বাদশাহ_নামা #পর্বসংখ্যা_১৬ #আ_মি_না

0
84

#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_১৬
#আ_মি_না

(গল্পের প্রয়োজনে কিছু ইনঅ্যাপ্রোপিয়েট ওয়ার্ড যুক্ত করা হয়েছে, কারো অস্বস্তি হলে এই পর্ব টা স্কিপ করতে পারেন)

২৬. দুপুরের খাওয়ার পর নিজের কামরায় জানালার ধার ঘেঁষে বসে ছিলো রুথ। বাইরে টা দেখছিলো ও। ওর কামরা টা প্রাসাদের সাতাশ নম্বর ফ্লোরে৷ এখান থেকে আশপাশের জঙ্গল টা খুব সুন্দর ভাবে দেখা যায়। রুথ সময় পেলেই ওই রহস্যপূর্ণ জঙ্গলটার দিকে তাকিয়ে দিন পার করে।

সেদিন আফিয়ার থেকে সে শুনেছে এই জঙ্গলের নাকি বিশেষ কিছু ক্ষমতা আছে যা সম্পর্কে শুধু রাজপরিবারের লোকেরাই অবগত। এই জঙ্গল টার ঠিক কি বিশেষ ক্ষমতা আছে সেটা তারও জানার খুব ইচ্ছা! কিন্তু তার গর্ভে বাদশাহর সন্তান আসলেও তো সে রাজপরিবারের সদস্য হতে পারবে না। সে যে একজন সাধারণ দাসী মাত্র! তাকে দাসী হিসেবেই দেখা হবে সারাটা জীবন, তার বেশি কিছু নয়।
কিন্তু কি হবে যদি সে বাদশাহর মন জয় করে নিতে পারে! তবে কি বাদশাহ তাকে এই জঙ্গলের গোপনীয় ব্যাপার গুলো বলবেন? সেও কি তবে তখন রাজপরিবারের অংশ হওয়ার মতো সৌভাগ্য অর্জন করতে পারবে?

রুথের এসব ভাবনার মাঝেই আফিয়া এসে ঢুকলো ওর কামরায়। ঢুকেই ভেতর থেকে দরজা টা বন্ধ করে দিয়ে দ্রুত পায়ে হেটে রুথের বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠলো,

— জানালার কাছে আর দাঁড়াবে না তুমি রুথ!

রুথ চকিতে পেছন ফিরে তাকিয়ে আফিয়া কে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। জঙ্গল টা দেখতে সে এতটাই মগ্ন ছিলো যে আফিয়ার উপস্থিতি সে টেরই পায়নি। আফিয়ার এমন কথায় জানালা দিয়ে আর একবার বাইরে তাকিয়ে আফিয়ার দিকে ফিরে সে জিজ্ঞেস করলো,

—কেন? তাকালে কি হবে?

আফিয়া জানালার কাছে এসে জানালার গ্লাস গুলো বন্ধ করে দিতে দিতে বলে উঠলো,

— আজ থেকে জানালা দিয়ে বাইরে দেখা বন্ধ। কামরা থেকেও তুমি বের হবে না কোনো প্রয়োজন ছাড়া। আর বের হলেও সাথে অবশ্যই কাউকে না কাউকে রাখবে। আমি কামরার বাইরে আমার দুজন বিশ্বস্ত দাসী কে রেখেছি, যেকোনো প্রয়োজনে তাদের কে ডেকে নিবে। একা একা মাতবারি করে কিছুই করতে যাবে না৷ আর হ্যা, রাতের বেলা ভুলেও কামরা থেকে বের হবে না৷ আমি বা হুমায়রা তাইর এসে ডাকলেও না৷

আফিয়ার কথায় রুথ কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বলল,

— কেন? তোমরা এসে ডাকলেও যাবো না কেন?

— কারণ আমরা এসে ডাকলে তোমাকে সন্ধ্যার আগেই ডাকবো, রাতে নয়। রাতে তোমাকে আমাদের কেউই ডাকতে আসবে না।

আফিয়ার কথায় খানিক টা ভয় পেলো রুথ, ভীতসন্ত্রস্ত কন্ঠে ও জিজ্ঞেস করলো,

— তোমরা আসবে না ডাকতে তাহলে কারা আসবে? কি বলছো তুমি আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!

আফিয়া জানালার পর্দা গুলো টেনে দিতে দিতে বলল,

— অতো প্রশ্ন করবে না, যেটা বলেছি সেটা শুনবে৷ রাতের বেলা তোমার কোনো পরিচিত কন্ঠ শুনলে ভুলেও তার ডাকে সাড়া দিবে না, বা দরজা খুলবে না নিজে গিয়ে, জানালাও না। যদি কেউ সত্যি সত্যিই তোমাকে ডাকতে আসে তবে দাসীরা নিজেরাই দরজা খুলে দিবে, বুঝেছো?

রুথ আফিয়ার কথায় উপর নিচে মাথা নেড়ে সায় জানালো, কিন্তু ওর মাথার ভেতর আফিয়ার কোনো কথা ঢুকলো না। এ প্রাসাদে কি এমন কিছু আছে যা তার থেকে লুকানো হচ্ছে! তাকে নিয়ে এত সাবধান সাবধান খেলছে কেন সবাই? তবে কি তারও প্রাণনাশের সম্ভাবনা আছে অন্য দাসী গুলোর মতো? অ্যানা কি তবে এসব কারণেই তাকে সাবধান করেছিলো!
রুথ কে এমন চিন্তার দুনিয়ায় হারিয়ে যেতে দেখে আফিয়া জানালার কাছ থেকে সরে রুথের পাশে এসে বসলো, তারপর মুখে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে চিন্তিত রুথ কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

— এত চিন্তা করো না, নইলে এই চাঁদের মতো মুখ খানাতে তার ছাপ পড়ে যাবে, আর বাদশাহর খাস কামরায় যাওয়াটাও তখন মাটি হয়ে যাবে। এখন এদিকে তাকাও তো!

শেষোক্ত কথা টা বলে রুথের চিন্তিত মুখ খানা নিজের ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা দ্বারা নিজের দিকে ফেরালো আফিয়া, তারপর হাসি হাসি মুখ করে উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— সকালের ব্যাস্ততার কারণে কিছুই শুনতে পারিনি, এখন বলো, বাদশাহ গতকাল তোমার সাথে সমস্ত রাত ছিলেন?

আফিয়ার প্রশ্ন শেষ হতেই রুথের গতরাতের সমস্ত স্মৃতি গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলো, মুহুর্তেই মনে পড়ে গেলো সেই আনন্দ মিশ্রিত কষ্টের স্মৃতি গুলো। আর সেসব মনে পড়তেই লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিলো রুথ, তারপর বলল,

— না, উনি হঠাৎ করেই বিছানা ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেছিলেন, তারপর সারা রাতে আর ফেরেননি হয়তো। আমি ভেবেছিলাম উনি হয়তো ফিরে আসবেন দ্রুতই, ওনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম কখন বলতে পারিনা৷ কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠেও ওনাকে দেখতে পাইনি আমি।

কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ চুপ থেকে রুথ আবারও বলে উঠলো,

— খুব ইচ্ছা ছিলো সকালে ঘুম ভাঙার পর নিজেকে ওনার বাহুডোরে আবদ্ধ দেখতে পাবো, চোখ তুলে তাকালেই ওনার সেই অসম্ভব সুন্দর মুখ খানা দেখতে পাবো, কিন্তু সেটা আর হলো কই!

শেষোক্ত কথা গুলো বলতে গিয়ে মুখের হাসি ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এলো রুথের। আফিয়া সেটা খেয়াল করে বলে উঠলো,

— আরে মন খারাপ করে না, সব হবে, আস্তে আস্তে। উনি ঠিকই তোমাকে নিজের মনে জায়গা দেবেন, ধৈর্য ধরো শুধু। আর এখন তো প্রাসাদে আমাদের বেগমও নেই, তাই তোমাকে ওনার মনে জায়গা করে নেওয়ার পথে কেউ বাধা হয়ে দাড়াতে পারবে না।

বেগম শব্দটা কানে আসতেই রুথ উৎসুক দৃষ্টিতে আফিয়ার দিকে তাকিয়ে আগ্রহভরে প্রশ্ন করলো,

— কেন, উনি কোথায়?

তারপর কিছুক্ষণ ইতস্তত করে চাপা সুরে আফিয়া কে জিজ্ঞেস করলো,

— উনি কি মারা গেছেন, আমি শুনেছি ওনার নাকি অনেক বয়স!

রুথের এমন প্রচন্ড উৎসুক দৃষ্টি দেখে আফিয়া স্মিত হাসলো, তারপর বলল,

— হ্যা, ওনার অনেক বয়স, এটা সত্যি। কিন্তু উনি তোমার আমার মতো স্বল্প আয়ুর কেউ নন৷ উনি দেমিয়ান বংশেরই মেয়ে। তাই ওনার আয়ুও তাদের মতোই।

রুথ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবনা চিন্তা করে আবার প্রশ্ন করলো,

— নিজেদের বংশ! তাহলে ওনারা সম্পর্কে কি হন?

আফিয়া বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল,

— ব্যাপার টা খানিক টা ঘোলাটে৷ আমাদের বাদশাহ, আমাদের বেগমের দাদাজানের ভাইয়ের ছেলে, বেগমের বাবার চাচাতো ভাই। সম্পর্কের দিক থেকে ওনারা চাচা ভাতিজি। দেমিয়ান বংশে মেয়েদের জন্ম খুব কম হয়, আর এটা একটা প্রকৃতি প্রদত্ত বিষয়। দুই থেকে তিন হাজার বা তার ও বেশি সময় পর পর এক একটা মেয়ের জন্ম হয়। আমাদের বেগম সেই বহুল আকাঙ্ক্ষিতদের একজন। আর দেমিয়ান বংশে নিজ বংশের ভেতরে বিবাহ নিষিদ্ধ। কিন্তু ওনারা দুজন কেন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন সে বিষয়ে আমরা কিছুই জানিনা। শুধু আমরা কেন কেউই হয়তো জানে না!

কথা গুলো শেষ করেই আফিয়া কিয়ৎক্ষণ বিরতি দিয়ে দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল,

— বাকি কথা পরে হবে, এখন তুমি এখানেই থাকো। আমার অনেক কাজ আছে। কাজ বাদ দিয়ে আমি এখানে এসে তোমার সাথে গল্প করছি শুনলে হুমায়রা তাইর আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দিবেন।

আফিয়া কে চলে যেতে দেখে রুথ কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে ভ্রু তুলে তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করলো,

— আমি আজ ওনার কাছে যাবো না?

রুথের এমন আগ্রহভরা চেহারা দেখে আফিয়া শব্দ করে হেসে উঠলো, তারপর বলল,

— ইশ, প্রেয়সীর আর তর সইছে না! উনি আজ প্রাসাদে থাকবেন না। আজ একটি বিশেষ রাত, তাই আজ উনি বাইরে থাকবেন। আর উনি এসে তোমাকে ডেকে পাঠালে তবেই তুমি তার দেখা পাবে, নইলে না।

বলেই এক টুকরো স্মিত হাসি রুথের দিকে ছুড়ে দিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেলো আফিয়া। আর রুথ কিছু মুহুর্ত আগে আফিয়ার বলা কথা গুলো নিয়ে নিজের মস্তিষ্কের ভেতর বিশ্লেষণ শুরু করলো।
.
.

২৭. মধ্যরাত পেরিয়ে ঘড়ির কাটা পরবর্তী প্রহরের দিকে এগিয়ে চলেছে৷ থিয়োডর বসে আছে মিটিং জোনে, একা একাই বসে আছে ও সেখানে, আর বাকিরা সবাই ঘুমে। ওর ও প্রচন্ড ঘুম ঘুম লাগছে, অথচ আজকে তেমন কিছুই করেনি ও ক্লান্ত লাগার মতো। কোনোদিনও এমন ক্লান্ত লাগে না ওর, শুধুমাত্র মাসের একটা নির্দিষ্ট দিনে ওর ক্লান্ত লাগে, শুধু ওর না বাকি সবারই। যার জন্য চারদিক আজ পুরোপুরি নিরব। ওয়ার্কার্স, আউটসাইডার্স, কারো আবাসিক এলাকা থেকেই কোনো রকম টু শব্দটি আসছে না।

থিয়োডরের চোখ লেগে আসছে কিন্তু দুঃশ্চিন্তা ওকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। একবার নিজের মাঞ্জারে ঘুমাতেও গেছিলো ও কিন্তু মাথার ভেতরে ঘুরপাক খাওয়া এলো মেলো চিন্তা গুলোর কারণে ওর আর ঘুম আসেনি। তাই আবারও উঠে এসেছে এখানে।
লাইব্রেরি এরিয়া থেকে একটা বই নিয়ে এসেছে, যে বইটা অ্যানা ঘুমাতে যাওয়ার আগে পড়ছিলো। অ্যানা খুব বই পড়ে, সব রকমের বই। একদম মন লাগিয়ে পড়ে, সেই সময় টুকুতে কারো কোনো কথা ওর কানে যায় না। মনে হয় যেন ও অন্য জগতে হারিয়ে যায় সে সময় টায়।

অ্যানার কথা মনে করতে করতে মুখে হাসি ফুটে উঠলো থিয়োডরের। ভালোবাসার মানুষ গুলো হয়তো এমনি হয়, তাদের নাম টা মনে পড়লেও ভালো লাগে৷
থিয়োডর সে বই টার প্রথম পাতা মেলে ধরলো নিজের সামনে। পড়লো কয়েক লাইন, হাত দিয়ে ছুয়ে দিতে লাগলো বইয়ের পৃষ্ঠা গুলো, অ্যানার হাতের ছোয়া লেগে আছে এই পৃষ্ঠা গুলোতে৷
মুহুর্তেই ওর মনে হলো, ইশ যে যদি এই বই টা হতে পারতো তবে কতো ভালোই না হতো! অ্যানা ওকে ছুয়ে দিতো প্রতি পরতে পরতে! কিন্তু বই হলে তো ওর পৃষ্ঠা গুলো এক সময় শেষ হয়ে যাবে, আর অ্যানাও আর ওকে নিজের সামনে মেলে ধরবে না; হাত দিয়ে ছুয়ে দিবে না, নতুন একটা বই খুলে বসবে। নাহ, বই হওয়া যাবে না, অন্য কিছু হতে হবে, কিন্তু কি হওয়া যায়!

লিন্ডা! লিন্ডা হলে অ্যানা তাকে সব সময় নিজের পকেটে নিয়ে ঘুরবে, তখন অ্যানার গায়ের সাথে গা মিশিয়ে ঘুমানো যাবে; অ্যানার বুকের ওপর, পেটের ওপর উঠে বসে থাকা যাবে যখন তখন; অ্যানা ওকে নিজের হাতে খাওয়াবে, কত্ত যত্ন করবে! হ্যা, গুড ডিসিশন, ওকে লিন্ডাই হতে হবে!

নিজের ভাবনা চিন্তা দেখে নিজে নিজেই মিটিং জোন টা কাপিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো থিয়োডর! প্রেমে পড়লে কি মানুষ তার মতো বোকা হয়ে যায়! বই হতে চায়, প্রাণী হতে চায়! নিজের মনে আবার হাসলো থিয়োডর, তারপর হাতের বই টা বন্ধ করে বই খানা নিজের বুকের ওপর রেখে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো, এটা যেন অ্যানাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা!

ঠিক এমন সময়ে থিয়োডরের কানে ভেসে এলো এক মেয়েলি কন্ঠের মোহনীয় সুর, জঙ্গলের গভীর থেকে ভেসে আসছে সেটা। চকিতে চোখ মেলে তাকালো থিয়োডর। তারপর শব্দ টা ঠিক কোন দিকের জঙ্গল থেকে আসছে সেটা কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করলো ও। আর কিছুক্ষণ চেষ্টার পরই ও বুঝতে পারলো শব্দটা ওদের মাঞ্জারের পেছন দিকের জঙ্গলের দিক থেকে আসছে।

সেই মুহুর্তেই কোনো এক অজানা আকর্ষণের হাতছানি তে বসা থেকে উঠে দড়ালো থিয়োডর, তারপর মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধীর পায়ে হেটে চলল সেই মোহনীয় সুরটির উৎসের দিকে।

মাঞ্জারে যাওয়ার রাস্তা পেরিয়ে, ওয়ার্কার্স দের আবাসিক এলাকার ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া সরু রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে এক সময় সময়ে শেষ মঞ্জারটিও পার করে সে এসে পৌছালো ব্লু জোনের নিকটে, আর তখনি থিয়োডরের চোখ গেলো রেড জোনের ভেতর কার জঙ্গলের দিকে। আর জঙ্গলের সে চোখ ধাধানো সৌন্দর্য দর্শন করে চোখ জোড়া যেন জুড়িয়ে গেলো ওর, মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইলো ও সে জঙ্গলের দিকে!

জঙ্গলের সমস্ত গাছ গুলো কোনো এক অজানা কারণে উজ্জ্বল হয়ে আছে, রঙ বেরঙের আলো টিকরে পড়ছে সেসব গাছেদের গা থেকে। জঙ্গলের সমস্ত গাছের পাতা গুলো কোনো এক দুর্বোধ্য আলোড়নে কাঁপা-কাঁপি করছে। আর সে গাছে থাকা সব শুকনো পাতা গুলো সেই অজানা আলোড়নের প্রভাবে ঝরে পড়ে যাচ্ছে মাটিতে। পৃথিবী পৃষ্ঠ সে শুকনো পাতা গুলোকে অদ্ভুত ভাবে নিজের ভেতরে টেনে নিচ্ছে, আর প্রতিটা শুকনো পাতার সেই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া জায়গা গুলো থেকে বেরিয়ে আসছে ছোট্ট ছোট্ট ফুলের চারা গাছ।

এই অলৌকিক দৃশ্যটা অবলোকন করার পরপরই হতভম্ব হয়ে যাওয়া থিয়োডরের চোখ গেলো জঙ্গলের গাছ গুলোর মাথার দিক টাতে। আর সেদিকে তাকিয়েই সে দেখতে পেলো এক অদ্ভুত রকমের স্বর্ণালি আলোর ঘনঘটা, ঝিকিমিকি করতে করতে সে আলোকরশ্মি গুলো একত্রে স্রোতের মতো বয়ে চলেছে গাছেদের মাথার ওপর দিয়ে, আর সে আলোকস্রোতের প্রভাবে জঙ্গলের ভেতরে থাকা সমস্ত গাছ গুলো একে একে সতেজ হয়ে উঠছে। হরেক রঙা গাছ গুলোর শরীরের সমুদয় রঙ গুলো গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে তার সৌন্দর্য বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে! আর সেই সাথে জঙ্গলের চারদিক থেকে ভেসে আসছে জঙ্গলে বসবাসরত সমগ্র প্রাণীদের একত্র কোলাহল।

থিয়োডর হা হয়ে সে দ্যুতি ছড়ানো গাছ গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো, এই অদ্ভুত আর অসাধারণ সুন্দর দৃশ্য টা চোখ ভরে দেখতে থাকলো ও, কিন্তু পারলোনা বেশিক্ষণ। সে সৌন্দর্য টা পুরোপুরি অবলোকন করার আগেই জঙ্গল থেকে ভেসে আসা সে সুরের মূর্ছনায় আচ্ছন্ন হয়ে সেখানেই ঢলে পড়লো ও মাটিতে।

.

প্রাসাদে নিজের কামরায় তুলতুলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে রুথ, ঘুম আসছে না ওর। বেশ অনেক্ষণ ধরেই ঘুমানোর চেষ্টা করছে ও, কিন্তু চোখে প্রচন্ড ঘুম থাকলেও ঘুমটা আসছে না, কোনো এক অজানা অস্বস্তি তে সারা শরীরে অশান্তি হচ্ছে ওর৷ কিন্তু এবার ও কোনো নড়াচড়া না করে ঠাই শুয়ে রইলো, এবার ও ঘুমাবেই, তাই যা-ই হয়ে যাক, আর একবারও এপাশ ওপাশ করবে না।

কিন্তু ঘুমানোর সংকল্প করে স্থীর হয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করতেই ওর কানে ভেসে এলো মেয়েলি কন্ঠের এক সুরেলা আওয়াজ। চোখ জোড়া বন্ধ রেখেই কিছুক্ষণ কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো রুথ, হ্যা, আসলেই একটা সুরেলা কন্ঠ ভেসে আসছে কই থেকে জানি। রুথ ধীরে ধীরে শোয়া থেকে উঠে বসলো। সুরেলা কন্ঠ টা আস্তে আস্তে মোহনীয় কোনো কিছুতে পরিণত হচ্ছে যেন! রুথ কে যেন হাতছানি দিয়ে ডেকে নিতে চাইছে নিজের কাছে।

রুথ ধীর গতিতে বিছানা থেকে নেমে উঠে দাড়ালো, তারপর আবারও কান খাড়া করে একবার শোনার চেষ্টা করলো সেটা। হ্যা, শোনা যাচ্ছে সেটা, স্পষ্ট! এমন মনোমুগ্ধকর সুর ও আগে কখনোই শোনেনি। কে গাইছে এভাবে! তার কন্ঠে কি কোনো জাদু আছে? রুথের মনে হচ্ছে এই সুর দিয়ে কেউ ওকে হিপনোটাইজ করে ফেলতে চাইছে, রুথ কে যেন নিজের সুরের মায়ায় ফেলে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে যেতে চাইছে!

রুথ পা বাড়ালো; জঙ্গলের দিক থেকে ভেসে আসা সেই মোহনীয় সুর টাকে আরো ভালো ভাবে শোনার জন্য ধীরে ধীরে কামরার জানালার দিকে এগিয়ে গেলো ও৷ তারপর জানালার পর্দা টা সরিয়ে বাইরে চোখ রাখলো, আর চোখ রাখতেই চোখ জোড়া জুড়িয়ে গেলো ওর!

এটা কিভাবে সম্ভব! জঙ্গলের সমস্ত গাছ গুলো এমন উজ্জ্বল হয়ে আছে কেন! আর ওইটা কিসের আলো! গাছের ওপর দিয়ে স্রোতের মতো বয়ে চলে যাচ্ছে সমস্ত দিকে! এই আলো টা কই থেকে আসছে?
মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেদিকে তাকিয়ে রুথ দেখার চেষ্টা করলো। হ্যা, ওই তো প্রাসাদ থেকে অনেক অনেক খানি দূরে, জঙ্গলের ঠিক মাঝখানের একটা জায়গা থেকে বেরিয়ে আসছে বাতাসে বয়ে বেড়ানো সে আলো, আর সেখান থেকেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে! সুর টাও কি তবে সেখান থেকে আসছে! কিন্তু এমন স্নিগ্ধ সুর কেউ কিভাবে উৎপন্ন করতে পারে! মনে হচ্ছে যেন সুরের স্নিগ্ধতায় এখনি ঘুমের সাগরে তলিয়ে যাবে ও! কিন্তু সে ঘুমাবে না, তাকে শুনতে হবে, ভালোভাবে শুনতে হবে!

মুহুর্তেই আফিয়ার বলা কথা গুলো ভুলে গেলো রুথ। ওই মহোনীয় সুর টা আরও ভালো ভাবে শুনতে জানালার গ্লাসের এক অংশ খুলে দেওয়ার জন্য হাত বাড়ালো ও, আর তখনই রুথের কামরার দরজা খুলে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করলো আফিয়া। কামরায় ঢুকে রুথ কে জানালার দিকে হাত বাড়াতে দেখেই উচ্চস্বরে চিৎকার দিয়ে সে রুথের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,

— রুথ! জানালার কাছ থেকে সরে আসো, এখনি!

আফিয়ার চিৎকারে যেন সম্বিত ফিরে পেলো রুথ, চকিতে ও পেছন ফিরে তাকালো আফিয়ার দিকে৷ আর আফিয়া ছুটে গিয়ে জানালার পর্দাটা আবার লাগিয়ে দিয়েই রুথ কে টেনে এনে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ধমকের সুরে বলল,

— এই মেয়ে, কি বলেছিলাম তোমাকে? বলিনি ভুলেও জানালার কাছে যাবে না? তবুও কেনি গিয়েছিলে? আমি জানতাম তুমি এই ভুলটাই করবে। আমি যদি আর একমুহুর্ত ও দেরি করতাম তবে তোমার কি হতো সে সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে?

আফিয়ার এমন ধমক শুনে থ বনে গেলো রুথ, এমন ধমক খাওয়ার মতো ও কি গুরুতর অপরাধ করেছে বুঝতে পারলো না। আফিয়া কথা টা শেষ করে চুপ হয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকলো, রুথ আফিয়াকে এমন অস্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিতে দেখে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— আফিয়া, কি হয়েছে তোমার, তুমি এমন করছো কেন!

আফিয়া নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে বাধা বাধা গলায় বলে উঠলো,

— আমার ঘুম আসছে প্রচন্ড!

আর এ কথা বলেই রুথের হাত ধরা অবস্থায় ওখানেই বিছানার ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো আফিয়া। আর আফিয়া ঘুমিয়ে পড়তেই সেই মোহনীয় সুরের দ্বিতীয় এক ঝলকে আচ্ছন্ন হয়ে ঘুমে ঢোলে পড়লো রুথ নিজেও।
.
.

২৮. গুরু দায়িত্বের সমাপ্তি টেনে অবশেষে নিজের মোহনীয় কন্ঠস্বরের সেই মোহাচ্ছন্নকারী সুর থামালো অ্যানা। আর তার সাথে সাথে থেমে গেলো তার চারপাশে উল্লাস করে বেড়ানো শিরো মিদোরির জঙ্গলের প্রাণীদের চিৎকার চেচামেচি।

স্বর্ণালি আভার লাইফ ট্রির গোড়ায় বসে তার শরীরে পিঠ ঠেকিয়ে আছে অ্যানা৷ ওর সাদা রঙা চুল গুলো টান টান হয়ে জড়িয়ে আছে লাইফ ট্রি টার চারপাশে, লাইফ ট্রির স্বর্ণালি আলো অ্যানার সে চুল বেয়ে প্রবেশ করছে অ্যানার শরীরে। অ্যানার হীরকখন্ডের ন্যায় উজ্জ্বল চোখ জোড়া আর ও উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাদের সে উজ্জলতায় আলোকিত হয়ে উঠছে চারপাশ।

লাইফ ট্রি তার নরম কান্ডের একটি দিয়ে আদুরে স্পর্শে ছুয়ে দিচ্ছে অ্যানার মুখমণ্ডল খানা৷ জঙ্গলের প্রাণীদের ছানা পোনা গুলোর বেশ কিছু এসে উঠে বসেছে অ্যানার কোলে। লিন্ডাও আছে সেখানে। কিন্তু অ্যানার কোলে তার জায়গা হয়নি। সে বসে আছে এক পাশে, মন টা খুব খারাপ তার৷ মাঝে মাঝে আড় চোখে সে দেখছে অ্যানাকে, কিন্তু অ্যানা তো তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না৷ সে জঙ্গলের প্রাণী গুলোকে নিয়ে ব্যাস্ত।
অ্যানার তার প্রতি এমন উদাসীনতা দেখে লিন্ডা গাল ফুলিয়ে পেছিন ঘুরিয়ে অন্য দিকে ফিরে বসলো। অ্যানা লিন্ডার এমন অভিমান দেখে মুচকি হাসলো তারপর নিজের কোলে থাকা ছানা পোনা গুলোকে নামিয়ে দিয়ে লাইফ ট্রি এর গোড়া থেকে উঠে দাড়ালো ও।

লাইফ ট্রির ওপাশে থাকা ছোট্ট, উজ্জ্বল চকচকা পানি ভর্তি ডোবা টার দিকে এগোলো অ্যানা। এরপর ডোবার পাড়ে দাঁড়িয়ে নিজের গায়ের হুডি আর ট্রাউজার টা খুলে রেখে দিলো এক পাশে। আর তারপর শুধুমাত্র পরণের ব্রালেইট আর বডিশর্টস পরেই ও নেমে পড়লো সে ডোবার পানিতে। আর অ্যানার পা ডোবার পানি স্পর্শ করতেই উজ্জ্বল এক নীল রঙা ঢেউ খেলে গেলো ডোবার পানির উপরিভাগ জুড়ে। আর সে ঢেউ গুলো গিয়ে আছড়ে পড়লো ডোবার কিনারায়।

অ্যানার পিছু পিছু লিন্ডাও এগিয়ে এলো, ও এসে ডোবার ধারে নিজের শরীর টা মাটিতে এলিয়ে দিয়ে অর্ধনগ্ন অ্যানাকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লেগে গেলো। অ্যানা পানিতে নেমে পড়লো পুরোপুরি, ওর সাদা রঙা লম্বা চুল গুলো ডোবার পানিতে স্পর্শ হওয়া মাত্রই সে চুল গুলো নানা উজ্জ্বল রঙে রাঙিয়ে উঠলো। ডোবার মাছ গুলো এসে ছুয়ে দিতে লাগলো অ্যানার শরীরের পানির ভেতরে থাকা উজ্জ্বল হয়ে যাওয়া অংশ টুকুকে। ওদের ছোয়ায় সুড়সুড়ি লাগলো অ্যানার, খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো ও, তারপর এক ডুব দিয়ে চলে গেলো ও ডোবার একদম গভীরের দিক টাতে। নিজের শরীর আর চুলের উজ্জলতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ডোবার গভীরের সে অংশ টা৷

সাঁতরে সাঁতরে ডোবার একেবারে নিচে পৌছে ডোবার নিচের কর্দমাক্ত ভূপৃষ্ঠ কে নিজের হাত দ্বারা ছুয়ে দিলো অ্যানা, আর সেখানে অ্যানার হাতের স্পর্শ লাগতেই উজ্জ্বল হয়ে আলোকিত হয়ে গেলো সে স্থান টি, আর তারপর সে উজ্জলতা টা ছড়িয়ে পড়লো ডোবার ভেতরকার চারপাশের পুরো এরিয়াটা।

ডোবাটা পুরোপুরি উজ্জ্বল হয়ে যাওয়া মাত্রই সাঁতরে আবার উপরে উঠে এলো অ্যানা। আর পানির ভেতর থেকে মাথা টা বের করার পরমুহূর্তেই ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ওর আশেপাশে অনুভব করলো দ্বিতীয় কোনো ব্যাক্তির উপস্থিতি। আর তখনি লাইফ ট্রির পাশ থেকে ভেসে এলো একটি গুরুগম্ভীর, পুরুষালি কন্ঠ,

— শিনজো…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here