যাতনা_আমার (পর্ব – ১৯) #সানজিদা_ইসলাম_সূচনা

0
122

#যাতনা_আমার (পর্ব – ১৯)

#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা

দুইদিন হলো নাভান বাংলাদেশে ফিরেছে। এর মধ্যে নাভানের সাথে নাহিদ মির্জা আর সোহানা। কেউই কোনো কথা বলেনি। নাভান বাড়িতে এসেছে? এ যেন কেউ বিশ্বাস করতে পারে নি। সেদিন রাতে নিধি আর ইশানের কথা কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি। নাভান যখন সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকেছিল। সবাই নিরব ভূমিকা পালন করেছিলো। সবার চোখ নাভানের উপর থাকলেও, নাভান তাকিয়ে ছিলো তার মায়ের পানে। অশান্ত চোখ জোড়া, হাজারো আকুতি ভরা দৃষ্টিতে সোহানা মির্জার দিকে তাকিয়ে থাকলেও তিনি সেটা অগ্রাহ্য করে চলে গিয়েছিলেন তার রুমে। বাকি সবার সাথে নাভানের কথা বার্তা ভালোই চলছে। আয়েশা মির্জা সারাদিন খুশিতে নাচতে থাকেন। নাভান মিনি ছাদের একটা বেতের সোফায় বসে আছে। সামনে চা রাখা। দু’হাত এক করে তাতে থুঁতনি রেখে বিষণ্নতা হতাশা মুখে বসে রয়। ইশান নাভানের পাশের সোফায় বসে হঠাৎ। নাভান ঘার ঘুরিয়ে তাকায়।

-” কি ব্যাপার? মন খারাপ? ”

ইশান গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করে। নাভান হাসে কিঞ্চিত। মুখ বাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি সেটা। সহসাই বলে ওঠে,

-” বুঝতে পারছি না। কি করবো? সবকিছু এবার বেশীই জটিল। মায়ের সাথে আমার কথা বলা৷ অনেক জরুরি। কিন্তু দেখনা, সে আমাকে দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ”

-” তুমি জানোই, বড়মার অভিমান কতোটা প্রখর। তুমি তার মতামত, কাজকে গুরুত্ব দাওনি। তার উপর, তার খুব ভালোবাসার পছন্দের মেয়ে ইনায়া। যাকে তুমি কঠিন ভাবে ভেঙে ফেলেছো। যেটা তার প্রাপ্য ছিলো না। তার দায় তুমি বড়মার থেকে সরাতে পারবে কি না? জানা নেই। ”

ইনায়ার কথা মাথায় আসতেই নাভান কিছুটা অস্থির হয়। চোখের সামনে ভেসে উঠে বৃষ্টিসিক্ত কোমল রমনী ইনায়ার মুখ। নাভান জোরে নিঃশ্বাস ফেলে।

-” মেয়েটা এখন কোথায়? ”

ইশান হাসে, -” কে? তোমার বউ? ”

নাভানের ভেতরটা ধুক করে উঠে যেন। ‘ বউ ‘ কয়েকবার বিরবির করে জপে নাভান।

-” ইনায়া এখন হলে থাকে। আর তোমার ফ্রেন্ড ফাহাদ করিম হলো ইনায়ার আপন মামাতো ভাই। শুধু ফাহাদ নয় তোমার বেবি অদিতিও ইনায়ার আপন ফুপাতো বোন। ”

নাভান কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকায়। কই ফাহাদ তো তাকে এতোদিন এই বিষয়ে কিছুই বলেনি। নাভান কে ইশান সম্পূর্ণ ঘটনা বলে। নাভান সব শুনে নিশ্চুপ রইলো। শুধু একটা বিষয় মাথায় ঘুরলো। কালকের মেয়েটাই কি ইনায়া। নাভানের তুখোর মস্তিষ্ক যেন এবার কিছু ধরতে পারল। ইনায়ার নাভান কে দেখে হকচকিয়ে যাওয়া, ঘাবড়ানো? সবই তাকে এখন ভাবাচ্ছে।

-” অদিতির কি খবর? শুনলাম তার সাথে ব্রেকআপ করেছ। কারণ কি? ”

ইশানের কথায় ধ্যান ভাঙে নাভানের। বিরক্ত হয়ে বলে,

-” ওর কথা মনে করাস না। মেজাজ বিগড়ে যায়। ”

-” কেন? তুমি তো ওর দিওয়ানা ছিলে। ”

নাভান এবার শুন্য মনে বলে ওঠে,

-” একাকিত্বের জীবনে অনেক নারীর সঙ্গীই হয়েছি। কানাডার কালচারে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম। মায়ের সাথে কিছুটা জেদ ধরেই সেখানে মানিয়ে নেওয়া। অদিতি একটু ডিফরেন্ট ছিল। আমি তার প্রতি আসক্তও হয়েছিলাম প্রচুর। অদিতি কেই আমার লাইফ পার্টনার বানাবো আমি শিওর ছিলাম। কিন্তু? ”

নাভান এবার থামে ইশান এক ধ্যানে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

-” কিন্তু এখান থেকে ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পর, লিও নামের অদিতির এক ফ্রেন্ড আমাকে কিছু ছবি পাঠায়। ছবি গুলো দেখে লিওর সাথে যোগাযোগ করে আমি যানতে পারি। অদিতি লিওর বেবি কনসিভ করেছিলো। কিন্তু সে আমাকে পাওয়ায় জন্য বাচ্চাটা এবোর্শন করিয়ে নেয়। জাস্ট ভাব। ”

ইশান চোখমুখ কুঁচকে নেয়। কি বিশ্রী মেয়ে অদিতি। ইশান নাভানের দিকে তাকিয়ে হতাশ কন্ঠে বলে,

-” যাই বলো, তোমার ইনায়া কে বিয়ে করে এভাবে চলে যাওয়াটা ঠিক হয় নি। ”

নাভান চুপ হয়ে থাকে। কিছু বলে না আর। বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে।

-” মায়ের সাথে জেদ ধরে সত্যিই আমি একটা পৈশাচিক কাজ করে ফেলেছি। ”

ক্লাস শেষে নিধি ইনায়া কে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে যায়। সেখানে গিয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করতেই, নিধি তার আর ইশানের বিয়ের খবর ইনায়া কে দেয়। ইনায়া অবাক হয় প্রচুর। ইশানের সাথে নিধি? কিন্তু নিধির চোখমুখ দেখে ইনায়া বোঝে এই বিয়েতে নিধি প্রচন্ড খুশি। কিন্তু ইশান?

-” ভাইয়ার কি মত নিধি? ”

নিধি ইনায়ার প্রশ্ন শুনে থমকায়। মুখটা মলিন করে বলে,

-” তা তো জানিনা। আমিতো আড়ি পেতে সব শুনেছি। বলেছে তোমাদের ডিভোর্স হলে সবাই কে জানাবে। ”

নিধি কথাটা বলে ইনায়ার মুখের দিকে তাকায়। ইনায়া শান্ত স্বরে জবাব দেয়,

-” আমার কাছে ডিভোর্স লেটার এসেছে নিধি। এখন শুধু আমাদের সম্পর্ক একটা সাইনের উপর নির্ভর করছে। ”

নিধি মলিন মুখে বলে,

-” পরশু ভাইয়া এসেছে ভাবি। ”

ইনায়া শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না। সে চুপচাপ বাইরে রাস্তায় তাকিয়ে থাকে। নিধি হতাশ হয়। হঠাৎ ফোন আসায় নিধি উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

-” আসছি ভাবি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করবো। ”

-” কি কাজ? ”

-” জানতে পারবে। কাজটা শেষ হলে তুমি সহ পুরো এলাকাই জানতে পারবে। ”

কথাটা বলে নিধি হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায়। ইনায়া অবাক হয়ে সেও হলের দিকে এগিয়ে যায়। রাস্তায় কিছুক্ষন দাড়ায় ইনায়া। আজ সুর্যের তেজ খুবই প্রখর। ঘামে জবজবে অবস্থা মুখমন্ডল। ইনায়া ওরনা দিয়ে মুখ মুছে সামনে অগ্রসর হয়। হঠাৎ মাথার উপর কেউ ছাতা ধরতে ইনায়া পাশে ফিরে তাকায়। জায়ান মুচকি হেসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইনায়া একবার আশেপাশে তাকায়। না, আজ গুন্ডাটা ছেলেপেলে নিয়ে আসেনি।

-” করছেন কি মানুষ জন দেখছে। ”

জায়ান ছাতাটা ইনায়ার হাতে মুঠোয় দিয়ে। একটু দুরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হেসে বলে,

-” প্রহর শেষের আলোয় রাঙা আজ চৈত্রমাস- তোমার চোখে দেখেছি আজ আমার সর্বনাশ। ”

জায়ানের হঠাৎ এমন কথায় ইনায়া চমকায়। হতবিহ্বল হয়ে তার দিকে কয়েক নেনো সেকেন্ড তাকিয়ে মুহূর্তেই হেসে উঠে। জায়ান অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে সেই মুক্তোঝরানো হাসি। ইনায়া নিজেকে সামলে শান্ত স্বরে বলে ওঠে,

-” শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ কেও কপি করলেন? তাও আবার নিজের মতো বানিয়ে? ”

ইনায়া কথাটা বলে থামলো। তারপর মুচকি হেসে আবার বলে উঠল,

-” প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস। তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ। এমনটা হবে। ”

জায়ান মাথা নিচু করে হেসে উঠে আবার ইনায়ার পানে তাকায়।

-” তা সত্যিই কি তোমার সর্বনাশ দেখতে পেয়েছো? ”

ইনায়া জায়ানের কথার মানে বুঝতে পারে। হাস্যোজ্জ্বল মুখটা এবার রাতের আধারের মতো অন্ধকার করে নেয়। তারপর মিহি কন্ঠে বলে,

-” দেখতে চাইলেও দেখবো না। বুঝতে পারলেও বুঝবো না। আমি আর কিছুই নতুন করে বুঝতে চাই না। ”

কথাটা বলে জায়ানের দিকে দু’পায়ে অগ্রসর হয় ইনায়া। জায়ানের হাতে ছাতা ধরিয়ে সে গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হয়। জায়ান কুটিল হেসে পেছন থেকে বলে ওঠে,

-” সামলে রেখো নিজেকে বোকা হরিণী। বাঘ মামা কিন্তু পেছনে ছুটছে। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন তাকালেই, বগলদাবা করে ফেলবো। সো বি কেয়ার ফুল। ”

কথাটা শুনে ইনায়া দাঁড়ায়। কিন্তু পিছনে ফিরে না।

-” আমি সাবধানেই থাকবো। আপনিই নিজেকে সামলে নিয়েন। না হলে পিছলে যাবার ভয় নিয়ে পিছু করতে হবে। ”

-” জায়ান করিম কোনো কাজে ভয় নিয়ে এগোয় না। আর এটাতো মনের ব্যাপার। জোর একটু বেশীই। ”

কথাটা বলে জায়ান পা চালিয়ে চলে যায়। ইনায়া খানিকক্ষণ পরে পিছনে ফিরে। জায়ান কে আর দেখতে পায়না সে। একটা বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে ইনায়া সামনে ফিরে হাটতে থাকে। হলে এসে ইনায়া প্রথম গোসল সেরে নেয়। আজ বিকালে মির্জা বাড়িতে যাবে সে। সোহানার সাথে কথা বলতে। সাথে মিজানুল করিম বা ফাহাদও যাবে। ইনায়া যখন চুল শোকাচ্ছিল তখনই তিথি রুমে আসে। পরনে পাতলা সাদা রঙের সুতির শাড়ি। চুল গুলো সুন্দর করে খোপা বাঁধা। হালকা সেজেছেও তিথি। নিশ্চয়ই পার্লার থেকে এসেছে।

-” কি ব্যাপার? আজ ইংলিশ ম্যাম থেকে বাঙালি গিন্নি হয়েছ যে? ”

তিথি মুচকি হেঁসে জবাব দেয়,

-” একজন কে সারপ্রাইজ দিব ভাবছি। তা তুমি কি মাত্র এলে? ক্লাস তো মনে হয় সেই কখনই শেষ হয়েছে। ”

-” আর বলো না। নিধির খপ্পরে পড়েছিলাম। আঁটকে রেখে একটা গুড নিউজ দিল। ”

ইনায়া ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে। তিথি ব্যস্ত হাতে নিজের ব্যাগ ঠিক করতে করতে শুধায়,

-” গুড নিউজটা কি? ”

-” তার আর ইশান ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। ”

হাসি খুশি বলে ইনায়া। কথাটা শ্রবণ হতেই তিথির ব্যস্ত হাত থেমে যায়। ভেতরটা কেঁপে উঠে তৎক্ষণাৎ। জিজ্ঞাসু চোখে ইনায়ার পানে তাকায় তিথি।

-” বিয়ে? তারা দুজনেই খুশি এতে? ”

-” সত্যিই, মেয়েটা খুব খুশি। আমি ওই বাড়িতে থাকা কালিন তাদের মধ্যে এমন কিছু দেখিনি। বিষয়টা সম্পূর্ন পারিবারিক ভাবে ঠিক করা হয়েছে। ”

তিথি যেন থমকে গেছে। তার মুখে কোনো রা নেই। তরতরিয়ে ঘেমে একাকার হয় তিথি। ইশান তো তাকে কিছু বলেনি? সে জানে তো ব্যাপার টা? আজ তো ইশানের সাথে দেখা করবে তিথি। হন্তদন্ত হয়ে তিথি উঠে দাঁড়ায়। ইনায়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

-” অল রাইট তিথি? ”

তিথি কোনো জবাব দেয় না। এক প্রকার দৌড়ে রুম থেকে বেরোয়। ইনায়া যেন বোকা বনে রয়। তিথির এভাবে হঠাৎ হকচকিয়ে উঠাটা তাকে ভাবায়। তিথি তার ব্যাগটাও রেখে গেছে। ইনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৈরি হতে থাকে।

নাভান বিকালের দিকে নিজের রুমে শুয়েছিলো। সোহানার সাথে কথা বলতে গিয়েও পারেনি। কি করবে কিছুই বুঝতে পারে না নাভান। সে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের বেলকনিতে যায়। সেখানে যেতেই নাভান অবাক হয়। বেলকনিতে প্রচুর ফুলের গাছ লাগানো। কিছু কিছু ফুলের নামও যানে না নাভান। গত দুইদিনে এদিকে আসা হয়নি নাভানের। কে সাজিয়েছে এমন করে? মা নয় তো? হবে, মাই হবে। শুধু বেলকনি নয় পুরো রুমটাই অনেক গুছানো ছিল। নাভানের ছবি দিয়ে পুরো রুমই সাজানো ছিল। নাভান ভাবনা বাদ দিয়ে বাইরে যাবার জন্য তৈরি হয়। ফাহাদের সাথে দেখা করতে হবে আজ। গাড়িতে উঠে ফাহাদের অফিসের দিকে যেতে থাকে নাভান। মাঝখানে গাড়ি জ্যামে পরায় নাভান বিরক্ত হয়। এইদেশের পপুলার সমস্যা এটা। বিশ মিনিট জ্যাম পরে থাকে গাড়ি। নাভান হঠাৎ জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই উলটো দিকের একটা গাড়িতে ইনায়া কে দেখতে পায়। যে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে রয়েছে। নাভান এক ধ্যান তাকিয়ে থাকে ইনায়ার দিকে। নাভান হঠাৎ লক্ষ্য করে ইনায়ার চোখের কার্নিশ দিয়ে গড়িয়ে অশ্রুধারা বয়ে যাচ্ছে। নাভানের ভিতরটা কেন যেন নড়ে উঠে। সে ভেতর থেকেই চাইতে লাগলো এই মেয়েটা যেন না কাঁদে। যেটা তার দেখতে একটুও ভালো লাগছে না। অনেক্ক্ষণ বাদেই জ্যাম ছুটে। নাভানের নজর এতোক্ষণ ইনায়াতেই নিবদ্ধ ছিল। গাড়ি যেতেই নাভানের হুঁশ আসে। সেও গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গন্তব্যের দিকে যেতে থাকে। ফাহাদের কাছে গিয়ে প্রথমেই, ইনায়ার প্রতি যে সন্দেহ হচ্ছে তা ভাঙতে হবে। কেন যানি তার মন বলছে। এটাই সেই ইনায়া।

চলবে……………

( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here