#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_১৫
#আ_মি_না
মুহুর্তের ভেতরে মেঘ হীন আকাশে ঘন কালো মেঘ জমলো, আর সেই সাথে চারদিকে মুহুর্মুহু বজ্রপাতের শব্দে কেঁপে উঠতে থাকলো শিরো মিদোরি, আর এর পরপরই শুরু হলো ঝড়ো হাওয়া আর তার সাথে বিধ্বংসী ঝুম বৃষ্টি। মিটিং জোনে উপস্থিত সকলেই সম্বিত ফিরে ফেলো সে বৃষ্টির পানির ছোয়ায়, আর তারপর পরিবেশের এমন অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলো ওরা৷ বসন্তে এমন ঝড় এর আগে আর কখনোই দেখেনি কেউ। বাতাসের তোপে মিটিং জোনের চারপাশের গাছ গুলো প্রচন্ড গতিতে একে অপরের ওপর অদ্ভুত শব্দ তুলে আছড়ে পড়ছে৷ আর এমন অস্বাভাবিক বজ্রপাতের বিকট শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে ওয়ার্কার্স দের৷
মিটিং জোনে থাকা ওয়ার্কার্স রা সম্বিত ফিরে পেতেই পরিবেশের এমন ভয়াবহ অবস্থা দেখে যে যার মাঞ্জারের দিকে ছুটে চলল। বসন্তে যে এমন অস্বাভাবিক ঝড় হতে পারে সেটা ওরা কখনোই ভাবেনি। যে যার মতো ছোটাছুটি করতে করতে নিরাপদ স্থানের দিকে চলে গেলো ওরা।
শার্লট স্বাভাবিক হওয়া মাত্রই ওর পাশে অ্যানা কে খুজলো, কিন্তু অ্যানা নেই। শার্লট চকিতে একবার চারপাশে নজর বুলিয়ে খুজলো অ্যনাকে, কিন্তু কোথাও নেই অ্যানা৷ দ্রুত গতিতে নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকাতে তাকাতে অ্যানার নাম ধরে চিৎকার পাড়লো শার্লট কয়েকবার, কিন্তু অ্যানার কোনো পাত্তা নেই৷
থিয়োডর নিজের মাঞ্জারের দিকে ছুটে চলে যেতে গিয়েও শার্লটের মুখে অ্যানার নাম শুনে থমকে দাড়ালো, আসলেই তো, অ্যানা কই!
ব্রায়ান বৃষ্টি থেকে নিজের সাউন্ড বক্স টা বাচাতে ওয়াটার রেজিস্টেন্স কোনো কিছু পাওয়ার আশায় আশপাশ টা হন্যে হয়ে খুজছিলো৷ শার্লটের মুখে অ্যানার নাম শুনে সেও চকিতে তাকালো নিজের চারপাশে, তারপর নিজের জায়গা থেকে উচ্চস্বরে শার্লট কে বলল,
— শার্লট, বৃষ্টির ভেতরে এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে মাঞ্জারের দিকে আগা, আর যাওয়ার সময় অ্যানার মাঞ্জার টা চেইক করে যাস, ও হয়তো ওর মাঞ্জারে চলে গেছে। ও মাঞ্জারে থাকুক বা না থাকুক আমাকে সাথে সাথেই জানাবি, আমিও আসছি এগুলো গুছিয়ে, এখনি৷
শার্লটের ব্রায়ানের কথায় মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে ছুটলো মাঞ্জারে যাওয়ার রাস্তার দিকে। আর থিয়োডর ও গেলো শার্লটের সাথে সাথে৷ শার্লট চলতে চলতে মনে মনে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। কিছুক্ষণ আগেই তো অ্যানা ওর পাশে বসে গান গাইছিলো, তাহলে এমন মুহুর্তের ভেতরে উধাও হয়ে গেলো কিভাবে। আর অমন ফকফকা আবহাওয়া এত দ্রুতই বা বদলে গেলো কিভাবে! কিছু মুহুর্ত আগেও তো চাঁদের আলো গাছের পাতার ফাক ফোকড় দিয়ে মাটিতে পড়ছিলো! তাহলে এত্ত অল্প সময়ের ভেতরে ভোজবাজির মতো কিভাবে আবহাওয়া পরিবর্তন হয়ে গেলো!
এসব ভাবতে ভাবতেই দ্রুত পায়ে শার্লট আগালো অ্যানার মাঞ্জারের দিকে৷
২৪.অশ্রুসিক্ত চোখে অসহনীয় যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে করতে বিদ্যুৎ বেগে ছুটে চলেছে অ্যানা রেড জোনের ভেতরের তার চিরচেনা সেই জায়গাটিতে। বৃষ্টির কারণে জঙ্গলের মাটি ভিজে উঠে স্যাতস্যাতে হয়ে গেছে, অন্ধকারের ভেতরে ঘন জঙ্গলের ভেতর কার মোটা মোটা গাছ গুলো ঝড়ের দাপটে একে বেকে এসে একটা অন্যটাকে আঘাত করছে। তাদের আঘাতের কারণে অদ্ভুত রকমের ক্যাচক্যাচ শব্দ হচ্ছে। এই অন্ধকারের মাঝে সে শব্দ গুলো ভয়ানক শোনাচ্ছে। মাঝে মাঝে সে গাছ গুলো হুটোপুটি করে অ্যানার সামনে এসে পড়ে ওর রাস্তা আটকে দিচ্ছে৷ কিন্তু অ্যানার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, গাছ গুলো অ্যানার পথ আটকাতে পারছে না। অ্যানার শরীরের আঘাতে সেগুলো ভেঙে গুড়িয়ে ছিটকে যাচ্ছে চারদিকে, আর সে ভেঙে পড়া গাছ গুলোকে পা দিয়ে মাড়াতে মাড়াতে বিধ্বংসী রূপে রেড জোনের ভেতর দিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট স্থানের উদ্দ্যেশ্যে ছুটে চলেছে অ্যানা৷
ঝড়ের বেগে ছুটতে ছুটতে নিজের গায়ের হুডিটা এক টান দিয়ে খুলে কোথাও ছুড়ে মারলো ও। আর হুডি টা খুলে নিজের হাত জোড়া শুন্যে তুলে ধরে গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে নিচের দিকে নিয়ে আসলো, আর তার সাথে সাথেই অ্যানার কালো কুচকুচে, লম্বা চুলের বেণী জোড়া উন্মুক্ত হয়ে খুলে গিয়ে ওর পিঠময় ছড়িয়ে পড়লো। আর পরমুহূর্তেই সেগুলো ধবধবে সাদা বর্ণ ধারণ করে, অ্যানার ঝড়ের গতিয়ে ছুটে যাওয়ার কারণে বাতাসে ওড়াওড়ি করতে করতে অদ্ভুত সুন্দর হরেক রঙের আঁচড় কেটে বাতাসের সাথে খেলা শুরু করলো৷
আর তার পরমুহূর্তেই অ্যানার কুচকুচে কালো রঙা চোখ জোড়ার সেই কালো রঙা আর্টিফিশিয়াল লেন্স জোড়া খুলে পড়ে গেলো কোন ঝোপ ঝাড়ের ভেতর, আর তারপরই সে আর্টিফিশিয়াল লেন্সের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো এক জোড়া হীরকোজ্জল চোখ, যেন সে চোখ জোড়াতে কেউ দুই টুকরা হীরকখণ্ড বসিয়ে দিয়েছে! অ্যানার দৌড়ানোর গতির সাথে সাথে বেড়ে যেতে লাগলো সে চোখ জোড়ার উজ্জলতা, অদ্ভুত সুন্দর দ্যুতি বেরিয়ে আশপাশ টাকে আলোকিত করে তুললো তারা!
অস্বাভাবিক ভাবে চিৎকার করতে করতে জঙ্গল কাপিয়ে ছুটতে ছুটতে অ্যানা এক সময় এসে পৌছালো তার কাঙ্খিত গন্তব্যে৷ আর তারপরই ধীরে ধীরে ছোটার গতি কমিয়ে দিলো ও, এরপর নিজের সামনে তাকিয়ে মৃদু পায়ে এগোলো তার সে গন্তব্যের দিকে৷ সেই সাথে আস্তে আস্তে থেমে এলো ওর সে আর্তনাদ!
কিন্তু অ্যানার করা সে আর্তচিৎকারে এতক্ষণে সচকিত হয়ে উঠেছে রেড জোনের সমস্ত প্রাণী কুল। নিজেদের বাসস্থান থেকে তারা ছুটে এসেছে তাদের চিরচেনা সেই মায়াবী মানবী টাকে এক পলক দেখার জন্য, আর এসেছে অ্যানার পূর্বনির্ধারিত সেই গন্তব্যের কাছেই, যেন তারা আগে থেকেই জানতো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে অসহ্যকর যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ছুটে আসা মানবী টি এখানেই আসবে।
অ্যানা দাঁড়িয়ে আছে মাথা তুলে, চোখে ওর পানির রেশ, কান্নার কারণে ফোপাচ্ছে ও এখনো, কপাল কুচকে আছে তীব্র যন্ত্রণার কারণে! ওর সামনে দন্ডায়মান, হাজার বছরের পুরনো, বিশালাকৃতির কান্ড ওয়ালা একটি গাছ, যার স্বর্ণোজ্জল ডালপালা গুলো বিস্তৃত হয়ে আছে আশেপাশের সমস্ত অঞ্চল জুড়ে। সে গাছের সমস্ত শরীর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে সোনা রঙের দ্যুতি। আর সে দ্যুতি ছড়ানো ডাল গুলোতে ফুটে আছে হীরক খন্ডের ন্যায় অসংখ্য উজ্জ্বল ফুল, যাদের শরীরে গাছ থেকে নির্গত হওয়া স্বর্ণাভ আলোচ্ছটা প্রতিফলিত হয়ে চারদিক টা আরও বেশি মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে।
গাছ টির পেছন দিকে একটা ছোটখাটো ডোবা, পরিষ্কার ঝকঝকা তার পানি। সেখানে ফুলে আছে হরেক রকমের উজ্জ্বল জলজ ফুল, সে ফুল গুলোর শরীর থেকে নির্গত দ্যুতিতে আলোকিত হয়ে আছে সে ডোবার পানি, আর সে উজ্জলতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে হরেক রঙা ছোটো বড় মাছ এসে ভিড় জমাচ্ছে সে ফুল গুলোর চারপাশে। মাছ গুলোর প্রতিটা চলনে সে ডোবার পানিতে উৎপন্ন ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ গুলোতে নীলচে রঙা আলো খেলে যাচ্ছে।
ক্লান্ত পায়ে, ধীর গতিতে অ্যনা এসে দাড়ালো সে বিস্তৃত ডালপালা ওয়ালা গাছটির একেবারে নিকটে, আর এরপর পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে গাছ টির গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ধীর গতিতে বসে পড়লো গাছটির গা ঘেঁষে। আর গাছটির গা ঘেঁষে বসতেই সে গাছটির শরীর থেকে নির্গত স্বর্ণ রঙা আলোচ্ছটা অ্যনার শরীরের ভেতর প্রবাহিত হতে শুরু করলো রক্তের স্রোতের মতো, আর তখনি সে গাছ টি যেন জেগে উঠলো।
নিজের ডাল পালা নাড়িয়ে অ্যানার স্পর্শে সাড়া দিলো সে গাছ টি; আর তারপর নিজের সবচেয়ে নরম, কোমল পাতা ওয়ালা লতা টা দিয়ে অ্যানার সাদা রঙা, লম্বা কেশপূর্ণ মাথা টায় নিজের স্বান্তনার স্পর্শ হিসেবে ছুইয়ে দিলো৷ যেন নিজের সমস্ত ভালোবাসা, মায়া, মহব্বত সে অ্যানাকে দিয়ে দিলো,
আর সে গাছ টা অ্যনাকে ছুইয়ে দিতেই এতক্ষণে সামান্য শান্ত হওয়া অ্যানা গাছটির সেই ভালোবাসা পূর্ণ ছোয়ায় আবারও আকাশ বাতাস কাপিয়ে চিৎকার দিয়ে কেদে উঠলো! আর সেই মুহুর্তেই সামান্য শান্ত হওয়া বৈরি পরিবেশটা আবারও অশান্ত হয়ে উঠলো, তবে এবার আর ঝড় হলো না, হলো শুধু ঝুম বৃষ্টি৷ সে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে চাপা পড়ে গেলো অ্যানার আর্তনাদ!
অ্যানার আর্তচিৎকার বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে গাছ টিও নিজের ডাল পালা গুলো একিয়ে বেকিয়ে অ্যনা কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো। আর অ্যানা তাকে আলিঙ্গনরত গাছ টির ডাল পালা গুলোকে নিজের দু হাতে জড়িয়ে নিয়ে ফুপিয়ে আর্তনাদ করে উঠে সে গাছ টির উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো
— কেন আমাকে তার সাথে জড়িয়ে দিলে! তুমি কি জানতে না? তুমি জানা সত্বেও এমন টা কেন করলে? আর করলেই যখন কেন তার সমস্ত অনুভূতির সাথে আমাকে জড়িয়ে দিলে? কেন তার সমস্ত অনুভূতি আমি অনুভব করি! এমন টা কেন করলে তুমি! তুমি আমাকে তার করেই দিবে যখন তখন তাকে কেন পুরোপুরি আমার করে দিলে না! আমি এসব কিভাবে সহ্য করবো! আমি শেষ করে দেবো নিজেকে! এই জীবন আমার আর প্রয়োজন নেই। প্রতি পদে পদে এমন বিচ্ছেদ, এমন যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারবো না! আমি চলে যাবো এখান থেকে, সারা জীবনের জন্য! আমি আর একটা মুহুর্ত ও এখানে থাকতে চাই না! তুমি সবার সাথে আমার সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দাও, কাউকে প্রয়োজন নেই আমার! আমার মন থেকে, মস্তিষ্ক থেকে মুছে দাও সবাইকে! কাউকে চাই না আমার!
কথা গুলো বলে আবারও ফুপিয়ে কেদে উঠলো অ্যানা, আর গাছ টি তাকে নিজের সাথে আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিলো, যেন ছেড়ে দিলেই অ্যানা নিজের অভিমান ভরা শরীর টা নিয়ে চলে যাবে কোথাও, আর ফিরে আসবে না!
অ্যানার সে যন্ত্রণা ভর্তি চিৎকারে সে গাছ টির চার পাশে এসে জড়ো হওয়া প্রাণী গুলোও চুপচাপ হয়ে গেলো পুরোপুরি। ওই রাজকীয় মানবিটার অভিমান ভরা আর্তচিৎকারের শব্দে মনোকষ্টে মাথা টা নত হয়ে গেলো তাদের! ভারী বর্ষনের ভেতরেও তারা চারদিক থেকে ঘিরে বসে রইলো অ্যানা কে। আর অ্যানা, শিরো মিদরির প্রাণ, তার মাতৃ তুল্য গাছটিকে জড়িয়ে ধরে অনেক অনেক দিন পর নিজের মনের ভেতরের সমস্ত কষ্টগুলোকে কান্না আর আর্তনাদের সাথে শিরো মিদোরির জঙ্গলে ছড়িয়ে দিলো!
২৫. ভোর বেলা, সূর্যের এখনো আলো দেওয়ার সময় হয়নি। আশপাশ টা তখনো বেশ অন্ধকার হয়ে আছে৷ বাদশাহর খাস কামরার সামনে দাঁড়িয়ে আছে হুমায়রা তাইর, তার সাথে তার সহযোগী আফিয়া লেইলা সহ আরও কয়েকজন দাসী। তারা অপেক্ষায় আছে রুথের বেরোনোর৷
কিছুক্ষণ পরেই তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে খাসকামরা থেকে এলোমেলো পায়ে বেরিয়ে এলো রুথ। রুথ বের হতেই আফিয়া দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ধরে ফেললো আলুথালু বেশি রুথ কে। রুথ পায়ে জোর না পেয়ে পড়ে যেতে নিয়েও পড়লো না৷ আফিয়া রুথ কে সোজা করে দাড় করিয়ে দিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস কিরলো,
— তুমি ঠিক আছো?
রুথ নিজেকে সামলে নিয়ে আফিয়ার দিকে নিভু নিভু দৃষ্টি তে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো, তারপর উত্তর দিলো,
— হ্যা, একটু বেশিই ঠিক আছি।
বলে সামান্য শব্দ করে হেসে উঠলো৷ রুথের সে হাসির ইশারা বুঝতে পেরে আফিয়া মুখ টিপে হাসলো। ওদেরকে এমন হাসাহাসি করতে দেখে হুমায়রা তাইর ধমক দিয়ে বলে উঠলেন,
— হাসাহাসি পরে করবে, এখন এখান থেকে সরো। বাদশাহ এখনি এসে পড়বেন।
তারপর আফিয়া কে আদেশ করে বললেন,
— আফিয়া, রুথ কে নিয়ে গোসল খানায় যাও। গোসল শেষে ওকে হেকিমের কাছে নিয়ে যাবে, আর এর মাঝে রাজ বাবুর্চি কে খবর দিয়ে ওর জন্য উপযুক্ত খাবারের ব্যাবস্থা করবে।
আফিয়া মাথা নেড়ে সায় দিলে হুমায়রা তাইর সেখান থেকে প্রস্থান করলেন, দাসী গুলোও চিলে গেলো তার পেছন পেছন। আফিয়া আর রুথ পেছনেই পড়ে রইলো।
হুমায়রা তাইর দৃষ্টির আড়াল হতেই আফিয়া নিজের দুহাতে আগলে ধরে রাখা রুথকে নিয়ে হেটে সামনের দিকে আগাতে আগাতে রুথের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠলো,
— বাবাহ, তোমার মুখে তো কোনো ক্লান্তির ছায়াও দেখছি না! এমন অসাধ্য সাধন কিভাবে করলে শুনি?
রুথ লাজুক লতার মতো নুইয়ে পড়লো, তারপর বলল,
— কি করেছি, কি দেখেছি কিছুই জানিনা! শুধু এতটুকুই জানি যে গত রাতটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত ছিলো!
আফিয়া ঠোঁট টিপে হেসে সুর করে বলে উঠলো,
— হুমমমম, সে তো মুখের হাসি দেখেই টের পাচ্ছি!
— উনি….. উনি…… ওনার মতো পুরুষ আমি কখনোই দেখিনি! আমি যদি আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাউকে মনে রাখি তবে সেটা হয়তো তিনিই হবেন!
এলোমেলো গলায় বলে উঠলো রুথ! রুথের এমন কথা শুনে আফিয়া চাপা সুরে বলে উঠলো,
— জীবনে একপিসই দেমিয়ান পুরুষ দেখবে, আর তারপর সারাজীবন ধরে মনে রাখবে তাকে, এক মুহুর্তের জন্যও তাকে ভুলতে পারবে না! সারাজীবন মনে রাখার মতো রাতই তারা উপহার দেন!
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো আফিয়া, ওর সে হাসিতে লজ্জায় মুখ নেমে গেলো রুথের। স্মিত হাস্যে মুখ টা পরিপূর্ণ হয়ে গেলো ওর৷
.
সকালে বেলাতেই কুরো আহমার থেকে এক দল ছেলে এসেছে৷ তাদের কে সকাল বেলাতে রাজ কর্মচারী রা চোখ বেধে গাড়িতে করে দিয়ে গেছে ওয়ার্কিং জোনে। কিন্তু তারা এখানে আসা মাত্রই হট্টগোল শুরু করেছে।
ব্রায়ান ধারে কাছে নেই। সে ভোর বেলা উঠেই কিছুদিন আগে তার হাতে রোপণ করা গাছ গুলোর অবস্থা দেখতে গেছে। কাল রাতে যে ঝড় বৃষ্টি হয়েছে তাতে গাছ গুলো আস্ত আছে কিনা সেটাই দেখতে গেছে ও।
মিটিং জোনের ওপর দুইটা গাছের উপরিভাগ ভেঙে পড়ে আছে, সেগুলো অন্যান্য ওয়ার্কার্স রা মিলে সরিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করছে। আর নতুন ছেলে গুলো সেখানে এসেই সবাইকে প্রচন্ড উত্যক্ত করছে।
সংখ্যায় ওরা পনেরো জন। আর পনেরো জনই অসম্ভব রকম অসভ্য। যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই আজে বাজে কথা বলে খোচাচ্ছে। মেয়েগুলোকে বেশি বিরক্ত করছে, কাউকে সামনে পেলেই তার গায়ে হাত দিতে যাচ্ছে, আর অশ্লীল কথাবার্তা বলে তাদের কে আজেবাজে ইঙ্গিত দিচ্ছে।
শার্লট বৃষ্টির কারণে ভিজে যাওয়া ডাইনিং টেবিল টা শুকনা কাপড় দিয়ে মুছতে মুছতে নতুন ছেলে গুলোর এসব কর্মকাণ্ডই লক্ষ্য করছিলো।
সকালের খাবার খাওয়ার সময় হয়ে গেছে৷ অ্যানা কিচেনে রান্না করছে। রাতে সে তার মাঞ্জারে ছিলো না৷ কিন্তু ভোর বেলাতেই কই থেকে জানি উদয় হয়েছে সে। শার্লট ঘুম থেকে উঠে মিটিং জোনে এসে দেখে অ্যানা আগে থেকেই সেখানে বসে আছে৷ চোখ জোড়া লাল, হয়তো ঘুমায়নি সারা রাত। শার্লট জিজ্ঞেস করেছে কয়েকবার ওকে কি হয়েছে, কিন্তু অ্যানা কোনো উত্তর দেয়া দূরে থাক, কোনো কথাও বলেনি, হু হা ও করেনি। সেটা নিয়ে শার্লট খুবই চিন্তিত। আর তার ওপর এসে যোগ হয়েছে এই অসভ্য ছেলে গুলোর উৎপাত।
থিয়োডর কয়েকবার এসে ওদের কে সাবধান করে দিয়ে গেছে। ওয়ার্কার্স দের রুলস গুলোও কয়েকবার রিমাইন্ডার দিয়েছে, কিন্তু তাতেও ওদের কোনো হেল দোল নেই। যে যেভাবে পারছে অন্যদের কে বিরক্ত করছে।
কিন্তু শার্লটের ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেলো যখন ওয়ার্কার্স দের ভেতরের সব চেয়ে বয়স্ক লোক টাকে সে উগ্র ছেলে গুলোর একজন পায়ে পা বাধিয়ে ফেলে দিলো, আর সে লোক টির হাতে থাকা পানি ভর্তি বালতি টা লোক টির পায়ের ওপর এসে পড়লো।
বৃদ্ধ লোক টি মাটিতে পড়ে গিয়ে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলো। কিন্তু অসভ্য গুলো বৃদ্ধ কে সাহায্য করা তো দূরে থাক খ্যাকখ্যাক করে বিশ্রি ভাবে হেসে উঠলো। আর এটা দেখেই শার্লট নিজের হাতের কাপড় টা ছুড়ে ফেলে দিয়ে রাগী চোখে দ্রুত পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধ লোকটিকে ধরে মাটি থেকে তুলে দিতে দিতে ছেলেগুলোর উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
— এই কি শুরু করেছো তোমরা? ওনাকে এভাবে ফেলে দিলে কেন? এখানে তোমরা এসেছো কতক্ষণ হয়েছে? আসতে না আসতেই তোমরা এমন অসভ্যতামি শুরু করেছো! ওয়ার্কার্স দের রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনস অনুযায়ী তোমাদের এমন অসভ্যতামির শাস্তি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে সেটা পড়েছো নিশ্চয়?
ছেলে গুলো শার্লটের এমন হুমকিতে খ্যাকখ্যাক করে হেসে উঠলো আবারও। তারপর ওদের ভেতর কার একজন পেছন দিক থেকে বলে উঠলো,
— বেবি, তোমার এমন রূপে এমন চিৎকার মানাচ্ছে না। তোমাকে মানাবে বিছানায় জামা কাপড় খুলে বাধা অবস্থায়। সেখানের চিৎকার টাই তোমার সাথে খুব মানাবে বলে আমি মনে করি। ট্রাই করে দেখতে চাও কোনটা বেশি মানায়?
ছেলেটার কথা শেষ হতেই বাকি ছেকে গুলো আবারও বিশ্রি করে হেসে উঠলো৷ শার্লট বুঝলো এদের সাথে কথা বলে নিজের শুধু মুখ টাই নষ্ট হবে৷ তাই কোনো উত্তর না দিয়ে বৃদ্ধ লোকটাকে দু হাতে ধরে নিয়ে সে হেটে হেটে আবারও ডাইনিং এরিয়ার দিকে এগোতে লাগলো। আর সেই মুহুর্তে পেছন থেকে সেই আগের ছেলেটাই আবার বলে উঠলো,
— বেবি, ট্রাই করতে চাও না? আমার পারফরম্যান্স কিন্তু অনেক ভালো, ট্রাই না করলেই মিস!
ছেলেটার কথা শুনে শার্লটের পা জোড়া থেমে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে সে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই অ্যানার কঠিন স্বর শোনা গেলো সেখানে,
— তোমার পারফরম্যান্স জঙ্গলের কুকুর কে গিয়ে দেখাও, এখানের মেয়েদের তোমাদের মতো কুকুর দের প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই৷ দ্বিতীয় বার এমন কথা বলতে শুনলে জিভ টেনে ছিড়ে ফেলবো। আজ শিরো মিদোরিতে তোমাদের প্রথম দিন, আজকের দিন টা চিরস্মরণীয় করে রাখতে না চাইলে এই মুহুর্তে এইখান থেকে চলে যাও।
ছেলে গুলো অ্যানার এমন ঠান্ডা, কঠিন স্বরে কিছু সময়ের জন্য থমকে গেলো। কোনো এক অজানা কারণে ওরা আর কোনো কথা বলল না৷ একে অপরের সাথে চাপা গলায় কথা বলে পেছন দিকে ফিরে নিজেদের মাঞ্জারের দিকে পা বাড়ালো। আর তখনই পেছন থেকে অ্যানা আবারও আগের মতো করে বলে উঠলো,
— ওয়ার্কার্স দের রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন্স গুলো আজ রাতের ভেতরেই ভালোভাবে মেমরাইজ করে নিও, নইলে সেগুলো আমি মেমরাইজ করিয়ে দেবো৷ আর আমি মেমরাইজ করালে শুধু ওয়ার্কার্স দের রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন্সই মনে থাকবে, আর বাকি সব ভুলে যাবে।
ছেলে গুলো আর একবার অ্যানার দিকে চোরা চোখে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে হেটে চলে গেলো মাঞ্জারের দিকে। যেন অ্যানার দৃষ্টি থেকে আড়াল হতে পারলেই বেচে যায় ওরা।
চলবে……
( আমার শরীর টা বেশি ভালো নেই, লিখতে পারছিনা, তবুও লিখেছি। ভুল ভ্রান্তি থাকতে পারে অনেক, কিছুটা খাপছাড়াও হতে পারে। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন 💙)