#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_২৫
#আ_মি_না
৪৪. পরদিন সকাল বেলা লিন্ডা কে নিয়ে রিসোর্টে ফিরে এলো অ্যানা। পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত এই রিসোর্ট টির চারপাশ টা প্রাচীর ঘেরা, বন্য লতাপাতায় সে প্রাচীর টা পুরোপুরি ঢেকে আছে। প্রাচীরের ভেতরে ছোটখাটো একটা বিলাসবহুল এক তলা রিসোর্ট। আর তার সামনে কিছুটা ফাকা জায়গা রেখে একটা বিশাল সুইমিং পুল। পানি টা ঝকঝকে পরিষ্কার। প্রাসাদ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন কেয়ারটেকার রোজ রিসোর্ট টিকে ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে রেখে যায়, যার জন্য পানি টা এত ঝকঝকা।
রিসোর্টে ঢুকে কয়েক কদম আগাতেই অ্যানা দেখলো ফ্যালকন সুইমিং পুলের পাশেই চিৎপাৎ হয়ে ঘুমাচ্ছে। খালি গা, পেটে কিছুই নেই। অ্যানা ওকে ডাকলো না৷ আস্তে ধীরে ফ্যালকন কে পাশ কাটিয়ে রিসোর্টে ঢুকে গেলো ও৷ তারপর ফ্রেস হয়ে কিচেনে ঢুকলো। কিচেনে কোনো খাবার থাকার কথা না। তারপর ও কি মনে করে ফ্রিজ খুললো অ্যানা। কিন্তু অ্যানাকে ভূল প্রমাণ করে দিলো ফ্রিজ ভর্তি মাছ, মাংস, শাকসবজি আর রান্না করে রাখা খাবার।
অ্যানা চমকালো না। এসব মীরের কাজ। এর আগে যতবারই ও রাগারাগি করে কোথাও চলে গেছে ততবারই রিসোর্টে ফ্রিজ ভর্তি খাবার পেয়েছে। আর পরবর্তী তে মীর ওকে বলেছে যে ও প্রাসাদ ছেড়ে চলে গেলে নাকি মীর সব গুলো রিসোর্টেই খাবার ভর্তি করে রাখার নির্দেশ দিতো৷ কারণ অ্যানা কখন কোন রিসোর্টে গিয়ে উঠবে তার কোনো ঠিক নেই। অ্যানা ভেবেছিলো এবার হয়তো ব্যাতিক্রম কিছু হবে। কিন্তু হয়নি।
অ্যানা রান্না করে রাখা খাবার গুলো ওভাবেই রেখে দিলো। ফ্রিজ থেকে কয়েক রকমের সবজি বের করে স্যুপ করলো। আর তারপর বেশ কয়েকটি পার্ল শ্রিম্প বের করে রান্না করলো। এরপর রিসোর্টের বাইরে, সুইমিংপুলের পাশে থাকা ডাইনিং টেবিল টিতে ওর আর ফ্যালকনের জন্য খাবার সাজিয়ে সুইমিংপুলের পাশে মরার মতো পড়ে থাকা ফ্যালকনের পাশে গিয়ে বসে ঠেলে ঠেলে ওঠালো ওকে।
ফ্যালকন ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ অথর্বের মতো বসে রইলো। ও ঠিক কোথায় আছে সেটা ঠাহর করতে ওর বেগ পেতে হলো কিছুক্ষণ। তারপর গতকালের কথা মনে পড়তেই মুখ ভার করে উঠে দাঁড়ালো ও৷ এরপর ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে থাকা অ্যানার কাছে গিয়ে নিজেও একটা চেয়ার টেনে বসল। ওকে এইভাবে মুখ ভার করে থাকতে দেখে অ্যানা জিজ্ঞেস করলো,
— কিরে? এরকম মুখ করে আছিস কেন? আর তোকে এত শুকনা শুকনা লাগছে কেন? খাসনি কিছু নাকি?
ফ্যালকন অভিমানী দৃষ্টিতে একবার অ্যানার দিকে তাকিয়ে আবার টেবিলের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বলল,
— উনি বলেছিলেন আপনার দিকে খেয়াল রাখতে। আমি তাই সেই কাল সকাল থেকে এখানে এসে বসে আছি। কিন্তু আপনার আসার কোনো নামই নেই! কতবার যে উড়ে উড়ে দেখতে গিয়েছি আপনি আসছেন কিনা, তবুও আপনাকে পাইনি! আর কাল থেকে আমি কিছু খাইওনি! কিভাবে খাই এত টেনশনের ভেতর?
ফ্যালকনের এমন অভিমানী চেহারা দেখে অ্যানা ফ্যালকনের এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
— আহারে, আমার বাচ্চা টা! তোকে আমার খেয়াল রাখার জন্য বলেছিলো, খেতে তো মানা কিরেনি, তো খাসনি কেন? এখন খা।
বলে অ্যানা খাবার গুলোর ওপরের ঢাকনা সরালো। আর ঢাকনা সরানো মাত্রই ফ্যালকনের চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো, খাবার দেখে ক্ষিদে টা পেটের ভেতরে যেন লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। ফ্যালকন হাত বাড়িয়ে ওর স্যুপের বাটিটা ধরতে যাওয়ার আগেই অ্যানা ওকে বাধা দিয়ে বলে উঠলো,
— এই তুই হাত মুখ ধুয়েছিস?
ফ্যালকন থমকালো, হাত মুখ সে ধোয়নি। খাওয়ার আগে হাত মুখ ধোয়ার কথা তার এই জীবনেও মনে থাকে না৷ ধরা পড়ে যাওয়া ভঙ্গিতে সে মাথা নাড়লো দুদিকে। অ্যানা ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
— অসভ্য কোথাকার! এখুনি হাত মুখ ধুয়ে আয়! ছোটবেলায় যেমন ছিলি এখনো তেমনি আছিস, একটুও বদলাসনি। কোকো ঠিকই বলে তুই একটা ছ্যাদাড়৷
সবঠিক ছিলো, কিন্তু কোকোর কথা বলায় ফ্যালকন সেন্টি খেলো। আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
— শেষ মেশ আপনিও এরকম বললেন আমাকে! আমি আমার এই চাকরি টা শেষ হলেই শিরো মিদোরি ছেড়ে চলে যাবো, আর আসবো না। দেখবেন আপনি!
ফ্যালকনের এমন কথায় ফিক করে হেসে উঠলো অ্যানা। তারপর বলল,
— আচ্ছা ঠিক আছে, আর বলবো না৷ এখন হাত মুখ ধুয়ে এসে ভালো ছেলের মতো খেয়ে নে৷
ফ্যালকন গাল ফুলিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে হাত মুখ ধুয়ে এসে আবার খেতে বসলো।
৪৫. রাত এখন অনেক। রিসোর্টের বাইরের একটি ফাকা জায়গাতে বনফায়ার তৈরি করে সেখানে লেইট নাইট বার্বিকিউ করছে অ্যানা, লিন্ডা আর ফ্যালকন। চারপাশে ঘন জঙ্গল, অন্ধকারের কারণে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। প্রচন্ড শব্দ করে ঝিঝি পোকা ডাকছে। জোনাকি পোকারা মিটিমিটি করে উড়ে বেড়াচ্ছে চারদিকে। আর আছে মশা। বো বো শব্দ করে সেগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে ওদের চারপাশে। অ্যানার গায়ে বসছে না, কিন্তু ফ্যালকন কে একদম ছেঁকে ধরেছে। ফ্যালকন থেকে থেকেই দুড়ুম দুড়ুম করে নিজের শরীরের যেখানে সেখানে চড় থাপ্পড় মারছে৷ আর অ্যানা ওর কান্ডকারখানা দেখে মিটিমিটি হাসছে৷
অ্যানা কে হাসতে দেখে ফ্যালকন বলে উঠলো,
— বেগম হওয়ার কত সুবিধা, মশাও কামড়াবে না। আর আমাকে দেখো! মশা গুলো এমন ভাব করছে যেন আমাকে এখান থেকে তুলে নিয়ে যাবে!
ফ্যালকনের কথায় অ্যানা মিহি সুরে হেসে উঠলো, তারপর আবার দৃষ্টি দিলো আগুনের ভেতর ঝলসাতে থাকা মাংসের দিকে৷ পরণে ওর একটা ফুল স্লিভ নরম, ফুরফুরে সাদা রঙা শার্ট, আর স্যাক্রামেন্টো রঙা ট্রাউজার। সাদা ধবধবে চুল গুলো মাথার ওপরে ক্লাচার দিয়ে বেধে রাখা। টেরাকোটা রঙা ঠোট জোড়াতে এখনো মিহি হাসি। চোখ জোড়া থেকে উজ্জলতা টিকরে পড়ছে৷ শরীরের নকশা গুলো রাতের আঁধারে উজ্জল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে। যেন বিশাল এক খন্ড কোহিনূর বসে আছে সেখানে, যার শরীর থেকে টিকরে পড়ছে আলোচ্ছটা।
ফ্যালকন এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। এই চিরযৌবনা মেয়েটি তার মা! এর কাছে থেকে যত আদর যত্ন পেয়েছে সেটা নিজের মায়ের থেকে কোনো অংশেই কম না। সে, কোকো, হাইনা, লিও, কাঞ্জি, ওকামি, আলফাদ, জোভি আর এখন লিন্ডা, এই সবাইকেই নিজের সন্তানের মতো করে আগলে রেখে বড় করেছে। অথচ এই মমতাময়ী মেয়েটিকে একটা সন্তানের কারণে কতই না ভুগতে হচ্ছে!
ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো ফ্যালকন। ফ্যালকন কে এভাবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে শুনে অ্যানা ফিরে তাকালো ওর দিকে, তারপর জিজ্ঞেস করলো,
— এভাবে হাওয়া ছাড়ছিস কেন? তোর আবার কিসের দুঃখ রে ফ্যালকন?
ফ্যালকন অ্যানার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল,
— আমি সিঙ্গেল মানুষ, আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি আমার প্রিয় মানুষ দের দুঃখে দুঃখ পাই।
অ্যানা ফিচেল হেসে বলল,
— বিয়ে শাদি করে ফ্যাল ফ্যালকন, আর কতকাল সিঙ্গেল থাকবি!
— কোকো আর লিও ভাইয়া সবার বড়, তারাই এখনো বিয়ের নাম নিচ্ছে না! আর আপনি আমাকে বিয়ে বসতে বলছেন। ভাইয়ারা আগে বিয়ে করবে তারপর ওদের সবার পুচকের মুখ দেখে আমি বিয়ে করবো৷ তার আগে করছিনা।
ফ্যালকনের উত্তর শুনে অ্যানা বার্বিকিউ এর মাংস টা উলটে দিতে দিতে বলল,
— দেমিয়ান বংশের মানুষেরা পাঁচশ বছর অব্দি বেচে থাকে। কিন্তু আমি একশো পেরোবো বলে মনে হয় না৷ মরার আগে তোদের সবার বাচ্চা কাচ্চা দেখে যেতে চাই। দুমদাম করে বিয়ে করে ফ্যাল সবাই।
অ্যানার কথা টা বুঝতে সময় লাগলো ফ্যালকনের। কিন্তু পরমুহূর্তেই অ্যানার কথার মর্মার্থ ধরতে পেরে আঁতকে উঠলো ফ্যালকন, ভয় জড়ানো কন্ঠে বলল,
— এরকম কথা কখনোই বলবেন না শেহিজাদী! আপনার কিছু হলে আমরা কিভাবে থাকবো? কোকো ভাইয়া, লিও ভাইয়া ওরা কিভাবে থাকবে? তার চেয়ে বড় কথা উনি কিভাবে থাকবেন? আপনি যদি প্রাসাদে না থাকতে চান তবে থাকবেন না, আপনি যদি ওনার সাথে না থাকতে চান তবে থাকবেন না! প্রয়োজন পড়লে আমরা শিরো মিদোরি ছেড়ে দিয়ে আপনার সাথে চলে আসবো, আপনি যেখানে যাবেন সেখানে যাবো, বাকিটা জীবন আপনার সাথে থাকবো আপনার সন্তান হয়ে। তবুও আপনি ওরকম কিছু করার চিন্তাও করবেন না শেহজাদী!
ফ্যালকনের ভয়ার্ত চেহারা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো অ্যানা। হাসতে হাসতেই জিজ্ঞেস করলো,
— ভয় পাচ্ছিস কেন তুই এত? তুই কি এখনো ছোট যে একা চলিতে পারবি না! আশে পাশে সব সময় মা কে লাগবে! কোকো আছে, লিও আছে, কাঞ্জি আছে; এরা থাকলে আর কি লাগে?
ফ্যালকনের গলা ধরে এলো আরও। কোনো রকমে বুক থেকে উঠে আসা কান্না টা আটকে রেখে উত্তর দিলো,
— আপনি আর কখনোই এরকম কথা বলবেন না শেহজাদী! যত জনই থাকুক না কেন আপনি না থাকলে কারোরই কোনো মূল্য নেই আমার কাছে!
ফ্যালকনের কথা শুনে সামান্য শব্দ করে মিষ্টি হাসলো অ্যানা৷ তখনি ওর নাকে এলো ওর অতি পরিচিত সুঘ্রাণ টি। মুখ থেকে হাসি টা সাথে সাথেই মিলিয়ে গেলো ওর। সেখানে এসে ভর করলো এক রাশ বিষাদ৷ পাশে বসা ফ্যালকন কে সে বলল,
— ফ্যালকন, তুই একটু লিন্ডা কে নিয়ে ওদিক থেকে ঘুরে আয়।
অ্যানার কথায় ফ্যালকন প্রথমে চমকালেও পরবর্তীতে কিছু বুঝলো হয়তো। ওর আর অ্যানার মাঝে বসা লিন্ডাকে কোলে তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ও লিন্ডাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
— চলো ছোট্ট আপাই, আমরা একটু ঘুরে আসি। আম্মাকে একটু ফুরসত দেওয়া উচিত আমাদের, কি বলো?
বলতে বলতে আশেপাশের জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে গেলো ফ্যালকন। আর তার কিছু মুহুর্ত পরেই সেখানে রাজকীয় ভঙ্গিতে এসে উপস্থিত হলো নামীর। কালো রঙা ট্রাউজার আর খালি গায়ের ওপর পার্ল রঙের সাথে কালো রঙা বর্ডারের রোব পরিহিত নামীর বুক আর পেট টা উন্মুক্ত করে দিয়ে অ্যানার পাশে ফ্যালকনের ছেড়ে যাওয়া চেয়ার টিতে বসলো। তারপর নিজের স্বর্ণোজ্জল দৃষ্টি ফেললো অ্যানার স্নিগ্ধ মুখশ্রীর ওপর। কিন্তু অ্যানা যেভাবে ছিলো সেভাবেই বসে রইলো, নামীরের দিকে তাকালো না৷
অ্যানা কে কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে দেখে নিয়ে নিজের একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে অ্যানার হাত টা ধরতে নিলো মীর৷ কিন্তু তার আগেই অ্যানা নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে আগুনের দিকে তাকানো অবস্থায় শক্ত গলায় বলে উঠলো,
— আমাকে ছুবে না৷
নামীর বাড়িয়ে দেওয়া হাত টা আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসলো। তারপর নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— আমার ওপর কি তোমার খুব রাগ?
অ্যানা নামীরের এ প্রশ্নের উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে পালটা প্রশ্ন করলো,
— কেন এসেছো তুমি এখানে?
— তোমাকে দেখতে।
নির্বিকার গলায় বলে উঠলো নামীর৷ অ্যানা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে উঠলো,
— রোজ রোজ এত মেয়ে দেখো তাতে তোমার হয় না? আবার আমাকে দেখতে এসেছো কি কারণে?
— এই প্রশ্ন টার উত্তর অনেক ভাবে দেওয়া যায়, তুমি কোন ভাবে শুনতে চাও?
চেয়ারের ওপর নড়েচড়ে বসে বলল নামীর৷
— আ’ ডোন্ট হ্যাভ এন্যি চয়েস, এন্যি মোর! তোমার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে বলতে পারো।
প্রজ্জ্বলিত আগুনের দিকে অপলকে তাকিয়ে কথা টা বলল অ্যানা৷ অ্যানার উত্তরে সামান্য শব্দ করে হাসলো মীর। তারপর বলল,
— আচ্ছা, পরে বলি। তারপর? তোমার ভ্যাকেশন কেমন কাটছে?
— এতক্ষন ভালো কাটছিলো, এখন আর ভালো কাটছে না৷
অ্যানা গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো। নামীর হেসে উঠলো ওর উত্তরে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো,
— শিনজো! তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি সে সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে?
— ছিলো না, কত কয়েক বছরে হয়েছে।
বার্বিকিউ টা আবার উলটে দিতে দিতে বলল অ্যানা। তারপর আবার বলে উঠলো,
— মীর, কথা যখন উঠেছে তখন আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।
নামীর নিজের স্বর্ণোজ্জল চোখ জোড়া অ্যানার দিকে দিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর বলল,
— বলো, আমি শুনছি।
অ্যানা কিছুক্ষণ নিরব থেকে বড় একটা দম নিয়ে বলতে শুরু করলো,
— মীর, আমাকে দেখতে আসা বন্ধ করো। আমাকে দেখে তোমার বিশেষ কোনো লাভ হবে না৷ আর তাছাড়া শিরো মিদোরির প্রাসাদ, তুমি, তোমার দাসী, তোমার অনাগত সন্তান বা রুথ কোনো কিছুর ওপরেই আমার আর কোনো রাগ বা ক্ষোভ নেই। তাই ফ্যালকন কে আমার ওপর নজর দারীতে রাখার আর কোনো প্রয়োজন নেই৷ তুমি যেদিন আমার ওপর অস্ত্র তুলেছো সেদিন থেকেই তোমাকে সহ তোমার প্রাসাদ কে আমি পেছনে ফেলে চলে এসেছি। তাই আমাকে নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করার আর কোনো প্রয়োজন নেই৷ আর আমার শাস্তির সময় সীমা শেষ হওয়া মাত্রই আমি শিরো মিদোরি ছেড়ে চলে আসবো। তোমার সামনে পড়ার আমার কোনো শখ নেই আর। আমি জানি তুমি আমার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে চাও না বা চাইবে না কখনো। আর আমি চাইলে তো হবেই না, কারণ আমার চাওয়া পাওয়ার কোনো দাম নেই তোমার কাছে। আর দাম থাকার দরকারও নেই। তুমি বিবাহ বিচ্ছেদ করবে না ঠিক আছে, আমি মেনে নেবো। কিন্তু তুমি আর কখনো আমার কাছে এসো না৷ আমি আমার বাকি জীবন টা শান্তিতে থাকতে চাই। অশান্তিতে আমি আর জীবন কাটাতে চাই না। তোমাকে বার বার চোখের সামনে দেখলে আমি কখনোই শান্তিতে থাকবো না৷ কারণ তোমাকে দেখা মাত্রই তোমার সাথে তোমার দাসীদের অন্তরঙ্গ দৃশ্য আমার কল্পনার মানসপটে ভেসে উঠবে, আর এটা হলে আমি কখনোই শান্তি পাবো না। তাই আমি খুব করে চাই তুমি আর আমার সামনে এসো না, বা আমার সাথে যোগাযোগের কোনো চেষ্টা কোরো না৷ তুমি তোমার মতো থাকো, আর আমি আমার মতো থাকি। আর তাছাড়া আমি যেহেতু তোমাকে কোনো সন্তান দিতে পারবো না সেহেতু আমাকে তোমার সাথে জড়িয়ে রেখে তোমারও কোনো লাভ হবে না৷ তার চেয়ে বরং তুমি আমাকে বাদ দিয়ে তোমার সাম্রাজ্য আর তোমার দাসীদের দিকে মনোযোগ দাও, এতে তোমার লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না। আর আমার দিক নিয়ে চিন্তা কোরো না। আমি আমার দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করবো, নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে আমি লাইফ ট্রির কাছে চলে যাবো আমার দায়িত্ব পালন করতে। তবে আশা রাখবো সে সব দিন গুলোতে তুমি আমার সামনে পড়বে না। বাকি জীবন টা আমি আমার মতো করেই কাটিয়ে দিতে চাই। তোমার ছায়াও মাড়াতে চাই না। আর তুমি আমার ছায়া মাড়াও সেটাও চাই না। ব্যাস এটুকুই!
এক নাগাড়ে এত গুলো কথা বলে থামলো অ্যানা। কথা বলার মাঝে একটি বারের জন্যও আগুনের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নামীরের দিকে তাকালো না ও৷ নামীর এতক্ষণ ধরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অ্যানার কথা শুনছিলো। ওর কথা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পর নামীর নরম গলায় বলে উঠলো,
— ঠিক আছে, আমি ভেবে দেখবো।
— শুধু ভেবে দেখলে চলবে না, খুব দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে জানাতে হবে৷ সেই অনুযায়ী আমি মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিবো। এখন তুমি আমাকে একা ছেড়ে দিলে আমি খুশি হবো।
কোনো এক অজানা কারণে এই মুহুর্তে অ্যানার গলা ধরে এলো। চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে আসতে শুরু করলো, কিন্তু মীরের সামনে কোনো ভাবেই নিজের চোখ থেকে পানি ফেলে নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করতে চায় না ও৷
নামীর কিছুক্ষণ অ্যানার দিকে অপলকে তাকিয়ে থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতে নিলো, তখনি কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে আবার বসে পড়ে অ্যানার দিকে তাকিয়ে বলল,
— তোমাকে কেন দেখতে আসি জিজ্ঞেস করছিলে, শুনতে চাও?
অ্যানা আগুনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— বলতে চাইলে বলতে পারো, জোর নেই।
অ্যানার অন্য দিকে চোখ সরিয়ে নিয়ে অশ্রু লুকানোর বৃথা চেষ্টা দেখে নামীর নিঃশব্দে হাসলো, তারপর অ্যানার দিকে কিছুটে ঝুকে এসে গেয়ে উঠলো,
— aram ata hai didar Se tere
Mit jate hai Sare gum
Hai ye dua ke Tujhe dekhte
Dekhte hi nikl Jaye dum
Sukhrana chahe main Jitna bhi krlu k
Fir bhi rhega vo km
Tera tassavur mujhe Deke mola ne
Mujhpe kiya hai karam
অ্যানা চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো, চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো ভূপৃষ্ঠের ওপর, সেখানে গজিয়ে উঠলো ছোট্ট ছোট্ট কয়কটি সুন্দর, উজ্জ্বল, স্বচ্ছ ফুলের লতা গুল্ম।
চলবে……