#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_২৩
#আ_মি_না
৪০. প্রায় এগারোটা নাগাদ ওয়ার্কিং জোনে ফিরলো অ্যানা। ফিরেই পানিশমেন্ট এরিয়াতে হাত পা বেধে পড়ে থাকা নতুন ওয়ার্কার ছেলে গুলোকে দেখে একটু অবাকই হলো ও৷ অ্যানা কে পানিশমেন্ট এরিয়ার দিকে তাকাতে তাকাতে মিটিং জোনের দিকে আসতে দেখে ডাইনিং এরিয়া সাফ করতে থাকা শার্লট হাত থেকে ক্লিনার টা ফেলে ছুটলো ওর দিকে। তারপর অ্যানার কাছে এসে বলল,
— কোথায় গেছিলি তুই? তোকে সকাল থেকে না পেয়ে কত টেনশনে ছিলাম জানিস!
অ্যানা শার্লটের দিকে এক পলক তাকিয়ে ওর প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়েই পালটা প্রশ্ন করলো,
— সকালের রান্না কে করেছে?
শার্লটের প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ায় মনোক্ষুণ্ণ হলো ও। কন্ঠ কিছুটা নামিয়ে ও বলল,
— ভোর বেলা প্রাসাদ থেকে দুজন বাবুর্চি এসেছে। রান্নার কাজ টা এখন থেকে ওরাই করবে। আর তোর লিভ অ্যাপ্লিকেশন গ্রান্ট হয়েছে। ভাইয়ার কাছে সকালেই খবর এসেছে৷ এক সপ্তাহের জন্য ছুটি পেয়েছিস তুই। কিন্তু তুই যাবি কোথায়?
অ্যানা এবারও শার্লটের প্রশ্নের উত্তর দিলো না। পানিশমেন্ট এরিয়ায় পড়ে থাকা ছেলে গুলোর দিকে তাকিয়ে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলো,
— ওদের কে ওইখানে এভাবে বেধে রাখা হয়েছে কেন? কি করেছে ওরা?
— ওরা কাল রাতে আউটসাইডার্স দের তিনটা মেয়েকে রে*প করার চেষ্টা করেছে। তাই ভাইয়া ওদের কে এক সপ্তাহের জন্য ওভাবেই বেধে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর ওদের খাবারও বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু সেসব কথা বাদ, তুই আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিস না কেন? কি লুকাচ্ছিস তুই আমার থেকে? আর কোথায় গেছিলি তুই ভোর সকালে? নাকি তুই তোর মাঞ্জারেই ছিলি না সারারাত?
শেষোক্ত প্রশ্ন গুলো সন্দিহান চোখে তাকিয়ে করলো শার্লট৷ কিন্তু অ্যানা শার্লটের প্রশ্ন গুলো আবারও পুরোপুরি উপেক্ষা করে ওর দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— ব্রায়ান কোথায়?
অ্যানার এমন আচরণে মন ভেঙে গেলো এবার শার্লটের। বিষাদ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে অ্যানাকে হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিলো ব্রায়ানের অবস্থানের দিকে৷ প্রাণ প্রিয় এই প্রিয়জন টির থেকে এমন উপেক্ষা পেয়ে কন্ঠ রোধ হয়ে এলো ওর। মুখ থেকে কোনো শব্দই আর বের হলো না শার্লটের। আর অ্যানা শার্লট কে পাশ কাটিয়ে শার্লটের দেখিয়ে দেওয়া রাস্তার দিকে হেটে চলল ব্রায়ানের খোজে।
ব্রায়ান মিটিং জোন থেকে বেশ খানিক টা দূরে, ব্লু জোনের কাছাকাছি একটা জায়গায় সদ্য পোতা কিছু গাছের পরিচর্যা করছিলো। হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ফিরে তাকালো ও। আর এরপর কালো রঙা হুডি আর ট্রাউজার পরিহিতা অ্যানা কে ওর দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্রই এতক্ষণের কর্মক্লান্তি নিমিষেই মুখ থেকে উধাও হয়ে গেলো ওর, সেখানে এসে ভর করলো এক রাশ মিষ্টি হাসি। হাতে থাকা সরঞ্জামাদি গুলো মাটিতে ফেলে উঠে দাড়িয়ে ময়লা মাখা হাত দুইটা পরণের প্যান্টে ঝেড়ে নিলো ব্রায়ান, তারপর অ্যানার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখ করেই বলল,
— কি ব্যাপার? তোমাকে তো সকাল থেকে খুজেই পাচ্ছি না! কোথায় ছিলে?
অ্যানা কিছুক্ষণ নিরব থেকে নরম গলায় উত্তর দিলো,
— এইতো, একটু হাটাহাটি করতে গেছিলাম আর কি!
— বাহ! খুবই ভালো খবর। নিজের দিকে একটু বেশি বেশি খেয়াল রাখো। আর হ্যা! তোমার লিভ অ্যাপ্লিকেশনটা গ্রান্ট হয়েছে, সকালেই খবর এসেছে।
শেষোক্ত কথা টা কিছুটা উচ্ছসিত হয়েই বলল ব্রায়ান। অ্যানা আগের মতোই নরম গলাতে বলল,
— হ্যা, শুনেছি। শার্লট বলল।
তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে অ্যানা বলে উঠলো,
— ব্রায়ান, তোমার যদি আপত্তি না থাকে তবে আমি আজ থেকেই লিভ নিতে চাই।
ব্রায়ান শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো একবার অ্যানার চোখ জোড়ার দিকে। অ্যানা আজকাল খুবই অন্যরকম বিহেভ করছে। আগে ও এমন ছিলো না৷ এমন উদাসীন হয়ে থাকতে অ্যানাকে কখনোই দেখেনি ব্রায়ান৷ কিছুক্ষণ নিরব থেকে ব্রায়ান বলল,
— হ্যা অবশ্যই, আমার কোনো অসুবিধা নেই। তোমার যখন ইচ্ছা তুমি লিভ নিতে পারো। কিন্তু তুমি কোথায় যাবে?
— লোকেশন টা বলতে পারবো না। তবে আমি নিজের মতো করে থাকতে চাই কিছুদিন। লোকসমাগম থেকে দূরে৷
সামান্য নতমুখী হয়ে উত্তর করলো অ্যানা। ব্রায়ান পূর্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অ্যানার চোখ জোড়ার দিকে। একমুহুর্তে ওর মনে হলো কিছুই ঠিক নেই। কিছু একটা অ্যানা কে ঠিক থাকতে দিচ্ছে না৷ কিন্তু অ্যানার সাথে তার সম্পর্ক টা এমন না যে সে অকপটে জিজ্ঞেস করবে যে তোমার কি হয়েছে? আর যদি জিজ্ঞেস করেও ফেলে সাহস করে তবে অ্যানার থেকে কখনোই সে কোনো সদুত্তর পাবে না৷ অ্যানা বরাবরের মতোই এড়িয়ে যাবে তাকে, শার্লট কেও। নিজেকে, নিজের ব্যাক্তিগত দিক টা কে অ্যানা যক্ষের ধনের মতো করে আগলে রাখে, সেখানে কারোরই প্রবেশাধিকার নেই। ব্রায়ান একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো,
— ঠিক আছে, নিজেকে সময় দাও। আর হ্যা, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি, প্রাসাদ থেকে দুজন বাবুর্চি কে পাঠানো হয়েছে, এখন থেকে রান্নার ব্যাপার টা ওরাই সামলাবে, তোমাকে আর রান্না করতে হবে না৷ তুমি তোমার লিভ থেকে ফিরে এসো, তারপর তোমাকে তোমার নতুন কাজ বুঝিয়ে দেবো।
ব্রায়ানের কথায় অ্যনা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে যেতে নিলো। পেছন ফিরে কয়েক পা এগোনোর পর ব্রায়ান হঠাৎ করেই ডেকে উঠলো,
— অ্যানা!
অ্যানা পা জোড়া থমকে দাড়ালো, তারপর ঘাড় টা সামান্য পেছন দিকে ঘুরিয়ে বলল,
— জ্বি।
— তোমাকে যদি আমার সাথে থেকে কাজ করতে বলি তবে কি তোমার কোনো আপত্তি আছে?
অ্যানা সেভাবে দাড়িয়েই কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত কন্ঠে উত্তর দিলো,
— তুমি ওয়ার্কার্স দের লিডার, তুমি আমাকে যে কাজ দিবে আমি সে কাজই খুশি মনে করবো ব্রায়ান। আমার মতামত শোনার প্রয়োজন নেই।
কথা টা বলেই নিজের গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালো অ্যনা। আর ব্রায়ান অ্যানার দেওয়া উত্তরে খুশি হয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।
৪১. প্রাসাদের সিড়ি বেয়ে, স্বর্ণ খচিত হাতল ধরে নামীরের কামরার উদ্দ্যেশ্যে দ্রুত পায়ে হেটে চলেছে রুথ। পাশে ওর আফিয়া। রুথের চোখে মুখে উচ্ছাস, ওই স্বর্ণ চোখের সুদর্শন পুরুষ টাকে না দেখা পর্যন্ত ওর শান্তি হচ্ছে না, উদভ্রান্তের মতো নিজের হাটার দিকে মনোযোগ না দিয়েই হেটে চলেছে ও, ফলে মেঝেতে টেনে টেনে যাওয়া নিজের পরণের গাউনের সাথে বার বার উষ্টা খাচ্ছে সে৷ আফিয়া ওকে বার বার বলছে আস্তে যেতে কিন্তু রুথ সে কথা শুনছে না।
নিজেকে আজ সবচেয়ে সুন্দর করে সাজিয়েছে ও, যেন সেই সুদর্শন পুরুষ টার মন একটু হলেও জয় করতে পারে সে৷ কামরায় বসে বসে নিজেকে সাজিয়ে বার বার আয়নার সামনে গিয়ে দাড়িয়েছে, আর আয়নায় ফুটে ওঠা নিজের প্রতিবম্ব কে প্রশ্ন করেছে, কে সেই নারী যে কিনা ওই আগুন চোখের অত্যান্ত শক্তিশালি পুরুষটিকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে! তার সামনে দাঁড়ানো এই প্রতিবিম্ব টার থেকেও কি সে বেশি সুন্দরী? বেশি আবেদনময়ী?
রুথের চোখ ভরা স্বপ্ন। আজ এই দুপুরের আগ মুহুর্তে সে বাদশাহর কামরায় ঢুকবে, আর তারপর নিজের সমস্ত ছলা কলা দিয়ে বাদশাহ কে নিজের সাথে গেথে নিবে, এই পুরুষটির ভাগ সে কাউকে দিবে না। সবার স্পর্শ সে ওই পুরুষ টির শরীর থেকে মুছে ফেলবে। ভাবতে ভাবতে আরও একবার নিজের পোশাকে বেধে পড়ে যেতে নিলো রুথ। কিন্তু তার আগেই আফিয়া ওকে ধরে ফেলে বলল,
— সাবধানে হাটা চলা করো মেয়ে! এত আনন্দের কিছু নেই। উনি যদি প্রাসাদে না থাকেন তবে তোমারও আর দেখা করা হবে না। তাই আগের থেকেই এত লাফালাফি করো না। আর উনি প্রাসাদে থাকলেও, তোমাকে যে তার সাথে দেখা করার অনুমতি দেবেন এইটারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
রুথ সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
— তুমি চিন্তা করো না কালবী, সব ঠিক ঠাকই থাকবে, আর ওনাকেও পাবো। তুমি শুধু আমাকে ওনার কামরা পর্যন্ত পৌছে দাও, তার পরের বিষয়টা আমি দেখবো।
আফিয়া রুথের দিকে এক পলক তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
— এই মেয়েটার মাথা টা পুরোপুরি গেছে!
খানিক্ষন বাদেই ওরা উঠে এলো একটি ফ্লোরে, তারপর বারান্দা দিয়ে হাটতে হাটতে এক সময় এসে দাড়ালো নামীরের কামরার সামনে। সেদিন অনেক রাত হওয়ার কারণে চারপাশ টা রুথের নজরে পড়েনি, কিন্তু এখন প্রাসাদের এই লেভেল টাকে খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো রুথ। এই প্রাসাদে আসার পর থেকে প্রাসাদের যত টুকু জায়গা ও দেখেছে তার ভেতরে সব চেয়ে বেশি আভিজাত্যপূর্ণ এই লেভেলটি। হতেই হবে! যেখানে স্বয়ং বাদশাহ থাকেন সেখানটা আভিজাত্যপূর্ণ হওয়াটাই স্বাভাবিক, না হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক!
রুথ চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো, আর আফিয়া ওকে দাড় করিয়ে রেখে এগিয়ে গেলো নামীরের কামরার সামনে দাঁড়ানো নামীরের প্রধাণ দুই দেহরক্ষীর দিকে। ওদের সাথে খানিক্ষন কথা বার্তা বলেই রুথের কাছে ফিরে এলো অ্যানা, তারপর বলল,
— এখন দেখা হবে না৷
রুথ ভ্রু জোড়া উচু করে জিজ্ঞেস করলো,
— কেন? উনি প্রাসাদে নেই?
— আছেন, তবে উনি কামরায় ঢোকার আগে বলেছেন কেউ যেন ওনাকে বিরক্ত না করে৷ ওনার দেহরক্ষী রা জানালো উনি কাল সারারাত প্রাসাদের বাইরে ছিলেন, কিছুক্ষণ আগেই এসেছেন। আর তাছাড়া উনি নাকি ভয়ানক রেগে আছেন, এই মুহুর্তে ওনাকে বিরক্ত করার অর্থ ক্ষুধার্ত সিংহের খাচায় ঢুকে নিজেকে সিংহের মুখে তুলে দেওয়া। ফিরে চলো!
কিন্তু আফিয়ার কথায় নিজের ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে নিলো রুথ, তারপর রাগ দেখিয়ে বলল,
— তুমি ইচ্ছে করে আমার সাথে এমন করছো তাই না? যাতে আমি বাদশাহ কে না দেখতে পারি! তার কাছে যেতে না পারি!
রুথের এমন ব্যাবহারে থতমত খেলো আফিয়া। চারদিকে একবার পরখ করে নিয়ে চাপা সুরে বলে উঠলো,
— রুথ, তোমার আওয়াজ নিচে করো। আর আমাকে কি বলছো সেটা একবার ভেবে দেখো। তোমাকে ওনার কাছে যাওয়া থেকে আটকে আমার তো কোনো লাভ নেই! ফিরে চলো এখন, দেখা হবে না।
আফিয়ার কথা শুনে রাগে গজরাতে গজরাতে পেছন ফিরে আগে আগে চলে যেতে শুরু করলো রুথ, আর ওর পেছন পেছন এগোতে লাগলো আফিয়া। কয়েক কদম সামনে আগানোর পরই রুথের চোখ গেলো নামীরের কামরা পাশ দিয়ে চলে যাওয়া একটা সরু জায়গার দিকে। সেদিকে একনজর তাকাতেই রুথ টের পেলো সে সরু জায়গাটার দু পাশের দেয়াল টা অসম্ভব সুন্দর কারুকার্য খচিত। দিনের আলোর কিঞ্চিৎ অংশ পড়ে সে দেয়ালের ওপরে খচিত মহামূল্যবান পাথর গুলো ঝিকিমিকি করছে৷ রুথ সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে গেলো সেখানে তারপর তার পেছন পেছনে আসা আফিয়ার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— এই জায়গাটা কিসের কালবী?
— ওটা আমাদের বেগমের কামরায় যাওয়ার রাস্তা। আমাদের বাদশাহ আর বেগমের কামরা পাশাপাশিই অবস্থিত। কয়েকজন বিশেষ মানুষ আর বিশেষ কর্মচারী ছাড়া বেগমের কামরায় ঢোকার অনুমতি কারো নেই৷ আর এখন যেহেতু বেগম নেই তাই সেখানে কারোরই ঢোকার অনুমতি নেই। শুধুমাত্র দুজন কর্মচারী রোজ এসে কামরা টা পরিষ্কার করে দিয়ে যায়, সেটাও বাদশাহর উপস্থিতিতে।
রুথ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
— কেন? এত সিকিউরিটি কেন? কি আছে ওখানে?
— সেটা জানিনা, তবে আমাদের বাদশাহ বরাবরই আমাদের বেগম কে নিয়ে একটু বেশিই সচেতন, বলতে পারো বাড়াবাড়ি রকমের। তবে যতটুকু জানা যায়, আমাদের বেগম ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার হত্যার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন, যার জন্য উনি বেগমের নিরাপত্তার ব্যাপার টিকে খুব জোর দিয়ে দেখেন৷ এখন এখান থেকে চলো। ওনার কামরায় যাওয়ার রাস্তাতেও বেশিক্ষণ দাঁড়ানো নিষেধ।
বলেই রুথ কে টানতে টানতে সেখান থেকে নিয়ে গেলো আফিয়া। তারপর রুথের হাত ছেড়ে দিয়ে সিড়ি বেয়ে নেমে এলো আরও দুই লেভেল নিচে। কিন্তু হঠাৎ করেই নিজের পেছন দিক টা নিরব অনুভব করলো আফিয়া। খটকা লাগলো তার, সাথে সাথেই পেছন ফিরে তাকালো সে। কিন্তু রুথ কে দেখতে পেলো না কোথাও৷ তার অগোচরেই রুথ কোথাও চলে গিয়েছে। আর রুথ ঠিক কোথায় যেতে পারে সেটা বুঝতে আফিয়ার আর বেগ পেতে হলো না। সাথে সাথেই বুকের ভেতর ধক করে উঠলো আফিয়ার। দ্রুত গতিতে আবার সিড়ি বেয়ে নিজের ফেলে আসা গন্তব্যের দিকে ছুটে চলল আফিয়া।
.
নামীরের কামরার সামনে দাঁড়ানো দেহরক্ষী দুজন তাকিয়ে ছিলো নিজেদের সামনের দিকে, হঠাৎ করেই লম্বা বারান্দা বেয়ে রুথ কে এইভাবে ছুটে আসতে দেখে তাদের ভেতরের প্রথম জন দ্বিতীয় জন কে উদ্দ্যেশ্য করে বলে উঠলো,
— একে কি আমাদের আটকানো উচিত?
প্রথম জনের প্রশ্নের উত্তরে দ্বিতীয় জন বলল,
— না। যে স্বেচ্ছায় সিংহের খাচায় যেতে চায় তাকে সেখানে যেতে দেওয়াই উচিত।
কথা টা বলেই দুজনে একে অপরের দিকে না তাকিয়েই নিঃশব্দে হাসলো। আর তার পরমুহুর্তেই রুথ ঢুকে গেলো অ্যানার কামরায় ঢোকার রাস্তাতে। আর তারপর অ্যানার কামরার স্বর্ণ খচিত নকশাদার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাতে দরজার দুই পাল্লা দুদিকে ঠেলে সরিয়ে দিতেই রুথের সামনে উন্মুক্ত হলো অ্যানার কামরা টা। আর সে কামরার ভেতর টা দেখতেই রুথের চোয়াল নেমে এলো!
সমস্ত কামরার দেয়াল গুলোতে মহামূল্যবান সাদা আর স্বর্ণালি রঙা পাথরের কারুকার্য, আলো টিকরে টিকরে পড়ছে সেগুলো থেকে। কামরার আসব পত্র গুলো সবই এক অদ্ভুত গাঢ় লাল রঙা কাঠের, সেগুলোর ওপর দিয়ে লতাপাতার ন্যায় অসম্ভব সুন্দর সাদা পাথরের কারুকার্য। সাদা রঙা দেয়ালের ভেতরে গাঢ় লাল রঙা সে আসবাব পত্র গুলো অসম্ভব রকম সুন্দর হয়ে ফুটে আছে। কামরার মার্বেল পাথরের মেঝে টাতে ফুটে আছে এক গাঢ় নীল পানির ঝর্ণার প্রতিকৃতি, মনে হচ্ছে যেন মেঝেতে পা দিলেই সে ওই ঝর্ণার ধারার সাথে বয়ে চলে যাবে দূরের কোনো এক অজানায়। মেঝের ওপরে কামরার সিলিং এ খচিত পাথরের কারুকার্য থেকে টিকরে পড়ছে আলো, পুরো কামরাটিকেই মহোনীয় করে রেখেছে যেন সে আলোচ্ছটা!
এসব দেখতে দেখতেই আবেশে তাড়িত হয়ে কামরার ভেতর পা রাখলো রুথ, তখনি তার চোখ পড়লো কামরার বিছানাটার দিকে। সাগরের ভেতরে পাওয়া মুক্তা ভর্তি ঝিনুকের খোলশের আকৃতির ন্যায় একটি ধবধবে সাদা রঙা বিছানা, সে বিছানার ওপর পড়ে আছে মুক্তার রঙের ন্যায় অসাধারণ সৌন্দর্যমণ্ডিত, মোলায়েম ফ্যাব্রিকের নকশাদার বিছানা বালিশ।
আর সে বিছানাটিকে পরখ করার মুহুর্তেই রুথের চোখ আটকে গেলো বিছানার ভেতরে বালিশ বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকা একটি বিশালাকৃতির কুচুকুচে কালো রঙা অবয়বের দিকে। বুকের ভেতর ধক করে উঠলো রুথের। কি ওইটা! এইখানে এই মুহুর্তে কি থাকতে পারে? বাদশাহ কে সে দেখেছে, ওই অবয়ব টা বাদশাহর হওয়ার প্রশ্নই আসে না! তাছাড়া ওই অবয়ব টা কোনো মানুষের হতে পারে না! এমন কালো রঙ জন্তু জানোয়ার ছাড়া কোনো সাধারণ মানুষের হতে পারে না কখনোই। তবে এটা কি? আর এটা বেগমের কামরাতেই বা কেন?
দ্বিধা ভরা পায়ে সেদিকে এক দুই কদম করে এগিয়ে গেলো রুথ৷ আর তারপর বিছানার কাছাকাছি এসে বিছানায় শুয়ে থাকা কালো রঙা অবয়ব টিকে ভালো ভাবে দেখতে গেলো ও, আর ঠিক সেই মুহুর্তেই ধাম করে চোখ মেলে তাকালো সে অবয়ব টি। আর অবয়ব টি চোখ মেলে তাকাতেই তার চোখের জ্বলজ্বলরত সোনা রঙা উজ্জলতা দেখে রুথের আর বুঝতে বাকি রইলো না সে কে। নিমিষেই ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো ওর।
পরমুহুর্তেই সে বিছানায় শোয়া থেকে উঠে বসলো নামীর। আর নামীর উঠে বসা মাত্রই ওর সোনা রঙা চোখ জোড়ার সে ভয়ঙ্কর, হিংস্র চাহনী আর শক্ত চোয়াল দ্বয় দেখে আত্মা কেঁপে উঠলো রুথের। ভয়ে কেঁপে উঠে বড় বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে এক পা দু পা করে পেছনে এগোতে শুরু করলো ও৷ আর ভয়ে আটকে যাওয়া কন্ঠে বাধো বাধো করে বলে উঠলো,
— আ-আমার ভু-ভুল হয়ে গেছে! আ-আমি আর ককখনোই আসবো এখানে! আ-আমাকে খ-ক্ষমা করে দিন! আ-আর হবে না এর-রকম!
আর এরপর দরজার কাছে পৌছে জোরে একটা দম নিয়ে উর্ধশ্বাসে সে কামরা থেকে রুথ ছুটে পালানোর আগ মুহুর্তেই বিছানা থেকে তড়িৎ গতিতে ছুটে এসে নিজের পেশিবহুল, ইস্পাত-দৃঢ় হাতের বিশাল থাবা টা দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রুথের গলা চেপে ধরে দেয়ালের সাথে বাড়ি দিয়ে ঠেসে ধরলো নামীর। আর অলৌকিক শক্তিধর নামীরের হাতের চাপ টা রুথের গলায় গভীর ভাবে পড়া মাত্রই দম আটকে গেলো রুথের। আর তার কিছুক্ষণ পরেই জিভ টা বের হয়ে নাক মুখ দিয়ে রক্ত উঠে পুরোপুরি স্থীর হয়ে গেলো রুথের দেহটা। আর এরপর রুথের সে স্থীর হওয়া দেহটা সামান্য টেনে নিজের দিকে নিয়ে এসে নামীর ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
— ব্যি কেয়ারফুল নেক্সট টাইম!
আর বলেই রুথের নিথর দেহটা ছুড়ে দিলো দরজার বাইরে৷ তারপর দরজা টেনে দিয়ে আবার নিজের দেহ টা নিয়ে গেলো অ্যানার বিছানায়।
নামীরের কামরার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দেহরক্ষী দুজনের একজন অন্যজনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— ল্যেটস ড্যু আওয়ার ডিউটি।
৪২. এখন অনেক রাত। হাতে একটা বড়সড় ব্যাগ নিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন রেড জোনের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দ্রুত পায়ে হেটে চলেছে অ্যানা। পরণে ওর একটা ঢোলা ঢালা শার্ট আর প্যান্ট। ওর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে সামনের দিকে এগোচ্ছে ফ্যালকন৷ লিন্ডা উঠে বসে আছে ওর ব্যাগের ওপরে৷ উদ্দ্যেশ্য ওদের সমুদ্র তীর৷ এই সমুদ্র তীর টা শুধুমাত্র রাজপরিবারের সদস্যদের ব্যাবহারের জন্য। এছাড়া অন্য কারো ব্যাবহারের অনুমতি নেই, কোনো রাজ কর্মচারীর ও না৷ রেড জোনের ভেতরে হওয়ায় কোনো সাধারণ মানুষ এর অস্তিত্বও জানে না৷ আর যদি ভুল করেও কেউ এসে পড়ে তবে তার পরিণতি নির্ঘাত মৃত্যু, কারণ এই পোর্ট টি সর্বক্ষণ পাহারা দেয় এক ভয়ঙ্কর সল্টওয়াটার ক্রোকোডাইল, নাম তার কোকো।
অ্যানারা যখন পোর্টে এসে পৌছালো তখন মধ্যরাত পেরিয়ে রাতের তৃতীয় প্রহরের সূচনা হচ্ছে৷ ফ্যালকন এসে উড়ে গিয়ে বসলো পোর্টের পাশে থাকা একটি পোলের মাথায়৷ আর অ্যানা এসে দাড়ালো পোর্টে থাকা তার ব্যাক্তিগত, অত্যাধুনিক আর আভিজাত্যপূর্ণ মিনি ইয়টের সামনে।
কোকো নামক প্রায় ত্রিশ ফিট দৈর্ঘ্যের সেই বিশালাকৃতির কুমির টি পোর্টের পাশেই চোখ বুজে পড়ে ছিলো। পোর্টে কারো উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই চোখ মেলে তাকালো সে। আর এরপর নিজের থেকে বেশ খানিক টা দূরে দাড়ানো অ্যানাকে দেখেই বিদ্যুৎ বেগে তেড়ে এলো সে অ্যানার দিকে, এসেই নিজের বিশাল শরীর টা নিয়ে এক প্রকার লাফিয়ে পড়লো অ্যানার ওপর৷ কিন্তু কোকো এসে অ্যানার শরীরের ওপর লাফিয়ে পড়ার আগেই অ্যানা কোকো কে জাপটে ধরে ফেলল, এরপর বক্সিং স্টাইলে ওকে ধরে উচু করে মাটিতে আছড়ে ফেলে দিয়ে ওর ওপর চেপে বসলো, আর বসামাত্রই পাশের পোলের মাথায় বসে থাকা ফ্যালকন দ্রুত গতিতে নিচে নেমে নিজের হিউম্যান ফর্মে এসে ওদের দুজনের পাশে বসে রেফারির ন্যায় মাটিতে থাবড়া দিতে দিতে কাউন্টিং শুরু করলো,
— ওয়ান, ট্যু, থ্রি!
আর কাউন্টিং শেষেই ফ্যালকন নুজের দু হাত দুদিকে দিয়ে বলে উঠলো,
— টিং টিং, টাইমস আপ!
সাথে সাথেই কোকো কে ছেড়ে দিলো অ্যানা৷ আর অ্যানার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পরই নিজের হিউম্যান ফর্মে ফিরে এলো কোকো। পরিণত হলো এক বিশাল দেহী, পেশিবহুল যুবকে। পরণে একটা কালো রঙা শার্ট ওর, আর নেভি ব্লু প্যান্ট। মাটিতে শুয়ে শুয়েই হাসতে হাসতে সে বলল,
— উফফ কত্তগুলো দিন পর আমাদের এইভাবে দেখা হলো! তাই না আম্মা?
অ্যানা মাটির ওপর দুই পা ক্রস করে বসে নিজের পেছনের মাটিতে হাত ঠেকিয়ে ভর দিয়ে পুরাতন স্মৃতি তে ডুব দিয়ে সেগুলো একবার হাতড়ে নিয়ে বলল,
— হ্যাঁ, অনেক দিন!
কোকোর জন্মের কিছুদিন পর এই সমুদ্র তীর থেকেই এক দল হাঙরের মুখে পড়ে কোকোর পরিবার। সেদিন নিজের সদ্য ফোটা বাচ্চাদের কে সাঁতার শেখাতে শেখাতে সমুদ্র তীর থেকে একটু বেশিই ভেতরে চলে গেছিলো কোকোর জন্মদাত্রী মা। কোকো সহ কোকোর অন্যান্য ভাইবোন ও ছিলো সেখানে। হঠাৎ করেই একদল হাঙরের আক্রমণে ঢেউয়ের প্রভাবে মায়ের থেকে ছিটকে তীরের দিকে চলে আসে কোকো, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার মা আর ভাইবোন গুলো সেখানেই মারা যায়, আর এরপর একে একে চলে যায় হাঙরের পেটে। চোখের সামনে মায়ের এমন নির্মম মৃত্যু দেখে ছোট্ট কোকো সেদিন স্থীর হয়ে যায়। আর এই সর্বহারা, এতিম কোকো কে তার কিছুদিন পরেই নজরে পড়ে অ্যানার। সেদিন থেকে কোকো কে লিন্ডার মতো নিজের কাছে রেখেই মানুষ করে অ্যানা। নিজের মাতৃস্নেহ ঢেলে দেয় সেই ছোট্ট বাচ্চা টাকে। তখন থেকেই কোকো অ্যানা কে আম্মা বলতে শিখেছে, অ্যানাই শিখিয়েছে। আর এরপর সেই ছোট্ট কোকো বড় হতে হতে একদিন তার বাবার মতোই বিশাল দেহের অধিকারী হয়ে পুরো সমুদ্র তীর টাকে অন্যান্য প্রাণিদের থেকে দখল করে নিয়ে একাই রাজ করছে। শুধুমাত্র এই কোকো ছাড়া আর কারোরই অধিকার নেই অ্যানা কে ছোয়ার বা আম্মা বলার।
সবাইকে এমন নিশ্চুপ দেখে ছিপছিপে গড়নের ফ্যালকন এসে বসলো বিশাল দেহী কোকোর পাশে। ফ্যালকন বসতেই কোকো ওর বাহুতে দিলো এক ধাক্কা। ফ্যালকন ক্ষেপে উঠে বলল,
— শোনো কোকো ভাইয়া, তুমি মোটেও তোমার ওই কুমিরের শরীর নিয়ে আমাকে ধাক্কাবে না! আমি একটা নিতান্তই ভালো মানুষ।
ফ্যালকনের এমন কথায় হেসে উঠলো কোকো আর অ্যানা দুজনেই। ফ্যালকন বরাবরই খুবই আবেগপ্রবণ আর ভীতু। ওদের ফ্যামিলির সবাই বরাবরই খুবই অ্যাডভেঞ্চারাস আর সাহসী, কিন্তু ফ্যালকন হয়েছে তাদের পুরাই উলটা৷
ফ্যালকন কে এইভাবে রেগে যেতে দেখে কোকো দুষ্টু হাসি হেসে অ্যানা কে লুকিয়ে ফ্যালকনের দিকে মুখ খানা এগিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
— শালা বেশি চিল্লাবি তো সেদিনের মতো তোর ডানা কামড়ে ধরবো, তখন বুঝবি মজা। সেদিন তো আম্মা ছিলো বলে বেঁচে গেছিলি, এইবার যেদিন তোকে ধরবো সেদিন আর আম্মার সামনে ধরবো না৷ এক কামড়ে তোকে নিজের পেটে পুরে নিবো। কিন্তু তোকে চিবোতে আমার রুচিতে বাধবে। তোর গা থেকে একটা পাতি হাঁস পাতি হাঁস গন্ধ আসে। এরকম নোংরা জিনিস আমি কখনোই খাইনা। তবুও তোকে শায়েস্তা করার জন্য এবার আমাকে খেতেই হবে৷
বলে কোকো মুখ দিয়ে ‘ইয়াক’ জাতীয় শব্দ করলো। অ্যানার থেকে লুকানোর চেষ্টা করলেও অ্যানা সব শুনেছে। ফ্যালকনের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসতে শুরু করলো অ্যানা। ফ্যালকন সেটা টের পেয়ে কোকোর দিকে তাকিয়ে ফুসে উঠে বলল
— শোনো কোকো ভাইয়া, মোটেও আমাকে অপমান করবে না! আমি রোজ সাবান দিয়ে গোসল করি! তোমার মতো শ্যাওলা মেখে বসে থাকিনা।
ফ্যালকনের কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো অ্যানা, আর কোকো কপট রাগ দেখিয়ে মারণ ভঙ্গিতে শার্টের হাতে গুটাতে গুটাতে বলল,
— হোই, কবে দেখেছিস রে আমি শ্যাওলা গায়ে মেখে বসে থাকি!
কোকোর মশন দেখে ফ্যালকন ভয় পেয়ে ‘শেহজাদীই’ বলে চিৎকার দিয়ে অ্যানার পেছনে গিয়ে লুকালো। আর অ্যানা এদের কান্ডকারখানা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো আবারও। ফ্যালকন অ্যানার পেছনে বসে বসে অ্যানার সে খিলখিলে হাসি শুনতে লাগলো। কতদিন পর অ্যানার এমন হাসি ও শুনেছে তার হিসাব নেই। এমন সময় হঠাৎ করেই দূর থেকে কে যেন বলে উঠলো,
— ওহ! তোমরা তাহলে আজকাল আমাকে ছাড়াই আড্ডা দেওয়া ধরেছো?
কোকো আর ফ্যালকন চকিতে তাকালো সেদিকে। লম্বা চওড়া সুঠামদেহী হাইনা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। হাইনা কে দেখতে পেয়ে কোকো ওর দিকে নিজের হাত টা উচু করে উচ্ছসিত কন্ঠে বলল,
— আরে, ভাই আমার! এদিকে কি মনে করে?
হাইনা ছেলেটা এগিয়ে এলো ওদের দিকে, এসে অ্যানার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা টা সামান্য নত করে অভিবাদন জানিয়ে বলে উঠলো,
— শেহজাদী!
অ্যানা হাইনা কে নিজের হাতের ইশারায় নিজের পাশের জায়গা টা দেখিয়ে বলল,
— আয়, বোস এখানে৷ এদিকে কি করছিলি?
— ঘুম আসছিলো না, তাই ভাবলাম জঙ্গল টা ঘুরে দেখি, কোথাও কোনো অসুবিধা আছে কিনা! এদিকে এসে আপনার হাসির শব্দ শুনে চলে এলাম।
অ্যানার দেখিয়ে দেওয়া জায়গায় বসতে বসতে বলল হাইনা৷ তারপর ফ্যালকন কে অ্যানার পেছন থেকে টেনে সামনের দিকে নিয়ে এসে বলল,
— কি রে, তুই ওইখানে লুকিয়েছিস কেন? সামনে আয়।
ফ্যালকন অ্যানার পেছন থেকে সরে এসে হাইনার পাশে বসলো। জঙ্গলের প্রাণিদের ভেতরে সব থেকে বেশি হিংস্র হলো হায়েনা। তাই এদের কেই কিছু বিশেষ অপরাধীদের জন্য পানিশমেন্ট হিসেবে রেখেছে নামীর৷ আর সে হায়েনা দের ভেতর থেকে হাইনাই সবচেয়ে বেশি হিংস্র। নিজের চতুরতা আর ক্ষীপ্রতার কারণে নিজের দলের লিডার হয়েছে সে আজ। ফ্যালকন, কোকোর সাথে সাথে মাতৃসম অ্যানার ভালোবাসা সেও পেয়েছে। হাইনা মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে অ্যানার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— শেহজাদী! আপনি এইখানে আপনার এই তিনটা বাচ্চার সাথে দেখা করেছেন শুনলে আপনার বাকি বাচ্চা রা তো বিদ্রোহ শুরু করবে!
অ্যানা হেসে উঠলো, তারপর বলল,
— সময় করে একদিন সবার সাথে দেখা করবো। আগের মতো করে জমিয়ে পিকনিক ও করবো। শুধু আমার পানিশমেন্ট এর ডেড লাইনটা আসুক, তারপর একে একে সব হবে।
ফ্যালকন উচ্ছসিত কন্ঠে বলে উঠলো,
— ইশ, কবে যে সেই দিনটা আসবে! শেহজাদীর হাতের সুস্বাদু রান্না খাবো।
কোকো পাশ থেকে ওর মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
— আর আমি খাবো তোকে, সেদিন ভালো করে একটু গোসল করিস, ছ্যাদাড়!
কোকোর কথায় চারজনেই হেসে উঠলো ওরা। ঠিক এমন সময়েই আশে পাশে নিজের চিরচেনা সুঘ্রাণ টা পেলো অ্যানা৷ মুহুর্তেই মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো ওর৷ আর তার পরমুহুর্তেই অ্যানার পেছনে, কিছুটা দুরত্বে নামীর কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তড়িঘড়ি করে বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে মাথা নত করে রইলো কোকো, হাইনা আর ফ্যালকন। ওদের দেখা দেখি অ্যানাও দাঁড়িয়ে পড়লো। চারদিকে পিন পতন নিরবতা নেমে এলো যেন।
ধীর গতিতে, রাশভারী পা ফেলে ওদের দিকে এগিয়ে এলো নামীর৷ এসে অ্যানার কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই ওদের দুজন কে প্রাইভেসি দিয়ে ফ্যালকন রা মাথা নত রেখেই আনুগত্যের সাথে পেছন দিকে একটা নির্দিষ্ট দুরত্ব পর্যন্ত হেটে নিজেদের মতো অন্যদিকে চলে গেলো। আর ওরা চোখের আড়াল হতেই নামীর এসে দাড়ালো অ্যানার সামনে। তারপর নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— কোথায় যাচ্ছো?
— সেটা তোমাকে বলার প্রয়োজন মনে করিনা।
নাকের পাটা ফুলিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো অ্যানা৷ নিজের হীরক খন্ডের ন্যায় চোখ জোড়া নামীরের দিক থেকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে রেখেছে ও, কোনো ভাবেই নামীরের চোখে চোখ মেলাচ্ছে না৷ অ্যানার এমন উত্তর শুনে সামান্য শব্দ করে হাসলো নামীর। তারপর অ্যানার দিকে আর একটু এগিয়ে এসে বলল,
— আমার অনুমতি ছাড়া তুমি এখান থেকে কোথাও যেতে পারবে ভেবেছো?
— আমি কারো অনুমতির তোয়াক্কা করিনা। আমার যখনই ইচ্ছা হবে, যেখানে ইচ্ছা হবে আমি সেখানে যাবো।
অন্যদিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে কথা টা বলল অ্যানা। অ্যানার কথা শুনে নামীর বলে উঠলো,
— বয়স কতো তোমার?
— কেন? তুমি জানোনা?
— আমি জানি, কিন্তু তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো। বলো, তোমার বয়স কত?
— সাতাত্তর।
নামীরের প্রশ্নের পর কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো অ্যানা। নামীর নিজের হাত টা বাড়িয়ে অ্যানার অন্যদিকে ঘুরিয়ে থাকা মুখ টা নিজের দিকে নিয়ে এলো, তারপর বলল,
— আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো, তুমি আমার থেকে কত বছরের ছোট?
অ্যানা চোখ তুলে তাকালো নামীরের দিকে। তারপর নামীরের চোখে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করলো,
— আমাকে এইমুহূর্তে এসব প্রশ্ন করার মানে কি?
— যা জিজ্ঞেস করবো তার ঠিক ঠিক জবাব দেবে, পালটা প্রশ্ন করবে না৷
শক্ত গলায় বলল নামীর৷ অ্যানা নামীরের চোখ থেকে চোখ নামিয়ে নিতে গেলো, কিন্তু সাথে সাথেই নামীর নিজের হাত দিয়ে অ্যানার চোয়াল জোড়া আকড়ে ধরে বাধা দিয়ে বলল,
— মোটেই চোখ সরাবে না, আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো। তুমি আমার থেকে কত বছরের ছোট?
— একশো ত্রিশ।
নামীরের চোখে চোখ রেখে চোয়াল শক্ত করে উত্তর দিলো অ্যানা। নামীর নিজের মুখ টা অ্যানার মুখের একেবারেই কাছে এগিয়ে নিয়ে এলো, তারপর শান্ত কন্ঠে বলল,
— আমি তোমার অত্যাধিক গুরুজন, তার ওপর তোমার স্বামী। আমাকে মান্য করে চলা তোমার প্রধান দায়িত্ব। তুমি একটা হাটুর বয়সী মেয়ে। এতটুকুন একটা মেয়ে হয়ে আমার সাথে এইভাবে কথা বলো! তোমার সাহসের তারিফ করতে হয়।
কথা টা বলেই অ্যানার ঠোঁটে টুক করে একটা চুমু খেয়ে নিলো নামীর। আর নামীর এ কাজ করা মাত্রই ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে নিজের মুখ খানা ওর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মাটি থেকে নিজের ব্যাগ আর লিন্ডা কে হাতে তুলে নিয়ে বড় বড় পা ফেলে নিজের ইয়টে উঠে গেলো অ্যানা৷ আর ইয়টে ওঠা মাত্রই পেছন থেকে নামীর উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
— এনজয় ইয়্যোরসেলফ! আর হ্যাঁ, ঘোরাঘুরি শেষে ফিরে এসে সাবধানে থাকবে। তোমার করা সামান্য ভুলের কারণে অন্য কারো প্রাণ ঝুকিতে পড়তে পারে। কথা টা মাথায় রেখো, হ্যাপি জার্নি।
কথা টা বলেই সেখান থেকে ঝড়ের গতিতে প্রস্থান করলো নামীর। আর নামীরের শেষোক্ত কথাটির মর্মার্থ বুঝতে পারা মাত্রই ফ্যাকাসে হয়ে এলো অ্যানার মুখ খানা।
চলবে……
( আজ অনেক বড় পর্ব দিয়েছি। লেখার মাঝে অনেক ভুল ত্রুটি থাকতে পারে, সেগুলো একটু মানিয়ে নিবেন৷ আর কমেন্ট করবেন ইয়ায়ায়ায়ায়া বড় বড়।)