বাদশাহ_নামা #পর্বসংখ্যা_৯ #আ_মি_না

0
2

#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_৯
#আ_মি_না

১৫. সন্ধ্যা হতে বেশি দেরি নেই। রুথ তার তাবুতে নিজের টুকটাক কিছু জিনিস পত্র গোছগাছ করছিলো। এই অল্প কয়েকদিনেই তাবু টাকে খুব আপন করে নিয়েছে ও, আপন করে নিয়েছে আশেপাশের সবাই কে৷ এসব ছেড়েই এখন ওকে চলে যেতে হবে ওই সাদা পাথরের ঝকঝকা চকমকা প্রাসাদে! তখন কি সে আর এইভাবে মুক্ত পাখির মতো যেখানে ইচ্ছা সেখানে দৌড়ে বেড়াতে পারবে?

মন টা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ওর। অল্প কিছু দিনের পরিচয়েই এখানের সবাইকে খুব নিজের নিজের মনে হতো; শার্লট, অ্যানা, জুলিয়া, লিলি, সবাইকে!
সন্ধ্যার দিকে নাকি প্রাসাদ থেকে কয়েকজন আসবেন তাকে নিয়ে যেতে৷ চলে যাওয়ার আগে একবার শার্লট আর অ্যানার সাথে গিয়ে দেখা করে আসতে হবে৷
রুথের এসব ভাবনার মাঝেই ওর তাবুর সামনের পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো জুলিয়া৷ রুথ কে নিজের জিনিস পত্র গোছাতে দেখে সে বলল,

— আরে, তুমি এগুলো গুছাচ্ছো কেন? ওরা এসে শুধু তোমাকেই নিয়ে যাবে। তোমার জিনিস পত্র তো নিবে না। ওইটা রাজ প্রাসাদ! ওইখানে তোমার যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হয়তো ইতোমধ্যেই জোগাড় হয়ে গেছে। আর সেগুলো তোমার এই জিনিস গুলোর থেকেও অনেক অনেক অনেক দামী! আমি শুনেছি বাদশাহর যিনি বেগম তিনি নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে দামী আর দুষ্প্রাপ্য লাল রঙা গ্রেনাডিল কাঠের তৈরি পালঙ্কের বিছানায় ঘুমান, যে পালঙ্কের গায়ের সমস্ত নকশা জুড়েই নাকি হিরক খন্ড বসানো। আর তুমি হবে সেই বাদশাহর দাসী, তাহলে তুমিও ওইরকমই অভিজাত্য পাবে! ইশ কি কপাল তোমার রুথ!

শেষোক্ত কথাটি রুথের টলটলে গাল দুটো দুই হাতে চেপে ধরে বলল জুলিয়া। জুলিয়ার কথা শেষ হতে না হতেই তাবুর দরজার কাছ থেকে একটি বৃদ্ধা মহিলার কাপা কাপা গলা ভেসে এলো,

— তুমি যেমন টা ভাবছো তেমন টা মোটেই নয় জুলিয়া! ওই প্রাসাদে যাওয়া মানেই নিজের কপাল পোড়ানো। যেখানে এমনিতেই হাজার হাজার সুন্দরী দাসী দের বাস, সেখানে রুথ তো নগন্য! আর দাসী হয়ে গেলেই যে বাদশাহর মন পাবে তেমন টা আশা করা বোকামি। সেখানে বাদশাহর মন পাওয়ার প্রতিযোগিতার শেষ নেই। সবাই সেখানে যে যার জায়গা থেকে নিজের সর্বোচ্চ টা দিয়ে চেষ্টা করে!

কথা গুলো বলে বৃদ্ধা থামলেন। বৃদ্ধার পরনে একটা ঢোলাঢালা রঙচটা পোশাক, হাতে নিজের চলার পথের ভরসা হিসেবে একটা লাঠি। চুল গুলো সব পেকে সাদা হয়ে গেছে। শরীরের চামড়া গুলো কুচকানো, গালের দাঁতের অধিকাংশই হাওয়া হয়ে গেছে আর বাকি গুলো নড়বড়ে।

বৃদ্ধা নিজের লাঠিতে ঠুক ঠুক আওয়াজ তুলে এগিয়ে এলো তাবুর ভেতরে। রুথ আর জুলিয়া সরে গিয়ে বৃদ্ধা কে বসার জন্য বিছানায় জায়গা করে দিলো। বৃদ্ধা ধীরে সুস্থে দম নিয়ে বসলেন সেখানে। তারপর মাটিতে লাঠির শেষাংশ ঠেকিয়ে লাঠির উপরের অংশে নিজের দুইহাত ঠেকিয়ে তিনি আবারও বলা শুরু করলেন,

— প্রাসাদের অবস্থা হয়তো আর ভালো নেই! আমি যখন এই দ্বীপে এসেছিলাম তখন আমার বয়স ছিলো পাঁচ। আর এখন আমার বয়স পঁচাত্তর। সত্তর টা বছর পার হয়ে গেছে আমার এই দ্বীপে আসার! আর এইখানে আসার পর থেকেই আমি শুনছি এখানের বাদশাহ, বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান। তাহলে ভাবো তার বয়স কত হয়েছে বর্তমানে! শুনেছি তার নাকি কোনো সন্তান সন্ততি ও নেই। বেশ কয়েক বছর আগে উড়ো খবর শুনেছিলাম যে তার কোনো এক দাসী নাকি সন্তান সম্ভবা! কিন্তু এর পরেই একদিন খবর পেলাম কে বা কারা নাকি সে দাসী কে সন্তান সহই খুন করে ফেলেছে! দেমিয়ান রাজবংশের হাতে আর সময় নেই। খুব শিঘ্রই যদি কোনোভাবে একটি পুত্র সন্তান দেমিয়ান বংশে না আসে তবে দেমিয়ান রাজবংশের ক্ষমতার পতন ঘটবে! আর অন্য কোনো বংশ রাজত্ব করবে সেখানে!

কথা গুলো বলে তিনি তাকালেন রুথের দিকে, তারপর ধীরে ধীরে বললেন,

— কোনো ভাবে যদি তুমি বাদশাহর মন জয় করতে পারো, আর তাকে পুত্র সন্তান উপহার দিতে পারো, তবে সেখানের বেগম হয়ে যাবে তুমি! আর তখন বর্তমানের বেগমের কোনো মূল্য থাকবে না, কারণ তার কোনো সন্তান নেই। আর তার বয়স ও অনেক! আমি এইখানে আসার কিছুবছর পর ধুমধাম করে বাদশাহ আসওয়াদ দেমিয়ানের সাথে বিয়ে হয় সেই মেয়ের। এখনো পর্যন্ত তার কোনো সন্তান হয়নি! তাই সে শুধু কাগজে কলমেই পঞ্চদ্বীপের বেগম! বাস্তবে বাদশাহের কাছে তার কোনো মূল্য নেই।

কথা শেষ করে বৃদ্ধা থামলেন আবারও। আর বৃদ্ধার কথায় রুথ যেন আশার আলো দেখতে পেলো! সে যদি সত্যি সত্যিই বাদশাহর মন জয় করে বাদশাহ কে পুত্রসন্তান দিতে পারে তবে সে-ই হবে পঞ্চদ্বীপের এজ এবং এক মাত্র বেগম! এর থেকে বেশি সৌভাগ্যের আর কি হিতে পারে! আর এরপর নিশ্চয় তার সন্তানই সিংহাসনে বসবে! তখন তো তার ক্ষমতাই হবে সব চাইতে বেশি! নিজের বাকি টা জীবন আভিজাত্যের মোড়কে কাটিয়ে দিতে পারবে সে, যখন যা চাইবে তাই পাবে। পঞ্চদ্বীপ কে নিজের হাতের মুঠোয় রেখে দিতে পারবে ও।

গর্বে বুক টা যেন ফুলে উঠলো রুথের। নিজের বেগম হওয়ার পরবর্তী জীবন টা চোখের সামনে কল্লনা করে দেখতে শুরু করলো ও। অসম্ভব সুন্দর অনুভূতিতে ছেয়ে গেলো ওর মন টা! ওই আভিজাত্যপূর্ণ জীবনের কল্পনা করলেও শরীরে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে যেন! কিন্তু ওর সে কল্পনায় ভাটা পড়লো জুলিয়ার ডাকে৷ জুলিয়া ওকে এভাবে নিজের ভাবনায় হারিয়ে যেতে দেখে ওর পিঠে একটা চাপড় দিয়ে বলে উঠলো,

— তুমি দ্রুত তৈরি হয়ে নাও রুথ! প্রাসাদের লোকেরা এলো বলে৷

জুলিয়ার কথাতে রুথের হুস ফিরলো। জিনিস পত্র গোছানো রেখে সে নিজের জন্য পোশাক পছন্দ করতে করতে জুলিয়া কে বলল,

— তোমাদের কথা আমার খুব মনে পড়বে জুলিয়া। আমি মাঝে মাঝেই প্রাসাদ থেকে চলে আসবো তোমাদের কে দেখতে। আর আমি বেগম হওয়ার পর যখন এখানে আসবো তখন তোমাদের সবার জন্যই অনেক অনেক উপহার নিয়ে আসবো!

বৃদ্ধা রুথের বিছানাতেই বসে ছিলেন, রুথের কথা শুনে হাতের লাঠিটা বিছানায় ঠেকিয়ে রেখে দিয়ে তিনি আগের মতো করেই বললেন,

— ওই স্বপ্ন এখানেই মেরে ফেলে যাও মেয়ে। তোমার আগে আর ও অনেকেই ওই প্রাসাদে দাসী হয়ে গিয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের কেউই ওই প্রাসাদের বাইরে আসতে পারেনি। তাদের কে আমরা পরবর্তী তে আর কখনোই দেখিনি। তাই ওই প্রাসাদে যাওয়া মানে বাইরের জগৎ থেকে চিরোকালের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া৷ তাই তুমিও সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করো রুথ!

বৃদ্ধার এহেন কথায় পোশাক পছন্দ করা রেখে তার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে রইলো রুথ! সে কি আর কখনোই বাইরে বের হতে পারবেনা? সারাজীবন কি তাকে ওই প্রাসাদের চার দেওয়ালের মাঝেই বন্দি হয়ে থাকতে হবস? কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব! কিভাবে থাকবে সে? বাইরে বের হতে না পারলে তো তার দম বন্ধ হয়ে আসবে!

রুথের চেহারায় এমন আতঙ্ক দেখে জুলিয়া রুথের কাধ স্পর্শ করলো, তারপর ইশারায় ওকে বুঝালো বৃদ্ধার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে। বয়স হয়েছে তার, এখন কি বলতে কি বলে ফেলে তার ঠিক নেই। জুলিয়ার ইশারায় যেন ভরসা পেলো রুথ, তাই বৃদ্ধার কথা টা নিয়ে বেশি না ভেবে আবারও খুশি মনে নিজের পোশাক পছন্দ করতে লেগে গেলো ও৷
|
|
|
|

১৬. থিয়োডর যখন ওয়ার্কিং জোনে প্রবেশ করলো ততক্ষণে রাত অনেক হয়ে গেছে। ওয়ার্কার্স রা নিজেদের কাজ কর্ম শেষ করে ইতোমধ্যে যে যার মাঞ্জারে চলে গিয়েছে, আর আউটসাইডার্স রা তাদের তাবুতে।
ওয়ার্কার্স দের নতুন লিডারের নাম জানতে এক প্রকার হন্তদন্ত হিয়ে মিটিং জোনের দিকে এগোলো থিয়োডর। সেখানে একমাত্র শার্লট ছাড়া আর কেউ নেই। সে লাইব্রেরীর সামনে রাখা চেয়ার টেবিলে বসে বই পড়ছিলো, আর অল্প কয়েকটা পৃষ্টা বাকি আছে, সেগুলো শেষ করে সে নিজেও চলে যাবে তার মাঞ্জারে।

থিয়োডর এসেই শার্লটের পাশে দাড়ালো, নিজের পোশাক বদলে ফ্রেশ হওয়ার মতো সময়ও তার নেই, তার এখনি নতুন লিডারের নাম জানতে হবে৷
শার্লট বইএর ভেতর ডুবে ছিলো, থিয়োডর এসে পাশে দাঁড়াতেই শার্লট চমকে বলে উঠলো,

— মিস্টার ব্রাউন, আপনি কখন এলেন এখানে?

থিয়োডরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, চুল গুলো এলোমেলো, শার্টের বুকের কাছের বোতাম দুটো খোলা। নীল রঙা চোখ জোড়াতে ক্লান্তির ছাপ৷
ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে টেবিলের পাশ থেকে একটা চেয়ার টেনে বসলো থিয়োডর শার্লটের পাশে, তারপর বা হাতের বুড়ো আঙুল টা দিয়ে কপালের ঘাম টা এক টান দিয়ে মুছে সেটা ঝেড়ে ফেলে ক্লান্ত গ্লায় জিজ্ঞেস করলো,

— অ্যানা কোথায় শার্লট? ও কি নিজের মাঞ্জারে চলে গেছে?

নতুন লিডারের নাম জিজ্ঞেস করার ব্যাপার টার চাইতে থিয়োডরের মস্তিষ্ক অ্যানার খবর নেওয়াটাকেই এখন যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। থিয়োডর নিজেও অবাক হয়ে গেলো যেন! ও কি প্রশ্ন কর‍তে চেয়েছিলো, আর ওর মুখ থেকে কি প্রশ্ন বের হলো সেটা ভেবে চমকিত হলো ও! অ্যানা যেন ওর মনের সাথে সাথে ওর মস্তিষ্ক কেও ধীরে ধীরে নিজের দখলে নিয়ে নিচ্ছে!
থিয়োডরের প্রশ্নে শার্লট হাতের বইটা বন্ধ করতে করতে বলল,

— অ্যানা সমুদ্রের পাড়ের দিকে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই, ওর মন ভালো নেই নাকি তাই।

অ্যানার মন ভালো নেই শুনে থিয়োডর চুপ হয়ে রইলো, অ্যানার মন ভালো নেই! অ্যানার মনটা কখন ভালো হয় বা কখন খারাপ হয় সেটা জানার অধিকার তার নেই। আর অ্যানা তো তাকে কখনো জানাবেও না নিজে থেকে, অ্যানা তো তাকে ওই ভাবে কখনো দেখেইনি!
থিয়োডরের হঠাৎ করেই মনে হলো শার্লটের সাথে অ্যানার যেমন সখ্যতা তেমন সখ্যতা যদি ওরও থাকতো! তাহলে আজ হয়তো অ্যানা তাকে এসে বলতো যে, ‘থিয়োডর, শুনো, আমার মন টা খুব খারাপ, ভালো করে দাও তো!’

কিন্তু সেটা তো কখনোই সম্ভব নয়! অ্যানা কখনোই তাকে এসে এই কথা বলবে না, শুধু মাত্র নিজের কল্পনা ব্যাতিত! এসব ভাবতে ভাবতে থিয়োডর শার্লটের দিকে তাকালো এক পলক। ঠিক এখন, এই মুহুর্তে পাশের চেয়ারে বসে থাকা গোলগাল মুখের এই প্রচন্ড মায়াবী মেয়েটাকে প্রচুর হিংসা হলো থিয়োডরের, মনে হলো ওর যা পাওয়ার কথা তা এই মেয়েটি পাচ্ছে! এটা কোনোভাবেই সহ্য করার মতো না! কি হতো যদি শার্লটের মতো সেও অ্যানার খুব কাছের কেউ হতো! অ্যানা সারাক্ষণ তার আশেপাশে থাকতো, তার সাথে নিজের সব গোপন কথা গুলো বলতো, নিজের মন খারাপের কথা গুলো বলতো! থিয়োডর কি কখনো বিরক্ত হতো? কখনোই না, অ্যানার কোনো কথাতেই সে বিরক্ত হতো না৷ অ্যানার সব কথাই তার ভাল্লাগতো! অ্যানা ঝগড়া করলেও তার ভাল্লাগতো!

শার্লটের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে থিয়োডর সিদ্ধান্ত নিলো সে সমুদ্রের পাড়ে যাবে, অ্যানার কাছে। কাল সকালের পর থেকে এখনো পর্যন্ত একটা বারের জন্যও অ্যানাকে দেখতে পায়নি ও! চোখ দুটো প্রচন্ড তৃষ্ণার্ত ওর! চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ার থেকে উঠলো থিয়োডর, এরপর পা বাড়িয়ে সমুদ্র তীরের রাস্তার দিকে এগোতেই কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে আবার শার্লটের দিকে ফিরে তাকালো থিয়োডর, তারপর শার্লট কে প্রশ্ন করলো,

— শুনলাম আমাকে নাকি আউটসাইডার্স দের লিডার করা হয়েছে, তাহলে ওয়ার্কার্স দের লিডার কাকে করা হয়েছে শার্লট?

শার্লট হাতের বই টা আবার নিজের সামনে মেলে ধরেছিলো, থিয়োডরের প্রশ্নের উত্তরে বইএর দিক থেকে মুখ তুলে ও উত্তর দিলো,

— আমার ভাইয়া, ব্রায়ান কে।

আর এ কথা টা কানে যাওয়া মাত্রই পা জোড়া যেন মাটিতে আঁটকে গেলো থিয়োডরের, ফ্যাকাসে হয়ে গেলো ওই অসম্ভব রকম গৌরবর্ণ মুখখানা, আর প্রচন্ড রকম হতাশায় নিমজ্জিত হলো ওই সমুদ্রের ন্যায় নীল মণীর চোখ জোড়া!

.

নিজের তাবুতে দাঁড়িয়ে আছে রুথ, তার দুইপাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রাসাদ থেকে আগত দুজন দাসী৷ পরনে তাদের প্রাসাদের পোশাক। তাবুর ভেতরের মৃদু আলোয় সে পোশাকের ওপরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথর গুলো চমক দিয়ে উঠছে৷ রুথের সামনে দাঁড়িয়ে রুথের পরনের পোশাক টা ঠিক ঠাক করে দিচ্ছে অন্য একজন দাসী৷ আর তাদের পাশে দাঁড়িয়ে পুরো বিষয়টা তদারকি করছেন প্রাসাদের দাসীদের প্রধান নিয়ন্ত্রক হুমায়রা তাইর। তিনি দাসী দের কে নির্দেশ দিচ্ছেন কিভাবে কিভাবে রুথ কে প্রস্তুত করতে হবে৷

অসম্ভব রকম সুন্দর লাগছে রুথ কে, তার চেহারায় দেওয়া প্রসাধনী আর শরীরের ওপর চড়িয়ে দেওয়া খাস বাদী দের পোশাক টাতে অপ্সরার ন্যায় দেখাচ্ছে ওকে। নিজের সামনে থাকা ফুল ভিউ মিররে মাঝে মাঝে তাকিয়ে নিজেকে দেখছে রুথ। এতটা সুন্দর তাকে আগে কখনোই লাগেনি।
আজ থেকে সে বাদশাহর খাস বাদী হবে, বাদশাহর সাথে এক বিছানায় থাকবে, হোক না সে বৃদ্ধি, সে তো ক্ষমতা বান! পঞ্চদ্বীপের বাদশাহ, নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান! নাম টা শুনলেও যেন মনে হয় এক ক্ষমতার পাহাড়!
একটিবার বাদশাহর মনে জায়গা করে নিতে পারলে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না ওকে, বাকিটা জীবন ওই প্রাসাদেই ক্ষমতা হাতে করে নিয়ে আভিজাত্যের সাথে কাটিয়ে দিতে পারবে সে৷
আজকের রাত টা যে তার অদ্ভুত রকমের সুন্দর কাটবে, ব্যাপার টা ভাবতেই বুকের ভেতর তার রক্ত ছলকে উঠছে যেন! অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে যাচ্ছে ওর সারা শরীরে।

রুথ কে পুরোপুরি তৈরি করা হয়ে গেলে প্রধান নিয়ন্ত্রক হুমায়রা তাইর রুথ কে আদেশের সুরে বললেন,

— তোমার যাদের থেকে বিদায় নেওয়ার প্রয়োজন নিয়ে আসো, দ্রুত ফিরে আসবে, আমরা এখানেই অপেক্ষা করছি। আর হ্যা, এটাই কিন্তু তাদের সাথে তোমার শেষ দেখা৷

হুমায়রা তাইরের আদেশে রুথ মাথা নামিয়ে মৃদু হেসে ধীর পায়ে আনুগত্যের সাথে তাবু থেকে বেরিয়ে গেলো, আর মাথার ভেতরে ওর ধাক্কা খেতে লাগলো ‘শেষ দেখা’ শব্দ টা৷ মন টা খারাপ হয়ে গেলো ওর৷ দ্রুত পা চালিয়ে এগোলো ও। আউটসাইডার্স দের ভেতরের কিছু প্রিয় মানুষের সাথে দেখা করেই শার্লট আর অ্যানার সাথে দেখা করে আসবে ও। আর যে কখনোই তাদের কে দেখার সুযোগ হবে না ওর৷

.

আউটসাইডার্স দের সবার সাথে দেখা করা শেষ করেই রুথ ছুটলো ওয়ার্কার্স দের মিটিং জোনের দিকে, রাত অনেক হয়ে গেছে, এখন হয়তো মিটিং জোনে কাউকেই পাওয়া যাবে না, তবুও শেষ আশা নিয়ে রুথ দ্রুত পায়ে ছুটলো সেদিকে৷ খানিকক্ষন বাদে মিটিং জোনে পৌছালো ও, কিন্তু ততক্ষণে সেখানের শেষ বাতিটাও নিভে গেছে। অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছে পুরো মিটিং জোন টা।

মিটিং জোনের প্রবেশ দ্বারে দাঁড়িয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে পুরো জায়গাটাতে একবার চোখ বুলালো রুথ। শার্লট আর অ্যানার সাথে হয়তো আর কখনোই তার দেখা হবে না! ওই গোলগাল মায়াবী মুখ আর ওই শক্ত কঠিন চোখ জোড়া, কোনোটাই আর দেখবে না রুথ কখনো, খুব মনে পড়বে যে ওদের!
চোখের কোন টা তর্জনী দ্বারা মুছে নিয়ে রুথ পেছন ফিরে চলে যেতে নিলো, ঠিক তখনই মিটিং জোনের লাইব্রেরি এরিয়া থেকে ভেসে এলো একটি পুরুষ কন্ঠস্বর৷

— রুথ! তুমি এই অসময়ে এই সাজে কি করছো?

অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো থিয়োডর। এতক্ষন ধরে সে এখানেই বসে ছিলো৷ শার্লট আরও আগেই উঠে চলে গিয়েছে নিজের মাঞ্জারে, কিন্তু সে যায়নি৷ অ্যানার সাথে দেখা করতেও যায়নি! বুকের ভেতরে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার, নিজের লিডার পদ টা হারানোয় হতাশা গ্রাস করেছে তাকে! অন্য কেউ ওয়ার্কার্স দের লিডার হলেও থিয়োডর এতটা কষ্ট পেতো না, কিন্তু কষ্ট টা অনেক অনেক গুন বেড়ে গিয়েছে শুধু মাত্র ব্রায়ানের লিডার হওয়ার খবর টা শুনে৷ সেই তখন থেকেই এই অন্ধকারের ভেতর একাকি বসে সে বেদনাবিলাস করছিলো, আর সে সময়েই রুথ কে এমন পোশাকে দেখে অবাকতার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো থিয়োডর।

আর থিয়োডরের কন্ঠ টা চিনতে পেরেই রুথ ফিরে দাড়ালো আবার, থিয়োডর রুথের দেখার সুবিধার্থে নিজের মাথার ওপরের বাতি টা জ্বালিয়ে দিলো। আর থিয়োডর বাতি টা জ্বালাতেই দ্রুত পায়ে, নিজের রাজকীয় পোশাকে ঝম ঝম শব্দ তুলে সেদিকে এগিয়ে গেলো রুথ৷
থিয়োডর নিজেও চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে এলো রুথের দিকে৷ এরপর রুথের কাছাকাছি পৌঁছে সে জিজ্ঞেস করলো,

— কি ব্যাপার রুথ, কোনো সমস্যা হয়েছে? এত রাতে তুমি এখানে, এই অবস্থায় কি করছো?

রুথ নিজের রাজকীয়, মাটি স্পর্শ করা গাউন পোশাক টা নিজের দুই হাতের সাহায্যে মাটি থেকে কিঞ্চিৎ উপরে তুলে নিয়ে বলল,

— আমি চিরকালের জন্য এ জায়গা ছেড়ে প্রাসাদে চলে যাচ্ছি মিস্টার ব্রাউন, বাদশাহ আমাকে নিজের দাসী হিসেবে পছন্দ করেছেন। প্রাসাদ থেকে লোকও এসেছে আমাকে নিতে, তারাই আমাকে এইভাবে, এই পোশাকে সাজিয়ে দিয়েছে। একবার প্রাসাদে গেলে আমি আর কখনোই কারো সাথে দেখা করতে পারবো না মিস্টার ব্রাউন! তাই চলে যাওয়ার আগে শেষ বারের মতো শার্লট আর অ্যানার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তাদের কারো সাথেই আমার আর দেখা হলো না!

শেষের কথা গুলো বলতে গিয়ে গলা ধরে এলো রুথের৷ চোখের কোণে বিন্দু পরিমাণ পানির রেখা দেখা দিলো। আর থিয়োডর, সে রুথের প্রাসাদে যাওয়ার কথা শুনে খুশি হলো প্রচন্ড, উচ্ছসিত হয়ে ও বলে উঠলো,

— তুমি তো বিরাট ভাগ্যবতী রুথ!

কিন্তু থিয়োডরের এ বাক্য শেষ হতে না হতেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো রুথ৷ আর রুথ কে কান্না করতে দেখেই থিয়োডর স্মিত হেসে বলে উঠলো,

— আরে বোকা মেয়ে, তুমি প্রাসাদে যাচ্ছো! যে সুযোগ পাওয়ার জন্য হাজার হাজার মেয়েরা হাহুতাশ করে সে সুযোগ তুমি না চাইতেও পেয়ে গেছো! তোমার তো খুশিতে লাফানোর কথা! আর ওই প্রাসাদে গেলে এমনিতেও তুমি আর ফিরে আসতে চাইবে না৷ তাই আর কান্না করো না! আর তোমাকে যা সুন্দর লাগছে তাতে বাদশাহ চোখ ফেরাতে পারবে বলে মনে হয় না, তোমাকে দেখতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে নিশ্চিত!

থিয়োডরের এই ছোট্ট রসিকতায় কান্নার মাঝেও হেসে উঠলো রুথ! এরপর নাক টেনে চোখ মুছলো, তারপর ধরা গলায় বলল,

— আমাকে এখন ফিরতে হবে মিস্টার ব্রাউন, ওনারা অপেক্ষা করছেন। শার্লট আর অ্যানাকে বলে দিবেন আমি তাদের বিদায় জানিয়েছি!

থিয়োডর মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,

— ঠিক আছে রুথ! আমি বলে দিবো ওদের, তুমি নিশ্চিন্তমনে ফিরে যাও। আর নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা। আশা করি সেখানে গিয়ে অনেক সুন্দর ওকটা জীবন পাবে তুমি।

রুথ থিয়োডরের দিকে তাকিয়ে সৌজন্য মূলক হাসি দিয়ে মিটিং জোন থেকে প্রস্থান করলো, আর থিয়োডর দাঁড়িয়ে রইলো মিটিং জোনের মাঝে। এই মেয়েটার ভাগ্য আর নিকের ভাগ্য টাকে পাশাপাশি দাড় করিয়ে পরিমাপ করলো ও৷ মেয়েটা কতই না ভাগ্যবান! না চাইতেও কত উচ্চপর্যায়ে চলে গেলো সে, আর এত চাওয়ার পর ও নিজের লিডার পদ টা হারিয়ে ফেললো ও! ব্যাপার টা ও এখনো মেনে নিতে পারছে না, কোনো ভাবেই!

.

বড়ো বড়ো গাছ পালার ভেতর দিয়ে, আকাশে থাকা এক ফালি চাঁদের আলোতে রাস্তা দেখতে দেখতে নিজের পরনের পোশাক টা দু হাতে মাটি থেকে কিছুটা উচু করে ধরে এগিয়ে চলেছে রুথ। থেকে থেকে নাক টানছে সে। শার্লট আর অ্যানার সাথে দেখা হয়ে গেলে হয়তো এতটা খারাপ লাগতো না, কিন্তু দেখা হয়নি বলেই খারাপ লাগছে ওর! ডান হাত থেকে পোশাক টা ছেড়ে দিয়ে নিজের অনামিকা দ্বারা চোখের কোণায় জমা পানির কণা গুলো মুছে ফেললো রুথ। তারপর আবারও পোশাক ধরে হেটে চলল আউটসাইডার্স দের তাবুর দিকে। প্রাসাদ থেকে আসা ওই প্রৌঢ়া নারী আর মেয়ে গুলোকে অনেক ক্ষন যাবৎ অপেক্ষা করিয়ে রেখেছে ও৷ তাদের কে এতটা সময় অপেক্ষা করানোটা বৃথা গেলো ওর, যাদের সাথে দেখা করার জন্য এতখানি আসা তাদের সাথেই ওর দেখা হলো না!

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনের দিকে তাকিয়ে হেটে চলল রুথ। ঠিক তখনই নিজের আশে পাশে কারো একজনের উপস্থিতি অনুভব কিরলো ও, আর সাথে সাথেই থমকে গেলো ওর পা জোড়া।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here