#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_১৮
#আ_মি_না
২৯. সকালের খাওয়া দাওয়ার পর ব্রায়ান মিটিং জোনে বসে, গোছগাছ করে, হাতে একটা কোদাল আর কাস্তে নিয়ে আশেপাশে কোথাও চারা রোপণ করার জন্য মাটি তৈরি করতে যাচ্ছিলো। বসা থেকে উঠে, মিটিং জোন পার হয়ে ডাইনিং এরিয়ায় এসে ওর দেখা হলো শার্লটের সাথে। ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে মন খারাপ করে বসে আছে সে।
ব্রায়ান এগিয়ে এসে আনমনা শার্লটের চুলের গোছা ধরে সামান্য টান মেরে জিজ্ঞেস করলো,
— কিরে বুড়ি, এইখানে এভাবে বসে আছিস কেন? কি হয়েছে?
শার্লট ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক ব্রায়ানের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা সোজা করে নিচের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বলল,
— অ্যানার অনেক মন খারাপ, ও কথা বলছে না কারো সাথে, আমার সাথেও না!
শার্লটের কথায় ব্রায়ান কিছুটা চিন্তিত মুখে বলল,
— আসলেই, আমি তো ভুলেই গেছিলাম। কি হয়েছে ওর? ভোর বেলা আমাকে এসে বলল ওর কিছুদিনের ছুটি চাই। কারণ জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু সেভাবে কোনো উত্তর দিলো না। বলল যে ওর কিছুদিন লোকসমাগম থেকে দূরে থাকা উচিত নাকি! আমি বলেছি রাজ কর্মচারী হুজায়ফা আবিদের সাথে কথা বলে ছুটি মঞ্জুর করে ওকে জানাবো। কিন্তু অ্যানা কোথায় আছে এখন?
ব্রায়ানের প্রশ্নে শার্লট ভারী গলায় উত্তর করলো,
— কিচেনেই আছে, রান্না শেষ তবুও বসে আছে। সকালে খায়ওনি। আমি কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি যে কি হয়েছে, কিন্তু আমার কথার কোনো উত্তর দেয়নি। আর শেষ বার যখন জিজ্ঞেস করেছি তখন আমাকে ধমক দিয়েছে!
শেষোক্ত কথাটা বলে ফুপিয়ে কেদে উঠলো শার্লট। ব্রায়ান তড়িঘড়ি করে হাত থেকে কোদাল আর কাস্তে নামিয়ে রেখে শার্লট কে দুহাতে আগলে নিয়ে বলে উঠলো,
— চুপ চুপ, কাদে না! অ্যানা কি কখনো এমন করে তোর সাথে? ও হয়তো কোনো কারণে অনেক আপসেট হয়ে আছে, যার জন্য এমন করেছে। এইটা নিয়ে মন খারাপ করলে চলে? আর মানুষ তাকেই ধমক দেয়, যন্ত্রণা দেয়, যাকে সে ভালোবাসে, যাকে যন্ত্রণা দেওয়ার অধিকার তার আছে। অ্যানা কি অন্য কাউকে কখনো এভাবে বলে? অন্যদের কে তো ঠান্ডা মাথায় হুমকি দেয়! তাই মন খারাপ করিস না। ভবিষ্যতে অ্যানা যখন আমার বউ হবে তখন ওকে আচ্ছা করে বকে দেবো, তোকে ধমক দেওয়ার শোধ তুলে দেবো। হবে?
শার্লট চোখ মুছতে মুছতে ফিক করে হেসে উঠে বলল,
— হবে!
ব্রায়ান শার্লটের মাথার তালুতে হাত ঘষে দিয়ে বলল,
— তাহলে আর মন খারাপ না করে দেখে আয় অ্যানা কিচেনে কি করছে। এমনিতেই মন খারাপ, ওখানে একা একা বসে থাকলে আরও মন খারাপ হয়ে যাবে। যা, উঠ।
শার্লট ব্রায়ানের কথায় সায় দিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার ছেড়ে উঠলো, তারপর পা চালালো কিচেনের দিকে। আর ব্রায়ান ওর যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে চলল নিজের গন্তব্যের দিকে৷
শার্লট হাটতে হাটতে কিচেনের কাছে পৌঁছে, ভেতরে ঢুকে দেখলো অ্যানা নেই। ফাতমা বসে আছে এক কোণায়, দুপুরের খাবারে কি কি আয়োজন করা হবে সেসব ঠিক করছে ও। শার্লট চারপাশে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফাতমা কে প্রশ্ন করলো,
— অ্যানা কি ওর মাঞ্জারে চলে গিয়েছে ফাতমা?
ফাতমা লিস্টের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে শার্লটের দিকে তাকিয়ে ধীর গলায় বলল,
— না, ও সমুদ্রের ধারে গিয়েছে। ওর মন মেজাজ ভালো নেই, তাই হয়তো একটু খোলা বাতাসে গিয়েছে, তুমি এসো, এসে আমাকে একটু হেল্প করে দাও। ও একটু ওর মতো থাকুক, একা একা সময় কাটাক।
শার্লট কিচেনের দরজা দিয়ে এক পলক বাইরে তাকিয়ে আবার ফাতমার দিকে ফিরে মাথা নাড়িয়ে সায় মানলো, তারপর নিজেও বসে গেলো ফাতমার সাথে হাতে হাতে কাজ করে দিতে৷
.
সমুদ্রের তীর থেকে কিছুটা নীচে, একটি সাদা রঙা পাথরের ওপর বসে, স্বচ্ছ নীল পানিতে দুই পায়ের হাটু অব্দি ডুবিয়ে পা নাচিয়ে নাচিয়ে চারদিক টা দেখছে অ্যানা। মুখে মাস্ক নেই ওর। মাথার ওপর থেকে হুডির হুড টাও সরিয়ে ফেলেছে। কালো রঙা চুল গুলোর বেনী খুলে মেলে দিয়েছে পিঠের ওপর। সাগরের দিক থেকে আসা ঝড়ো হাওয়ায় ওর সে দীঘল কালো চুল গুলো ওড়াউড়ি করে ওর মুখের ওপর এসে জ্বালাতন করছে। অ্যানা সেগুলোকে সরিয়ে দিচ্ছে আলতো হাতে।
চোখ জোড়া ওর সমুদ্রের ওই মাঝখানে, সেখানে এক দল কালো সাদা মিশেলের ডলফিন হুটোপুটি করছে। আগ্রহভরে সে দৃশ্য দেখছে অ্যানা। এমন সময়ে ওর চোখ জোড়া গেলো আকাশের দিকে। একটা বাজপাখি তার বিশাল বিশাল ডানা মেলে নিঃশব্দে উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশের নীলের ভেতরে। অ্যানা সেদিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ, তারপর উচ্চস্বরে ডাক পাড়লো,
— ফ্যালকন! অ্যাই ফ্যালকনের বাচ্চা! নিচে নাম, এক্ষুনি।
অ্যানার সে কন্ঠ শুনে আকাশে উড়ে বেড়ানো ফ্যালকন মনে মনে বলে উঠলো,
— এই রে! কেস খেয়ে গেছি! এবার আমাকে বার্বিকিউ না বানাইলেই হইলো!
ফ্যালকন ঘুরে উড়ে এসে ল্যান্ড করলো অ্যানার পাশে, আর মাটিতে পা পড়তেই নিজের আসল চেহারায় ফিরে এলো সে। অ্যানার পাশে এসে দাড়াতেই খপ করে ফ্যালকনের হাত ধরে ফেললো অ্যানা। ফ্যালকন আঁতকে উঠে ভীতসন্ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে রইলো অ্যানার দিকে। অ্যানা ওর হাত ধরে ওকে এক টান দিয়ে নিজের পাশে বসালো, তারপর কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— তুই এখানে কি করছিস? তোকে ওই মীরের বাচ্চা পাঠিয়েছে তাই না?
ফ্যালকন মুখ ভার করে তাকিয়ে বলল,
— সাড়ে সর্বনাশ! কোনো বাদশাহ কে এইভাবে সম্বোধন করা কি ঠিক!
অ্যানা ভ্রু জোড়া কুচকে ধমক দিয়ে বলে উঠলো,
— কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক সেটা কি আমাকে তোর থেকে শিখতে হবেরে ফ্যালকনের বাচ্চা?
ফ্যালকন দমে যাওয়া গলায় বলল,
— এ কথা আমি কখন বললাম! আমি তো শুধু বলেছি…..
ওর কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই অ্যানা বলে উঠলো,
— তুই চুপ থাক, এখন বল ওই শালার ঘরের শালা তোরে কেন পাঠাইছে? আমার ওপর নজরদারি করতে?
ফ্যালকন শিউরে উঠে অনুনয়ের সুরে বলল,
— দয়া করে চুপ করুন শেহজাদী! আপনি এসব বললে আপনাকে তো কিছু বলবে না, কিন্তু এই কথা শোনার অপরাধে আমার কল্লা টা যাবে!
ফ্যালকনের সে কথা শেষ না হতে হতেই অ্যানার রিস্টওয়াচের টুংটুং শব্দ জানান দিলো কেউ তাকে টেক্সট করেছে, আর রিস্টওয়াচ টা ওপেন করতেই অ্যানার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই আননোন নম্বর থেকে আগত একটি মেসেজ, যেখানে লেখা,
— আমি কিন্তু সব শুনতে পাচ্ছি!
অ্যানা দাঁতে দাঁত পিষে নিজের বা হাত থেকে সে রিস্টওয়াচ টা এক টানে ছিড়ে খুলে ফেলে গায়ের সর্বোচ্চ জোর দিয়ে ছুড়ে দিলো দূর সমুদ্রের ভেতর, সমুদ্রপৃষ্ঠে আছাড় খেয়ে বুদবুদ তুলতে তুলতে সেটা ডুবে গেলো সমুদ্রের পানিতে। এরপর আবার ফ্যালকনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— ফ্যালকন, আমার শাস্তির আর কতদিন বাকি আছে? হিসাব কর।
ফ্যালকন বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিলো অ্যানার রিস্টওয়াচ ছুড়ে ফেলে দেওয়া সে জায়গাটার দিকে। অ্যানার প্রশ্নে অ্যানার দিকে তাকিয়ে ও কিছুক্ষণ হিসাব নিকাশ করে উত্তর দিলো,
— তিন মাস!
অ্যানা ফ্যালকনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সমুদ্র আর আকাশের মিলন স্থলের দিকে তাকালো তারপর স্বগতোক্তি করলো,
— অ্যানা হয়ে থাকতে থাকতে আমি বিরক্ত হয়ে গেছি। তিনটা মাস শুধু চলে যাক, তারপর এই দ্বীপে আমি আর একটা মুহুর্তও থাকব না! ওই মীরের বাচ্চাকে আমি বুঝিয়ে দেবো এই আনাবিয়া ফারহা দেমিয়ান কি জিনিস!
এরপর সামনে তাকানো অবস্থাতেই ফ্যালকনের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
— এখন তোকে একটা কাজ করতে হবে ফ্যালকন।
ফ্যালকন আনুগত্যের সাথে বলে উঠলো,
— জ্বি বলুন শেহজাদী, আপনার সেবায় আমি সদা প্রস্তুত!
— আমার বা কাধের চামড়ার নিচে একটা ছোট্ট ডিভাইস আছে, এতদিনে হয়তো সেটা মাংসের সাথে আটকে গেছে। ওইটা চামড়া কেটে বের করে ফেলতে হবে তোকে।
নির্বিকার গলায় বলল অ্যানা। অ্যানার কথা শুনে ভয়ে আঁতকে উঠলো ফ্যালকন। তড়িঘড়ি করে বাধা বাধা গলায় বলল,
— অসম্ভব! এইকাজ আমি জীবনেও করতে পারবো না! আপনাকে ছুয়েছি শুনলে বাদশাহ আমাকে হায়না দিয়ে জীবন্ত খাইয়ে দেবেন, নয়তো কুমিরের খাচায় ফেলে দেবনে আপনার দাদা কে যেভাবে দিয়েছিলেন আপনাকে আঘাত করার অপরাধে! ক্ষমা করুন শেহজাদী, মরে গেলেও আমার পক্ষে এই কাজ জরা সম্ভব না! শুধু কাজ করা কেন, আমার পক্ষে ওই কাজের কথা উচ্চারণ করাও সম্ভব না! আমার প্রাণের মায়া আছে!
ফ্যালকনের কথা শুনে অ্যানা বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
— শালার ঘরের শালা মানুষ কে এমন আতঙ্কে রেখেছে যে কেউ আমাকে ছোয়ার কথা মুখে উচ্চারণ করতেও ভয় পাচ্ছে!
তারপর বিরক্তি নিয়ে ফ্যালকন কে বলল,
— ঠিক আছে, না পারলে সর আমার সামনে থেকে! দ্বিতীয় বার যেন তোকে আমার আশেপাশে না দেখি, যদি দেখি তবে তোকে মেগালাডন দিয়ে খাইয়ে দেবো! মনে থাকে যেন।
অ্যানা বলার সাথে সাথেই ফ্যালকন তাড়াহুড়ো করে উড়াল দিলো সেখান থেকে, আর এরপর মাঝা আকাশে গিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
— বড় বাঁচা বেচেছি! এই দুইটা এমন সেইম কোয়ালিটির কিভাবে যে হলো আমার মাথায় আসে না! এদের রক্তে সমস্যা!
৩০. ভর দুপুর বেলা, প্রাসাদের রাজকীয় হাম্মামখানায় বাথটাবের ভেতর গলা অব্দি ডুবিয়ে বসে আছে রুথ। ওর চোখের সামনে হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে নামীরের প্রতিকৃতি! সেই রাতের পর থেকে যখন তখন ওই অতি সুন্দর্শন পুরুষটাকে নিজের সামনে দেখতে পাচ্ছে রুথ, প্রতি পদে পদে হ্যালুসিনেশন হচ্ছে ওর! এই মুহুর্তে নামীর কে বাথটাবের অন্য কোণায় দেখছে ও, বসে আছে ওর দিকে তাকিয়ে, তার সেই আগুনের ন্যায় চোখের দৃষ্টি দিয়ে! কি আছে এই সুঠাম দেহী পুরুষ টার চেহারায়, যা ওকে এত টা দুর্বল করে ফেলেছে! কি আছে!
নিজের সামনে, শূণ্যে হাত বাড়িয়ে নামীরের সেই অর্ধনগ্ন প্রতিকৃতি টা ছোয়ার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো রুথ। আর তখনি ওর চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে কেউ একজন বলে উঠলো,
— এই মেয়ে! কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছো না!
রুথ চমকে উঠে তাকালো তার পাশে ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকা মেয়েটার দিকে। এই মুহুর্তে ওর পাশে কয়েক জন চ্যালাব্যালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রাসাদের হেরেমের সবচেয়ে সুন্দরী দাসী টা। রুথ হা হয়ে দেখতে লেগে গেলো ওকে! অসম্ভব সুন্দরী এই মেয়েটির কোথাও যেন কোনো খুত নেই! চোখ, কান, নাক, মুখ; সবকিছুই তার সুন্দর, সুগঠিত! যেন সৃষ্টি কর্তা বড্ড যত্ন করে বানিয়েছেন এর মুখ খানা! দেখতে থাকলে শুধু দেখতেই ইচ্ছা করে!
রুথ কে এমন হাবার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে অ্যামেলিয়া নামের সে মেয়েটি ঝাঝিয়ে উঠে বলল,
— এই মেয়ে! পাগল নাকি তুমি? যেদিকে তাকাচ্ছো তাকিয়েই থাকছো! কি সমস্যা তোমার?
রুথ কিছুই বলল না, আগের মতো করেই তাকিয়ে রইলো অ্যামেলিয়ার দিকে, ব্যাপার টা কি হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করলো ও! আর এতে মেজাজ আরও গরম হয়ে গেলো অ্যামেলিয়ার। রুথের দিকে সামান্য ঝুকে, ক্ষিপ্র গতিতে, শক্ত হাতে রুথের চিবুকটা চেপে ধরে, ওর মুখ টা খানিক ওপরে টেনে উঠিয়ে বলে উঠলো,
— এইরকম হাবামি নিয়ে বাদশাহর সামনে তুমি কোন মুখে গিয়েছো? আমাকে দেখো, আমার নখের যোগ্যও নও তুমি! আমার রূপ, যৌবন, বুদ্ধিমত্তা; কোনোটার ধারে কাছে যাওয়ার মতোও কিছুই নেই তোমার। কিন্তু দিন শেষে আমি খাস কামরায় যেতে পারিনি, কারণ আমার নাকি বাদশাহ কে সহ্য করার মতো শরীর নেই! এখন বেগম প্রাসাদে নেই, এই সুযোগে বাদশাহর আপন আমি হতে চেয়েছিলাম! কিন্তু সে সুযোগ আমার হলো না! আমার বদলে তোমার মতো একটা গেয়ো, গাধা, হাবা সেই সুযোগ পেলো! কি আছে তোমার শরীরে যা আমার নেই?
কথা গুলো বলে রুথের চিবুক ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো অ্যামেলিয়া, এরপর নিজের গায়ে জড়ানো টাওয়েল টা খুলে ফেলে দিলো হাম্মামের মেঝেতে, তারপর আবার কড়া গলায় বলে উঠলো,
— কি নেই আমার, যা তোমার আছে? উঠে দাড়াও দেখি আমি!
বলে রুথ কে হেচকা টান দিয়ে বাথাটাবের ভেতর থেকে টেনে তুলে দাড় করিয়ে দিলো অ্যামেলিয়া। আর রুথ দাড়াতেই ওর শরীরের ওপরের অংশের অন্তর্বাসের ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো মহামূল্যবান পাথর খচিত খাপের খঞ্জর খানি।
সেদিন আফিয়ার মুখ থেকে দাসী দের মৃত্যুর কথা শোনার পর থেকে খঞ্জর টাকে রুথ সবসময় নিজের সাথেই রাখছে, ওর মনে হচ্ছে ওকেও হয়তো কেউ বাকিদের মতো খুন করে ফেলবে! বাদশাহর কাছে যাওয়ার ওর আর সুযোগ হবে না!
ধাতব কিছু মেঝেতে পড়ার শব্দে ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকালো অ্যামেলিয়া আর ওর সাথে থাকা মেয়েগুলো। আর সেদিকে তাকাতেই চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেলো ওদের! সাথে সাথে রুথ কে ছেড়ে দিয়ে খঞ্জর টা থেকে খানিক টা দূরে সরে গিয়ে অ্যমেলিয়া বলে উঠলো,
— এটা তুমি কোথায় পেয়েছো? এটা তো…. এটা তো ওনার খঞ্জর!
রুথ অ্যামেলিয়ার দিকে অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, যেন ওর কোনো কথাই রুথের মাথায় ঢুকছে না। রুথের এমন দৃষ্টি তে অ্যামেলিয়া রুথের গালে ছোটখাট একটা চাপড় দিয়ে বলল,
— এই মেয়ে, কথার উত্তর দাও! এই খঞ্জর তুমি কোথায় পেয়েছো?
রুথ যেন এবার কিছুটা সম্বিত ফিরে পেলো, আমতা আমতা করে ও উত্তর দিলো,
— এখানে আসার আগে অ্যানা দিয়েছে!
অ্যনা নাম টা গিয়ে বাড়ি খেলো অ্যমেলিয়ার মস্তিষ্কে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে রুথের কথাটা বোঝার চেষ্টা করলো সে, তারপর কিছু একটা মনে পড়তেই ও ক্রুর হেসে বলে উঠলো,
— তাহলে আমি শুধু শুধু আমার সময় নষ্ট করছি কেন! তোমাকে ভোগে পাঠানোর ব্যাবস্থা তো ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে! এই খঞ্জর যার কাছেই থাকবে বুঝে নিতে হবে তার মৃত্যু অতি সন্নিকটে!
এরপর হাসি মুখ টা নিমিষেই শক্ত করে নিয়ে অ্যামেলিয়া বলল,
— উনি যেখানেই থাকুন না কেন বাদশাহর ভাগ কাউকে দিবেন না! যাক, তোমার মতো হাবাকে দিয়ে একটা উপকার তো হলো! নইলে তোমার জায়গায় আমি থাকলে তো আজ আমাকেই যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিতো! এই কয়টা দিন ভালো ভাবে,শান্তিমতো বেচে নাও! নইলে মরার পরে আফসোস করবে!
কথা গুলো বলেই পেছন ঘুরিয়ে অ্যামেলিয়া ওর চ্যালাব্যালা গুলোকে নিয়ে হাম্মাম থেকে বেরিয়ে গেলো। আর রুথ অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলো ওদের যাওয়ার পানে। এতক্ষণ অ্যামেলিয়ার একটা কথাও বোধগম্য হয়নি ওর! কারো কথাই ও বুঝতে পারছে না আজ, বোঝার চেষ্টাও করছে না!
আর হাম্মাম খানা নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই আবারও রুথের সামনে এসে হাজির হলো নামীরের প্রতিচ্ছবি, যাকে দেখতেই লেগে গেলো রুথ! বাথটাবের ভেতরে ওভাবেই অথর্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলো ও!
৩১. দুপুরের খাওয়ার পর একা একা ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসে ছিলো ব্রায়ান। অ্যানার হঠাৎ ছুটি চাওয়ার ব্যাপার টা নিয়ে ও খুব চিন্তিত, তাছাড়া শার্লট বলেছে অ্যনার নাকি মন খারাপ! অ্যানার ঠিক কি হয়েছে সেটা জানা ওর জন্য খুব দরকার, কিন্তু কিভাবে জানতে পারবে সেটাই বসে বসে ভাবছে ও।
এমন সময় শার্লট আর ফাতমা চিন্তিত মুখে এসে দাড়ালো ব্রায়ানের পাশে। ওদের দুজন কে এভাবে গাতা বেধে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ব্রায়ান জিজ্ঞেস করলো,
— কি ব্যাপার? কিছু বলবি?
ব্রায়ানের প্রশ্নের উত্তরে শার্লট বলে উঠলো,
— অ্যানা এখনো ফেরেনি, দুপুরের রান্না টা আমি আর ফাতমাই করে নিয়েছি, কিন্তু এখনো অ্যানার কোনো খোজ নেই!
শার্লটের কথায় চোখ কপালে উঠে গেলো ব্রায়ানের! আঁতকে উঠে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ও কঠিন স্বরে বলে উঠলো,
— আর এই কথা টা তোরা আমাকে এখন বলছিস! ও গিয়েছে সেই কোন সকালে, আর এখন দুপুর শেষ হতে চলল! ওই সমুদ্রের পাড় টা ব্লু জোনের ভেতরে, ওর যদি কোনো বিপদ আপদ হয় তাহলে কি হবে!
কথা গুলো বলেই ব্রায়ান দ্রুত গতিতে পা চালিয়ে সমুদ্রের দিকে এগোলো। আর শার্লট আর ফাতমা ব্রায়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে।
.
সমুদ্রের ভেতরে বেশ খানিক্ষন হুটোপুটি করে আবার সেই সাদা রঙা পাথর টার ওপর এসে বসেছে অ্যানা৷ রোদ আর সমুদ্রের মাঝ থেকে আসা ঝড়ো হাওয়ায় গায়ের ভেজা কাপড় ওর গায়েই শুকিয়ে গেছে। নিতম্ব ছাড়ানো আধ ভেজা চুল গুলো পিঠময় ছড়িয়ে দেওয়া, সেগুলো বাতাসে ওড়াউড়ি করছে। গায়ের হুডি টা খুলে পাশে রেখে দেওয়া, পরণে ওর ট্রাউজার আর ক্রপ টপ।
সবকিছু প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে ওর। এখানে বসে বসে নিজে কে অকারণে শাস্তি দিচ্ছে ও! আজ ওর নির্ঘাত জ্বর চলে আসবে, এই ঘন্টাখানেক পানিতে ডুবিয়ে কড়া রোদে বসে থাকার কারণে। কিন্তু ও এখান থেকে উঠবে না, তাই যা হয়ে যাক যাবে!
এমন সময় দূরে কারো দ্রুতগতির পায়ের আওয়াজ কানে এলো ওর। ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে পাশে থাকা হুডি টা গায়ে চড়িয়ে দিলো অ্যানা। কিন্তু মুখ টা ঢাকলো না, চুল টাও বাধলো না। শুধুমাত্র হুডি টা পরেই সমুদ্রের বিশালতার দিকে তাকিয়ে বসে রইলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পায়ের শব্দটা ওর কাছাকাছি এসে পৌছালো, কিন্তু পৌছেই থমকে দাড়ালো যেন সে পা জোড়া৷ অ্যানা নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দ্বারা বুঝলো আগত লোকটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে, অপলকে। পেছন দিকে না তাকিয়েই অ্যানা বলে উঠলো,
— এসো ব্রায়ান!
ব্রায়ানের যেন পা এগোচ্ছে না৷ অ্যানার কোমর ছাড়িয়ে, সাদা রঙা পাথর টির ওপর মেলে পড়া দীঘল কালো চুল গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো ও। প্রচন্ড ইচ্ছা করলো ওর, হাতে নিয়ে সেগুলো একটু ছুয়ে দিতে! কিন্তু নিজের সে ইচ্ছাটাকে বুকের ভেতর পাথর চাপা দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ব্রায়ান৷ অ্যানা নিজের ডান দিকে সরে গিয়ে ব্রায়ান কে বসার জন্য জায়গা করে দিলো, আর ধীর পায়ে হেটে অ্যানার পাশে এসে বসে অ্যানার দিকে তাকাতেই চোখ জোড়া থমকে গেলো ব্রায়ানের!
অ্যানা ওর হরিণী চোখের ন্যায় কাজল কালো চোখ জোড়া দিয়ে তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে! টেরাকোটা রঙা ঠোট জোড়া আবদ্ধ, মাঝে মাঝে মনের ভেতরে চলা ঝড়ের কারণে কেঁপে কেঁপে উঠছে তারা। কপালের ওপর থাকা বেবি হেয়ার গুলো বাতাসের দাপটে মুখের ওপর এসে পড়ছে বারে বারে! আর ব্রায়ান, সে অপলকে তাকিয়ে রইলো অ্যানার ওই স্নিগ্ধ, অনিন্দ্য সুন্দর মুখ খানার দিকে!
নিরবতা ভেঙে অ্যানা ব্রায়ানের উদ্দ্যেশ্যে প্রশ্ন করলো,
— তুমি এখানে কি করছো? কোনো দরকার?
ব্রায়ান অ্যানার দিকে ওভাবে তাকিয়ে থেকেই সম্মোহিতের মতো উত্তর করলো,
— তুমি অনেকক্ষণ এসেছো এখানে, তাই দেখতে এসেছিলাম তুমি ঠিক আছো কিনা!
ব্রায়ানের কথার উত্তরে অ্যানা মৃদু হেসে বলল
— তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো ব্রায়ান, আমি এই পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই না কেন আমার কিছুই হবে না! ব্যিকজ, সামওয়ান’স গ্যট মায় ব্যাক!
অ্যানার সে কথা যেন ব্রায়ানের কানে গেলো না! ও মন্ত্রমুগ্ধের মতো অ্যানার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো,
— তুমি অনেক সুন্দর অ্যানা!
ব্রায়ানের এ কথায় শব্দ করে হেসে উঠলো অ্যানা, তারপর বলল,
— প্রথমবারের মতো আমার মীর ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষের মুখ থেকে এ কথা শুনলাম, ভালোই লাগছে!
অ্যানার সে কথায় ব্রায়ানের কোনো হেলদোল হলো না! সে আগের মতো করেই তাকিয়ে রইলো অ্যানার দিকে, আর এইমুহুর্তেই ও করে বসলো সবচেয়ে বিপদ্দজনক কাজটি! অ্যানা কিছু বুঝে ওঠার আগেই অ্যানার বাদিকের চোয়ালে দুম করে একটা চুমু খেয়ে বসলো ও! আর ব্রায়ানের এহেন কাজে আতঙ্কে আত্মা কেঁপে উঠলো অ্যানার। বিস্ফোরিত চোখে সে ব্রায়ানের দিকে এক পলক তাকিয়ে তড়িৎ গতিতে সমুদ্রে পানি নিজের হাতের কোষে নিয়ে ব্রায়ানের ঠোঁটের স্পর্শ লাগা স্থান টা ধুয়ে ফেলতে ফেলতে আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলো,
— এ তুমি কি করলে ব্রায়ান! কি সর্বনাশ করলে তুমি! এইবার কি হবে! মীর সব শেষ করে দেবে!
আর সেই মুহুর্তেই দূরের জঙ্গলের ভেতর থেকে অ্যানার কানে ভেসে এলো ক্ষিপ্র গতিতে তাদের দিকে ছুটে আসা এক ঝাক হায়েনার হিংস্র হাসি। আর সেটা শুনতে পেয়েই চকিতে ব্রায়ানের দিকে তাকালো অ্যানা তারপর ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বলে উঠলো,
— এখনি এখান থেকে পালাও ব্রায়ান! যতদ্রুত সম্ভব সেইফ জোনে চলে যায়! দ্রুত!
কিন্তু ব্রায়ান অ্যানার কথার আগা মাথা বুঝলো না! ও ভাবলো অ্যানা হয়তো ভয়ানক রাগ করেছে ওর এ কাজের জন্য! অ্যানার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে ও অপরাধী গলায় অনুনয়ের সুরে বলে উঠলো,
— ক্ষমা করে দাও অ্যানা, আমি ইচ্ছা করে করিনি! কিভাবে হয়ে গেছে আমি বুঝতে পারিনি অ্যানা! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও! এরকম আর কোনোদিনও হবে না! আই সয়্যার!
কিন্তু ব্রায়ানের কথা শেষ হতে না হতেই সে হায়েনার ঝাকের পদধ্বনি আরও নিকটে চলে এলো, আর সেই সাথে কর্ণগোচর হতে লাগলো ওদের ভয়ঙ্কর হাসির ক্রর ধ্বনি! অ্যানা দ্রুত গতিতে পাথরের ওপর বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হ্যাচকা টান দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো ব্রায়ান কে, তারপর আতঙ্কগ্রস্ত গলায় বলল,
— ব্রায়ান, প্রাণপণে দৌড়াবে, ভুলেও পেছনে তাকিয়ে দেখতে যাবে না, যত দ্রুত সম্ভব সেইফ জোনে চলে যাও, এখনি! নইলে তোমাকে ওরা ছিড়ে খেয়ে ফেলবে! এখনি যাও!
আর অ্যানার এমন কথা শুনে কথার আগা মাথা না বুঝলেও ব্রায়ান ছুটলো ওয়ার্কিং জোনের দিকে ! আর ব্রায়ান ছুটে যাওয়া মাত্রই হায়েনার ঝাকের সে গতিবিধি ও পরিবর্তন হয়ে গেলো সাথে সাথেই, ওরাও চলল ওয়ার্কিং জোনের দিকে, ব্রায়ান সেইফ জোনে পৌছানোর আগেই তাকে ধরতে হবে ওদের!
চলবে…….
(তড়িঘড়ি করে লিখেছি, কিছুটা খাপছাড়া হয়ে গেছে আজ, একটু মানিয়ে নিয়ে পড়বেন 💙)