো। এখন আগে পরিক্ষার প্যারাটা শেষ করে আসি। বায় কিউটি ভাবি।”
___

পরিক্ষা শেষ করে এসে দুপুর থেকেই কাজে লেগে পড়েছে আদ্রিতা। নিবিড়ের জন্য সারপ্রাইজ সাজানোর কাজে। ছাঁদের দরজা লাগিয়ে তখন থেকে একাই সব করছে। বিকেল পর্যন্ত কাজ শেষ করে বের হলো সে। বের হয়ে ছাদের দরজায় তালা লাগিয়ে দিলো যাতে কেউ ঢুকতে না পারে। নিবিড় আসার পরেই এখানে আসবে সে। এমনটাই প্ল্যান করে রাখলো। নিবিড় আসতে আসতেতো অনেক রাত হবে। ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে একটু ঘুমিয়ে নিতে চাইলো আদ্রিতা। কিন্তু করিডোরে আসতেই দেখলো নিচ থেকে শোরগোল আসছে। আর হৈচৈ মানেই নিশ্চয় তাসানের আবির্ভাব ঘটেছে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে দেখলো আদ্রিতার ধারণাই ঠিক৷ তাসান আর সানভি এসেছে। তাসান এসেই তানির উদ্দেশ্যে অভিযোগ জাহির করে বলল,
“মামি,আমার সাথে অনেক অবিচার করছে তোমার ননদ আর ননদাই। এই মাছুম অবিচারের নিচে চাপা পরে পঁচা আলুর মতো পিচকে যাচ্ছে একেবারে।”
তাসানের এমন হৃদয় বিদারক দুঃখের কথা শুনে তানি ডাইনিং টেবিলে প্লেট গোছাতে গোছাতে মুচকি হেঁসে বলল,
“তাই নাকি! তা কি এমন অবিচার করছে শুনি তারা?”
তাসান তার দুঃখের বস্তা আরও খুলে অতি ব্যাথিত ভঙ্গিতে বলল,
“কি বলবো মামি! এমন অবিচার করছে যা শুনলে আকাশ-পাতাল ভেঙে পড়বে! গাছের পাতারাও দুঃখে সবুজ থেকে বেবি পিংক কালার হয়ে যাবে। হিটলারও এতটা অবিচার করেনি যতোটা এই মাছুম, কিউট ছেলেটার সাথে হচ্ছে।”
“কিন্তু অবিচারটা কি করছে তাতো বলবে?”
“আরে এই হ্যান্ডসাম নওজোয়ান ছেলেটাকে বিয়ে না করিয়ে আইবুড়ো করে মারছে এরচেয়ে বড়ো আর কোনো অবিচার আছে! ঘরে জোয়ান আবিয়াত্তা পোলা রেখে তাদের ঘুম ধরে কেমনে তাইতো বুঝি না আমি! আরে কোথায় আমাকে জোর করে দরকার হলে হাত-পা বেঁধে বিয়ে করাবে। বলবে,” আজই বিয়ে করে কালই নাতি-পুতি দিবি নাহলে তোর রক্ষে নাই।” আমিও মা-বাবার অতি আজ্ঞাকারী সন্তান হিসেবে মাথার ঘাম টিস্যুতে মুছে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাদের আদেশ পালনে লেগে পড়বো। কিন্তু না। এখানেতো প্রটোকলই উল্টো হচ্ছে। আমি বিয়ে করার জন্য আবেদনের উপর আবেদন জানাচ্ছি। অথচ তারা দুর্নীতি করে সেসব আবেদন আনদেখা করে রাখছে। এটা কোনো কথা হলো! সরাসরি মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। দুঃখে কলিজায় পাইলস হয়ে যাচ্ছে আমার।”
বেচারা তাসানের এমন নিদারুন, নির্মম, শোকাহত বানী শুনে সবাই সহমর্মিতা দেখানোর পরিবর্তে হেঁসে কুল পেলোনা। সানভি যদিও খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখলোনা। ভাইয়ের এসব ড্রামা দেখে অভ্যস্ত সে। তাই খুব একটা প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নিজের মতো সোফায় বসে টিভি চালু করল। তানহাও সোফায় বসে হাসছে। তাসান তার দুঃখের দরিয়ায় আরও ঝাপ দিয়ে বলল,
“হায়রে অমানবিকতা! কেউ বুঝল না এই দুঃখীনির দুঃখ! উরফি জাভেদের কাপড়ের চেয়েও বেশি খারাপ অবস্থা আমার।”

“এতো দুঃখ নিয়ে তোর বেঁচে থাকা একদম উচিত হচ্ছে না। এই মুহুর্তেই ছাঁদ থেকে লাফ দিয়ে এই দুঃখের বোঝা থেকে মুক্ত কর নিজেকে।”
আগত কণ্ঠস্বর শুনে সামনে তাকালো তানহা। অপরাহ্নকে দরজা দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে তনু মন নড়েচড়ে উঠল যেন তৎক্ষণাৎ। এগিয়ে আসতে আসতে সন্তর্পণে তানহার দিকে নজর দিতেও ভুলল না অপরাহ্ন। অপরাহ্নের তিরস্কারমূলক কথা শুনে তাসান বলে উঠল,
“ইজ্জত দিয়ে কথা বল বুঝলি। ভুলে যাসনা আমি তোর সুমুন্দি হই। কথা কওয়ার আগে একশ বার অযু করে আসবি। একদম পায়ে মাথা ঠেকিয়ে সালাম করে তারপর কথা বলবি। সুমুন্দিরে রাগাইলে বউয়ের ঝাড়ুও পাবিনা। মনে রাখিস, সারা দুনিয়া একপাশে আর বউয়ের ভাই একপাশে।”
“আরে সুমুন্দি সাহেব আগে বলবেন তো আপনার ইজ্জত লাগবে। আমার বাথরুমের কমোডটা নিয়ে আসতাম আপনার জন্য। ইজ্জত একদম আপনার মাথায় ঢেলে দিতাম।”
“কিহ! দ্য গ্রেট তাসানের এত্তোবড়ো ইনসাল্ট! এই তানু,খবরদার! তুই যদি আমার বোইন হইয়া থাকোস তাইলে এই ফাতরা ডাক্তারের গলায় মালা পড়াবিনা। দেখা গেল শেষে ভুল ঔষধ খাওয়াইয়া মানুষ থেকে ছাগল বানায় দিলো তখন! কেমন লাগবো যখন ম্যা-ম্যা কইরা ডাকবি।”
অপরাহ্ন তানহার দিকে নজর রেখে বলল,
“ছাগল হোক আর যাই হোক থাকবে এই অপরাহ্নেরই। তাই তোর এই গাধার মতো মুখ বের করে ঢ্যাচু ঢ্যাচু করা বন্ধ কর।যা গিয়ে কমোডে ডুব দিয়ে মর।”
তানি এগিয়ে এসে অপরাহ্নের উদ্দেশ্যে বলল,
“আরে অপু বাবা কেমন আছো?”
অপরাহ্ন সৌজন্যমূলক হেঁসে বলল,
“ভালো আন্টি৷ আসলে আগামীকাল আমি রাজশাহী যাচ্ছি। ওখানে ডক্টরস বার্ষিক সম্মেলনে ইনভাইট করেছে আমাকে। তাই আপনাদের কাছ থেকে দোয়া নিতে এলাম।”
“ও আচ্ছা সে’তো অনেক ভালো কথা। তুমি বোসো। আমি চা করে আনছি তোমাদের জন্য।”
তানি যেতেই তাসান বিড়বিড় করে বলল,
“দোয়া না ছোঁয়া নিতে এসেছিস তা’কি আমরা বুঝি না! বোন বলে আজ বলতেও পারছিনা কিছু।”

আদ্রিতা এদের কথার মাঝে আর এলোনা। সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠে গেল। হঠাৎ এই হৈচৈ পার্টির আগমনে একটু চিন্তা হতে লাগল তার। এতো মানুষের ভীড়ে সে সারপ্রাইজ দিবে কিভাবে? আবার ভবলো নিবিড় এমনিতেও অনেক রাত করে ফেরে। ততক্ষণেতো নিশ্চয় সবাই ঘুমিয়ে পড়বে। তাই সমস্যা হবে না। এই ভেবে রুমে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো আদ্রিতা। শাওয়ার নিয়ে বের হলো তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঝাড়তে নিলেই হঠাৎ নিচ থেকে তাসানের বলা কথা কানে আসতেই হাত থেমে গেল তার। সে’কি ঠিক শুনল! হ্যাঁ, ওইতো তাসান ভাইয়া বলল,”আরে নিবিড় ভাই তুই এসে গেছিস! আয় ভাই আয়। তুইই একটা কিছু কর এবার।” তারমানে উনি এসে গেছে! এত আগেই এলো! আদ্রিতা হাতের তোয়ালে রেখে দ্রুত পা চালিয়ে দরজার বাইরে এলো। করিডরের রেলিঙের কাছে এসে নিচে উঁকি দিতেই কাঙ্খিত ব্যক্তি দৃষ্টির সীমানায় এলো আদ্রিতার। হ্যাঁ নিবিড় এসেছে। ওইতো নিচে। আদ্রিতার মনটা আচমকা কেমন হু হু করে উঠল। আজ কতদিন হলো সে তার প্রাণপ্রিয় পুরুষটাকে দু-দন্ড ভালো করে মন ভরে দেখতেই পারে ন। মন প্রচন্ড ব্যাকুল হয়েছে তার দূরত্বে। ব্যাকুল মনোভাবেই আদ্রিতা দ্রুত পা চালিয়ে সিঁড়ির ধাপ পার করে নিচে নেমে এলো। তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে রইল সে নিবিড়ের পানে। নিবিড় দরজার সামনে জুতো খুলে সু-র‍্যাকে রাখছে তখন। রাখা শেষে মাথা তুলে সামনে তাকিয়ে এগুতে নিলেই আদ্রিতার অধীর মুখটাতে নজর পড়ল তার। সে আদ্রিতার দিকেই যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। কিন্তু পথে বাঁধা হয়ে এলো তাসান৷ তাসান নিবিড়ের হাত টেনে ওদের মাঝে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“আরে কোথায় যাচ্ছিস ভাই! আগে এদিকে আয়। আজতো একটা বিহিত করে দিবি আমার। নাহলে আমার যৌবনে মাছি পড়া শুরু করে দিবে।”
সোফায় বসে থাকা অপরাহ্ন বলল,
“তাও গু ওয়ালা মাছি।”
“দেখলিতো ভাই! কিভাবে এই ফাতরা ডাক্তার আমার মজা নেয়! আমারতো উকুনের ডিম পরিমাণও ইজ্জত নাই। আজ এর একটা বিচার তুই করবি ভাই।”
নিবিড় একবার তাকালো আদ্রিতার পানে। তারপর তাসানদের উদ্দেশ্যে বলল,
“আচ্ছা হবে সব বিচার। তোরা বস আমি আগে ফ্রেশ হয়ে আসি।”
বলেই নিবিড় ওদের মাঝ থেকে সরে আসতে চাইলে তাসান ওকে জোর করে সোফায় বসিয়ে বলল,
“আরে এমনিতেই অনেক ফ্রেশ আছো তুমি। বউয়ের আঁচলের তলে যাওয়ার ধান্ধা ছাইড়া একটু দুঃখীয়ারি ভাই-ব্রাদারের কথাও ভাবো বুঝলা! দিনদিন পুরাই স্বার্থপর বনে যাইতাছো।”
নিবিড় গরম চোখে তাকিয়ে বলল,
“মার মনে হয় অনেকদিন মিস করছে তোর পিঠ!”
তাসান এবার মেলোড্রামা করে বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ মারবাইতো! এখন কি আর আমি কিছু হই তোমার!”
নিবিড় গোপন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তাকালো আবারও আদ্রিতার পানে। বুকটা খা খা করছে তার। কোথায় ভেবেছিল আজ কাজ জলদি শেষ করে আগে আগে বাসায় এসে আদ্রিতাকে একটু সময় দিবে। তাদের মাঝে বিগত দিনের এই দূরত্ব অসহনীয় পর্যায়ে হয়ে উঠেছে নিবিড়ের জন্য। আজ কতদিন হয়ে গেল পুতুলটাকে মন ভরে দেখেনা, আদর করেনা সে। তাকে কোলে বসিয়ে তার কথার ফুলঝুরি শোনে না। তার ছোটো ছোটো বায়না পুরনে ব্যাস্ত রাখেনা নিজেকে। উপর থেকে নিজেকে শক্ত দেখালেও ভেতর থেকে যে সে এই দূরত্বে ভালো নেই তা খুব করে উপলব্ধি করছে সে। আজতো তাই এই দূরত্বের গ্লানি দূর করতে এতো আগে আগে এসেছে সে। কিন্তু এই দল-বল যে এসে হাজির হবে তা কে জানতো। দূরে দাঁড়ানো আদ্রিতারও মনোভাবও ভিন্ন না। তারও মন চাইছে এই মুহুর্তে ছুটে গিয়ে তার স্বামীর বুকটার মাঝে জায়গা করে নিতে। কিন্তু সবার জন্য তার কাছে যেতে পারছেনা সে। হঠাৎ কেমন যেন কান্না পাচ্ছে তার। আদ্রিতা আর দাঁড়াল না৷ উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে পা ফেলে উপরের দিকে চলে গেল সে। যেতে-যেতে চোখের পানি সন্তর্পণে লুকিয়ে ফেলল সে। তবে তা নিবিড়ের দৃষ্টিগোচর হলোনা। সে উঠে যাবে ভাবতেই সানভি এবার নিবিড়ের কাছ ঘেঁষে বলল,
“ভাইয়া দেখো আমি ঢাকা বিভাগের বিউটি কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়েছি। এবার ন্যাশনালে চাঞ্চ পাবো আমি।”
নিবিড় আবারও যেতে পারলোনা। সানভির উদ্দেশ্যে জোরপূর্বক হেঁসে বলল,
“বাহ! ভালোতো। আটা-ময়দাগুলো অবশেষে কাজেতো এলো।”
নিবিড়ের কথায় হাসলো সবাই। তবে নিবিড়ের ব্যাকুল মন শান্তি পাবে কেবলই তার প্রিয়তমা স্ত্রীর সংস্পর্শে। যা আজ তার জন্য সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। ভাই-বোনের দল তাকে ছাড়ার নাম নেই।

রাত তখন ৯ টা প্রায়। অনেক কষ্টে হৈচৈ পার্টির কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করে অবশেষে নিজের রুমে আসতে সক্ষম হলো নিবিড়। কিন্তু রুমে এসে আদ্রিতাকে কোথাও না দেখে মেজাজটা হঠাৎ বিগড়ে গেল তার। এই মেয়েটা শুধরালো না কিছুতেই। আমি এখানে মরছি তাকে দেখার জন্য, কাছে পাবার জন্য। আর ম্যাডাম নাজানি কোন বাগিচায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। রুক্ষ মেজাজেই ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এলো নিবিড়। ওয়াশরুম থেকে ফের রুমে এসেও আদ্রিতাকে দেখলোনা সে। অগত্যা আবার বাইরে এলো সে। ততক্ষণে রাতের খাবারের জন্য বসে পড়েছে সবাই। নিবিড় এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে’ও গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলো। তানি খাবার সার্ভ করছে। এখানেও আদ্রিতা নেই। তানিকে জিজ্ঞেস করতে নিয়েও করলোনা। এখানে সবগুলো বদের হাড্ডি বসে আছে। এদের সামনে আদ্রিতার কথা জিজ্ঞেস করলে সবগুলো মজা নিতে শুরু করবে। তাই চুপ রইল সে। আদ্রিতাকে না দেখে নিবিড়ের এবার সত্যি সত্যি মেজাজ খারাপ হচ্ছে। মেয়েটাকে সামনে পেলে তুলে একটা আছাড় মারবে আগে। কোথায় ভেবেছিল আজ একসাথে খাবার খাবে। কিন্তু কোন জায়গায় গুম হয়ে আছে কে জানে! নিবিড়কে জ্বালানো যেন মেয়েটার ফেবারিট কাজ। নিবিড়ের মন চাচ্ছে এখান থেকে এখুনি উঠে যেতে। কিন্তু এতেও সবগুলো ওর উপর প্রশ্নের তীর ছুঁড়ে বিরক্ত করে ফেলবে। এতে নিবিড়ের রাগ আরও বাড়বে। শুধু সবার উপর রাগ দেখাতে চায়না নিবিড়। সবার হাসিখুশি মনোভাবটা ওরজন্য নষ্ট করতে চায়না সে। তাই চুপচাপ অল্প করে কিছু খেয়ে উঠে গেল সে। বাকিরাও খাওয়া শেষে সোফায় বসে আড্ডা দিতে লাগল।

আদ্রিতা ছাঁদে সারপ্রাইজ তৈরির পরবর্তী কাজ শেষ করছিলো। রাত প্রায় দশটা তখন। আদ্রিতা ভাবলো এখন সারপ্রাইজ দেওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু নিবিড়কে ডাকবে কিভাবে। আদ্রিতা কিছু একটা ভেবে ছাঁদের দরজার বাইরে করিডোরে এলো। তখনই তিন্নিকে খেলা করতে দেখলো সে। আদ্রিতা খুশি হয়ে তিন্নিকে কাছে ডাকলো। একটা চকলেট ধরিয়ে দিয়ে বলল,”তুমি তোমার টম চাচ্চুকে গিয়ে বলো অরি ফুপি ছাঁদে যেতে বলেছে তাকে।” তিন্নি মাথা ঝাকিয়ে দৌড়ে চলে গেল তার কাজে। আদ্রিতাও উত্তেজিত মনে ছাঁদে এসে সব লাইটের সুইচ বন্ধ করে দিলো। অপেক্ষা করতে লাগল নিবিড়ের আগমনের। মিনিট পাঁচেক পর ছাদের দরজা খোলার শব্দ পেল আদ্রিতা। খুশি হয়ে গেল সে। ঝট করে আবারও সুইচ টিপ দিয়ে চারিদিক আলোকিত করে দিলো। তারপর পেছনে ঘুরতে-ঘুরতে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল, “সার…..”
কিন্তু পিছে ফিরতেই তব্দা খেয়ে গেল আদ্রিতা। “সারপ্রাইজ” শব্দের “সার”টুকু উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললেও পরের “প্রাইজ”টুকু মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলতে-বলতে নিভে গেল যেন। উচ্ছ্বসিত মুখখানা হতভম্বের মতো স্থির হয়ে গেল। সে’তো নিবিড়কে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য তাকে ডাকতে পাঠিয়েছিল। কিন্তু এখানে পুরো জনগোষ্ঠী কিভাবে এসে হাজির হলো! আদ্রিতার সামনে এখন তাসান,সানভি,অপরাহ্ন আর তানহা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখেমুখেও বিস্ময়। দুই পক্ষই হা হয়ে তাকিয়ে আছে।ছাঁদে এতো সুন্দর করে সাজিয়ে আদ্রিতা কি করতে চাচ্ছে তাই বুঝতে ব্যস্ত তারা। এরমাঝে মৌনতা ভঙ্গ করে তানহা বলে উঠল,
” সারপ্রাইজ! কিসের সারপ্রাইজ! আর কারজন্য?”
আদ্রিতা বেচারি চরম পর্যায়ে থতমত খেয়ে গেল। কি বলবে এখন সে! তিন্নিটা যে এভাবে সবাইকে ডেকে আনবে তা’কি জানতো সে! এখন এদের সামনে কিভাবে বলবে যে আদ্রিতা তার বরের জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে! সবার সামনে লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হবে ওকে। আদ্রিতা আমতা-আমতা করে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই তাসান মাঝখান থেকে এগিয়ে এসে প্রসন্নচিত্তে বলে উঠল,
“বুঝতে পেরেছি, আমি সব বুঝতে পেরেছি। অরি! আমার কইলজার বোইন! এই সারপ্রাইজ আমার জন্য রাখছোস তুই তাইনা! আমাকে দুঃখের টাইটানিক সাগরে ডুবতে দেখে তোর মন কাঁদছিল। তাই আমাকে খুশি করার জন্য এই সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছিস তুই তাইনা! আয় বোন বুকে আয়। তুইই আমার সত্যিকারের বোন।”
বলতে-বলতে তাসান গিয়ে আদ্রিতাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে আবেগে আপ্লূত যেন। আদ্রিতা বেচারি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। তাসানের মন রাখতে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল সে। তখনই সানভি বলে উঠল,
“আরে ধুর, তোমার জন্য কেন হতে যাবে। অরি নিশ্চয় এটা আমার জন্য করেছে তাইনারে! আমি বিউটি কম্পিটিশন জিতেছি সেই খুশিতে সারপ্রাইজ পার্টি প্ল্যান করেছিস তাইনা! অওওওওও! হাউ সুইট ইয়ার!”
বলতে-বলতে সানভিও গিয়ে আদ্রিতাকে জড়িয়ে ধরে আবেগ প্রকাশ করল। আদ্রিতা পরপর ভ্যাবাচেকা খেতে-খেতে ক্লান্তই হয়ে গেল যেন। তাসান তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“কি একটা আটা ময়দার দোকান জিতছস তার আবার পার্টি! যা ফুট! দূরে গিয়ে মর। এটা আমার জন্য বুঝছস।”
“তুমি যাও। এটা আমার জন্য।”
দুই ভাই-বোনের ঝগড়া দেখে হঠাৎ আদ্রিতা বলে উঠল,
“আরে থামো থামো ঝগড়া করতে হবে না। আ….আসলে এটা সবার জন্যই করেছি৷ অনেকদিন হলো সবাই একসাথে মজা করা হয়না। তাই সবার জন্যই এই সারপ্রাইজ।”
বলেই জোরপূর্বক মলিন হাসলো আদ্রিতা। সবাই আদ্রিতার কথাই মেনে নিলো অগত্যা। খুশিমনে পার্টির মজা নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এতক্ষণ পর ছাদে আগমন ঘটলো সেই ব্যক্তির যারজন্য এই আয়োজন। নিবিড় ওর স্টাডি রুমে ছিলো এতক্ষণ। রুমে ফিরতে নিলে ছাঁদ থেকে সবার কথার শব্দ শুনতে পেয়ে এগিয়ে আসে সে। কিন্তু ছাঁদে এমন এলাহি আয়োজন দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো সহসাই। গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কি হচ্ছে এখানে? ”
নিবিড়ের কন্ঠ শুনে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ হয় তার দিকে৷ তাসান উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
“আরে ব্রো এসেছ তুমি! আরে আসো আসো, দেখো অরি আমাদের সবার জন্য সারপ্রাইজ পার্টি এরেঞ্জ করেছে৷ কত্তো সুইট আমার বোইন! তোমার সাত জনমের ভাগ্য করে এমন একটা বউ পেয়েছ। ”
নিবিড় তাকালো আদ্রিতার মুখপানে। সত্যিই কি একটা বউ পেয়েছে সে! মানে এখানে তার স্বামী বউয়ের জন্য হাহাকার করছে আর বউ সাহেবা ভাই-বোন নিয়ে পার্টি করতে ব্যস্ত। সত্যিই গ্রেট তার বউ। তাসান নিবিড়কে টেনে নিয়ে এলো পার্টির মাঝে। আদ্রিতা একপাশে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কি করতে চেয়েছিল আর কি হয়ে গেল! মনটাই খারাপ হয়ে গেল তার। এরমাঝেই হঠাৎ খেয়াল করলো তাসান ছাঁদের চিলেকোঠা ঘরটার ওপর পাশে যাচ্ছে। তা দেখে আদ্রিতা সহসা আৎকে উঠে উচ্চস্বরে বলল ,
“না…. দাঁড়াও ভাইয়া।”
বেচারা তাসান চমকেই গেল। বুকে হাত দিয়ে আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
“কি হইছে অরি? এমনে কেউ ভয় দেখায়! অহনি আমার আত্মা লাফাই বাড়াইয়া আসতো।”
আদ্রিতা থতমত গলায় বলল,
“আ…আসলে ওপাশে অনেক ভাঙাচুরা পরিত্যক্ত ফার্নিচার রাখা আছেতো৷ তোমার লেগে যাবে। তাই ওদিকে যেওনা কেউ।”
তাসান এবার মাত্রাতিরিক্ত নেকামি ভাব করে বলল,
“হায়! আমার কইলজার বোইন! কতো চিন্তা করে আমার। আমারতো চোখে পদ্মা,মেঘনা নেমে আসছে এখন।”
এদের আড্ডার মাঝে নিবিড় বলে উঠল,
“তোরা মজা কর। আমার মাথা ব্যাথা করছে। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। একটু আরাম করবো।”
বলেই নিবিড় জায়গা ত্যাগ করলো। তবে আদ্রিতা ঠিকই বুঝতে পারল নিবিড় তার উপর রাগ করেই এখান থেকে চলে গেল। রাগবেইতো।রাগার মতো কাজই যে করেছে তার বউ। ভীষণ কান্না পাচ্ছে এবার আদ্রিতার৷ একটা কাজও তার দ্বারা ঠিকমতো হয়না। কোনো কাজেরই না সে। নিবিড় ভাইয়া ঠিকই বলে, আমি আসলেই একটা বলদি। গুড ফর নাথিং।

কিছুক্ষণ পর অপরাহ্ন সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“ওকে গাইস,এখন যেতে হবে আমাকে। ভোরে রওয়ানা হতে হবে। তাই সকাল সকাল ঘুমুতে হবে। বায় এভরিওয়ান।”
কথা শেষ করে অপরাহ্ন যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। যেতে যেতে চোখের ইশারায় তানহাকেও নিচে আসতে বোঝালো সে। অপরাহ্ন যেতেই তানহাও তাই কোনো এক উছিলা দিয়ে নেমে এলো নিচে। বাইরে এসে দেখলো অপরাহ্ন পুল সাইডে দাঁড়িয়ে আছে ওরজন্য। তানহা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল তার সামনে। মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে সে। অপরাহ্ন বলল,
“মাথা তোলো তানু।”
তবুও যেন তানহা মাথা তুলতে পারতে অক্ষম। অপরাহ্ন এবার নিজের দুই হাতে তানহার মুখটা ধরে উঁচু করে ধরল মুখোমুখি করে। তারপর বলল,
“কখনো আমার সামনে মাথা নিচু করে থাকবা না। আমার এটা একদম পছন্দ না। সবসময় আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলবা। আমি চাই আমার অর্ধাঙ্গিনী আমার বরাবরই হয়ে থাকুক সবসময়। কখনো নতো হয়ে থাকবা না আমার সামনে। সবসময় আত্মবিশ্বাসের সহিত কথা বলবা। মনে রাখবা তুমি আমার সহধর্মিণী। আর সহধর্মিণী সবসময় সাথে চলে, পিছে না। বুঝতে পেরেছ!”
তানহা স্থীর নজরে এবার তাকালো অপরাহ্নের পানে। নিজেকে কেমন সৌভাগ্যবতী মনে হচ্ছে তার। লোকটাকে যতো কাছ থেকে জানছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে সে। তনু মনে অসীম ভালো লাগার রঙিন বর্ষণ হচ্ছে যেন। যার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ তানহার চোখের কোণ চিকচিক করে উঠল। অপরাহ্ন মুখটা এগিয়ে তানহার কপালে পরম আদরে অধর ছোঁয়াল। আবেশে চোখ বুঁজে নিলো তানহা। চোখ বুঁজতেই কোণ বেয়ে সুক্ষ্ম এক ফোটা জল টুপ করে গড়িয়ে পড়ল। অপরাহ্ন অধর এটে সেভাবেই রইল কিছুসময়। সময় নিয়ে তারপর মুখ তুলল সে। তানহার চোখে চোখ রেখে বলল,
“আসি।”
তানহা মুচকি হাসি উপহার দিয়ে বলল,
“সাবধানে যাবেন। আর নিজের খেয়াল রাখবেন।”
“তুমি বলেছ এখন কি না রেখে পারি! জলদিই ফিরবো তোমার কাছে। আসি।”
তানহাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল অপরাহ্ন। তানহা তাকিয়ে রইল তার যাওয়ার পানে। অপরাহ্ন যেতেই সে’ও বাসার ভেতর চলে গেল। অন্যদিকে সানভিও নিজের বিউটি স্লিপ নিতে পার্টি ত্যাগ করলো৷ সবাই চলে যাওয়ায় তাসানও বোর হয়ে কিছুক্ষণ পর নেমে গেল। সবাই যেতেই এতক্ষণ ধরে আঁটকে রাখা কান্নাটা হু হু করে বেড়িয়ে এলো আদ্রিতার।

চোখ খুলে মোবাইলটা চোখের সামনে ধরল নিবিড়। সময় ১২-০৩ দেখতেই কপাল কুঁচকে ঝট করে উঠে বসলো নিবিড়। আশেপাশে রুমে আদ্রিতার অবস্থান না পেয়ে এবার চরম পর্যায়ে রাগ হলো তার৷ তখন সত্যিই অনেক মাথা ব্যাথা করছিলো বলে একটা পেইন কিলার খেয়ে একটু শুয়েছিল সে। কখন চোখ লেগে গেছে টের পায়নি৷ কিন্তু এত সময় হয়ে গেছে তবুও আদ্রিতাকে রুমে না দেখে মাথা আবার গরম হয়ে গেল যেন তার। এতক্ষণ ধরে পার্টি করছে সে! আমার কথা বেমালুম ভুলে গেছে বলদিটা।তখন দেখলো আমি মাথা ব্যাথার কথা বললাম। তারপরও রুমে না এসে মজা করছে! কত্তবড় বদ! ওর পার্টিতো আমি ছুটাচ্ছি এখুনি। চোয়াল শক্ত করে ঝট করে বিছানা থেকে নামল নিবিড়। দ্রুত পায়ে ছাঁদে এসে দেখলো ছাঁদে কেউ নেই। সামনে এগিয়ে এদিক-ওদিক নজর বোলাতেই দেখতে পেল আদ্রিতা এক কোণায় উল্টো দিকে ঘুরে হাঁটুর ভেতর মুখ গুঁজে বসে আছে। এভাবে একা একা বসে থাকা দেখে যেন রাগ আরও বেড়ে গেল নিবিড়ের। সে এগিয়ে যেতে-যেতে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগল,
“আজতো ছাঁদ থেকে ছুঁড়ে মারা হান্ড্রেড পার্সেন্ট পাক্কা হয়ে গেছে তোর জন্য। সাহস অনেক বেশি বেড়ে গেছে তোর! বলদির মতো এখানে একা একা বসে কি তোর ভূত-পেত্নী বন্ধুদের সাথে পার্টি করতে বসে আছিস?”
আদ্রিতা ফিরে তাকালোনা তবুও। নিবিড় আদ্রিতার কাছে এসে ওর দিকে ঝুঁকতে-ঝুঁকতে বলল,
“কথা বলছি….”
এতটুকু বলতেই হঠাৎ থমকে গেল নিবিড়। যখন বুঝতে পারল আদ্রিতা কাঁদছে। কাঁধে হাত দিতেই টের পেল আদ্রিতা ফোঁপাচ্ছে। নিবিড়ের মনোভাব তৎক্ষনাৎ পরিবর্তিত হলো। ক্ষোভের স্থান নিলো এক আকাশ চিন্তার কালো ছায়া। দ্রুত বেগে আদ্রিতার পাশে বসলো নিবিড় । দুই হাত বাড়িয়ে হাঁটুর মাঝ থেকে আদ্রিতার ক্রন্দনরত মুখখানা তুলে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে ধরল সে। কেঁদে কেটে লাল হয়ে গেছে আদ্রিতার মুখখানা। নিবিড় উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“হেই পুতুল সোনা! কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে তোকে? বল আমাকে।”
আদ্রিতা অশ্রুসিক্ত করুন চোখে তাকালো নিবিড়ের পানে। ঠোঁট উল্টিয়ে কান্না জড়িত করুন সুরে বলল,
“আপনি ঠিকই বলেন। আমি আসলেই একটা বলদি। আমার দ্বারা কোনো কাজ ঠিকমতো হয়না। আম গুড ফর নাথিং,ইডিয়ট, স্টুপিট!”
“হুঁশ,হুঁশ! আগে বল হয়েছেটা কি? আর এসব আবোলতাবোল বলছিস কেন?”
আদ্রিতা হাতের তালুতে নাক ডলে বলল,
“হ্যাঁ ঠিকই বলেছি। আমার দ্বারা কোনো কাজ ঠিকমতো হয়না। দেখুন না আজ ভেবেছিলাম আপনাকে সারপ্রাইজ দিবো৷ এজন্য এতকিছু করলাম৷ কিন্তু সব উল্টো পাল্টা হয়ে গেল। আপনার জায়গায় ওরা এসে গেল। আর পার্টি ওদের নামে করতে হলো।”
ভ্রু কুঁচকে আসলো নিবিড়ের। সে হতবাক দৃষ্টিতে একবার চারপাশের আয়োজন দেখলো। যা এখন অনেকটায় অগোছালো ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। তারপর আবার আদ্রিতার দিকে তাকালো। কৌতুহলী গলায় বলল,
“এক মিনিট, তুই এসব আমার জন্য করেছিলি?”
আদ্রিতা কান্না মাখা মুখে মাথা উপর-নিচ করে হ্যাঁ বোঝালো। নিবিড় কতক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আদ্রিতার পানে। তার পরপরই হঠাৎ হো হো শরীর কাঁপিয়ে হেঁসে উঠল সে। হাসতে হাসতে আদ্রিতার কপালে মাথা ঠেকিয়ে ফেলল সে। আদ্রিতার তা দেখে ভীষণ অভিমান হলো। ভাবলো নিবিড়ও তাকে তিরস্কার করছে। সে নিবিড়কে ছাড়িয়ে উঠে চলে যেতে চাইলো। কিন্তু যেতে দিলোনা নিবিড়। হাত ধরে টান মেরে তাকে নিজের কোলের মাঝে বসালো। আদ্রিতা অভিমানে আবারও কাঁদতে লাগল। নিবিড় তার হাতের বাঁধনে শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরল আদ্রিতার কোমড়। অন্য হাতে আদ্রিতার চোখ মুছে দিলো বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্যে। নিবিড়ের সংস্পর্শে আদুরে আদ্রিতার চোখের নোনাজল আরও বেগ পেল যেন৷ করুন সুরে বলল,
“আমি খুব অপদার্থ বউ তাইনা?”
নিবিড় মুচকি হেঁসে বলল,
“হ্যাঁ তা যা বলেছিস! অপদার্থতো এক নাম্বারের তুই। অপদার্থের সেরা পুরস্কারটা তোকেই যায়।”
আহত হলো আদ্রিতার মন। নিবিড় কি তাহলে সত্যিই তাকে অযোগ্য ভাবে? টলমটলে আহত চোখে তাকালো আদ্রিতা। নিবিড় তখন আদ্রিতার কান্নায় লাল হয়ে যাওয়া নাকের ডগায় আলতো কামড় বসিয়ে দিলো। তারপর বলল,
“অপদার্থ নয়তো কি! এই সামান্য কারণে ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কাঁদতে বসা কি বুদ্ধিমানের কাজ!”
“তো কি করবো? আপনিওতো রাগ করে চলে গেলেন আমি কি বুঝিনি!”
“কচু বুঝেছিস। আমার তখন সত্যিই মাথা ব্যাথা করছিলো এইজন্য গিয়েছিলাম। হ্যাঁ আমি তোকে আজ শুধু নিজের জন্য চেয়েছিলাম। তাই বলে কি তোকে ভাই-বোনের সাথে আনন্দ করতে দেখে নারাজ হবো আমি! তবে এত রাত পর্যন্ত রুমে না দেখে সত্যিই রাগ হয়েছিল আমার। আর এখানে তোকে একা বসে থাকতে দেখেতো মাথাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল আমার। তোর সাহস কি করে হলো এত রাতে এখানে একা একা বসে থাকার?”
আদ্রিতা মুখ গোমড়া করে বলল,
“তো কি করবো! আমি এতো আশা করে সব করেছিলাম সব ভেস্তে গেল।”
নিবিড় আদ্রিতার নাকের ডগায় চুমু খেল।নাকে নাক ঠেকিয়ে হাতের চার আঙুল আদ্রিতার কানের নিচে আর বৃদ্ধাঙ্গুল গালে বুলিয়ে ভাবপ্রবণ গলায় বলল,
“কে বলল ভেস্তে গেছে! আমি আছি, তুই আছিস আর এই সজ্জাও আছে। তাহলে আর কি লাগে। জানিস আজ শুধু আমার পুতুলটার জন্য আমি তাড়াহুড়ো করে সবকাজ শেষ করে এসেছি। নাহয় একটু দেরিতে হয়েছে। তাতে কি হয়েছে। তুই কাছে থাকলে আমার প্রত্যেক মুহূর্তই স্পেশাল আর সারপ্রাইজিং।”
আবেগপ্রবণ হয়ে দু’হাতে নিবিড়ের গলা জড়িয়ে তাকে জাপ্টে ধরল। নিবিড়ও দুই হাতের বাঁধনে পিষে ফেলল বউটাকে তার বুকের মাঝে। আদ্রিতা নিবিড়ের কানের নিচে গলায় চুমু খেলো পরপর কয়েকটা। কানে ঠোঁট লাগিয়ে আবেগী কন্ঠে বলল,
“অনেক মিস করেছি আমি আপনাকে। অনেক, অনেক, অনেক।”
নিবিড় চোখ বুঁজে আদ্রিতার চুলে নাক ডুবিয়ে বলল,
“আমার পুতুল সোনার থেকে দূরে থেকে যে আমিও ভালো ছিলাম না। নিজেকে যেন হারানো পথিক মনে হচ্ছিল। আজ তোর আলিঙ্গনে নিজেকে যেন আবার সজীব মনে হচ্ছে।”
নিবিড়ের কানে চুমু খেয়ে আদ্রিতা বলল,
“আজ অনেক ভালোবাসুন আমাকে। এতদিনে এতদিনের শূন্যতা ঘুচিয়ে দিন আপনার ভালোবাসার চাদরে।”
“বাসবো। আজ আমার পুতুল সোনাকে ভালোবাসায় মুড়িয়ে নিবো। লুকিয়ে ফেলবো পৃথিবী থেকে।”
নিবিড় আদ্রিতার গলা, কাঁধে অধর ছুঁইয়ে দিলো সুগভীর ভাবে। আদ্রিতা আস্তে করে মাথা তুলে তাকালো নিবিড়ের চোখে। নাকে নাক ঠেকে আছে দুজনের। নিবিড় এগুতে নিলো আদ্রিতার অধরপানে। তখনই আদ্রিতা তার তর্জনী আঙুল ঠেকালো নিবিড়ের অগ্রসর হওয়া অধর জোড়ায়। নিজের কাজে বাঁধা পাওয়ায় আদ্রিতার চোখের দিকে ভ্রু জোড়া নাচিয়ে ইশারায় বুঝালো আদ্রিতা কেন তাকে আটকালো। আদ্রিতা কিছু বলল না। আবেদনময়ী হাসি দিয়ে নিবিড়ের কোল থেকে উঠে দাঁড়াল সে৷ উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলো বসে থাকা নিবিড়ের দিকে৷ নিবিড় একবার আদ্রিতার মুখের দিকে আবার তার বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে তাকালো। বোঝার চেষ্টা করছে আদ্রিতার মনোভাব। নিবিড় কিছু না বলে আপাতত আদ্রিতার হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। আদ্রিতা নিবিড়ের হাত ধরে আগে আগে হাটলো। নিবিড় সুবোধ বালকের মতো তার সাথে সাথে যাচ্ছে। যেতে-যেতে একসময় আদ্রিতা নিবিড়কে ছাঁদের পেছন সাইডে নিয়ে এলো। সেখানে এসে নিবিড়ের নজর চমকপ্রদ হয়ে গেল। সে দেখতে পেল সামনেই সাদা পর্দায় ঘেরা বর্গাকৃতির একটা তাবুর মতো সাজানো হয়েছে। তার মাঝে গদির বিছানা করা। দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। নিবিড় অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখলো অপূর্ব আয়োজনটা। আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে বিস্ময় ভরা কন্ঠে বলল,
“এটা তুই করেছিস? তো এইজন্য তখন কাউকে এদিকে আসতে দিচ্ছিলি না?”
আদ্রিতা নিবিড়ের দিকে ঘুরে দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে আবেদনীয় হেঁসে বলল,
“হ্যাঁ, আমার হট এন্ড হ্যান্ডসাম বরটার জন্য।”
নিবিড় বাঁকা হেঁসে আদ্রিতার কোমড় পেঁচিয়ে নিজের সাথে চেপে ধরে বলল,
“বাহ! আমার বউটাতো দেখছি অনেক রোমান্টিক হয়ে গেছে! বড়ো হয়ে যাচ্ছিস।”
বলেই নিবিড় আদ্রিতাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে এগিয়ে গেল তাবুর মাঝে। গদির উপর এনে বসিয়ে দিলো তাকে৷ তখনকার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে অগ্রসর হলো। করল ঠোঁটের কোলাজ। সুধাপানের নেশায় ডুব দিলো ভালোবাসার আগ্রাসী মানব যুগল। ঠোঁটের চুম্বনলীলা জারি রেখে আদ্রিতা হাত বাড়িয়ে ধীরে ধীরে নিবিড়ের শার্টের বোতামগুলো একে-একে খুলে কাঁধ থেকে পেছনের দিকে নামিয়ে দিলো। বাকিটুকু নিবিড় নিজ দায়িত্বে খুলে ছুঁড়ে মারল দূরে। আদ্রিতার অধর এবার ছুঁয়ে চলল নিবিড় গলা থেকে বুক জুড়ে সর্বত্র। নিবিড়ও প্রতিদান স্বরুপ আদ্রিতার সারা অঙ্গে শিহরিত ভালোবাসার পুষ্প অর্পণ করল। বিগত দিনের দূরত্বের শূন্যতা পরিপূর্ণ করার হিসাব-নিকাশে ব্যাস্ত দুজন। ভারী নিঃশ্বাসের ধ্বনি ছড়াচ্ছে নিশির পারদে,পারদে। আকাশের চাঁদও যেন লাজে ঢেকে ফেলল নিজেকে মেঘের আড়ালে৷ নিশি রাত আর শীতল পবন সাক্ষী হলো তাদের সুখময় আবেশের মোহময় আবহের। যে আবহে ভেসে বেড়াচ্ছে কেবলই ভালোবাসা। যেন বলছে এই রাত তোমার-আমার, আমরা দুজন দুজনার।
____________________________

®মেহরুমা নূর

(আজকের মতো এতটুকুই। আবারও কোনোদিন মন চাইলে ওদের নিয়ে আসবো কখনো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here