বাদশাহ_নামা #পর্বসংখ্যা_৫ #আ_মি_না

0
3

#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_৫
#আ_মি_না

রুথ এসেই শার্লটের পাশে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,

— কই যাও তুমি? সাগরপাড়ে?

শার্লট মুখে কিছু বলল না, মাথা নাড়ালো শুধু। ওই অসভ্য মেয়েদুটোর কথার কারণে মেজাজ টা বিগড়ে গেছে ওর৷ সারাক্ষণ হাসি খুশি থাকা শার্লট কে এমন চুপ চাপ আর মুখ ভার করে থাকতে দেখে রুথও বুঝলো শার্লটের কোনো কারণে মেজাজ খারাপ আছে, তাই কথা না বাড়িয়ে বলল,

— চলো আমিও যাই তোমার সাথে, তাবুতে বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না।

শার্লট ইশারায় ওকে আসতে বলে নিজে আগে আগে পা বাড়িয়ে চলে গেলো, আর রুথ চলল ওর পেছন পেছন। শার্লটের থেকে অনেক কিছু জানার আছে রুথের, কারণ বাইরের পৃথিবীতে তার রক্তের সম্পর্কের আর কেউই নাই, সেদিন সে শার্লট কে মিথ্যা বলেছিলো, যে তার রক্তের সম্পর্কের কেউ একজন এখনো ওপারে আছে৷ যদি সেই অছিলায় তাকে ফেরত পাঠানো হয়! কিন্তু গতকাল রাতেই এক বৃদ্ধা আউটসাইডার্স কে দেখেছে সে তাবুতে, যে কিনা সেই ছোট বেলা থেকেই এই দ্বীপে বসবাস করছে, কিন্তু বাহির বিশ্বে ফিরে যাওয়ার সুযোগ তার আর হয়নি কখনোই, কারণ তার ও রক্তের সম্পর্কের কেউই ওপারে ছিলো না। আর এ খবর জানার পর নিজের ভাগ্যে কি রয়েছে সেটা রুথ কালকেই বুঝে গেছে, তাই এই দ্বীপেই বাকি জীবন পার করে দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার মনোভাব নিয়েই সে এগোচ্ছে।

শিরো মিদোরির অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সাগরপাড়ের দিকে এগিয়ে চলল রুথ আর শার্লট৷ কিছুদুর এগোনোর পর রুথ চলতে চলতে পেছন থেকে শার্লট কে প্রশ্ন করলো,

— শার্লট! শিরো মিদোরি ছাড়া আর কয়টা দ্বীপ আছে এখানে?

শার্লট সোজা হাটা চালু রেখেই বলল,

— শিরো মিদোরির দু পাশে দুইটি করে মোট চারটি দ্বীপ আছে; কুরো আহমার, ওয়ারদিচা, কিমালেব আর রামাদি সামা। আর এই পাঁচটিকে এক সাথে পঞ্চদ্বীপ বলে ডাকে সবাই৷

রুথ মনে মনে ভাবলো ‘ কি সমস্ত নাম রে বাবা!’
তারপর মুখে জিজ্ঞেস করলো,

— সেসব দ্বীপ ও কি শিরো মিদোরির মতোই এরকম জঙ্গলে ভরা? আর জনবসতিও এরকম অল্প স্বল্প?

শার্লট তার আশ পাশের পরিবেশের দিকে নজর বুলাতে বুলাতে উত্তর দিলো,

— না রুথ! পঞ্চ দ্বীপের সমস্ত জনগোষ্ঠী বসবাস করে শিরো মিদোরি ব্যাতিত অন্য চারটি দ্বীপে। শিরো মিদোরি তে শুধুমাত্র বাদশাহ, বাদশাহর পরিবারের সদস্য গণ আর রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিরা বসবাস করেন। আর এখানের জঙ্গলের যে দিক টা আমাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে তার বাইরের সমস্ত জঙ্গলেরই কোনো এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, যা আমাদের সাধারণ মানুষের জানা শোনার বাইরে, সেটা শুধুমাত্র রাজপরিবারের মানুষ গুলোই জানে৷ আর এ ছাড়া প্রাসাদে অবস্থিত বাকি সবাই দাস দাসী, এমন কী তুমিও৷ যে মুহুর্তে তুমি এই পঞ্চদ্বীপে পা রেখেছো সেই মুহুর্তেই তুমিও বাদশাহর দাসী তে পরিণত হয়েছো৷ আর আমরা যারা নিজেদের দ্বীপ ছেড়ে শিরো মিদোরিতে নির্বাসিত হয়েছি তারাও শাস্তি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর পঞ্চদ্বীপের নাগরিক নই, আমরা এখন বাদশাহর দাস এবং দাসী৷

শার্লটের উত্তর শুনে রুথ চুপ হয়ে রইলো। এই দ্বীপে প্রবেশ করা মাত্রই সে যে দাসী তে পরিণত হয়েছে সেটা জেনেই তার দুঃখ লাগলো খুব! তার পরিবারের কাছে তাকে পাঠানোর জন্য আবেদন করা হয়েছিলো৷ গতকাল প্রাসাদ থেকে একজন কর্মচারী এসে থিয়োডর কে বলে গেছে যে রুথের ব্লাড রিলেটেড যেকোনো আত্মীয় কে খোজার চেষ্টা চালানো হচ্ছে, পেয়ে গেলেই রুথ কে ফেরত পাঠানো হবে। আর না পাওয়া গেলে রুথ কে সারাজীবন এখানেই পড়ে থাকতে হবে, একজন দাসী হয়ে। রুথের মন খারাপ হলো খুব। এ ছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই! তাকে এখন থেকে দাসী হয়েই কাটিয়ে দিতে হবে সারাটা জীবন। কিন্তু এই শিরো মিদোরির মতো এমন প্রাণ জুড়ানো জায়গায় থাকলে আর কি লাগে? ওর তো এমনিতেও কেউ আর বেচে নেই! তাহলে বাহির বিশ্বের সাথে ওর কিসের আর সম্পর্ক রইলো? হয়তো জন্মস্থানের! আর? আর কি!

ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রুথ। গুমোট করা মন খারাপ টাকে দূরে সরানোর জন্য সে আবার ও শার্লট কে প্রশ্ন করতে শুরু করলো।

— আচ্ছা শার্লট, তোমার অপরাধ কি ছিলো? যার জন্য তোমাকে এখানে নির্বাসিত করা হলো?

শার্লট পেছন ফিরে এক পলক রুথের দিকে তাকিয়ে বলল,

— আমি কোনো অপরাধ করিনি রুথ! আমার ভাই, ব্রায়ান, তার অপরাধের কারণেই আমাদের এখানে আসা। ব্রায়ান অনেক শান্ত, চুপচাপ। কিন্তু রেগে গেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো না, রেগে গেলে হুস থাকে না ওর। আমাদের বাড়িতে শুধু ও আর আমি থাকতাম। কিমালেবের সবচেয়ে ধনি পরিবারের ভেতরে আমরা ছিলাম অন্যতম। কিন্তু আমাদের বাবা মা, আমার যখন দশ বছর বয়স তখন এক দুর্ঘটনার কারণে মারা যান৷ প্রথম প্রথম সবাই খোজ খবর নিলেও ক্রমে ক্রমে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় রা খোজ নেওয়া বন্ধ করে দিলেন। তাই উপায় না পেয়ে দুই ভাই বোন একা একাই থাকতে শুরু করলাম। আস্তে আস্তে বাবার জমানো সম্পদের ভান্ডার খালি হতে শুরু করলো। আর আমাদের দ্বীপ টা অন্য দ্বীপ গুলোর থেকে কিছুটা অনুন্নত, তাই কাজের ক্ষেত্রও ছিলো সীমিত। কোনো রকমে খেয়ে পড়ে বেচেছিলাম। কিন্তু ব্রায়ান বাবার মতোই অনেক হার্ডওয়ার্কার ছিলো৷ পড়াশোনা করতো ও প্রচুর। কুরো আহমারের সব চেয়ে নামীদামী মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি তে ওর এডমিশন হয়েছিলো৷ আর সেই সুবাদে ওর সাথে আমিও কুরো আহমারে গিয়ে থাকি বেশ কয়েক বছর। নিজেদের বাড়ি ঘর ওভাবেই ফেলানো ছিলো। মাঝে মাঝে এসে ঘুরে দেখে যেতাম। কিন্তু একবার গরমের ছুটিতে কিমালেবে এসে দেখি আমাদের বাড়ির দখল নিয়েছে আমার এক দূর্সম্পর্কের চাচা আর তার সন্তানেরা৷ আমরা এসে তাদের কে বাড়ি ছেড়ে দিতে বললে তারা বাড়ি ছাড়তে পুরোপুরি অস্বীকার করে৷ এবং এই নিয়ে কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে হাতাহাতি শুরু হলে সে চাচার এক ছেলে এসে হঠাৎ করেই আমার গলা টিপে ধরে মেরে ফেলার চেষ্টা করে, আর এরপরেই হয় সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক কাজ টি। আমার ভাই চাচার হাতে থাকা ধারালো অস্ত্র টা কেড়ে নিয়ে চাচার পরিবারের সবাই কে কুপিয়ে জখম করে ফেলে। শুধু মাত্র চাচার ছোট মেয়েটা ছাড়া আর কাউকেই বাচাতে পারেনি ডাক্তার রা। আর এরপরেই আমাদের স্থান হলো শিরো মিদোরিতে। এই হলো আমাদের শিরো মিদোরি তে আসার কাহিনী।

কথা শেষ করে শার্লট ঘাড় ফিরিয়ে একবার তাকালো রুথের দিকে। রুথ বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ব্রায়ান ছেলেটা যে রেগে গেলে এতটা ভয়ানক হতে পারে সে সম্পর্কে ওর কোনো ধারনাই ছিলো না। অবশ্য ওর চেহারা দেখেও বোঝার উপায় থাকে না যে ও এরকম কাজ করতে পারে৷ শার্লট রুথের থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার সামনে তাকালো। সাগর পাড়ের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা৷ আর কিছু পথ হাটলেই জঙ্গল শেষ হয়ে সাগরের বালুকাময় তীরের সূচনা ঘটবে৷
|
|
|
|
|
৭. পিটারের দেওয়া ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা মাছের ঝাপি নিয়ে শার্লট যখন কিচেনের দিকে এগোলো ততক্ষণে শিরো মিদোরির আউটসাইডার্স আর ওয়ার্কার্স সবাই-ই জেগে উঠে যে যার কাজে নিয়োজিত হয়ে গেছে৷ ঘড়ির কাটা নয় সংখ্যা টা পার করে সামনে এগোনোর পথে। রুথ ফেরার পথে নিজের টেন্টে চলে গেছে, আর শার্লট ফাতমা কে সাথে করে নিয়ে এসেছে অ্যানা কে সাহায্য করার জন্য। দ্রুত পায়ে কিচেনের দিকে এগোচ্ছে ওরা। আজ অ্যানা একাই সব করছে, আউটসাইডার্স দের সকালের খাবার হতে হতেই আজ দুপুর হয়ে যাবে হয়তো!

ফাতমা আর শার্লট কিচেনের কাছে এসে সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ দেখে একটু অবাক হলো। দুজন একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে কিচেনের দরজার কাছে এসে দরজায় নক করলো দুবার৷ কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ এলো না। ভয় পেলো দুজনেই, স্টেলা সহ অন্য অসভ্য গুলো আবার উল্টাপাল্টা কিছু করেছে কিনা সেটা ভেবেই দুজনের মুখ শুকিয়ে এলো। শার্লট একটা শুকনো ঢোক গিলল, এরপর দরজায় আবারও নক করতে যাবে তখনি খট করে খুলে গেলো দরজার লক।

কিঞ্চিৎ ফাকা হওয়া দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো ওরা দুজন। আর ঢুকেই অবাক হয়ে গেলো দুজনেই। আড়াইশ লোকের খাবার রান্না শেষ! খাবারের বড় বড় ডেগ গুলো ইলেকট্রিক হিটারের ওপর থেকে নামিয়ে রেখে দেওয়া। খাবারের মন মাতানো গন্ধে ম ম করছে চারদিক। আর কিচেনের ডান পাশের দেয়াল ঘেঁষে থাকা চেয়ারে দুই পা দুই দিকে দিয়ে বসে নিজের রিস্টওয়াচের টাচস্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে আছে অ্যানা। স্ক্রিনের ওপর আঙুল নাড়িয়ে কিছু একটা করছে সে৷ গায়ের হুডি টা খুলে চেয়ারের পিঠের ওপর মেলে দেওয়া৷ ট্যাংক টপ টা শরীরের সাথে আটসাট ভাবে লেগে আছে৷ সুডৌল আবক্ষের সাথে সরু কোমর, আর তার নিচেই চওড়া হাই হিপের কাছ টাতে পরণের প্যান্টের সূচনা অংশ টা সেটে আছে৷ লম্বা চুল গুলো বেণি করে কাধের দুপাশ দিয়ে বুকের ওপর দিয়ে দেওয়া। কিচেনের সাদা চকচকা মেঝের ওপরে বৈদ্যুতিক বাল্বের আলো পড়ে, সেটা প্রতিফলিত হয়ে গিয়ে পড়েছে অ্যানার হানি টোনের স্কিনের ওপর, মেঝের সাথে সাথে চকচক করছে সেও৷ মুখের মাস্ক টা অবশ্য সে খোলেনি, কিন্তু তাতেই শার্লট আর ফাতমা হা হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। অ্যানা এই দ্বীপে আসার পর এই প্রথম বার তাকে এইভাবে দেখলো শার্লট আর ফাতমা।

ওদের কে এইভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিস্টওয়াচের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে মাথা তুলে তাকালো অ্যানা৷ শার্লট আর ফাতমা কে এমন হা হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে চেয়ার ছেড়ে বসা থেকে উঠে দাড়ালো ও৷ আর অ্যানা কে উঠে দাঁড়াতে দেখেই ওদের দুজনের মুখের হা আরও বড় হয়ে গেলো যেন! ওই লম্বা গড়নের অসম্ভব সুন্দর গঠনের শরীর টার দিকে তাকিয়েই রইলো ওরা দুজন৷

নিজের লম্বা লম্বা পা ফেলে শার্লট দের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো অ্যানা৷ আর তা দেখে শার্লট চাপা সুরে ফাতমার দিকে কিঞ্চিৎ ঝুকে বলে উঠলো,

— মডেল!

ফাতমা নিজেও অ্যানার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে থেকেই শার্লটের কথার উত্তরে বলল,

— হু!

শার্লট দের দিকে আসতে গিয়েও আবার দাঁড়িয়ে গেলো অ্যানা। তারপর আবার ফিরে গিয়ে, চেয়ারের পিঠের ওপর থেকে হুডি টা নিয়ে গায়ে চড়ালো। এরপর শার্লট আর ফাতমার দিকে এগিয়ে এসে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে হুডির হুড টা মাথায় তুলতে তুলতে বলল,

— এমন হা করে তাকিয়ে আছিস কি কারণে? আমাকে আগে কখনো দেখিসনি এমন তো না!

শার্লট ওরকম ভাবে চোখ বড় বড় রেখেই বলল,
— দেখেছি, কিন্তু এমনে কোনোদিন দেখিনাই!

অ্যানা মৃদু হেসে হুডির স্লিভ দুটো ঠিক করতে করতে বলল,

— রান্না শেষ, আউটসাইডার্স দের খাবারের বেল বাজিয়ে দিয়ে আয়। আর ব্রায়ান আর অন্য কয়েকটা ছেলেকে ডেকে খাবার গুলো আউটসাইডার্স দের ডাইনিং এরিয়াতে নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা কর। আমি কিছুক্ষণ সমুদ্রের পাড়ে হাটবো, ওদিকে যেন কেউ না যায়।

কথা গুলো বলেই গটগট পায়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে গেলো অ্যানা। আর শার্লট আর ফাতমা একে অপরের দিকে হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। ওই মেয়েটা এত অল্প সময়ের ভেতরে এত গুলো সবজি কেটে একা একা এত রান্না কিভাবে করলো? তার থেকে বড় কথা অতো বড় বড় ডেগ গুলো ও হিটারের ওপর থেকে নামালো কিভাবে?

সারাক্ষণ হুডি পরে থাকার কারণে অ্যানার শরীরের অবয়ব কখনোই বোঝা যেত না। শুধুমাত্র অ্যানার পিঠের আঘাত দেখার সময়টাতেই অ্যানা কে সামান্য অনাবৃত অবস্থায় কোনো রকমে দেখেছে শার্লট, কিন্তু সেভাবে খেয়াল করে দেখেনি৷ এতকাল শার্লট ওকে গোলুমোলু ভেবে এসেছে, কিন্তু এ তো পুরোপুরি তার ভাবনার উলটো! অ্যানার শরীর টা অতোটাও স্লিম না হলেও প্রচন্ড আকর্ষণীয়। শার্লটের নিজেরই চোখ উপড়ে যাওয়ার উপক্রম!

মাথা নাড়িয়ে এসব চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে শার্লট ফাতমা কে কিচেনে থাকতে বলে তড়িঘড়ি করে বাইরে চলে গেলো ব্রায়ান কে ডাকতে৷ আর অ্যানা তার ট্রাউজারের দুপাশের পকেটে দুই হাত দিয়ে জঙ্গলের বড় বড় গাছ গুলোকে পাশ কাটিয়ে ধীর পায়ে, সদর্পে হেটে চলল সমুদ্রের দিকে। সে সমুদ্রে থাকা অবস্থায় অন্য কারো সমুদ্রের দিকে যাওয়া পুরোপুরি ভাবে নিষিদ্ধ, আর এই রুলস টি সে এই দ্বীপে আসার পর পরই থিয়োডর কে দিয়ে পাশ করিয়ে নিয়েছে।

.

আউটসাইডার্স দের শুধুমাত্র নিজেদের বাসস্থান পরিষ্কার রাখা আর গল্প করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। তাদের দৈনন্দিনের সমস্ত কাজ করতে হয় ওয়ার্কার্স দের, তাই এক প্রকার রাজার হালে আছে তারা। আর এইভাবে থাকতে থাকতে তারা আজকাল নিজেদের জায়গা ভুলে যেতে শুরু করেছে যেন আস্তে আস্তে!

আউটসাইডার্স দের টেন্ট এর বাইরে কয়েকটা ভাগে বিভক্ত হয়ে গোল হয়ে বসে আছে অনেকেই৷ তাদেরই ভাগের একটাতে অন্যদের সাথে বসে আছে রুথ। অন্যরা গল্প করছে, সে শুনছে কান পেতে। নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে তার একটু কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এইখানে এইমুহুর্তে যারা ওর আশে পাশে বসে আছে তারা সবাই-ই তারই মতো বাইরের পৃথিবী থেকে আগত। সবাই তার মতোই কপাল পোড়া, তাই এদের মাঝে থেকেও কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে সে, আপন আপন একটা অনুভূতি কাজ করছে ওর ভেতর।

ঠিক সেই মুহুর্তেই দূর থেকে, আউটসাইডার্স দের টেন্টের সীমানা ঘেঁষা রাস্তা দিয়ে অ্যানা কে ধীর পায়ে হেটে যেতে দেখা গেলো সমুদ্রের দিকে। আড্ডার মাঝে থাকা রুথের চোখ চলে গেলো সেদিকে। রুথ ওকে দেখেই চিনে ফেললো, হাজার ভিড়ের মাঝেও ওই অ্যানা নামক মেয়েটাকে দেখলেই চেনা যাবে। ভিড়ের মাঝে সবার মাথা ছাড়িয়ে ওই মেয়েটার মাথাই ভেসে ওঠে সবখানে!

শার্লটের থেকে সে শুনেছে যে এইমেয়েটাই তাদের জন্য রান্না করে প্রতিবেলা৷ মেয়েটির রান্নার হাত অসম্ভব সুন্দর, মানতে হবে! জিভে স্বাদ লেগে থাকার মতো। মেয়েটা হেব্বি লম্বাও! কি দারুণ করে হেটে চলেছে, যেন কোনো এক আভিজাত্যপূর্ণ রাজ্যের রাণী, যার মাথা রাজা ছাড়া অন্য কোনো মানুষের সম্মুখে কখনোই নত হবার নয়! ওই রাজকীয় চলন ভঙ্গির দিকে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করছে শুধু।

রুথ কে হা হয়ে সামনে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওদের গ্রুপের জুলিয়া নামের একজন বছর ত্রিশের মেয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলো,

— ভাবওয়ালী কে দেখছো? উনি এভাবেই হাটেন সবসময়, মনে হয় যেন শিরো মিদোরির নবাবজাদী হেটে যাচ্ছেন! করে সামান্য রান্না! অথচ ভাবখানা এমন যেন দেশোদ্ধার করে ফেলে! ঢং!

কথা গুলো শুনে রুথের খারাপ লাগলো কিছুটা৷ মেয়েটিকে এইভাবে বলার কোনো কারণ খুজে পেলো না ও৷ মেয়েটিকে ওর যথেষ্ট ভালো মনে হয়েছে, সবাই যে স্বাভাবিক ভাবে হাটবে তা তো না! তার এইভাবেই হাটার অভ্যাস, এতে খারাপের কি আছে বুঝলো না ও। মেয়ে গুলো এবার নিজেদের এতক্ষণের সমস্ত আলোচনার বিষয়বস্তু এক পাশে সরিয়ে রেখে অ্যানা কে নিয়ে সমালোচনা করতে শুরু করলো। একজন বলে উঠলো,

— সেদিন মিস ক্রিস্টিনার হাতে কি মার টাই না খেলো, তবুও তার ভাব এক বিন্দুও কমেনি! আর কপাল টাও দেখো, মিস ক্রিস্টিনা কেই শেষ মেশ মরতে হলো! এই মেয়েটির ওপর নিশ্চিত কোনো খারাপ শক্তি আছে, নইলে ওকে মারার পরদিনই মিস ক্রিস্টিনা কেন মারা যাবেন? স্টেলার শরীর টাও শুনছি ভালো না৷ সেদিনের পর থেকে তার শরীর টাও প্রচন্ড খারাপ৷ রক্তবমি হচ্ছে নাকি যখন তখন!

এই মেয়টির কথা শুনে অন্য একটা মেয়ে তার কথার বিরোধিতা করে কড়া গলায় বলে উঠলো,

— ওই মেয়েটির সাথে তোমাদের সমস্যা কি বলোতো? তার তো কোনো দোষ দেখিনা কখনো! সে তো কারো সাথে কখনো ঝঝগড়াঝাটি ও করেনা তোমাদের মতো! এরপর ও তাকে নিয়ে তোমাদের এত অসুবিধা কেন? নাকি তোমাদের হিংসা হয় তোমরা ওর মতো স্বচ্ছ আর দৃঢ় মানসিকতার হতে পারোনি বলে! ওরা এখানের স্থানীয়, আর আমিরা হলাম বাহির বিশ্ব থেকে আগত, আউটসাইডার্স, এই কথা টা ভুলে যেও না৷

অ্যানা কে নিয়ে সেখানে তর্ক বিতর্ক বেড়েই চলল, আর তারই এক ফাকে সে সমাগম থেকে চুপিসারে উঠে এলো রুথ। তারপর সবার চোখ এড়িয়ে অ্যানা যে পথে সমুদ্রের দিকে গিয়েছে সেইদিকে পা চালালো ও। ওই অসম্ভব রকম দৃঢ় মানসিকতার মেয়েটির সাথে একবার কথা বলার জন্য মনের ভেতর টা আকুপাকু করছে রুথের৷
|
|
|
|
|
৮. সাদা রঙা তুলার পেজার মতো থরে থরে সাজানো মেঘের ঠিক নিচে নীল রঙে পরিপূর্ণ অসীম জলরাশি। সে জলরাশির ওপর দিয়ে বড় বড় ঢেউ এসে সাদা রঙা ফেনা তুলে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের বালুকাময় তীরে, আর সে ঢেউয়ের সাথে করে বয়ে নিয়ে আসছে কোনো দূর দেশের অজানা অচেনা মানুষের সুখ দুঃখের কথা৷
আকাশে রোদের তেজ কম। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে সমস্ত সমুদ্র সৈকত জুড়ে। আর সে সমুদ্র তীরেই বালুকা ভেদ করে উঠে আসা একটা সাদা পাথরের ওপর বসে আছে অ্যানা৷ দৃষ্টি তার নীল সাগরের ওই অসীমে, যেখানে আকাশ এসে আলতো করে ছুয়ে দিচ্ছে সাগরের নীল পানির রাশি।

ঠিক এমন সময়ে নিজের পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেলো অ্যানা, কিন্তু পেছনে তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করলো না। মুখে বলে উঠলো,

— আমার পাশে এসে বসো, রুথ!

রুথ মেয়েটা থতমত খেলো। এই মেয়েটা পেছনে না তাকিয়েই তাকে চিনে ফেললো কিভাবে! এর সিক্সথ সেন্সও প্রখর, মানতেই হবে!
অ্যানার শীতল স্বরের আদেশে গুটি গুটি পায়ে সে এগিয়ে এসে বসলো অ্যানার পাশে৷ অ্যানা রুথের দিকে না তাকিয়েই আবার বলল,

— তোমাদের খাবার দেওয়া হচ্ছে, তুমি না খেয়ে এখানে এসেছো কেন? এক বেলার খাবার মিস হলে কিন্তু সে বেলা আর খাবার জুটবে না, জানোতো?

রুথ এই মাস্ক পরিহিতা অদ্ভুত সম্মোহনী দৃষ্টির অধিকারীনী রমণীটির দিকে তাকালো। তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদু কন্ঠে উত্তর দিলো,

— হ্যা, জানি। কিন্তু আমার ক্ষিদে নেই।

নিজের কথার প্রতিউত্তরে অ্যানার থেকে কোনো জবাব পেলো না রুথ, কিন্তু অ্যানার মাস্কের আড়ালের ওই রহস্যময় মৃদু হাসিটা তার চোখে পড়লো না। অ্যানা কে চুপ হয়ে থাকতে দেখে রুথ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,

— আচ্ছা, তুমি ওই চারটি দ্বীপের কোন টি থেকে এসেছো?

অ্যানা পৃথিবী পৃষ্ঠ আর আকাশের মিলনস্থল থেকে চোখ সরিয়ে সমুদ্রের তীরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উত্তর দিলো,

— ব্যাক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নিষেধ।

রুথ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো, ঢোক গিলে আগের থেকেও মৃদু স্বরে বলল,

— তাহলে শার্লট বলল কেন? সে কি নিয়ম লঙ্ঘন করেছে? তার কি শাস্তি হবে?

অ্যানা রুথের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

— না, এই নিয়ম শুধুমাত্র আমার জন্য প্রযোজ্য।

এইমুহুর্তে আরও অনেক অনেক প্রশ্ন জমলো রুথের মস্তিষ্কের ভেতর, কিন্তু সে প্রশ্ন গুলো করতে সাহসে কুলাচ্ছে না ওর৷ এই লম্বা, কঠোর মুখের, কঠিন স্বরের মেয়েটির সামনে সে মিইয়ে যাচ্ছে৷ কারণ টা কি ভয়, নাকি শ্রদ্ধা, সেটা নিয়ে বেশ দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে সে নিজেই।

মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে অ্যানাকে রুথ, শুধুমাত্র অ্যানার ওপর আরোপিত এমন অদ্ভুত নিয়মের কারণ জানতে প্রশ্ন করবে ঠিক এমন সময়ে সমুদ্রের ভেতর থেকে হঠাৎ করেই উঠে এলো একঝাঁক ছোট্ট ছোট্ট পার্পল রঙা কাকড়া। কুটি কুটি পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো তারা। ওদের দিকে বললে ভুল হবে, এগিয়ে আসতে লাগলো অ্যানার দিকে।
সবগুলো এগিয়ে এসে অ্যানার কাছে এসে পৌঁছে অ্যানা কে এক প্রকার ঘিরে ধরলো চারপাশ থেকে। কোনো কোনোটি আবার পাথর বেয়ে অ্যানার ট্রাউজারের ওপর চড়ে বসলো। রুথ অবাক হলো কিছুটা, কাকড়া রা তো সচরাচর মানুষের কাছে আসে না! আর এই পিচ্চি গুলা তো অ্যানার কোলে চড়ে বসছে।

ওদের কয়েকটি রুথের দিকেও এগিয়ে এলো, কিন্তু এই ছোট্ট ছোট্ট কাকড়া গুলো দেখতে অসম্ভব সুন্দর হলেও সেগুলোকে নিজের শরীরের দিকে আগাতে দেখে ভয়ের কারণে রুথ ওদের কে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে গেলো, কিন্তু সে কাকড়া গুলোর শরীর স্পর্শ করার আগেই খপ করে রুথের হাত ধরে ফেললো অ্যানা, অ্যানাকে এমন ক্ষীপ্রতার সহিত তার হাত টা ধরে ফেলতে দেখে চমকে তাকালো রুথ। নিজের হাতে ব্যাথা পাচ্ছে ও, অ্যানা প্রচন্ড শক্ত করে ধরে আছে ওর হাত টা, যেন কেউ লোহার বেড়ি দিয়ে রুথের হাতের কবজি টা চেপে ধরে আছে!

মুহুর্তেই সে ব্যাথার ছাপ ফুটে উঠলো রুথের চেহারায়৷ অ্যানা রুথের এমন বেদনাতুর চেহারা দেখে সাথে সাথেই ছেড়ে দিলো রুথের হাত টা৷ তারপর রুথের চোখের দিকে সরাসরি দৃষ্টি দিয়ে সে নরম গলায় বলল,

— ওদের কে আঘাত কোরোনা, এখানের কোনো প্রাণীকে কখনোই আঘাত করবে না, ওরা তোমার কোনো ক্ষতি করবেনা। এই পুরো পঞ্চদ্বীপের ওরা একটি গুরুত্বপূর্ণ আর অবিচ্ছেদ্য অংশ, ওদের শরীরে আঘাত করার অর্থ এই পঞ্চদ্বীপের ইকোসিস্টেম কে আঘাত করা। বুঝেছো?

রুথ অ্যানার ওই চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। একটু আগেও যে চোখ জোড়া কঠোরতায় পরিপূর্ণ ছিলো সেটা এখন অসম্ভব রকম মায়ায় পরিপূর্ণ। কাকড়া গুলো তার শরীরের ওপর বিচরণ করে বেড়াচ্ছে, নির্বিঘ্নে; আর অ্যানাও তাদের কে পরম যত্নে ছুয়ে দিচ্ছে, যেন কত শত দিনের পরিচিত এরা একে অপরের সাথে! কাকড়া গুলো যেন তার সন্তান তুল্য!

কিন্তু এরপরেই ঘটলো সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা। এতক্ষণ সমুদ্রের পানি ওদের পর্যন্ত পৌছাচ্ছিলো না। কিন্তু হুট করেই সমুদ্রের একটা বড়সড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো অ্যানার পায়ের ওপর। আর মুহুর্তের ভেতরেই অদ্ভুত ভাবে অ্যানার মুড পরিবর্তন হয়ে গেলো। কঠোরতার সে শক্ত দেয়াল টা অ্যানার ওপর থেকে খসে পড়লো হঠাৎ করেই৷ চোখে মুখে ওর ফুটে উঠলো অদ্ভুত রকমের খুশি। রুথ কে পুরোপুরি অবাক করে দিয়ে এবার নরম হাতে রুথের ডান টা ধরে ও খুশি খুশি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— শিরো মিদোরির সাথে কানেক্টেড আর বাকি চারটি দ্বীপ দেখেছো?

রুথ অবাক চোখে অ্যানার দিকে তাকিয়ে রইলো, কিয়ৎক্ষণ পর অ্যানার প্রশ্ন টা বোধগম্য হতেই মাথা নেড়ে না বোঝালো ও। আর এরপর রুথ কে আর ও অবাক করে দিয়ে অ্যানা তখনই ওর হাত টা ধরে ওকে টেনে নিয়ে উঠে দাড়াতে দাড়াতে আনন্দ মিশ্রিত কন্ঠে বলল,

— এই পঞ্চদ্বীপ কে একসাথে কেউ কখনোই দেখতে পারেনি, কিন্তু তুমি সৌভাগ্যবান! আজ আমি তোমাকে সেগুলো দেখাবো! দেখবে চলো!

বলেই রুথের হাত ধরে সমুদ্রের ভেতরের দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো অ্যানা…….

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here