বাদশাহ_নামা #পর্বসংখ্যা_২১ #আ_মি_না

0
1

#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_২১
#আ_মি_না

৩৬. জ্বর তপ্ত শরীর নিয়ে রেড জোনের ভেতর দিয়ে দুর্বল পায়ে সামনের দিকে হেটে চলেছে অ্যানা। পকেটে ওর লিন্ডা, অ্যানার মন খারাপ যেন ওকেও ছুয়ে দিয়েছে, নিশ্চুপ হয়ে অ্যানার তপ্ত শরীরে মাথা ঠেকিয়ে পকেটের ভেতর বসে আছে ও৷
অ্যানার বা কাধের ওপর চুপচাপ বসে আছে ফ্যালকন! সে এখন ঠিক কি করবে সেটাই বুঝতে পারছে না! একদিকে তার বাদশাহ যার আদেশ অমান্য করার মতো সাহস ওর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখনো হবে না, আর অন্যদিকে তার মাতৃসম অ্যানা, যার আদর আতিশয্যে বেড়ে উঠেছে সে এবং শিরোমিদোরির তার জেনারেশনের সমস্ত প্রাণিকুল! নিজের মায়ের মতো করে যে আগলে রেখেছে তাদের কে, আর তাদের অভয়ারণ্য শিরো মিদোরি কে! অতি নিঃশব্দে, অ্যানার অগোচরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ফ্যালকন নিজেও!

অ্যানা ভারী, তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে হেটে চলেছে কোথাও। শরীরে ওর একরত্তি শক্তি নেই। মাথার ভেতর শুধু ওর একটা কথাই ঘুরছে, যে মীর আজ ওর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলেছে। অ্যানা স্পষ্ট দেখেছে সৌলজার্স দের হাতে অস্ত্র ছিলো, আর সেটাও কোনো সাধারণ অস্ত্র নয়, ফার্স্ট গ্রেডের অস্ত্র! এর মানে কি! মীর কি তবে ওর বিরুদ্ধে এবার যুদ্ধ ঘোষণা করছে! এটা কেন হলো, কেন হলো এসব! আজ যদি সে কোনো সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করতো, বা মীরের সাথে যদি তার বিয়ে টা না হতো, তবে এসব কি কখনো হতো? আর মীরের সাথে ওর বিয়ে টা হলোই যখন তখন লাইফ ট্রি কেন তাকে দেমিয়ান বংশের সন্তান ধারণে অক্ষম করলো! কি কারণে? তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই কি!

চলা থামিয়ে কিছুক্ষণের জন্য আকাশের দিকে তাকালো অ্যানা, তারপর বাষ্পীত নয়নে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এরপর কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবারও চলা শুরু করলো ও। ফ্যালকন মুখ খুলল এতক্ষনে, আনুগত্যের সাথে অনুরোধের সুরে ও অ্যানাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,

— শেহজাদী, এই অসুস্থ শরীর নিয়ে এত রাতে জঙ্গলের ভেতরে দয়া করে আর যাবেন না! আপনার মাঞ্জারে ফিরে চলুন শেহজাদী! উনি শুনলে আমাকে খুব করে বকাবকি করবেন আপনাকে মাঞ্জারে ফিরিয়ে না নিয়ে যাওয়ার অপরাধে, দয়া করে ফিরে চলুন শেহজাদী!

অ্যানা কিছুক্ষণ চুপ থাকলো, ওর এখন কথা বলতে একদমই ইচ্ছা করছে না। চারপাশের সব কিছু ওর কাছে এখন বিষের মতো লাগছে। কিছুক্ষণ নিরব থেকে অতঃপর ও বলল,

— আমার যেখানে ইচ্ছা হবে আমি সেখানে যাবো, তুই চুপ থাকতে পারলে এখানে থাকবি নইলে থাকবি না৷

ফ্যালকন কি করবে বুঝতে পারলো না। অ্যানার শরীর টা প্রচন্ড গরম, আস্তে আস্তে শরীরের তাপমাত্রা আরও বাড়ছে, এদিকে আবার আকাশে মেঘ করতে শুরু করেছে! এখন যদি অ্যানা কান্না করে তবে এক্ষুনি বৃষ্টি আসবে! আর সেই বৃষ্টি তে ভিজে গেলে অ্যানা আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে! কি করবে ও এখন? ফ্যালকন শুকনো ঢোক গিললো একটা, তারপর নরম সুরে অ্যানা কে মানানোর উদ্দ্যেশ্যে আবারও বলে উঠলো,

— আপনার শরীর টা মোটেও ভালো নেই শেহজাদী, আপনার শরীরের তাপমাত্রা উত্তরোত্তর বাড়তেই আছে! আর আকাশের অবস্থা কেমন সেটা আপনি সবার থেকে ভালো জানেন, এখন যদি বৃষ্টি আসে তবে আপনি ভিজে যাবেন! দয়া করে ফিরে চলুন শেহজাদী, আপনার শরীর টা সুস্থ হলে আপনি যেখানে খুশি যাবেন, এখন মাঞ্জারে ফিরে চলুন শেহজাদী!

অ্যানার মেজাজ খারাপ হলো প্রচন্ড। তার মন টা একদমই ভালো নেই, এই মুহুর্তে তার পার্সোনাল স্পেস প্রয়োজন, একা থাকা প্রয়োজন, মানসিক শান্তির প্রয়োজন। কিন্তু এই ফ্যালকন সেটা হতে দিচ্ছে না। শক্ত গলায় ধমকের সুরে অ্যানা বলে উঠলো,

— ফ্যালকন, তুই যদি আর একটা কথাও বলেছিস তবে তোকে একেবারে কোকোর কাছে পাঠিয়ে দেবো, এক গালে তোকে গিলে ফেলবে ও৷ চুপ করে এখানে বসে থাক, আর সেটা না পারলে আমার সামনে থেকে চলে যা।

ফ্যালকন বেচারা অ্যানার ধমক খেয়ে চুপসে গেলো, আর কোনো কথা বলল না। চুপচাপ অ্যানার কাধে বসে রইলো অ্যানা যেখানে নিয়ে যায় সেখানে যাওয়ার জন্য।

.

বেশ কিছুক্ষণ হাটার পর ওরা এসে পৌছালো লাইফ ট্রির কাছে। গন্তব্য যে এখানেই সেটা উপলব্ধি করে অ্যানার কাধ থেকে উড়ে গিয়ে লাইফ ট্রির একটা লম্বা, চিকন ডালে বসলো ফ্যালকন। কিন্তু অ্যানা লাইফ ট্রির কাছে গেলো না। ফ্যালকন কে অবাক করে দিয়ে ও এলো সে উজ্জ্বল পানির ডোবাটার ধারে৷ তারপর লিন্ডাকে পকেট থেকে নামিয়ে মাটিতে রেখে দিয়ে নিজের গায়ের হুডি টা খুলে মাটিতে ছুড়ে ফেললো ও। ফ্যালকন সাথে সাথেই নিজের দৃষ্টি নিচু করে নিয়ে অন্য দিকে তাকালো। আর এরপর অ্যানা ট্যাংক টপ আর ট্রাউজার পরা অবস্থাতেই ডোবার ধার থেকে কিছুটা পেছন দিকে সরে গিয়ে, ফ্যালকন কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেখান থেকে ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়লো সে ডোবার উজ্জ্বল, শান্ত পানির ভেতরে৷ তারপর এক ডুব দিয়ে সাতরে সাতরে সে চলে গেলো ডোবার একেবারে নিচের কর্দমাক্ত তলে।

সেখানে পৌছে ডোবার তল টাকে নিজের তর্জনি দিয়ে ছুয়ে দিলো অ্যানা, আর সাথে সাথেই আলোকিত হয়ে উঠলো ডোবার তলা সহ চারধার। ডোবা টা আলোকিত হয়ে যাওয়ার পর আবার পানির উপরি ভাগে উঠে এলো অ্যানা, তারপর সাতরে ডোবার ধারে এসে পাড়ে উঠে পড়লো।
ডোবার ঠান্ডা পানির কারণে অ্যানার শরীরের তাপমাত্রা কমে গেলেও ঠান্ডায় থরথর করে কাপতে শুরু করলো ও। আর এরপর ভেজা অবস্থাতেই ধীর পায়ে হেটে গিয়ে ও দাড়ালো লাইফ ট্রির সামনে, লাইফ ট্রির গা ঘেঁষে, কিন্তু লাইফ ট্রি কে স্পর্শ করলো না৷ কিঞ্চিৎ ঝড়ো বাতাসে একে বেকে এলো মেলো হয়ে যাওয়া লাইফ ট্রির দিকে এক নজরে তাকিয়ে ধীরে ধীরে সেখানের মাটিতে বসে পড়লো অ্যানা৷

ঠান্ডার কারণে গায়ের পশম গুলো বার বার কাটা দিয়ে উঠতে থাকলো ওর, টেরাকোটা রঙা ঠোট জোড়া কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো বুকের ভেতর থেকে জলোচ্ছাসের ন্যায় ধেয়ে আসা অশ্রুর ঝাপটা কে দমিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায়। লাইফ ট্রি কে তার অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু কথা গুলো কান্নার সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে! কন্ঠ দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে কোনো বুলি বের করা এখন অ্যানার কাছে পাহাড় ঠেলার মতো অসম্ভব কোনো কাজের মতো মনে হচ্ছে।

গলায় উঠে আসা কান্না গুলোকে চেপে রাখতে বড়সড় একটা ঢোক গিললো অ্যানা৷ তারপর নিজের মুখ খানা লাইফ ট্রির নিকট সামান্য এগিয়ে নিয়ে এসে এক প্রকার ফিসফিসে কন্ঠে, ধীর গতিতে বলে উঠলো,

— আমার মীর আজ আমার ওপর অস্ত্র তুলেছে! যে মীর আমার শরীরে সামান্য ফুলের টোকাও লাগতে দিতো না সেই মীর আজ আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলেছে!

এই দুটো কথা বলেই অ্যানার কন্ঠ রোধ হয়ে এলো আবারও, কান্নার দমকে আর কিছুই বলতে পারলো না ও। বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা আর্তনাদ টা কোনো রকমে গলা দিয়ে চেপে ধরে রইলো ও, কিন্তু চোখ জোড়া বাধা মানলো না৷ ঝর ঝর করে দুচোখ বেয়ে পানি পড়তে শুরু করলো ওর৷ আর সাথে সাথেই শিরো মিদোরি তে শুরু হলো বৃষ্টি; শান্ত, স্নিগ্ধ বৃষ্টি; যাতে কোনো ঝড়ো বাতাসের ছিটে ফোটাও নেই, নেই কোনো আক্রোশের চিহ্ন!

আর সে বৃষ্টির ফোটা অঝোরে নামতেই এবার ফুপিয়ে কেদে উঠলো অ্যানা৷ কান্নারত অবস্থাতেই লাইফ ট্রিকে উদ্দ্যেশ্য করে ও বলে উঠলো,

— আমি তো সব কিছু শেষ করতেই গেছিলাম! আমি তো আর কোনো সংঘাত চাইনি! তবুও কেন সে আমার ওপর অস্ত্র তুললো! আর তুমি, তুমি কি জানতে না আমি কখনো দেমিয়ান বংশের সন্তান নিজের গর্ভে ধারণ করতে পারবো না, আমার প্রাণসংশয় থাকবে! তবে কেন তুমি মীরের সাথে আমাকে জড়িয়ে দিলে, কোন কারণে! তুমি কি দেখতে চেয়েছিলে দেমিয়ান বংশের মেয়েরা কতটা ধৈর্য ধরতে পারে? তার জন্যই কি আমার সাথে এতটা নিষ্ঠুর হতে হলো তোমাদের সবাই কে?

অ্যানা দাঁতে দাঁত চেপে নিজের কান্না নিবারণ করার চেষ্টা করলো। কাউকে আর কোনো কথাই বলতে চায় না ও, নিজের কোনো যন্ত্রণা কাউকে আর ও বুঝতে দেবে না৷ ওর সমস্ত দরজা সবার জন্য বন্ধ করে দেবে ও, সিল গালা করে দেবে সবকিছু।

অ্যানা সময় নিয়ে নিজের কান্নার দমক টা থামালো। তারপর চোখ মুছে উঠে দাড়িয়ে বৃষ্টি থেকে বাচতে লাইফ ট্রির এক কোণায় জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা লিন্ডা কে হাতে নিয়ে, গাছের ডালে মাথা নিচু করে বসে থাকা ফ্যালকন কে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,

— ফ্যালকন, আমার লিন্ডা কে মাঞ্জারে পৌছে দিয়ে আয়। এই বৃষ্টি তে এইখানে ঠান্ডার ভেতরে থাকলে ও অসুস্থ হয়ে পড়বে।

ফ্যালকন মাথা নিচু রেখেই নরম গলায় বলে উঠলো,

— আপনিও ফিরে চলুন শেহজাদী, জেদ করে এইখানে এইভাবে থাকবেন না, আপনার শরীর আরও খারাপ করবে। ফিরে চলুন শেহজাদী, আমার কথাটা শুনুন দয়া করে!

অ্যানা নিজের ভ্রু জোড়া সামান্য কুঞ্চিত করে কড়া গলায় বলে উঠলো,

— আমাকে জ্ঞান দিতে আসবি না, যতটুকু করতে বলবো ততটুকুই করবি। আর লিন্ডা কে পৌছে দিয়ে নিজের বাসায় চলে যাবি, আমার পেছনে আর আসবি না!

অ্যানার কথায় ফ্যালকন ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, তারপর বলল,

— ঠিক আছে, দিন ওকে, আমি রেখে আসি।

অ্যানা লিন্ডাকে সামান্য উচু করে ধরলো সামনে, আর ফ্যালকন গাছের ডাল থেকে উড়ে নেমে এসে অ্যানার হাত থেকে নিজের ধারালো নখ ওয়ালা শক্ত থাবার পা জোড়া দিয়ে ধরলো লিন্ডা কে। কিন্তু ফ্যালকন ধরা মাত্রই লিন্ডা রেগে মেগে ম্যাও করে উঠে, নিজের শরীর টা একে বেকে ফোস ফোস করা শুরু করলো। অ্যানা কে এখানে একা রেখে ফ্যালকনের সাথে ও মোটেও যেতে রাজি নয়। লিন্ডার এমন আচরণে অ্যানা লিন্ডার মাথায় হাতে বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় বলে উঠলো,

— তুমি ওর সাথে চলে যাও লিন্ডা, কোনো ভয় নেই। আমি কিছুক্ষণ পরেই চলে আসবো।

অ্যানার কথায় লিন্ডা কিছুটা শান্ত হলেও ওর ফোসফোসানি কমলো না। রাগে ফুলে ফুলে উঠতে থাকলো ওর পিঠের শিরদাঁড়া। ফ্যালকন সাবধানে লিন্ডা কে ধরলো যেন ওর নখের কারণে লিন্ডা ব্যাথা না পায়। তারপর লিন্ডা কে পায়ে আকড়ে ধরেই মাঞ্জারের উদ্দ্যেশ্যে উড়াল দিলো আকাশে৷

আর ওরা চোখের আড়াল হতেই অ্যানা লাইফ ট্রির দিকে একবার শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ডোবার পাড়টা ঘেঁষে হেটে চলল রেড জোনের আরও ভেতরের দিকে।

৩৭. কৃত্তিম আলোতে আলোকিত হয়ে আছে মিটিং জোন। সেখানে হাত পা বেধে ফেলে রাখা হয়েছে আউটসাইডার্স এর তিন টা মেয়েকে সেক্সুয়ালি অ্যাসাল্ট করার অভিযোগে নতুন আসা সে ওয়ার্কার ছেলে গুলো কে। সংখ্যায় তারা এগারো জন। প্রায় সবার মুখেই উত্তম মধ্যমের চিহ্ন বসে আছে। কালশিটে পড়ে গেছে অনেকের৷

থিয়োডর একটা চেয়ার টেনে বসে আছে ওদের সামনে, আর ব্রায়ান বুকে হাত বেধে দাঁড়িয়ে আছে ওদের একেবার কাছে। ওদের কে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সেইফ জোনের প্রায় সব আউটসাইডার্স আর ওয়ার্কার্স রা৷ চোখে মুখে ওদের ক্ষোভ। এত যাবৎ কালের ভেতরে এমন ন্যাকারজনক কাজ কখনোই ঘটেনি। পঞ্চদ্বীপে ঘটা অপরাধের সংখ্যা খুবই কম, আর সব চেয়ে কম হলো মেয়েদের ওপর যেকোনো ধরণের নির্যাতন। ছোটবেলা থেকেই তাদের কে সমস্ত ধরণের মূল্যবোধ শেখানো হয়, বিশেষ করে নারীজাতির প্রতি সম্মান। কিন্তু এই ছেলে গুলো কিনা এতজনে মিলে তিনটা অসহায় মেয়ের সাথে এমন ঘৃণ্য কাজ করলো! এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো না৷

আশেপাশের সবার চোখেই প্রায় আগুন জ্বলছে। সবাই অপেক্ষায় আছে ব্রায়ান কি সিদ্ধান্ত নেয় সেটা শোনার জন্য। ব্রায়ান বুক থেকে হাত নামিয়ে ভারী পায়ে এগিয়ে এলো সে ছেলে গুলোর আরও নিকটে৷ তারপর দাঁতে দাঁত পিষে গমগমে কন্ঠে বলল

— তোমরা এখানে এসেছো তোমাদের করা কোনো গুরুতর অপরাধের সাজা ভোগ করার জন্য। আর এইখানে এসে তোমরা আবারও অপরাধ করেছো! আর সেটাও কোনো সাধারণ অপরাধ নয়, অতি মাত্রায় ঘৃণ্য একটা অপরাধ! তোমরা জানো এই অপরাধের শাস্তি কি? মৃত্যুদণ্ড।

ব্রায়ানের কথা শেষ হতেই ছেলে গুলোর ভেতর থেকে একজন উদ্বেগহীন কন্ঠে বলে উঠলো,

— কিন্তু আমরা তো কিছুই করে উঠতে পারিনি, তার আগেই আপনারা চলে এসেছেন৷ যেহেতু আমরা কিছুই করে উঠতে পারিনি সেহেতু আমাদের মৃত্যুদণ্ড হওয়ার প্রশ্নই আসে না৷

ছেলেটার কথায় চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ব্রায়ানের। ভ্রু জোড়া কুচকে ও বলে উঠলো,

— তোমরা তো প্রচন্ড রকম বেয়াদব! এত জঘন্যতম একটা অপরাধ করার চেষ্টা করার পরেও তোমরা বলছো যে তোমরা কিছুই করোনি!

ব্রায়ানের এ কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই অন্য একজন ছেলে বলে উঠলো,

— এইতো, দেখুন আপনিও বললেন, চেষ্টা করেছি। সে অপরাধ তো আমরা সত্যি সত্যিই আর করিনি বা কর‍তে পারিনি! তাহলে আমরা অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড পাবো না।

ব্রায়ান দাঁতে দাঁত পিষলো, থিয়োডর ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো তীক্ষ্ণ চোখে। আশেপাশে থাকা জনসমাগম ও প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হলো ওদের এই ধরণের কথাতে৷ ব্রায়ান এখন এদের কি শাস্তি দেয় সেটাই দেখার অপেক্ষা৷
ব্রায়ান প্রচন্ড ঘৃণায় নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সে ছেলে গুলোর দিক থেকে, তারপর তার আশেপাশে থাকা জনসমাগমের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,

— বাকি রাত টুকু এরা এভাবেই এইখানে বাধা থাকবে, আর কাল সকাল হলেই এদের কে পানিশমেন্ট এরিয়াতে হাত পা বেধে রোদের ভেতরে ফেলে রাখা হবে এক সপ্তাহের জন্য এবং আগামী তিনদিন এদের কে কিছুই খেতে দেওয়া হবে না, পানিও না। আর বাকি চারদিন ওদের কে শুধুমাত্র পানি খেতে দেওয়া হবে, আর সেটাও দিনে একবার৷ নিজেদের টয়লেটও ওদেরকে এখানেই সারতে হবে। ওরা যেহেতু মৃত্যুদন্ড পাওয়ার মতো অপরাধ করেনি সেহেতু ওদের কে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে না।

কথা টা বলেই ব্রায়ান গটগট পায়ে নিজের মাঞ্জারের দিকে চলে গেলো, আর আউটসাইডার্স আর ওয়ার্কার্স রাও ব্রায়ানের এমন সিদ্ধান্তে খুশি হয়ে যে যার জায়গায় ফিরে গেলো।

৩৮. লাইফ ট্রি থেকে প্রায় পাঁচ সাত মাইল দূরে অবস্থিত কোস্ট রেডউড গাছের জঙ্গলের ভেতরের প্রায় তিনশো ফিটের কাছাকাছি উচ্চতার একটি গাছের এক্কেবারে মাথায় উঠে বসে আছে অ্যানা৷ সেখানের একটি নরম ডালে পা ঝুলিয়ে দিয়ে বসে আছে ও। মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে যাচ্ছে গাছের উপরিভাগ জুড়ে। এখান থেকে শিরোমিদোরির চারপাশ টা খুবই মনোমুগ্ধকর লাগছে দেখতে।

বৃষ্টি এখনো টিপ টিপ করে পড়ছে। গাছ গুলো সব ভিজে পিচ্ছিল হয়ে গেছে। সমস্ত জঙ্গল জুড়ে জোনাকি রা টিপ টিপ করে জ্বলছে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা, উড়ে উড়ে এদিক সেদিক যাচ্ছে তারা। মেঘের ফাক ফোকড় দিয়ে মাঝে মাঝে মিটিমিটি করে জ্বলা তারা গুলো উকি দিচ্ছে।রাতের এখন শেষ প্রহর চলছে। আকাশে আজ চাঁদ নেই। হয়তো ডুবে গিয়েছে এতক্ষণে।

অ্যানা টিপটিপে বৃষ্টির ভেতরেই বসে আছে গাছের ডালের ওপর, চুপচাপ। দৃষ্টি ওর সামনের দিকে স্থীর, যেখানে সমুদ্রের নীল পানিতে সাদা রঙা ফেনা তুলে বড় বড় ঢেউ খেলে যাচ্ছে। বাতাসের সাথে ভেসে আসছে সমুদ্রের তর্জন গর্জন।
গায়ে ওর এখনো সেই ভিজে জামাকাপড়। হুডি টা লাইফ ট্রির কাছেই ফেলে রেখে এসেছে৷ সেটা থাকলেও এই বৃষ্টি আর শীত থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাওয়া যেত, কিন্তু অ্যানা সেটা ইচ্ছে করেই নিয়ে আসেনি। হয়তো নিজেকে কষ্ট দিতে আজ ওর খুব ভালো লাগছে৷

এমন সময় ফ্যালকন কোথা থেকে তড়িঘড়ি করে উড়ে এলো সেখানে, তারপর উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠলো,

— শেহজাদী! আপনি এখানে, আর আমি আপনাকে কোথায় কোথায় না খুজেছি! ভয়ে তো আমার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার অবস্থা হয়েছিলো।

কিন্তু ফ্যালকনের সে কথাতে অ্যানার কোনো হেলদোল হলো না, কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো ও, ফিরেও তাকালো না ফ্যালকনের দিকে। নিজের কথা শেষ করে ফ্যালকন হাফাতে হাফাতে অ্যানার পাশে থাকা একটা ছোট ডালের ওপর বসে অ্যানার দিকে তাকালো, আর তাকানো মাত্রই আঁতকে উঠলো ও৷

অ্যানার চোখ জোড়া লাল টকটকে হয়ে আছে। চেহারা টা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে পুরোপুরি, যেন রক্তশূণ্য হয়ে গেছে সে। থেকে থেকে ঠান্ডার কারণে কেঁপে কেঁপে উঠছে অ্যানা৷ আর এটা দেখেই ফ্যালকন দ্রুত সেই ছোট ডাল টা থেকে উড়ে এসে বসলো অ্যানার কাধে। আর বসা মাত্রই ও টের পেলো অ্যানার শরীরের তাপমাত্রা। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে অ্যানার। মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ করছে অ্যানা, যা এতক্ষণ ফ্যালকন শুনতে পায়নি, এখন অ্যানার কাছাকাছি এসেই সে শব্দ টা শুনতে পাচ্ছে ও৷ অ্যানা হয়তো কিছু বলতে চাইছে! এই অবস্থায় ফ্যালকন কি করবে বুঝতে পারলো না! আর অ্যানাও উঠে এসে বসেছে গাছের একেবারে মগডালে, এখান থেকে তাকে নিয়ে তার মাঞ্জারে দিয়ে আসাও তো সম্ভব না! মাটিতে হলেও একটা কথা ছিলো। বাদশাহ কে খবর দিতে যাওয়ার ও সাহস পাচ্ছে না। অ্যানার যা অবস্থা! বাদশাহ কে খবর দিতে সে এখান থেকে চলে গেলে যদি অ্যানার কিছু হয়ে যায়! তখন কি হবে!

প্রমাদ গুনলো ফ্যালকন। অজানা আতঙ্কে গলা শুকিয়ে এলো ওর৷ অ্যানার কাধ থেকে উড়ে গিয়ে অ্যানার মুখোমুখি দাড়ালো ও, ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে অ্যানা কে উদ্দেশ্য করে উদ্বেগপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,

— শেহজাদী, আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? শেহজাদী, আপনি আমার কথা শুনতে পারলে সাড়া দিন দয়া করে! শেহজাদী!

কিন্তু অ্যানার থেকে কোনো সাড়া আসলো না৷ জ্বরের ঘোরে কিছুই টের পাচ্ছে না ও৷ চোখ জোড়া ওর সামনের দিকেই নিবদ্ধ, ঠোঁট জোড়া সামান্য আলগা, সেখান থেকে ভারী, তপ্ত নিঃশ্বাস পড়ছে থেকে থেকে। ফ্যালকন কি করবে বুঝতে পারলো না, কাকে খবর দিবে ও৷ আর এখন তো কোনো প্রাণীও জেগে নেই! এত উপরে তো পাখিও বাসা বাধে না! ও কি করবে?

কিন্তু ফ্যালকনের এই ভাবনা চিন্তার মাঝেই ঘটলো একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা৷ এতক্ষন অ্যানা শক্ত হয়ে গাছের ডালের ওপর বসে থাকলেও এবার শিথিল হয়ে এলো ওর দেহ। চোখ মুখে আধার নেমে এলো ওর, আর সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে ফ্যালকন কিছু টের পাওয়ার আগেই ভিজে যাওয়া পিচ্ছিল ডালের ওপর থেকে সরে পড়ে যেতে লাগলো ও নিচে। আর সেটা টের পাওয়া মাত্রই ফ্যালকন হুড়মুড়িয়ে অ্যানাকে ধরার চেষ্টা করলো, কিন্তু সে ভুলেই গেছিলো যে সে এখন হিউম্যান ফর্মে নেই! আর তার এই উদ্ধারকার্য টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে অভিকর্ষজ টানে পৃথিবী পৃষ্টের দিকে সবেগে পতিত হতে লাগলো অ্যানা। আর এটা দেখা মাত্রই আতঙ্কে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলো ফ্যালকন! তারপর প্রচন্ড আতঙ্কে হাউমাউ করে উঠে নিজের সর্বোচ্চ গতিতে অ্যানার পেছন পেছন নিচের দিকে ছুটলো ও, যদি তার শেহজাদী মাটিতে পড়ার আগেই সেখানে পৌছে তার শেহজাদী কে সে ধরতে পারে!

কিন্তু ফ্যালকনের আগেই অ্যানা ভূপৃষ্ঠে পতিত হওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে ঝড়ের গতিতে কেউ উড়ে এসে নিজের পেশিবহুল বাহুডোরে আগলে নিলো জ্বরের ঘোরে জ্ঞান হারানো অ্যানা কে৷

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here