#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_১১
#আ_মি_না
খানিক টা পথ যাওয়ার পর হঠাৎ করেই নিজেদের পেছন থেকে শার্লটের কন্ঠ কানে এলো ওদের দুজনের৷ দুজনেই পেছন ফিরে তাকালো। শার্লট ওদের দিকে ছুটছে আর চিৎকার করে বলছে ওর জন্য অপেক্ষা করতে। অ্যানা আর জুলিয়া দুজন দুজনের দিকে এক পলক তাকিয়ে শার্লটের জন্য থামলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই শার্লট পৌছালো ওদের নিকট তারপর ভারী দম ফেলতে ফেলতে অ্যানা কে উদ্দেশ্য করে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
— তোরা আমাকে রেখে জঙ্গলে যাচ্ছিস কেন? আমি তোদের কতদিন বলেছি যে জঙ্গল দেখার আমার কতো শখ! আর তোদের আমার কথাই মনে নেই! স্বার্থপরের মতো আমাকে রেখে চলে যাচ্ছিস! যত্তসব!
কথাটা বলেই শার্লট গটগট পায়ে ওদের আগে আগে হাটতে লাগলো জঙ্গলের দিকে। শার্লটের এমন কান্ড দেখে হেসে ফেললো জুলিয়া, আর অ্যানা স্মিত হেসে চলল ওর পেছন পেছন।
|
|
|
১৮. হাটতে হাটতে অ্যানারা রাজপথের প্রায় কাছাকাছি এসে গেলো। আরও কিছুক্ষণ হাটার পর দূর থেকে রাজপথ টা দৃষ্টি গোচর হলো ওদের। জঙ্গলের সেইফ জোনের কিনারা ঘেঁষে লাইমস্টোনের দুই লেনের রাস্তা৷ চওড়ায় প্রায় ছাব্বিশ ফুট এই রাস্তা টি প্রাসাদের সামনে থেকে শুরু হয়ে চলে গেছে পঞ্চদ্বীপের অন্যান্য দ্বীপ গুলোতে যাওয়ার রাস্তার দিকে৷ কিন্তু বিশেষ এক প্রযুক্তির প্রয়োগের কারণে কিছুদূর যাওয়ার পর সে রাজপথ টা সাধারণ মানুষের আর দৃষ্টি গোচর হয় না, সেটাকে দেখার জন্য বিশেষ ধরণের একটি ডিভাইসের প্রয়োজন হয় যেটা শুধু রাজ পরিবারের সদস্য আর নির্দিষ্ট কিছু রাজ কর্মচারীদের নিকটেই বিদ্যমান৷
অ্যানা সবার আগে আগে হেটে চলেছে৷ হুডির পকেটে ওর লিন্ডা, ছোট্ট মাথা টা বের করে দিয়ে মালিকের সাথে ঘুরছে ও। আশেপাশের পরিবেশ দেখছে চুপচাপ, কোনো টু শব্দটি করছে না৷ অ্যানার পেছনে জুলিয়া আর তার পেছন পেছন শার্লট।
এতখানি রাস্তা হেটে শার্লট হাপিয়ে উঠেছে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে ওর। জুলিয়াও ক্লান্ত হয়ে গেছে কিন্তু অ্যানার সামনে সেটা প্রকাশ করছে না, কারণ অ্যানা কোনো ক্লান্তি ছাড়াই পুরোদমে হেটে চলেছে সামনের দিকে; তার নিঃশ্বাসের গতিতেও কোনো তারতম্য হয়নি এখনো। অ্যানার এমন অ্যানার্জি দেখে জুলিয়া পুরাই অবাক।
রাজপথের কাছে পৌছে শার্লট থেমে গেলো। রাজপথের দুপাশে লাগানো হরেক রঙা, খুব সুন্দর করে কেটে ছেটে একই আকারের করে রাখা ফুলের গাছের প্রতিটার মাঝে একটা একটা করে স্টোন ব্লক বসানো৷ সেটারই একটাতে গিয়ে বসে পড়লো শার্লট, তারপর ক্লান্ত গলায় অ্যানা কে বলল,
— আমি আর পারছিনা। আমি এখানে একটু বসছি। তোরাও চাইলে বস। দু মিনিট পরেই উঠে যাবো।
রাজপথের ওপরে উঠে পড়া অ্যানা পেছন ফিরে শার্লটের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকালো, তারপর বলল,
— আর বেশি দূর নেই। আমাদের দ্রুত ফিরতে হবে, নইলে লাঠি বুড়ি আরও অসুস্থ হয়ে যাবেন।
জুলিয়াও অ্যানার কথাতে সম্মতি জানিয়ে শার্লট কে রাজপথের ওপাশ টা দেখিয়ে বলল,
—ওই তো সামনেই নীল রঙের কাটাতার দেখা যাচ্ছে ওইটা সেইফ জোনের সাধারণ বলয়, ব্লু জোন। ওইটা পার হওয়া যাবে কিন্তু পার না হওয়াই উত্তম, আর তার থেকে কিছু টা সামনে গেলে লাল রঙের কাটা তারের বলয়, যেটাকে বলা হয় রেড জোন, সেইটা পার করা সম্পুর্ন নিষিদ্ধ। সেইফ জোন ছাড়া বাকি সমস্ত জঙ্গল টা রেড জোনের ভেতরে।
জুলিয়ার কথাতে রাজপথের ও পাশের রেড জোনের দিকে তাকিয়ে ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে অ্যানা বলে উঠলো,
— আশা করি ব্লু জোনের ভেতরেই লতাটা আমরা পেয়ে যাবো। আর যদি না পাই তবে রেড জোন পার হয়েই নিয়ে আসতে হবে৷
অ্যানার কথা শুনে জুলিয়া ফুসে উঠে ঝাঝালো গলায় বলে উঠলো,
— কখনোই সম্ভব নয়, কোনো মতেই রেড জোনের ওই কাটাতার পার হওয়া যাবে না৷ প্রাসাদ থেকে স্পষ্ট বারণ করে দিয়ে গেছে যে কোনো ভাবেই যেন কেউ সেইফ জোনের বাইরে না যায়! আমি তো যাবোই না। তোমার যদি যেতে ইচ্ছা হয় তুমি যাও৷ আমার নিজের জানের মায়া আছে বাপু!
জুলিয়ার কথা শেষ হতে না হতেই রাজ পথের প্রাসাদ গামী দিক থেকে গাড়ির হর্নের শব্দ ভেসে এলো। তিনজনেই তাকালো ওরা শব্দের উৎসের দিকে, আর কিয়ৎক্ষণের ভেতরেই দৃষ্টি গোচর হলো ঝড়ের গতিতে এগোনো পাঁচ খানা বিলাসবহুল গাড়ি, যার সামনের টা পুরোপুরি কালো, মিশমিশে কালো রঙা। আর তার পেছনের সারিবদ্ধ চার খানা গাড়িই ঝকঝকা সাদা রঙা। গাড়ি গুলো একই লেন দিয়ে একই গতিতে একটার পিছে অন্যটা সারিবদ্ধ ভাবে এগোচ্ছে। আর সেটা দেখেই জুলিয়া রাজপথের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা অ্যানা কে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
— অ্যানা, জলদি নেমে আসো ওখান থেকে!
জুলিয়ার বলার সাথে সাথেই রাস্তার ওপর থেকে দ্রুত গতিতে নেমে জুলিয়া আর শার্লটের কাছে এসে দাড়ালো অ্যানা। কিন্তু গাড়িগুলো ওদের কাছাকাছি আসতেই সেগুলোর ঝড়ো গতি কমে এলো, ধীর গতিতে এগোতে শুরু করলো সেগুলো। জুলিয়া তখন অ্যানা আর শার্লট কে তাগাদা দিয়ে বলল,
— শার্লট উঠে দাড়াও এখনি, আর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জলদি মাথা নিচু করো৷ ওনারা পঞ্চদ্বীপের কন্ট্রোলার৷ শিগগিরই!
জুলিয়ার কথা শেষ হতেই লাফ দিয়ে উঠে দাড়ালো শার্লট, তারপর জুলিয়ার কথা মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো তারা তিনজনেই৷
গাড়ি গুলো ওদের একেবারেই কাছে যখন এলো তখন সামনে থাকা কালো রঙা গাড়িটির পেছনের সিটের জানালার কাঁচটা নেমে যেতে থাকলো ধীরে ধীরে, আর সে জানালার ভেতর দিয়ে রাজপথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তিন মানবীর ভেতরকার সবচেয়ে বেশি উচ্চতার মেয়েটির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো গাড়িটির পেছনের সিটে বসা জ্বলজ্বলে সোনালি রঙা চোখের সেই ব্যাক্তিটি।
আর নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দ্বারা সেই চিরচেনা ব্যাক্তিটির উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই নিজের নত চোখ জোড়া আরও নিচে নামিয়ে নিজের মুখ খানা ঘুরিয়ে বা দিকে নিলো অ্যানা। আর সে দৃশ্য অবলোকন করে ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসি ফুটে উঠলো আগুন চোখের পুরুষ টির।
এই তিন মানবিকে অতিক্রম করেই কালো রঙা গাড়িটির পেছনের সিটের জানালার গ্লাস উঠে গেলো, আর রাস্তার পাশে দাঁড়ানো অ্যানা এতক্ষন ধরে নিজের আটকে রাখা দম টা ছেড়ে দিলো! যেন সে নিঃশ্বাস নিলেই কিছু একটা হয়ে যেতো সেখানে৷
গাড়ি গুলো ওদের কে অতিক্রম করে চলে যাওয়ার সাথে সাথেই শার্লট রাজপথের উপরে দৌড়ে এসে গাড়ি গুলোকে আর এক নজর দেখার চেষ্টা করতে করতে উচ্ছসিত কন্ঠে জুলিয়া কে জিজ্ঞেস করলো,
— এনারাই তাহলে সেই কন্ট্রোলার! কিমালেবে থাকতে কতই না শুনেছি কন্ট্রোলারের কথা! আমাদের ওখানের কন্ট্রোলার ছিলেন জায়ান সাদি। ওনাকে দেখার আমার যে কত শখ ছিলো তা বলার মতো না! আর আজ উনি আমার এত কাছ দিয়ে চলে গেলেন! ইশ, ভাবতেই গায়ে কাটা দিচ্ছে!
শেষোক্ত কথা টা নিজের চোখ মুখ কুচকে, দু হাতে নিজের বাহু ঘষে বলল শার্লট। শার্লটের কথার উত্তরে জুলিয়া গাড়ি গুলোর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আনমনে বলল,
— হ্যা, এনারাই সেই কন্ট্রোলার। শিরোমিদোরি ব্যাতিত পঞ্চদ্বীপের চার দ্বীপের জন্য চার জন কন্ট্রোলার, এবং এনারা সব কজনই কোনো না কোনো ভাবে দেমিয়ান বংশের রক্তের সাথে সম্পর্কিত। রক্তের বাইরে তারা কাউকে কোনো ধরনের ক্ষমতা দেন না। যদিও কন্ট্রোলার রা কেউই দেমিয়ান বংশের নন। দেমিয়ান বংশের রীতি অনুযায়ী বাদশাহ আর বাদশাহর সন্তানেরা ছাড়া অন্য কোনো দেমিয়ান বংশের পুরুষ প্রাসাদে থাকতে পারে না৷ তাদের কে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হয়, নয়তো মেরে ফেলা হয়! আমি যদিও সঠিক টা জানিনা৷
জুলিয়ার কথা শেষ হলে শার্লট আবার কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কিন্তু কন্ট্রোলার তো চার জন, গাড়ি তো পাঁচ খানা!
শার্লটের প্রশ্নে জুলিয়া শার্লটের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,
— একটু মাথা খাটিয়েও তো বের করতে পারো! পঞ্চম জন বাদশাহ নিজেই। বাদশাহ ছাড়া অমন বিলাশবহুল গাড়িতে আর কে উঠবে! গাড়ি গুলোর চেহারা দেখেছো! তোমার শরীরের সব পার্টস পাতি বিক্রি করলেও অমন একখান গাড়ি কিনতে পারবে না। ওই ধরনের গাড়ি শুধুমাত্র রাজপরিবারের মানুষই ব্যাবহার করে৷ এগুলো কমনসেন্স।
এরপর শার্লটের দিকে তাকিয়ে জুলিয়া ভাব নিয়ে ভ্রু তুলে মাথা উঁচু করে বলল,
— আমি এখানে দশ বছর ধরে আছি! এখানের সব খবর আমার জানা৷ তোমাদের থেকে বয়সে, জ্ঞানে আর বুদ্ধিতে ও আমি অনেক উপরে, তাই আমাকে সম্মান দিয়ে চলবে।
এ কথা বলেই জুলিয়া গর্বে বুক ফুলিয়ে অ্যানা আর শার্লট কে পাশ কাটিয়ে রাজপথ অতিক্রম করে ওপাশের জঙ্গলের দিকে এগোলো। আর শার্লট হতবাক হয়ে জুলিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো!
সত্যিই বাদশাহ গেলেন তাদের সামনে দিয়ে! ওই সবার সামনের মিশমিশে কালো গাড়িখানাই কি তবে বাদশাহর! ওয়াহ! কত কি দেখে ফেললো ও আজকে! এসব ভেবে শার্লট অ্যানার দিকে তাকালো।
বাদশাহর গাড়ি খানাকে এত কাছ থেকে দেখে অ্যানার অনুভুতি কেমন সেটা একবার অ্যানা কে জিজ্ঞেস করতে মন চাইলো ওর। কিন্তু গুরুগম্ভীর অ্যানা কে আরও চুপচাপ দেখে সেটা আর জিজ্ঞেস করতে ওর সাহসে কুলালো না। তাই শার্লট এবার অ্যানার থেকে চোখ সরিয়ে নিজের মনের আনন্দে ঠোঁট টিপে হেসে জুলিয়ার পেছন পেছন নাচতে নাচতে এগোতে এগোতে বলল,
— ইয়ে, আজ সবাইকে গিয়ে গল্প দেওয়া যাবে যে আমরা কন্ট্রোলার আর বাদশাহ কে দেখেছি! হিহি!
.
ওরা রাজপথের ওপাশে যেতেই অ্যানার পকেটে এতক্ষণ আরাম করে বসে থাকা লিন্ডা হঠাৎ করেই ফোস করে উঠে এলোমেলো চোখে চারদিকে তাকাতে শুরু করলো৷ ওর সে দৃষ্টিতে স্পষ্ট ফুটে উঠলো অদ্ভুত এক ভীতি! ছোট্ট তুলতুলে হাতের থাবার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ধারালো নখের অগ্রভাগ, পিঠের শিরদাঁড়া ফুলে উঠে গায়ের পশম গুলো খাড়া হয়ে গেলো তার।
আর সামনে থাকা নীল রঙা কাটাতারের দিকে আগানো অ্যানার প্রতিটা কদমের সাথে সাথে লিন্ডার ভীতি আর ফোসফোসানি দুইটাই বেড়ে যেতে লাগলো ক্রমে ক্রমে।
অ্যানা সেটা খেয়াল করে নিজের ডান হাত খানা পকেটে ঢুকিয়ে লিন্ডার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চাপা সুরে লিন্ডার উদ্দেশ্যে বলল,
— ডোন্ট ওয়্যারি লিন্ডা, এই অ্যানা থাকতে তোমার গায়ে একটা আচড়ও লাগবে না৷
এরপর আবার হাটতে হাটতে নীল কাটাতার টা পার হয়ে অপর পাশে গেলো ওরা তিনজন। অ্যানা তার সাথে থাকা জুলিয়া আর শার্লট কে বলল ডান দিকে যেতে আর ও নিজে গেলো বা দিকে। লতা টা খুজে পাওয়া মাত্রই যেন শার্লট অ্যানার রিস্টওয়াচে মেসেজ দেয় সেটা ভালোভাবে শার্লট কে বলে দিলো অ্যানা৷ তারপর লতা টা খুজতে যে যার নির্ধারিত দিকে চলে গেলো।
.
জুলিয়া আর শার্লট হেটে চলেছে ডান দিকে, রেড জোনের গা ঘেঁষে। শার্লটের গায়ে মাঝে মাঝেই কাটা দিচ্ছে। মোটেই ভালো অনুভূতি হচ্ছে না ওর, কেমন যেন একটা গা ছমছমে ভাব জাগছে৷ যেন কেউ ওই রেড জোনের ওপাশের জঙ্গল থেকে ওদের কে দেখছে৷ ভীতি পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার রেড জোনের ওপাশের জঙ্গলের দিকে তাকালো শার্লট।
রেড জোনের ওপাশ থেকে জঙ্গল টা ঘন থেকে অধিকতর ঘন হতে হতে ভেতরের দিকে চলে গেছে! জঙ্গল টা কেমন যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন, কুয়াশায় ঘেরা ভুতুড়ে পরিবেশ! একবার ওই জঙ্গলে গিয়ে কারো পথভ্রম হলে আর হয়তো কখনো নিজে নিজে রাস্তা চিনে ফিরে আসতে পারবে না! নির্ঘাত জঙ্গলে থাকা হিংস্র প্রাণীর হাতে মৃত্যুবরণ করবে সে বেচারা। শুকনো একটা ঢোক গিলে রেড জোনে থেকে চোখ সরিয়ে শার্লট তার পাশে থাকা জুলিয়ার কাছাকাছি গিয়ে ওর গা ঘেঁষে হাটতে শুরু করলো।
শার্লটের এমন ভয় টের পেলো জুলিয়া, সে হেসে বলল,
— ভয় পাচ্ছো? আরে ভয়ের কিছুই নেই। রেড জোনের ও পাশ থেকে কিছুই এদিকে আসতে পারবে না। ভয় পেয়ো না।
কথা টা বলে শার্লটের পিঠের ওপর একটা চাপড় দিলো জুলিয়া৷ তারপর আবার হেটে সামনে যেতে শুরু করলো।
কিছুদূর হাটার পর অ্যানা আর ফাতমার দেওয়া বিবরণ অনুযায়ী কয়েকটা কোল্টসফুটের লতা পেয়েও গেলো ওরা৷ তারপর সেগুলো মাটি থেকে তুলে অ্যানা কে মেসেজ দেওয়ার জন্য শার্লট নিজের বা হাতের কব্জি তে থাকা রিস্টওয়াচ টা ওপেন করলো,
ঠিক তখনই পাশ থেকে জুলিয়া শার্লট কে গুতা মেরে ডেকে বলল,
— ওইটা অ্যানা না?
জুলিয়ার গুতা খেয়ে শার্লট রিস্টওয়াচের থেকে চোখ সরিয়ে জুলিয়ার দিকে তাকালো। জুলিয়া তাকিয়ে আছে রেড জোনের ওপাশের জঙ্গলের দিকে৷ জুলিয়ার সে দৃষ্টি অনুসরণ করে শার্লটও তাকালো সেদিকে। হ্যা, অ্যানাই তো! কিন্তু ও রেড জোনের ভেতরে ঢুকেছে কোন আক্কেলে!
শার্লট ভীতসন্ত্রস্ত চোখে একবার তাকালো জুলিয়ার দিকে। তারপর আবার রেড জোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— অ্যানা কোন বুদ্ধিতে রেড জোনের ভেতর গেলো বলতো! ওকে ডাকো এক্ষুনি! বেরিয়ে আসতে বলো ওখান থেকে৷ কখন কই থেকে কোন নেকড়ে ভাল্লুক চলে আসে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই!
শেষোক্ত কথা টা শার্লট রেড জোনের ভেতরের জঙ্গলের চার পাশের দিকে একবার নজর বুলিয়ে বলল। শার্লটের কথা শুনে জুলিয়া অ্যানা কে ডাকতে নিলো৷ এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে, লাঠি বুড়ির ওদিকে কি অবস্থা কে জানে! ফাতমা এর মাঝে শার্লট কে একবার মেসেজও দিয়েছে দ্রুত ফিরে যাওয়ার জন্য! আর এই মেয়েটা এখন রেড জোনে ঢুকেছে! এখন যদি ওর কিছু হয়ে যায়! তাহলে কি জবাব দিবে ও ফিরে গিয়ে? সে তো অ্যানা, শার্লট দুজনেরই সিনিয়র! যতোই তারা ওয়ার্কার্স, আর সে আউটসাইডার্স হোক না কেন, সে তো এই মুহুর্তে তাদের অভিভাবক। জুলিয়া অ্যানা কে গলা ছেড়ে ডাকতে নিবে ঠিক তখনই ওদের পেছন থেকে অ্যানা এসে বলে উঠলো,
— ভুলেও ওকে আমার নাম ধরে ডেকোনা জুলিয়া। ওইটা আমি নই৷
হঠাৎ করে নিজের পেছনে অ্যানার কন্ঠস্বর শুনে চমকে লাফিয়ে উঠলো শার্লট আর জুলিয়া দুজনেই। এরপর পেছনে ফিরে তাকিয়ে অ্যানা কে দেখে তাদের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেলো৷ তাদের সামনে অ্যানা দাঁড়িয়ে তাহলে রেড জোনের ভেতরে ওইটা কে? অ্যানার মতোই লম্বা, অ্যানার মতোই পোশাক, অ্যানার মতোই হাটাচলা! ওই টা কি তাহলে? জুলিয়া একবার রেড জোনের ভেতরে থাকা অ্যানার সদৃশ অবয়ব আর একবার তার সামনে দাঁড়ানো অ্যানার দিকে তাকালো, তারপর বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞেস করলো,
— তুমি অ্যানা, তাহলে ও কে?
রেড জোনের ভেতরে থাকা অ্যানা সদৃশ অবয়ব টার দিকে নির্দেশ করে বলল জুলিয়া। অ্যানা সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল,
— ওটা একটা ঘেউল, সম্ভবত অনেক ক্ষন ধরেই তোমাদের পিছু নিচ্ছে, আর আমার বেশ ধরেছে। যেকোনো ভাবে একজন কে ফুসলিয়ে রেড জোনের ভেতরে নিতে পারলেই শেষ। জিবন্ত কামড়ে খেয়ে ফেলবে!
অ্যানার কথা শুনে শার্লট আর জুলিয়া দুজনেই আঁতকে উঠলো। ঘেউল! তার মানে এ জঙ্গলে শুধু বাঘ ভাল্লুক থাকে না, ঘেউল ও আছে! অ্যানা তখনও সে অবয়বটির দিক থেকে চোখ সরায় নি, অবয়ব টির পেছন দিক টা দেখা যাচ্ছে, যেটা অবিকল অ্যানার মতো। অ্যানার মতো করে হাটছে, মাঝে মাঝে ঝুকে পড়ে মাটি থেকে কিছু একটা তুলছে তারপর আবার সোজা হয়ে হাটছে!
অ্যানা কে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শার্লট আর জুলিয়াও আবার ভয়ে ভয়ে তাকালো সে অবয়ব টার দিকে। আর ঠিক সেই মুহুর্তেই অবয়ব টি পেছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ওদের দিকে, আর অবয়বটি তাকাতেই আত্মা কেঁপে গেলো শার্লট আর জুলিয়ার!
অবয়ব টির মুখে চামড়ার কোনো ছিটেফোঁটাও নেই! চোখের কোটর থেকে লাল রঙা চোখ জোড়া অর্ধেকের বেশি বের হয়ে আছে, দাঁতের ওপর চামড়ার কোনো আবরণ না থাকায় সেটা দেখতে ভয়ঙ্কর রকমের বিদঘুটে লাগছে! চামড়া বিহীন মুখের সে মাংসের ভেতর থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে৷
সমস্ত মুখে রক্ত মাখা সে ঘেউল টি ওদের দিকে তাকিয়ে নিজের মুখ থেকে অদ্ভুত এক হাড়হিম করা শব্দ করলো, আর সে শব্দ টা শুনে শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে এলো শার্লট আর জুলিয়ার!
আর পরমুহুর্তেই ওদের সে ভয় টাকে আরও বাড়িয়ে দিয়ে ঘেউল টা ঝড়ের গতিতে জঙ্গলের ভেতর থেকে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো! আর সেটা দেখা মাত্রই শার্লট আর জুলিয়া ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে, অ্যানা কিছু বুঝে ওঠার আগেই অ্যানার হাত টা দুজনে দুই পাশ থেকে ধরে উর্ধশ্বাসে ছুটে পালিয়ে এলো ব্লু জোনের এপাশে। আর তারপর এক ছুটে রাজপথে এসে দাড়ালো ওরা তিনজনেই।
রাজপথে পৌছেই লাইম স্টোনের ওপর হুড়মুড়িয়ে বসে পড়লো শার্লট আর জুলিয়া। বসেই জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো ওরা দুজনেই। শার্লট জুলিয়ার দিকে তাকিয়ে হাফাতে হাফাতে বলল,
— বড় বাঁচা বেঁচে গেছি! প্রাণ থাকতে আর এমুখো হবো না আমি! জঙ্গল দেখার স্বাদ আমার এ জন্মের মতো মিটে গেছে!
জুলিয়া শার্লটের কথার উত্তরে কিছুই বলল না, এক পলক শার্লটের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে সে পথের ওপর নিজের ক্লান্ত শরীর টা এলিয়ে দিলো।
কিন্তু অ্যানা ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো রাজপথের ওপর! চোখ জোড়া ওর রেড জোনের দিকে, আর হাত টা নিজের হুডির ডান পাশের পকেটে!
রেড জোনের দিকে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকানো অ্যানার মুখ থেকে এই মুহুর্তে শুধু একটা শব্দই বের হলো,
— লিন্ডা!!
|
|
|
|
১৯. সাদা রঙা মার্বেল পাথরের সুউচ্চ প্রাসাদটির তৃতীয় তলায় একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত কামরায় স্ট্রেচারে আধশোয়া করে বসিয়ে রাখা হয়েছে রুথ কে। তার আশে পাশে ঘুর ঘুর করছে সাদা রঙা অ্যাপ্রোন পরিহিতা বেশ কয়েকজন নারী, যাদের চোখে সাদা রঙা স্বচ্ছ গগলস, আর মুখে ক্লিনিক্যাল মাস্ক।
তাদের ভেতরের একজন রুথের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কয়েকটা লিকুইড একসাথে মেশাচ্ছে, তার হাতের কাছে একটা নতুন সিরিঞ্জ। রুথ সেদিকে তাকিয়েই বুঝলো যে এটা তাকে দেওয়ার উদ্দ্যেশ্যেই তৈরি করা হচ্ছে।
অন্য কয়েকজন মেয়ে মিলে একসাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছে কিন্তু সেটা রুথের থেকে কিছুটা দূরে হওয়ায় রুথ ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছে না তাদের৷
আর অন্য মেয়েটি রুথের স্ট্রেচারের পায়ের দিক টাতে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে হাওয়ায় ভেসে ওঠা একটি কম্পিউটার স্ক্রিনে হাত দিয়ে স্পর্শ করে কি সমস্ত কাজ করছে যার কিছুই রুথের মাথায় আসছে না। সে চারদিকে চোখ বুলিয়ে শুধু ভাবছে এদের প্রযুক্তি এত উন্নত কিভাবে হলো!
কাল মাঝরাতের পর প্রাসাদে এসে পৌছেছে সে। রাত টা ওকে থাকতে দেওয়া হয়েছিলো অদ্ভুত সুন্দর এক কামরায়, যার মেঝে আর দেওয়াল ছিলো অসম্ভব রকম সুন্দর আর মোলায়েম কার্পেট দিয়ে ঢাকা। কামরাটির সিলিঙে নিজের প্রভাব বিস্তার করে সদর্পে ঝুলছিলো বিশালাকার একটি স্ফটিকের ঝাড়বাতি, যার আলোতে আলোকিত হয়ে উঠছিলো কামরাটির প্রতিটা কোণা।
কামরা টাতে ও যখন ঢুকেছিলো তখন মনে হচ্ছিলো যেন কোনো এক স্বর্গপুরী তে ঢুকেছে ও! নিশ্চুপ শান্তিতে চোখ জোড়া যেন লেগে আসছিলো ওর!
আর এরপর কামরার এক কোণায় থাকা বিছানার ওপর গিয়ে ক্লান্ত দেহটা রাখতেই ঘুমে ঢোলে পড়ে ও। কামরা টা ভালো করে দেখারও সুযোগ হয়নি ওর আর। ভেবেছিলো সকালে দেখবে! কিন্তু ঘুম থেকে উঠেই সে নিজেকে আবিষ্কার করেছে এই সাদা রঙা কামরাটার সাদা অ্যাপ্রোন পরিহিতা নারী গুলোর মাঝখানে৷
রুথের এসব ভাবনা চিন্তার মাঝেই এতক্ষণ ধরে লিকুইড মিক্স করা মেয়েটি হঠাৎ করেই নিজের পাশে থাকা সিরিঞ্জ টা হাতে উঠিয়ে নিয়ে চলে এলো রুথের পাশে। তারপর সে লিকুইড টা সিরিঞ্জে ঢুকাতে শুরু করলো।
তাকে কিসের জন্য ইঞ্জেকশন দেওয়া হচ্ছে সেটা নিয়ে রুথ চিন্তিত হলো অনেক৷ মনে মনে একবার ভাবলো জিজ্ঞেস করবে তার কি হয়েছে বা কেন তাকে ইঞ্জেকশন পুশ করা হবে, কিন্তু সাহস হলো না! প্রাসাদের মানুষ এরা, এদের কে প্রশ্ন করা ঠিক হবে না হয়তো! কিন্তু যেই মুহুর্তে মেয়েটি রুথের শরীরে ইঞ্জেকশন টি পুশ করতে যাবে ঠিক তখনই না চাইতেও রুথের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো
— আমাকে ইঞ্জেকশন কেন দেওয়া হচ্ছে? আমার কি হয়েছে?
ইঞ্জেকশন পুশরত মেয়েটির হাত থেমে গেলো সাথে সাথেই। সে রুথের হাতের ইঞ্জেকশন পুশ করার স্থানটিতে তাকিয়ে ছিলো, ঠিক সেই অবস্থাতেই রুথের বাহুর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে রুথের চোখের দিকে তাকালো সে, কিন্তু মাথা উঁচু করলো না! তীর্যক চোখে তাকিয়ে রইলো মেয়েটি।
মেয়েটির এমন দৃষ্টি দেখে রুথ ভয় পেলো! সে কি ভুল কিছু বলে ফেললো! এখন কি তার শাস্তি হবে? শুকনো একটা ঢোক গিললো রুথ৷ ইঞ্জেকশন পুশ কারী মেয়েটি নিজের চোখ জোড়া আবার নামিয়ে রুথের বাহুতে রাখলো, তারপর শক্ত গলায় বলল,
— সামান্য একজন দাসী হয়ে প্রাসাদের এমপ্লয়ি দের প্রশ্ন করার সাহস কোথায় পাও? তুমি নতুন তাই তোমাকে ছেড়ে দিলাম এবারের মতো! পরবর্তীতে কোনো এমপ্লয়ি কে কোনো ধরণের প্রশ্ন করলে সাথে সাথেই কঠোর শাস্তি পেতে হবে, বিষয় টা মাথায় রেখো৷
কথা টা শেষ করেই মেয়েটি রুথের বাহুতে ইঞ্জেকশনটা পুশ করে দিলো৷ ইঞ্জেকশন টা পুশ করার সাথে সাথেই রুথের ঘুম ঘুম অনুভত হলো প্রচন্ড! চোখ জোড়া ওর বুজে আসতে লাগলো। ঠিক সে সময়েই মেয়েটি বলে উঠলো,
— তোমার শরীর দেমিয়ান বংশের পুরুষদের কে সহ্য করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালি কিনা, আর তাদের সন্তান ধারণের জন্য উপযুক্ত কিনা সেটাই পরীক্ষা করা হবে। এখন শান্তিতে ঘুমাও।
মেয়েটির কথা শেষ হতে না হতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো রুথ।
চলবে…….