যাতনা_আমার (পর্ব- ২৩) #সানজিদা_ইসলাম_সূচনা

0
2

#যাতনা_আমার (পর্ব- ২৩)

#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা

হাইওয়ে রোড দিয়ে সাই সাই করে তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছে জায়ানের কালো রঙের মার্সিডিজ বেঞ্জ। মধ্যাহ্ন দুপুরের সূর্যের তির্যক আলো যেন গাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছে। ড্রাইভিং সীটে বসে খুব দক্ষ হাতে ড্রাইভ করছে জায়ান। পাশের সিটে চুপটি করে বসে আছে ইনায়া। তার মুখ খুব শান্ত হয়ে রয়েছে। জায়ানের ও তাই। তারা কোথায় যাবে জানা নেই ইনায়ার। সকালের সেই জায়ানের কোমল গলায় প্রশ্নের জবাব জানা ছিলো না ইনায়ার। চুপচাপ ছিলো দুজনেই। তাদের নিরবতা ভেঙে ছিলো ফোনের বিপ বিপ শব্দে। জায়ান আলতো হাত ফোন রিসিভ করে এগিয়ে দিয়েছিলো ইনায়ার দিকে। ফোন কানে ধরে অপর পাশের ফাহাদের কিছু কথা শুনলো ইনায়া। কথা ছিলো এতোটুকুই, ‘ আমি আর বাবা আছি। জায়ানের সাথে চলে এসো।’ অতঃপর জায়ান গাড়ির দরজা খুলতেই উঠে পরেছিলো সে। গন্তব্য জানার ইচ্ছে আর হয়নি। শহরের ব্যস্ত রাস্তা, যানবাহনে ব্যস্ত জনগণ, আধুনিক জীবন ও স্থান পেরিয়ে শৈশবের সেই প্রিয় চেনা রাস্তার গলিতে আসতেই চোখগুলো ধপ করে জ্বলে উঠে ইনায়ার। যেখানে রিকশার ক্রিংক্রিং শব্দ, গলির ছোট্ট দোকানে চায়ের আড্ডা। বড়ো বড়ো আড়তের দোকানে বিরিয়ানির ভোজন। বাবার হাত ধরে চিপা চিপা গলি পেড়িয়ে বাজারে যাওয়া। সবই যেন চোখে ভেসে উঠে ইনায়ার। সে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে জায়ানের দিকে তাকায়। কিন্তু সে লোকের মুখ নিশ্চল অবিচল। একটু সামনে যেতেই বড়ো করে ব্রেক কষলো জায়ান। বিরক্তি নিয়ে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে জায়ান। ইনায়া ও বেরুলো। জায়ান মুখ গম্ভীর করে ইনায়ার দিকে তাকায়। মেয়েটার মুখটা আচমকাই চঞ্চলতায় ভরে গেছে। ইনায়ার কাজল কালো আঁখি গুলোতে খুশির আভাস। সে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে,

-” আমরা পুরান ঢাকায়? ”

-” এতো খুশী হওয়ার কি আছে? দেখো তোমার শহরের অবস্থা। এ রাস্তায় তো রিকশা ছাড়া কিছুই চলে না মনে হচ্ছে। ”

ইনায়া দেখে সামনের রাস্তায় আসলেই গাড়ি ঢুকবেনা। সামনের দুইটা গুলির মোর নিলেই ইনায়াদের বাড়ি। অবশ্য অন্য রাস্তা ধরে গেলে ঠিকই গাড়ি ঢুকতো। কারণ গলির বড়ো রাস্তার পাশেই ইনায়াদের বাড়ি। ইনায়া সামান্য রাগ নিয়ে বলে,

-” আগে কেন বললেন না? যে বাড়িতে নিয়ে যাবেন? বললে আমি ঠিক রাস্তা দেখিয়ে দিতাম। ”

জায়ান ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ফাহাদ জিপিএস অন করে রেখেছিলো। সে হিসেবেই তাড়াতাড়ি রাস্তা খুজতে গিয়ে জট পাকিয়ে ফেলেছে জায়ান। জায়ান ঘন স্বরে জিজ্ঞেস করে,

-” জানা থাকলে চলো। গাড়ি ঘোরাতে হবে আবার। ”

ইনায়া মাথা নাড়িয়ে তারাতাড়ি করে বলে ওঠে,

-” না, না, এখন ঘুরে যেতে হলে অনেক সময়। আমার সাথে আসুন। আমার এদিকের রাস্তা একেবারে মুখস্থ। ”

বলেই ইনায়া সামনে হাঁটতে শুরু করে। অগত্যা জায়ানও ইনায়ার পিছন হাঁটে। একতালা দুতালা প্রায় লাগানো লাগানো, শেওলা যুক্ত স্যাঁতস্যাঁতে সাদা রঙের দেয়ালের, লম্বা উন্মুক্ত করিডর। বড়সড় জানালা যুক্ত বাড়িগুলোকে জায়ানের কাছে নেহাৎ হরর ফিল্মের ভুতুড়ে বাড়ির মত লাগছে। গলির রাস্তা পেরুতেই সামনে চিকন সুরু রাস্তা পরে। জায়ান অবাক হয়। একজন কোনো রকম যেতে পারবে। অপর পাশ থেকে অন্য কেউ এলে রাস্তা কি করে পার হয় এরা? আর মাথা ঘামায় না জায়ান। আর কিছুক্ষণ হাটার পরে বড়ো রাস্তায় উঠে তারা। রাস্তার সাইডে দাঁড় করানো তিনটি গাড়ি। দুটি অবশ্য জায়ান ভালো করে চেনে। গাড়ি বরাবর বড়ো লোহার গেইট। কাঙ্ক্ষিত জায়গায় এতোক্ষণে এলো তারা। ইনায়া শান্ত নির্জীব হয়ে তাকিয়ে থাকে চিরচেনা সেই বাড়িটার দিকে। চোখের কোনে অশ্রুরা ভিড় করে। গুনে গুনে বারোটা মাস হতে চললো। ইনায়া সোহানার হাত ধরে এই বাড়ি ছেড়েছিলো। জায়ান বাড়িটা অবাক হয়ে দেখে। এল আকৃতির বিশাল বড়ো সাদা রঙের তিনতলা বাড়ি। যেখানে বড়ো করিডর পেরিয়ে রয়েছে একতলা থেকে অন্যতলায় যাবার বিশাল বড়ো সিড়ি। পুরনো হলেও আভিজাত্যপূর্ণ বাড়ি। আসেপাশের বাড়ি থেকে বিবেচনা করলে, এটা নির্ঘাত জমিদার বাড়ির খেতাব দেওয়া যাবে। জায়ান ইনায়ার পানে তাকাতেই গম্ভীর ঘন স্বরে বলে ওঠে,

-” চোখের পানি তোমার কাছে এতোই অমূল্য? যখন দেখি তখনই ঝরাতে থাকো। আগে নিজেকে সামলানো শিখে নাও। দেখবে, মূল্যবান প্রবাহিত পানির স্রোত বারবার তোমার ধারে আসবে না। ”

ইনায়া ম্লান হাসলো। জায়ানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

-” শান্ত নদী বরাবরই শান্ত থাকে। একদম নির্জন নিস্তব্ধ স্রোতশূন্য। আর অশান্ত নদীর প্রবাহিত স্রোত ক্ষনে ক্ষনে গর্জন তুলে একের পর এক নতুন রুপে ফিরে আসে। আমার ভাগ্য নাহয় অশান্ত নদীর পাড়েই দাঁড়িয়ে থাকবে। ”

জায়ান আর কোনো কথা বলে না। তার সামনে দাঁড়ানো নারীটিকে সে আসলেই চিনতে পারে না। যখন মনে হয়, তাকে বুঝে গেছি। তখনই, তাকে টেনে বের করে এই নারী। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লোহার বড়ো গেইট পেড়িয়ে বাড়িতে ঢোকে জায়ান। ইনায়া বাড়িতে ঢুকে আগে আগে পা ফেলে সামনে যায়। অনেক খুশি ভিড় করে মনে। এই বাড়িতেই তার শৈশব-কৈশোরের জড়ানো কাহিনি ডুবে আছে। চোখ বন্ধ করলেই সেগুলো ভেসে উঠে। বড়ো উঠোন পেরিয়েই বাড়িটি। জায়ান সামনে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে,

-” তোমাদের হলরুমে নিয়ে চলো। বাবা, ভাই ওখানেই আছে। ”

এতোক্ষণ খুশিতে ভাসতে থাকা ইনায়ার মুখ গম্ভীর হয়ে এলো। মনে ভিড় করলো অনেক প্রশ্ন।

-” সবাই এখানে কেন? কিছু হয়েছে কি? ”

-” গেলেই বুঝতে পারবে। ”

ইনায়া আর রা করে না। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলে বাড়ির আনাচে-কানাচে মুখস্থ করা রাস্তাতে। পেছনে জায়ান লক্ষ্য করে তার পায়ের পদক্ষেপ। হলরুমে ঢুকতেই ইনায়ার চোখ স্থির হয়ে যায়। বিশাল বড়ো হলরুমের পুরনো আমলের কাঠের খোদাই করা কারুকাজ সম্পূর্ণ সোফা গুলোতে বসে আছে ছয়জন। দুইটা মানুষ কে দেখে ইনায়া ভিষণ অবাক হলো। কারন সামনে তার ফুপু আনিলা ও তার হাসব্যান্ড ইয়াসিন চৌধুরী। যে তার ভাইয়ের মৃত্যুর পরেও একবারও আসলোনা। তার হঠাৎ পুরান ঢাকায় আসার কারণ ধরতে পারলো ইনায়া। আনিলা মুখ বাঁকা করে ইনায়া কে দেখে। ইনায়া মাঝেমধ্যে অবাক হয়। মাও বলতো আনিলা তাকে ছোট বেলায় অনেক আদর করতো। এমনকি ইনায়ার নামটাও তার রাখা। ফাহাদ হাত নাড়িয়ে জায়ান আর ইনায়াকে পাশে বসতে বলে। ইনায়া গুটি মেরে মিজানুল করিমের পাশে বসে পরে। মিজানুল করিম উকিলের সাথে কথা বলে আনিলা বেগমের দিকে তাকায়।

-” দেখুন বিষয়টা আমি সহজেই হ্যান্ডেল করতে চাইছি। ইনায়ার বাবা আশরাফ হোসেন আপনার কাছে ব্যবসার জন্য টাকা ধার করেছিলো বছর চার এক আগে। যেটা তিনি শোধ করেননি। এখন আপনি পৈতৃকসম্পত্তি ও ধারকর্জ টাকা সহ তার পুরো বাড়িটাই দাবি করছেন। তাইতো? ”

আনিলা বেগম গম্ভীর মুখে বললেন,

-” হ্যাঁ, ভাই আমার কোনো টাকাই শোধ করেননি। আর বাবার সম্পত্তির উপর আমারও অধিকার আছে। তাই আমি দাবি করতেই পারি। ”

ফাহাদ এবার উকিলের থেকে একটা ফাইল নিয়ে আনিলা বেগমের দিকে এগিয়ে দেয়। আনিলা ও তার হাসব্যান্ড ইয়াসিন চৌধুরী দুজনেই চমকে উঠে তাদের দিকে তাকায়। জায়ান বাঁকা হেঁসে বলে ওঠে,

-” আশরাফ হোসেন আপনার থেকে টাকা নিয়ে আড়ত আরো বড়ো করেছিলেন। বছর দুই যেতেই তিনি তিনটি আড়তের মালিক হন। তারপর আপনার টাকাসহ গোটা একটা আড়ত তিনি আপনার নামে দিয়েছিলো ওনার মৃত্যুর মাস তিন আগে। এই দলিল তার প্রমান। তাহলে আপনি টাকা দাবি কি করে করতে পারেন? ”

ইনায়ার এতোক্ষণে মনে পরে তার বাবা আনিলার নামে একটি আড়ত দিয়েছিলো। কিন্তু এর পেছনে এতো কাহিনি জানা ছিলোনা ইনায়ার। আনিলা বেগম চটে উঠেন।

-” মিথ্যা কথা ভাই আমাকে এমন কিছুই বলেনি। এবং দেননি। মিথ্যা রটাচ্ছেন আপনারা। ”

জায়ান গম্ভীরমুখে একটু হাসি ফোঁটায়। পাতলা ঠোঁট দুটি নাড়িয়ে ঘন স্বরে জিজ্ঞেস করে,

-” কিন্তু? এখানে তো আপনারও সিগনেচার আছে। আপনার পাসপোর্টের হিসাব ধরে দেখতে গেলে আপনি তখন বাংলাদেশেই ছিলেন। ”

মুখ ছোট হয় আনিলার। এই ছেলে তার ভিসা অবধি ঘেঁটে ফেলেছে? এই চুনোপুঁটি মেয়ে কি করে মেয়র উকিল নিয়ে আসলো? তা মাথায় ঢুকছেনা তার। ইয়াসিন চৌধুরী এবার রাগান্বিত হয়ে বলে ওঠে,

-” দুর্নীতি করছেন সবাই? এসব কি? ”

মিজানুল করিম এবার গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,

-” প্রমাণ সব আমাদের হাতেই। এখন যদি আপনারা না মানেন। তাহলে কঠোর আইনের ব্যবস্থায় আমাদের যেতে হবে। ”

-” যতো যাই হোক, আমি আমার বাড়ি থেকে এক পাও নড়বো না। ”

কঠিন গলায় জোর খাটিয়ে বললেন আনিলা। ফাহাদ এবার উকিলের কাছ থেকে একটা বার্থ সার্টিফিকেট এনে দু’জনের সামনে ধরে। অতঃপর দুজনের মুখ কালো আধারে ডুবে যায়। ফাহাদ বাঁকা
হেঁসে বলে উঠে,

-” এই কাগজ অনুযায়ী, আপনি এবাড়ির কেউ নন। আশরাফ হোসেনের বাবা তার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পরে, আপনার মাকে বিয়ে করেছিলেন। আপনার মা ছিলেন বিধবা ও তার ছিলো তিন বছরের একটা মেয়ে। মানে আপনি। ”

এইটুকু শুনেই ইনায়া আশ্চর্য হয়ে যায়। আজ পর্যন্ত এই সত্য তার কাছে অজানা ছিলো। বাবা মা এবং কি ছোট বেলায় দাদা দাদির মুখেও কোনোদিন এসব কথা শুনেনি। আনিলা বেগমের মুখ রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে যায়। পুরোনো সত্য বেরিয়ে এলো বলে। ইয়াসিন চৌধুরী নিজেও এই ব্যাপারে অবগত ছিলেন না। তিনি অবাক হয়ে তাকায় আনিলার দিকে। ফাহাদ তাদের হতভম্ব মুখ দেখে মজা পেলো। সে কুটিল হেসে বাকি কথা শেষ করে।

-” আশরাফ হোসেনের বাবা, মানে আপনার সৎ বাবা আপনাকে মেনে নিয়েছিলো। নিজের পরিচয়ে আপনাকে বড়ো করে, তিনি সমান ভাবে আপনাকে এবং আশরাফ হোসেনকে সম্পত্তি ভাগ করে দিয়েছিলেন। তার মধ্যে এই বাড়ি আশরাফ হোসেনের ভাগে ছিলো। ইয়াসিন চৌধুরীর সাথে আপনার প্রনয়ের সম্পর্ক ছিলো। এর সাথে অবৈধ মেলামেশা। যার জন্য আপনি বিয়ের আগেই প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছিলেন। সব শুনে আপনাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিলো। অতঃপর আপনি ইয়াসিন চৌধুরীকে বিয়ে করেন এবং তার কিছুদিন পর আপনার সকল সম্পত্তি বিক্রি করে কানাডায় চলে যান। বাবা মায়ের মৃত্যুর কিছুদিন আগে আপনি আবার তাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেন। কি তাইতো, মিসেস চৌধুরী? ”

পিনপিনে নিরবতা চলছে রুমটিতে। দুই গম্ভীর ব্যাক্তিত্বের পুরুষের মুখে কুটিল হাসি ফুটে উঠেছে। যে হাসি অপর পক্ষকে পরাজিত করার। ইনায়া চোখমুখ কুঁচকে রয়েছে। আনিলা এতো জঘন্য তার জানা ছিলো না। ইয়াসিন চৌধুরী আর কিছু না বলে গটগট পায়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। মিজানুল করিম ও ফাহাদ বাকি দুই উকিল কে নিয়ে কথা বলতে বলতে বাইরে যায়। আনিলা বেগম চটে গিয়ে ইনায়ার সামনে দাঁড়ায়।

-” ভালোই তো রুপ দেখিয়ে খদ্দের জোগাড় করেছিস। তোর মতো মেয়েরা পারে আর কি। ”

-” তা তো বটেই, আপনার মেয়েও কিন্তু খদ্দের জোগাড় করাতে বেশ পটু। তাও আবার বিবাহিত। আপনার শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন বোঝাই যায়। কানাডার মোস্ট হট প্রস্টিটিউট বলে কথা। ”

ইনায়া কিছু বলার আগেই জায়ান পিছন থেকে কঠিন গলায় বলে ওঠে। আনিলা বেগম ক্ষেপে গিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠে। জায়ান কে আঙুল শাসিয়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই মুখের আদল ভয়ংকর লাল করে গর্জে উঠে জায়ান।

-” আবার গলা উঠালে, মেরে পুরান ঢাকার অলিতে-গলিতে দেহ ছিন্নভিন্ন করে রেখে দেবো। ”

আনিলা জায়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলেন। ইনায়াও হতভম্ব হয়। এই গুন্ডাটা হঠাৎ করেই মুখের আদল বদলে ফেলে। জায়ান লম্বা পায়ে হেঁটে আনিলার সামনে আসে। তারপর পাঞ্জাবির হাতা হালকা গুটাতে গুটাতে বলে,

-” এক্ষুনি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যান। না হলে ঠ্যাং ভেঙে সারাজীবনের জন্য গলিতে ভিক্ষা করার ব্যবস্থা করে দিবো। কারণ জায়ান করিম কথা কম বলে, কাজে বেশি ফোকাস করে। ”

জায়ান নাম শুনতেই আনিলা থমকালো। বিডি তে এসেছে পনেরো দিন। এই দিনের মধ্যেই বাড়ির জন্য বিশাল ঝুটঝামেলা পোহাতে হয়েছে জায়ান করিমের সঙ্গে। সামনা সামনি দেখা না হলেও লোকজন দিয়ে ঠিকই শাসাতো। তাহলে এই সে ছেলে? আনিলা আর কথা বাড়ালো না। চলে গেলেন
সামনে থেকে। ইনায়া নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। জায়ান সোফার মধ্যে ক্লান্ত ভঙ্গিতে গা এলিয়ে দেয়। টেবিলের উপর এক পা, আরেক পায়ের উপর ভাজ করে রাখে। অতঃপর হাই তুলে ইনায়ার উদ্দেশ্যে বলে,

-” এই তোমার বাড়ির মেহমানদারী? এক কাপ চাও খাওয়ালেনা? ত্রিশ মিনিটের মেহমান আমি। তোমার থেকে এতো কুঞ্জসি আসা করিনি হরিণী। ”

-” আব্বে হালা, খাইবার হইলে থাকতে হইবো। নাইলে আমডা কোনো মেমানি করিনা। বুঝে আইলে থাহো, না অইলে যাওগা। ”

জায়ান থ হয়ে রইলো। ইনায়া কথা গুলো মুচকি হেসে সরে যায়। জায়ান কিছুটা অবাকের রেশ ধরে বলে ওঠে,

-” এখন আবার সালা?এটাকি ঠিক করলে হরিণী? ”

কথাটা ইনায়া অগোচরে থেকে যায়। বাইরে এসে মিজানুল করিম আর ফাহাদকে অনেক ধন্যবাদ জানায় ইনায়া। তারা না থাকলে বাবা মায়ের নিজের শৈশবের স্মৃতিটাও হারাতে হতো। ফাহাদ ইনায়াকে মুচকি হেসে বলে ওঠে,

-” ধন্যবাদ টা আমাদের না জায়ানের পাওয়া দরকার। বাবা বলার পরে এই বিষয়টা আমি জায়ান কে দেখতে বলেছিলাম। সে অনেক কষ্টে তোমাদের বাড়ি আর তার হিস্টোরি বের করেছে। ”

ইনায়া অবাক হয় না। কারণ সে জানে। এই গুন্ডাটার ধারা সব সম্ভব। মিজানুল করিম এবার ফাহাদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলে,

-” এই ঝামেলা তো শেষ হলো। এখন বলো তোমার কিচ্ছা কবে মিডিয়া থেকে ডিলিট করছো? আজকাল বিজনেস পার্টনার গুলোও তোমার নাম ভাঙিয়ে আমার সাথে মজা করে। ”

ফাহাদের মুখটা শুকিয়ে যায়। ঘটনাটা আসলেই দিনকে দিন বড়ো হচ্ছে। তার দলের লোক গুলো এই নিয়ে তাকে সন্দেহ শুরু করেছে। আপাতত ভাবনায় আছে সামনের সপ্তাহে তিলককে সাথে নিয়ে প্রেস মিটিং ডেকে বিষয়টা সেখানেই ক্লোজ করবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তার আগে সে নিধিকে চরম শিক্ষা দেবে। নিধি ফাহাদকে অপমান করলেও তার গায়ে লাগতো না। কিন্তু বিষয়টা এবার তার স্বপ্নের ক্যারিয়ারে পরেছে। এবার কোনো ছাড় সে দেবেনা।

-” সামনের দিনেই প্রেস মিটিং করবো। আসা করি ঠিক হবে। না হলে দলের লোক গুলো আমার শিরশ্ছেদ করে দিবে। সব দোষ নিধির। ওর কাছে মাথাটাই আছে। কোনো বুদ্ধি নেই। ওর তো খবর আমি নেবোই। ”

চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠে ফাহাদ। ইনায়া ইন্টারনেটে ফাহাদের বিষয় দেখেছে। কিন্তু এর মধ্যে নিধি কি করে ইনভলভ হলো তা ভাবার বিষয়। মিজানুল করিম ফাহাদের কথার প্রেক্ষিতে খুশি হয়ে বললেন,

-” আলহামদুলিল্লাহ! এতোদিনে কাজের মতো কাজ হয়েছে। নিধিকে আমি দুইদিনের শপিং করার টাকা গিফট করবো। তুই যদি ওকে বকেছিস তো, আমি নিজেই তোর শিরশ্ছেদ করবো। ”

ফাহাদ আবার আহত হয়। পৃথিবীতে মনে হয় তার বাবাই একমাত্র মানুষ। যিনি নিজের ছেলেদের ক্যারিয়ার ভাঙার জন্য দিনরাত দোয়া করে। মিজানুল খুশি মনে হেঁটে হেটে বাইরে চলে যায়। তার তো অনেক আনন্দ লাগছে। ফাহাদের রাগ নিধির উপর আরো বৃদ্ধি পায়। সে ইনায়া দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,

-” তুমি জায়ানের সাথে চলে এসো। আমার জরুরি কাজ আছে। ”

ইনায়া হ্যা বা না বলার আগেই ফাহাদ একপ্রকার দৌড় লাগিয়ে গাড়ির দিকে অগ্রসর হয়।

– চলবে………………

( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here