বাদশাহ_নামা #পর্বসংখ্যা_৪ #আ_মি_না

0
1

#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_৪
#আ_মি_না

৫. সূর্য এখন প্রায় মাথার ওপরে। কিছুক্ষণ আগে মিস ক্রিস্টিনার লাশ সৎকার করা হয়েছে খ্রিস্টান রীতি অনুযায়ী। এই মুহুর্তে ওয়ার্কার্স দের মিটিং জোনে বসে আছে সব ওয়ার্কার্স আর আউটসাইডার্স রা। প্রাসাদ থেকে ক্রিস্টিনার মৃত্যুর খবর পেয়ে তিন জন ইনভেস্টিগেটর এসেছেন ইনভেস্টিগেট করতে, তাদের আদেশেই তাদের কে ঘিরে বসে আছে সবাই। থিয়োডর দাঁড়িয়ে আছে ইনভেস্টিগেটর দের পাশে, চাপা স্বরে টুকটাক কথা বলছে সে ইনভেস্টিগেটর দের প্রধান হামজা আনাসের সাথে। তাদের বলা কথা গুলো অন্যদের কর্ণগোচর হচ্ছে না।
অ্যানা, শার্লট আর ব্রায়ান বসেছে সবার শেষে, জনসমাগম থেকে কিছুটা দূরে৷ ক্রিস্টিনার এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে নিজেদের ভেতরে চাপা স্বরে আলোচনা করছে ওরা৷

ইনভেস্টিগেটরেরা থিয়োডরের সাথে প্রাথমিক আলাপ শেষে এবার মুখ খুললেন। ইনভেস্টিগেটর দের প্রধান, হামজা আনাস জেরা শুরু করলেন সবাইকে; চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, সমস্ত ওয়ার্কার্স আর আউটসাইডার্স দেরকে উদ্দেশ্য করে তিনি প্রশ্ন করলেন,

— মিস ক্রিস্টিনাকে সর্বশেষ কে এবং কোথায় দেখেছে?

হামজা আনাসের প্রশ্নে ওয়ার্কার্স দের ভেতর চাপা গুঞ্জন শুরু হলো। কিন্তু কেউ কিছুই বলল না। এমন নিরাবতার মাঝেই কিছুক্ষণ পর রোগা পটকা একটা ছেলে ভয়ে ভয়ে আশেপাশে চোরা চোখে তাকিয়ে উঠে দাড়ালো জনসমাগমের ভেতর থেকে, তারপর এলোমেলো গলায় বলল,

— আমি ওনাকে কাল রাতে দেখেছি, স্টেলার সাথে স্টেলার মাঞ্জারের পাশে কথা বলতে।

স্টেলার নাম টা শুনতেই জনসমাগমের ভেতর আবারও চাপা গুঞ্জন শুরু হলো। স্টেলা কে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুজতে লাগলো সবাই। হামজা আনাস এবার স্টেলার খোজ করলেন। স্টেলা ভিড়ের ভেতরে মাথা নিচু করে বসে ছিলো এতক্ষন, ইনভেস্টিগেটরের গমগমে কণ্ঠে নিজের নাম শুনে চমকে উঠলো সে। সাথে সাথেই বসা থেকে উঠে দাড়ালো। জজনসমাগমের সমস্ত চোখ গিয়ে পড়লো তার ওপর। থতমত খেয়ে স্টেলা উঠে দাড়াতেই হামজা আনাস স্টেলা কে প্রশ্ন করলেন,

— মিস স্টেলা, আপনার সাথে কথা বলার পর মিস ক্রিস্টিনা কোথায় গেছিলো? সে কি নিজের মাঞ্জারে ফিরে গেছিলো? নাকি অন্য কোথাও গেছিলো।

স্টেলা এই পুরো দ্বীপের ভেতরে নিজের একমাত্র পছন্দকারী মানুষ টাকে হারিয়ে খুবই মর্মাহত, এসব প্রশ্নত্তোর তার এখন মোটেই ভালো লাগছে না। এটা ঠিক যে মিস ক্রিস্টিনার সাথে তারই শেষ কথা হয়েছে, এখন কোনো কারণে সে যদি ফেসে যায় তাহলে যন্ত্রনারও শেষ থাকবে না৷ স্টেলা শুকনো ঢোক গিললো একটা, তারপর উত্তর দিলো,

— আমার সাথে কথা শেষ করে তিনি জঙ্গলের ওদিকটায় গেছিলেন বেবি ব্লু ফ্লাওয়ার তুলতে, ওনার কাশি টা খুব বেড়েছিলো তাই। তার সাথে ওইটাই আমার শেষ দেখা।

হামজা আনাস কিছুক্ষণ তীর্যক দৃষ্টিতে স্টেলা কে পরখ করলেন আর তারপর স্টেলা কে ইশারায় আবার বসতে বললেন। এরপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি তার সামনে আবিষ্টমান জনসমাগমের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

— শিরো মিদোরির জঙ্গলের একটা নির্দিষ্ট অংশ আপনাদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে এবং সেই নির্ধারিত জায়গার বাইরে যাওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মিস ক্রিস্টিনার একটা হাত আর বুকের হৃৎপিন্ড মিসিং। কেউ তার বুকের ওপর টা খুবলে নিয়েছে হৃৎপিণ্ড শুদ্ধ। এবং গভীর জঙ্গলের ভেতর তাকে হত্যা করে টেনে হিচড়ে তাকে ওয়ার্কার্স দের সেইফ জোনের কাছে ফেলে রেখে গেছে। হতে পারে এটা কোনো জংলি পশুর কাজ, বা হতে পারে কেউ শত্রুতা বসত এমন কাজ করেছে। কিন্তু অতো রাতে জঙ্গলের অতটা গভীরে যাওয়ার মতো বুকের পাটা কারো হবে বলে আমার মনে হয় না।

এরপর কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে হামজা আনাস এবার আগের থেকেও জোর দিয়ে বলে উঠলেন,

— আজকের পর থেকে জঙ্গলের নির্ধারিত জায়গার বাইরে আপনাদের একটা পা ফেলাও পুরোপুরি ভাবে ফরবিড করা হলো। রাত হোক বা দিন, কেউ ভুলেও সেদিকে মাড়াবেন না। মাড়ালেই মৃত্যু নিশ্চিত।

হামজা আনাস আরও কিছুক্ষন সবার সাথে কথা বললেন, এরপর থিয়োডরের সাথে কিছুক্ষণ গোপন আলাপ সেরে বাকি দুইজন ইনভেস্টিগেটর দের সাথে আবারও প্রাসাদের দিকে রওনা দিলেন৷ কিন্তু এই অনাকাঙ্ক্ষিত খুন টা নিয়ে তাদের মাঝে কোনো উদ্বেগ দেখা গেলো না, যেন সবকিছুই স্বাভাবিক। শুধুমাত্র জনগন কে সাবধান করেই এই কেসটা তারা সেখানেই থামিয়ে দিলেন নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে৷

হামজা আনাস চলে যেতেই জনসমাগম ভেঙে গেলো। কিন্তু অ্যানা, শার্লট আর ব্রায়ান তিনজন এখনো নিজেদের জায়গায় বসে রইলো। ব্রায়ান বলল,

— ক্রিস্টিনার একটা উচিৎ শিক্ষা হয়েছে। যে-ই এই কাজ টা করেছে তাকে আমার একটা চুমু খেতে ইচ্ছা করছে, হোক সে কোনো জংলি জানোয়ার, কিন্তু সে যদি জীবনে একটা ভালো কাজ করে থাকে, তবে সেটা হবে ক্রিস্টিনা কে খুন করা। এই স্টেলা টাকেও একসময় ধরে ওই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আসবো আমি। ওর কুটকুটানি বেরিয়ে যাবে।

শার্লট আশে পাশে সতর্ক নজর বুলিয়ে বলল,
— ভাইয়া, তুমি চুপ করো, কেউ শুনলে কি হবে বলোতো! ভাববে আমরাই এই কাজ টা করেছি। তখন পড়তে হবে বিপদে।

শার্লট আর ব্রায়ান নিজেদের ভেতর তর্কাতর্কি শুরু করলো, কিন্তু অ্যানার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই৷ ওর চোখ গেলো ওর বা হাতের রিস্ট ওয়াচে৷ সেখানে ভোর বেলাতেই কোনো এক আননোন আইডি থেকে একটা অদ্ভুত রকমের মেসেজ এসে বসে আছে,

‘মেইক অ্যা উইশ’

অ্যানা সে মেসেজ টির দিকে তাকিয়ে রইলো। তার যে কোনো উইশ নেই! উইশ হবেও না। এই মেসেজ টি রোজ ভোর বেলা তার রিস্টওয়াচে আসে, কিন্তু সে কখনো রিপ্লাই দেয়নি। কখনো প্রশ্ন করেনি যে এই মেসেজ দাতা টা কে? তার যে উইশ করার মতো কিছুই আর বাকি নেই!

অ্যানা কে নিজের রিস্টওয়াচের দিকে এমন গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে শার্লট ওর কনুই দিয়ে অ্যানা একটা গুতা দিলো। গুতা খেয়ে অ্যানা চমকে তাকালো শার্লটের দিকে। শার্লট সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল,

— কি রে, সেই অদ্ভুত মেসেজ টি আজ ও এসেছে নাকি?

অ্যানা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বুঝালো। ব্রায়ান এই বিষয়ে কিছুই জানতো না। শার্লটের এ কথা শুনে ও তীর্যক চোখে শার্লটের দিকে তাকিয়ে বলল,

— কিসের মেসেজ? কার মেসেজ? কি মেসেজ?

শার্লট অ্যানার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ব্রায়ানের দিকে ফিরে বলল,

— তার কোনো এক শুভাকাঙ্ক্ষী তাকে রোজ একটা উইশ করতে বলে! হয়তো সে অ্যানার প্রেমে পড়েছে, তাই ভালোবেসে সে একটা উইশ করতে বলে রোজ! ইশ! কি রোম্যান্টিক!

শার্লট দুইহাতের তালু একসাথে করে চোয়াল ফুলিয়ে হেসে অ্যানার দিকে তাকিয়ে চোখের পাপড়ি নাড়তে লাগলো ঘন ঘন। এদিকে শার্লটের কথা শুনে ব্রায়ানের বুক শুকিয়ে এলো যেন। সে অ্যানার দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকালো, ওকে কেউ উইশ মেসেজ দেয় ব্যাপার টা ভাবতেই বুকের ভেতর কেমন যেন কষ্ট কষ্ট অনুভব হলো ওর! কিছুক্ষণ অ্যানার দিকে ওভাবেই তাকিয়ে থেকে তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে ভারী কন্ঠে অ্যানা কে ও জিজ্ঞেস করলো,

— তুমি কখনো মেসেজটির রিপ্লাই দিয়েছো?

অ্যানা রিস্ট ওয়াচ থেকে চোখ সরিয়ে ব্রায়ানের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে না বুঝালো। ব্রায়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,

— মেসেজ টি আমাকে একটু দেখাবে?

অ্যানা আবার এক পলক ব্রায়ানের দিকে তাকিয়ে হাতের রিস্ট ওয়াচ টা খুললো তারপর সেটা ব্রায়ানের দিকে এগিয়ে দিলো। ব্রায়ান রিস্টওয়াচ টা নিয়ে খুব মনোযোগের সাথে দেখতে লাগলো সেই মেসেজ টা। ব্রায়ান কি করে সেটা দেখার জন্য শার্লট বাবু দয়ে বসে হাটুর উপরিভাগে দুই কনুই ঠেকিয়ে মুখে হাত দিয়ে বসে রইলো।
ব্রায়ান এই আননোন আইডি টার নম্বর নিজের রিস্টওয়াচে টুকে নিলো। সময় করে সে এই আইডির মালিক কে খোজ করবে। নম্বর টা টুকে নিয়ে সে আবারও অ্যানার রিস্টওয়াচ এর দিকে মনোযোগ দিলো। কিছুক্ষণ আবার ও মেসেজ টি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে সে অ্যানা কে বলল,

— কেমন হয় যদি সত্যি সত্যিই আমরা এই মেসেজের রিপ্লাই দিই, আর কোনো একটা উইশ করি?

ব্রায়ানের কথা টা অ্যানার কানে যেতেই চমকে তাকালো অ্যানা। তারপর খপ করে ব্রায়ানের হাত থেকে নিজের রিস্ট ওয়াচ টা একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো অ্যানা। তারপর সেটা আবার নিজের বা হাতে পরতে পরতে গম্ভীর স্বরে বলল,

— না, এটা কখনোই সম্ভব না। কে না কে মেসেজ দেয়, তার মেসেজের রিপ্লাই আমি দিতে পারবো না৷

অ্যানার এমন আচরণে ব্রায়ান অবাক হলো কিছুটা। এমন আচরণ সে কখনোই অ্যানা কে করতে দেখেনি। শার্লট ও অ্যানার দিকে তাকিয়ে আছে হা হয়ে। এইভাবে ঘড়ি টা ছিনিয়ে নেওয়ার মতো কি হলো! অ্যানা কি কিছু লুকাচ্ছে ওদের থেকে? ব্রায়ান আর শার্লট নিজেদের ভেতরে অ্যানা কে লুকিয়ে একবার চোখাচোখি করে নিলো। অ্যানা রিস্টওয়াচ টা পরা শেষ করেই বসা থেকে উঠে দাড়াতে দাড়াতে শার্লট কে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,

— আমাকে কাজে যেতে হবে, পরে কথা বলবো তোদের সাথে৷

কিন্তু অ্যানা পেছন ফিরে যেতে নিলেই কোত্থেকে ধীর পায়ে হেটে হেটে স্টেলা আসলো সেখানে। তারপর সোজা অ্যানার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ক্রুর হেসে বলল,

— কেমন লাগলো কালকের আতিথেয়তা? আমি তো ভেবেছিলাম এক সপ্তাহ তুমি উঠেই দাড়াতে পারবে না, কিন্তু একটা দিন যেতে না যেতেই খুব তো ছটফট করে বেড়াচ্ছো দেখি! কি চামড়া পুরু মেয়ে রে বাবা! এত গুলো বাড়ি খেয়েও তার কিছুই হয়নি! তুমি মেয়ে তো? নাকি হিজড়া, বলতো শুনি!

অ্যানা এতক্ষন বেটে খাটো স্টেলার মাথার ওপর দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। স্টেলার কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে সে স্টেলার দিকে তাকিয়ে মাথা টা সামান্য ঝুকিয়ে বলল,

— শুনলাম তোমার ‘প্রিয় অভিভাবক’ কে নাকি জঙ্গলের বুনো কুকুরে খুবলে খেয়েছে! যদিও কাজটা ঠিকই হয়েছে, কিন্তু তোমার তো অন্তত মাস খানেক শোক পালন করা উচিত ছিলো! জীবন থেকে এমন মহান একজন কে হারিয়েছো! কিন্তু সেটা না করে নির্লজ্জের মতো হাসি মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছো দেখি! লজ্জাজনক!

কথা গুলো বলেই আবার সোজা হয়ে স্টেলা কে পাশ কাটিয়ে ভারী পায়ে সামনে এগিয়ে গেলো অ্যানা। আর স্টেলা ভোতা মুখে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে৷ ব্রায়ান বসে বসেই স্টেলার দিকে খেয়ে ফেলা চোখে তাকিয়ে রইলো আর শার্লট অ্যানার এমন মোক্ষম জবাবে মুখ টিপে হাসতে লাগলো।
|
|
|
|
|
|
৬. ভোর সকালে শিরো মিদোরির জঙ্গলের নাম না জানা পাখিদের কলকাকলীতে ঘুম ভাঙলো অ্যানার। ভোরের প্রশান্তিকর বাতাস, চেরি গাছ দ্বারা আচ্ছাদিত সতেরো নম্বর মাঞ্জারটির জানালার পর্দা গুলো ঠেলে ঠুলে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকলো। বসন্তের শুরু হয়েছে অল্প কিছুদিন হলো, বসন্তের সে আদুরে পরশে শিরোমিদোরির পুরোটাই ফুলে ছেয়ে আছে। দূর থেকে শিরো মিদোরির দিকে তাকালে মনে হয় যেন কোনো শিল্পি তার সংগ্রহের সমস্ত রঙ ঢেলে দিয়েছে শিরো মিদোরির ওপর৷

ঘুম ঘুম চোখে বিছানা ছেড়ে উঠলো অ্যানা, তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে একেবারে গোসল সেরে বের হয়ে এলো। এরপর অসম্ভব রকম কালো কুচকুচে, কোমর ছাড়ানো ভেজা চুল গুলো সাদা রঙা টাওয়েলে জড়িয়ে নিয়ে আয়নার সামনে এসে দাড়ালো ও। শরীরে ওর বাথরোব জড়ানো। গা থেকে ভুর ভুর করে বডি ওয়াশের নির্মল সুগন্ধ বের হয়ে চারদিক ছড়িয়ে পড়ছে।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, শরীরে প্রয়োজনীয় প্রসাধনী দ্রব্য ব্যাবহার করে, শরীর থেকে বাথরোব টা খুলে একটা ছাই রঙা ঢোলাঢালা ট্রাউজার পরে নিলো অ্যানা, সাথে পরলো একটা সাদা রঙা ট্যাংক টপ। আর তারপর মাথায় টাওয়েল জড়ানো অবস্থাতেই চলে গেলো নিজের কিচেনে৷
চায়ের কাপে টুংটাং শব্দ তুলে ঝটপট এক কাপ চা করলো, তারপর ঝটপট একটা ছোটখাটো ব্রেকফাস্ট তৈরি করে কিচেনের বাম পাশের দেয়ালের সাথে লাগোয়া ছোট্ট ডাইনিং টেবিলটার চেয়ার টেনে বসলো।

অ্যানার মাঞ্জারটা থেকে অন্যান্য মাঞ্জার গুলোর দুরত্ব একটু বেশি। অন্যান্য মাঞ্জার গুলো প্রায় কাছাকাছি হলেও অ্যানার মাঞ্জার অন্যদের মাঞ্জার থেকে বেশ খানিক টা দূরে, আর গাছগাছালির ঘনত্বের কারণে সে দুরত্ব টা আরও বেশি মনে হয়। তারপর ও অন্যান্য মাঞ্জার গুলো থেকে সকাল বেলার নিশ্চুপতার কারণে টুকটাক শব্দ ভেসে আসছে৷ সবাই যার যার কাজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাকেও বের হতে হবে দ্রুতই, কারণ তার কাজ টা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

খুবই দ্রুত নাস্তা টা শেষ করে কোনোরকমে খানিক পানি খেয়ে ট্যাংক টপ টার ওপর ছাই রঙা একটা হুডি জড়িয়ে মাথায় হুডির হুড তুলে দিলো অ্যানা। তারপর মুখের মাস্ক টা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়লো নিজের কর্মস্থলের উদ্দ্যেশ্যে।

.

আউটসাইডার্স দের খাবার রান্নার জন্য নির্ধারিত কিচেনে একা হাতে কাঠের তৈরি বেশ বড়সড় একটা চপিং বোর্ড এর ওপর ভেজিটেবল নাইফ দিয়ে দ্রুত গতিতে সবজি কাটছে অ্যানা। দুই কামরা বিশিষ্ট এই কিচেন টির একটি হলো গুদাম ঘর; চাল, ডাল সহ অন্যান্য অপচনশীল দ্রব্য গুলো ওই কামরাতেই রাখা। আর অন্য কামরা টা হলো কিচেন৷

কিচেনের একদিকে রান্নার জন্য বেশ বড় বড় রান্নার পাত্র রাখা৷ এত গুলো মানুষের জন্য এক বারে সব খাবার রান্না করা যায় না বলে অ্যানাকে প্রতিববেলা দুইবার করে রান্না করতে হয়। তার সাথে তার দুজন সহযোগী থাকে, একজন ছেলে, অন্যজন মেয়ে। কিন্তু মেয়েটি কাল রাত থেকে অসুস্থ, আর ছেলেটির স্ত্রী সদ্য সন্তান প্রসব করার কারণে আজ আর কাল দুদিন ছুটি নিয়েছে সে। তাই পুরো রান্নার ভার টা আজ ওকে একাই সামলাতে হবে৷

সবজি কাটার ফাকে কিছু একটা ভেবে হুট করেই সবজি কাটা থামিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো অ্যানা। তারপর কিচেন এর চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে কিচেনের সমস্ত জানালা গুলো বন্ধ করে দিলো ও, এরপর দ্রুত পায়ে হেটে কিচেনের দরজার কাছে গিয়ে বাইরের দিক টা এক পলকে দেখে নিলো একবার। এদিকটাতে লোকজন খুব কমই আসে, আর আজকে আর ও কম। বাইরে টা দেখে নিয়েই মৃদু হেসে দরজা টা ধাম করে বন্ধ করে দিয়ে ভেতর থেকে লক করে দিলো অ্যানা। তারপর আবার এগিয়ে গেলো চপিং বোর্ডের কাছে। এবার সে রান্না করবে অন্যভাবে।

.

শার্লট, ব্রায়ান আর অন্যান্য কিছু ওয়ার্কার্স মিলে ডাইনিং এরিয়া টা সাফ করছে। ডাইনিং এরিয়া গুলো তারা সহ আর ও বেশ কিছু ওয়ার্কার্স দের দায়িত্বে। এইখানের যত কাজ আছে সব ওরাই করবে। অন্য কেউ তাদের কাজে সাহায্য করতে পারবেনা, থিয়োডরের অনুমতি ব্যাতিত।

ব্রায়ান বরাবরের মতো আজও গম্ভীর মুখেই আছে। কোনোদিকে না তাকিয়ে একমনে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। পরণে তার একটা আন্ডার শার্ট আর প্যান্ট। ঘাড় বাবড়ি কোকড়া চুল গুলোর কিছু অংশ কপালের ওপর এসে পড়েছে। বয়স যদিও এখন আঠাশ চলছে, কিন্তু মুখে তার দাড়ির লেশ মাত্র নেই৷
তার জন্য যদিও অন্যান্য ছেলেদের কটাক্ষের শিকার হয় সে প্রায়শই, কিন্তু শার্লটের থেকে সে জেনেছে বাইরের পৃথিবীতে তে নাকি এমন কিছু দেশ আছে যেখানের ছেলেদের তার মতোই দাড়ি টাড়ি তেমন উঠে না, আর তার চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে অ্যানা তাকে বলেছে যে তাকে দাড়ি ছাড়া মোটেও খারাপ দেখায় না। যেহেতু অ্যানা তাকে এভাবেই পছন্দ করেছে, তাই দাড়ির চিন্তা সে পুরোপুরি বাদ দিয়েছে। ওয়ার্ম আইভরি টোনের স্কিনে দাড়ি ছাড়া তাকে সত্যিই খুব সুন্দর দেখায়।

এইমুহুর্তে তার চোখের প্রচন্ড ঘন আর লম্বা পাপড়ির নিচের লাইট ব্রাউন রঙা মণি দুইটা নিজের হাতের কাজের দিকে নিবদ্ধ। তার মুখের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে এই জগৎ সংসারের ওপর তার বিন্দুমাত্র ভক্তি নেই, আশেপাশের সবকিছুই তার জন্য প্রচন্ড বিরক্তিকর। আর এই বিরক্তির অন্যতম কারণ হলো ওদের সাথে কাজ করা অন্য দুজন ওয়ার্কার মেয়ে।
মেয়ে দুটো এসেছে সপ্তাহ দুয়েক হবে, এখনো এখানের নিয়ম কানুন শিখছে, কিন্তু রোজ কাজের সময় অসভ্য মেয়ে দুটো সারাক্ষণ আশেপাশের মানুষ গুলোর বিদঘুটে আর উদ্ভট সমালোচনা করবে আর কুটকুট করে হাসবে শুধু, আর মেয়েদুটোর অমন হাসিতে ব্রায়ানের হয় মেজাজ খারাপ। না চাইতেও ওই সমালোচনা গুলো কানে আসে ওর, বার বার কটমটে চোখে মেয়েদুটোর দিকে তাকায় ও, কিন্তু মেয়ে দুটো নতুন হওয়ার কারণে নিজে গিয়ে তাদের কিছু বলতেও পারে না। আজ ও সেইম কাহিনি হচ্ছে। মেয়েদুটো কাজ করার চাইতে কুটকুট করছে বেশি। শার্লট নিজেও ব্রায়ানের পাশে কাজ করছিলো, ভাইয়ের এই বিরক্তির ব্যাপার টা লক্ষ্য করে ও মেয়েদুটোর উদ্দ্যেশ্যে দূর থেকেই উচ্চস্বরে বলে উঠলো,

— এই যে, নতুন মেয়ে দুটো! কি ব্যাপার তোমাদের? কাজ না করে এতো হাসাহাসি করছো কেন? কাজে মন দাও।

মেয়েদুটো হাসি থামিয়ে শার্লটের দিকে চোখ সোজা করে তাকালো, তারপর ওদের ভেতর থেকে একজন শার্লট কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

— আমরা হাসবো কি কাদবো সেটা তোমার থেকে শুনতে হবে নাকি? তুমি জানো আমি কোন দ্বীপ থেকে এসেছি? কুরো আহমার থেকে, শিরো মিদোরির পর সবচেয়ে আভিজাত্য পূর্ণ দ্বীপ থেকে এসেছি আমি। তোমাদের মতো বস্তি থেকে আসিনি। তাই আমাদের কে আদেশ করবে না।

ভ্রু জোড়া নাচিয়ে নাচিয়ে নাক উঁচু করে কথা গুলো বলল মেয়েটি। ওদের এমন বেপরোয়া আর বেয়াদবি মার্কা কথা শুনে শার্লট থতমত খেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। নিজের থেকেও বয়সে ছোট মেয়ের থেকে এমন উত্তর পাবে ও আশাই করেনি।
ব্রায়ান মেয়েটির কথা গুলো শোনা মাত্রই সোজা হয়ে দাড়ালো, তারপর হাত থেকে ডাইনিং টেবিল ঝাড়ামোছা করার কাপড় টি চেয়ারের পিঠের ওপর রেখে নিজের চোয়াল দ্বয় শক্ত করে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো মেয়েদুটোর দিকে। মেয়েদুটো ব্রায়ান কে নিজেদের কাছে এগিয়ে আসতে দেখে চোয়াল ফুলিয়ে হাসলো। ব্রায়ান কাছে এগিয়ে আসতেই শার্লট কে কথা শোনানো মেয়েটা ব্রায়ানের দিকে ভ্রু তুলে তাকিয়ে নিজের ডান হাতের আঙুলে নিজের খোলা চুলের কিছু অংশ পেচাতে পেচাতে বলল,

— কি ব্যাপার চকলেট বয়! তুমি এদিকে আসছো কেন? কোনো পার্সোনাল ডিমান্ড আছে নাকি?

ব্রায়ান মেয়েটির সামনে গিয়ে দাড়ালো। তারপর ভ্রু জোড়া কুচকে ভারী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— এখানের রুলস এন্ড রেগুলেশন্স গুলো জেনেছো নিশ্চই?

মেয়েটি ভাব নিয়ে মাথা দুলিয়ে বলল,
— হ্যা, সব রুলসই আমার জানা আছে, আর এখন নতুন রুলসও আমি তৈরি করবো।

মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বেকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো ব্রায়ান। আর তারপরই সবাইকে অবাক করে দিয়ে এতদিনের শান্ত থাকা ব্রায়ান সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিলো মেয়েটির গালে। চড়ের শব্দে আশ পাশ থেকে বাকি ওয়ার্কার্স গুলো চমকে তাকালো ব্রায়ানের দিকে। ব্রায়ান যে কাউকে এইরকম তাল ফাটানো চড় মারতে পারে সেটা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। আর চড় খাওয়া মেয়েটি গালে হাত দিয়ে বড় বড় চোখ করে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ব্রায়ানের দিকে। আর মেয়েটির এ হতভম্ব চেহারার দিকে তাকিয়ে ব্রায়ান কঠিন গলায় বলল,

— রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনস এ উল্লেখ করা, সিনিয়র দের সাথে বেয়াদবি করার সর্বনিম্ন শাস্তি এটা। সর্বোচ্চ শাস্তি টা কি সেটা আর ও একবার রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনস টা চেইক করলেই পেয়ে যাবে। আর এরপর ও যদি নিজেদের এই থার্ড ক্লাস আচরণটা না বদলাও তবে সর্বোচ্চ শাস্তির কথাটাও কোনো এক দিন কেউ না কেউ তোমার ওই গোবর ভর্তি মগজে ঢুকিয়ে দিয়ে যাবে।

কথা টা বলেই ব্রায়ান আবার নিজের জায়গায় ফিরে এলো৷ নিজের ভাইয়ের এমন অ্যাকশন দেখে ভেতরে ভেতরে হেব্বি খুশি হলো শার্লট, চোখের তারায় ফুটে উঠলো সে খুশির ছাপ। ডাইনিং টেবিলের অন্য পাশে, গালে হাত দিয়ে দাড়ানো মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে হেসে মনে মনে ও বলল, ‘ভাগ্য ভালো শুধু চড়ের ওপর দিয়ে গেছে! আমার অ্যানা বন্ধু থাকলে তোর টুটি টেনে ছিড়ে দিতো! আজকের মতো বেচে গেলি।’

ব্রায়ান নিজের কাজে মন দিলো আবারও। আশ পাশ টা পুরোপুরি নিশ্চুপ হয়ে রইলো, অন্যরাও যে যার কাজে মন দিলো আবার, কিন্তু কারো মুখে আর কোনো কথা নেই। এমন সময় থিয়োডর এলো সেখানে৷ খানিক আগেও কিলবিল করে কথা বলা সবাইকে এমন চুপচাপ দেখে সে কিছুটা অবাক হলো, কিন্তু প্রকাশ করলো না৷ দ্রুত পায়ে হেটে সে শার্লটের কাছে এসে বলল,

— শার্লট, এখনি সাগর পাড়ে যাও, পিটার বেশ কিছু মাছ ধরেছে সেগুলো নিয়ে অ্যানা কে দিয়ে আসো, আর সাথে কাউকে নিয়ে যেও। অ্যানা আজ কিচেনে একাই রান্না করছে, পেরে উঠবে না ও একা একা৷ তোমরা গিয়ে ওকে একটু হেল্প করে দিও।

থিয়োডরের কথায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে ডাইনিং এরিয়া থেকে বেরিয়ে এলো শার্লট, তারপর দ্রুত চলল সাগরপাড়ের উদ্দ্যেশ্যে।

কিন্তু সাগর পাড়ে যাওয়ার জন্য আউটসাইডার্স দের টেন্ট পার হওয়ার সময়েই কোত্থেকে শার্লটের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে, ছুটতে ছুটতে এসে শার্লটের পাশে এসে দাড়ালো রুথ……..

চলবে……..
|
|
|
|
|

( বেশি বেশি কমেন্ট করবেন! 🥹 আর ভুল ত্রুটি গুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন 💙)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here