প্রণয়ের_সুর #পর্বঃ০৯ #মহুয়া_আমরিন_বিন্দু

0
16

#প্রণয়ের_সুর
#পর্বঃ০৯
#মহুয়া_আমরিন_বিন্দু
নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে রাতের পরিবেশ, হসপিটালের করিডরে বসে আছে শহিদুল চৌধুরী আর নিখিল বাকিদের বহু কষ্টে বাড়িতে পাঠিয়েছে দুজন,তাহমিদা বেগম নিজেও অসুস্থ তাই তাকে বুঝিয়ে নিয়ে গেছেন হামিদা বেগম।
নিখিল দাঁড়িয়ে আছে আইসি’ইউর দরজার সামনে , কাঁচ বেধ করে দেখা যাচ্ছে নেহার নিস্তেজ দেহটা।মেয়েটার জ্ঞান এখনো ফিরেনি,ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে তাদের আর কিছু করার থাকবে না।নেহার কোমায় যাওয়ার সম্ভবনা বেশি!
শহিদুল চৌধুরী আজ নিরুপায় বাবা হয়েও পারছেনা মেয়ের কষ্ট কমাতে, তাকে সুস্থ করে তোলার কোনো উপায় নেই।চেয়েও নিতে পারছেন না মেয়ের কষ্টের ভাগ।

বাড়িতে আসার পর কেউই তেমন কথা বলেনি সেতারা বেগমের সাথে,জেরিন শুধু ছোট করে জানিয়ে
,,জ্ঞান ফিরেনি।
সেতারা চুপ রইলেন কথা বলার মতো মুখ নেই,বাড়িটা প্রাণ শূন্য হয়ে পড়েছে।খাবার টেবিলে আজ কেউ নেই,খাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই,হাসিখুশি সেই পরিবেশ নেই।সবাইকে পাল্লা দিয়ে ঘিরে নিয়েছে বিষন্নতা।

ভোরের আলো ফুটলেও ঠায় একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে নিখিল,তার মাঝে কোনো ক্লান্তি নেই। পা ব্যাথা করছে না তার,শুধু দেখতে ব্যস্ত নেহাকে।
সকালে ডাক্তার আসলেও নিখিল ভিতরে প্রবেশ করেনি,সবাই দেখে আসলেও সে যায় নি।তার মনের কোথাও একটা বিশ্বাস জন্মেছে, সে ছুঁয়ে দিলে নেহা ব্যাথা পাবে,তার কাছে যাওয়াতে মেয়েটা কষ্ট পাবে, ঘৃ’ণায় মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটাও স্বাভাবিক মনে করে নিখিল!যদি তার থেকে দূরে থেকে মেয়েটা ভালো থাকে,কোনো দুঃখ তাকে ছুঁতে না পারে তো নিখিল দূরে থাকবে,একই বাড়িতে থাকবে তবুও সর্বোচ্চ দুরত্ব বজায় রাখবে,ভালোবাসার মানুষের সুখ বড় সুখ।নেহা না চাইলে কোনো দিন সে আশেপাশেও ঘেঁষবে না।
নিদারুণ য’ন্ত্রণা পুষবে তবুও না!
নিখিল ভয়ে কাছে যায় না যদি নেহার জ্ঞান ফিরে আসে আর সে নিখিল কে দেখে রিয়েক্ট করে আবার অসুস্থ হয়ে যায়!তখন নিখিল নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।
হারিয়ে ফেলার ভয় টা প্রতি মুহুর্ত কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে।

ব্যস্ত শহরে গুমোট আবহাওয়া, তবুও এক ফোঁটা বৃষ্টির দেখা নেই,দুইদিন হতে চললো,নেহার জ্ঞান ফিরেনি।নিখিল সব সময় চুপচাপ থাকে,একজন সুন্দর পরিপাটি ছেলে,আয়রন বিহীন শার্ট কোনো দিন গায়ে দেয় নি,চুলগুলো অলস ভঙ্গিমায় ছড়ানো,হামিদা বেগমের ভেতর থেকে হাহাকার বেরিয়ে আসে, তার ছেলেটার এই রূপ সে মা হয়ে মেনে নিতে পারছে না।নেহাকে কতোটা ভালোবাসে প্রতিটা মানুষ তা কোনো দিন স্বীকার করা হয়নি কারো,তবে এই দুই দিনের চোখের পানি যেনো তা প্রমান করতে ব্যস্ত।
তাহমিদা বেগমকে সাহস করে দেখতে গিয়েছিলেন সেতারা বেগম,তাহমিদা কিছু বলেনি,চুপচাপ হয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসে ছিলো শুধু।
সেতারা বেগম নিজের সুন্দর পরিবার নিজের হাতে নষ্ট করে দিয়েছেন বেশ বুঝতে পেরেছেন তিনি।

দুইদিনে সর্বোচ্চ বিশ মিনিটের জন্য নিখিল বাড়ি এসেছিলো,তার বেশি তাকে বাড়িতে রাখা যায় নি।
আজ এসেছে সবে সেতারা বেগম ডাকলেন তাকে
নিখিল চুপচাপ ঢুকলো সেতারা বেগমের রুমে।
নিখিলের দৃষ্টি মেঝেতে।সেতারা বেগমের সাথে নিখিলের সম্পর্ক টা সবচেয়ে ভালো,প্রতিদিন নিয়ম করে একবার হলেও ফোন দিতো সব খবর নিতো বাড়ি এসে।কিন্তু এখন!নাতিটা তার দিকে ফিরেও তাকালো না।
সেতারা বেগমের শান্ত কন্ঠ –, নেহা কেমন আছে দাদু ভাই?
,,,ম’রে গেলে খুশি হতে তুমি?
সেতারা বেগমের ভিতরটা কেঁপে উঠলো,নিখিলের কন্ঠস্বর ভেজা,বার বার ঠোঁট ভেজাচ্ছে জিব দিয়ে।তিনি তো কখনো এমনটা চায়নি।
নিখিলের হতাশ কন্ঠ
,,কেনো এমনটা করলে তুমি দাদী?আমার মুখের হাসিটুকু কেঁড়ে নিলে কেনো?আমার জীবনের শান্তি কে তুমি ধ্বং স করে দিয়েছো দাদী!
তুমি না চাইতে সব সময় যেনো তোমার নাতী সুখে থাকে,তুমি আমার এমন সুখ চাইলে যার জন্য আজ আমি নিঃস্ব!তুমি আমাকে পুরোপুরি নিঃশেষ করে দিয়েছো।
তুমি জানো নেহা আর কোনো দিন আমার সাথে কথা বলবে না,দুরত্ব চেয়েছে আমার থেকে,আমাকে মুক্তি দিয়েছে!
তুমি আমার ভালো চাইতে গিয়ে আমার এতো বড় ক্ষ’তি কেনো করলে?নেহা, আমার নেহা দাদী! আদুরে বাচ্চাটা নিস্তেজ হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে,আমি নির্বোধ আহাম্মক কিছুই করতে পারছি না।
নে,,হা না থাকলে শ্বাস আটকে আমি ম’রে যাবো।তুমি আমার কেনো এমন সুখ চাইলে,রূপবতী গুনবতী নারী দিয়ে কি করবো আমি।নেহা যেমনই হোক তাকে আমি ভালোবাসি।
ভালোবাসা তো এতো কিছু দেখে হয় না।তোমার দোষ দিচ্ছি কেনো আমি,ভুল তো আমার, তুমি এতো কিছু বলার সাহস তো আমার জন্যই পেয়েছো!আমি তোমাকে বাঁধা দেই নি তাই বলতে পেরেছো,তোমাকে আমি সুযোগ করে দিয়েছি তাই বলতে পেরেছো।ভালোই করেছো আমার মতো মানুষের সুখে থাকার কোনো অধিকার নেই। তোমার কোনো দোষ নেই, নেহার অবস্থার জন্য দায়ী আমি,শুধু একটাই অনুরোধ তুমি আর কোনো দিন নেহার বিষয়ে কোনো কথা বলবে না,ওর নামও মুখে নিবে না,নয়তো দ্বিতীয় বার আমি ভুলে তোমার আমার সম্পর্ক!
—-
তিন দিন পর নেহা চোখ খুলেছে। ডাক্তার কড়া কড়ি ভাবে শাহআলম চৌধুরী আর শহিদুল চৌধুরী কে জানিয়েছেন,পরবর্তী তে বড় কোনো শক পেলে নেহা স্ট্র’ক করতে পারে,খেয়াল রাখতে হবে যেনো বেশি উত্তে”জিত হয়ে না পড়ে।রেগে না যায়,রেগে যাওয়াটা ওর জন্য বিপদ’জনক, এখন যাতে ফুলটাইম রেস্টে রাখা হয়।
নেহা চোখ মেলতেই বাড়ির সবাই হুমড়ি খেয়ে ঢুকেছে কেবিনে,নেহা তো উঠেই বালিশে হেলান দিয়ে বসেছে,
মুখ ভর্তি হাসি যেনো কিছুই ঘটেনি!

,,আরে তোমরা সবাই এখানে কেনো?আমি হসপিটালে এসেছি কেনো বলোতো বাড়িতে কি রাখতে পারলে না আমাকে,তোমরা জানো না হসপিটাল আমার কতোটা অপছন্দের!
শাহআলম চৌধুরী ঢুকতেই নেহা মুখ কুঁচকালো
,,বড় আব্বু বাড়ি নিয়ে চলো,বাড়ি যাবো।বাকি সবাই আমার কথা শুনবে না আমি জানি!
শহিদুল চৌধুরী কেবিনে ঢুকলেন চোখ চিকচিক করছে ভদ্রলোকের,তবুও ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বললো

,,অবশ্যই আমার মা যখন বলেছে আজকেই বাড়ি নিয়ে যাবো!
তাহমিদা বেগমের শরীর দুর্বল তিনি আসেনি হাসপাতালে, মহিলা জানলে হয়তো উড়ে আসতো, সাহারাও আসেনি সে একা হাতে রান্না করছে,কতোদিন বাড়ির মানুষ গুলো খায় না,সাব্বির ফোন দিয়ে জানাতেই আল্লাহর শুকরিয়া করলেন তিনি,চোখে জল নিয়ে খুশি মনে একা হাতে সবার জন্য রান্না করতে লাগলেন,মনে কোনো হিং”সে নেই কেনো তিনি খেটে মর’বেন এরকম কোনো ভাবনা নেই।কয়েকদিন যাবৎ উনিই তো সামলাচ্ছ সব।শাশুড়ীর উপর মনঃক্ষুণ্ণ হলেও ঔষধ খাবার দিতে ভুলেনি।দায়িত্ব পালনে অবহেলা নেই!
নেহার অবাধ্য চোখ নিখিল কে খুঁজতে ব্যস্ত মানুষটি আসেনি!তাকে দেখতে একবারও আসলো না,সাব্বির
বেডের এক কোনায় অলস ভঙ্গিতে বসে বললো

,,নেহা বইন কসম মাইরি তুই তিন দিন ধরে যা টেনশন দিয়েছিস, এতোবছরের জমানো পেটের চর্বি তিন দিন না খেয়ে সব উবে গেছে।ডায়েট ফায়েট করা লাগেনি!এরকম মাঝেমধ্যে অসুস্থ হলেও পারিস বইন ফ্রিতে ডায়েট হয়ে যায়।
জেরিন ধুম করে ওর পিঠে বসায় একটা।
,,তোর কি মুখ বন্ধ থাকে না কয়েকমিনিট,ভালোই ছিলো এতোদিন তোর বকবক থেকে রেহাই পেয়েছিলাম।

নেহা অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় সবার দিকে মুখে জোরেই বলে—,তিন দিন!
নেহার মনে হলো সে ঘুম থেকে উঠেছে,তেমন কোনো ক্লান্তি নেই শরীরে,নিজেকে প্রথমে অসুস্থই মনে হয়নি তার!ভেবেছে হয়তো কিছুক্ষণ সে অজ্ঞান ছিলো,কিন্তু তিন তিনটা দিন কেটে গেছে ইতিমধ্যে!

মিহির ঘেমে-নেয়ে কেবিনে ঢুকলো,তিন দিন ধরে অফিসের সব দায়িত্ব তার উপর দিয়ে দিয়েছে অদৃশ্য ভাবে সবাই!বলে না আসলেও সব কিছু সামলাতে হচ্ছে তাকে।পরিবারের একজনও কাজ করার পরিস্থিতিতেই ছিলো না।নিখিলের কথা সে বাঁধই দিলো,ছেলেটা কে এতোটা গুমোট ভাবে থাকতে কখনো দেখেনি,তার কাছে এই নিখিল ভিন্ন অন্য এক স্বত্বা যে ভীষণ উদাসিন যার কাজে কোনো মন নেই।পৃথিবীতে যে নিখিল বলে কারো অস্তিত্ব আছে সেটাই ভুলতে বসেছিলো!

মিহির কে দেখেই নেহা হাসিমুখে বললো–,কেমন আছেন মিহির ভাইয়া!
মিহির চমকালো তার নিজের এ কথাটা জিজ্ঞেস করার কথা আর মেয়েটা উল্টো তাকে জিজ্ঞেস করছে।

,,তুমি যেমন রেখেছো আমাদের তেমনই আছি!

,,এতো টেনশনে রেখেছি আপনাদের, সরি ভাইয়া ভর পাই হিসাবে চকলেট খাইয়ে দিবো সবাইকে!
সবাই একটু হলেও হাসলো নেহার কথায়।
কেবিনের বাহিরে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দাড়িয়ে আছে নিখিল,হামিদা বেগম ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন
নিখিল চোখ তুলে স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো
,,কিছু বলবে মা?
নিখিলের চোখ অসম্ভব লাল।দাঁড়ি গুলো বেড়েছে অনেকটা, চুল গুলো কুঁকড়ানো কপালে ভাজ পড়েছে দুটো,ফর্সা ত্বকে মলিনতার ছাপ স্পষ্ট!

,,নেহার সাথে দেখা করে আয় যা!

নিখিল জবাব দিলো না,উল্টো সেখান থেকে বেরিয়ে চলে গেলো,মিহির পিছু নিলো তার ছেলেটা তিন দিন ধরে তার সাথেও ঠিক মতো কথা বলেনি।

নেহার অশান্ত চোখ বুঝে নিলো,সে জানে মানুষটি আসবে না!তার জন্য নিজের মূল্যবান সময় কেনো নষ্ট করবে নিখিল?নেহার কোনো অস্তিত্বই নেই নিখিলের জীবনে!আশা টাও ছেড়ে দিয়েছে নেহা,যে যেমন থাকতে চায় তাকে তেমনই থাকতে দেওয়া উচিত,
জোরজ’বরদস্তি কোনো দিনই ভালো কিছু বয়ে আনে না।
,,,
বিকালে নেহাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়।তাহমিদা বেগম ফের মেয়েকে জড়িয়ে কাঁদলেন কেউ থামাতে পারেনি তাকে।
পরীক্ষা মাথার উপর তার মধ্যে নেহা অসুস্থ, যদিও নেহা বলেছে তার কিছু হয়নি সে সুস্থ আছে!তাহমিদা বেগম বলেছে দরকার পরলে পরীক্ষা পরের বছর দিবে।নেহা এবার বিরক্ত সামান্য জিনিস নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে তার মা।
রাতে খাবার টেবিলে সবাই বসেছে,নেহাকে শত মানা করেও লাভ হয় নি লাফাতে লাফাতে চলে এসেছে নিচে।নেহা টেবিলে নিখিল কে না দেখে মন খারাপ করলো,মনে হচ্ছে কতো বছর দেখতে পায়নি মানুষটিকে।কিন্তু মানুষটি তো তার খবর একবারও নিলো না, নিখিল মেহমেত চৌধুরীর একজন সামান্য মেয়ের জন্য সময় কেনই বা হবে!
——–
নেহা, বৃষ্টির সাথে পড়তে বসেছে,নেহা কথা বলে না বেশি,চুপচাপ থাকে।বাড়ির সবার মধ্যে সব কিছু স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে,শুধু অনিয়ম দুজন মানুষ নেহা, নিখিল,নেহার প্রাণবন্ত সেই রূপ আর নেই,সবাই ভেবেছে পরীক্ষা তাই হয়তো আর ওইদিন যা হলো,তার পর থেকেই মেয়েটা চুপচাপ থাকে।আগের কথা মনে হলে নেহা যদি অসুস্থ হয়ে যায়,সেই ভয়ে কেউ কিছু বলে না,সেতারা বেগম ঘর বন্দী করেছে নিজেকে,সবার সামনে আসলেও নিজেকে ছোট মনে হয় তার।নেহা,তাহমিদা,নিখিল তার সাথে একদমই কথা বলে না।নেহা একবারের জন্য ও চোখ তুলে তাকায়নি তার দিকে।
,,,,,,,,,
নেহা ঘুমের ঘোরে প্রায় সময়ও নিখিল কে দেখতে পায়,নিখিল কেনো প্রতিদিন নিয়ম করে স্বপ্নে আসে কিন্তু সামনে আসে না?নেহা নিজের মনের প্রশ্নের জবাব পায় না।

খাটের পাশে ঝুঁকে নেহার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে নিখিল,এই এতোদিন হলো এতো এতো সময় পার হলো নিখিল নেহার সামনে পড়েনি,আসেনি!ইচ্ছে করে দুরত্ব বাড়িয়েছে।নেহার মুখের এক পাশে আলতো হাতে ছুঁয়ে দিলো, এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো টুপ করে।

,,নীহারিকা!এই সম্বোধন টা আমি আর করতে চাই না জানো তুমি?
আমি চাই তুমি নক্ষত্র হয়ে ফুটো!
নীহারিকা মানে যে কুয়াশার ন্যায় আবছা ঝাপসা কিছু যে রং চকচকা তবুও তাকে ধরার সাধ্য নেই কারোর,সে থেকে যায় অধরা!
আমি তোমাকে গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিতে চাই,নিজের অস্তিত্বে মিশিয়ে নিতে চাই,সব টুকু ভালোবাসা দিতে চাই,আমি আমাকে তোমার নিকট খোলা বইয়ের মতো প্রকাশ করতে চাই।তুমি কি পড়তে ইচ্ছুক হবে নক্ষত্রের রাত!
নীহারিকা থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে একটা নক্ষত্র ভরা রাত উপহার কবে দিবে অবুঝ পাখি?
,,তুমি কি কোনো দিন আমাকে চাইবে না?এতোটা খারাপ মনে হয় নিখিল কে?একবার ও ডাকলে না কেনো?তুমি ডাকলে আমি সব কিছু ছেড়ে চলে আসবো সব!
“তুমি একবার ডাকোনা লক্ষীটি” ডাকবেনা বলো?
এতো অভিমান জমাতেই নেই তো জান,তুমি জানো না অভিমান বাড়ায় দুরত্বের সীমারেখা!”

নিখিল উঠে দাঁড়ায় চুপচাপ, তার নির্ঘুম রাতের সাক্ষী এই অন্ধকার রুমের দেয়াল,নেহার নিশ্বাস, নিস্তব্ধ চাঁদ জোছনা বিহীন কোনো কোনো রাত!নেহাকে রোজ রাতে নিয়ম করে দেখে,সারাদিনের দুরত্ব সবটুকু গুটিয়ে এসে বসে পড়ে মেয়েটার সামনে মেয়েটার অজান্তে খুব সন্তর্পণে।
নিখিল পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়,তার এক হাত টেনে ধরেছে নেহা!নিখিল চমকে উঠলো নেহা ঘুমায়নি এখনো?জেগে আছে!

নিখিল তাকালো পিছনে নেহার চোখ বন্ধ, নিশ্বাস ভারি তার মানে ঘুমাচ্ছে,তাহলে হাত টানলো কি করে?নিখিল তাকালো নিজের হাতের দিকে বাঁধন খুবই আলগা,তার মানে ঘুমের ঘোরে ধরেছে।
নিখিল কান পেতে শুনলো নেহা বিরবির করে কিছু একটা বলছে,চোখ পিটপিট করছে,স্বপ্ন দেখছে হয়তো।
নিখিলের আগ্রহ জাগলো কথা শোনার,মেয়েটার কন্ঠ কতো দিন শুনে না!

“আপ,,নি প্রতিদিন স্বপ্নে কেনো আসেন নিখিল?আমার মনে হয় আপনি এত্তো কাছে আমি আপনার নিশ্বাস শুনতে পাই,কিন্তু আপনাকে ছুঁতে পারি না, এভাবে দৌড়ে ছুটে পালিয়ে যান কেনো?আমি কি রাক্ষ’সী আপনাকে খেয়ে ফেলবো নাকি?আর আসবেন না বলছি,আমি রাগ করছি আপনার উপর!
বিরবির করে কথা গুলো বললো কন্ঠ অস্পষ্ট তবুও নিখিলের মনে হলো সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সব।
নেহার ঘুমের মাঝেই নাকের ডগা তিরতির করে কাঁপলো, ঠোঁট কাঁপলো কিছুটা।

,,আ,,পনি আ,,সুন একবার,শুধু একবার, আমি আপনাকে একটু দেখতে চাই নিখিল ভাই!
কতোটা আকুল এই আবেদন, নিখিল আবার বসে পড়লো, নেহার দুগালে নিজের শক্ত হাত রাখলো খুব আদুরে ভঙ্গিতে।
কপালে কপাল ঠেকিয়ে দিলো নিখিল,নেহা নড়েচড়ে উঠলো এবার,নিখিল সরলো না,আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো নাকে, মেয়েটা কেঁপে উঠলো রীতিমতো।

হুট করে নিখিল নেহার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,ঘুমের ঘোরে এভাবে নেশাধরা কন্ঠে ডাকিস না নেহা,,
আমি এক তৃষ্ণায় কাতর পথিক,তুই এক গভীর কুয়া।আমি ঝাপ দেওয়া থেকে নিজেকে আটকাতে পারবো না।নিজের সর্বনা’শ এভাবে ডেকে আনতে নেই অবুঝ পাখি!

সাব্বির পানি বের করছে ফ্রিজ থেকে নিখিল কে স্পষ্ট দেখেছে নেহার রুম থেকে বের হতে।জেরিন ওই সময় সিঁড়ি বেয়ে নামছে।

সাব্বির জেরিন কে দেখে বললো–,,,রাতের বেলা তুই এখানে কি করস জেরিন বইন?
,,তোর আর তোর বউয়ের রোমান্স করাতে বা হাত ঢুকাতে এসেছি!

,,ভুল মানে বড় একটা মিস্টেক করলি তুই বড় আফা!
কথাটা তুই নিখিল ভাই কে বললেও পারতি।

ভাইরে কি দিয়া বানাইছে খোদা,আমাগো নেহা বইন কতো সুন্দর সুইট আর নিখিল ভাইরে দেখ,বউ রে রাইখা আলাদা থাকে!আহ্! কষ্ট এদিকে আমি সিঙ্গেল বউ থাকলে তো বউ রেখে রুম থেকে বের হতাম না আমি,নিজের বউরে দেখতে ভাই আমার রাতের বেলা চোরের মতো ঢুকে কি কপাল কি কপাল!

জেরিন সাব্বিরের হাত থেকে পানির বোতল ছিনিয়ে নিয়ে বললো
,,যা যা সাহস থাকলে ভাইয়াকে গিয়ে বল।যত্তসব আজাইরা কথা!
,,,,,,,,,,,
নেহা ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি সাবার করেছে,নিখিল ওর মুখ দুহাতে ধরার পরই ঘুম ছুটে গেছে,অবিশ্বাস্য ঘটনা বুঝতে পেরে চোখ খোলার সাহস হয়নি, নিখিল ভাই ওকে চুমু দিয়েছে,কথা ভাবতেই কেঁপে উঠলো সর্বাঙ্গ!কানের কাছে কি বললো এসব?নিখিল ভাই কে নেহা ডেকেছে,স্বজ্ঞানে তো এটা করেনি নিশ্চিত। নেহা বুদ্ধি শূন্যের মতো বসে রইলো সারাদিন যে মানুষ একবার সামনে আসে না সে রাতে এসে চুমু দিচ্ছে!

নেহার রাগ লাগলো নিখিলের উপর,মনে মনে একবার বললো বিরক্তিকর পুরুষ! বিশ দিনে একবারও সামনে আসলি না এখন এসে কি প্রমান করতে চাস?তোর চুমু তুই রাখ খচ্চর ব্যাটা,একবার পাই সামনে আমাকে এরিয়ে চলার সাধ একদম মিটিয়ে দিবো, কিছু বলি না দেখে কি পেয়ে বসেছে,চুল টেনে ছিড়ে ফেলবো আমি তোর।বিয়ে করে তামশা শুরু করেছে,সব কিছু তে আগে আগে নেহা কেনো বলবে তোর মুখ নেই এসে বলতে পারোস না নেহা তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে আমার।তা পারবে কেনো?ভোঁতা আলু একটা,পরীক্ষা টা শেষ হোক শুধু নেহা হারে হারে তার অধিকার বুঝে নিবে!

***
মেঘবালিকা,আপনার পড়াশোনাকে আমার এখন হিং’সে হচ্ছে!
আমাকে পাঁচ মিনিট ও সময় দিচ্ছেন না আপনি,কেনো এতো অবিচার এই প্রেমিক পুরুষটার উপর?
আপনি দিন দিন পাষা’ণ রমনীতে পরিনত হচ্ছেন কেনো?
,,মিহির তুমি থামবে!

,,না,,পরীক্ষা দেওয়ার পর আমি তোমাকে ছাড়বো না একদম বলে দিলাম,জোর করে হলেও তুলে নিয়ে আসবো,কবে আসবে বৃষ্টি আমি কিন্তু বড্ড অধৈর্য!

,,কোনো দিন আসবো না!

,,মে’রে ফেলবো আমি তোমাকে?আসবো না বললেই হবে নাকি,এখন আসো এখন মানে এখন!

,,ওফ্!মিহির তুমি কি বাচ্চা?

,,হ্যাঁ বাচ্চা।এখন বারান্দায় আসো আমি দেখবো তোমাকে কতোদিন ধরে আমার চোখ গুলো অভুক্ত তুমি জানো?

,,পারবো না!

,,প্লিজ না জান।কেঁদে ফেলবো এবার আমি!আমি ধ’ম আটকে মরে যাই এটা চাও তুমি?

বৃষ্টি ততক্ষণে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে মিহির দাড়িয়ে আছে ফোন হাতে নিয়ে জোছনার আলোতে আলোকিত চারপাশ,মিহির কে দেখে হাসলো বৃষ্টি।
,,পাগ’ল!

তোমরা দুই বান্ধবী মিলে আমাদের দুই বন্ধুকে ওটাই তো বানাতে চাচ্ছো,মানে বদ্ধ উ’ন্মাদ!

,,প্রেমিকার জন্য হলেই না হয় লোকচক্ষু তে তুমি বদ্ধ উ’ন্মাদ!
“প্রেমিক তুমি ঝড়ো হাওয়ার ন্যায় উন্মা”দ হও।আমি শান্তির পরশ হয়ে নামবো তোমার বুকে”!
——-
পরীক্ষার দিনটা অবশেষে আসলোই,বৃষ্টি, নেহাকে সবাই মিলে দোয়া করেছে।বৃষ্টি গিয়ে সেতারা বেগমের থেকে দোয়া নিলো,সবাই জানে নেহা যাবে না,মেয়েটা এই কদিনে একবারও সেতারা বেগমের সাথে কথা বলেনি।নিখিল নেমেছে সিঁড়ি বেয়ে,সেদিনের পর এই প্রথম নেহার সামনে এসেছে স্বেচ্ছায়!
নেহা একবারও তাকালো না,বৃষ্টি গিয়ে ভাইয়ের থেকে দোয়া নিলো,বাড়ির সবাই আচ করতে পেরেছে নেহা নিখিলের নিরব যুদ্ধ!

সেতারা বেগম পা বাড়ালেন রুমে যাওয়ার জন্য, পেছন থেকে ডেকে উঠলো নেহা–,আমাকে দোয়া করবে না দাদী?চলে যাচ্ছো কেনো?

বাড়ির সবাই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো, নেহা নিজ থেকে গিয়েই পা ছুঁয়ে ফেললো,এ মেয়েকে দিয়ে এ কাজটা কখনো করানো যায়নি,আজ নিজ থেকে পা ছুঁয়েছে!
সেতারা বেগমের চোখ ছলছল করে উঠলো কেঁদে দিলেন বৃদ্ধা।নেহা হাসলো শুধু,সেতারা বেগম কে নিজ থেকে জড়িয়ে ধরে বললো
,,কাঁদছো কেনো তুমি,তুমি তো দেখছি বেশ দুষ্টু হয়ে যাচ্ছো বুড়ি!পরীক্ষার আগে কেঁদে কেটে সাগর বানিয়ে দিয়ে আমার পরীক্ষার খাতা যাতে ভেসে যায় সে তাল করছো?

সেতারা নিজে নেহাকে জড়িয়ে ধরে বললেন–,আমারে মাফ কইরা দেইছ বইন আমি ভুল করছি!সবাইরে কতো কষ্ট দিছি আমি,আমি আসলেই ভালো দাদী, ভালো শাশুড়ী হতে পারি নাই।তোদের সবাই কে কতো কথা শোনাই আমি!

সেতারা বেগম ভুল হলেও আগে ক্ষমা চাইতে পারতেন না,আজ একটা হাঁটুর বয়সী মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইলো?
নেহা সুন্দর করে হেসে বললো–,বোনের থেকে ক্ষমা চাইতে হয় না বুঝলে,এতো কিছু মনে রাখতে নেই।এখন চটপট দোয়া টা করো আমরা যাই!

সেতারা বেগম দোয়া করলেন মন থেকে,এক মাসে নিজেকে আলাদা রেখে কম কষ্ট পাননি তিনি।একাকিত্বের মতো বড় শাস্তি আর কি হতে পারে!
সবাইকে বিদায় দিয়ে বের হওয়ার আগে বৃষ্টি নেহাকে বললো
,,সত্যি দাদীর প্রতি তোর আর কোনো রাগ নেই?

,,প্রথমেও ছিলো না এখনো নেই।
আর জানিস না রাগ,দুঃখ, অভিমান,ভালোবাসা বেশিদিন নিজের কাছে পুষে রাখতে নেই!
“এগুলো সময়ের সাথে সাথেই হারিয়ে যায় অবহেলায় অযত্নে”!

নিখিল পুরোটা সময় তাকিয়ে ছিলো নেহার দিকে, কথাটা নিখিল কে উদ্দেশ্য করে কেনো বললো নেহা?কি বুঝাতে চাইলো মেয়েটা ভালোবাসা রাও হারিয়ে যায় অবহেলায়! তবে কি নেহা হারিয়ে যাবে নিখিলের জীবন থেকে?
চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here