বাদশাহ_নামা #পর্বসংখ্যা_১৩ #আ_মি_না

0
87

#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_১৩
#আ_মি_না

মিটিং জোনে ফেরার রাস্তা দিয়ে চুপচাপ হেটে চলেছে ব্রায়ান আর অ্যানা। ওদের ভেতরে একটা নির্দিষ্ট দুরত্ব। অ্যানার মুখটা থমথমে, আর ব্রায়ানের মুখে তৃপ্তির হাসি। ভাগ্যিস তার অ্যানার কিছু হয়নি!

এই তো কিছুক্ষণ আগেই উর্ধশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে সে রেড জোনে এসে পৌছেছিলো, চার কিলো রাস্তাতে এক সেকেন্ডের জন্যও থামেনি ব্রায়ান! আর পৌছেই অ্যানাকে নিজের সর্বোচ্চ জোর দিয়ে উচ্চস্বরে ডাকতে শুরু করে ও। আর তার কিছু মুহুর্ত পরেই রেড জোনের জঙ্গলের ভেতর থেকে গুটি গুটি পায়ে বের হয়ে আসে অ্যানা৷

আর সেই চরম দুঃশ্চিন্তার মুহুর্তে অ্যানার উপস্থিতি টা যেন ব্রায়ানের মনের ওপর এক পশলা বৃষ্টির মতো এসে অশান্ত মন টাকে শান্ত করে দিলো! সেই সময় টাতে ব্রায়ানের মনে হচ্ছিলো যেন এই মুহুর্তে ছুটে গিয়ে অ্যানা কে নিজের বুকের ভেতর জড়িয়ে নিতে পারলে ও হতো পৃথিবীর সবথেকে সুখি মানুষ!

কিন্তু নিজের সে দুর্দমনীয় ইচ্ছা টাকে অতি কষ্টে দমন করে , নিজের সমস্ত অনুভুতি কে ধামাচাপা দিয়ে ধীর পায়ে সে এগিয়ে গেছিলো অ্যানার কাছে, তারপর অ্যানার থেকে একটা নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে সে শুধু জিজ্ঞেস করে ছিলো ‘অ্যানা, তুমি ঠিক আছো’।

অ্যানা ব্রায়ানের সে প্রশ্নের উত্তরে মুখে কিছুই বলেনি শুধু মাথা নেড়ে সায় জানিয়েছে আর তারপর দুজন মিলে সেখান থেকে হেঁটে চলে এসেছ মিটিং জোনের দিকে।

ওরা যখন মিটিং জোনের কাছাকাছি এসে পৌছালো ততক্ষণে দুপুর পার হয়ে প্রায় বিকালের দিকে গড়িয়েছে। ওয়ার্কিং জোনে ওয়ার্কার্স, আউটসাইডার্স কারোরই দুপুরে খাওয়া হয়নি, রান্নাও চড়েনি। ব্রায়ান আর অ্যানার অপেক্ষায় তারা এখনো মিটিং জোন জুড়ে বসে আছে শুকনো মুখে৷

ব্রায়ান আর অ্যানা মিটিং জোনে এসে পৌঁছানো মাত্রই ওয়ার্কার্স রা যে যেখানে ছিল ছুটে এলো ওদের দিকে। শার্লট তখনো মাটিতে, ওকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল ফাতমা, কান্নারত শার্লট কে সান্তনা দিচ্ছিল সে৷

হঠাৎ করেই ওয়ার্কার্স দের সবাইকে রাজপথের রাস্তার দিকে ছুটে যেতে দেখে শার্লট নিজেও মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালো আর তারপর অ্যানা আর ব্রায়ান ওর দৃষ্টিগোচর হতেই কান্না মাখা চোখে, প্রবল উচ্ছাসের সাথে নিজের জায়গা থেকে ছুটে চলে গেলো ও ওদের থেকে।

গিয়েই অ্যানাকে জড়িয়ে ধরল শার্লট আর তারপর বান্ধবী কে ফুরে পাওয়ার আনন্দে হাউ মাউ করে কান্না করে দিল ও। শার্লটের এমন হঠাৎ চিৎকারে পকেটের ভিতরে আরামে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত লিন্ডা চিৎকার দিয়ে ধড় মড় করে জেগে উঠলো। ভীষণ ভয় পেয়ে অ্যানার হুডির পকেটের ভেতরের অংশ টা নুজের ধারালো নখ দিয়ে খামচে ধরলো, আর পরক্ষণেই হুডির পকেট থেকে নিজের মাথা বের করে শার্লট কে দেখে প্রচন্ড বিরক্ত হলো ও! শুধু শুধু এই পাজি মেয়েটার জন্য ওর ঘুম খানা নষ্টি হলো ভেভে শার্লট কে মনে মনে খানিক বকা দিলো ও৷ তারপর আবার ও ঘুরর ফিরে শোয়ার প্রস্তুতি নিলো। ঘুম ছাড়া ওর জীবনে আপাতত কোনো কাজ নেই।

শার্লট অ্যানাকে নিজের সাথে গায়ের জোর দিয়ে জড়িয়ে ধরে কান্না মাখা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— তুই ঠিক আছিস তো, তোর কিছু হয়নি তো!

শার্লটের এমন কান্না দেখে মৃদু হাসলো অ্যানা, হেসে শার্লট কে নিজের দু হাতে জড়িয়ে নিলো সে নিজেও তারপর বলল,

— হ্যাঁ আমি ঠিক আছি, আমার কিছুই হয়নি৷ আর কান্না করিস না, তুই যে আমাকে ভালোবাসিস সে বিষয়ে আমি কনিভিন্সড হয়ে গেছি, তাই আর নকশা করে কান্না করতে হবে না৷

বলেই মৃদু শব্দ করে হেসে দিলো অ্যানা৷ শার্লট অ্যানার এ কথা সশুনে অ্যানা কে জড়িয়ে ধিরা অবস্থাতেই অ্যানার পিঠে একটা আলতো চাপড় দিয়ে বলল,

— তুই একটা শয়তান!

শার্লটের কিথার উত্তরে অ্যানা বলল,

— ইয়াপ, ডেফিনেটলি আই অ্যাম!

তারপর শার্লট কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিজের সামনে নিয়ে এসে অ্যানা জিজ্ঞেস করলো,

— দুপুরের খাওয়া হয়েছে কারো?

শার্লট মাথা নেড়ে না বুঝালো তারপর গাল ফুলিয়ে বলল,

— তোদের চিন্তায় কি আমাদের কারো খাওয়া ঘুম আছে? একজন ছুটলো বিড়ালের পেছনে, আর অন্যজন ছুটলো বিড়ালের মালিকের পেছনে। আর আমরা এইখানে খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে শোক বিলাস করলাম। হুহ!

শার্লটের এমন কথাতে অ্যানা নিজের মাস্কের নিচে মৃদু হাসলো তারপর নিজের হুডির হাতা টা সামান্য গুটিয়ে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,

— আমি কিচেনের যাচ্ছি। দুপুর আর রাতের রান্না এক সাথে করে দিবো। তুই নিজের কাজে যা, উল্টা পালটা স্বপ্ন দেখে নিজের মাথা খারাপ করিস না।

আর এ কথা বলেই অ্যানা নিজের লম্বা লম্বা পা ফেলে কিচেনের দিকে চলে গেলো৷ আর শার্লট ভাবতে লাগলো অ্যানার শেষোক্ত বাক্য টা৷

২২. রুথের যখন জ্ঞান ফিরলো তখন প্রায় শেষ বিকাল৷ ধীরে ধীরে ও যখন চোখ মেলে তাকালো তখন হঠাৎ করেই ওর মাথায় এলো না যে ও আসলেই কোথায় আছে, কিন্তু এরপর যখন ওর মনে পড়লো যে ওকে ল্যাবে নিয়ে আসা হয়েছিলো তখনই তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসলো ও বিছানায়৷ কিন্তু ও তো এখন আর ল্যাবে নেই। ওকে রাখা হয়েছে অন্য আর একটা ছোটখাটো কামরায়।

অ্যানা বিছানায় বসে বসে নিজের আশেপাশে তাকালো। কামরা টা পুরো সাদারঙা, এমন কি আসবাব পত্র গুলোও সাদা, বিছানা, বিছানার চাদির, বালিস সবই সাদা৷ সে সাদা দেয়াল গুলোর দিকে তাকিয়ে কামরার দরজা টা ঠিক কোথায় সেটা বোঝার চেষ্টা করলো রুথ, কিন্তু সমস্ত জায়গা টাই দেয়াল মনে হলো ওর, দরজার চিহ্নও কোথাও দেখলো না ও৷

হঠাৎ করেই আতঙ্কিত হয়ে উঠলো রুথ৷ সে কি মারা গেছে? নইলে তাকে এমন দরজা জানালা বিহিন বদ্ধ ঘরে কেন রাখা হয়েছে! এমন সময়ে রুথের ভাবনার মাঝেই ওর বিছানার ডান দিকের দেয়ালে ভেসে উঠলো একটি দরজা, আর তারপর সে দরজা ঠেলে কামরার ভেতরে প্রবেশ করলো প্রাসাদের দাসী দের প্রধান নিয়ন্ত্রক হুমাইরা তাইর।

রুথ হুমায়রা তাইর কে দেখেই তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো৷ হুমায়রা তাইরের পেছনে পেছন কামরায় ঢুকলো আরও কয়েকজন দাসী। হুমায়রা তাইর রুথের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

— শরীর এখন কেমন লাগছে তোমার মেয়ে?

রুথ মাথা নত করে মৃদুস্বরে উত্তর দিলো,

— জ্বি, ভালো লাগছে৷

রুথের উত্তর টা শোনার সাথে সাথেই তিনি বললেন,

— ভালো, এখন এই দাসীদের সাথে যাও, ওরা তোমাকে তোমার কামরায় পৌছে দিবে। আর আজ রাতে তুমি বাদশাহর খাসকামরায় যাবে তাই সেই ভাবে নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করো৷

কথা গুলো বলেই তিনি দাসী গুলোকে ইশারা করলেন রুথ কে নিজেদের সাথে নিয়ে যেতে৷
হুমায়রা তাইরের ইশারা পাওয়া মাত্রই সে দাসী গুলো রুথ কে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সেখান থেকে বের করে নিয়ে এলো। আর সে কামরা থেকে বের হওয়া মাত্রই রুথের চোখ জোড়া কপালে উঠে গেলো, বিস্ময়ে মুখগহ্বর আলগা হয়ে এলো ওর৷

প্রাসাদের সে কামরা থেকে বেরিয়েই রুথ এসে পড়লো প্রাসাদের কেন্দ্রীয় হলরুমে, যার আয়তন দেখে রুথের চোক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেলো। চারপাশ টা হা হয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকলো ও৷ এমন আভিজাত্যপূর্ণ ইনটেরিওর ও আগে কখনো কোথাও দেখেছে বলে ওর মনে পড়ে না!

সমস্ত প্রাসাদটাতেই সাদা রঙা মার্বেল পাথরের দেয়াল, আর সে দেয়ালের সমস্ত কোণায় কোণায় অভূতপূর্ব, স্বর্ণবাধানো নকশা। প্রাসাদের ভেতরে হলরুম জুড়ে অসাধারণ সুন্দর মোটা মোটা স্তম্ভ গুলো সারিবদ্ধভাবে, সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে প্রাসাদ টিকে মাথায় নিয়ে। গুরুগম্ভীর এক আবহাওয়া ছড়িয়ে দিচ্ছে যেন ওরা চারদিকে।

চকচকা মেঝের ওপর, স্তম্ভ গুলোর মাঝখানের ফাকা জায়গা গুলো দিয়ে কালো রঙা বর্ডারের লাল রঙা জমিনের কার্পেট বিছানো। সে অসম্ভব রকম সৌন্দর্য মন্ডিত কার্পেট গুলো যেন এই সাদা রঙের মেঝের ওপর সাদা রঙা গোলাপের বাগানের ভেতরে ফুটে থাকা লাল টকটকে গোলাপ টির মতো ফুটে পড়েছে। প্রাসাদের বিশাল রকম চওড়া, সাদা রঙা সিড়ি গুলোর দুই ধার দিয়ে স্বর্ণের তৈরি হাতল, আর সে হাতলের ওপর দিয়ে সাদা রঙা কোনো এক অমূল্য ধাতবের অসাধারণ লতাপাতা ওয়ালা নকশা৷

প্রাসাদের সমস্ত সিলিং জুড়ে বিশাল বিশাল আকৃতির স্ফটিকের ঝাড়বাতি, যেগুলো থেকে নির্গত সোনালি রঙা আলো সাদা রঙা মেঝের ওপর প্রতিফলিত হয়ে চার পাশ টাকে সোনা রঙে রাঙিয়ে আলোকিত করে, আশ পাশের ধবধবে সাদা রঙ টাকে আরও উজ্জ্বল করে দিচ্ছে৷

প্রাসাদের চার ধারে থাকা বিশাল বিশাল নকশাদার জানালা গুলোর কয়েকটি দিয়ে গোধুলি বেলার সূর্য কিরণ এসে পৌছাচ্ছে প্রাসাদের ভেতরে৷ শেষ বিকালের মৃদু মন্দ বাতাসে জানালার ওপরের মখমলি নকশাদার পর্দা গুলো বাতাসে ওড়াওড়ি করছে৷

সমস্ত হলরুমটা জুড়ে খিলখিলে হাসির শব্দ, প্রাসাদের দাস দাসী রা সবাই হলরুম টা জুড়ে ঘুরে ঘুরে কাজ করে বেড়াচ্ছে আর নিজেদের ভেতর গল্প গুজব করছে৷ কোথাও যেন আনন্দের কোনো কমতি নেই৷ আশপাস থেকে অসম্ভব রকম সুন্দর সুগন্ধ ভেসে আসছে, রুথ ভেবে পেলো না এই সুগন্ধ টা কিসের; ফুলের, নাকি কোনো সুগন্ধীর!

রুথ কে এভাবে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার সাথে আসা দাসী দের একজন তাকে তাগাদা দিয়ে বলল,

— এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না, তোমাকে তোমার কামরায় যেতে হবে৷ তারপর রাতের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে৷ দ্রুত চলো৷

দাসীটার কথা শুনে রুথ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে, তার সামনে আগে আগে হেটে চলা দাসী টার পেছন পেছন আগালো। আর ঠিক সেই মুহুর্তেই ওর মাথার ভেতর ঠোক্কর খেলো একটা শব্দ

— খঞ্জর!

মুহুর্তেই ফ্যাকাসে হয়ে গেলো রুথের মুখ খানা! খঞ্জর টা তো গতকাল রাতে ঘুমানোর সময় নিজের পোশাকের ভেতর থেকে বের করে ওই সুন্দর কামরাটার বালিশের তলায় রেখেছিলো! ওটা যদি কেউ পেয়ে যায় তবে কি হবে! অ্যানা তো বলেছিলো ওই খঞ্জর টা যেন কেউ না দেখে, নইলে সবাই ওই খঞ্জর টার পেছনেই পড়ে যাবে!

রুথ সাথে সাথে নিজের সামনে হেটে চলা দাসী টাকে জিজ্ঞেস কিরলো,

— আমাকে কি গতকাল যে কামরাটায় থাকতে দেওয়া হয়েছিল সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?

দাসী টা রুথের দিকে না ফিরেই কড়া গলায় উত্তর করলো,

— হ্যা। অযথা কোনো প্রশ্ন কোরো না। যেখানে নিয়ে যাবো চুপচাপ সেখানে যাবে৷ তোমার যখন প্রশ্ন করার মতো ক্ষমতা হবে শুধু তখনই প্রশ্ন করবে।

রুথ নিশ্চিন্ত হলো খানিক টা, কিন্তু পরক্ষনেই ওর মনে হলো সেই কামরায় যদি তার আগেই কেউ ঢুকেযায় আর খঞ্জর টাও পেয়ে যায় তাহলে কি হবে!
অস্থির হয়ে গেলো রুথ, দ্রুত নিজের কামরায় যাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগলো ও। কিন্তু তার সামনে সামনে হেটে চলা দাসীটা ধীর গতিতে হাটছে, তাই বাধ্য হয়ে ওকেও ধীর গতিতে হাটতে হচ্ছে। তাই বেশি চিন্তা না করে নিজের অস্থিরতা টাকে নিজের ভেতরেই চেপে রেখে দাসী টার পেছন পেছন এগোতে লাগলো রুথ।

প্রকান্ড হলরুম টা পেরিয়ে সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠলো ওরা, তারপর দোতলায় উঠে একটা লাল টকটকা উজ্জ্বল পাথরের দেয়ালের নিকট গেলো সে দাসিটি।
রুথ অবাক হলো কিছুটা। সবখানে সাদা রঙা পাথরের দেয়াল, তাহকে এই পাথর টা লাল কেন! আর ঠিক তখনি রুথ কে অবাক করে দিয়ে সে লাল পাথরের ওপর ভেসে উঠলো একটি হাওয়ার ন্যায় আবছা কালো রঙা আবরণ, আর সেই আবরণ টার উপরের দিকে, বা পাশে ভেসে উঠলো সংখ্যা লেখার জন্য একটি ক্যি প্যাড স্ক্রিন৷

দাসী টা সেই ক্যি প্যাডের ওপর টাইপ করলো,

— 3044

আর সে সংখ্যা টা টাইপ করার পরমুহূর্তেই লাল রঙা পাথরের সে দেয়ালটির সামনের আবছা কালো রঙা আবরণ টি সাদা রঙে পরিবর্তিত হলো। এরপর সে দাসী টি পেছন ফিরে রুথ কে নিজের পেছন পেছন আসতে বলে সেই সাদা রঙা আবরণের ভেতর পা রেখে মুহুর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেলো, আর এটা দেখা মাত্রই ভড়কে গেলো রুথ। ভয়ে দু কদম পেছনে চলে এলো ও। কিন্তু ওর পেছনে থাকা অন্য দুজন দাসী ওর দুহাত দুপাশ থেকে ধরে ওকে নিয়েই পা রাখলো সেই সাদা রঙা আবরণের ওপাশে। আর দু কদম এগিয়ে সে আবরণ টা পার হতেই দাসীদেরকে সহ নিজেকে গতকালের সেই অসাধারণ আভিজাত্যপূর্ণ কামরাটাতে আবিষ্কার করলো রুথ।

আর এই অত্যাশ্চর্য ঘটনা টা নিজের চোখের সামনে ভোজবাজির মতো ঘটতে দেখে রুথের চোয়াল নেমে গেলো৷ সে তো একটু আগেও ছিলো ওই লাল পাথরের সামনে আর ওই আবরণ টা পার হতেই ও এখানে কিভাবে চলে এলো! সেখানে তো কোনো দরজাও ছিলো না!

হতভম্ব হয়ে রুথ তাকিয়ে রইলো নিজের সামনে থাকা, তার আগেই কামরায় প্রবেশ কিরা সেই দাসীটার দিকে। আর এরপর খঞ্জরের ব্যাপার টা মাথায় আসতেই তাকে দু হাতে ধরে রাখা দাসীদেরদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এক প্রকার দৌড়ে চলে গেলো ও কামরার বিছানার ওপর রাখা বালিশ টার দিকে।

অন্য একজন দাসী ইতোমধ্যেই কামরার ভেতর এসে রুথের বিছানা টা ঠিক কিরছিলো, আর এই মুহুর্তে সে ওই বালিশ টাই ধরতেই যাচ্ছিলো৷ কিন্তু দাসী টা বালিশ স্পর্শ করার আগেই সেখানে ছুটে চলে গেলো রুথ, তারপর দাসী টাকে বালিশ স্পর্শ করতে না দিয়েই সে বালিশের ওপর বসে পড়লো, তারপর ধরা পড়ে যাওয়া কাপা কাপা গলায় বলল,

— বাকিটা আমি করে নিবো, এখন আপনারা আমাকে একটু একা ছেড়ে দিন, আমি একটু একা থাকতে চাই।

রুথের এ কথা শুনে বিছানা ঠিক করা দাসী টা সন্দেহের চোখে তাকালো রুথের দিকে কিছুক্ষণ, তারপর বিছানার কাছ থেকে সরে দাড়ালো। আর সে দাসী টা সরে দাড়ালে রুথের সাথে আসা দাসী দের একজন বলে উঠলো,

— ঠিক আছে, তুমি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও, আমরা খানিক বাদেই তোমাকে হাম্মাম খানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আসবো৷

দাসী টার কথায় রুথ মাথা নেড়ে সায় জানাতেই দাসী গুলো কামরা ত্যাগ করলো৷ আর ওরা প্রস্থান করতেই রুথ যেন হাফ ছেড়ে বাচলো! দ্রুততার সাথে বালিশের তলা থেকে সেই মহামূল্যবান পাথর বসানো খাপ ওয়ালা খঞ্জরটা বের করলো আর এরপর সে খঞ্জরটা উঠিয়ে বিছানার ডান পাশের দেয়ালের সাথে লাগোয়া ওয়াল আলমিরা টার একটি কম্পার্টমেন্ট খুলে সেখানে রেখে দিলো। আপাততের জন্য এটা এখানে নিরাপদ থাকবে।

খঞ্জর টা রেখে দিয়ে আবার এসে বিছানায় বসলো রুথ আর সেই সময়েই হুট করে রুথের কামরার দরজা টা খুলে ঝট করে একটা মেয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা টা আবার বন্ধ করে দিলো সাথে সাথে।
হঠাৎ এই অচেনা মেয়েটিকে এভাবে নিজের কামরায় ঢুকতে দেখে রুথ তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ালো বিছানার ওপর থেকে। ওর মনে পড়ে গেলো অ্যানার বলা কথা গুলো, মিনে পড়ে গেলো প্রাসাদের কোণায় কোণায় মৃত্যু ওত পেতে থাকা কথা টা।

রুথ উঠে দ্রুতগতিতে বিছানার এক কোণায় সরে গিয়ে বিছানার পাশে রাখা সাইড টেবিলের ওপর রাখা চিনামাটির ফুলদানি টা হাতে উঠিয়ে নিলো, তারপর সেটা কে নিজের প্রতিরক্ষার অস্ত্র হিসেবে উচু করে ধরলো মেয়েটির দিকে, এরপর ঝাঝালো গলায় বলল,

— কে তুমি? আমার কামরায় কি করছো?

আগন্তুক মেয়েটি রুথের এমন ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থা দেখে বন্ধ দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মিষ্টি করে বলল,

— ভয়ের কিছুই নেই, আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। তুমি নাকি বাদশাহর সেবায় যাবে আজ রাতে তাই তোমাকে দেখতে এলাম। যে তুমি কেমন সুন্দরী!

তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রুথ কে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে মেয়েটি বলে উঠলো,

— হুম, বেশ! হুমায়রা তাইরের পছন্দ আছে বলতে হবে।

রুথের হাতে ধরে রাখা ফুলদানি টা শিথিল হয়ে এলো, শক্ত করে রাখা চোয়ালদ্বয় আলগা হয়ে এলো। হুমায়রা তাইর পছন্দ করেছেন তাকে! বাদশাহ পছন্দ করেননি? তাহলে ওয়ার্কিং জোনে সবাই যে বলল বাদশাহ পছন্দ করেছেন ওকে! তাহলে কি সেটা মিথ্যা ছিলো! রুথ দমে যাওয়া গলায় বলে উঠলো,

— আমাকে হুমায়রা তাইর পছন্দ করেননি, স্বয়ং বাদশাহ পছন্দ করেছেন!

মেয়েটি রুথের এ কথায় খিলখিল করে হেসে উঠলো, তারপর বলল,

— বাদশাহর আকাল পড়েনি যে তোমাকে পছন্দ করবেন তিনি, এদিকে আসো তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।

শেষোক্ত কথাটি মেয়েটা রুথ কে হাতের ইশারায় নিজের দিকে ডেকে বলল। রুথ প্রথমে ইতস্তত করলেও পরবর্তীতে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো মেয়েটির দিকে, হাতে ধরে রইলো সে ফুলদানি টা৷ এরপর মেয়েটির কাছাকাছি পৌছালে মেয়েটি দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো থেকে সোজা হয়ে দাড়ালো। তারপর দরজার দিকে ফিরে নকশাদার সে দরজাটার দুপাশের দুইটা হাতল ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে খুলে দিলো, আর দরজা টা খুলে দেওয়ার সাথে সাথেই সে মেয়েটির পেছনে থাকা রুথের মুখে এসে ঝাপটা দিলো এক রাশ অদ্ভুত সুন্দর সুগন্ধী ওয়ালা বাতাস৷

রুথ চোখ জোড়া খিচে বন্ধ করে নিলো, তারপর বাতাসের দাপট কমে এলেই বন্ধ চোখ জোড়া খুলে নিজের সামনে দাঁড়ানো মেয়েটিকে পেরিয়ে ও সামনের দিকে হেটে গেলো দু কদম, আর তারপর কামরাটির দরজার সামনের সরু, ঝকঝকা বারান্দার ধার ঘেঁষে থাকা স্বর্ণের তৈরি রেলিং ধরে নিচে তাকালো ও৷ আর নিচে তাকাতেই চোখ জোড়া জুড়িয়ে গেলো ওর।

খানিক্ষন আগে তার দেখা হলরুম টার মতো বড় একটা জায়গা জুড়ে ছোট ছোট সাদা রঙা বিছানা পাতা। সে বিছানা গুলোর মাঝে মাঝে প্রাসাদের মোটা মোটা স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে৷ আর সে বিছানার চার পাশে, বিছানার ওপরে, সারি সারি বিছানার দুই সারির মাঝের ফাকা জায়গাতে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে অসংখ্য রূপবতী, যাদের সে রূপের কাছে রুথ কিছুই না!

জায়গা টা দেখা মাত্রই রুথ বুঝতে পারলো এটা বাদশাহর হেরেম! অবাক হয়ে তাদের কে দেখতে থাকলো রুথ। মেয়েগুলো যেন এক এক টা সাক্ষাৎ পরী! তাদের ওপর থেকে চোখ সরানোও দায়। কোথাও কোনো খুত নেই যেন! পুরোপুরি নিখুত গঠনের সে মেয়ে গুলো খলবল করে কথা বলছে নিজেদের ভেতরে, আর হাসাহাসি করে একে অপরের ওপর উলটে পড়ছে।

রুথ অপলকে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। সেটা দেখে রুথের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলে উঠলো,

— যেখানে বাদশাহ এদের দিকেই ফিরে তাকাননা, সেখানে তোমাকে পছন্দ করতে যাবেন কোন দুঃখে!

মেয়েটির কথায় হুস ফিরলো রুথের। আসলেই তো! এই মেয়েগুলোর কাছে তো ও কিছুই না! তাহলে তাকে এখানে এনেছে কেন? রুথ সেই অসম্ভব রকম রূপবতী দের থেকে চোখ সরিয়ে নিজের পেছনে থাকা মেয়েটির দিকে তাকালো, তারপর জিজ্ঞেস করলো,

— তাহলে আমাকে কেন নিয়ে আসা হয়েছে এখানে? আমি তো ওদের নখের যোগ্যও নই! আর বাদশাহই বা এদের দিকে ফিরে তাকান না কেন ওরা তো যথেষ্ট সুন্দরী! আর তাছাড়া ওনার তো বেগমও নেই!

রুথের কথা শুনে মেয়েটি মুচকি হাসলো, তারপর বলল,

— কামরায় আসো, তোমাকে সব বুঝিয়ে বলছি৷

বলে মেয়েটি পেছন ফিরে রুথের কামরার দরজা ঠেলে ভেতরে চলে গেলো, আর রুথও গেলো মেয়েটির পেছন পেছন, যেতে যেতে বলল,

— কিন্তু তুমি কে? তোমার নাম কি?

মেয়েটি রুথের বিছানায় বসতে বসতে উত্তর দিলো,

— আমি হেরেমের দাসীদের প্রধান নিয়ন্ত্রক হুমায়রা তাইরের সহযোগী, আফিয়া লেইলা। বলতে পারো এই প্রাসাদের সব দাসীদের খবর আমার হাতের মুঠোয়। আর আমি এখানে এসেছি তোমাকে আদব কায়দা শেখাতে, কারণ আমার কাছে খবর এসেছে তুমি খুবই বেয়াদব। কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তার কিছুই জানো না!

আফিয়া লেইলার কথা শুনে রুথ মাথা নিচু করে নিলো, তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলো,

— হুমায়রা তাইর আমাকে কেন পছন্দ করেছেন বললে না তো!

মেয়েটি বিছানায় বসে বসে পা দোলাতে দোলাতে বলল,

— কারণ তোমাকে দেখে হুমায়রা তাইরের মনে হয়েছে যে তুমি দেমিয়ান বংশের পুরুষদের জন্য এবং তাদের সন্তান ধারণের জন্য উপযুক্ত শরীরের অধিকারী।

— তাহলে নিচের মেয়েগুলোর কাজ কি?

— ওরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে বাদশাহর জন্য উপহার হিসেবে এসেছে, যদিও তাদের মধ্যের নির্দিষ্ট কিছু মেয়েকে তোমার মতো করে পরীক্ষা করা হয়েছে, তাদের কে বাদশাহর কাছে পাঠানোও হয়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্য বসত তাদের কেউই আজ বেচে নেই।

কেউ বেচে নেই শুনেই রুথের বুকের ভেতর টা কেপে উঠলো, আতঙ্কিত চোখে আফিয়ার দিকে তাকিয়ে ও বলল,

— বেচে নেই কেন? কিভাবে মারা গেছে তারা?

— সেসব তোমার না জানলেও চলবে, এখন আমার সামনে এসে দাড়াও।

রুথ কে হাতের ইশারায় নিজের কাছে আসার ইঙ্গিত দিলো আফিয়া। রুথ বিছানার কোণা থেকে সরে আফিয়ার সামনে দাড়াতে দাড়াতে ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস কিরলো,

— কিন্তু শুনেছি বাদশাহর নাকি অনেক বয়স, এই বয়সে ওনার কি আর সন্তান হওয়ার মতো অবস্থা আছে? উনি তো মনে হয় উঠে দাড়াতেও পারেন না ঠিক মতো!

রুথের এমন কথা শুনে আবারও খিলখিল করে হেসে উঠলো আফিয়া, তারপর বলল,

— দেমিয়ান বংশ সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই দেখছি, যদিও ধারণা থাকার কথাও না! এই প্রাসাদের বাইরে এই প্রাসাদ সম্পর্কে একটা ইঞ্চি পরিমাণ সত্যিও কারো জানা নেই।

এরপর রুথের দিকে ভ্রু তুলে তাকিয়ে আফিয়া জিজ্ঞেস করলো,

— আমাদের বাদশাহর বয়স কতো জানো?

রুথ তখনও আতঙ্কিত চোখেই তাকিয়ে ছিলো। আফিয়ার প্রশ্নে সে সেভাবে তাকিয়েই মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। আফিয়া রুথ কে এমন আতঙ্কিত হতে দেখে মজা পেলো অনেক। বিছানায় সোজা হয়ে বসে রুথের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে ভ্রু জোড়া নাচিয়ে আফিয়া উত্তর দিলো,

— দুশো সাত।

রুথ ভিড়মি খেলো যেন। হতভম্ব হয়ে ও জিজ্ঞেস করলো,

— মানে কি! এটা কিভাবে সম্ভব! একটা মানুষের বয়স দুশো সাত কিভাবে হয়!

আফিয়া বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রুথের কাছে এসে রুথ কে পুরোপুরি সোজা করে দাঁড়িয়ে দিতে দিতে বলল,

— দেমিয়ান বংশের মানুষদের গড় আয়ু পাঁচশ বছর৷ আমাদের বর্তমান বাদশাহর আগে যিনি বাদশাহ ছিলেন, হুজায়ফা আদনান দেমিয়ান, আমাদের বর্তমান বাদশাহর দাদা, তিনি বেচে ছিলেন সাতশ বছর। সেই হিসাবে আমাদের বাদশাহ এখন পরিপূর্ণ যুবক!

রুথ আফিয়ার নির্দেশনা অনুযায়ী ঠিক ভাবে দাঁড়ানো অনুশীলন করতে করতে কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— কিন্তু দাদার পরে বাবা বাদশাহ না হয়ে ছেলে কেন হলো?

আফিয়া হঠাৎ কাজ থামিয়ে দিলো তারপর রুথের সামনে এসে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বলল,

— ওনারা বাদশাহ, দেমিয়ান বংশের পুরুষ, তাদের কে এইভাবে অসম্মান দিয়ে কথা বলার সাহস তুমি কোথায় পাও? দ্বিতীয় বার তাদেরকে কোথাও সম্বোধন করতে হলে বাদশাহ বলে সম্বোধন করবে। যারা গত হয়েছেন তাদের নাম ধরতে পারো অসুবিধা নেই৷ কিন্তু! বর্তমান বাদশাহর নাম ভুলেও কোথাও উচ্চারণ করবে না। তাকে বাদশাহই বলবে। নইলে এই মাথা টা আর ধড়ে থাকবে না৷

শেষোক্ত কথা টা রুথের মাথায় আঙুল দিয়ে গুতা দিয়ে বলল আফিয়া। তারপর আবার নিজের কড়া গলা ছেড়ে আগের মতোই মিষ্টি গলায় বলল,

— এখন এদিকে দেখো, বাদশাহর কামরায় ঢুকে এইভাবে সামনে হেটে যাবে, যেন পায়ের হাটার টু শব্দটি না হয়, যেন মনে হয় কোনো বিড়াল ছানা হেটে আসছে। আর হ্যা, বাদশাহর সামনে দাঁড়িয়ে ভুলেও নিজের মাথা উচু করবে না, মাথা টাকে যথা সম্ভব নিচু করে রাখবে। তিনি যদি বলেন মাথা উচু করতে তখনই কেবল উচু করবে, নইলে না। মুখে সবসময় মৃদু হাসি লাগিয়ে রাখবে তবে ভুলেও জোরে হাসবে না, এটা একটা বেয়াদবি। এরপর উনি যদি তোমাকে গ্রহণ করেন এবং তোমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেন তাহলে ওনার হাত খানা এভাবে ধরবে, তারপর তার হাতের ওপর পৃষ্ঠে চুমু খাবে, আলতো করে।

আফিয়া প্রত্যেকটা কাজ রুথ কে প্রাকটিকালি দেখাতে লাগলো, আর রুথ সেগুলো দেখতে দেখতে ক্রমে ক্রমে নার্ভাস হয়ে যেতে লাগলো। এত এত নিয়ম কি তার মনে থাকবে! নাকি প্রথম রাতেই সে গর্দান হারাবে! শুকনো একটা ঢোক গিললো রুথ, তারপর আফিয়া কে অনুকরণ করতে করতে সে জিজ্ঞেস কিরলো,

— আচ্ছা, আমি তো সাধারণ একজন মানুষ! দেমিয়ান বংশের হিসাবে বাদশাহ আর ও অনেক অনেক বছর বেচে থাকবেন, কিন্তু আমি বেচে থাকবো না। তাহলে আমার থেকে যে সন্তান আসবে সে কি অতোটা আয়ু পাবে? সে কি আমার মতো সাধারণ মানুষের কোনো বৈশিষ্ট্য পাবে না?

আফিয়া এক পলক রুথের দিকে তাকিয়ে বলল,

— দেমিয়ান বংশে শুধু মাত্র পুরুষদের বৈশিষ্ট্যই সন্তান দের মাঝে দেখা যায়। মায়ের কোনো বৈশিষ্ট্যই তাদের মাঝে দেখা যায় না৷ আর দেমিয়ান বংশের পুরুষেরা নারীদের কে শুধু সন্তান লাভের জন্যই ব্যাবহার করে৷ ভালোবাসার জন্য নয়। কারণ তারা বেচে থাকবে অনেক অনেক বছর আর সেখানে তাদের সন্তানের জন্মদায়িনী বেচে থাকবে মাত্র কয়েক বছর! সুতরাং ভালোবেসে কষ্ট পেয়ে সাম্রাজ্যের কথা ভুলে ওইসব আবেগ নিয়ে পড়ে থাকলে তাদের চলবে না৷ আর খুব কম সংখ্যক বাদশাহই জীবনে বিয়ে করেছেন, আর সেই বিবাহিতদের মাঝে আমাদের বর্তমান বাদশাহ একজন!

রুথের রাগ লাগলো খুব। এটা কি ধরণের কাজ কর্ম! একটা পুরো বংশ কিনা শুধুমাত্র সন্তানের জন্যই মেয়েদের কে কাছে রাখে, ভালোবাসার ছিটে ফোটাও নেই! এরকম জীবন কে চায়! আগে যদি তার জানা থাকতো যে এই বংশের এই কাহিনী তাহলে সে কখনোই এখানে আসতো না, মরে গেলেও না। চরম বিতৃষ্ণা নিয়ে রুথ আফিয়া কে জিজ্ঞেস করল,

— তাহলে এরা কেন আমাদের মতো স্বল্প আয়ুর মানুষকে নিজেদের সন্তানের জন্মদায়িনী হিসেবে বেছে নেয়? নিজেদের মতো কাউকে বেছে নিলেই তো পারে৷ এদের বংশে কি মেয়ে জন্মায় না?

রুথের এমন অপ্রয়োজনীয় রাগ দেখে আফিয়া শব্দ করে হাসলো, তারপর বলল,

— নিজেদের বংশে দেমিয়ান পুরুষদের বিয়ে করা নিষিদ্ধ, কেন নিষিদ্ধ সেটা আমি জানিনা, এমনকি কেউই জানে না, শুধুমাত্র দেমিয়ান বংশের লোকেরা ছাড়া৷ আর এই কারণেই তো আজ প্রাসাদে এত ঝামেলার সৃষ্টি!

কথা গুলো বলতে বলতে কেমন যেন আনমনা হয়ে গেলো আফিয়া৷ কিন্তু হঠাৎ করেই সম্বিত ফিরে পেয়ে সে রুথ কে তাগাদা দিয়ে বলল,

— ঠিক আছে, যথেষ্ট নিয়ম কানুন শেখানো হয়েছে তোমাকে৷ এখন তোমাকে হাম্মামে পাঠানো হবে৷ সেখান থেকে একেবারে ঝকঝকে হয়ে বের হবে তুমি, তারপর আর একবার সমস্ত নিয়ম কানুন গুলোর পুনরাবৃত্তি করে আমাকে দেখাবে। তারপর তোমাকে বাদশাহর জন্য তৈরি করা হবে৷

কিন্তু রুথ আফিয়ার সে সব কথা শুনতে পেলো না, আনমনা হয়ে বসে রইলো ও বিছানায়, তার পর নিজের মনেই আফিয়া কে ও প্রশ্ন কিরলো,

— তাহলে বাদশাহর যিনি বেগম ছিলেন তিনি কতটা কষ্ট পেয়েছেন! রোজ রোজ যদি কারো স্বামী ভিন্ন ভিন্ন মেয়ের কাছে যায়, হোক তারা দাসী, তাহলে তার কেমন লাগবে! আবার তার নাকি সন্তানও হয় না! বাদশাহ হয়তো তাকে কখনো ভালোই বাসেননি! এই কষ্ট নিয়ে তিনি কিভাবে বেচে ছিলেন!

রুথের কথা শেষ না হতেই কামরার ভেতরে বেশ কয়েকজন দাসী ঢুকলো রুথ কে হাম্মাম খানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। আফিয়া এতক্ষণ রুথের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। দাসী গুলো কামরায় ঢোকার সাথে সাথে তাদের দিকে এক পলক তাকালো সে, তারপর তাদের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আবারও রুথের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে নিচু গলায় বলল,

— যিনি বেগম ছিলেন, তিনি এখনো আছেন, আর আজ পর্যন্ত দেমিয়ান বংশে যতগুলো বেগম এসেছেন তাদের ভেতরে হয়তো তিনিই সবচেয়ে ভাগ্যবতী! কারণ পঞ্চদ্বীপের পর বাদশাহ এই পৃথিবীতে যদি সবচেয়ে বেশি কোনো কিছুকে ভালো বেসে থাকেন তবে তিনি হলেন আমাদের বেগম। এখন তুমি জলদি জলদি হাম্মামে যাও, আর আজ রাতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করো।

চলবে……..

( আজকের পর্ব টা বেশিই বড় হয়ে গেছে, হয়তো একটু খাপছাড়াও হয়ে গেছে, রিচেক করার সময় নাই আর, ভুল ভ্রান্তি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here