বাদশাহ_নামা #পর্বসংখ্যা_৩ #আ_মি_না

0
3

#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_৩
#আ_মি_না

মেঝেতে বসে অ্যানা কে পর্যবেক্ষণরত মেয়েটির চোখ লেগে এসেছিলো সামান্য, কিন্তু সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিলো সে। নিজের কব্জি তে থাকা ঘড়িটাতে সময় দেখে নিলো একবার। রাতের শেষ প্রহরের শুরু হয়েছে সবে মাত্র৷ অ্যানার শরীরে দেওয়া স্যালাইন টার দিকে একবার দৃকপাত করলো সে। সেটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। মেয়েটি এবার বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে উপুড় হয়ে বেঘোরে ঘুমিয়ে থাকা অ্যানার পিঠের ওপর থেকে পোশাক টা সরিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত মোলায়েম পিঠ খানা অনাবৃত করলো।

হ্যা, আর সামান্য তম আঘাতের চিহ্নও নেই। পুরোটাই সেরে উঠেছে। এক বিন্দু দাগ ও অবশিষ্ট নেই আর। মোলায়েম পিঠ খানা আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার আগের অবস্থাতেই আবার ফিরে এসেছে৷ এ দৃশ্য দেখে মেয়েটির ঠোটের কোণে কিঞ্চিৎ খুশির রেখা দেখা দিলো।

এতক্ষন ধরে একনাগাড়ে চেয়ারে বসে থাকা দীর্ঘকায় ব্যাক্তি টা এবার উঠে দাড়ালো। সে উঠে দাড়াতেই মেঝেতে বসে থাকা কালো পোশাক পরিহিতা মেয়েটি হড়বড় করে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে সরে গেলো বিছানার অন্য পাশে। কামরার ভেতরে থাকা অন্যান্য নারী আর পুরুষ গুলো, যারা খানিকটা ঝিমিয়ে গেছিলো তারাও সাথে সাথে সোজা হয়ে দাড়ালো যে যার নিজের জায়গাতে৷

দীর্ঘকায় ব্যাক্তিটি এবার ধীর পায়ে হেটে এসে দাড়ালো অ্যানার বিছানার পাশে। তারপর সামান্য ঝুকে নিজের বিশাল থাবা ওয়ালা হাত টা অ্যানার মোলায়েম পিঠের ওপর ছোয়ালো, হাত টা সম্পুর্ন পিঠটাতে একবার বুলিয়ে নিয়ে এসে পিঠের ওপর থেকে হাত টা সরিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো আবার। তারপর ধীর অথচ ভারী পায়ে হেটে চলল কামরার দরজার দিকে, এরপর দরজা টা নিঃশব্দে টান দিয়ে খুলে বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে, আর তার পেছন পেছন মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলো কামরার ভেতরে থাকা অন্যান্য পুরুষ গুলো, আর মেয়ে গুলো রয়ে গেলো কামরাতেই। অ্যানা কে দেওয়া স্যালাইন টা পুরোপুরি শেষ হওয়ার পর তারাও বের হয়ে যাবে এ কামরা থেকে৷

৪. সকাল বেলাতেই একজন নতুন আউটসাইডার এসেছে। মেয়ে; বয়স আঠারোর কোঠায়। গতকাল রাতে বাহির সমুদ্রে হওয়া এক প্রবল ঘূর্নিঝড়ের কারণে তাদের জাহাজ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, দেড় হাজার যাত্রীর ভেতরে সে একাই বেচে ছিলো। বাচতো না, যদি না থিয়োডর আর কিছু সময় পরে মেয়েটাকে খুজে পেতো! জাহাজের টুকরো হয়ে যাওয়া একটা অংশের সাথে ভেসে ভেসে পঞ্চদ্বীপের অদৃশ্য ব্যারিয়ার পার করে সে চলে এসেছিলো শিরোমিদোরির কিনারায়, সমুদ্রের পাড়ের বালিয়াড়ির ভেতর ডুবে ছিলো সে৷ ভোর সকালে থিয়োডর অন্য কয়েকজন ওয়ার্কার্স দের সাথে নিয়ে সমুদ্র থেকে মাছ ধরে ফেরার সময় মেয়েটাকে সমুদ্রের তীরে পড়ে থাকতে দেখে, আর তারপরই মেয়েটাকে একজন ওয়ার্কার্স এর সাথে করে পাঠিয়ে দেয় হেকিম ফাতমার মাঞ্জারে। এখন সে মোটামুটি সুস্থ আছে, আউটসাইডার্স দের থাকার জন্য নির্ধারিত জায়গায় তাকেও একটা তাবুর ব্যাবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। শার্লট আর অন্য কিছু ওয়ার্কার্স মিলে এখন সেই মেয়েটার তাবুটি খাটিয়ে দিচ্ছে, আর মেয়েটিকে দেওয়া অনুদানের জিনিস পত্র গুলো দিয়ে তাবুর ভেতর টা সাজিয়ে দিচ্ছে।

নতুন আসা এ মেয়েটির নাম রুথ। সে এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। জাহাজ টাতে তার পুরো পরিবার ছিলো, সবাইকে হারিয়ে সে এখন পাগল প্রায়। তার জ্ঞান ফেরার পর থেকেই সে তার পরিবারের জন্য আহাজারি করছে! তার কান্না দেখে শার্লটের খুব খারাপ লাগছে। সে এমনিতেই আবেগি মানুষ, আর এসব কান্না কাটি সে একদমই সহ্য করতে পারে না৷ কাউকে কান্না করতে দেখলে তার নিজেরও কান্না আসে। রুথের কান্না দেখে সবার অগোচরে সে মাঝে মাঝে নিজের চোখের কোণা জোড়া মুছে নিচ্ছে৷

রুথের তাবু টা বেশ বড় সড় করেই দিয়েছে শার্লট, একজনের থাকার স্থানে দুজনের মতো জায়গা করে তাবু টা খাটিয়ে দিয়েছে ও৷ তাবু খাটানো হয়ে গেলে অন্য ওয়ার্কার্সরা যে যার নিজের কাজে চলে গেলেও শার্লট থেকে গেলো সেখানে। রুথ এখনো থেকে থেকে ফোপাচ্ছে। সাজানো গোছানো তাবুর ভেতরে রুথের জন্য গোছানো বিছানার ওপর তাবুর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা রুথ কে হাত ধরে টেনে এনে বসিয়ে দিলো শার্লট। রুথ নাক টেনে চোখ মুছে এসে বসলো বিছানাতে৷ শার্লট ওকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য বলল,

— আর কেদো না তুমি, তোমার নাম আউটসাইডার্স দের লিস্টে লেখা হয়েছে। তুমি যেখান থেকে এসেছো সেখানে তোমার রক্তের সম্পর্কের যদি কেউ থেকে থাকে তবে অবশ্যই এখানের বাদশাহ তোমাকে সেখানে ফেরত পাঠানোর ব্যাবস্থা করবেন, আর যদি থেকে না থাকে তবে তোমাকে বাকি জীবন এখানেই থাকতে হবে। তখন তুমি আর আউটসাইডার থাকবে না, আমাদেরই একজন হয়ে যাবে!

কথা টা বলে ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসি ফোটালো শার্লট। রুথ নাক টেনে বলল,

— আমার এক দূর সম্পর্কের ফুফু আছে ওখানে, তাহলে কি আমাকে ফেরত পাঠানো হবে?

শার্লট আগের মতো করেই উত্তর দিলো,

— কাকে ফেরত পাঠানো হবে, আর কাকে ফেরত পাঠানো হবে না, এসব সিদ্ধান্ত নেন রাজ কর্মচারীরা। আমাদের কোনো হাত নেই সেখানে। তোমাকে ফেরত পাঠানোর হলে তুমি খুব শিঘ্রই জানতে পারবে। এখন তুমি মন খারাপ করে থেকো না আর। কান্না কাটি বন্ধ করো।

রুথ মেয়েটা চোখ দুইটা ভালো ভাবে মুছে স্বাভাবিক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— আমি এখন কোথায় আছি? আর এই আউটসাইডার্স, ওয়ার্কার্স; এরা কারা?

— তুমি এখন তোমার বাসভূমি থেকে অনেক অনেক দূরে আছো! কত দূরে আছো সেটা আমি নিজেও জানিনা। আর এই আউটসাইডার্স আর ওয়ার্কার্স দের সম্পর্কে তোমাকে আমি পরে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেবো।

কথা গুলো বলে রুথের বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রুথের হাত জোড়া নিজের মুঠিতে ভরে নিয়ে শার্লট মুখে হাসি ফুটিয়ে কিছুটা উচ্চস্বরে বলে উঠলো,

—তোমার ক্ষিধে পেয়েছে নিশ্চই? চলো, বাইরে ডাইনিং এরিয়ায় আউটসাইডার্স দের জন্য সকালের খাবারের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। তোমাদের জন্য যে রান্না করে তার রান্না একবার খেলে আর ভুলতে পারবে না, সারাজীবন সে খাবারের স্বাদ মুখে লেগে থাকবে! কিন্তু দুঃখের বিষয়, সে খুবই অসুস্থ, তাই আজ তোমাকে বিশ্রি খাবার খেতে হবে। এখন উঠো!

শেষোক্ত কথা টা বলেই রুথের হাত টা ধরে টেনে তাবুর বাইরে বের করে নিয়ে এলো শার্লট। আর বের হয়েই অবাক হয়ে চারপাশ টা দেখতে লেগে গেলো রুথ।

এতক্ষণ ধরে বেদনা বিলাস করার কারণে চারপাশ টা সে দেখেও দেখেনি। অসম্ভব রকম সুন্দর, সতেজ পাতা ওয়ালা গাছ পালায় ঘেরা এই পুরো এরিয়া টা, ঝোপঝাড়ের বালাই নেই কোথাও।
গাছের ফাকে ফাকে আউটসাইডার্স দের জন্য তাবু খাটানো। তাবু গুলোও অসম্ভব রকমের সুন্দর। তাবুর কাপড় গুলোর ওপর সুতার তৈরি কারুকাজ। দেখতে লাগলে শুধু দেখতেই ইচ্ছা করছে। জঙ্গলের অনেক অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে সে তাবু গুলো।

জঙ্গলের গাছ পালা গুলোতে হরেক রকমের ফুল আর ফল ধরে আছে, যা রুথ আজ পর্যন্ত কখনোই দেখেনি! বড় বড় চোখ করে উপরের দিকে তাকিয়ে সে গাছ গুলো দেখতে লেগে গেলো! লাল, গোলাপি, হলুদ, সবুজ ছাড়াও যে গাছের পাতার এত রকমের রঙ হতে পারে তা এই শিরো মিদোরির গাছ গুলো না দেখলে সে কখনোই জানতে পারতোনা।
প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকলো রুথ। আর সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে মনে মনে খুশি হলো শার্লট। শিরো মিদোরির মতো এত সুন্দর জায়গাতে এসে কেউ মন খারাপ করে থাকবে এটা কখনোই সম্ভব নয়!

রুথের ডান হাত টা ধরে টানতে টানতে সে নিয়ে গেলো আউটসাইডার্স দের জন্য নির্ধারিত খাবার জায়গায়। সেখানে বিশাল লম্বা লম্বা তিনটা ডাইনিং টেবিল পর পর সাজানো। প্রতি বেলায় দুশো থেকে আড়াইশ আউটসাইডার্স খাওয়া দাওয়া করে এখানে৷ চোখ বড় বড় করে রুথ এই অসম্ভব রকম সুন্দর আর মনোরম পরিবেশ টা দেখতে লাগলো, ওর মনে ঘুরপাক খেতে থাকলো হাজারো প্রশ্ন, কিন্তু সেগুলোকে আপাতত প্রশ্রয় দিলো না ও। ক্ষিদেতে পেটের নাড়ি জ্বলে যাচ্ছে, এখন তাকে খেতেই হবে৷

টেবিলে ইতোমধ্যেই সবাই বসে গেছে। ব্রায়ান সহ আর ও বেশ কিছু ছেলে আউটসাইডার্স দের খাবার পরিবেশন করছে। খাবারের সুগন্ধে চারদিকে ম ম করছে। বুক ভরে খাবারের গন্ধ নিয়ে শার্লট রুথের হাত ধরে ব্রায়ানের দিকে এগিয়ে গেলো, এরপর ব্রায়ান কে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— কি ব্যাপার ভাইয়া? রান্না কে করলো আজ! এত সুন্দর ঘ্রান আসছে! জিভে পানি চলে এলো!

ব্রায়ান একজন আউটসাইডার কে খাবার পরিবেশন করতে করতে গম্ভীর মুখে উত্তর দিলো,।

— যার রান্না করার কথা তিনিই করেছেন।

শার্লট অবাক চোখে তাকালো ব্রায়ানের দিকে। তারপর বলল,
— অ্যানা রান্না করেছে? গতকাল ওর অবস্থা দেখেছিলে তুমি ভাইয়া! কাল ও আমাদের সাহায্য ছাড়া দাড়াতে পর্যন্ত পারছিলো না! হেকিম ফাতমা কেও ভেতরে ঢুকতে দেয়নি ও! কাল রাতে ফাতমা কে সাথে নিয়ে ওর মাঞ্জারের সামনে গিয়ে কত ডাকাডাকি করলাম, কিন্তু ওর কোনো সাড়াশব্দও পেলাম না! আর সকালে উঠে ও এতই সুস্থ হয়ে গেলো যে রান্না শুরু করে দিলো!

ব্রায়ান বিরক্ত হলো প্রচুর৷ ভ্রু জোড়া কুচকে সে খাবার সার্ভ করা বাদ দিয়ে শার্লটের দিকে ফিরলো পুরোপুরি, তারপর ঝাঝালো গলায় বলল,

— এ কথা আমাকে বলে তোর লাভ কি? লাভ আছে কোনো? আমি কি কর‍তে পারি? সে অসুস্থ অবস্থায় জনসেবা করে বুঝাচ্ছে যে সে খুবই দায়িত্ববান একজন ওয়ার্কার! তো এখানে আমার কি করার আছে?

শার্লট বুঝলো ভাই তার রেগে আছে খুব। গত দেড় বছর ধরে তারা তিনজন; সে, ব্রায়ান আর অ্যানা, সারাক্ষণ একসাথেই সময় কাটিয়েছে, আর তার ভাই যে এত গুলো দিনে ওই ইয়া লম্বা আর কঠোর মুখের মেয়েটার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে ভিষণ ভাবে, সে সম্পর্কে শার্লট খুব ভালোভাবেই অবগত। নইলে তার ভাইকে আজ পর্যন্ত কারো ওপর এত বিরক্ত হয়ে মিষ্টি করে রাগ দেখাতে দেখেনি সে! ব্রায়ান সহজে রাগে না, আর রেগে গেলে আর থামানো যায় না, তাই ভাই কে শান্ত করার জন্য সে বলল,

— দাড়াও আমি দেখে আসি ওর কি অবস্থা! সুস্থ হয়ে যেতেও পারে, হয়তো শরীর ভালো লাগছে তাই কাজে এসেছে!

শার্লটের অ্যানার হয়ে এই ওকালতি করতে দেখে ব্রায়ানের মেজাজ আর ও খারাপ হলো, সে ভ্রু জোড়া আরও কুচকে নিয়ে কাজে নেমে পড়লো আবার৷ শার্লট পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলো,

— কিন্তু অ্যানা কোথায় আছে, বলতে পারো?

শার্লটের কথার উত্তরে ব্রায়ান তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
— থেও ডর, তিনি এসে জরুরি কথা বলার নাম করে নিয়ে চলে গেছেন তাকে!

ব্রায়ান থিয়োডরের নাম টা এমন বিশ্রি করে টেনে টেনে উচ্চারণ করায় শার্লট চারদিকে একবার তড়িৎ গতিতে সতর্ক দৃষ্টি তে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল,

— কি হচ্ছে ভাইয়া! কেউ শুনে ফেললে কি হবে বলোতো! আমাদের সামনে তুমি যা ইচ্ছা ডাকো তাকে, তাই বলে সবার সামনে এই ভাবে ডাকলে কেউ যদি শুনে ফেলে তবে কি হবে ভাবতে পারছো! সে একজন সম্মানিত ব্যাক্তি, আমাদের লিডার সে! তাকে এইভাবে ব্যঙ্গ করে ডাকলে তার ফলাফল মোটেও ভালো হবে না কিন্তু!

ব্রায়ান আবার কাজ থামিয়ে শার্লটের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

— ওর উদ্দ্যেশ্য কি সেটা আমি জানিনা ভেবেছে! বয়স পঁয়ত্রিশের কোঠায়, এখনো বিয়ে করছে না কেন? অ্যানা এখানে আসার আগে তো ঠিকই বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো হঠাৎ থেমে গেলো কেন? ও কি ভেবেছে? ক্ষমতার জোরে আমার অ্যানা কে বিয়ে করবে? কখনোই না! আমি তা হতে দেবো না!

শার্লট ভাইয়ের এমন অকপট স্বীকারোক্তিতে হা হয়ে গেলো প্রথমে, পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বত্রিশ পাটি দাঁত মেলে সে বলল,

— অবশেষে স্বীকার করলে তাহলে! তবে তুমি চিন্তা করো না! মিস্টার ব্রাউন অমন মানুষ না, তার চোখে আমি অ্যানা কে নিয়ে কোনো রকম ফিলিংস দেখিনি কখনো! আর যদি থেকেও থাকে তবে অ্যানা কে ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে তাকে আমি তোমার করার ব্যাবস্থা করে দেবো! তাই তুমি নিশ্চিন্তমনে থাকো!

ব্রায়ান আবার নিজের কাজে মন দিয়ে বলল,

— হু, হয়েছে! এখন আমার সামনে থেকে সর!

রুথ এতক্ষন এই দুই ভাইবোনের কথা বার্তা হা হয়ে শুনছিলো, কোনো আগামাথা না বুঝেই। শার্লট এতক্ষনে খেয়াল করলো ওকে। রুথের দিকে তাকিয়ে সে অপরাধী গলায় বলল,
— আহারে! তোমাকে আমি এইখানে দাড় করিয়ে রেখেছি! তুমি বসে পড়ো, দেখো ওইদিকে একটা চেয়ার ফাকা আছে! আর আমি ভাইয়াকে বলে দিচ্ছি তোমাকে একটু বেশি করে খাবার দিতে! খাওয়া শেষ হলে তোমাকে আমি চারপাশ টা ঘুরে দেখাবো, ঠিক আছে?

রুথ কে একটা ফাকা চেয়ারে বসিয়ে রেখে ব্রায়ানের সাথে আর একটু কথা বলে শার্লট চলল মিটিং জোনের দিকে।

৪. মিটিং জোনের উত্তর দিকে থাকা কাঠের গুড়ির বসার স্থানে বসে আছে থিয়োডর। পরণে তার একটা হাফ হাতা টি শার্ট, আর ঢোলাঢালা প্যান্ট। মুখ ভর্তি বাদামি রঙা চাপ দাড়ি। মাথা ভর্তি কোকড়া চুল৷ সেটাও বাদামি রঙা। অতিরিক্ত ফর্সা এই লোকটার ডান হাতের কনুই আর কব্জির ভেতরের জায়গাটাতে একটা কালো রঙা স্করপিয়নের ট্যাটু। চোখের মণি জোড়া নীল। শরীরটা পুরু নয়, পাতলা। কিন্তু নিয়মিত পরিশ্রম করার কারণে শরীরটা হয়ে উঠেছে শক্ত, কঠিন।

পঁচিশ বছর বয়সে তেরোটা খুনের অপরাধে তাকে শিরো মিদোরি তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷ আর এরপর দশ টা বছর পার হয়ে গেছে। একসময় একজন সাধারণ ওয়ার্কার হয়েই এই দ্বীপে এসেছিলো সে। আর এরপর নিজের ভালো কাজের মাধ্যমে আউটসাইডার্স আর ওয়ার্কার্স দের মন জয় করে নিয়ে একসময় সে হয়ে উঠলো ওয়ার্কার্স দের লিডার। গত চার বছর ধরে নিষ্ঠার সাথে নিজের দায়িত্ব পালন করে আসছে সে৷ তার শাস্তি কবে শেষ হবে সে বিষয়ে সে কিছুই জানে না। এখানে কাউকেই তাদের শাস্তির ডেডলাইন বলা হয় না! শুধুমাত্র শাস্তি শেষ হওয়ার পরই তাকে খবর টা জানানো হয়, এবং নিজের দ্বীপে ফিরে যাওয়ার ব্যাবস্থা করে দেওয়া হয়। থিয়োডর কিছু বছর আগেও নিজের দ্বীপে ফিরে যাওয়ার আশায় ছিলো, কিন্তু এই শিরো মিদোরি তাকে এতটাই আপন করে নিয়েছে যে সে এখন এই শিরো মিদোরি কেই নিজের বাড়ি ভাবে! তার জন্মদ্বীপে ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই তার আর নেই।

থিয়োডরের বিপরীতে থিয়োডরের দিকে মুখ করে বসে আছে অ্যানা। পরণে তার একটা ঢোলাঢালা ফুল স্লিভ হুডি, আর ঢোলাঢালা প্যান্ট। মুখের ওপর কালো রঙা মাস্কের আবরণ। শুধু মাত্র হাতের কব্জি আর অনিন্দ্য সুন্দর, অদ্ভুত চকচকা চোখ জোড়া ছাড়া তার আর কিছুই দেখা যায় না তার৷ গত দেড় বছরে এই পোশাকের বাইরে অন্য কোনো পোশাকে তাকে কেউ কখনো দেখনি৷ কারণ এটাই তার জন্য নির্ধারিত ড্রেস কোড। হুডির হুড দিয়ে সর্বক্ষণ মাথা টা ঢেকে রাখে সে৷ চুলের একটা কোণাও বের হয়না সেখান থেকে। আর তার শরীরের অবয়বটাও কোনো ভাবেই বোঝা যায় না। আর অতিরিক্ত লম্বা হওয়ার কারণে সে মেয়ে নাকি ছেলে এই বিষয়টা নিয়েও অনেক সময় অনেকে কনফিউশানে ভোগে।

থিয়োডর অপলকে চেয়ে আছে অ্যানার চোখের দিকে। থিয়োডরের এমন দৃষ্টিতে অস্বস্তিতে পড়ছে সে। তার সাথে কিছু কথা বলার জন্য আউটসাইডার্স দের ডাইনিং এরিয়া থেকে তাকে ডেকে নিয়ে এসেছে থিয়োডর, কিন্তু এখনো ভালভাবে সে কোনো কথাই শুরু করেনি, অকারণে অ্যানা কে তার সামনে বসিয়ে রেখেছে আর অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকছে মাঝে মাঝে। এই কারণেই অ্যানা থিয়োডরের সামনে যেতে চায় না। ওই নীল চোখের অদ্ভুত দৃষ্টি তাকে খুব অস্বস্তি তে ফেলে, মনে হয় যেন থিয়োডর তার ভেতর টা পড়ার চেষ্টা করছে।
থিয়োডর অবশেষে কথা শুরু করলো। অ্যানার চোখের গভীরে দৃষ্টি দিয়ে সে নরম গলায় ধীরে ধীরে বলল,

— শার্লটের থেকে সকালে শুনলাম তুমি নাকি রাতের খাবার খাওনি, হেকিম ফাতমা কেও ঢুকতে দাওনি! শার্লট বলেছে আমাকে যে তোমার আঘাত কতখানি গভীর ছিলো। এরপর ও তুমি চিকিৎসা নাওনি কেন?

অ্যানা নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো। থিয়োডর নিজেও জানে অ্যানার থেকে সে কোনো উত্তর পাবে না। মাস্কের আড়ালে থাকা ওই শক্ত চোয়ালদ্বয় খুব কমই আলগা হয় তার, খুব কম কথাই বের হয় সেখান থেকে, কিন্তু অ্যানার চোখ জোড়া কথা বলে, সর্বক্ষণ! কোনো এক অব্যাক্ত বেদনা যেন সর্বক্ষণ ওই বড় বড়, কালো রঙা চোখের দৃষ্টিতে দাপিয়ে বেড়ায়! বুঝিয়ে দিতে চায় অনেক কিছু! তাই অ্যানার এই নিরবতা কে পাশে রেখে তার মনের ভেতর টা পড়ার জন্য অ্যানার চোখের দিকেই দৃষ্টি দিয়ে রাখে থিয়োডর। কিন্তু ওই চকচকা চোখের দৃষ্টি যেন কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে ঘায়েল করে বসে! চোখের ভাষা পড়ার মতো অবস্থা আর থিয়োডরের থাকে না!

অ্যানা নিশ্চুপ থাকায় থিয়োডর আবার বলল,

— আমি ফাতমা কে আবারও ডেকে পাঠিয়েছি। ও এসে তোমাকে চেকআপ করবে। এবার আর ওকে বাধা দিও না৷ আর নিজের যত্ন নাও বেশি বেশি। শার্লটের থেকে শুনলাম তুমি নাকি খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে একটু বেশিই উদাসীন! এমন করলে চলবে কিভাবে? খাওয়া দাওয়ার দিকে নজর দাও! আর এত পরিশ্রম করো না! পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তুমি রেস্টে থাকো, সুস্থ হয়ে গেলে তবেই কাজে এসো। চিন্তা করো না, তোমার স্যালারি থেকে কিছুই কাটা হবে না৷

অ্যানা মুখ খুললো এতক্ষনে, বলল,

— প্রয়োজন নেই মিস্টার ব্রাউন, আমি পুরোপুরি সুস্থ আছি।

ব্যাস, এইটুকু বলেই চুপ হয়ে গেলো অ্যানা। শক্ত চোয়াল দ্বয় আর ও শক্ত করে তাকিয়ে রইলো সে মাটির দিকে। থিয়োডর কিছু বলতে যাবে তার আগেই শার্লট এসে উপস্থিত হলো সেখানে। দ্রুত পায়ে অ্যানার পাশে এসে দাড়ালো সে, তারপর কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

— এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজে আসার কোনো দরকার ছিলো? ওই অসভ্য ক্রিস্টিনা আর বেয়াদব স্টেলা, তোকে কিরকম আঘাত দিয়ে মেরেছে আমি দেখেছি! আর এক টা রাত পার হতে না হতেই তুই এমন প্রিটেন্ড করছিস, যেন কিছুই হয়নি! কাল রাতের খাবার টাও খাস নি। উঠ এখন, খাবার খাবি, তারপর ফাতমার কাছে যাবি৷ তারপর সোজা নিজের মাঞ্জারে চলে যাবি, বুঝেছিস?

অ্যানার ঠোঁটের কোণে সামান্য বাকালো। সে এইখানে আসার পর থেকেই এই মেয়েটা একদম নিজের বড় বোনের মতো করে খেয়াল রাখে তার, শাসন ও করে। দেখে মনে হয় যেন কেউ একজন তার ওপর অ্যানার সমস্ত ভার সপে দিয়েছে। অন্য সবার সাথে রূঢ় আচরণ করলেও শার্লটের সাথে সে বরাবরই খুবই নরম আচরণ করে। তার শক্ত হয়ে থাকা চোয়ালদ্বয় তখন আলগা হয়ে আসে। সবার আড়ালে এই মেয়েটির সাথেই সে মন খুলে অনেক কথা বলতে পারে! সে ছাড়া আর ও একজনের সাথে অ্যানা মন খুলে কথা বলতে পারে, সে হলো ব্রায়ান।

শার্লট তাগাদা দিলো অ্যানা কে আবার। অ্যানা কে হালকা পাতলা কিছু খাইয়ে, হেকিম ফাতমার কাছে নিয়ে গিয়ে একবার ওর পিঠ টা দেখিয়ে নিয়ে আসতে হবে। এমন সময় হেকিম ফাতমা নিজেই সেখানে উপস্থিত হলো। সে এসে থিয়োডর কে বলল,

— মিস্টার ব্রাউন, আপনি আমাকে ডেকেছিলেন?

থিয়োডর ফাতমা কে দেখে খুশি হয়ে বলল,

— হ্যা ফাতমা, ভালো সময়ে এসেছো। অ্যানা কে নিয়ে যাও তোমার মাঞ্জারে। ওর আঘাত গুলো একবার চেকআপ করো, করে আমাকে জানাও।

ফাতমা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল,

— আপনি যা বলবেন, মিস্টার ব্রাউন!

এরপর শার্লট কে ইশারা করলো অ্যানা কে নিয়ে তার সাথে আসতে। শার্লট অ্যানা কে একটা গুতা দিয়ে নিজের সাথে যেতে ইশারা করলে অ্যানা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসা থেকে উঠে দাড়ালো, তারপর হাটা শুরু করলো শার্লটের সাথে সাথে। থিয়োডরের থেকে বেশ কিছুটা দূরে এসে সে শার্লট কে বলল,

— ফাতমা কে দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই শার্লট, আমি পুরোপুরি সুস্থ আছি, আমার পিঠে কোনো আঘাত নেই।

শার্লট ভ্রু কুচকে অ্যানার দিকে তাকিয়ে বলল,

— এ কথা যে কোনো ভাবেই বিশ্বাস যোগ্য না সেটা তুই নিজেও বেশ ভালো ভাবেই জানিস৷ যাকে কাল বিকেলে অমানুষের মতো মেরে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে তার আঘাত এক রাতেই গায়েব হয়ে যাবে! এটা কোনো কথা হলো!

অ্যানা রাস্তার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বলল,

— ঠিক আছে, বিশ্বাস একটু পরেই করে নিবি! ফাতমার মাঞ্জারে গিয়ে।

.

ফাতমার মাঞ্জারে অ্যানার পিঠ খানা দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেলো শার্লট ফাতমা দুজনেই। কাল বিকেলের করা আঘাতের সামান্যতম চিহ্ন ও সেখানে নেই। মনে হচ্ছে যেন এ পিঠের ওপর এই জীবনেও কোনো আঘাত পড়েনি! মাখনের মতো মোলায়েম হয়ে আছে সে পিঠ খানা।

শার্লট ফাতমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে তাকিয়ে বলল,

— ফাতমা, এটা কিভাবে সম্ভব!

ফাতমা নিজেও অবাক হয়ে বলল,

— আমি নিজেও জানি না শার্লট! কাল বিকেলে ওকে ক্রিস্টিনা যেভাবে মেরেছিলো, তাতে তো ওই আঘাত এক মাসেও সারতো কিনা সন্দেহ। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব!

অ্যানা নিজের পিঠ খানা উন্মুক্ত করে উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে ছিলো। শার্লট আর ফাতমা কে নিজের পিঠ খানা দেখিয়ে শোয়া থেকে উঠে সোজা হয়ে বসলো সে। শার্লট ওর সামনে এসে বসে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল,

— এটা কিভাবে হলো, সত্যি করে বল!

অ্যানা শার্লটের এমন দৃষ্টি দেখে নিঃশব্দে হাসলো তারপর বলল,

— আমি নিজেও জানিনা! সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি শরীরে কোনো ব্যাথা নেই, গায়ে জ্বর এসেছিলো রাতে, সেটাও নেই। পিঠে হাত দিয়ে দেখি কোনো আঘাত অনুভব করছিনা। পরে আয়নায় দেখলাম পিঠে আঘাতের কোনো চিহ্নই নেই! এখানে আমার কোনো হাত নেই। আমিও তোদের মতোই অবাক হয়েছি, সত্যি।

শার্লট তখনো সন্দেহের চোখেই তাকিয়ে রইলো অ্যানার দিকে। ফাতমা হা করে তাকিয়ে রইলো অ্যানার কথা শুনে। রাতারাতি একজন মানুষের এমন গভীর আঘাত কিভাবে ঠিক হতে পারে সেটা ভেবেই মাথা ঘুরতে লাগলো ওর। মিস্টার ব্রাউন কে এখনি এই খবর টা দিতে হবে।

এমন সময় হঠাৎ করেই বাইরে থেকে অনেক মানুষের চিৎকার চেচামেচির আওয়াজ ভেসে আসলো। শার্লট, ফাতমা, অ্যানা তিনজনেই একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে ফাতমার মাঞ্জার থেকে বেরিয়ে এলো দ্রুত পায়ে।

ওয়ার্কার দের মাঞ্জার যেখানে গিয়ে শেষ হয়ে গভীর জঙ্গল শুরু হয়েছে চিৎকার টা সেদিক থেকেই আসছে। ওয়ার্কিং এরিয়া থেকে অনেকেই ছুটে চলেছে জঙ্গলের সেই দিক টাতে। থিয়োডর ও আছে তাদের মাঝে। কি হচ্ছে জানার জন্য শার্লট একজন ওয়ার্কার কে উচ্চস্বরে ডেকে জিজ্ঞেস করলো,

— পিটার, কি হয়েছে সবাই ওদিকে যাচ্ছে কেন?

পিটার ছেলে টা নিজেও জঙ্গলের দিকেই ছুটছিলো, শার্লটের প্রশ্নে সে দাঁড়িয়ে গিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে উত্তর করলো,

— জঙ্গলের ভেতরে মিস ক্রিস্টিনার ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া গেছে শার্লট! শরীরের কয়েকটা পার্ট গায়েব ও হয়ে গেছে! আমরা সেখানেই যাচ্ছি……..

চলবে……..

( বেশি বেশি কমেন্ট করবেন সবাই, নইলে কিন্তু আর লিখবো না! 🤧)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here