রিদ_মায়ার প্রেমগাঁথা #লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া ৩৭

0
10

রিদ_মায়ার প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া

৩৭
মায়া ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে হিচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে মুখে কাপড় চাপল। ফিসফিসিয়ে বলতে চাইলল…

‘ আমি জানি না কোথায় আছি! আশেপাশে কিচ্ছু চিনি না। ওরা আমাদের খোঁজছে! ওরা! ওরা পাহাড়ি জঙ্গি! আমাদের মেরে ফেলতে চাই প্লিজ আপনি আমাদের বাঁচান! আমি মরতে চাই না। আমার আপনার সাথে এখনো সংসার করা হয়নি! আপনার জন্য বউ সাজা হয়নি। আপনাকে নিয়ে এক জনমের স্বপ্ন বুনা বাকি। আমাদের বাঁচান প্লিজ নেতা সাহেব। আমি আপনাকে ছেড়ে মরতে চাই না। প্লিজ আমাদের সাহায্য করুন!

মায়ার কান্নায় রিদের মন অস্থির হলো। ছটফটে ব্যাকুল হলো মস্তিষ্ক। হুট করেই যেন রিদ বুঝতে পারলো তার বউকে ছাড়া সে একেবারেই অচল। এই মেয়ের কিছু হবে ভেবেই যেন তাঁর নিশ্বাস আঁটকে আসছে। আল্লাহ না করুক তার বউয়ের কিছু হলে? এর এ-র বেশি ভাবতে পারলো না রিদ। নিশ্বাস আঁটকে আসার মতোন থমকে দাঁড়ালো। বলিষ্ঠ হাত জোড়ায় কম্পন অনুভব করলো মূহুর্তে। রিদ নিজের সেই কম্পিত হাতের দিকে তাকাল। ডানহাতটা রক্তে ছুপছুপ। হয়তো তখন টেবিলের জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলার মধ্যে ধারালো কিছুতে লেগে কেটে গেছে। তাজা রক্তে ব্যথা তার অনুভব হলো না, বরং ভিষণ ভাবে বুক কাঁপলো, কলিজা নড়ছে বউয়ের বিপদের কথা শুনে। রিদের এতোদিন মনে হতো বউকে শুধু সে পছন্দ করে, রিদ চাইলে ঠিকঠাক সংসার করার মতোন, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার পুরো দুনিয়া ঘুরে এই মেয়ের আগে-পিছু। এই মেয়ের শূন্যতা সে নিতে পারবে না। রিদের স্বাধ্যের বাহিরে বউকে হারিয়ে বাঁচা। অস্থির, উত্তেজিত রিদের কন্ঠে স্বর কমে আসল অসহায়ত্বে, এই প্রথম মনে হলো রিদ অসহায়। ভিষণ ভাবে অসহায় এই নারীর সামনে। তার ক্ষমতা, টাকা পয়সা কিচ্ছু কাজে দিচ্ছে না। সে পারছে বউকে সেইফ করতে। অস্হির রিদ ব্যাকুলতা চেপে ধীর গলায় মায়াকে শুধাল…

‘ জান! জান! রিলাক্স! এইতো আমি আছি। কিছু হবে না তোমার। শুধু একবার ঠান্ডা মাথায় বলো তুমি কোথায় আছো? আশপাশটা চেনার চেষ্টা করো জান।

রিদের নরম স্বরের পিছনে তীব্র অস্থিরতার ঠাহর করতে পারলো না ফোনের ওপাশের থাকা মায়া। বরং একই ভাবে ফুঁপানো গলায় মায়া বলল…

‘ আমি জানি নাতো কোথায় আছি। আশেপাশে কিচ্ছু চিনতে পারছি না অন্ধকারে। আমাদের কলেজ বাস আমাদের রেখে চলে গেলো অনেক আগেই। বিগত দু-ঘন্টা ধরে আমি আর আমার এক ফ্রেন্ড এই পাহাড়ের মাঝে দৌড়াচ্ছি জঙ্গি ছেলেদের হাত থেকে বাঁচতে। এখন আর দৌড়ানোর শক্তি নেই নেতা সাহেব। আমরা দুজনই আহত। পাহাড়ের একটা গুহায় লুকিয়ে আছি। আর কতক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারব জানি না। আশেপাশে জঙ্গি ছেলেগুলো আমাদের খুঁজছে। ধরতে পারলে সবশেষ। ইজ্জত আর আপনাকে দুটো হারাব নেতা সাহেব। প্লিজ আমাদের সেইভ করুন প্লিজ। প্লিজ!

মায়ার আকুতি কথায় রিদের মেজাজ খারাপে রক্ত টগবগিয়ে উঠলো রাগে রি রি করে। সে পারছে মায়াকে চিবিয়ে খেতে। তাঁর না করার শর্তেও মায়ার ট্যুরে যাওয়ার বিষয়টা রিদের মেজাজ খিচাল। হাতের কাছে থাকা কফির মগটা স্বজোড়ে ফ্লোরে ছুড়ে মারতে মারতে চিচাল রিদ।

‘ কই গিয়েছিলি তুই আমাকে না বলে? রিত! রিত! তুই আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছিস। যদি তোর কিছু হয় আমি সবশেষ করে দিব রিত। আমা…

রিদের বাকি কথা গুলো শেষ করার আগেই টুট টুট শব্দ করে মায়া কলটি কেটে যেতেই রিদের পাগলামো আরও বাড়ল। রিদ বুঝতে পারছে তার বউ খারাপ কোনো জঙ্গির হাতে পরেছে। রিদ মন মস্তিষ্ক অচলে কম্পিত হাতে দ্রুত কল মেলাল মায়াকে। অথচ রাফার ফোনের ব্যালেন্স শেষ হতেই কল কেটে গেল। মায়া হ্যালো হ্যালো বলে পুনরায় সময় ব্যয় না করে রিদকে কল করতে গিয়ে বুঝতে পারলো ফোনে ব্যালেন্স না থাকার বিষয়টি। বিপদজনক অবস্থায় মায়াকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না তার আগেই উচ্চস্বরে মুঠোফোনটি ভেজে উঠলো অন্ধকার নিস্তব্ধতা কাটিয়ে। ফোন সাইলেন্ট না থাকায় সেই শব্দ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়তেই মায়া তাড়াহুড়ো করে কলটি রিসিভ করে কানে তুলতেই শুনা গেল আশেপাশের জঙ্গি ছেলেগুলোর মাঝে হৈচৈ। মায়ার ফোনের শব্দে তাদের কানে ততক্ষণে পৌঁছে গেল। এবং সেই শব্দ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছেলেগুলো একত্রে হয়ে খোঁজ করলো মায়াদের। ভাগ্য খারাপ হওয়ায় মায়া রিদের কল রিসিভ করে হ্যালো বলার আগেই গুহার বাহিরের উপস্হিত পেল সেই ছেলেগুলোর। আতঙ্কিত মায়া রিদের ফোনটি রিসিভ করেও চুপ করে রইলো ভয়ে। জড়সড় অবস্থায় গুহার ভিতরে সিটিয়ে বসতেই ফোনের ওপাশে রিদের অস্থির অনবরত ডাকাডাকি শুনতে পেল। মায়া রিদের ফোন দু’হাতে মুঠোয় চেপে চুপ করে যেতেই গুহার বাহিরে জঙ্গি ছেলেগুলোর হৈচৈয়ের কথা শুনা গেল। ঝরঝরে চট্টগ্রামের ভাষায় বলতে শুনা গেল একে অপরকে…

‘ এই খোঁজ! খোঁজ! ফোনের আওয়াজটা এদিকটায় থেইক্কা আইছে। মাইয়া দুইডা মনে হয় আশেপাশেই কোনোখানে লুকাইয়া আছে। তাড়াতাড়ি খোঁজ। শালী দুইডারে পাইলে জীবনের কষ্ট দিইয়া মারুম।

মারুফ নামে ছেলেটির কথায় তৎক্ষনাৎ শ্রায় জানাল তিতাস নামের হ্যাঙলা পাতলা ছেলেটি। মায়ার উপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলতে লাগল…

‘ হ ভাই! নতুন মাইয়াডারে একটু বেশি কষ্ট দিতে হইব। হেতি আমাগো শাফিনের অবস্থা খারাপ কইরা দিছে। হের মাথাডা ফাটাইয়া ভাগ ভাগ করে দিছে। এই মাইয়া বহুত চালাক। আমাগো এতো দৌড়ের উপরে রাখছে এই মাইয়াডাই।

‘ এই শালীরে আগে ধরমু সবাই মিলে। কষ্ট কারে কই সব আজকে রাতেই বুঝবো। এই শালী আশেপাশেই কোনোখানে লুকাইয়া আছে। তোরা তাড়াতাড়ি খোঁজ
আবার পালাইবার আগে।

ছেলেগুলো চিল্লাচিল্লি কথা ফোনের ওপাশের রিদের কানেও পৌঁছাল। এই প্রথম আতঙ্কে রিদের বুক কাঁপল থরথর করে। মনে হলো রিদের দুনিয়ার ঘুরছে, থমকে যাওয়ার মতোন রিদের দুনিয়াটা শেষ হয়ে যাবে মূহুর্তে। রিদ তার কিছুই করতে পারবে না। তার বউ বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আর রিদ ঢাকায় নিজের বাড়িতে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌছাতে রিদের যতোটা সময় লাগবে ততক্ষণে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। তাঁর বউকেও চিরতরে হারিয়ে ফেলবে। হারানো ভয়ে রিদের সমস্ত কায়া নাড়িয়ে কেঁপে উঠলো শরীর। দূর্বলতায় শরীরের শক্তি খুইয়ে পরতেই পাশের টেবিলটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। ফোনটা কানে চেপে কম্পিত স্বরে রিদ বলল…

‘ আমার জন্য নিজেকে কিছুক্ষণ সেইফ রাখতে পারবে বউ? ওয়াদা করছি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করাব না তোমাকে। তোমার জামাই সুপারম্যান হয়ে হলেও পৌঁছাবে তোমার কাছে। শুধু একটুখানি রক্ষা করবে নিজের জান?

রিদের দূর্বলতার ভাষা মায়ার কান্নার কারণ হলো। অসাবধানতার বশে ফের ফুপিয়ে কেঁদে উঠতেই বাহিরের ছেলেগুলো ঠাহর করতে পারলো মায়াদের উপস্থিতির ঠিকানা। হৈচৈ ছেলেগুলো গুহার সম্মোহে আসতেই মায়া রিদের কথা উত্তর করার আগেই আতঙ্কে ফোন হাতে নিয়েই অপর হাতে রাফা হাতটা চেপে গুহার ভিতরের পথে হামাগুড়ি দিয়ে প্রাণপূর্ণ দৌড়াল বাহিরের রাস্তায়। ততক্ষণে ছেলেগুলো বন্ধ গুহার মুখ খুলল মায়ার ঢেকে দেওয়া গাছপালা টেনে সরিয়ে। হামাগুড়ি দিয়ে বসে সবার ফোনের আলো গুহার ভিতরের ফেলতেই দেখল মায়া রাফাকে নিয়ে গুহার ভিতরের পথে চলে যেতে। হৈচৈয়ের চিৎকারের মারুফ ছেলেটি আগে চেঁচাল। সবার উদ্দেশ্যে বলল…

‘ এইতো শালী দুইডারে পাইছি। এইবার যাইব কই? ধরা তো পড়বোই।এই তিতাস তুই পলাশরে নিইয়া গুহার ভিতরে ঢোক। আর আমি, রাসেল, সুজন, রতন, মানিক এই গুহার শেষ মাথায় গিইয়া দাঁড়াই। শালী দুইডা বাইর হইলেই কেল্লা ফতে। এই চল চল সবাই। মাইয়া দুইডা বাইর হইবার আগেই ধরতে হইব।

মারুফ ছেলেটির কথায় তৎক্ষনাৎ তিতাস আর পলাশ নামক ছেলেটি গুহায় ঢুকল মায়াদের পিছন পিছন। বাকি ছেলেগুলোও অন্ধকার রাস্তা দৌড়াল গুহার শেষ রাস্তার দিকে। যেটা দিয়ে মায়াদের বের হওয়ার কথা। চারদিক থেকে বিপদে ঘিরা মায়া তখনো প্রাণপূর্ণ চেষ্টা করছি দ্রুত বের হতে। এই গুহার যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ বিপদ। আতঙ্কিত মায়া, রাফা অনুভব করলো ওদের পিছন পিছন জঙ্গি ছেলেগুলোও প্রবেশ করেছে গুহায়। বাঁচতে হলে ওদের এই মূহুর্তে কি করতে হবে জানা নেই। তবে মায়া যেকোনো বিনিময়ে নিজের ইজ্জত খইয়ে মরতে চাই না। মরার হলে সে এমনই মরবে। মুঠোফোনে রিদের কলটি অনেক আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে যথেষ্ট নেটওয়ার্কের সংযোগ না থাকায়। রিদ মায়াকে বারবার কল দিবে সেটা মায়া জানে। কিন্তু মায়ার কিছুই করার নেই। এই মূহুর্তে মায়া প্রাণ বাঁচানো দায়ে দৌড়াচ্ছে না বরং ইজ্জত খুয়ানো ভয়ে পালাচ্ছে। ভাগ্যক্রমে গুহার শেষ মাথায় আসতেই মায়া দেখলো এই গুহার দুটো সরো পথ দু’দিকে চলে গেল। প্রথম অবস্থায় মায়া বুঝল না ডানদিকে যাবে নাকি বামদিকের রাস্তায় যাওয়া উচিত। সময় নষ্ট না করে অনবরত আল্লাহ নাম নিতে নিতে ঘুরে গেল বামের রাস্তায়। ভাগ্য সহায় হওয়ায় সেইফলি গুহার থেকে বের হতেই দেখল ওদের থেকে অনেক দূরে গুহার অপর মুখে সবাই উৎপেতে দাঁড়িয়ে মায়া-রাফাকে ধরতে। আতঙ্কিত রাফা কিছু বলবে তার আগেই হঠাৎ পায়ে টান অনুভব করতেই দাঁড়িয়ে থাকা রাফা উল্টে পরলো মাটিতে। রাফার চিৎকারে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলো মায়াদের দেখতে পেয়ে হৈচৈয়ে এইদিকটায় দৌড়ালে, মায়া দ্রুত রাফাকে টেনে ধরতে চেয়ে বুঝতে পারলো গুহার ভিতরে থাকা তিতাস ছেলেটি রাফার পা আঁকড়ে ধরে আছে যেতে না দিয়ে। তাড়াহুড়োর মায়া কি করবে বুঝতে না পেরে হাতে কাছে যা পেল তাই ছুড়ে মারলো গুহার ভিতর। পাহাড়ি লাল বালু মুঠো ভরতি নিয়ে অনবরত ছুঁড়ে মারায় মূহুর্তে চেঁচাল তিতাস আর পলাশ নামক ছেলে দুটো। মায়ার হঠাৎ বালুর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না তারা। নিজেদের চোখ বাঁচাতে রাফার পা ছেড়ে দিতেই মায়া রাফাকে টেনে তুলে ফের দৌড়াল পাহাড়ের উঁচু পথে। বেখেয়ালি মায়া রাফাকে বাঁচাতে গিয়ে তাড়াহুড়ো হাতের ফোনটা সেখানে ফেলে আসল। কিছুটা পথ দৌড়াতে দৌড়াতে কানে আসল ফোনের রিংটোনের শব্দ। আতঙ্কিত মায়া পিছন ঘুরে দেখল গুহার সামনে অল্প আলোয় ফোনটি বাজছে। হয়তো রিদের কল এসেছে। কিন্তু ফিরে গিয়ে ফোনটা তুলে আনার সুযোগ মায়ার আর ছিল না। ততক্ষণে মায়ার পিছনে জঙ্গি ছেলেগুলোও ছুটছিল। অসহায় মায়া হু হু শব্দ কেঁদে উঠলো। এমন অসহায় পরিস্থিতিতে মায়ার শুধু রিদের কথায় মনে পরছে। মনে হচ্ছে এই যাত্রায় মায়া বেঁচে যাক। জীবন একটা সুযোগ দিক মায়াকে ওর স্বামীর কাছে ফিরে যাবার। মায়া কতো স্বপ্ন জীবনকে নিয়ে। আজ যেন সব শেষে পথে লাগছে এই অন্ধকার পাহাড়ের পথে দৌড়িয়ে। উদ্দেশ্য বিহীন মায়াদের দৌড় শেষ হলো উঁচু পাহাড়ের শেষ প্রান্তে এসে। এখান থেকে এগোনোর পথ শেষ। সামনে মরণের গহীন খনন। পিছনে জঙ্গির আতঙ্ক। ওদের ফিরে যাবার পথ বন্ধ। এখান থেকে ঘুরে দৌড়াতে চাইলে ততক্ষণে ধরা পরে যাবে জঙ্গি হাতে। মায়া রাফা দুজন হা করে বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে একে অপরের দিকে। দুজনের চোখেই আতঙ্ক, ভয় আর অশ্রু। এরপর কি হবে দুজনই জানে। এখান থেকে লাফ দিলে মৃত্যু নিশ্চিত। আবার দাঁড়িয়ে থাকলেও জঙ্গি হাতে ইজ্জত খইয়ে অসম্মানজনক মরতে হবে এটাও নিশ্চিত। দুইদিক থেকেই ওদের মৃত্যু নিশ্চিত। পার্থক্য শুধু পাহাড় থেকে লাফ দিলে সম্মানের সহিত মরবে আর প্রাণের ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে জঙ্গিদের হাতে অসম্মানের সহিত ইজ্জত খইয়ে মরবে। দূর্বল শরীরের দুজনের আঁকড়ে ধরা হাত গুলো অনবরত কাঁপছে। পিছন ছেলেগুলোর হৈচৈয়ের চিৎকার মায়া রাফা দুজনই ভয়ে, আতঙ্গে পিছনে তাকাল। ছেলেগুলো অনেকটা কাছে চলে এসেছে। যা করার মায়াদের এক্ষুনিই করতে হবে। মায়া যখন পাহাড় থেকে লাফ দিবার মনোস্থির করছিল তক্ষুনি আতঙ্কিত রাফা কাঁদতে কাঁদতে আকুতি স্বরে বাঁচার আহাজারি করে বলল…

‘ আমি পারব না মায়া। আমাকে দ্বারা হবে না এখান থেকে লাফ দেওয়া। আমি মরতে চাইনা মায়া। আমি বাঁচতে চাই। আমার ভয় করছে।

রাফার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরার মতোন মায়া তাকাল রাফার দিকে। একই কান্না মিশ্রিত কম্পিত স্বরে বলল…

‘ এর থেকে উত্তম আর সহজ মৃত্যু আমাদের আর হতে পারবে না রাফা। পিছনে দশটা ছেলে আছে তাদের হাতে ধরা পরা মানে বুঝিস? তাদের ভোগের কারণ হবো আমরা। তারপর তীব্র যন্ত্রা দিয়ে মারবে। এর থেকে ভালো মরতে যখন হবেই তখন ইজ্জত বাঁচিয়ে আগেই মরে যায়।

‘ আমি পারব না মায়া। প্লিজ আমাকে বাঁচা, আমি মরতে চাই না। আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল। তোর তো অনেক সাহাস। চল আবার দৌড়ায় তারপরও লাফ দিতে চাই না। আমি বাঁচতে চাই।

রাফার বাঁচার তীব্র আকুতিতে মায়ার কান্না বাড়লো। মরতে কে বা চাই? মায়া চাই মরতে? নিশ্চিত মৃত্যু মুখে দাঁড়িয়ে রাফার যেমন বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে এরথেকে বেশি মায়ার আকুতি কোনো ভাবে ওরা বেঁচে যাক। কিন্তু এরপর কিছুই করার নেই ওদের।
রিদের কথা মায়া স্মরণে আসতেই ঝরঝর করে চোখে পানি ছেড়ে দিয়ে দূর্বল গলায় বলল মায়া…

‘ তোর থেকে বহুগুণ বেশি আমার বাচার ইচ্ছে রাফা। আমি বিবাহিত। একটু আগে যার সাথে ফোনে কথা হয়েছিল সে আমার স্বামী। আমার বিপদের কথা শুনে তার পাগলামি ঠাহর আমি এখান থেকেই পেয়েছি। কাল সকালে আমরা জীবিত থাকি বা মৃত্য, আমার মৃত্য দেহটা হলেও তার কাছে পৌঁছাবে। সে আমাকে ঠিক খোঁজে বের করবে। শুধু আফসোস থাকবে তার সাথে আমার ভালোবাসার লেনদেনটা হলো না। কিছু ইচ্ছে মানুষের অসম্পূর্ণ থেকেই থাকে। আমার তোর দুজনেরই থাকবে আজ মরে গেলে। আমার তার সাথে তোর থেকে বেশি বাঁচা ইচ্ছেটা ছিল রাফা। কিন্তু বেঁচে ফিরার পরিস্থিতি আমাদের হাতে আর নেই। বর্তমানে হয় পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে জান দিতে হবে, আর নয়তো ছেলেগুলোর হাতে নিজেদের মান হারাতে হবে। অপশন দুটো। কতগুলো পাহাড়ি জঙ্গি কুকুরের ভোগবিলাসের কারণ হওয়ার চেয়ে, এখান থেকে লাফ দিয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। মরতে যখন হবেই তখন ইজ্জত নিয়েই মরবো, চল।

মায়া রাফার হাত টেনে ধরতেই রাফা ভয়ে আরও কাঁদতে লাগল। উপস্থিত মৃত্যু সামনে দেখে কেই বা মরতে চাই। বয়সে দুজনই ছোট। সতেরো বছরের কিশোরী। তাদের দুনিয়াটায় হচ্ছে রঙ্গিন। বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা নেই। উড়ুচন্ডি মনে রঙ্গিন স্বপ্ন চোখে সবকিছুই ভালো লাগে। এই বয়সে মেয়েরা রঙ্গিন দুনিয়ার বাঁচার আকাঙ্ক্ষার বহুবছরের দেখে। সেখানে হুট করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার বুকফাটা আর্তনাদের কারণ। মায়া বুঝানো রাফার কাজে দিল না। সে মূলত মরতে চাই না বাঁচতে চাই। কিন্তু কিভাবে বাঁচবে জানা নেই। মায়া একহাত সে নিজের দু’হাতে চেপে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের শেষ পিষ্টে। বাঁচা মরার টানাটানিতে ততক্ষণে ছেলেগুলো মায়াদের ছুঁই ছুঁই। দশবারো কদম দৌড়ালেই হাতের লাগালে। কিন্তু এই অবস্থায় মায়া রাফাকে নিয়ে লাফ দিতে পারছে না। কারণ রাফা নিজে যেমন লাফ দিচ্ছে না তেমনই মায়াকেই দিতে দিচ্ছে না। শক্ত হাতে মায়াকে চেপে আছে। জোড়াজুড়িতে মায়া ভিষণ আতঙ্কিত হলো। সামনে ছেলেগুলো হাতে একবার ধরা পরলে সবশেষ। কিন্তু রাফাকে কে বুঝাবে এসব? মায়া আবারও ঘুরে পাহাড়ের তলদেশের অন্ধকার গহীনতা তাকাল। পর মূহুর্তে ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেগুলোর অবস্থান নিজেদের কাছে ঠাহর করতে পেরেই মায়া রাফার দিকে তাকাল। এই মূহুর্তে মায়ার ইচ্ছা করছে রাফাকে দুগালে কতক্ষণ চড়াতে। মায়াকে আটকিয়ে মরার থেকে বাঁচতে পারবে এই মেয়ে? নাকি নিজেদের জন্য আরও বিপদ বাড়াচ্ছে। আতঙ্কিত মায়া কি করবে বুঝতে না পেরে হঠাৎ করেই রাফার হাত কামড়িয়ে ধরলো নিরুপায় হয়ে। ভয়ার্ত রাফা ব্যথা চিৎকার করে উঠতেই সেই সুযোগে মায়া রাফাকে নিয়ে তৎক্ষনাৎ লাফ দিল পাহাড়ের চূড়ায় হতে। মায়াদের লাফের সাথে সাথে আতঙ্কিত মুখে চেঁচাল বাকি ছেলেগুলো। দৌড়ে মায়াদের অবস্থানের দাঁড়িয়ে হাফাতে হাফাতে তাকাল পাহাড়ের অন্ধকার তলদেশে। ভয়ার্ত মুখে তাঁরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়িও করলো। মূলত তাদের ধারণাতে ছিল না মেয়ে দু’টো হুট করে পাহাড় থেকে ঝাপ মারবে। এই পাহাড়ি এলাকায় জায়গা জায়গা চেনা তাদের তারা হলফ করে বলতে পারবে মেয়ে দুটো এই খানে ঝাপ দিয়ে নিজেদের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। এদের মাঝে ছেলেগুলোর সরদার মারুফ লোকটা রেগেমেগে গালি ছুড়ল মায়াদের উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ সময় দৌড়ানোতে হাফাতে হাফাতে বলল….

‘ শালী বাচ্চারা মরার আর সময় পাইলো না। এতো উঁচু থেকে পরে নিশ্চয়ই এতক্ষণে দেহ ছিঁড়ে ভাগ ভাগ হয়ে গেছে পাহাড়ী গাছের ঢালে। ফ্রীতে বনশেয়ালের খাবার হইল। তারপরও আমাদের ধরা দিল না। কু**** জাত

মোটা করে রতন ছেলেটা একই ভাবে হাফাতে হাফাতে বলল….

‘ ভাই যদি মাইয়া দুইডা না মরে এখান থেইক্কা পড়য়া?

‘ হু মরবো নাতো কি করবো? এলাকায় সবচেয়ে বিপদসংকেত এরিয়া হইল এইদিকটা। দিনের বেলায় মানুষের এই এরিয়াতে ঢোকা নিষেধ। আর রাতের বেলা মাইয়া দুইডা এতো উপর থেকে ঝাপ দিইয়া মরবো নাতো বাঁচবো তোর মনে হয়? এরপরও যদি না মরে তাইলে নিচে ঝাওবনে আমাদের থেকেও হিংস্র ডাকাত দল বাস করে। কমে হলেও তারা তিনশো বেশি হইব। আমরা দশজন মাইয়া দুইডা ভোগ করতাম। এহন তিনশো ডাকাতদল ভোগ করবো। শালার আমাদের ভাগ্যটায় খারাপ শিকার করলাম আমরা মজস লইবো অন্য কেউ ধুর। চল!
~~

বিগত তিনঘন্টা ধরে পাহাড়িয়ান রাস্তার অলিগলি ধরে পাগলের মতোন মায়াদের খোঁজ করে যাচ্ছে আরিফ, রাকিবের সঙ্গে কলেজে মায়াদের সিনিয়র কিছু ছেলেপেলে। তখন মায়া রাফার নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ত্রিশ মিনিট পর জানতে পারলো মায়া গাড়িতে নেই। জুই শ্রেয়া পাশ থেকে উঠে নিজেদের সিটে গিয়ে বসতেই দেখল মায়া নেই পাশে। মায়ার কথা মাথায় আসতেই জুই তাড়াহুড়ো উঠে দাঁড়িয়ে পুরো বাসে চোখ বুলিয়ে কোথাও মায়াকে দেখতে না পেয়ে চেচামেচি করে জানাল মায়া বাসে উঠেনি। আরিফ তখন ক্লান্তিতে বাসের পিছনের সিটে বসে ঝিমচ্ছিল, জুইয়ের চিৎকারে হঠাৎ মস্তিষ্ক তড়াক করে জেগে উঠে মায়ার মিসিংয়ের ব্যাপারটা শুনে। অবিশ্বাসের মতো তৎক্ষনাৎ এগোল। মায়ার খোঁজ করে যখন পুরো বাসে হৈচৈ পরে গেল তখন বুঝতে পারলো মায়া সত্যিই মিসিং। আরিফের পুরো দুনিয়া ঘুরে উঠার মতোন চক্র কাটলো। এতোকরে বোনদের চোখে চোখে রেখেও শেষ পযন্ত বোনকে হারিয়ে ফেলল কিভাবে? আরিফ আতঙ্কিত ভঙ্গিতে চিল্লাচিল্লি করে দ্রুত বাস থামিয়ে বাকি বাসগুলোতেও মায়ার খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারে রাফা নামের আরও একটা মেয়েও মিসিং আছে বাস থেকে। রাফার বান্ধবী চৈতী জানায় সেটা। চৈতী মনে করেছিল রাফা অন্যবাসে আছে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড সোহানীর সাথে কিন্তু মায়ার নিখোঁজের সাথে সাথে বুঝল রাফাও গায়েব। পরপর চারটে বাসই থামে পাহাড়ি রাস্তার মাঝে। হৈচৈয়ে সকল স্যার সিনিয়ররা গাড়ি থেকে নেমে পরলো টেনশনে। এতো রাতে মেয়ে দুটো কোথায় যাবে? উনারাই বা কোথায় ফেলে এসেছে মেয়ে দুটোকে। এতো কঠোর নজরদারি পরও এতো বড়ো দূর্ঘটনার জন্য কলেজের কর্তৃপক্ষের কৈফিয়তদারী করতে হবে এরজন্য। মেয়ে দুটো সহিসালামত না পেলে থানা-পুলিশ ঝামেলা বাড়বে, কলেজের বদলাম। টেনশনে একেকজন টিচার্স ঘেমে জবজব হলো। আতঙ্কিত দেখাল একেকজনের ফেইস। সবাই ধারণা করলো লাস্ট যখন তারা খাবার হোটেলে বাস থামিয়েছিল তখন হয়তো মেয়ে দুটো সেখানে রয়ে গেছে। ধারণা অনুযায়ী তাই হলো জুই জানাল মায়া ওকে বাহিরে যাবা কথা বলে বাস থেকে নেমে ছিল তখন। তাড়াহুড়ো আরিফ বাকি টিচার্সসহ তখনকার হোটেলের মেনেজারকে কল দিয়ে জানতে চাইল তাদের হোটেলে কলেজ শিক্ষার্থী দুটো মেয়ে পাওয়া গেছে কিনা? বা আশেপাশে খোঁজ নিতে। অল্প সময়ে হোটেলের মেনেজার জানায় সেখানে আপাতত কলেজ শিক্ষার্থীদের মতোন কেউ নেই। যদি এমন কেউ তাঁরা পাই তাহলে অবশ্যই জানাবে আরিফদের। অতিরিক্ত টেনশন থেকে আরিফের মাথা চক্কর দিয়ে উঠতেই পাশ থেকে রাকিব, আর আরিফের বন্ধু দিহান ঝাপটে ধরলো আরিফকে। ধরাধরি করে আরিফকে রাস্তায় বসাতে চাইলে আরিফ অস্থির গলায় কলেজ সহকারী অধ্যাপককে বলল….

‘ আমাকে একটা টিমের ব্যবস্থা করে দিন স্যার। আমি আমার বোনকে খোঁজবো। আপনি বাকি শিক্ষার্থীদের নিয়ে আপাতত চলে যান। দরকার হলে সকালে আবার আসবেন। ততক্ষণে আমরা এইদিকে আর্মি ক্যাম্পে যোগাযোগ করছি। তাঁরা আমাদের সাহায্য করবে মিসিং কেইসে।

আরিফের কথায় সেচ্ছায় একদল ছেলে আলাদা হয়ে এগিয়ে আসল আরিফের সাহায্যের জন্য। দশ-পনেরো জনের একটা টিম হয়ে পুনরায় হোটেলের দিকে যেতে চাইলে গাড়ির সংকীর্ণতার জন্য আটকে গেল। রাত তখন ১০ঃ৫৫ ঘরে।
এতো রাতে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি খোঁজে পাওয়া মুশকিল। সেজন্য পুনরায় বাসগুলো আবারও আরিফদের নিয়ে হোটেলে রাস্তায় গেল। সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি পৌঁছালও সেখানে। সকল স্টুডেন্টর গাড়িতে লক করে তাড়াহুড়ো নামল আরিফসহ বাকি টিচার্সরা। সকলেই আশেপাশে খোজ নিয়ে দেখল সত্যি মায়াদের উপস্থিতি সেখানে কোথায় নেই।
চৌদ্দ সদস্যের টিম মেম্বারদের জন্য হোটেল থেকে টচলাইট সংগ্রহ করে সবপ্রথম আরিফ যেতে চাইল আর্মি ক্যাম্পে। সেখান থেকে আর্মিদের সাহায্যে পাহাড়ের বুকে চড়বে মায়াদের খোঁজতে। এতোকিছু মাঝে মায়ার টেনশনে টেনশনে আরিফ জুইয়ের কথা ভুলে বসল। সে বের হয়ে যেতে গিয়েও থেমে গেল দ্বিতীয় বোনের কথা ভেবে। তাড়াহুড়ো আরিফ চলে যেতে গিয়েও ফিরে আসল জুইয়ের কথা ভেবে। আরিফ চলে গেলে এতো রাতে একা জুইকে কার কাছে দিয়ে যাবে? মায়া নেই, আরিফ নেই, জুই এতো রাতে কার কাছে থাকবে? বাসগুলো পুনরায় মুরাদপুরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত দুটোর উপর হবে। এতো রাতে একা মেয়ে হয়ে জুইয়ের পক্ষে সম্ভব হবে না বাসায় গিয়ে একা উঠার। আবার আরিফের সঙ্গেও এতো রাতে পাহাড়ি এলাকায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। ওরা জানে না সামনে কি হবে? কোন বিপদ থেকে কোন বিপদে পরে তাঁরা। উত্তেজিত আরিফ এগিয়ে এসে জুইয়ের দায়িত্ব দিয়ে গেল অন্য একজন টিচার্সের কাছে। হাতজোড় করে রুকিয়া ম্যাডামকে বলে গেল তাঁর বোনকে দেখে রাখতে। অন্তত আজরাতটা জুইকে উনার বাসায় রাখতে কাল সকালে আরিফ গিয়ে নিয়ে আসবে। জুইকে সেইফলি রেখে যেতেই আরিফ সকলকে নিয়ে চলল আর্মি ক্যাম্পে। পাহাড়ের বুকে চড়তে হলে অবশ্যই তাদের ট্রেনিং প্রাপ্ত একজন ট্রেনার লাগবে। যে তাদের পাহাড়ি পথের নিদর্শনা দিবে। আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাবে। সেটাও সংগ্রহ করলো হোটেল থেকে একজনকে। আর সেই ট্রেনারের সাহায্যে প্রথম গেল আর্মি ক্যাম্পে। মিনতি করার মতোন তাদের কাছে সাহায্য চাইলে তাঁরা জানাল সকালে আগে তারা কিছুই করতে পারবে না। এতো রাতে তাদের দ্বারা কিছু সম্ভব না। আইনি সাহায্য চাইলে আরিফদের অন্তত সকাল পযন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অসহায় আরিফ মায়ার টেনশনে সময় ব্যয় না করে আর্মি ক্যাম্প থেকে বের হয়ে একায় চলল বোনকে খুঁজতে। সঙ্গে তাদের পনেরো সদস্যের টিমটিও ছিল। বয়স্ক ট্রেনারকে নিয়ে পাহাড়ি পথের অলিগলি চলতে গিয়ে বেশ কয়েকজনে আঘাতও পেল। তাদের মধ্যে আরিফও ছিল একজন। আশাহত আরিফ বুঝতে পারলো এই রাতে কোনো আইনি সহায়তা পাবে না তাঁরা। সাধারণ মানুষের সাহায্য কেউ করতে চাই না। মায়াকে হারিয়ে প্রায় ঘন্টা তিনেক মতো চড়তে লাগল এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে চূড়ায়। রাত তখন একটার ঘরে। আরিফের টিম মেম্বার যখন মায়াদের খোজাখুজিতে ব্যস্ত তখনই দেখা গেল পাহাড়ি রাস্তার বুকে ছিঁড়ে উজ্জ্বল আলোয় কতোগুলো ট্রাকে উপস্থিতি। হৈচৈ আর চিৎকারের ভয়ংকর প্রতিধ্বনি হচ্ছে আশপাশটা। পাহাড়ের উপর থেকে সবাই রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখল বেশ কয়েকটা ট্রাক একত্রে এইদিকটায় আসছে। সবগুলো ট্রাকে মাল- বা অন্য কিছু নেই। বরং ট্রাক ভরতি অসংখ্য ছেলেদের উপস্থিত। প্রত্যেকের হাতে টচ, হকিস্টিক আর দা নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করছে ক্ষেপ্ত ভঙ্গিতে। কাউকে কুপিয়ে মারা তেজ। এতো কিছু মাঝে আরিফ বা ওদের টিম বুঝলো না চোখে পলকে এতোগুলা ট্রাকে, এতো মানুষ কোথায় থেকে আসল? কেনই বা আসল? এই পাহাড়ি বুকে তাদের কি কাজ? দেখতে দেখতে মূহুর্তে মাঝে সবগুলো ট্রাক রাস্তায় পরপর দাঁড় করাতেই ট্রাক সবাই হৈ-হুল্লোড় চিৎকার চেচামেচি করে লাফে নামতে লাগলো ক্ষিপ্ত ছেলেগুলো। সবার হাতে হাতে দা, হকিস্টিক আর উজ্জ্বল আলোর টচ বিদ্যমান। চোখের পলকে রকেটের গতির মতো দেখতে দেখতে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো পাহাড়ের বুকে। হুট করে এতোগুলো মানুষের উপস্থিত দেখে আরিফ আশ্বস্ত হয়ে তাদের কাছে সাহায্যের জন্য এগোতে চাইল। নিজেদের গতিপথ বদলিয়ে গেল নিচে। পাহাড়ের তলদেশে নামতে নামতে দেখলো দলবেঁধে আরও অনেকটি ট্রাক উপস্থিত হচ্ছে সেখানে। সবগুলো ট্রাকেই মানুষের একই রকমের হৈচৈ আর চিল্লাচিল্লি কলরব শুনা যাচ্ছে। রাকিব বোকার মতোন দাঁড়িয়ে থেকে সবগুলো ট্রাক গুনতে চাইল। ওর ধারণা মতে না হলেও বিশটা ট্রাকে উর্ধে হবে লাইন বেঁধে চলছে একটার পর একটা। একটা ট্রাকে কম করে পঞ্চাশজন মানুষ দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় আছে তাহলে বিশটা ট্রাকে একহাজার জন মানুষ হবে। এতো মানুষ, এতো রাতে কোথায় থেকে আসল? তাঁরা এতো ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে পাহাড়ের বুকে কি খোঁজছে? রাকিবের মতো কি ওদের কেউ মিসিং নাকি? নির্জন এলাকায় হুট করে অসংখ্য মানুষের আভাস পেয়ে বুক ভরা আশা নিয়ে তাড়াহুড়ো সেদিকে দৌড়ে গেল আরিফ, রাকিবসহ তাদের দল। হকিস্টিক হাতে ছেলেগুলোর কাছাকাছি যেতেই ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে প্রায় একদল ছেলে আক্রমণ করে বসল আরিফদের। উত্তেজিত পরিস্থিতিতে হুট করেই কেউ কারও চেহেরা দেখা সময় পায়নি। কিন্তু চোখে পলকে একদফা মার আরিফদের উপর দিয়ে চলে যেতেই হঠাৎ পরিচিত কন্ঠের রাহাত সবাইকে ঠেলে থামিয়ে দিতে দিতে চিৎকার করে বলল…

‘ এই দাঁড়া দাঁড়া আর মারিস না। এটা আমাদের আরিফ ভাই। উনিও হয়তো ভাবিকে খোঁজতে এসেছে আমাদের মতো। থাম! থাম! তোরা থাম।

হাতে ঠেলে সবাইকে থামাতে থামতে লাঠির আঘাত বেশ আহত হলো সবাই। টচ লাইটের আলো আরিফদের উপর পরতেই বুঝলো তাঁরা সবাই অতি পরিচিত মানুষ। আরিফ নিজের এলাকার পরিচিত রাহাত ও তাদের সঙ্গীদের দেখে উত্তেজনায় ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো খুশিতে। এই বিপদের সময় এই বুঝি মায়াকে খুজতে সবাই সাহায্য করবে ওর। আরিফ কিছু বলার আগেই রাহাত আরিফকে আশ্বস্ত করে বলল…

‘ চিন্তা করবেন না ভাই। ভাবির কিচ্ছু হবে না আমরা সবাই আছি। পুরো পাহাড় ছেঁকে হলেও ভাবিকে খোঁজে বের করবো। শুনলাম ভাবির সাথে নাকি আরও একটা মেয়ে মিসিং আছে?

রাহাত কাকে ভাবি ডাকছে তখনও বুঝল না আরিফ। আরিফের ধারণা মায়ার সাথে যে মেয়েটা আছে তাকে হয়তো রাহাত ভাবি ডাকছে। সেজন্য আরিফ রাহাত শুধিয়ে ছাড়তে ছাড়তে বলল…

‘ তোমাদের ভাবির সাথে আমার বোন মায়া মিসিং। প্লিজ তোমরা আমাদের সাহায্য…

আরিফকে বলতে না দিয়ে রাহাত পুনরায় বলল…

‘ আপনি চিন্তা করবেন না, আমরা ভাবির জন্যই এসেছি আরিফ ভাই। ঢাকা থেকে ভাইও আসছে। ভাবিকে আমরা অবশ্যই খোঁজে পাব ইনশাআল্লাহ।

আরিফ কিছু বলার আগেই দেখল সেখানে একে একে উপস্থিত হলো, আর্মি, রেব, ফোর্সের দলবেঁধে গাড়ি লাল-নীল সিগ্ন্যাল জ্বালিয়ে। কে বা কারা আর্মি, রেব বাহিনীকে খবর দিল আরিফ জানে না। তবে এর পিছনে অবশ্যই ক্ষমতাধর কারও হাত আছে। নয়তো যেখানে আরিফ একঘন্টার মতোন সময় ব্যয় করেও একটা আর্মির সদস্যকে রাজি করাতে পারলো না ওদের সাথে আসার জন্য। সেখানে বন্দুক হাতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে দলে দলে আর্মি, আর কালো পোষাক দারি রেব বাহিনী চলে আসল মায়াদের খোঁজতে? আরিফ, রাকিব শুধু বোকার মতোন দাঁড়িয়ে রইল। মূলত তাঁরা বুঝতে পারছে সবাই মায়াদের খোঁজে এসেছে। কিন্তু কে এতো বিশাল ক্ষমতাধর আয়োজন করলো দুটো মানুষকে খুঁজতে? আরিফের নিজের ভিতরের কৌতূহল চেপে সবাই সাথে পাহাড়ের চূড়ায় চলল মায়াদের খোঁজে। অল্প সময়ের ব্যবধানে অন্ধকার পাহাড়ি এলাকা হয়ে উঠলো দিনের আলোয় নেয় উজ্জ্বল। পাহাড়ি গাছ-গাছালিতে থেকে মানুষের কলরবের শব্দ বেশি। একত্রে হাজার হাজার মানুষের আগমনে বন পশুগুলোরও ভয়ার্ত চিৎকার শুনা গেল চারদিকে। চোখের পলকে পাহাড়ের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া আর্মি, রেব, আর রিদের পাঠানো হাজার হাজার ছেলেপেলে। দূর থেকে যে -কেউ দেখলে বলে দিতে পারবে পাহাড়ের বুকে কোনো কিছুর অভিযান চলছে জড়োসড়ো। চারদিকে শুধু আলোর মেলা। সেখানে অল্প সময়ের ব্যবধানে অন্ধকার আকাশে দেখা গেল উজ্জ্বল আলোর কতোগুলো হেলিকপ্টার। এতে কে বা কারা আছে আরিফরা বাদে সবাই জানে। রাত তখন ১ঃ২৮ ঘরে। তুমুল শব্দ করে হেলিকপ্টারের পাখার রাউন্ড রাউন্ড ঘুরে নামলো পাহাড়ী উম্মুক্ত রাস্তায়। পাখার তীব্র বাতাসে উপস্থিত মানুষ হতে পাহাড়ের ছোট বড় গাছ-গাছালীর ডাল-পাতা নুইয়ে নুইয়ে পড়ছে একে অপরের গায়ে। আশেপাশে মানুষজনের দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠতে সবাই দূরে গিয়ে দাঁড়াল হেলিকপ্টার থেকে। তীব্র গমগমে শব্দে পরপর নয়টি হেলিকপ্টার নামলো একই পাহাড়ি রাস্তায়। প্রথম হেলিকপ্টার থেকে রিদের সাথে আসিফকে লাফিয়ে নামতে দেখা গেলেও বাকি আটটা থেকে বন্দুক হাতে বডিগার্ডদের লাফিয়ে বের হতে দেখল সবাই। রিদকে দেখেই আরিফ বুঝতে পারলো এসব ক্ষমতার উৎস কোথায় থেকে এসেছে। হয়তো রাফা নামের মেয়েটির সাথে রিদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকতে পারে ভেবেই আরিফ রিদকে নিয়ে এতো মাথা ঘামাল না। তার এই মূহুর্তে বোনকে দরকার। সেজন্য আরিফ রিদকে দেখে এগিয়ে গেল সামনে। উদ্দেশ্য রিদকে জানাবে তার বোন মায়াও মিসিং রাফার সাথে। উত্তেজিত রিদ হেলিকপ্টার থেকে লাফিয়ে নামতেই আর্মি, রেব ফোর্সের দুজন কমান্ডার এগিয়ে আসল রিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে। অস্থির, উত্তেজিত রিদের মেজাজ বুঝা দায়। হিংস্রত্ব রাগে চোখের পাটা ফুলে আছে লাল লাল হয়ে। ঘায়েল বাঘের নেয় হিংস্রত্বে গর্জন ছাড়বে যেকোনো সময়। দৃষ্টিতে সেকি তেজ কিন্তু মুখে ভাষা নিশ্চুপ। কালো শার্টের হাতাগুলো টেনে গুটাতে গুটাতে সামনে এগোতেই পিছন থেকে আসিফ একটা বন্দুক এগিয়ে দিতেই সেটা দক্ষ হাতে তুলল রিদ। ডানহাতে বন্দুক চেপে বামহাতে ট্রিগার পয়েন্ট টানতেই পথ আটকে দাঁড়াল দুজন কমান্ডার। রিদকে আশ্বস্ত করতে চাইল তারা মেয়ে দুটোকে অতি শীঘ্রয় খোঁজে পাবে। কিন্তু ক্ষিপ্ত রিদ তাদের ভালো কথায় পোষাল না তার। মেজাজ হারিয়ে দাঁত পিষে বলল…

‘ আশেপাশে, যেখানে যাকে পাবেন সবাইকে বন্দী করুক। ছোট, বড়ো, ছেলে-বুড়ো, চোর, ডাকাত, জঙ্গি, সন্ত্রাস যাকে পাবেন, আমার সবাইকে বন্দী চাই। এই রাতে পাহাড়ের বুক থাকা একটা মানুষও যাতে পালাতে না পারে সেটা সিউর করুন। আমার সবাইকে মানে সবাইকে বন্দী চাই গড ইট?

‘ হয়ে যাবে মিস্টার খান। আপনি…

‘ রিদ ভাই!

কমান্ডারের কথা শেষ করার আগেই সেখানে উপস্থিত হলো আরিফ। উত্তেজনায় কমান্ডারের কথা মাঝেই কথা বলে ফেলল রিদকে ডেকে। রিদের খিঁচে থাকা মেজাজ তড়াগ করে তপ্ত আগুনের নেয় জ্বলে উঠলো আরিফের উপস্থিতি দেখে। মেজাজ হারিয়ে মূহুর্তে মাঝে হিংস্র বাঘের নেয় থাবা বসাল আরিফের শার্টের কলারে। চোখের পলকে কারও কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই পরপর শক্ত হাতে ঘুসি পরলো আরিফের নাকে মুখে। উপস্থিত সবাই থমথমে খেয়ে গেল রিদের হঠাৎ কান্ডে। আসিফ দ্রুত সবাইকে ঠেঙ্গিয়ে রিদকে ঝাপটে ধরলো আরিফকে আঘাত করা থেকে। একা আসিফ রিদকে সামলাতে মুশকিল হতে দেখে পরপর সঙ্গে সঙ্গে আরও দুজন কমান্ডার এগিয়ে এসে রিদকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো আরিফ থেকে ছাড়াতে। টানাটানি করে আরিফ হতে রিদকে ছাড়িয়ে নিতেই ভয়ংকর মেজাজে চেঁচাল রিদ। আরিফকে উদ্দেশ্য করে ফের ত্যাড়ে যেতে চেয়ে গর্জে উঠে বলল…

‘ হারামির বাচ্চা তুই থাকতে আমার বউ হারাল কিভাবে? বোনকে যদি দেখে রাখতে না পারিস তাহলে দায়িত্ব নিতে গেলি কেন? তোকে কে বলেছে আমার বউকে ট্যুরে নিয়ে আসতি? আমার পারমিশন নিয়েছিলি?

আহত অবস্থায় পুনরায় রিদের আঘাত পেয়ে নুইয়ে পরলো আরিফ। রিদ কেন আরিফকে হঠাৎ আক্রমণ করলো বুঝল না সে। রিদের সাথে আরিফদের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে সেই সুবাদে রিদ আরিফকে আঘাত করার কথা নয়। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো আরিফ রিদ খানের বউকে চিনে না পযন্ত।
তাহলে সেখানে আরিফ অন্য কারও বউকে ট্যুরে নিয়ে আসবে কিভাবে? আরিফ শুধু তার বোনদের দায়িত্বে ছিল। আর এরজন্য সে কারও থেকে পারমিশন নিবে না অবশ্যই। নুইয়ে পরা আরিফ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বামহাতে ঠোঁটের আঘাতের রক্তটা পরিষ্কার করতে করতে তাকাল রিদের হিংস্র চেহারার দিকে। রিদের বন্দুকের ট্রিগার দিয়ে আঘাত করায় বেশ কেটেছে আরিফের ঠোঁট। আরিফ ঠোঁটের রক্ত মুছতে মুছতে রিদকে বুঝাতে চেয়ে বলল…

‘ আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে ভাই। আমি আপনার ওয়াইফকে চিনি না। আমি শুধু আমার বোনের মিসিং কেইসটা আপনাকে জানাতে এসেছিলাম। আমার ছোট বোন মায়াকে তো আপনি চিনেন। ওহ আপনার বউয়ের সাথে মিসিং। আমাদের ধারণা ওরা হয়তো এই পাহাড়ি এলাকায় কোথাও আঁটকে আছে।

আরিফের ভদ্র কথায় রিদের মেজাজ যেন খারাপ হতেই থাকল। তার বউ হারিয়ে গেছে আর এখনো আরিফ বালে ভদ্রতা দেখাচ্ছে। সে যদি তার বউকে সহিসালামত না পাই তাহলে সবার আগে এই ছেলেই মারবে সে ট্রিগার পয়েন্ট রেখে। রিদ গর্জে উঠে ফের আরিফের দিকে তেড়ে যেতে চাইলে একই ভাবে বাঁধা দেয় আসিফ আর বাকি দুজন কমান্ডার। রিদ তেতে উঠে দাঁত পিষে চেঁচিয়ে বলল…

‘ তোর বালে ধারণা আছে ভদ্রলোকের বাচ্চা। তুই জানিস তোর বোন কই আছে? সে পাহাড়ি জঙ্গি ছেলেদের হাতে পরেছে। এতক্ষণে কি হয়েছে তাদের সাথে সেই ধারণা আছে তোর? করতে পারবি?

রিদের কথায় আরিফ অবিশ্বাস্য গলায় শুধালো….

‘ কিহ? আপনাকে এসব কে বলেছে?

‘ তোর বোনের ফোন এসেছি সে জানিয়ে সবটা। আরিফ দোয়া কর তোর বোনের যাতে কিছু না হয়। যদি কিছু হয় তাহলে তোকে আমি ছাড়বো না।
~~
রাত প্রায় শেষে দিকে। সময় তখন ৪ঃ২১ মিনিট। পুরো পাহাড়ি এলাকায় এতো অভিযান চালিয়েও মায়াদের খোঁজের সন্ধান পেল না কেউ। এমনকি মায়াদের তাড়ানো তখনকার সেই দশজন জঙ্গি ছেলেগুলোও ততক্ষণে আঁটকে পরেছে আর্মিদের হাতে। কিন্তু জানের ভয়ে তাঁরা কেউ মুখ খুলছে না পযন্ত। আর না এটা বলছে মায়াদের তাঁরা হোটেল থেকে তুলে এনেছিল। রিদের কথা মতো পাহাড়ের বুকে যাকে পেয়েছে সবাইকে বন্দী করেছে আর্মি, আর রেব ফোর্স। এমনকি মায়াদের তখন পাহাড় থেকে লাফিয়ে পরা বিপদজনক এরিয়াতেও রেব বাহিনীর অভিযান চালিয়ে তিনশো ডাকাত দলকে আঁটুক করেছে মায়াদের খোঁজে। বিগত চার-পাঁচ ঘন্টার অভিযান চালিয়েও দুটো মেয়ের খোঁজ কেউ দিতে পারলো না। আর না জঙ্গি ছেলেগুলো জানে ভয়ে মুখ খুলে জানাচ্ছে মায়াদের পাহাড় থেকে লাফিয়ে পরার বিষয়টি। আটকে রাখা সবার সাথে তাঁরাও কিছু জানে না বলে অজানা সাজল। জঙ্গি ছেলেগুলোর ধারণা এতো উপর থেকে মেয়েগুলো ঝাপ দিয়ে অবশ্যই মরে গেছে এতক্ষণে। সেখানে মৃত্য মেয়ে দুটো এসে বলবে না তাদের পিছনে কারা লেগেছিল তখন। জঙ্গি ছেলেগুলো যদি এই মূহুর্তে চুপ থাকে তাহলে অবশ্যই প্রাণে বেঁচে যাবে সবার। আর নয় পরিস্থিতি যে গরম দেখছে একবার ধরা পরলে প্রাণ থাকবে না কারও। ভয়ার্ত মুখে সকলে বারবার একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। বুঝতে পারলো মেয়ে দুটো কোনো সাধারণ কেউ ছিল না। ওরা ভুল জায়গায় হাত দিয়েছিল। চারদিকে না পাওয়ার ব্যর্থতা সুর শুনতে শুনতে নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ হয়ে গেল রিদ। মন মস্তিষ্ক টনটন করছে তপ্ত দহনে। বউকে না পাওয়ার ব্যর্থতা তাঁকে ঘায়েল করছে ক্ষণে ক্ষণে। এতো ফোর্স লাগিয়েও বউকে খোঁজে না পাওয়ার কারণটা ব্যাখ্যা করে তার বউ সহিসালামতে আর নেই। দূর্বল শরীরে রিদ মাথা ঘুরিয়ে খৈ হারিয়ে পরতে নিলেই পিছনের ছেলেগুলো হৈচৈ করে ধরলো রিদকে পরা থেকে। ততক্ষণে রিদ জ্ঞান হারাল। সবাই ধরাধরি করে ক্যাম্পে দিকে নিয়ে যেতেই সেখানে সারি সারি ভাবে দেখা গেল আরও কিছু গাড়ি ও পুলিশ ফোর্সের উপস্থিতি। ছেলের খবর শুনে মন্ত্রী নিহাল খানও শেষ রাতের দিকে উপস্থিত হয় সেখানে। সিকিউরিটি আরও বাড়িয়ে দিয়ে রিদের খোঁজ করলো। রিদকে তাবুতে দূর্বল অবস্থায় বেহুশ হয়ে পরে থাকতে দেখে আতঙ্কে বসল রিদের পাশে। উনার এতো বলিষ্ঠবান ছেলেকে কখনো দেখেনি দূর্বল হয়ে জ্ঞান হারাতে। আজ প্রথম দেখল উনার ছেলে জ্ঞান হারিয়েছে। বাবার মনটা যেন হু হু করে উঠলো রিদের টেনশনে। ডাক্তার ব্যবস্থা ছিল তাবুতে। পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালাতে গিয়ে যদি কেউ আহত হয় তাহলে তার সুষ্ঠু চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের ব্যবস্থা করে রেখেছিল আসিফ। নিহাল খান রিদের পাশে বসতেই আরিফ সবটা জানাল তাঁকে, কেন তাঁরা এখানে এসেছে। মায়াকে নিয়ে সবকিছু না বললেও এতোটা জানায় রিদের সাথে মায়ার একটা হালাল সম্পর্ক আছে। চতুর দাম্ভিক নিহাল খানকে আর কিছু ভেঙ্গে বলতে হয়নি আসিফের। চট করে বুঝে গেল ছেলের দূর্বল হয়ে জ্ঞান হারানোর কারণটা। নারীর টানে বলিষ্ঠ থেকে বলিষ্ঠবান পুরুষকেও মূহুর্তে দূর্বল হতে দেখেছে তিনি। উনার ছেলেতো কিছুই না। রিদকে ঘুমের ইনজেকশন দিতেই নিহাল খান নিজে দায়িত্ব নিল সবকিছুর। বাকি রাতটা তিনি বিরতিহীন ভাবে দাঁড়িয়ে মায়াদের খোঁজের অনুসন্ধান করলো। কিন্তু ফলাফল তখনো শূন্য। রিদের জ্ঞান ফিরে প্রায় তিন ঘন্টা পর। সকাল তখন সাতটার ঘরে। খালি মস্তিষ্কের তারাক করে উঠলো কয়েক সেকেন্ড পরপরই। শিট!শিট! শিট! বলে চেঁচিয়ে পাগল পাগল হয়ে বের হলো তাঁবু থেকে। আশেপাশে পরিবেশটা সেই রাতের মতোন গমগমে আর উত্তেজিত দেখে বুঝল তাঁর বউকে এখনো খুজে পাইনি। নিহাল খান তাঁবুর বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিল। রিদকে জেগে উঠতে দেখে তিনি এগিয়ে আসল। রিদের চঞ্চল দৃষ্টি আর অস্থির বাচনভঙ্গি দেখে তিনি নিজ থেকেই রিদকে জানাল মেয়ে দুটোর নিখোঁজ থাকার বিষয়টি। নিস্তব্ধ রিদ হুম, হা কোনো শব্দ করলো না। শুধু নিশ্চুপ চোখে বাবার থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল পাহাড়ের দূর পথে। দৃষ্টি শান্ত। মন চঞ্চল। নিশ্চুপ রিদের অস্থির মনের অবস্থার ঠাহর ততক্ষণে করতে পারলো নিহাল খান। এগিয়ে এসে ছেলেকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরতেই রিদ ভাঙ্গা গলায় একটু করে বলল…

‘ আই লাভ হার বাবা। এন্ড আই ওয়েন্ট হার। প্লিজ বাবা যেকোনো মূল্যে মেয়েটিকে এনে দাও আমায়। আমার বুক কাঁপছে, ভিষণ কলিজা পুড়ছে, মনে হচ্ছে নিশ্বাস আঁটকে মারা যাব ওকে ছাড়া। প্লিজ বাবা আমার আবদারটা রাখো। এনে দাও আমার বউকে। নয়তো আমি পাগল হয়ে যাব বাবা। নিশ্বাস আঁটকে মরে যাব। প্লিজ বাবা সেইভ হার। প্লিজ।

#চলিত….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here