#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_১২
#আ_মি_না
২০. লাইব্রেরি এরিয়ার একটা টেবিলের ডান দিকের পায়া টা ঘূণে ধরেছে। ব্রায়ান নতুন একটা পায়া কই থেকে জোগাড় করে নিয়ে এসে হাতুড়ি পেরেক দিয়ে সেই টেবিল টা মেরামত করছিলো। শার্লট রা এখনো ফেরেনি, লাঠি বুড়ির অবস্থা বেশি ভালো না৷ ফাতমা ইতোমধ্যে দু বার লোক পাঠিয়ে খবর নিয়ে গেছে ওরা এসেছে কিনা, কিন্তু ওদের কোনো খোজ নেই৷ কিছুক্ষণ আগে ব্রায়ান মেসেজ দিয়েছে শার্লটের রিস্টওয়াচে, কিন্তু কোনো অনিবার্য কারণ বসত সেটা সেন্ড হয়নি৷ চিন্তিত মনে ব্রায়ান টেবিলের পায়া টা মেরামত করতে করতে এসব ব্যাপারেই ভাবছিলো।
ঠিক এমন সময়ে রাজপথের দিকে যাওয়ার রাস্তার দিক থেকে মিটিং জোনের দিকে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে চিৎকার করতে করতে উর্ধশ্বাসে ছুটে আসতে লাগলো শার্লট আর জুলিয়া। হাতে ওদের কোল্টসফুটের লতা, চোখে পানি আর ভয়! ওদের কে এইভাবে ছুটে আসতে দেখে ওয়ার্কিং জোনে কর্মরত অন্যান্য ওয়ার্কার্স রা ভয় পেয়ে গেলো! নিজেদের কাজ থামিয়ে ওরা শার্লট আর জুলিয়ার জাছে ছুটে গেলো! মনের ভেতরটা ওদের শঙ্কিত, কারো কিছু হলো না তো আবার!
দূর থেকে শার্লটের চিৎকার কানে আসতেই ব্রায়ান নিজের হাতের কাজ রেখে ফিরে তাকালো মিটিং জোনের প্রবেশ দ্বারের দিকে। আর সেদিকে তাকিয়ে শার্লট কে এমন বিধস্ত অবস্থায় চিৎকার করে কান্না করতে করতে ছুটে আসতে দেখে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো ওর! সবার প্রথমে যে বাক্য টা ওর মস্তিষ্কে নাড়া দিলো সেটা হলো ‘অ্যানা কই!’
হাত থেকে হাতুড়ি টা মাটিতে ছুড়ে ফেলে মিটিং জোন থেকে এক প্রকার দৌড়ে বেরিয়ে এলো ব্রায়ান। তারপর শার্লটের কাছে ছুটে এসে ওকে দু হাতে আকড়ে ধরে আতঙ্কিত গলায় বলল,
— কি হয়েছে, তুই এভাবে কাদছিস কেন? আর অ্যানা কই? ওকে দেখছিনা কেন?
পাশে থাকা জুলিয়া অসহায় চোখে তাকালো ব্রায়ানের দিকে, তারপর ফুপিয়ে কেদে উঠলো ও৷ আর সেই মুহুর্তেই ব্রায়ানের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কেদে উঠে শার্লট বলল,
— অ্যানা রেড জোনের ভেতরে চলে গেছে ভাইয়া! ওইখানে একটা ঘেউল ছিলো! অ্যানার এখন কি অবস্থা সেটা হয়তো শুধু জেইসাস ই জানেন! আমরা ওকে আটকাতে পারিনি! লিন্ডাকে খুজতে ও লিন্ডার পেছন পেছন রেড জোনে ঢুকে গেছে! আর আমাদের কে পাঠিয়ে দিয়েছে কোল্টসফুটের লতা নিয়ে চলে আসার জন্য। তোমাকে মেসেজ দিলাম কতো গুলো, একটাও সেন্ড হলো না! তাই বাধ্য হয়ে চলে এসেছি আমরা!
বলতে বলতে শার্লট হাউমাউ করে কেদে উঠলো। আর শার্লটের কথা শুনে ব্রায়ানের আত্মাটা যেন উড়ে গেলো! অ্যানা রেড জোনে ঢুকেছে! সমস্ত রকমের হিংস্র পশু পাখিদের বসবাস ওই রেড জোনে। আর শার্লট বলল ঘেউলের কথা! সেখানে যদি ঘেউল থাকতে পারে তবে আরও না জানি কি কি আছে!
আর এক টা সেকেন্ডও সময় নষ্ট করলো না ব্রায়ান। শার্লটের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই শার্লট কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে এক প্রকার ছুড়ে ফেলে দিয়ে ছুট লাগালো ও রাজপথের ওদিকে৷ আর শার্লট মাটিতে পড়ে অশ্রুসিক্ত চোখে ব্রায়ানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো, আর্তনাদের পরিমাণ আরও বেড়ে গেলো ওর!
ওয়ার্কার্স দের ভেতরে চাপা আতঙ্ক দেখা দিলো! অ্যানার এবার কি হবে! ওই রেড জোনে নাকি শার্লট রা ঘেউল দেখেছে, তারমানে শুধু জঙলি জানোয়ারের আড্ডাখানাই নয় সেখানে; আরও বহুত কিছু আছে! অ্যানার ওপর দিয়ে এই মুহুর্তে কি চলতে পারে সেটা ভেবেই ওয়ার্কার্স দের কেউ কেউ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নিজেদের মুখে হাত চাপা দিলো! কি হবে এবার!
রেড জোন, যেটা প্রত্যেকটা ওয়ার্কার্স আর আউটসাইডার্স দের কাছে একটি আতঙ্কের নাম, যে এরিয়া টাকে ওরা সদা সর্বদা ভয় পেয়ে এসেছে, যেখানে যেতে প্রাসাদ থেকে বার বার করে নিষেধ করে দিয়েছে, সেখানেই আজ দুর্ভাগ্যজনক ভাবে অ্যানা পৌছে গেছে! তাহলে সাধারণ মানুষের জন্য রেড জোন নিষিদ্ধ হওয়ার কারণটা শুধু মাত্র জঙলি জানোয়ার নয়! এর পেছনে আরও অনেক কিছুই আছে!
আতঙ্কিত হয়ে, নিজেদের একজন অতি প্রিয় সঙ্গী হারানোর ভয়ে ওয়ার্কার্স দের ভেতরে শোকের গুঞ্জনের সৃষ্টি হলো! কাজে ভাটা পড়লো সবার।
মাটিতে পড়ে নিজের কলিজার বান্ধবী আর প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের জন্য আর্তনাদরত শার্লট কে ঘিরে দাঁড়িয়ে স্বান্তনা দিতে থাকলো অনেকে, আর চোখ লাগিয়ে রাখলো রাজ পথে দিকে যাওয়ার রাস্তা টার দিকে! হয়তো ব্রায়ান খুব শিঘ্রই অ্যানা কে নিয়ে ফিরে আসবে, নয়তো ব্রায়ান ক্লান্ত পরিশ্রান্ত চোখে একাই ঘরে ফিরবে, আর নয়তো কেউই ফিরবে না!
২১. রেড জোনের ভেতর, ঝোপঝাড় আর গাছপালার ভেতর দিয়ে ঝড়ের গতিতে সামনে ছুটে চলেছে অ্যানা৷ আর প্রতিটা কদম ফেলার সাথে বিদ্যুৎ গতিতে আশপাশ টা চোখ বুলিয়ে পরখ করে নিচ্ছে ও কোথাও লিন্ডার উপস্থিতি টের পাওয়া যায় কিনা দেখতে৷
বিদঘুটে রকমের একটা গন্ধ আছে আশপাশে থেকে, মাংস পঁচা গন্ধ৷ যতই সামনের দিকে এগুচ্ছে অ্যানা সে গন্ধটা ততটাই তীব্র হচ্ছে। অ্যানা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে যে গন্ধটা তাকে ঘেউল দের আস্তানার দিকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ বাকা হেসে সেও সেই বিদঘুটে, মাংস পঁচা গন্ধটার দিকেই বিদ্যুৎ গতিতে এগোতে লাগলো।
কিন্তু কিছু মুহুর্ত বাদেই ওর আশপাশে নিজের চলার শব্দ ছাড়াও আরও অনেক অনেক গুলো অদৃশ্য পায়ের শব্দ কানে এলো অ্যানার। অ্যানার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে এগোচ্ছে সেগুলো। অ্যানার পেছনে, মাটিতে থাকা ঘন ঝোপঝাড় আর লতাপাতা গুলো সেই অদৃশ্য অবয়ব গুলোর দ্রুত গতির চলনের কারণে দুমুড়ে মুচড়ে মাটিতে শুয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অ্যানা সেসবে সামান্য তমও ভড়কালো না। আগের মতো করেই চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে লিন্ডা কে খুজতে খুজতে সামনে এগোতে থাকলো ও৷
যতই সামনে এগোলো নিজের পেছনে পায়ের শব্দের সংখ্যা ততই বেড়ে যেতে লাগলো৷ সেই সাথে শোনা যেতে লাগলো হায়েনার মতো হাসির ক্ষীণ শব্দ, শব্দ গুলো হয়েই বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে! যেন শিকার পেয়ে নিজেদের ভেতর সে অদৃশ্য অবয়ব গুলোর মহোৎসব চলছে এবং খুব দ্রুতই নিজেদের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে শিকার টাকে মেরে খুব দারূন একটা ভূরিভোজের আশায় চোখ চকচক করছে
ছুটন্ত অ্যানার নাকে হঠাৎ করেই ছোট্ট লিন্ডার গায়ের গন্ধ এসে লাগলো। আর সাথে সাথেই, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তীব্রবেগে ছুটে চলা হরিণীর সামান্য শব্দে হঠাৎ থমকে যাওয়ার মতো করে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো অ্যানা। আর অ্যানার থেমে যাওয়ার সাথে সাথে থেমে গেলো ওর পেছন পেছন ছুটে আসা সেই অসংখ্য পদধ্বনির শব্দ। কিন্তু থামলো না তাদের সেই হিংস্র হাসি। মনে হলো যেন শ খানেক অদৃশ্য অবয়ব এই মুহুর্তে অ্যানাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে; নিজেদের শিকার কে ভালোভাবে দেখে নিচ্ছে যেন। তাজা, নরম মাংসের লোভে লালা পড়ছে যেন অনেকেরই৷ সেই লালাকে শব্দ করে আবার নিজেদের ভেতর নিয়ে নিচ্ছে তারা! লোভাতুর শব্দ ভেসে আসছে অ্যানার চারদিক থেকে৷ কিন্তু কোনো এক গুরুতর কারণে তারা অ্যানাকে ছুতে পারছে না!
এমন সময়ে সেখানে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মতো নিজের মুখের মাস্ক টা টেনে খুললো অ্যানা৷ মাস্কটা খুলতেই তার অনিন্দ্য সুন্দর মুখ খানা দৃষ্টিগোচর হলো। লাইট হানি টোনের, ডায়ামন্ড শেপের সেই মোলায়েম মুখ খানা অনাবৃত করে নিজের শক্ত হয়ে থাকা চোয়াল দ্বয় আলগা করলো অ্যানা, আর এরপর তার টেরাকোটা রঙা ঠোট জোড়া আলগা করে জোরে একটা দম নিলো, আর তারপরই লিন্ডার নাম টা ধরে উচ্চস্বরে লিন্ডা’ বলে ডাক পাড়লো ও।
ওর মুখনিঃসৃত সেই উচ্চশব্দের লিন্ডা ডাকটা, মোটা মোটা বাকলের গাছের সাথে বাড়ি খেয়ে অদ্ভুত প্রতিধ্বনি তুলতে তুলতে গাছ পালার ফাক ফোকড় দিয়ে যেন চারদিকে ছড়িয়ে গেলো, আর সে প্রতিধ্বনি গুলোর একটা কিয়ৎক্ষণ বাদেই ফিরে এলো একটা ক্ষীণ, মিও ধ্বনি নিয়ে।
যেদিক থেকে সে প্রতিধ্বনি টা ফিরলো সেদিকে তড়িৎ গতিতে তাকিয়ে সাথে সাথে শব্দের উৎসের দিকে ছুটলো অ্যানা৷ আর সেই সাথে ছুটলো তার পেছনে, তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে রাখা অসংখ্য অদৃশ্য ঘেউলের দল।
কিন্তু খানিক্ষণ সমানে ছোটার পর হঠাৎ করেই অ্যানার আশপাশে হল্লা করে বেড়ানো সে হিংস্র ঘেউল গুলোর উপস্থিতি উধাও হয়ে গেলো। মুহুর্তেই গায়েব হয়ে গেলো তাদের সে হায়েনার হাসি আর মহোল্লাস। অ্যানার আশ পাশের সেই অদৃশ্য চাপ টা মুহুর্তেই হালকা হয়ে এলো। আর ঘেউল গুলোর এমন হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া টা অ্যানার মস্তিষ্কে নাড়া দিলো, মাথার ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,
— সামথিং ইজ রং!
অ্যানার ছোটার গতি কমে গেলো। নিজের ঝড়োগতি ধীরে ধীরে কমিয়ে সে এবার দ্রুত গতিতে হেটে যেতে শুরু করলো লিন্ডার সেই মিউ ধ্বনির উৎসের দিকে। আর ঠিক সেই মুহুর্তেই ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিলো সেই চিরপরিচিত মানুষ টার উপস্থিতি। এত এত দূরে থেকেও সেই মানুষ টার উপস্থিতি নাড়িয়ে দিয়ে গেলো ওকে, জানিয়ে দিয়ে গেলো যে ‘আমি আছি’……
দাঁড়িয়ে গেলো অ্যানা। সেই চিরপরিচিত মানুষ, যার সামনে আর কখনোই নিজেকে উপস্থাপন করবে না বলে পণ করেছিলো, সেই তার সামনেই নিজেকে দাঁড় করানোর জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকলো ও। আর তারপর বুক ভরে দম নিয়ে আবারও সেদিকে হেটে চলল ও।
.
বেশ কিছুক্ষণ হাটার পর ঘন জঙ্গল টা ধীরে ধীরে হালকা হতে শুরু করলো। ঝোপ ঝাড় কমে গিয়ে শুধু গাছ পালা দৃষ্টি গোচর হতে লাগলো অ্যানার৷ আর এরপর ধীরে ধীরে সে ঝোপঝাড় টাও মিলিয়ে গিয়ে মাটির সেই গুমোট, স্যাতস্যাতে ভাব টা কমে গিয়ে শুকনো মাটি দেখা দিলো। সূর্যের আলো যে এখানে বেশ ভালোভাবেই পড়ে সেটাই জানান দিলো সে শুকনো পৃথিবী পৃষ্ঠ।
সেখান থেকে সামনে আগানোর সাথে সাথে সে চিরপরিচিত মানুষ টার উপস্তিতি আর ও গাঢ় হতে শুরু করলো, আর কিছুক্ষণ বাদেই সেই ফাকা হয়ে যাওয়া জঙ্গলের ভেতরে অ্যানার দৃষ্টিগোচর হলো সেই ভয়ঙ্কর বিদঘুটে দর্শন ঘেউল গুলোর এক বিশাল জটলা। কিছু একটা কে ঘিরে, পুরোপুরি নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তারা৷ শুধুমাত্র বাতাসে গাছের শুকনো পাতার মড়মড় শব্দ ছাড়া আর সামান্য তম শব্দও সেখান থেকে আসছে না৷
অ্যানা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারলো যে সেখানে ঠিক কি হয়েছে। এমন সময়ে সেই জটলার ওপাশ থেকে লিন্ডার বাচ্চা কণ্ঠের আনন্দ মিশ্রিত মিউ ধ্বনি ভেসে এলো। তার সে কন্ঠে নেই কোনো ভীতির চিহ্ন, ঠিক অ্যানার সাথে খুনসুটি করার সময়ে লিন্ডা যেমন শব্দ করে ডাকে তেমন করেই ডেকে উঠছে ও, যেন সে বহাল তবিয়তে আছে, এবং এই মুহুর্তে তাকে হেব্বি আদর দেওয়া হচ্ছে।
ব্যাপার টা টের পেয়েই সেই জটলা বাধা, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ঘেউল গুলোর দিকে এগিয়ে গেলো অ্যানা৷ আর নিজেদের পেছনে কারো উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই পেছনের দিকে দাঁড়ানো কয়েক টা ঘেউল ফিরে তাকালো নিজেদের পেছন দিকে৷ আর তাকানো মাত্রই আতঙ্কিত হয়ে, ত্রস্ত গতিতে অ্যানার সামনে থেকে হুড়মুড়িয়ে সরে গিয়ে, একটা অন্যটার গায়ের ওপর উঠে পড়লো, আর তাদের দেখা দেখি বাকি ঘেউল গুলোও পেছনে ফিরে অ্যানা কে দেখে পড়ি কি মরি করে দ্রুত গতিতে দু পাশে সরে গিয়ে অ্যানা কে সামনে যাওয়ার জন্য একটা চওড়া রাস্তা করে দিলো। আর এতক্ষন স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যানা ঘেউল দের মাঝের সেই চওড়া রাস্তা টা দিয়ে ধীর পায়ে, সদর্পে এগিয়ে গেলো সামনে।
ঘেউল গুলোকে পুরোপুরি ভাবে পার হওয়ার পর অ্যানার চোখে বাধলো সেই পাঁচ খানা বিলাসবহুল গাড়ির প্রথম খানা, সেই চিরচেনা কালোরঙা গাড়িটা, যার সামনের অংশে নিজের কোমর ঠেকিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে একজন শ্যামরঙা, বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী, কঠোর মুখের পুরুষ। অ্যানার উচ্চতার থেকে এগারো ইঞ্চ বেশি উচ্চতার সে পুরুষটির পরণে একটা ঢোলাঢালা, ধুসর রঙা প্যান্ট, আর তার সাথে একটা সাদা রঙা, পাতলা, ফিরফিরা ফুল স্লিভ শার্ট যেটার বুকের সমস্ত বোতাম খুলে রাখা।
বোতাম খুলে রাখা সে শার্টের কারণে পুরুষটির বলিষ্ঠ, ইস্পাত-দৃঢ়, পেশিবহুল বুক আর পেট দৃশ্যমান। পুরুষ টির বুকের উপরিভাগ জুড়ে ছাই রঙা পশমের সামান্য উপস্থিতি, আর সে ছাই রঙা পশম বুকের উপরিভাগ থেকে শুরু হয়ে সরু আকৃতি নিয়ে, পেটের মাঝখান দিয়ে নেমে নাভী পর্যন্ত গিয়ে পৌছেছে৷
ঘন, গাঢ় ছাই রঙা ভ্রু জোড়া তার তীব্র রাগে কুঞ্চিত হয়ে আছে৷ তীক্ষ্ণ চোয়াল দ্বয় শক্ত। মাথার ওলফ্ কাট দেওয়া গাঢ় ছাই রঙা চুল গুলোর কিছু অংশ কপালের ওপর এসে পড়েছে। চোয়াল জুড়ে সামান্য দাড়ির আভাস সে পুরুষটির পৌরুষ যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
সুঠাম দেহী সে ব্যাক্তিটির ডান হাত ধরে রাখা একটি হোয়াইট গোল্ডের তৈরি হাতলের, প্রচন্ড ধারালো, চকচকা সৌর্ড; যার সে ধারালো অংশে লেগে আছে এক অদ্ভুত সবুজ রঙা তরল। সৌর্ড ধরে রাখা সে হাতটির কনুই কালো রঙা গাড়িটির সম্মুখ অংশের ওপরে ঠেস দেওয়া, আর তার বা হাতের বিশাল থাবার ওপর ধরে রাখা ছোট্ট লিন্ডা কে। লিন্ডার ওই তুলতুলে দেহ টা সেই শ্যামরঙা পুরুষটির হাতের বিশাল থাবা টা জুড়ে পরম সুখে চিল করছে।
পুরুষ টির পা জোড়ার একটি গাড়ির সম্মুখ অংশের সাথে হাটু মুড়ে ঠেস দেওয়া আর অন্যটি মাটিতে। ঈগলের ন্যায় তীক্ষ্ণ, আগুনের ন্যায় উজ্জ্বল চোখ জোড়া সামনের দিকে নিবন্ধিত যেখানে ধড় থেকে মাথা আলাদা হয়ে পড়ে আছে গোটা পঞ্চাশেক ঘেউল, আর সেই পুরুষ টির ঠিক সামনেই জীবিত অবস্থায় হাটু গেড়ে বসে ক্ষমা চেয়ে বিলাপ করছে অন্য আর একটি ঘেউল।
অ্যানা সে ঘেউল টাকে দেখা মাত্রই চিনতে পারলো। এটা সেই ঘেউল টা যেটা অ্যানার বেশ ধরে রেড জোনের ভেতর থেকে তাদের ওপর আক্রমণ করতে ছুটে এসেছিলো।
ঘেউল দের ভেতর কার সরদার গোছের ঘেউল টি ঘেউল সমাবেশের একপাশে ফাকা জায়গাতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। চেহারা জুড়ে তার তীব্র অনুতাপের ছাপ। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, যে নিজের অধীনের ওই মৃত ঘেউল গুলো কে বাচানোর জন্য শ্যামরঙা ওই বলিষ্ঠ পুরুষ টির কাছে খুব বেশিই কাকুতি মিনতি করেছে সে, কিন্তু তার সে মিনতি শোনা হয় নি!
অ্যানা গিয়ে ঘেউল গুলোকে পার হয়ে সামনে দাড়াতেই কালো রঙা গাড়িটাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো মানব টি তার সামনে হাটু গেড়ে বসে থাকা ঘেউল টির দিক থেকে চোখ সরিয়ে অ্যানার দিকে তাকালো৷ আর অ্যানা কে দেখা মাত্রই সে পুরুষটির এতক্ষণের ভ্রু কুচকানো তেজী দৃষ্টি স্তিমিত হয়ে এলো। কুঞ্চিত কপাল টি টান টান হয়ে, তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া থেকে সমস্ত রাগ, তেজ উবে গিয়ে সেখানে এসে ভর করলো এক প্রেমপূর্ণ দৃষ্টি।
কিন্তু পরক্ষণেই অ্যানার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সে পুরুষ টি নিজের সামনে, পায়ের কাছে বসে থাকা ঘেউল টির দিকে তাকালো, আর তাকানো মাত্রই তার দৃষ্টি আবারও আগের অবস্থায় ফিরে এলো, আর তার পরপরই সে পুরুষ টি বিদ্যুৎ বেগে নিজের শাণিত সৌর্ড ধরা হাত টা উচু করে তড়িৎ গতিতে সে ঘেউল টার মাথার মাঝ বরাবর চালিয়ে দিলো, আর সাথে সাথে সে ঘেউল টির দেহটি দ্বীখন্ডিত হয়ে দুই খন্ড দুদিকে ঢলে পড়ে গেলো।
ঘেউল টা মাটিতে পড়ে যেতেই আশেপাশে দাঁড়ানো ঘেউল দের ভেতর একটা চাপা আর্তনাদ ভেসে এলো। কিন্তু উচ্চস্বরে কেদে উঠার সাহস পেলো না কেউ। টু শব্দটি হলেও যে তাদেরও একই অবস্থা হবে!
ঘেউল টিকে দুই খন্ড করে সৌর্ড টা আবারও উপরে উঠিয়ে নিলো সে, তারপর সৌর্ড টাকে নিজের সামনে লম্বালম্বি করে সোজা করে ধরে তড়িৎ গতিতে দুদিকে দুইবার ঘুরালো, আর ঘুরানোর পর পরই সৌর্ড টিতে লেগে থাকা সবুজ রঙা থকথকে তরল টি মুহুর্তেই উধাও হয়ে গিয়ে সৌর্ড টি আগের মতোই চকচকা হয়ে গেলো। আর এরপর সৌর্ডের হাতলের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় চাপ দিতেই সেটি সাথে সাথে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে হতে এক সময় পুরুষ টির ডান হাতের চামড়ার গলিয়ে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আর এরপর সে পুরুষ টি নিজের কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ঘেউল দের লিডারের ওপর।
আর সে পুরুষ টির দৃষ্টি ঠাহর করা মাত্রই ঘেউল দের ভেতরের সেই লিডার ঘেউল টি নিজের নিচু মাথাটা আরও নিচু করে ভীতু পায়ে এগিয়ে এলো অ্যানার দিকে, তারপর একটা নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে অত্যান্ত আনুগত্যের সাথে, ভীতি পূর্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,
— ক্ষমা করুন, আমাদের ছেলেরা আপনাকে চিনতে পারেনি। তারা যদি আপনাকে চিনতো তবে আপনাকে অনুসরণ করা আর আপনার বেশ ধরার মতো দুঃসাহস তারা কখনোই দেখাতো না। ক্ষমা করুন আমাদেরকে, দয়া করুন! আপনি ক্ষমা না করলে আপনার পিছু নেওয়া আমাদের সব গুলো ছেলের গর্দান নিবেন বাদশাহ! দয়া করুন আমাদের ওপর, ক্ষমা করুন!
অ্যানা ঘেউল টির দিকে তাকিয়ে নিজের হাতের ইশারায় বুঝালো যে তাদের কে ক্ষমা করা হলো। অ্যানার ইশারা পাওয়ার সাথে সাথেই ঘেউল টি কৃতজ্ঞতার সাথে মাথা নিচু রেখে নিজের পেছন দিকে হেটে আবার আগের জায়গায় ফিরে গেলো।
আর লিডার ঘেউল টি নিজের জায়গায় ফিরে যেতেই গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ টি নিজের ডান হাত টা উচু করে বাতাসে নাড়ালো দু বার। আর তার সে হাতের ইশারা পেতেই ঘেউল গুলো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ত্রস্ত পায়ে নিজেদের পেছন দিকে হেটে সে জায়গা পরিত্যাগ করে বাতাসে মিলিয়ে গেলো মুহুর্তেই। আর সেই সাথে সাথে অদৃশ্য হয়ে গেলো মাটিতে পড়ে থাকা জনা পঞ্চাশেক মৃতদেহ আর তাদের খন্ডিত দেহ থেকে বের হওয়া সমস্ত সবুজ রঙা তরল।
অ্যানা ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো সে পুরুষটির দিকে এখনো চোখ তুলে তাকায়নি সে। দেহ টা সোজা রেখে, মাথা টা সামান্য ঝুকে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে সে প্রথম থেকেই। চোয়াল দুটো ওর শক্ত, যেন দাঁতে দাঁত পিষে আছে ওর৷
লিন্ডা এতক্ষণ ধরে সেই গাড়িতে ঠেস দেওয়া পুরুষ টির বাম হাতের থাবা দখল করে বসে নিজের সামনের তুলতুলে পা দুইটা দিয়ে সে পুরুষটির হাতের উপরিভাগ জড়িয়ে ধরে বসে বসে নিজের কুট্টু জিহবা টা দিয়ে পুরুষ টির হাতের আঙুলের ডগা চেটে দিয়ে পুরুষটিকে বোঝাচ্ছিলো যে তোমাকে আমার খুব মনে ধরেছে’। কিন্তু তার সে কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে পুরুষ টি এবার নিজের বাম হাতে থাকা লিন্ডা কে মাটিতে নামিয়ে দিলো।
কিন্তু এত আরামের জায়গা থেকে হঠাৎ করে নিচে নামিয়ে দেওয়ায় লিন্ডা কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে সে জায়গায় ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। আর এরপর কিছুটা সামনে নিজের মালিক কে দেখা মাত্রই প্রচন্ড খুশি হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে অ্যানার কাছে চলে এলো ও৷ লিন্ডা কাছে আসতেই অ্যানা ওকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে হুডির পকেটে ঢুকিয়ে ফেললো। লিন্ডা পকেটের ভেতরে ঢুকে ঘুরেফিরে জুৎ করে বসে পকেটের বাইরে নিজের মুখ খানা বের করে দিলো। তারপর বড় বড় চোখ করে তাকে এতক্ষন হেব্বি আদর দেওয়া পুরুষ টির দিকে তাকিয়ে রইলো।
লিন্ডা হুডির পকেটে উঠে বসা মাত্রই অ্যানা কোনোদিকে না তাকিয়ে পেছন ফিরে রাজপথের উদ্দ্যেশ্যে হাটতে নিলো। কিন্তু দুই কদম আগানোর পরই ঝড় তুলে বিদ্যুৎ গতিতে সে শ্যামরঙা পুরুষটি এসে অ্যানার ঠিক পেছনে, ওর শরীর ঘেঁষে দাড়ালো, আর সে এসে দাড়াতেই অ্যানার চলন্ত পা জোড়া থেমে গেলো।
শ্যামরঙা পুরুষ টি তখন অ্যানার মাথার ওপর থেকে ওর হুডির হুড টা সরিয়ে দিয়ে অ্যানার বেনী করে রাখা কেশগুচ্ছ উন্মুক্ত করে দিলো, তারপর সামান্য ঝুকে অ্যানার বা কানের কাছে মুখ নিয়ে ভারী, গুরুগম্ভীর কন্ঠে ডেকে উঠলো,
— শিনজো…..
চিরপরিচিত ডাক নাম টা শুনে অ্যানার সমস্ত শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। কিন্তু সেই চিরপরিচিত ডাকে কোন সাড়া দিলো না অ্যানা, আগের চাইতেও বেশি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। দীর্ঘকায় ব্যাক্তিটি অ্যানার সেই শক্ত হয়ে যাওয়া চোয়াল দ্বয়ের দিকে দৃষ্টি দিয়ে হাসলো মৃদু, তারপর অ্যানার কাছাকাছি আরও একটু সরে এসে দাঁড়িয়ে ভারী, মৃদু কন্ঠে সে বলে উঠলো,
— অনেক দিন হলো তোমার হাসি মুখ টা দেখিনা৷ লিন্ডাকে সুস্থসবল ভাবে ফিরিয়ে দেওয়ার উপহার হিসেবে এক চিলতে হাসি তো আমি পেতেই পারি৷ পারি না?
নিজের মুখখানা অ্যানার কানের গোড়া থেকে সামান্য দূরে নিয়ে এসে অ্যানার বা দিকের চোয়ালের ওপর দৃকপাত করে শেষোক্ত প্রশ্ন টি করল পুরুষ টি। কিন্তু অ্যানা নিজের হাতের মুঠি শক্ত করে চোখ জোড়া স্থীর করে সামনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, পুরুষ টির কথাতে সামান্যতম প্রতিক্রিয়াও জানালো না সে।
অ্যানার এমন মুখোভঙ্গিতে দীর্ঘকায় সে মানব টি সামান্য শব্দ করে হেসে উঠলো, তারপর তড়িৎ গতিতে নিজের মুখ খানা আবারও অ্যানার কানের কাছে নিয়ে এসে অ্যানার কানের সামনের চোয়ালের অংশে নিজের নাকের ডগা ছুইয়ে মৃদু, ফিসফিসে কন্ঠে বলে উঠলো,
— পঞ্চদ্বীপের একচ্ছত্র অধিপতি, বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান যার একটা আদেশে গাছের পাতাও ঝড়ো বাতাসের তোপে স্থীর হয়ে থাকে, সেই ব্যাক্তিটি তোমার হাসিমাখা মুখ টা সামান্য সময়ের জন্য দেখতে চায়, কিন্তু তুমি সেটুকুও দিতে নারাজ। তুমি ছাড়া এমন দুঃসাহস এই পৃথিবীর মাটিতে আর কার আছে বলো!
অ্যানার দম আটকে এলো যেন! গা শিউরে উঠলো ওর, নিঃশ্বাস টা যেন বন্ধ হওয়ার উপক্রম! হাতের শক্ত করে ধরা মুঠি আর কঠোর হয়ে থাকা চোয়াল দ্বয় আলগা হয়ে আসতে চাইলো ওর! নিজের চিরচেনা পুরুষ টিকে এত কাছে পেয়ে ওর এতদিনের জমানো অভিমান যেন ভেঙে যেতে বসেছে, এখুনি হয়তো এই সুগঠিত দেহের পুরুষটির অভিমান ভাঙানোর মোহনীয় কৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে যাবে সে!
কিন্তু শেষ মুহুর্তে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলো অ্যানা। আলগা হয়ে যাওয়া হাতের মুঠি আবার ও শক্ত করে নিয়ে তড়িৎ গতিতে সেই মানব টির অদৃশ্য আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঝড়ের গতিতে পুরুষ টির দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেলো ও৷
আর ওর যাওয়ার পানে প্রেমপূর্ণ দৃষ্টি তে তাকিয়ে নিজের আশে পাশের পরিবেশ টাকে কাপিয়ে শব্দ করে হেসে উঠলো নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান, আর তারপর আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে নিজের দু হাত দুদিকে প্রসারিত করে তার থেকে পলায়নরত মানবীটির উদ্দ্যেশ্যে সে গেয়ে উঠলো,
—
কত আদরে ভালবেসেছি
তোমার ওই মিষ্টি হাসি
তোমাকেই আজ বেঁধে নিয়েছি
আমারও হৃদয়ও মাঝে।
পথে যেতে হায় সে ভালবাসায়
দুরু দুরু বুকটা কেঁপে যায়
ছুঁয়ে দিলে মন আজও আজীবন
হৃদয়ও সঁপেছি তোমায়।
তার সে তৃষ্ণার্ত কন্ঠের সুরে রেড জোনের জঙ্গলে বয়ে চলে গেলো এক ঝড়ো বাতাস, আর নাড়িয়ে দিয়ে গেলো পঞ্চদ্বীপের বাদশাহ, নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানের বুকের বোতাম খোলা সাদা রঙা ফিনিফিনা শার্ট টা……
|
|
|
চলবে……..
(yoooo, whassup 🫣)