#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_১৪
#আ_মি_না
২৩. ঘড়ির কাটা রাতের দশটা কে পার করে এগারোটার দিকে এগোচ্ছে। এই মুহুর্তে ওয়ার্কার্স দের মাঞ্জারের শেষ প্রান্তে, ব্লু জোন আর রেড জোনের সীমান্ত রেখায় দাঁড়িয়ে আছে একজন প্রৌঢ়বয়সী নারী। পরণে তার প্রাসাদের আভিজাত্যপূর্ণ পোশাক, চেহারায় তার বুদ্ধিদীপ্ত আভা। হাতের মুঠিতে একটা লাঠি, সেটার নিম্নভাগ মাটিতে ঠেস দিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে সোজা হয়ে৷ তার থেকে বেশ খানিক টা দূরে অবস্থিত মাঞ্জার গুলোর দিকে বারে বারে দৃষ্টি দিচ্ছে সে, দেখে মনে হচ্ছে বেশ খানিকটা সময় ধরেই কারো জন্য সে এখানে অপেক্ষারত।
এমন সময়ে তার অপেক্ষার অবসান ঘটলো, আবছা আলো আঁধারি তে ঢাকা মাঞ্জার গুলোর ভেতরের সরু রাস্তা দিয়ে নিঃশব্দে হেটে আসতে দেখা গেলো একজন লম্বা চওড়া অবয়ব কে। পরণে তার হুডি, মুখে মাস্ক; দুই হাত পরণের প্যান্টের পকেটে রাখা। তার হুডির পকেটের ডান দিকের টার ভেতর থেকে উকি দিচ্ছে এক জোড়া ছোট্ট জ্বলজ্বলে চোখ।
অবয়ব টি ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো সে প্রৌঢ়া নারীটির দিকে, তারপর সে অবয়ব টি একেবারে নিকটে আসতেই প্রৌঢ়া নারীটি মুখে হাসি ফুটিয়ে, আনুগত্যের সাথে নত হয়ে কুর্নিশ করে, মোলায়েম কন্ঠে ডেকে উঠলো,
— শেহজাদী!
তারপর সেভাবেই কিছুক্ষণ নত থেকে এরপর মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে প্রৌঢ়া নারীটি। আর এরপর তার সামিনে দাঁড়ানো সে অবয়ব টির দিকে তাকিয়ে নিজের আনুগত্যকে যথাসম্ভব বজায় রেখে উচ্ছসিত কন্ঠে বলে উঠলো,
— শেহজাদী! কতদিন পর দেখলাম আপনাকে! আপনাকে দেখে আমার যে কতটা ভালো লাগছে আমি সেটা বলে বোঝাতে পারবো না!
প্রৌঢ়া নারীটির কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তার দিকে আর ও খানিক টা এগিয়ে গিয়ে নিজের হুডির হুড আর মুখের মাস্কটা খুলে ফেললো অ্যানা, তারপর খুলে রাখা মাস্ক টা নিজের হুডির পকেটে ঢুকিয়ে রেখে, স্মিত হেসে দু হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো নিজের সামনে দাঁড়ানো সেই প্রৌঢ়া রমণী টিকে৷ তারপর জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই বলল,
— তোমাকে দেখে আমারও অনেক ভালো লাগছে ইয়াসমিন!
এরপর ইয়াসমিন নামক মেয়েটিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে নিজের সামনে দাড় করিয়ে অ্যানা শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— প্রাসাদের খবর বলো, কি অবস্থা ওদিকের?
ইয়াসমিনের হাসি মুখ খানাতে নিমিষেই আঁধার নেমে এলো। মন খারাপ করে সে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
— প্রাসাদে আনন্দ আছে শেহজাদী, কিন্তু আগের মতো আনন্দ নেই! আপনি সেখান থেকে চলে আসার পর থেকে প্রাসাদ টা যেন প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। কোথাও আর আপনার সেই খিলখিলে হাসি শোনা যায় না! আর আমাদের বাদশাহ! আপনি কাছে থাকলে তার চোখে মুখে যে আনন্দ দেখা যেত তার ছিটে ফোটাও আর নেই! তার সেই প্রাণখোলা হাসিও আর শোনা যায় না! এখন সারাটা সময়ই গম্ভীর মুখে থাকেন। সারাটা ক্ষণ রাজ্যের নানা গুরুত্বপূর্ণ ফাইল পত্র নিয়ে ব্যাস্ত থাকেন, বাইরেও বের হতে চান না! খেতে ইচ্ছা হলে খান নইলে খান না, ঘুমাতে উচ্ছা হলে ঘুমান নইলে ঘুমান না! সব কিছুতে অনিয়মিত হয়ে গেছেন তিনি। তার রাগ, তেজ আপনি চলে আসার পর আবারও বেড়ে গেছে! সামান্য অপরাধের কারণেও ভয়ানক রেগে যাচ্ছেন তিনি। শুধুমাত্র গত পাঁচ মাসেই ষোলো জন রাজকর্মচারী কে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন তিনি! অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে ওনার সামনে এখন আপনার চাচা রা দাড়াতেও ভয় পান, খুব সন্তর্পণে কথা বলেন তারা, যেন বাদশাহ ভুলেও রেগে না যান৷ আমার ধারণা উনি হয়তো আস্তে আস্তে আবারও নিজের আগের রূপে ফিরে যাচ্ছেন! আর সত্যি সত্যিই যদি সেরকম টা হয় তবে কি হবে সেটা আর কারো বলার অপেক্ষা রাখে না!
শেষোক্ত কথা টা কোনো এক অজানা শঙ্কায় ভ্রু উচিয়ে বলল ইয়াসমিন। ইয়াসমিনের কথাতে অ্যানা কে খুব চিন্তিত দেখালো, কিন্তু পরমুহূর্তে চাচা দের কথা মনে পড়তেই অ্যানা ইয়াসমিনের দিকে প্রশ্ন ছুড়লো৷
— চাচাদের সবাইকে সকাল বেলাতে দেখলাম কোথাও যেতে, ওনারা হঠাৎ শিরো মিদোরি তে কি করছেন?
— আসলে একটু ঝামেলা হয়ে গেছে, কুরো আহমারে হঠাৎ করেই একদল উগ্রবাদীর উৎপাত বেড়েছে। তার যাচ্ছেতাই করে বেড়াচ্ছে শহর জুড়ে, আর তারা সংখ্যায়ও অনেক। তাই কুরো আহমারের কন্ট্রোলার, আপনার চাচা আহসান পারসি এসে ছিলেন এই বিষয়ে বাদশাহর সাথে কথা বলতে, আর যেহেতু বিষয় টা গুরুতর তাই অন্যদের কেও তিনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
অ্যানা আনমনা হয়ে গেলো, হঠাৎ কি এমন ঝামেলা হলো যে সবাই শিরো মিদোরি তে এসে মিটিং করলো! খুব জরুরি কিছু না হলে তো আর এমন করার কথা নয়!
অ্যানা কে আনমনা দেখে ইয়াসমিন আবার বলতে শুরু করলো,
— ওই উগ্রবাদীদের ভেতরের সবচেয়ে মার্কা মারা গুলোকে সম্ভবত শিরোমিদোরিতে পাঠানো হবে। শাস্তি স্বরূপ ওরাও এখানে কাজ করবে অন্য সবার সাথে মিলে! আর আমার ধারণা এতসব অরাজকতার সৃষ্টি হচ্ছে আপনার ওপর বাদশাহের আরোপিত সীমাবদ্ধতার কারণে৷ উনি যদি আপনার ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি না করতেন তাহলে এসবের কিছুই হতো না!
ইয়াসমিনের বলা শেষের বাক্য দুটো কানে আসতেই অ্যানার খুশি খুশি মায়া ভরা মুখ খানা হঠাৎ করেই শক্ত হয়ে গেলো। চোয়াল শক্ত করে ইয়াসমিনের দিকে দু কদম পা বাড়িয়ে সে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে, কঠিন স্বরে বলে উঠলো,
— ইয়াসমিন! তুমি কি নিজের সীমা ভুলে গেছো? পঞ্চ দ্বীপের বাদশাহ, নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানের আদেশ নিয়ে তুমি সমালোচনা করছো! এত টা সাহস কে দিয়েছে তোমাকে? সামান্য দাসী হয়ে, আমার সামনে দাঁড়িয়ে, আমার স্বামীর দেওয়া আদেশ নিয়ে এই ভাবে কথা বলার সাহস তুমি কোথায় পাও?
শেষোক্ত কথা টা উচ্চস্বরে হুংকার দিয়ে বলে উঠলো অ্যানা৷ অ্যানার সে হুংকার শুনতেই জড়সড় হয়ে যেন মাটিতে মিইয়ে গেলো ইয়াসমিন। আর সেই মুহুর্তেই ইয়াসমিন বুঝলো আবেগের বশবর্তী হয়ে কি চরম ভুলটাই না সে করেছে! দ্রুততার সাথে অ্যানার সামনে নত হয়ে হাটু গেড়ে বসে পড়লো ও, তারপর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কাঁদোকাঁদো কন্ঠে, দ্রুততার সাথে সে বলে উঠলো,
— ক্ষমা করবেন শেহজাদী! আমার ভুল হয়েছে, মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে! প্রাণ থাকতে আর এমন হবে না, ক্ষমা করুন এই অধম কে! দয়া করুন!
অ্যানা নিজের পা দুখানা ইয়াসমিনের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে দু কদম পেছনে সরে এলো। তারপর দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো,
— তুমি যখন দেমিয়ান প্রাসাদে দাসী হয়ে এসেছিলে তখন তুমি দুধের শিশু ছিলে, তা সত্বেও তোমাকে আমি আমার কাছে রেখেছিলাম, আমার বিশ্বস্ত দাসীদের একজনে পরিণত হয়ে ছিলে তুমি! আর সেই আমার ছায়া তলে থেকে আমার বাদশাহ কে নিয়ে এই ধরণের কথা বলার মতো স্পর্ধা তোমার কোথা থেকে এসেছে? আবার নিজের হয়ে সাফাই গাইছো যে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে!
অ্যানার এমন কথা শুনে মাটিতে পড়ে থাকা ইয়াসমিন ফুপিয়ে কেদে উঠলো, তারপর মাটিতে হাটু গেড়া অবস্থাতেই অ্যানার দিকে এগিয়ে এসে অ্যানার পায়ে পড়ার চেষ্টা করলো আবারও। কিন্তু ওকে সে সুযোগ দিলো না অ্যানা৷ আবারও দু কদম পেছনে সরে গিয়ে সে কঠিন স্বরে বলে উঠলো,
— নিজের প্রাণ বাচাতে চাইলে এই মুহুর্তে আমার সামনে থেকে চলে যাও! নইলে এইখানে আর একটা মিনিট ও যদি আমি তোমাকে দেখি তবে আজকেই হবে তোমার শেষ দিন। আমার সামনে থেকে চলে যাও তুমি, আর কখনোই তোমার ওই চেহারা আমি দেখতে চাই না!
ইয়াসমিন বুঝলো সে এখন হাজার চেষ্টা করলেও তার সামনে দাঁড়ানো মানবী টার মন পাবে না! তাই ফুপিয়ে কেঁদে উঠে মাটি থেকে উঠে দাড়ালো সে। তারপর চোখের পানি মুছতে মুছতে, নিজের পেছন দিকে হেটে অ্যানার থেকে দূরে সরে গেলো ও, আর ইয়াসমিন দূরে সরে যেতেই অ্যানা পেছন ফিরে আবার মাঞ্জারের দিকে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
অ্যানা দুকদম আগে বাড়াতেই পেছন থেকে ইয়াসমিন কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো,
— শেহজাদী, দ্বিতীয় বার ডাকার জন্য ক্ষমা করবেন! আপনাকে বলতে ভুলে গেছি, আজ রাত্রে রুথ নামক সেই মেয়েটাকে বাদশাহর খাসকামরায় পাঠানো হবে।
ইয়াসমিনের কথা শুনে অ্যানার পা জোড়া থেমে গেলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য, কিন্তু তারপর আবারও কোনো দিকে না তাকিয়ে গটগট পায়ে হেটে অ্যানা চলল মিটিং জোনের দিকে। আর ইয়াসমিন অ্যানার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো আবারও, হয়তো আর কখনোই ওই মানবীটির স্নেহ তার পাওয়া হবে না!
.
মিটিং জোনের কাঠের গুড়ির সারি সারি বসার স্থানে বসে আছে ওয়ার্কার্স দের অনেকেই, সেখানে থিয়োডর, শার্লট আর ফাতমাও আছে। ব্রায়ান বসে আছে সে কাঠের গুড়ির বসার স্থান গুলোর ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত একটা বড়সড় কাঠের চেয়ারে। নিজেদের ভেতর গল্প গুজব আর হাসি ঠাট্টা করছে ওরা।
থিয়োডর বসে আছে এক কোণায়, ভালোই লাগছে ওর! বহুদিন এইভাবে বসে আড্ডা দেওয়া হয় না, ব্রায়ান একটা ভালো উদ্যোগ নিয়েছে, মানতেই হবে। কিন্তু অ্যানা নেই! রাতের খাবারের পর সে কোথায় জানি চলে গেলো, এখনো এলো না। আবার নিজের মাঞ্জারেও যায়নি। তাহলে সে মেয়েটা গেলো কোথায়!
থিয়োডরের চোখ জোড়া আশেপাশের দূরদূরান্তে তাকিয়ে অ্যানা কে খুজে বেড়াতে লাগলো, ঠিক সেই মুহুর্তেই মাঞ্জারে যাওয়ার রাস্তার দিক থেকে ধীর পায়ে হেটে মিটিং জোনে এলো অ্যানা।
ওকে আসতে দেখেই সবাই গল্প বন্ধ করে ওর দিকে তাকালো। অ্যানার ওই লম্বা লম্বা পা ফেলে, ঢোলাঢালা প্যান্টের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে রাজকীয় ভঙ্গির চলা টা একটা দেখার মতো বিষয়, মনে হয় যেন কোনো মডেল হেটে আসছে।
সবার এরকম তাকানোয় অ্যানা কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেও কাউকে বুঝতে দিলো না। সেই মুগ্ধ দৃষ্টি গুলো কে উপেক্ষা করে অ্যানা নিঃশব্দে হেটে এসে বসলো শার্লটের পাশে। আর অ্যানা পাশে বসতেই শার্লট কনুই দিয়ে ওর গায়ে একটা গুতা মেরে বলল,
— নায়িকা! কোথায় ছিলেন আপনি ম্যাডাম?
অ্যানা শার্লটের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— হাটতে গেছিলাম, রাতের খাবারের পর হাটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
শার্লট আবার একটা গুতা মেরে মজা করে বলল,
— বাবাহ! মডেল দেখি নায়িকার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিদও!
অ্যানা শার্লটের সে কথা শুনে সামান্য শব্দ করে হাসলো। সেই সময়েই ব্রায়ান লিডারের চেয়ারের ওপর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তার সামনে উপস্থিত বাকি ওয়ার্কার্স দের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
— সাইলেন্ট এভরিবাডি, অনেক গল্প গুজব হয়েছে, এইবার একটা ছোটখাটো গেইম খেলা যাক। আমরা এইখানে যারা যারা উপস্থিত আছি, আমরা সবাই নিজেকে ডিফাইন করে গাইবো, এক বা দুই লাইন। বর্তমানে আমরা কে কি অবস্থায় আছি, বা নিজেকে কে কি ভাবছি, কার নিজের প্রতি কতটা কনফিডেন্স, বা কে নিজেকে কি ভাবে সেটাই দেখা যাবে এই গেইমের মাধ্যমে, ঠিক আছে?
ব্রায়ানের কথাতে একটা চাপা উচ্ছাস দেখা গেলো সেখানে উপস্থিত ওয়ার্কার্স দের মধ্যে। সবাই যে যার জায়গাতে হাসি মুখে সোজা হয়ে বসলো ব্রায়ানের দিকে ফিরে। আর নিজের প্রস্তাবিত গেইমের ব্যাপারে সবাইকে এমন উৎসুক হতে দেখে খুশি হলো ব্রায়ান। খুশি খুশি কন্ঠে ও আবারও বলে উঠলো,
— তাহলে শুরু করা যাক। ফার্স্ট আমি শুরু করি, কি বলো!
ওয়ার্কার্স দের দিকে ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নে সায় উচ্ছ্বসিত কন্ঠে জানালো সবাই, চুপচাপ থাকা থিয়োডরের মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। সে এতক্ষন কাঠের গুড়ির ওপর বাকা হয়ে বসেছিলো, ব্রায়ানের কথায় দেহ টা সোজা করে বসলো ও৷
ব্রায়ান কথা শেষ করে আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসলো তারপর চেয়ারের পাশে থাকা তার সেই ছোট্ট, জোড়াতালি দেওয়া সাউন্ড বক্স টার সাথে তার ওয়ারলেস মাইক্রোফোন টা কানেক্ট করে নিয়ে সবার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে গলা খাকারি দিয়ে ও অ্যানার দিকে দৃষ্টি দিয়ে গান ধরলো,
—
Secrets I have held in my heart
Are harder to hide than I thought
Maybe I just wanna be yours
I wanna be yours, I wanna be yours ( ওয়ানা বি ইয়োরস)
মাত্র দুকলি গানের মাধ্যমেই ব্রায়ান তার মনের পুরো অবস্থাটাই উন্মুক্ত করে দিলো! অ্যানা জানতো এরকম কিছুই হবে৷ তাই একটি বারের জন্যও মাথা তুলে নিজের সামনে তাকায়নি ও, তখন থেকে মাটির দিকেই তাকিয়ে আছে৷
ব্রায়ান ছেলেটা এই ওয়ার্কিং জোনের ভেতরে তার সবচেয়ে আপন মানুষ শার্লটের ভাই। তাই সেই হিসেবে ব্রায়ান কেও সে বন্ধুর চোখে দেখে, ব্রায়ান ও সেটাই দেখতো এতদিন। কিন্তু বিগত, খুব অল্প কয়েক মাসের ভেতরেই অ্যানার প্রতি ব্রায়ানের সে বন্ধুত্বের অনুভূতিটা বদলে যেতে শুরু করেছে হঠাৎ করেই, সেটা এখন মোড় নিচ্ছে ভিন্ন দিকে।
কয়েক সপ্তাহ আগেও সে অনুভূতিটাকে ব্রায়ান প্রকাশ করতো না, কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে সে আর কোনো কিছুরই পরোয়া করছে না৷ এই ছেলেটাকে খুব দ্রুতই শোধরাতে হবে, নইলে কবে না জানি লিমিট ক্রস করে ফেলবে আর অকালে নিজের প্রাণ টা হারাবে।
গান টা গাওয়ার সময়ে ব্রায়ানের দৃষ্টি যে অ্যানার দিকে পড়েছে সেটা থিয়োডর সহ সেখানে উপস্থিত সবাই দেখলো৷ দেখে সে ওয়ার্কার্স রা খুশিই হলো, যে অবশেষে একটা নতুন জুটি পেতে চলেছে তারা খুব শিঘ্রই! কিন্তু থিয়োডর খুশি হতে পারলো না, সে দাঁতে দাঁত পিষে, ব্রায়ানের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থম মেরে বসে রইলো কাঠের গুড়ির ওপর৷
গান শেষ করে ব্রায়ান হাসি হাসি মুখে আবার নিজের জায়গায় বসে পড়লো, লজ্জা লজ্জা লাগছে ওর খুব। আবেগের বশবর্তি হয়ে অ্যানার দিকে তাকিয়ে ফেলেছিলো ও, আর সেটা সবাই দেখে ফেলেছে! সবাই কেমন যেন মিটিমিটি করে হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে, বিশেষ করে শার্লট৷ সে তো রীতিমতো ভ্রু নাচিয়ে বোঝাচ্ছে যে, হেব্বি পারফরম্যান্স দিছো ভাই, এগিয়ে যাও! কিন্তু ব্রায়ান লজ্জা পাচ্ছে৷
নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ব্রায়ান এবার বাকি দের উদ্দেশ্যে বলল,
— এবার কে পার্টিসিপেট করবে?
ব্রায়ানের বলার সাথে সাথেই চোয়াল শক্ত করে রাখা থিয়োডর সবার পেছন থেকে হাত উঁচু করলো। ব্রায়ান যেন জানতো এরকমই হবে, ওর দৃষ্টি থিয়োডরের দিকেই ছিলো। ব্রায়ান বাকা হেসে মাইক্রোফোন টা ওয়ার্কার্স দের হাতে হাতে থিয়োডরের কাছে পাস করে দিলো। সবার পেছনে বসায় থিয়োডর কে দেখতে সবার অসুবিধা হচ্ছিলো, তাই সবাই মিলে কাটের গুড়ির ও পাশ থেকে এপাশে ঘুরে বসলো থিয়োডরের দিকে মুখ করে৷
থিয়োডর পড়লো বিপদে, সে এমনিতেই চুপ চাপ স্বভাবের মানুষ, লাজ লজ্জা তার একটু বেশি, ভেবেছিলো পেছনে বসে থাকলে তার দিকে কেউ তাকাবে না, অনায়াসেই গাইতে পারবে, কিন্তু তার সে গুড়ে বালি দিয়ে সব কয়টা ওর দিকে ঘুরে বসে খুব উৎসাহের সহিত তাকিয়ে রইলো। থিয়োডর সবার এমন উৎসুক দৃষ্টি তে ইতস্তত বোধ করলো কিছুটা। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে তার থেকে কিছুটা দূরে, ডান দিকে বসে থাকা অ্যানার দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সে গান ধরলো,
—
Pehle bhi main tumse mila hoon
Pehli dafa hi milke laga
Tune chhua zakhamo ko mere
Marham marham dil pe laga
Paagal pagal hain thode
Baadal pagal hain dono
Khulke barse bheegein aa zara
Pehle bhi main tumse mila hoon
Pehli dafa hi milke laga
Tune chhua zakhamo ko mere
Marham marham dil pe laga
থিয়োডরের সেই মোলায়েম কন্ঠে কিছু একটা যেন ছিলো, সবাই শান্ত হয়ে এলো ওর সে গানের সুরে, আর এটাও বুঝে গেলো যে তাদের এতদিনের খুবই শান্ত স্বভাবের থিয়োডরের মনেও কারো না কারো জন্য ভালোবাসা লুকায়িত আছে! গেইম টা দৈনিক দৈনিক খেলতে হবে, তাহলে সবার মনের অবস্থাটা সুন্দর মতো বোঝা যাবে, যে বোঝাতে চায় না তার টাও বোঝা যাবে৷
তার দিকে সবার এমন সন্দেহের নজরে তাকানোতে থিয়োডর অস্বস্তিতে পড়লো, অন্যদের সে নজর থেকে বাচতে দ্রুত মাইক্রোফোন টা সামনের দিকে পাস করে দিলো৷ তখনি অ্যানার পাশ থেকে শার্লট উচ্ছসিত কন্ঠে বলে উঠলো,
— এবার আমি, আমি!
ওকে এমন বাচ্চাদের মতো লাফাতে দেখে হেসে উঠলো ব্রায়ান৷ মাইক্রোফোন টা সামনের দিকে পাস হতে গিয়েও গেলো না, ডান দিকে চলে গেলো। শার্লট মাইক্রোফোন টা হাতে নিয়ে গলা খাকারি দিয়ে গাওয়ার প্রস্তুতি নিলো, কিন্তু আশেপাশের সবাই ওর দিকে থিয়োডরের দিকে তাকানোর মতো করেই তাকিয়ে আছে দেখে মাইক্রোফোন টা মুখের কাছে নিয়ে গাইতে গিয়েও শেষ মুহুর্তে হেসে দিলো ও, তারপর তার দিকে তাকিয়ে থাকা পাবলিকের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
— অ্যাই কেউ আমার দিকে তাকাবে না, নইলে আমি গাইতে পারবো না, সবাই অন্য দিকে তাকাও৷
শার্লটের কথায় নিঃশব্দে হেসে উঠলো অ্যানা, শরীর টা সামান্য দুলে উঠলো ওর৷ আর অন্যরা সবাই হেসে উঠে শার্লটের দিক থেকে অন্য দিকে ঘুরে বসলো, ব্রায়ানও শব্দ করে হেসে উঠে নিজের চেয়ারের ওপর উলটো দিকে ঘুরে বসলো, তারপর শার্লটের উদ্দেশ্যে বলল,
— হ্যা, হয়েছে, এইবার শুরু করেন।
শার্লট তখন মাইক্রোফোন টা নিজের মুখের কাছে ধরে বলল,
— আসলে আমার নিজের কোনো কথা নাই, আমি আমার গানটা গাইবো অন্য কারো হয়ে৷ কার হয়ে সেটা না হয় অজানাই থাকলো
উপস্থিত ওয়ার্কার্স রা শার্লটের সে অন্যের হয়ে গাওয়া গান টা শোনার জন্য মুখিয়ে রইলো, আর শার্লট কথা টা শেষ করেই গেয়ে উঠলো,
—
আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখের সন্ধানে যাও
তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখের সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে
আর কিছু নাহি চাই গো
আমার পরান যাহা চায়
শার্লট গান শেষ করে হাসি হাসি মুখে অ্যানার দিকে তাকালো এক পলক, কিন্তু তার দৃষ্টি গোচর হলো না অ্যানার ওই শক্ত হয়ে যাওয়া মুখ খানা৷ হাসি হাসি মুখে শার্লট নিজের হাতের মাইক্রোফোন টা অ্যানার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
— ধর, এইবার তুই গাইবি৷
অ্যানা মাথা সোজা করে নিজের সামনের দিকের কোনো এক অজানায় স্থীর দৃষ্টি তে তাকিয়ে ছিলো, শার্লটের কথা শুনে শার্লটের দিকে ফিরে তাকালো ও। তারপর কিছুক্ষণ কঠিন চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে উত্তর করলো,
— আমি গাইবো না৷
আর কথা টা বলেই শার্লটের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সেখানে থেকে উঠে চলে যেতে নিলো ও, কিন্তু শার্লট ধরে ফেললো ওর ডান হাত খানা। তারপর আদুরে গলায় বলল,
— আরে আজকের দিন টাই তো! সবসময় এরকম করলে চলে বল! প্লিজ, দুই কলি মাত্র! শুধু আজকে!
অ্যানা শার্লটের হাত থেকে নিজের হাত খানা আলতো করে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
— সম্ভব না। আমি গাইলে কেউ শুনতে পারবে না। শুধু শুধু গাওয়া হবে।
বলেই চলে যেতে নিলো ও, কিন্তু তখনই তার আশে পাশে থাকা বাকি মেয়ে গুলোও পেছন থেকে অ্যানাকে অনুরোধ করলো একটা বার ওদের সাথে কোনো কিছুতে অংশগ্রহণের জন্য। কারণ অ্যানাকে ওরা কখনোই সেভাবে জানতে পারেনি। সবার সাথে সব সময় টুকটাক কথা হলেও অ্যানার সাথে তাদের সেইভাবে কখনোই কথা হয়নি৷ আর অ্যানাও নিজেকে সবসময় অন্যদের থেকে দূরে দূরে রেখেছে। শুধুমাত্র শার্লট, ব্রায়ান আর ফাতমার সাথে ছাড়া আর কারো সাথেই তার তেমন সখ্যতা হয়নি। তাই আজ এই গেইমের মাধ্যমে অ্যানা কে একটু বুঝতে চাইছে ওরা। মেয়েগুলোর অনুরোধের মাঝে ব্রায়ানও একবার অ্যানা কে অনুরোধ করলো অংশগ্রহন করার জন্য।
সবার এত অনুরোধে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো অ্যানা, চলে যেতে গিয়েও আবার ফিরে এসে বসলো শার্লটের পাশে, অ্যানা সত্যিই ফিরে আসায় শার্লট খু্শি হলো অনেক। দাঁত কেলিয়ে হেসে ও অ্যানার দিকে তাকিয়ে রইল। আর সেই সময়ে অ্যানা শার্লটের হাত থেকে মাইক্রোফোন টা নিজের হাতে নিতে নিতে চাপা গলায়, কঠিন সুরে শার্লট কে বলল,
— শার্লট, তোকে আমি আমার একজন ভালো বন্ধু ভাবি, এবং ভবিষ্যতেও ভাবতে চাই। তাই আমি আশা রাখি তুই এমন কিছু করবি না যাতে এই বন্ধুত্বের সম্পর্ক টা ভেঙে গিয়ে আমরা অচেনা দুজন মানুষে পরিণত হই।
অ্যানার সে ইঙ্গিত পূর্ণ কথা টা বুঝলো শার্লট। ওর হাসি মাখা মুখ টাতে ধীরে ধীরে আঁধার নেমে এলো। অ্যানার দিকে ব্যাথাতুর চোখে তাকিয়ে রইলো ও। এই প্রথম বারের মতো অ্যানা ওর সাথে এভাবে কথা বলল। অ্যানা হাজার কঠিন হওয়া সত্বেও ওর সাথে কখনোই শক্ত গলায় কথা বলেনি, এই প্রথম বার! গলা ধরে এলো শার্লটের।
ভাইয়ের পরে নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ টার থেকে এমন কথা ও নিতে পারলো না, চোখের কোণা জোড়া ভিজে উঠলো ওর৷ আর ঠিক সেই সময়েই শার্লটের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মাইক্রোফোন টা মুখের কাছে ধরে অ্যানা তার সম্মোহনী কন্ঠে গেয়ে উঠলো,
—
I put my armor on, show you how strong I am
I put my armor on, I’ll show you that I am
I’m unstoppable
I’m a Porsche with no brakes
I’m invincible
Yeah, I win every single game
I’m so powerful
I don’t need batteries to play
I’m so confident
Yeah, I’m unstoppable today
Unstoppable today
Unstoppable today
Unstoppable today
I’m unstoppable today ( Unstoppable)
আর অ্যানার মুখনিঃসৃত প্রতিটা সুরে আচ্ছন্ন হয়ে গেলো সেখানে উপস্থিত ওয়ার্কার্সরা! ওর কণ্ঠনিঃসৃত সে গানের প্রতিটা শব্দের সাথে সাথে বদলে যেতে লাগলো শিরো মিদোরির আবহাওয়া৷ হঠাৎ করেই মৃদু মন্দ শীতল বাতাস বইতে শুরু করলো চারদিকে, আর সে বাতাসের সাথে জঙ্গলের গভীর থেকে মিটিং জোনের দিকে ভেসে এলো মন মাতানো এক সুবাস! সে সুগন্ধীর দাপটে যেন নেশা হয়ে গেলো সবার। ঘুম ঘুম চোখে সেই মন মাতানো সুবাস আর প্রাণ জুড়ানো কন্ঠে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে রইলো সবাই, যেন হুস হারিয়ে ফেলেছে! পুরো মিটিং জোনের চারপাশে থাকা গাছ গুলোতে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো যেন! চার পাশে এক অদ্ভুত রকমের চমকিত আভা দেখা দিলো, যেন বাতাসের ভেতরে কেউ সোনা রঙা গ্লিটার ছড়িয়ে দিয়েছে! অদ্ভুত ভাবে সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উজ্জ্বল বস্তু গুলো একসাথে জড়ো হয়ে, আঁকাবাকা লাইন বেধে মিটিং জোনের চারপাশে, অ্যানা কে ঘিরে, নিজেদের শরীরের দ্যুতি ছড়াতে শুরু করলো!
কিন্তু ঠিক সেই সময়েই হঠাৎ করে অ্যানার বুকের ভেতরে ধক করে উঠলো! বুকের ভেতর টা ওর মুচড়ে উঠলো যেন! আর এরপর সে মুচড়ে ওঠা টা আকস্মিক ভাবে তীব্র কষ্টে পরিণত হয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করে দিতে শুরু করলো ওর বুকের মাঝখান টা! যন্ত্রণায় কন্ঠরোধ হয়ে চোখ মুখ কুচকে এলো ওর! আর এই চরম বেদনা পূর্ণ মুহুর্তে ওর মুখ থেকে শুধুমাত্র একটা শব্দই বের হলো,
— রুথ!
আশেপাশের সমস্ত ওয়ার্কার্সরা তখনো ওর সে সুরের মূর্ছনায় আচ্ছন্ন হয়ে। আর সেই সুযোগেই নিজের বুক ফেটে বের হতে চাওয়া আর্তনাদ টাকে প্রাণপণ চেষ্টায় নিজের ভেতর আটকে রেখে তড়িৎ গতিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের পকেটে থাকা লিন্ডাকে বের করে এক প্রকার ছুড়ে ফেলে দিয়ে মিটিং জোন থেকে ঝড়ের গতিতে ছুটে বেরিয়ে গেলো অ্যানা৷ আর তারপর এক ছুটে, বিদ্যুৎ গতিতে মাঞ্জার পেরিয়ে, জঙ্গলের ব্লু জোন অতিক্রম করে ও ঢুকে গেলো রেড জোনের ভেতর। আর ঢুকেই ঝড়ের বেগে শিরো মিদোরির জঙ্গলের গভীর থেকে গভীরের দিকে ছুটে যেতে যেতে আকাশ বাতাস কাপিয়ে গগন বিদারি এক চিৎকার দিয়ে উঠলো অ্যানা, ওর সে আর্তনাদে যেন কেঁপে উঠলো শিরো মিদোরির জঙ্গল!
.
.
চলবে…….