বাদশাহ_নামা #পর্বসংখ্যা_৭ #আ_মি_না

0
103

#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_৭
#আ_মি_না

পানির গ্লাস টা মুখে নিতে গিয়েও থেমে গেলো স্টেলা। দরজার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে পানির গ্লাস টা হাত থেকে নামিয়ে আবার টেবিলের ওপর রাখলো। তারপর ভারী, দুর্বল শরীর টা একটু একটু করে টেনে নিয়ে দরজার কাছে পৌছালো ও। ধীর গতিতে, নিঃশব্দে, দরজার ওপর কান পাতলো। কিন্তু কিছুই শুনতে পেলো না। এটাকে নিছক নিজের মনের ভুল ভেবে দরজার কাছ থেকে সরে আবার ও নিজের টেবিলের দিকে পা বাড়ালো স্টেলা। আর ঠিক সেই মুহুর্তে আবারও সেই ফিসফিসে কন্ঠে নিজের নাম শুনতে পেলো ও৷

পা দুটো থমকে গেলো ওর৷ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকালো একবার৷ বাইরে গিয়ে দেখবে কি দেখবে না এই দোনোমনা করতে লাগলো; পরমুহূর্তেই কোনো এক দুর্দমনীয় আকর্ষণের কারণে আবার ফিরে দরজার কাছে এসে ধীর গতিতে দরজার লকটা খুলল স্টেলা। তারপর কিছুক্ষণ সময় নিলো, কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পরই এক প্রকার হ্যাচকা টানে দরজা টা টান দিয়ে খুলে ফেললো স্টেলা৷ আর খুলেই পুরোপুরি চমকে গেলো ও৷

পুরোপুরি কালো পোশাকে আবৃত একটা অতি লম্বা, চিকন শরীরের অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে তার মাঞ্জারের সামনের খোলা জায়গাটায়৷ গাছের ফাক ফোকড় দিয়ে চাঁদের ফকফকা আলো এসে পড়ছে সে অবয়ব টির গায়ের ওপর৷ নিজের চোখের সামনে এমন অস্বাভাবিক কোনো অবয়ব দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা স্টেলা যেন নিজের জায়গায় জমে গেলো, চোখ জোড়া বড়ো বড়ো হয়ে এলো আতঙ্কে, গলা টা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো যেন!

আর স্টেলার এমন অবস্থার মাঝেই অবয়ব টা আস্তে আস্তে নিজের কঙ্কাল সার ডান হাত টা সোজা করে উচু করে ধরলো স্টেলার দিকে, তারপর নিজের লম্বা, লকলকা, ধারালো নখ ওয়ালা আঙুলের ইশারায় কাছে ডাকলো স্টেলা কে। আর সে অবয়ব টি ডাকতেই স্টেলা যেন নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারালো! সম্মোহিতের মতো মাঞ্জারের রোয়াক থেকে নেমে ধীর পায়ে হেটে অবয়বটির দিকে এগিয়ে গেলো স্টেলা৷

হেটে হেটে অবয়বটির একেবারেই সামনে গিয়ে দাড়ানোর পর হুস ফিরলো ওর! নিজেকে অবয়বটির একেবারেই সামনে আবিষ্কার করে প্রমাদ গুনলো স্টেলা! অবয়ব টির কালো পোশাকের আড়ালে থাকা অদৃশ্য মুখটার দিকে তাকিয়ে সে এখন ভাবতে লাগলো কি চরম ভুল টাই না সে করেছে!
কিন্তু এখন! এখন সে কি করবে?

অবয়ব টি এবার নিজেও ধীর পায়ে দুকদম এগিয়ে এলো স্টেলার দিকে। এরপর নিজের লম্বা, হাড় জিরজিরে শরীর টা ঝুকিয়ে স্টেলার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,

— পানি টা তোমাকে আমি খেতে দিলাম না স্টেলা!

আর কথাটা বলেই ফ্যাসফ্যাসে, বিশ্রী শব্দ করে হাসলো সে অবয়ব টি৷ আর সে হাসিতে আত্মা কেঁপে উঠলো যেন স্টেলার!
পা চলছে না ওর! মস্তিষ্ক বারবার বলছে পেছন ফিরে দৌড় দিতে, কিন্তু শরীর টা মস্তিষ্কের সে কমান্ডে সায় দিচ্ছে না৷ নিজের জায়গাতেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে, চোখ বড় বড় করে কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের মতো তাকিয়ে রইলো স্টেলা অবয়বটির দিকে!

হঠাৎ করেই হাসি থামিয়ে নিলো অবয়বটি, তারপর সোজা সুজি স্টেলার দিকে তাকালো। তারপর আবার ও ধীর গতিতে নিজের হাড় সর্বস্ব ডান হাত টা উচু করতে থাকলো সে। আর তার হাত উচু হওয়ার সাথে সাথে স্টেলার শ্বাস যন্ত্র টা যেন সংকুচিত থেকে আরও সংকুচিত হতে শুরু করলো৷ নিজের জায়গায় দাড়িয়েই নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য তড়পাতে লাগলো ও। কিন্তু ক্রমান্বয়ে ফুসফুসে ঢোকা অক্সিজেনের ঘাটতি হতে শুরু করলো!

বুকের ওপর নিজের ডান হাত টা চেপে ধরে বড় বড় শ্বাস নিয়ে দম নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকলো স্টেলা। কিন্তু পুরোপুরি ব্যর্থ হলো! চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো, গলা টা শুনিয়ে কাঠ হতে আসতে লাগলো! শেষ চেষ্টা হিসেবে নিজের বুকের ওপর নিজের ডান হাত টা দ্বারা গায়ের সর্বোচ্চ জোর দিয়ে কয়েকটা কিল দিলো স্টেলা, যদি একটু খানি বাতাস হলেও তার ফুসফুসে প্রবেশ করে সেই আশায়!

কিন্তু সে শেষ চেষ্টাও সফল হলো না স্টেলার! আর এরপর নিঃশ্বাস না নিতে পারার দরুন ফুসফুস টা দুমড়ে মুচড়ে ফেটে গিয়ে মুখ থেকে কলকল করে রক্ত বেরিয়ে এলো ওর! আর এরপরই স্টেলার প্রাণ পাখি টা উড়ে গিয়ে ধাম করে নিশ্চল শরীরটা পড়ে গেলো মাটির ওপর। আর খুলে রাখা বিস্ফোরিত চোখ জোড়াতে লেগে রইলো ভয়ঙ্কর এক কষ্টের ছাপ।
|
|
|
|

১১. রোজকার মতো কাক ডাকা ভোরে সবার আগে ঘুম ভাঙলো অ্যানার। ওর পাশেই মরার মতো ঘুমাচ্ছিলো অ্যানার কুড়িয়ে পাওয়া বনবিড়ালের বাচ্চা, লিন্ডা। গতকাল রাতেই ব্রায়ান আর শার্লটের সাথে আলোচনা করে এই নাম টা সিলেক্ট করেছে ও৷ যদিও ব্রায়ানের মতে বিড়াল হলো বিড়াল, কুকুর হলো কুকুর; নাম ধাম দিয়ে ওর কিছু যায় আসে না। তবুও অ্যানার জন্য কাল ব্রায়ানের বিড়াল আর বিড়াল থাকেনি, লিন্ডা হয়ে গেছে।

অ্যানার নড়াচড়ার শব্দে ঘুমিয়ে থাকা লিন্ডাও আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো৷ তার পর বিছানায় শুয়ে চোখ কচলাতে থাকা অ্যনার কাছে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে অ্যানার গাল চেটে দিলো। হুট করে এসে অ্যানার গাল চেটে দেওয়ায় সুড়সুড়ি লেগে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো অ্যানা! তারপর লিন্ডার কান ধরে ওকে নিজের থেকে সরিয়ে দিলো অন্য দিকে।

বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে লিন্ডার জন্য দুধ গরম করে ওকে খাইয়ে, নিজের জন্য নাস্তা বানিয়ে অ্যানা যখন টেবিলে বসলো তখন হঠাৎ করেই দূরের মাঞ্জার গুলোর দিক থেকে কারো হঠাৎ চিৎকার শুনলো ও৷ নাস্তা খাওয়া রেখে ভ্রু জোড়া কুচকে কান খাড়া করলো ও আবারও কিছু শোনা যায় নাকি দেখার জন্য৷
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরে অনেক মানুষের শোরগোল শুনতে পেলো অ্যানা৷ ব্যাপার টা কি দেখার জন্য নাস্তা টা ওভাবেই ঢেকে রেখে তড়িঘড়ি করে নিজের হুডি টা পরে মুখের ওপর মাস্ক চড়িয়ে নিজের মাঞ্জার থেকে বের হয়ে এলো ও৷

অ্যানার মাঞ্জার টা জঙ্গলের এক কোণায় আর অন্যদের থেকে দূরে হওয়ায় একটু অসুবিধায় পড়তে হয় ওর৷ অন্য দের মতো সব খবর সে সাথে সাথে পেয়ে যায় না৷ সব খবর সে অন্যদের থেকে অনেক দেরীতেই পায়। বলতে গেলে সবার শেষে।

মাঞ্জার থেকে বেরিয়ে মাঞ্জারের দরজাটা লক করে, গাছ পালার ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া, দু ধারে হরেক রঙা কুটি কুটি ফুল ওয়ালা সরু রাস্তা ধরে সামনে এগোলো অ্যানা৷ কিছুদূর যেতেই থিয়োডর কে দেখতে পেলো ও। হন্তদন্ত হয়ে সেও শব্দের উৎসের দিকে হেটে চলেছে৷ থিয়োডর কে এইভাবে কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা হেটে যেতে দেখে পেছন থেকে উচু গলায় ডাক দিলো অ্যানা,

— মিস্টার ব্রাউন!

অ্যানার গলা শুনে থিয়োডর চমকে দাঁড়িয়ে গেলো। অ্যানা দ্রুত গতিতে পায়ে হেটে থিয়োডরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো, আর পেছনে ঘুরে তাকিয়ে অ্যানা কে দেখে শান্ত হয়ে এলো এতক্ষণ ধরে ছটফট করা থিয়োডর। অ্যানার ওই কঠিন অথচ নির্মল চোখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো ও। প্রচন্ড উদ্বেগের কারণে বেড়ে যাওয়া হৃৎপিণ্ডের গতি ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে এলো থিয়োডরের।

অ্যানা থিয়োডরের কাছে এগিয়ে এসে উদ্বেগ পূর্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

— সব ঠিক আছে তো মিস্টার ব্রাউন? আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আর একটু আগেই ওদিক থেকে কারো চিৎকার কানে এলো! কিছু কি হয়েছে?

শব্দের উৎসের দিকে চোখ ইশারা করে বলল অ্যানা। থিয়োডর অ্যানার দিকে সোজা হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে ভ্রু জোড়া অসহায়ের ন্যায় উচিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,

— স্টেলা মারা গেছে অ্যানা! তার মাঞ্জারের সামনে তার লাশ পাওয়া গেছে, লাশ টা এখনো সেখানেই পড়ে আছে। আমি যাচ্ছি সেখানে৷ তুমিও এসো আমার সাথে।

কথা গুলো বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবারও নিজের গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালো থিয়োডর, আর তার পেছন পেছন দ্রুত গতিতে পা চালিয়ে সামনে এগোলো অ্যানা নিজেও৷

দুতিন মিনিটের মাথাতেই স্টেলার মাঞ্জারের সামনে পৌছালো ওরা। সেখানে ছোটখাটো একটা জটলা হয়ে গেছে। স্টেলার লাশ টাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আশে পাশের মাঞ্জারের অন্যান্য ওয়ার্কার্স রা৷ অনেকেই এখনো ঘুম থেকে উঠেনি বা টের পায়নি এই হঠাৎ মৃত্যুর ব্যাপার টা।
থিয়োডর এসে সেখানে পৌছেই ওয়ার্কার্স দের উদ্দ্যেশ্যে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,

— সরে যাও সবাই, কেউ ভুলেও লাশের শরীর স্পর্শ কোরো না!

থিয়োডরের গলার আওয়াজ পেয়ে ওয়ার্কার্স রা দ্রুত গতিতে সরে দাঁড়িয়ে থিয়োডর কে লাশের নিকট যাওয়ার জন্য জায়গা করে দিলো। কিন্তু একই সাথে থিয়োডরের পেছন পেছন আসা অ্যানার দিকে খুব অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো ওরা! ওদের নজর গুলো কেমন জানি সন্দিহান! সেখানে কিছুটা ভয়, কিছুটা অবিশ্বাস, কিছুটা আশঙ্কা দিয়ে পরিপূর্ণ। আর নিজের সহকর্মী দের এমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে খুব অস্বস্তি তে পড়লো অ্যানা, চলার গতি ধীর হয়ে এলো ওর; স্টেলার মৃত্যুর জন্য কি কোনোভাবে তাকে সন্দেহ করছে ওরা?

কিন্তু ওয়ার্কার্স দের সে সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টি উপেক্ষা করে থিয়োডরের পেছন পেছন স্টেলার কাছে এগোলো অ্যানাও৷ ফাতমা সহ আর ও কয়েকজন হেকিম বসে আছে স্টেলার পাশে৷ অ্যানা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে স্টেলার লাশের পাশে দাড়ালো। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো ও স্টেলা কে।

চোখ জোড়া খোলা স্টেলার। তাতে ফুটে আছে বাঁচার জন্য তীব্র আকুলতার চিহ্ন! বেশ কিছু লাল পিপড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে স্টেলার ওই খুলে রাখা চকচকা চোখের ওপর দিয়ে, কিন্তু কেউ তার চোখ জোড়া বন্ধ করে দিচ্ছে না। কারো ফিঙ্গারপ্রিন্টস লাশের শরীরে লাগলে তো তাকেই খুনি ধরে নেওয়া হবে এক দিক থেকে! কে যাবে এই ঝামেলায়?
মুখ টা ওর কিঞ্চিৎ হা করানো, সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে পড়ে এখন শুকিয়ে গেছে। খানিকটা রক্ত বেয়ে পড়ে লেগে আছে স্টেলার বুক থেকে শুরু করে পেটের নিচে পর্যন্ত, আর গাল বেয়ে কিছু রক্ত পড়েছে মাটিতে। পিপড়া গুলো সার বেধে সে রক্তের ওপর মহোল্লাসে ঘুরছে। স্টেলার সাদা ঝকঝকা চামড়া রক্তশূন্যতার কারণে আর ও বেশি ফ্যাকাসে লাগছে।

মৃত্যুর কারণ টা ঠিক কি সেটা দেখে বোঝার উপায় নেই। থিয়োডর ইতোমধ্যেই নিজের রিস্টওয়াচের মেসেজের সাহায্যে প্রাসাদে আউটসাইডার্স আর ওয়ার্কার্স দের জন্য নিয়োজিত কর্মচারীদের নিকট খবর পাঠিয়েছে।
ওয়ার্কার্স দের এ রিস্টওয়াচে শুধুমাত্র মেসেজ ছাড়া অন্য কোনো কমিউনিকেশনের অপশন নেই। শুধু মাত্র ওয়ার্কার্স দের জন্যই বিশেষ ভাবে এগুলো তৈরি করা হয়েছে, আর এটাও তাদের জন্য নির্ধারিত শাস্তিরই একটা অংশ, প্রযুক্তি তগেকে দূরে থেকে যেন নিজেদের শাস্তি টা আর ও বেশি করে উপলব্ধি করতে পারে তাই এই ব্যাবস্থা!
আর ওয়ার্কার্স ব্যাতিত প্রাসাদে থাকা সেই নির্দিষ্ট কর্মচারী দের কাছেই আছে এই রিস্টওয়াচ। থিয়োডর তাদের একজনকেই খবর পাঠিয়েছে৷

অ্যানা স্টেলা কে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে লাশের পাশ থেকে সরে এসে কিছুটা ভিড় কম ওয়ালা জায়গাতে গিয়ে দাড়ালো। ইতোমধ্যে আরও অনেক মানুষই এসে পৌছেছে সেখানে৷ আউটসাইডার্স রাও খবর পেয়ে চলে এসেছে অনেকে। তাদের ভেতর রুথ আর সেই সাথে জুলিয়া নামের মেয়েটিও আছে।
জুলিয়া মেয়েটা এসেই খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা অ্যানার পাশে এসে দাড়ালো। তারপর মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে বলল,

— খেল তো ভালোই দেখাচ্ছো শেফ’ অ্যানা! নিজের সব শত্রুদের একে একে শেষ করে দিচ্ছো। আবার কেউ কিছু টের ও পাচ্ছে না! বাহ! তোমার মতো এমন বুদ্ধিমতি হতে পারলে তো খুব সুবিধা হতো, কেউ এসে দুটো কথা বললেই তাকে যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিতাম, কি বলো?

শেষোক্ত কথা টা বলে জুলিয়া অ্যানার মুখের দিকে মিটিমিটিয়ে হেসে তাকিয়ে থাকলো। কিন্তু অ্যানা জুলিয়ার দিকে তাকালো না। সোজা সামনে তাকিয়েই নির্বিকার কন্ঠে ও উত্তর দিলো,

— হ্যা, আমি খুব ভালোই খেল দেখাচ্ছি। কখন কার কি হয় বলা যায় না। তুমি নিজেও সাবধানে থেকো। দুটো কথা বলতে গিয়ে আবার যমের বাড়িতে যেও না।

বলেই জুলিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো অ্যানা। আর অ্যানার সে দৃষ্টি দেখে দমে গেলো জুলিয়া। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক এলোমেলো ভাবে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে চলে গেলো ও অ্যানার পাশ থেকে। আর জুলিয়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে মাস্কের নিচে বাকা হাসলো অ্যানা৷

জুলিয়া চলে যেতেই হুট করেই কোথা থেকে দ্রুত পায়ে হেটে ব্রায়ান এলো অ্যানার পাশে। তারপর ওর একেবারে কাছে এসে, ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলল,

— অ্যানা! তোমাকে একটা কথা বলি, আশেপাশে এখন তোমাকে নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে আর ও হবে, অনেকেই হয়তো তোমাকে উদ্দেশ্য করে আজেবাজে কথা বলবে, তাদের কারো কথাতেই তুমি কান দিবে না৷ আর তাদের কথা শুনে তুমি মন খারাপ করবে না, ঠিক আছে?

অ্যানা ভরাট দৃষ্টিতে তার সমান উচ্চতার ব্রায়ানের দিকে তাকালো। ওর সে তাকানোতে ফুটে উঠলো নিদারুণ এক অসহায়ত্ব। অন্য মানুষের তার দিকে তাকানোর ভাব ভঙ্গি দেখেই সে বুঝেছে যে স্টেলার মৃত্যুর জন্য সবাই তাকেই সন্দেহ করছে, যেটা পুরোপুরি ভিত্তিহিন! কিন্তু সে এদের কে কিভাবে বোঝাবে যে সে কিছুই করেনি।

অ্যানার ওই ভরাট দৃষ্টিতে তাকিয়ে ব্রায়ান যেন বুঝে ফেললো অ্যনার মনের কথাটা। অ্যানার দিকে আরও একটু এগিয়ে এসে ও বলল,

— আমি জানি অ্যানা, তুমি কিছুই করোনি। তুমি আর যা-ই করো না কেন এইসব কাজে তুমি যে কখনোই নিজেকে জড়াবে না সেটা আমি বেশ ভালোভাবেই জানি। আর যারা তোমাকে অকারণে সন্দেহ করছে তাদের ভুলও ভেঙে যাবে পোস্টমর্টেম এর পর। তুমি চিন্তা করো না৷

অ্যানা নিজের চোখ জোড়া বন্ধ করে উপর নিচে মাথা নাড়ালো। তারপর আবার তাকালো মাটিতে পড়ে থাকা স্টেলার দিকে। সেই মুহুর্তেই দূর থেকে শব্দ করে এসে পৌছালো একটা লাশবাহী গাড়ি, যেটা সরাসরি কুরো আহমার থেকে এসেছে। গাছ পালার আধিক্য আর সরু রাস্তার কারণে গাড়িটি স্টেলার লাশ পর্যন্ত পৌছালো না। ওয়ার্কিং জোনেই থেমে রইলো। তারপর সেখান থেকে দুইজন নির্দিষ্ট পোশাকাবৃত কর্মি স্ট্রেচার নিয়ে নেমে হেটে হেটে চলে এলো লাশের কাছে।
ভিড় ঠেলে স্টেলার লাশ নিয়ে তারা স্ট্রেচারে তুলে লাশবাহী গাড়িতে তুলে আবার রওনা দিলো কুরো আহমারের উদ্দ্যেশ্যে। থিয়োডর ও চলল তাদের সাথে।
যাওয়ার আগে থিয়োডর অ্যানা কে বলে গেলো সকালের রান্নার তোড়জোড় শুরু করতে। সব বন্ধ থাকলেও কারো পেট বন্ধ থাকতে চাইবে না!

এতক্ষণ সবাই চুপচাপ হয়ে ছিলো, কিন্তু লাশ বাহী গাড়িটি সবার চোখের আড়াল হতেই গুঞ্জন শুরু হলো চারদিক থেকে। আর সবাই অদ্ভুত নজরে দেখতে থাকলো অ্যানা কে৷ কিন্তু সেসব দৃষ্টিকে পাত্তা দিলো না অ্যানা। রান্না শুরু করার জন্য কিচেনের দিকে পা বাড়ালো ও৷ পথিমধ্যে নিজের সম্পর্কে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত কথাও কানে এলো তার। কিন্তু সেগুলোকে চুপচাপ হজম করে নিয়ে নিজের রাস্তাতে চলল ও৷

শার্লট সেই জনসমাগমের ভেতরেই ছিলো, রুথ ও ছিলো তার সাথে। অ্যানার বিরুদ্ধে বলা কথা গুলোর যথাসাধ্য প্রতিবাদ করলো শার্লট, কিন্তু এত গুলো মানুষের অটল যুক্তির সামনে তার সে প্রতিবাদ টিকলো না বেশিক্ষন। তাই মন খারাপ করে অ্যনা কে সাহায্য করার জন্য সে নিজেও চলে গেলো কিচেনের দিকে৷ আর শার্লট কে যেতে দেখে উপায় না পেয়ে রুথ ও গেলো ওর পেছন পেছন।

শার্লট আগে আগে হাটছে, আর রুথ ওর পেছন পেছন। রুথের খারাপ লাগছে অনেক৷ অ্যানা মেয়েটা অসম্ভব রকম ভালো। তা সত্বেও তার প্রচুর হেটার্স আছে এখানে৷ ওই অসভ্য গুলোই অন্যান্য মানুষ দের কে উস্কে দিচ্ছে। এই কাজ করে তাদের কি লাভ হচ্ছে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না রুথ।
শার্লট চুপ হয়ে আছে৷ অ্যনার বিরুদ্ধে সবার এত কথা তার ভালো লাগছে না একটুও৷ ব্রায়ান ও এইসব কারণে খুব আপসেট হয়ে আছে। আর এসব কারণে অ্যনার কেমন লাগছে সেটা ভেবেই শার্লটের আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে৷

শার্লটের পেছন পেছন হাটা রুথ হঠাৎ করেই আনমনা শার্লট কে প্রশ্ন করে বসলো,

— শার্লট, ওই বাইরের দ্বীপ গুলোতে যাওয়ার রাস্তা গুলো কোথায়, কোনদিকে?

আনমনে হাটা শার্লট রুথের প্রশ্নে চমকালো কিঞ্চিৎ। তারপর হাটা চালু রেখেই ও উত্তর দিলো,

— সব দ্বীপে যাওয়ার জন্যই নির্দিষ্ট কিছু রোড আছে। তবে শিরোমিদোরি থেকে অন্যান্য দ্বীপে যাওয়ার রাস্তা গুলো ঠিক কোথায় সেটা আমরা কেউই জানিনা। যতদূর শুনেছি সে রাস্তা গুলো সব আন্ডারওয়াটার হাইওয়ে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া শিরো মিদোরি তে অন্যান্য দ্বীপ থেকে কেউ আসে না প্লাস যায়ও না৷

শার্লটের উত্তরে রুথ কিছুক্ষণ ভেবে আবার প্রশ্ন করলো,

— কিন্তু তুমি তো ওই দ্বীপ গুলো থেকে শিরো মিদোরিতে এসেছো? তুমি সে রাস্তা দেখোনাই?

শার্লট রুথের দিকে এক পলক তাকিয়ে উত্তর দিলো,

— শিরো মিদোরি তে নিয়ে আসার সময় আমাদের সবার চোখ কাপড় দিয়ে বাধা ছিলো, কোন রাস্তা দিয়ে এসেছি, কিভাবে এসেছি কিছুই আমরা দেখিনি, শুধু অনুভব করেছি যে আমরা কোথাও যাচ্ছি।

রুথ আর কিছুই জিজ্ঞেস করলো না, শুধু ভাবতে লাগলো নিজের দেশের মানুষের থেকেও এত সিকিউরিটির কি আছে এখানে!
|
|
|
|
|

১২. রাতের প্রায় এগারোটা৷ খাওয়া দাওয়া শেষ করে যে যার জায়গায় চলে গেছে। বৈদ্যুতিক বাল্ব গুলো সবই বন্ধ।চারদিক অন্ধকার হয়ে আছে। শুধুমাত্র মিটিং জোনের লাইব্রেরি এরিয়াতে এখনো টিমটিম করে একটা বাতি জ্বলছে। সেখানে বই হাতে বসে আছে অ্যানা, শার্লট আর ব্রায়ান।

লাইব্রেরির বই এর তাকের সামনে রাখা ছোট ছোট টেবিলের একটিতে তিন জন তিন চেয়ারে বসে আছে৷ অ্যানা আর শার্লট বসেছে মুখোমুখি, আর ব্রায়ান শার্লটের পাশে৷ তিন জনেই নিরব। অ্যানার কোলে শুয়ে ঘুমাচ্ছে লিন্ডা, গরগর শব্দ তুলছে ও ঘুমের ভেতর৷

অ্যনার পূর্ণ মনোযোগ বই এর দিকে, ব্রায়ানের মনোযোগ অ্যানার দিকে আর শার্লটের মনোযোগ আকাশের দিকে৷ কোলের ওপর বই মেলে রেখে সে মাথা উচু করে বিগত পনেরো মিনিট ধরে তারা গুনছে, কারণ তার বই পড়তে একদমই ইচ্ছা করছে না, শুধুমাত্র নিজের ভাইয়ের অ্যানাকে দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য অনিচ্ছা সত্বেও এইখানে জোর করে বসে আছে ও৷ ঘুমে ওর চোখ ভেঙে আসছে!

থিয়োডর এখনো ফেরেনি। সে খবর পাঠিয়েছে আগামী কাল পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে তবেই ফিরবে।

সারাদিনে অ্যানা আর স্টেলার মৃত্যু নিয়ে ওয়ার্কার্স আর আউটসাইডার্স দের ভেতর কানাঘুষা চলেছে। পর পর দুই টা রহস্যজনক মৃত্যুতে তারা বেশ অনেক টাই আতঙ্কিত, আর তার ওপর নির্দিষ্ট একটা চক্র বাকিদের কে অ্যানার বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইছে।
এমনকি আউটসাইডার্স দের তাবু তে রুথ কে নিয়ে বিচার বসানো হয়েছে সারাক্ষণ অ্যানা আর শার্লটের পিছে পিছে ঘুরার কারণে৷
আউটসাইডার্স দের বিনা প্রয়োজনে ওয়ার্কার্স দের সাথে কথা বলা নিষিদ্ধ, আর সেখানে রুথ সারাক্ষণ ওদের আশেপাশেই থাকে। সে নতুন হওয়ায় এই কয়েক দিন তাকে কেউ কিছু বলেনি। কিন্তু এখন অ্যানার ওপরে হওয়া আক্রোশের কারণেই তারা এই সমস্ত করছে।

রুথ কে এইভাবে সবার সামনে বকাবকি করার কারণে সে বেচারি চরম মন খারাপ নিয়ে ঘুমাতে গেছে। রাতের খাবার টাও সে খায়নি।
রুথ কে এইভাবে অকারণে বকাবকি করার কথা শুনে অ্যনারও খুব খারাপ লাগছে। মেয়েটা এইখানে আসার পর থেকে তার আর শার্লটের সাথে সারাক্ষণ ভাব জমাতো৷ এই অল্পদিনেই মেয়েটার ওপর একটা মায়া মায়া ভাব চলে এসেছে ওর, আর আজ ওর জন্যই মেয়েটাকে এইভাবে সবার সামনে বকা খেতে হলো। শুধু শার্লটের পিছে পিছে ঘুরলে হয়তো কেউ ওকে কিছু বলতো না! ভাবতে ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো অ্যানা৷

ব্রায়ান এতক্ষন নিজের হাতে থাকা বই টা মুখের সামনে খুলে রেখে বই এর ওপর দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে আড়চোখে অ্যানা কে দেখছিলো। অ্যনার এমন লম্বা দীর্ঘশ্বাস শুনে সে মুখের ওপর বই টা নিচে নামিয়ে টেবিলের ওপর রেখে বই এর দিকে তাকালো। কিন্তু এক ফোটা মনোযোগও বই এর দিকে দিলো না।

শার্লট এতক্ষনে তারা গোনা শেষ করে আকাশের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মাথা সোজা করে নিজের সামনে তাকালো। অ্যানা কে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে দেখে ও ভ্রু কুচকে বলে উঠলো,

— অ্যানা! তোর গরম লাগছে না? এখন তো ডিউটি আওয়ার শেষ, ড্রেস কোড ফলো করার তো কোনো প্রয়োজন নেই! এখন অন্তত মাস্ক টা খোল, মাথা থেকে হুড টা সরা!

অ্যনা যেন সম্বিত ফিরে পেলো শার্লটের কথায়৷ বই এর ভেতর ডুবে ছিলো ও৷ শার্লটের কথা শুনে নিজের মাথার ওপর থেকে হুড টা সরালো ও কিন্তু মাস্ক খুললো না। চুলের বেনী দুটো হুডির ভেতর থেকে বের করে বুকের ওপর দিয়ে রাখলো। অ্যানা নিজের মাথার ওপর থেকে হুড সরিয়েছে টের পেয়েই ব্রায়ান মাথা উচু করে এক পলক দেখলো অ্যনা কে৷

ঘন, কালো, মিশমিশে চুল গুলো বেনী করে দুপাশে দিয়ে দেওয়া, বেণী দুটোর শেষাংশ অ্যনার উরুতে এসে পড়ছে৷ এই প্রথম অ্যানার চুল গুলো দেখলো ব্রায়ান। অনেক অনেক ক্ষণ ধরে দেখতে মন চাইলো ওর! কিন্তু অ্যানা পাছে কিছু মনে করে সেই ভয়ে আর তাকালো না ও৷ তাড়াতাড়ি অ্যানার থেকে চোখ নামিয়ে বই এর দিকে তাকিয়ে থম মেরে বসে রইলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই কিছু একটা মনে পড়তেই সে সাথে সাথে আবার মাথা তুলে অ্যানার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

— অ্যানা! সেই ‘মেইক অ্যা উইশ’ ম্যাসেজ টা কি তোমার এখনো রোজ আসে?

চলবে…….?

( রিচেক করিনাই, ভুল ভ্রান্তি থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন৷ আর বেশি বেশি কমেন্ট করবেন 💙)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here