#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_১৯
#আ_মি_না
ব্রায়ান সেইফ জোনের দিকে ছুটে চলে যাওয়ার সাথে সাথেই অ্যানা ছুটলো তার বা দিকের রেড জোনের ভেতর, সে হায়েনা দের ছুটে আসার রাস্তার দিকে। আর কিছুক্ষণ ঝড়ের গতিতে ছোটার পরপরই ওর চোখে পড়লো ক্ষিপ্র গতিতে ছোটা সে হায়েনার পাল; দাঁত মুখ খিচিয়ে, হিংস্র হাসি হেসে ওরা ছুটে চলেছে ব্রায়ানের গমনপথের দিকে৷
অ্যানা ওদের কে দেখতে পেয়েই নিজের ছোটার গতি আরও বাড়িয়ে দিলো, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ও ছুটে গিয়ে পথ আটকে সামনে দাড়ালো সে হায়েনার পালের। আর অ্যানা ওদের সামনে এসে দাড়াতেই ক্ষিপ্রতার সাথে নিজেরদের ছোটা থামিয়ে দিলো সে হায়েনার পাল। ওরা থামতেই অ্যানা ওদের ভেতরের লিডার হায়েনা টার দিকে তাকিয়ে ও শক্ত গলায় বলে উঠলো,
— আর এক পাও সামনে আগাবে না হাইনা, ফিরে যাও! ওর কোনো দোষ নেই।
হায়েনার ঝাকের সে লিডারটি অ্যানার সামনে মাথা নত করে গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো, আর সাথে সাথেই সে চলে এলো তার হিউম্যান ফর্মে। এরপর মাটি থেকে ধীর গতিতে মাথা নত অবস্থাতেই উঠে দাঁড়িয়ে সে আনুগত্যের সাথে বলে উঠলো,
— দয়া করে আমাদের কে আমাদের কাজ করতে দিন শেহজাদী! আমাদের সামনে থেকে দয়া করে সরে দাড়ান! বাদশাহর আদেশ অমান্য করার দুঃসাহস দেখানোর মতো দুঃসাহস আমাদের নেই! দয়া করে আমাদের কে বাধা দিবেন না!
অ্যানা তীর্যক দৃষ্টিতে সে সুঠামদেহী, জংলি গঠনের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,
— আমি বলেছি ওর কোনো দোষ নেই, আবেগের বশবর্তী হয়ে এমন কাজ করে ফেলেছে ও। ও যদি আমার পরিচয় জানতো তবে কখনোই এমন কিছু করার দুঃসাহস দেখাতো না। তোমরা ফিরে যাও, ওর পিছু নিও না!
কিন্তু হাইনা নামক ছেলেটা তখনো ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো, তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে আগের মতোই নত সুরে বলল,
— দয়া করে আমাদের কে যেতে দিন শেহজাদী! বাদশাহর আদেশ আমরা অমান্য করতে পারবো না কোনো অবস্থাতেই। আপনি যদি আমাদের কে বাধা দেন তবে আপনাকে ডিঙিয়ে যেতে আমরা বাধ্য হবো, কিন্তু আপনাকে এমন অসম্মান আমরা কখনোই করতে চাই না, তাই দয়া করে আমাদের সামনে থেকে সরে দাড়ান!
হাইনার কথা শুনে অ্যানা দাঁতে দাঁত পিষলো, তারপর চাপা গর্জনে বলে উঠলো,
— তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে এই ধরনের কথা বলার মতো সাহস কোথায় পাও হাইনা! দেমিয়ান বংশের শেহজাদী আমি, আমি এই শিরো মিদোরির প্রাণ! তুমি আমার সাথে এইভাবে কথা বলার মতো স্পর্ধা কোথায় পেয়েছো?
হাইনা ছেলেটা কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না, মাথা নিচু করে রইলো৷ আর এরপর, তার কানে থাকা ব্লুটুথ ডিভাইসের মাধ্যমে কারো গুরুগম্ভীর কন্ঠের আদেশ ভেসে আসতেই মাথা নত অবস্থাতে ধীর পায়ে এক পা একপা করে পেছালো ও, আর ওর সাথে পেছালো ওর পেছনে থাকা বাকি হায়েনার দল। আর এরপর কিছুদূর পিছিয়েই সে ছেলেটি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আবার পরিণত হলো হায়েনা তে, এরপর অ্যানার দিকে তাকিয়ে নিজের মাথা নত করে আনুগত্য জানিয়ে ছুটে ফিরে চলে গেলো তাদের ফেলে আসা রাস্তাতে।
আর অ্যানা কিছুক্ষণ সেদিকে কটমট চোখে তাকিয়ে থেকে গটগট পায়ে ফিরে চলল ওয়ার্কিং জোনের দিকে।
৩২. সন্ধ্যা নামলো এই মাত্র, প্রাসাদের চারপাশে কৃত্রিম আলোয় আলোকিত হয়ে ঝলমলিয়ে উঠছে। নিচের হলরুম থেকে দাসীদের টইটম্বুর কলরবের আওয়াজ আসছে, নিজেদের ভেতর গাল গল্প করছে আর কাজ করছে ওরা।
নিজের কামরায় ভাবলেশহীনের মতো বসে আছে রুথ।রুথের পাশে বসে আছে একজন দাসী, সে রুথ কে সাধছে কিছু খেয়ে নেওয়ার জন্য। সকাল থেকেই সে কিছুই খাচ্ছে না, শুধু তাকিয়ে থাকছে নিজের সামনের দিকে। চোখের পলক ও পড়ছে না ওর, পুতুলের মতো করে বসে থাকছে সবসময়।
দুপুর বেলা অনেক্ষণ হয়ে গেলেও যখন রুথ কামরায় ফিরলো না তখন এই দাসী গিয়ে হাম্মাম খানায় খোজ চালাতেই রুথ কে পায় অস্বাভাবিক অবস্থাতে। বাথ টাবের ভেতিরে দাঁড়িয়ে নিজের সামনের দিকে তাকিয়ে কারো উদ্দ্যেশ্যে বিড়বিড় করে কিসব বলছিলো ও। ওকে এভাবে দেখেই দাসী টা তাড়াতাড়ি করে ওকে বাথটাব থেকে নামিয়ে, ভেজা জামাকাপড় বদলে শুকনো জামাকাপড় পরিয়ে রুথের কামরায় এনে বসিয়েছে, আর সেই থেকে রুথ এভাবেই বসে আছে, একটুও নড়েনি। খাচ্ছেও না!
দাসী টা এবার হাল ছেড়ে দিলো। খাবারের পাত্র টা রেখে ও চলে গেলো বাইরে, আফিয়ার নিকট। আফিয়া রুথের কামরার নিচের ফ্লোরের হলরুম পরিষ্কার রত দাসীদের কে পর্যবেক্ষণ করছিলেন, যেন কোনো কাজে কোনো ভুল না হয়। রুথের সে দাসী টা গিয়ে আফিয়ার পেছনে, ওর কাছাকাছি দাড়ালো। তারপর নিচু স্বরে বলে উঠলো,
— কালবী, রুথ মেয়েটা কিছুই খাচ্ছে না, কেমন করে তাকিয়ে থাকছে, আর কিসব বিড়বিড় করছে সারাক্ষণ! কি করবো এখন? আর, আমি ওখানে একা একা থাকতে পারবো না, ওকে দেখলে আমার ভয় করছে! আমার সাথে অন্য কাউকে পাঠান কালবী, নইলে অন্য কোনো দাসীকে মোতায়েন করুন!
আফিয়া দাসীটার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো, কিন্তু শেষের কথা গুলো উপেক্ষা করে বলল,
— তুমি যাও ওর কাছে, ওকে একা ছেড়োনা। আমি এখনি আসছি!
আফিয়ার কথায় অনিচ্ছা সত্বেও সে দাসীটা সিড়ি বেয়ে আবার ওপরে উঠে রুথের কামরায় চলে গেলো। আর আফিয়া আরও কিছুক্ষণ দাসীদের কাজের তদারকি করে অন্য একজন দাসীকে নিজের দায়িত্ব টা অর্পণ করে দিয়ে গেলো রুথের কামরায়।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই আফিয়ার চোখে পড়লো রুথের ফ্যাকাসে, অনুভূতি শূন্য চেহারা টা। ঠোঁট নাড়িয়ে কিসব যেন বিড়বিড় করছে ও। আর রুথের জন্য নির্ধারিত সে দাসীটা পেঁচার মতো মুখ করে খাবারের পাত্র হাতে নিয়ে বসে আছে পাশে। আফিয়া দেখেই বুঝলো দাসীটা কামরায় ফিরে আবারও সেধেছে রুথ কে খাবার খাওয়ার জন্য, কিন্তু খাওয়াতে পারেনি।
আফিয়া কামরায় ঢুকে সে দাসীটির দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো, আর দাসীটি আফিয়ার ইশারা পেয়ে প্রচন্ড খুশি হলো যেন! সাথে সাথে খাবারের পাত্র টা বিছানার ওপর রেখে বসা থেকে উঠে চলে গেলো কামরার বাইরে। আর সে দাসীটি চলে গেলে কামরার ভেতর থেকে দরজা লক করে দিয়ে আফিয়া এগিয়ে গেলো রুথের বিছানার দিকে। তারপর রুথের পাশে বসে রুথ কে উদ্দেশ্য করে ডেকে উঠলো,
— রুথ!
কিন্তু আফিয়ার ডাকে রুথের কোনো হেলদোল হলো না, ও আগের মতো করেই এক দৃষ্টিতে নিজের সামনের দেয়াল টির দিকে তাকিয়ে বসে রইলো। আফিয়া কিছুক্ষণ বিচক্ষণ চোখে রুথ কে পর্যবেক্ষণ করলো, তারপর আবার বলে উঠলো,
— রুথ, আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?
কিন্তু রুথ কোনো সাড়া শব্দ দিলো না। ওভাবেই বসে রইলো। আফিয়া এবার বসা থেকে উঠে গিয়ে রুথের একেবারে সামনে এসে দাড়ালো, তারপর রুথের বা গালে নিজের ডান হাত দ্বারা সজোরে একটা চাপড় দিলো। আর সে চাপড় খেয়ে সাথে সাথেই নিজের হ্যালুসিনেশন থেকে বেরিয়ে এলো রুথ। বা গালের আঘাত লাগা স্থান টায় নিজের বা হাত দ্বারা চেপে ধরলো ও, তারপর বড়বড় চোখ করে আফিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে উঠলো,
— আমাকে মারলেন কেন!
আফিয়া রুথের সে প্রশ্ন শুনে বলে উঠলো,
— কারণ তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছো! আর এইভাবে চলতে থাকলে এই জনমে আর বাদশাহর সন্তানের মা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে হবে না!
বাদশাহ নাম টা শুনতেই রুথের সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। চমকে উঠে সে বলল,
— আমি ওনার কাছে কখন যাবো আফিয়া! উনি কি আমাকে আর ডাকবেন না?
রুথের প্রশ্নে আফিয়া ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো, তারপর আবার এসে রুথের পাসে বসে রুথ কে নিজের দিকে ফেরালো, তারপর বলল,
— রুথ, আমাকে কিছু সত্যি কথা বলো তো! আমি যা যা জিজ্ঞেস করবো তার সত্যি সত্যি উত্তর দেবে, কোনো মিথ্যা কথা বলবে না। ঠিক আছে?
আফিয়ার কথায় রুথ বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। আফিয়া রুথের নত হয়ে থাকা মুখটা সামান্য উচু করে বলে উঠলো,
— আমার দিকে তাকাও।
রুথ তার কাঁপা কাঁপা চোখের দৃষ্টি দিয়ে আফিয়ার দিকে তাকালো। ওর সে চোখ জোড়াতে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে আফিয়া বোঝার চেষ্টা করলো রুথের মনে ঠিক কি চলছে! তারপর নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— সত্যি কথা বলো, সেদিন উনি তোমাকে কিভাবে কাছে টেনে নিয়েছিলেন?
আফিয়ার প্রশ্নে আবার দৃষ্টি নামিয়ে নিলো রুথ, তারপর আগের মতোই চুপ করে রইলো। আফিয়া ওকে চুপ থাকতে দেখে আবার জিজ্ঞেস করলেন,
— উনি কি তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন? বা চুমু খেয়েছিলেন? একটুও বাড়তি আদর করেছিলেন?
আফিয়ার কথাতে নত হয়ে থাকা রুথের দুচোখে পানি জমলো, তারপর সেগুলো ওর চ্যাল বেয়ে ফোটায় ফোটায় গড়িয়ে পড়লো নিচে। নিজের কান্না গুলোকে নিঃশব্দে ঝরিয়ে দেওয়ার প্রয়াসে ঠোট জোড়া চেপে ধরে রইলো রুথ। তারপর আফিয়ার প্রশ্নের উত্তরে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো, এরপর ফুপিয়ে কেদে উঠে বলল,
— উনি কিছুই করেননি….. কিছুই না! শুধু…… শুধু
আফিয়া ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, তারপর বলে উঠলো,
— ঠিক আছে বুঝেছি, তাহলে তুমি সেদিন ওনার কামরা থেকে বের হওয়ার পর এত খুশি কেন ছিলে!
রুথ আগের মতো করেই ফুপিয়ে উঠে বলল,
— আমি জানিনা, কিছুই জানিনা আমি! সেদিন আমি শুধু ওনাকেই দেখেছি! আর কিছুই দেখিনি। আমি জানিনা ওনার মাঝে ঠিক কি ছিলো, আমি একটা বারের জন্যও ওনার দিক থেকে চোখ সরাতে পারিনি! অথচ…. অথচ উনি আমার দিকে এক নজর তাকানও নি, আমি কেমন সেটা দেখেনও নি! আর আমি মুগ্ধের মতো শুধু ওনাকে দেখে গেছি অপলক! ওনাকে দেখেই আমার মন ভরে গেছে কালবী! আর এরপর থেকে আমি ওনাকে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছিনা, আমার মাথার ভেতর সবসময় উনি ঘুরছেন, আমার চোখের সামনে সবসময় আমি ওনাকে দেখছি! আমি হয়তো পাগল হয়ে যাবো কালবী!
রুথ থামলো, তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে নাক টেনে আবার বলে উঠলো,
— উনি যদি সেদিন আমাকে সত্যি সত্যিই কাছে টেনে নিতেন তাহলে আমার এমন অবস্থা হতো না কালবী! কিন্তু উনি আমাকে একজন প্রেয়সী মনে করে কাছে টানেননি! আমি জানিনা ওনার মনের ভেতরে ঠিক কি চলছিলো, কিন্তু ওনার মুখে আমি কোনো রকম অনুভূতি দেখিনি সেদিন! আর এরপর উনি মাঝপথে, হঠাৎ করেই আমাকে ছেড়ে উঠে পড়েন, আর এরপর কোনো রকমে নিজের পোশাক টা গায়ে জড়িয়ে হন্তদন্ত হয়ে ওনার কামরার জানালা দিয়ে বাইরে চলে যান! কোথায় যান তা আমি জানিনা! আর তারপর সারারাতে আর ফেরেননি! আমি ওনার মন জয় করতে ব্যর্থ হয়েছি কালবী! আমাকে হয়তো উনি একটুও পছন্দ করেননি, আমি হয়তো ওনার যোগ্যই নই!
শেষোক্ত কথা টা বলে রুথ আবারও ফুপিয়ে উঠলো। আফিয়া রুথের অসহায় চেহারাটার দিকে তাকালো, তারপর রুথের মুখ খানা নিজের দুহাতের ভেতর ধরে বলে উঠলো,
— শোনো রুথ! তোমার প্রতি ওনার কোনো অনুভূতি জন্মাবে এমন অবাস্তব স্বপ্ন দেখা বাদ দাও! বেগম থাকতে ওনার মনে জায়গা করে নেওয়া অসম্ভব! তুমি যত চেষ্টাই করো না কেন, বেগম কে সরিয়ে ওনার মনে তুমি কোনোদিনই জায়গা করতে পারবে না রুথ! আর তাছাড়া…..
আফিয়া থামলো, তারপর একটা ঢোক গিলে বলে উঠলো,
— তাছাড়া, তুমি ওনার কাছে শুধুমাত্র একজন সন্তান জন্মদানের যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না! তোমার কোনো মূল্য নেই ওনার কাছে রুথ! তুমি বাঁচলে কি মরলে সেটাও উনি কখনোই দেখতে আসবেন না! তাই তোমার নিজের সুস্থতা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে, তোমার নিজের খেয়াল তোমার নিজেকে রাখতে হবে! কেউ তোমাকে সুস্থ রাখতে পারবে না রুথ! একটা সন্তান হয়ে গেলেই তোমাকে এসব থেকে মুক্ত করে দেওয়া হবে! একজন সাধারণ দাসী হয়ে ওনার ভালোবাসা পাওয়ার স্বপ্ন দেখো না! ওনারা কখনো সাধারণ কাউকে ভালোবাসবেন না রুথ! আর বাসলেও, বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান কখনোই বাসবেন না! তার বেগমই তার কাছে সব! তুমি কষ্ট করে হলেও নিজেকে সামলাও রুথ!
আফিয়ার কথা শেষ হওয়ার পর রুথ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কাদলো। ওর মস্তিষ্ক কোনোভাবেই এই অবহেলা মেনে নিতে পারছে না! ও তো এমন কখনোই চায়নি! কত স্বপ্ন নিয়েই না এখানে এসেছিলো ও! কিন্তু সেসব স্বপ্ন নিমিষেই ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেলো ওর।
কিছুক্ষণ পর কান্না থামালো রুথ, তারপর আফিয়ার দিকে তাকিয়ে নাক টেনে বলে উঠলো,
— উনি কি আমাকে আর ডাকবেন না! আমার ওনাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে যে!
রুথের এমন কথায় আফিয়া ওর দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা, তারপর বলল,
— ওনার যখন সময় হবে উনি তোমাকে ডেকে নিবেন, তখন দেইখো।
— কিন্তু আমার তো এখনি দেখতে ইচ্ছা করছে, ওনার কামরার কাছে গিয়ে একটু উকি মেরে দেখে আসি না! তুমি আমাকে একটু নিয়ে চলো না কালবী!
আফিয়া ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,
— ঠিক আছে৷ সকালে নিয়ে যাবো তোমাকে, এখন সম্ভব না। উনি এইসময়ে রাজকার্যে ব্যাস্ত থাকেন অনেক। কোনোভাবে ওনার কাজে ব্যাঘাত ঘটলে তোমার সাথে সাথে আমার কল্লা টাও যাবে!
আফিয়ার এ কথার মাঝেই হঠাৎ করে রুথের কিছু একটা মনে পড়লো, আর সাথে সাথেই ও নিজের পোশাক আশাকের ভেতর হন্যে হয়ে খোজা শুরু করলো কিছু একটা। আর ওকে এভাবে কিছু খুজতে দেখে আফিয়া বলে উঠলো,
— কি খুজছো তুমি?
রুথ কাদো কাদো গলায় বলে উঠলো,
— আমার খঞ্জর টা! ওটা তো আমার সাথেই ছিলো, কোথায় গেলো! আমি কি হারিয়ে ফেললাম? এখন কি হবে!
আফিয়া ওর দিকে তাকিয়ে নিজের পোশাকের বুকের ভেতর থেকে সেই খঞ্জর টা বের করে বলল,
— দেখোতো, এটা নাকি!
রুথ আফিয়ার হাতের দিকে তাকিয়ে সে খঞ্জর টা দেখেই দু হাতে লুফে নিয়ে বলল,
— হ্যা এটাই তো! কিন্তু তুমি কোথায় পেয়েছো!
— হাম্মামে পেয়েছে এক দাসী, সেই এসে এটা আমাকে দিয়েছে। তুমি জানো এই খঞ্জর টার মালিক কে?
রুথ খঞ্জর টাকে দেখতে দেখতে আফিয়ার কথার উত্তরে বলে উঠলো,
— হ্যা, জানিতো! খঞ্জর টা ওয়ার্কার্স দের ভেতরের একজনের, ওর নাম অ্যানা। ও-ই দিয়েছিল আমাকে, এখানে আসার সময়ে। ও অনেক ভালো মেয়ে জানো! ওর মতো মেয়ে আমি দ্বিতীয় টা দেখিনি!
আফিয়া রুথের দিকে তাকালো, এই মেয়েটার মন ভেঙে দিতে ওর ইচ্ছা করছে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, খাবারের পাত্র টা হাতে নিয়ে সেখান থেকে পরম যত্নে খাবার তুলে রুথের মুখে তুলে দিতে থাকলো আফিয়া৷
৩৩. কৃত্তিম আলোয় ছেয়ে গেছে ওয়ার্কার্স দের ওয়ার্কিং জোন। সন্ধ্যার পর কাজের চাপ কম থাকায় মিটিং জোনে বসে গাল গল্প করছে অনেকে। বাকিদের কেউ কেউ এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর অন্যরা টুকিটাকি কাজ করছে।
শার্লট নীরব হয়ে ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবারের জন্য থালা সাজাচ্ছিলো। খুব মন খারাপ ওর, মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। কোনোদিকে না তাকিয়ে একমনে নিজের কাজ করে চলেছে ও।
ব্রায়ান এলো এমন সময়ে, এসে ওর পাশে দাঁড়ালো। শার্লট একবার ব্রায়ানের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিলো। ব্রায়ান এবার ডাইনিং টেবিলের ওপর উঠে বসে পা জোড়া ঝুলিয়ে দিলো নিচে, তারপর বলে উঠলো,
— কি হয়েছে তোর! মুখ খানা এমন করে আছিস কেন? অ্যানা আবার কিছু বলেছে?
শার্লট ব্রায়ানের দিকে না তাকিয়েই নিজের কাজ করতে করতে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে উত্তর করলো,
— না, অ্যানা আর কিছু বলেনি, ওর সাথে আমার এখনো কথাও হয়নি। আমার ভালো লাগছে না কিছু, তাই হয়তো মুখ দেখতে এমন লাগছে।
ব্রায়ান শার্লটের দিকে আর একটু এগিয়ে এসে নিচু স্বরে বলে উঠলো,
— আমি আজকে একটা ভয়ানক কাজ করে ফেলেছি শার্লট! অ্যানা বোধহয় আমার ওপর অনেক রেগে আছে! কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি ইচ্ছা করে কিছু করিনি!
শার্লট এবার কাজ রেখে ব্রায়ানের দিকে তাকালো, তারপর সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— কি করেছো তুমি?
ব্রায়ান কিভাবে বলবে বুঝতে পারলো না। লজ্জায় লাল হয়ে যেতে শুরু করলো ও। শার্লটের দিকে থেকে চোখ সরিয়ে এলোমেলো চোখে এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করলো ও। শার্লট নিজের সন্দেহের দৃষ্টি আরও গভীর করে বলে উঠলো,
— লজ্জা পাচ্ছো কেন তুমি ভাইয়া? এদিক তাকাও, কি করেছো তুমি? উল্টাপাল্টা কিছু করোনাই তো!
শার্লটের এমন কথাতে ব্রায়ান কোনোরকমে তাকালো ওরদিকে, তারপর বাধা বাধা গলায় বলল,
— আমি ভুল করে, আবেগে ভুল করে অ্যানার চোয়ালে একটা চুমু খেয়ে ফেলেছি!
বলেই লজ্জায় লাল হয়ে আবার অন্য দিকে তাকালো ও৷ আর ব্রায়ানের একথা শুনে শার্লট যেন আকাশ থেকে পড়লো! বিস্ফোরিত চোখে ব্রায়ানের দিকে তাকিয়ে সে এক প্রকার উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
— কিইই! এ তুমি….
কিন্তু এ দুইটা শব্দ উচ্চারণ করেই নিজের গলার উচ্চস্বরে নিজেই চমকে গিয়ে চোরা চোখে একবার আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি তে তাকিয়ে আবার নিচু গলায় ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
— এ তুমি কি করেছো! অ্যানা তোমাকে কিছু বলেনি?
— তাড়িয়ে দিয়েছে ও আমাকে, কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি ইচ্ছা করে কিচ্ছু করিনি! বাই চান্স হয়ে গেছে! এখন ও নিশ্চিত আমার ওপর রাগ করেছে রে শার্লট! এই কাজ করা আমার কোনো ভাবেই উচিত হয়নি!
মাটির দিকে তাকিয়ে অপরাধি গলায় বলল ব্রায়ান, তারপর নিচের দিকে থেকে চোখ সরিয়ে শার্লটের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— কিন্তু এখন কি করার? ও তো আমার ওপর প্রচন্ড রাগ করে আছে। আর রাগ করে যদি ও আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয় তবে আমার হালুয়া টাইট হয়ে যাবে রে শার্লট! এখন আমি কি করবো? বুদ্ধি দে!
অসহায় গলায় বলে উঠলো ব্রায়ান। শার্লট ওর দিকে তাকিয়ে ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— আপাতত কিছু করতে হবে না, তুমি কিছুদিন একটু আড়ালে আড়ালে থাকো, ওর সামনে পইড়ো না। ওর রাগ কমলে আমি ওর সাথে তোমার কথা জেনারেল অ্যাপোলজির ব্যাবস্থা করে দিবো। এখন তুমি যাও, আমাকে কাজ করতে দাও।
কথা গুলো বলে শার্লট আবার নিজের কাজে মন দিলো।আর ব্রায়ান ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে, ডাইনিং টেবিল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে হেটে চলে গেলো অন্যদিকে।
আর ব্রায়ান চলে যাওয়ার সাথে সাথেই অ্যানা এলো সেখানে। অ্যানা কে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো শার্লট। অ্যানা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েই সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করলো,
— কি হয়েছে তোর? সত্যি কথা বল, লুকাবিনা কিছু। কেউ কিছু বলেছে?
অ্যানার এমন হঠাৎ প্রশ্নে থতমত খেলো শার্লট, অ্যানার থেকে কথা টা আলগোছে চেপে যেতে গিয়েও অ্যানার ওই তীরের ফলার ন্যায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে কিছু লুকানোর সাহস পেলো না ও। চারদিকে একবার সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে উঠলো,
— অ্যানা, নতুন আসা ছেলে গুলো মোটেও সুবিধার না! ওরা এখানের সব মেয়েকেই সারাক্ষণ আজেবাজে অঙ্গভঙ্গি দেয়, আর বিশ্রী বিশ্রী কথা বলে! সেসব কথা মুখে আনার মতো না। আমার সাথে এরকম করেছে কয়েকবার কিন্তু আমি পাত্তা দেইনি। কিন্তু আজ সকালে আমি আর ফাতমা যখন কিচেনের ওই সাইডে পানি আনতে গেছিলাম তখন আমাদের পথ আটকেছে! আর যা যা বলেছে আমাদের তা শুনলে মানুষের কান পঁচে যাবে!
শেষের কথা টা বলতে গিয়ে শার্লটের গলা ধরে আসলো! অ্যানা ওরদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কি বলেছে?
শার্লট কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল,
— ফাতমা কে বলেছে ওর হাত পা বেধ……. আর আমাকে বলেছে…. আমাকে বলেছ….
বলতে বলতে থেমে গেলো শার্লট। সেই কুরুচিপূর্ণ কথা গুলো মনে পড়তেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো ওর, আর সেই সাথে চোখের কোণ বেয়ে দু ফোটা পানি পড়লো ওর চোয়াল বেয়ে। অ্যানা শক্ত গলায় বলে উঠলো,
— ব্রায়ান কে বলিস নি কেন?
— ওরা বলেছে ভাইয়া কে জানালে ভাইয়া যদি ওদের কে কিছু বলে তবে ওরা ভাইয়ার কোনো ক্ষতি করে দিবে! সেই ভয়ে বলিনি!
অ্যানা নিজের ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে শার্লটের চোখ থেকে পড়া পানিটা মুছে দিয়ে বলে উঠলো,
— আমার শরীর টা ভালো নেই, নইলে আমি এখনি গিয়ে ওদেরে এমন কথা বলার মূল্য বুঝিয়ে দিয়ে আসতাম! তবে তুই চিন্তা করিস না! খুব শিগগিরই ওদের কোনো একটা ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।
শার্লট অ্যানার সে হাতের ছোয়ায় শিউরে উঠলো, তারপর বলল,
— তোর গা তো গরম অ্যানা!
অ্যানা সামান্য হেসে বলে উঠলো,
— এ কিছু না! সামান্য গরম হয়েছে৷ সেরে যাবে। তোরা একটু রাতের কাজ টা সামলে নিস, আমি আমার মাঞ্জারে যাচ্ছি। আমার ভালো লাগছে না!
শার্লট অ্যানার কথায় সায় জানিয়ে বলে উঠলো,
— ঠিক আছে, যা, গিয়ে একটু ঘুমা। আমি তোকে রাতের খাবার টা দিয়ে আসবো তোর মাঞ্জারে।
অ্যানা সেখান থেকে চলে যেতে যেতে বলল,
— প্রয়োজন নেই, আমি রাতে খাবো না।
এরপর কিছুক্ষণ থেমে বলল,
— আর একটা কথা, ব্রায়ান কে সাবধান করে দিস। আজ যে ভুল ও করেছে সেই ভুল দ্বিতীয় বার যেন না করে। আর যদি করে তবে সে দিনটা হবে ওর জীবনের সর্বোচ্চ ভয়ঙ্কর দিন৷
বলেই নিজের মাঞ্জারের দিকে হেটে চলল অ্যানা। আর শার্লট অ্যানার এই সামান্য হুমকিতে, অ্যানার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজের জায়গায় চুপসে দাঁড়িয়ে রইলো।
৩৪. রেড জোনের ভেতর দিয়ে ধীর পায়ে হেটে সামনে এগোচ্ছে অ্যানা। হুডির পকেটে ওর লিন্ডা, পকেটের মুখ দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বসে বসে বাইরে টা দেখছে আর ঝিমুচ্ছে ও। অ্যানার চোখ জোড়া লাল, নিঃশ্বাস তপ্ত! জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, তবুও হাটা থামছে না ওর। জোর করে নিজের জ্বরতপ্ত শরীর টা এগিয়ে নিয়ে চলেছে ও সামনের দিকে।
এমন সময় কোথা থেকে ফ্যালকন উড়ে এসে বলো ওর কাধে। তারপর আনুগত্যের সাথে বলে উঠলো,
— আপনি এই অসুস্থ অবস্থায় কোথায় যাচ্ছেন শেহজাদী?
অ্যানা গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
— সে উত্তর কি তোকে দিতে হবে?
— না, সেটা নয়! আপনার গায়ে অনেক জ্বর! আপনি মাঞ্জারে ফিরে যান শেহজাদী! নইলে আপনার শরীর আরও বেশি খারাপ করবে। এত রাতে এভাবে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালে আপনার জ্বর বাড়বে বৈ কমবে না! দয়া করে ফিরে চলুন শেহজাদী!
অ্যানা ফ্যালকনের কথার কোনো উত্তর দিলো না। নিজের হাটা চালু রাখলো, আর কিছুক্ষণ হাটার পরই অ্যানার গন্তব্য উপলব্ধি করে ফ্যালকন কিছুটা উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলো,
— আপনি প্রাসাদের দিকে কেন যাচ্ছেন শেহজাদী!
অ্যানা ফ্যালকনের দিকে তাকালো এক পলক, তারপর আবার সামনে তাকিয়ে, নিজের চোয়ালদ্বয় শক্ত করে উত্তর দিলো,
— রুথের যাথে সাক্ষাৎ করতে।
চলবে…….