প্রণয়ের_সুর #পর্ব৩ #মহুয়া_আমরিন_বিন্দু

0
23

#প্রণয়ের_সুর
#পর্ব৩
#মহুয়া_আমরিন_বিন্দু
গাড়ির গতি সর্বোচ্চ সীমায় রেখে ড্রাইব করছে নিখিল,দিক বেদিক ভুলে গেছে, উন্মা’দ প্রায়! উদভ্রান্তের ন্যায় ট্রাফিক রুলস ভঙ্গ করেছে সে,একটাই লক্ষ্য যত দ্রুত সম্ভব তাকে বাড়িতে পৌঁছাতে হবে।হৃদপিণ্ডের নিপীড়ন বন্ধ করতে হলেও তাকে যেতে হবে।আচমকা গাড়ির সামনে একটা বাচ্চা চলে আসে ব্রেক কষে নিখিল, ফলস্বরূপ তার মাথা গিয়ে লাগে স্টিয়ারিং এ। কপাল কে টে গড়িয়ে পড়ে লাল তরল তবুও আজ থামবে না সে,যে কোনো মূল্যে তাকে এখন নেহার কাছে যেতে হবে।

বাড়িতে পৌঁছাতে নিখিলের সময় লেগেছে আটাশ মিনিট এক ঘন্টার পথ সে পাড়ি দিয়েছে আধঘন্টার ও কম সময়ে।কালো রঙের শার্ট পরিহিত সুদর্শন যুবকটি কে আজ ভীষণ অন্য রকম লাগছে।ইন করা শার্টের এক পাশ খুলে পড়েছে,শার্টের হাতা উচু নিচু ভঙ্গিতে গোটানো, চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে কপালে, ঘামের সাথে সেঁটে আছে অবলীলায়, সরানোর কোনো তাড়া নেই আজ।শুভ্র মুখশ্রী তে ফুটে উঠেছে তীব্র উৎকন্ঠা,চিন্তার ছাপ।রাগের আভাস ছড়িয়েছে চোখে, টকটকে লাল আঁখিদ্বয়ে শুধুই রাগ নাকি আছে কোনো কিছু হারিয়ে ফেলার তীব্র ভয়?
কিছু মুহুর্তের ব্যাবধানে সব সময় পরিপাটি থাকা মানুষটি অগোছালো হয়ে গেছে।

সিঁড়ি বেয়ে ধুপধাপ পায়ে উপরে উঠে সে,ছুটে যায় কাঙ্ক্ষিত মানুষটির কাছে,ঘরের দরজা ভেজানো এসির বাতাসে অত্যাধিক ঠান্ডা হয়ে উঠেছে বদ্ধ রুমটি।টলমলে পায়ে ভিতরে ঢুকে নিখিল,নিজেকে এতোটা দুর্বল মনে হচ্ছে কেনো তার।বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী কঠোর ব্যক্তিত্বের মানুষদের তো দুর্বল হতে নেই।তবে কেনো নিখিল এই একটা মেয়ের কাছে নিজেকে এতোটা কমজোর অনুভব করে!

নেহার পরনে এখনো কলেজ ইউনিফর্ম, রক্তের দাগ শুকিয়ে খয়েরি বর্ণ ধারন করেছে।নিখিলের দৃষ্টি আটকায় খাটের পাশে ঝুলে থাকায় রক্তা’ক্ত হাতটির দিকে।মেয়েটা এতো ক্যা য়ারলেস কেনো?হাতের ক্ষ ত টি দূর থেকে ততটাও স্পষ্ট না।মেঝেতে রক্ত দেখে আঁতকে উঠে নিখিল।এক প্রকার ছুটে যায় সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ে নেহার ঘুমন্ত ফ্যাকাশের মুখের কাছে।
আলতো হাতে ছুঁয়ে দেয় রক্ত জবার ন্যায় ফুলেফেঁপে উঠা গাল।কাঁপা হাতে স্পর্শ করে নেহার কে টে যাওয়া হাতটি, যতোটা রাগ নিয়ে অফিস থেকে এসেছে তার ছিটেফোঁটা ও এখন নেই নিখিলের মাঝে, মায়াবী মোহনীয় নারীটি তা শুষে নিয়েছে পুরো দমে।নিখিল নিজ মনেই বলতে থাকে

,,কেনো নীহারিকা?কেনো তুই সব সময় আমার প্রতি রাগ দেখিয়ে আমারই ক্ষ’তি করিস?লাভ লোকসানের হিসাবে এতো কাঁচা কেনো তুই?আমার কলিজায় ছু*রি চালাতে একটুও হাত কাঁপে না তোর?

“এতো এতোটা নির্দয় কেনো তুই?নিখিলের প্রেয়সিকে এতোটা কঠোর মানায় না কেনো বুঝিস না তুই?”

“আমার এতো শত অভিযোগ, অভিমান, রাগ,অনুরাগ তো তোর প্রতি,কবে এসে শুনবি সব কিছু?সময়টা এতো ধীরে অগ্রসর হচ্ছে কেনো নীহারিকা? আমার হৃদয়ে ” প্রণয়ের সুর” তুলে তুই কেনো? কেনো এতোটা হেলাফেলা করছিস?আমার প্রেমিক হৃদয়কে দগ্ধ করে বুঝি অনেক সুখ পাস?
নিখিল থামলো পর পর ঠোঁট এলিয়ে হাসলো, উদাসীন কন্ঠে বললো
“তবে তোর সুখেই হোক আমার হৃদয়ের তীব্র বিরহের অসুখ”!
” তুই যে শুধু আমার,এই নিখিলের অবুঝ পাখি!”
,,,,,,,,,,,
দরজার আড়ালে দাড়িয়ে সব কিছু দেখেছে শুনেছে জেরিন আর সাব্বির দুজনের মুখ হা হয়ে গেছে পুরপুরি। কথা বলতে ভুলে গেছে মনে হয়,দুজনই চোখের পাতা ফেলছে ঘনঘন।
জেরিন মৃদু চেঁচিয়ে বললো

,,সাব্বির আমি যা শুনেছি দেখেছি তা কি তুই ও দেখেছিস?

সাব্বির জেরিনের মুখ চেপে ধরে বলে
,,এতো জোরে বলছিস কেনো?ভাইয়া যদি জানতে পারে যে তার প্রেমের রহস্য আমি আর তুই মিলে লুকিয়ে দেখেছি তো দুইজন কে ধরে বনবাসে পাঠিয়ে দিবে।

,, আরে ভাই আমরা কি ইচ্ছে করে দেখেছি নাকি,আমরা তো ভার্সিটি থেকে এসে ভালো মানুষের মতো রুমে যাচ্ছিলাম ওরা দরজা খুলে প্রেম করতে বসলে আমার কি দোষ?

পেছন থেকে বর্ষা বলে উঠলো
,,কার প্রেম করার কথা বলছো আপু?

জেরিনের মুখ আবার চেপে ধরে সাব্বির, এই মহিলা বয়সে বড় কিন্তু পেটে কোনো কথা থাকে না।
সাব্বির গর্ব করে বলে
,,কার আবার আমার তেইশ নাম্বার প্রেম!তাই না জেরিন আপু?
জেরিন জোরে জোরে দুইবার মাথা ঝাঁকায়
,,তোমার বয়স জানি কতো সাব্বির ভাইয়া?
সাব্বির উত্তর দেওয়ার আগেই নিখিলের গম্ভীর কন্ঠস্বর শোনা যায় ভেতর থেকে

,,এই দরজায় দাড়িয়ে কে কথা বলছিস?ভিতরে আয়!

তিনজনের হাওয়া যেনো একসাথে বের হয়েছে,নেতিয়ে পড়া বেলুনের মতো মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে একে অপরের।সুযোগ বুঝে জেরিন বৃষ্টিকে এক ঠেলা মেরে রুমের ভিতরে পাঠিয়ে দিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসে।

বৃষ্টি কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুঝায় মায়ের কাছে তোমার নামে যদি উল্টো পাল্টা কিছু না বলেছি তো আমার নাম বৃষ্টি না।জেরিন, সাব্বির বৃষ্টিকে ফাঁসিয়ে কেটে পড়েছে।

,,তুই দরজায় কি করছিলি বৃষ্টি?

,,না মানে ভাইয়া,,,নেহা কে দেখতে এসেছিলাম!

,, ওর হাত কা’টলো কিভাবে?
শান্ত কিন্তু অত্যাধিক কঠিন কন্ঠস্বর নিখিলের।

বৃষ্টি পর পর দুইবার ঢোক গিলে,অর্ধেক সত্যি অর্ধেক মিথ্যা মিলিয়ে একট গল্প বানিয়ে নেয় মনে মনে। বৃষ্টি ম্যাচিউর মেয়ে,এর আগেও নেহার জন্য এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে সে তবুও বান্ধবীকে কখনো একা ছাড়েনি।যেভাবেই হোক পরিবার কে বুঝিয়ে দিয়েছে কিছু একটা।এরকম উন্মা’দনায় ভরপুর বন্ধু যার কপালে আছে তার জীবনের অর্ধেক পাপ শুধু হবে মিথ্যা বলার কারনে।মনে মনে একবার আল্লাহ মাফ করো ও বলে নিয়েছে বৃষ্টি।

নিখিল আবার জিজ্ঞেস করলো

,,লিমার সাথে কি করেছিস তোরা, মেয়েটা অচেতন হলো কি করে?আর চাকরি থেকে রিজাইন কেনো করেছে!

বৃষ্টি অবাক হয় এবার ওরা তো মেয়েটাকে কিছু বলতেও পারেনি তার আগেই নিখিল চলে এসেছিলো তাহলে চাকরি ছাড়লো কেনো?

,,চাকরি কেনো ছেড়েছে তা তো জানি না ভাইয়া।ওই আমাদের কলেজে লিমা নামের আপুটার বোন পড়ে,তার নাম সীমা, আসলে ভাইয়া সীমা নেহার সাথে অনেক মিস বিহেভ করেছে,নেহা কে তো চিনোই রেগে গিয়েছিলো তাই লিমা আপুর কাছে বিচার দিবে বলে আমরা তাদের বাসার সামনে যাই আমরা যাওয়ার পরেই আপুটা হঠাৎ জ্ঞান হারায়,নেহা তাকে ধরে থাকার মাঝেই তো তুমি সেখানে এসেছিলে!আর,,,

বৃষ্টি একবার তাকালো নিখিলের দিকে,নিখিল খুব মনোযোগ দিয়ে বৃষ্টির কথা শুনছে,বৃষ্টি শুকনো ঢোক গিললো মনে মনে বললো আল্লাহ এবারের মতো বিশ্বাস যাতে করে এই শেষ বার মাবুদ!

,,পরে কি বলছিস না কেনো?
নিখিলের ধমক শুনে বৃষ্টি দ্রুত বললো

,,তার পরই তো তুমি না বুঝে নেহাকে ব কা দিয়েছো,নেহাকে উল্টো পাল্টা বলেছো সে নাকি লিমা আপুর সাথে কিছু একটা করেছে।পরেই তো তুমি লিমাকে নিয়ে চলে গেলে।নেহা কে বিশ্বাস না করে তুমি একটা অন্য মেয়েকে আগলে নিয়েছিলে ভাইয়া যা নেহার সহ্য হয়নি!
মিনমিন করে কথাটি বললো বৃষ্টি নিখিলের ভ্রুযুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো।

,,কলেজে ফিরে গিয়ে সীমাকে দেখে নেহার রাগ আবার বেড়েছে, জে*দের বসে রাগে নিজ হাতে কাঁচের টুকরো চেপে ধরেছিলো,,,,

,,ডাক্তার কে ফোন করতে বল মা কে!

,,নেহা,,,,ট্রিটমেন্ট করাবে না বলেছে যদি কেউ করতে চায় তো আবার নাকি হাত কা’টবে!

নিখিল রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে
,,তোকে যা করতে বলেছি তা কর।

বৃষ্টি ঝড়ের গতিতে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে।হামিদা বেগম দুপুরে কাজ করে শুয়ে পড়েছিলেন এসবের কিছুই তিনি জানেন না।রুমে ঢুকে ছেলের বেহাল দশা দেখে বুঝলেন গুরুতর কিছু একটা হয়েছে।
ছেলেকে নেহার হাত ধরে বসে থাকতে দেখে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না এখন।কিছুক্ষণের মধ্যেই তাহমিদা আসলেন রুমে,নেহাকে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে কেঁদে উঠলেন দুপুরে বকার মাঝে তিনি মেয়েকে খেয়ালই করেননি।তিনি কেঁদে কেঁদে বললেন

,,আপা আমার মেয়েটার কি হয়েছে কথা বলছে না কেনো?
নেহার মাথার কাছে গিয়ে মাথাটা নিজের কোলে তুলে মুখ হাত বুলিয়ে বললেন
,,কোথায় কষ্ট হচ্ছে মা?মাকে বল!

তাহমিদা বেগমের কান্না শুনে সাহারা আসলেন,জেরিন সাব্বির,রৌফ ছুটে এসেছে।
ইতিমধ্যে ডাক্তার আসলেন রুমে,পিটপিট করে চোখ খুললো নেহা,নিজের খাট ঘিরে সবাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো,সে তো ঘুমাচ্ছিলো সবাই এখানে কেনো?
সবাইকে ঠেলে ডাক্তার কে আসতে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকালো নেহা।নেহার কাছে দুনিয়ায় সবচেয়ে অপছন্দের জিনিসের মধ্যে একটা হলো ডাক্তার,ঔষধ, আর হসপিটাল।

নেহা সব কিছু ভুলে চিৎকার করে উঠলো

,,ডাক্তার কেনো এসেছে?কেনো এসেছে এখানে?উনাকে চলে যেতে বলো।আমার তো কিছু হয়নি আমি সুস্থ আছি।একজন সুস্থ মানুষকে ডাক্তার দেখাচ্ছো কেনো তোমরা?

নিখিল দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বললো

,,চুপ, একদম চুপ!হাত কে টে এসে এখন নাটক করছিস কেনো?চুপচাপ হাত বেন্ডেজ করতে দে বলছি।

নেহা চুপসে যায় মুহুর্তে মিন মিন করে বলে

,,প্লিজ উনাকে যেতে বলুন।আমার হাত তো কা’টেনি, ওই সামান্য কা’টার জন্য ডাক্তার লাগে না তো।
ডাক্তার এসে নেহার হাত ধরে বলে

,,নেহা মামনি কিভাবে হয়েছে এমনটা?হাতে তো কম হলেও তিনটা সেলাই করতে হবে।

নেহা এবার হু হু করে কেঁদে দিলো সচারাচর কাঁদে না নেহা মানুষের সামনে তো ভুলেও না।হাত পা ছুঁড়ে কাঁদা শুরু করে দিয়েছে এখন,তাহমিদা মেয়েকে বুঝাচ্ছেন কিন্তু কাজ হচ্ছে না।
নিখিল সবার দিকে তাকিয়ে বলে
,,সবাই রুম থেকে বের হও এখন,শুধু ডাক্তার আংকেল থাকবেন এখানে।যাও বলছি নেহা কে আমি সামলাচ্ছি!

নেহা নিজের মায়ের আঁচল টেনে বলে মা আমাকে উনার কাছে রেখে যাবে না বলছি,আমাকে মা’রবে,থা’প্পড় দিবে প্লিজ যাবে না।

নিখিল নেহার হাত টেনে ধরে বলে
,,ছোট মা তুমি যাও বলছি,ওর হাতে ইনফেকশন হয়ে যাবে কতোক্ষণ ধরে এভাবে বসে আছে খেয়াল আছে কারো।

সবাই বেরিয়ে যেতেই ডাক্তার নেহার হাত ধরে পরিষ্কার করতে লাগলো।নেহা হাত ছাড়িয়ে নিতে চাচ্ছে বার বার।নিখিল এবার উপায় না পেয়ে নেহার এক হাত চেপে ধরে আরেক হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
সেলাই করতে হয় স্ব জ্ঞানে এখানে চাইলেও কিছু করার নেই কারোর।
নেহা ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে নিখিলের পিঠের দিকে শার্ট সহ খামচে ধরেছে নখ বসিয়ে দিয়েছে।তবুও নিখিলের মাঝে কোনো পরিবর্তন নেই।সে নেহাকে আগলে ধরে রেখেছে, নেহার ছোট্টখাটো দেহটা মিশে গেছে নিখিলের বুকে।বুকের এক পাশে মাথা এলিয়ে বসে আছে নেহা।দেহটা কেমন অসার হয়ে আসছে ক্রমশ, নেহা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে নিখিলের হৃদপিণ্ডের অস্বাভাবিক ধুকপুকানি!নিখিলের গায়ের মনমাতানো মিষ্টি সুভাসটি কেমন মাতাল করে দিচ্ছে নেহাকে।নিজের সীমা অতিক্রম করছে চাইছে অবাধ্য মন,ঠোঁটে দাঁত চেপে ধরেছে নেহা,কোনো বেহায়া পনা করতে চায় না, কোনো মতেই না।
নেহা দূরে যেতে চাইছে,নিখিল কে মনে মনে কাঁচা গিলে ফেলতে মন চাচ্ছে রাগে।ছেলেটা কেনো এতো কাছে আসছে বার বার নিজের মতো সবাইকে কঠিন ধাতু মনে হয় নাকি তার।উনার হয়তো কোনো অনুভূতি নেই অন্য মানুষের ও কি থাকবে না নাকি।
নেহা কাঁপা কন্ঠে বললো

,,ছাড়ু,,ন নিখিল ভাই!

নিখিল প্রতিউত্তর করলো না

,,ছাড়ুন না প্লিজ ধ’ম বন্ধ হয়ে আসছে।
নিখিল নেহার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো
,,ম রে গেলেও ছাড়বো না।
নেহা পড়ে রইলো আগের মতো উষ্ণতায় এবার নেহার ঘুম পাচ্ছে,কিন্তু পারছে না কিছু সময় পর পর সুই য়ের খোঁচায় আহ্ শব্দ করে উঠছে।
—-
ডাক্তার চলে গেছে,নেহা আগের মতোই বসে আছে এখনো।
নিখিল শান্ত কন্ঠে বললো
,,কিরে এভাবেই থাকার পরিকল্পনা করেছিস নাকি?উঠবি না আর?
নেহার কানে কথাগুলো পৌঁছাতেই লজ্জা পেয়ে গেলো, সরে বসার জন্য তাড়াহুড়ো করলো কিছুটা তখনই আবার নিখিলের কন্ঠ শোনা গেলো

,,তুই চাইলে সারাজীবনই এভাবে থাকতে পারিস।আমি কিছু মনে করবো না!

নেহা কে যেনো চিন্তা করার বিন্দু মাত্র সময় দিলো না নিখিল।

,,ছোট মাকে পাঠাচ্ছি ড্রেস চেঞ্জ করে নে।

,,না! আমার এখন ঘুম পাচ্ছে।

,,মুখে খৈ ফুটছে দেখছি।যা কাজ করেছিস আজকে শাস্তি স্বরুপ পাঁচটা চ*ড় মারলেও তো কম হতো।

নেহা হাত নিজের গালে আগেভাগে দিয়ে দিয়েছে দেখে নিখিল ঠোঁট কামড়ে হাসলো।মুখে হাসি বজায় রাখলো সে,এই হাসিটা মিলিয়ে নিতে চাইছে না কেনো জানি,নেহা দেখলো মুগ্ধ চোখে,এই হাসি দিয়েই আমাকে পা’গল করেছেন আপনি নিখিল ভাই,আপনি খারা প খুব খারা প একজন পুরুষ!

,,কি দেখছিস এমন করে?ড্রেস চেঞ্জ করতে চাচ্ছিস না তাই তো?
নেহা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

,,ছোট মায়ের কাছে যেহেতু তুই যাবি না তো চল আমি কাজটা করে দিচ্ছি।
নেহা প্রথমে কথাটি বুঝেনি, সেকেন্ডেই ওর কান গরম হয়ে উঠেছে, নিখিল ভাইয়ের নিশ্চিত মাথা খারা প হয়ে গেছে কিসব বলছে। নেহা চোখ বড় বড় করে তাকালো, মুখ ঘুরিয়ে বললো
,,মাকে ডেকে দিন।

নিখিল বিরক্ত নিয়ে বললো
,,কোন কাজ তো সোজা কথায় করোস না। ঘাড়*ত্যাড়া একটা!

নিখিল রুম থেকে বের হয়ে গেলো,তাহমিদা বেগম এসে নেহাকে কাপড় পরিবর্তন করিয়ে দিলেন।খাবার নিয়ে আসলেন হামিদা বেগম।নেহা মুখে হাত আটকে বসে আছে,বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে প্রায়।হামিদা বেগম জোর করে খাওয়ালেন,ঔষধ খাওয়াতেই রাজ্যের ঘুম নেমে আসলো নেহার চোখে।
,,,,,,,,
নিখিল শাওয়ার নিয়ে বসেছে, পিঠ জ্বল ছে তার নেহা যা জোরে খামছে দিয়েছে পুরো রক্তা*রক্তি অবস্থা করে ছেড়েছে। নিজের কপালেও একটা বেন্ডেজ করে নিয়েছে।
নিখিল বুঝার চেষ্টা করছে নেহার কথা,নেহা লিমার সাথে তাকে দেখে রিয়েক্ট করেছে কিন্তু কেনো?মেয়েটার মনে কি তাকে নিয়ে কোনো সফট্ কর্নার আছে নাকি সবটাই তার মনের ভুল!

মোবাইল কাঁপিয়ে শব্দ হলো মিহিরের নাম্বার দেখে রিসিভ করে কানে ধরলো নিখিল
মিহিরের হাস্যেউজ্জ্বল কন্ঠ

,,তা মহা গুপ্ত প্রেমিক সাহেব। কি খবর গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছেড়ে গিয়ে বউ দেখে শান্তি মিলেছে কি আপনার?

,, সব কিছু জেনে শুনে কেনো জ্বা লাতে ফোন করেছিস?

,,আমাকে অফিসে কামলা হিসাবে রেখে তুই বাড়ি গিয়ে প্রেম করছো?আজ একটা বউ নেই বলে।

,,প্রজেক্ট টা কি পেয়েছি আমরা?

,,হুম আংকেল সামলে নিয়েছে।আর তোর জন্য নতুন পিএ রাখতে হবে,লিমা নাকি কানাডা চলে যাচ্ছে পড়াশোনার জন্য তাই চাকরি টা ছেড়ে দিয়েছে তখন তো তুই কোনো কথায়ই শুনতে চাইলি না।

,,ওহ!

নিখিল, মিহিরদের বাড়ি পাশাপাশি ছোটবেলার বন্ধু তার।পারিবারিক ভাবেও দুই পরিবারের সম্পর্ক ভালো।
মিহির অন্যত্র জব করতে চাইলেও তা সম্ভব হয়ে উঠেনি নিখিলের জন্য। সে বন্ধু ছাড়া এক দন্ড চলতে পারে না।অগত্যা চাকরি টা নিখিলের সাথেই করতে হচ্ছে তাকে।
—-
রাতে বাড়ি ফিরেছেন নেহার বাবা ও তার মেজো চাচ্চু দুজনই এসে দেখে গেছেন নেহাকে।মাহফুজ চৌধুরীর নিজের কোনো মেয়ে নেই তার দুই ছেলে।বড় ভাইয়ের দুই মেয়ে আর নেহাকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসেন তিনি।
সেতারা বেগম এসেছেন নেহা ঘুমিয়ে থাকার মধ্যেই একবার।যতই রাগ দেখান তিনি, নাতনি হয় তো তার মায়া তো সবার জন্য সমানই লাগে।
সেতারা বেগম দরজায় দাড়িয়ে ভাবলেন, নেহা যদি এখন তাকে দেখতো,অভিমান নিয়ে বলতো
,,কি বুড়ি উপরে চলে গেছি কিনা দেখতে এসেছো নাকি?তোমার জামাই আমাকে বেশি পছন্দ করতো বলে হিং সে হয় তোমার?কি আর করবে বলো আমি তো তোমার থেকে দেখতে সুন্দর এতে আমার কি দোষ!

মেয়েটা সত্যি এখনো বাচ্চাদের মতো রয়ে গেছে,কথা গুলো ভেবেই তার চোখের কোণে অশ্রুরা এসে ভীর জমালো।মনে মনে বললেন জলদি সুস্থ হয়ে যা,আমার এই বাড়ির প্রাণ তুই,তুই হুড়োহুড়ি না করলে তো বাড়িকে বাড়িই মনে হয় না।
হামিদা শাশুড়ী কে দেখে নিরবে হাসলেন।পরিবার মানেই তো শক্তপোক্ত এক অদৃশ্য বন্ধন একজনের কিছু একটা হলে পুরো বাড়ির মানুষের মাঝে যেনো তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে।হামিদা বেগম মন থেকে চায় তার এই সুখের সংসারে যেনো কারো নজর না লাগে,জীবনের বাকিটা সময় যেনো এভাবেই হেসে খেলে কাটিয়ে দিতে পারে সবাই একসাথে। তাদের বন্ধন অটুট যেনো থাকে সবসময়।
———
সকাল সাতটায় ঘুম ভাঙ্গলো নেহার,হাত ব্যাথায় নাড়াতে পারছে না।ঘরে কাউকে খুঁজে পেলো না।ভেবেছিলো নিখিল হয়তো তার সাথে থাকবে,সকালে চোখ খুলেই মানুষটিকে এক নজর দেখতে পাবে,কিন্তু সব আশা কি মানুষের পূর্ন হয়।নিজের প্রতিই বিরক্ত হচ্ছে এখন কা টলো ভালো কথা তাই বলে ডান হাতটা কেনো।বাম হাতে ভর দিয়ে উঠলো, কোনো রকম মুখ ধুয়ে বের হয় ওড়না জড়িয়ে, এক হাতে চুল বাঁধতে ও পারেনি।তার লম্বা চুল গুলো মুক্তি পেয়ে নিজেদের আধিপত্য চালাচ্ছে।আজকে নেহার সত্যি ভাগ্য খারা প। নিখিলের পাশের চেয়ার টা ছাড়া একটাও খালি নেই।আজ তো সয়ং সেতারা বেগমও উপস্থিত, নেহা ঘোমটা টেনে নিয়েছে চুল যাতে বিরক্ত করতে না পারে।
নিখিলের পাশে নেহা বসলো,সেতারা দেখেই বললো

,,এইতো এইবার ঠিক আছে,এমনে কইরা ঘোমটা দিয়া থাকলে আনা বউ বউ লাগে।

নেহা চমকে তাকালো সে আর কিনা বউ,যাক ঘোমটা দিয়া একটা ভালো কাজ তো হলো সেতারা বেগমের কোনো ঠেস মারা কথা সকাল সকাল শোনা লাগলো না।
মেয়েকে দেখে তাহমিদার অভিমান এবার তড় তড় করে বাড়লো।
নেহা মুখ বাকিয়ে বাচ্চাদের মতো বললো
,,মা খাইয়ে দাও না একটু!
তাহমিদা যেনো পেয়ে বসলেন, সব রাগ উগলে দিলেন একবারে
,,হাত কা’টার সময় মনে ছিলো না নাকি।বড় হচ্ছে আর দিন দিন দুষ্টুমির পরিমান বাড়ছে এর।হাড়মাস জ্বা লিয়ে খেলো আমার।খাইয়ে দিতে পারবো না নিজে নিজে পারলে খা না হয় না খেয়ে থাক।
হামিদা বেগম এসে বললেন
,,আহ্! ছোট রাগ দেখাচ্ছিস কেনো?খাইয়ে দে আমার কাজ আছে না হয় তো আমি দিতাম।

,,আপা তুমি এটাকে আদর দেখাবে না একদম,লাই পেয়ে পেয়ে মাথায় চড়ে বসেছে।

নেহার মন খারাপ হলো, অভিমানে টইটম্বুর হলো মন।উঠে যেতে নিলেই নিখিল ওর এক হাত চেপে ধরে,চোখ রাঙিয়ে বুঝায় একদম নড়বি না।
নেহা হাত ছাড়ানোর জন্য জোরাজোরি করে কিন্তু ফলের কোঠা দাড়ায় শূন্য, এরকম একটা তাগড়া যুবকের কাছে তার শক্তি চুনোপুঁটির ন্যায়!

,,তোমরা যেহেতু কেউই পারবে না আমিই খাইয়ে দিচ্ছি আমার বউকে!
নিখিলের শান্ত কন্ঠে বলা কথাটায় যেনো বা জ পড়লো রীতিমতো। জেরিন মুখে খাবার তুলতে ভুলে গেছে, সাব্বির গিলতে পারছে না,বর্ষা তো রীতিমতো কেশে উঠেছে।
শাহআলম চৌধুরী তো ছেলেকে নির্লজ্জ ট্যাগ দিতে ভুলেনি বাপ চাচাদের সামনে বউকে খাইয়ে দিবে তাও কতো গর্ব করে বলছে।এরকম বিপরীত চরিত্রের পুত্র সন্তান তার কিভাবে হলো,মানে একটা গুন ও বাপের মতো পেলো না কেনো?মাহফুজ চৌধুরী খাওয়া শেষ করছেন দ্রুত লজ্জা থেকে বাঁচতে উঠে যাবে এই আর কি।শহিদুল চৌধুরী ঠোঁট চেপে হাসলেন,মেয়ের জামাইটা তার মতোই হয়েছে,কপাল করে জামাই পেয়েছে একটা!

নেহা অবাক নেত্রে এখনো ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে, তার কি শুনতে কোনো ভুল হলো?
নিখিলের চাপা ফিসফিসে কন্ঠ কানে আসলো নেহার

,,আমার হাতে খাওয়ার এতো সখ তোর?ঠিক কায়দা করে ডান হাতটা কে টেছিস!তোর এই গোবর মার্কা মস্তিষ্কে যে এতো বুদ্ধি তা তো আগে বুঝিনি!

নেহা বেআক্কল বনে গেলো পুরো, তার হা থাকার মাঝেই মুখে খাবার তুলে দিলো নিখিল।
চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here