প্রাপ্তমনস্ক_এলার্ট #বাদশাহ_নামা #পর্বসংখ্যা_৪৫ #আ_মি_না

0
3

#প্রাপ্তমনস্ক_এলার্ট
#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_৪৫
#আ_মি_না

৬২. ভোর সকালে সমুদ্রের ওপার থেকে সূর্য উঁকি দিয়ে উঠে লালচে আভা ছড়িয়ে দিলো সমস্ত আকাশ জুড়ে। সে আলোর ঝিলিক সমুদ্রের নীল রঙা পানিতে প্রতিফলিত হয়ে ঢেউ গুলো ক্রমশ লালচে থেকে সোনালি আলোয় ঝিকিমিকি করতে শুরু করলো।

শিরো মিদোরির দেমিয়ান প্রাসাদের সবচেয়ে উঁচু মিনারটার জানালা আর মার্বেল পাথরের দেয়ালে এসে আছড়ে পড়লো ভোরের প্রথম সূর্যকিরণ। ভোরের নিস্তব্ধতায় সমুদ্র থেকে ভেসে আসতে শুরু করলো ঢেউয়ের গর্জন, সেই সাথে জঙ্গলের পাখিদের কলকাকলীতে মুখোরিত হয়ে উঠলো চারপাশ। বাতাসে বয়ে প্রাসাদের সুউচ্চে অবস্থিত কামরা গুলোতে ভেসে আসতে থাকলো সমুদ্রের লবণাক্ততা মিশ্রিত স্নিগ্ধ ভোরের শীতল মায়াবী পরশ। ধীরে ধীরে সমস্ত প্রাসাদ টা ভোরের সোনালী আলোয় মুড়িয়ে ধারণ করলো এক স্বর্গীয় রূপ!

নিজের কামরার সমুদ্রের অতলস্পর্শী ঝিনুকের আকৃতির ন্যায় বিছানায় এলোমেলো ভাবে ঘুমিয়ে আছে অ্যানা৷ ওর শুভ্র কোমল নিরাবরণ শরীর টা একটা মুক্তা রঙা পাতলা চাদরে ঢাকা। অ্যানার পাশের জায়গাটা ফাঁকা। সেখানের বালিশ টায় কারো তৃপ্ত বিশ্রামের চিহ্ন, কিন্তু বিশ্রাম শেষ করে সে অনেক আগেই বিছানা ছেড়েছে।

কিছুক্ষণ পর ঘুম ভাঙলো অ্যানার। কিয়ৎক্ষণ আড়ামোড়া করে গায়ের চাদর টা শরীরে ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ও। তারপর কামরার সমুদ্রের দিকের জানালাটার কাছে গিয়ে রেশমি পর্দা টা সরালো, সাথে সাথেই সকালের এক ঝাক মিষ্টি রোদে এসে ঝাপিয়ে পড়লো ওর চোখে মুখে। আলোর তীব্রতায় মিষ্টি হেসে চোখ কুচকে নিলো অ্যানা। তারপর আবার ফিরে গেলো বিছানার দিকে।

মীর নেই কামরাতে। গতকাল কারখানাটাকে ভেতরে থাকা অপরাধীদের শুদ্ধ উড়িয়ে দিয়ে, আঘাতপ্রাপ্ত মীর কে নিয়ে প্রাসাদে ফিরেছিলো ও। রাতেই প্রাসাদে হৈচৈ পড়ে গেছিলো যে শেহজাদী আবার প্রাসাদে ফিরে এসেছেন। কিন্তু এ খবর শুনে মীরের জন্য নির্ধারিত দাসী গুলোর মুখে ভাটা পড়ে গেলো। একেই এই মেয়ে বাদশাহর ধারে কাছে কাউকে ঘেঁষতে দেয় না, যা একটু কয়েক বছরের জন্য একটু নিস্তার পাওয়া গেছিলো, এখন আবার যা তাই!

সন্ধ্যা রাতে প্রাসাদে ফেরার পর মীর ওকে প্রাসাদের কারো সাথেই দেখা করতে দেয়নি। অ্যানার ব্যাক্তিগত দাসী গুলো এতদিন পর শেহজাদীকে প্রাসাদে পেয়ে পরম উচ্ছাসের সাথে ছুটে আসলেও কোনো গার্ড তাদের কে তাদের বাদশাহর অন্দরমহলের চৌকাঠ মাড়াতে দেয়নি৷ অ্যানা তাদের সাথে দেখা করতে চাওয়া সত্বেও দেখা করতে দেয়নি মীর। বলেছে ‘ তুমি ক্লান্ত, সকালে দেখা করো’।

যদিও কালাভুনা ক্লান্তির কথা বলে অন্যদের সাথে ওকে দেখা করতে না দিলেও নিজের পাওনা সুদে আসলে ঠিকই আদায় করে নিয়ে তবেই অ্যানাকে একটু ঘুমাতে দিয়েছে। তা নিয়ে মাঝরাতে অ্যানার অভিমানের শেষ নেই। শেষ মেশ না পেরে অ্যানা ওর সাথে লেপ্টে থাকা মীরকে নিজের থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজের গাল ফুলিয়ে বলে উঠেছিলো,

— রাতের একটা বাজে, এখনো তোমার আবদারের শেষ হলো না!

মীর নেশালো চোখে অ্যানার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে আবারও অ্যানাকে কাছে টেনে নিয়ে ওর শরীরে নিজের স্পর্শ গাঢ় করতে করতে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত গলায় বলেছিলো,

— আজ যদি আমি মারা যেতাম, তবে এমন আবদার কে করতো তোমার কাছে? কার আবদার মেটাতে রাতের একটা বাজে জেগে থাকতে তুমি, বলোতো শিনু!

মীরের এহেন কথায় মীর কে সর্বশক্তি দিয়ে আকড়ে ধরে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলো অ্যানা। আর মীর অ্যানার কান্না দেখে সশব্দে হেসেছিলো শুধু! ব্লাকমেইল, পিউর ব্লাকমেইল! সব আদর করার ধান্দা!

রাতের স্মৃতি গুলো তাজা করে, ঠোঁট জোড়া তৃপ্ত ভঙ্গিতে প্রসারিত করে অ্যানা ধীর পায়ে হেটে ওর কামরার বাদিকের দেয়ালের সাথে লাগোয়া বিশালাকার ড্রেসিং টেবিলটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। চুল গুলো ওর বেনী করা, অথচ রাতে ঘুমানোর সময় চুল গুলো ওর খোলাই ছিলো। নিশ্চয় হতচ্ছাড়াটা বেধে দিয়েছে৷
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শরীরের ওপর থেকে চাদর টা খুলে ছেড়ে দিলো ও নিচে। সমস্ত শরীর জুড়ে মীরের পাগলামির চিহ্ন গুলো স্পষ্ট হয়ে আছে। সেগুলোকে দেখতে দেখতে অ্যানার মুখমণ্ডল জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো এক লাজুক হাসি।

তখনি ওর কামরার বাহির দ্বারে শোনা গেলো কড়া নাড়ার শব্দ। চমকে দরজার দিকে একবার তাকিয়ে মেঝে থেকে চাদর টা উঠিয়ে সমস্ত শরীর টা ভালো ভাবে ঢেকে নিলো অ্যানা৷ তারপর বলে উঠলো,

— এসো!

অ্যানার অনুমতি পাওয়া মাত্রই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো অ্যানার বাল্যবন্ধু ইয়াসমিন। ওর পেছন পেছন কামরায় ঢুকলো অ্যানার ব্যাক্তিগত দাসীদের দুজন।

ইয়াসমিন এসে অপরাধী চেহারায় অ্যানার সামনে দাঁড়িয়ে সামান্য মাথা নুইয়ে আনুগত্য দেখালো। পেছনে থাকা দাসী গুলো উচ্ছাসের সাথে মুখে হাসি ফুটিয়ে সমস্বরে ‘শেহজাদি’ বলে উঠে আনুগত্য দেখিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো৷

অ্যানা পেছনের দুজনকে এক পলক দেখে নিয়ে ইয়াসমিনের দিকে তাকালো। ইয়াসমিনের চোখে মুখে অপরাধবোধ। সেদিন রাতে নিজের বাদশাহের সম্পর্কে নিজেরই শেহজাদীর নিকট এইভাবে বলা টা তার একেবারেই উচিত হয়নি। অ্যানা রাগের মাথায় তাকে আর কখনো তার সামনে আসতে নিষেধ করে দিয়েছিলো। তাসত্বেও ইয়াসমিন আজ এসেছে আবারও। তার প্রাণের শেহজাদী তার ওপর রেগে আছে, এটা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেনা!

অ্যানা ইয়াসমিনের দিকে এগিয়ে এসে পেছনের দাসী দুটোকে ইশারায় বাইরে যেতে বলল। সে দাসী দুটো সামান্য মনোক্ষুণ্ণ হলো, কিন্তু অ্যানার আদেশ পালন করে দরজা ঠেলে বাইরে গিয়ে বাইরে থেকে আবার দরজাটা লাগিয়ে দিলো।

দাসী দুটো চলে যেতেই ইয়াসমিন দ্রুতপায়ে এগিয়ে এলো অ্যানার কাছে, তারপর অ্যানার হাত জোড়া ধরে মাথা নত করে ভেজা গলায় বলে উঠলো,

— শেহজাদী, আমি সেদিনের জন্য অনেক অনুতপ্ত! আমি আবারও আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন শেহজাদী! বিশ্বাস করুন, সেদিনের পর থেকে আমি একটা রাতের জন্যেও ভালোভাবে ঘুমাতে পারিনি! অপরাধবোধ প্রতিনিয়ত আমাকে কুরে কুরে খেয়েছে শেহজাদী, আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিন! এমন দুঃসাহস আমি আর কখনোই দেখানোর সাহস করবোনা শেহজাদী!

অ্যানা ইয়াসমিন কে থামিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলল,

— আমি তোমাকে অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি ইয়াসমিন! সেদিন আমারও এতটা রিয়্যাক্ট করা ঠিক হয়নি। সেদিন এমনিতেই আমার মাথা একটু গরম ছিলো, আর তার ওপর তুমি আমার মীরকে নিয়ে ওভাবে বলায় আমি আর নিজেকে সংযত রাখতে পারিনি। জানোইতো ওর ব্যাপারে কেউ কিছু বললে আমি সেটা নিতে পারিনা!

অ্যানার কথায় ইয়াসমিন আস্বস্ত হলো। বুক থেকে একটা পাথর সমান ভার নেমে গেলো যেন ওর। অসহায় মুখটা ওর কৃতজ্ঞতার হাসিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। হাসি হাসি মুখ করে অ্যানার ডান হাত টা নিজের মুঠিতে নিয়ে চুমু খেয়ে বলল,

— আপনি আমার অশান্ত মনটাকে শান্ত করে দিলেন শেহজাদী! আপনার নিকট আমি চিরকৃতজ্ঞ!

অ্যানা কিছু বলল না। ইয়াসমিনের কথার প্রতিউত্তরে একটা মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে রাখলো ওর ঠোঁটে৷ ইয়াসমিন আবার বলল,

— আপনার খাবার প্রস্তুত আছে শেহজাদী! হিজ ম্যাজেস্টি বের হওয়ার আগে ইয়াসির কে বলে দিয়েছেন আপনার খাবার প্রস্তুত করে রাখতে৷ আপনি রাতে ভালো ভাবে খাননি তাই। আপনি বললেই নিয়ে আসবো।

— কোথায় গেছে ও? ইয়াসির কে কিছু বলেছে?

— না শেহজাদী, তবে উনি অনেক ভোরেই বেরিয়ে গেছেন। কোথায় গেছেন সেটা কাউকে বলেননি। তবে ফ্যালকন এসেছিলো হিজ ম্যাজেস্টির নিকট, ভোর বেলাতে, ইয়াসিরের থেকে শুনেছি।

অ্যানা ভ্রু কুচকালো। ফ্যালকন অতো ভোরে মীরের কাছে কেন এসেছিলো? আর মীরই বা কোথায় গেলো! ভাবলো একবার ফোন দিবে। কিন্তু পরক্ষণেই পেটের ভেতর টা ক্ষিদেয় মুচড়ে উঠলো ওর। মীর তবে ঠিকই আন্দাজ করেছে, ঘুম থেকে উঠেই ও খাই খাই করবে!
অ্যানা হাসলো নিজের মনে। তারপর ইয়াসমিন কে খাবার পরিবেশন করতে বলে ও ঢুকলো শাওয়ারে৷

৬৩. সকালের খাবারের পর ওয়ারকার্স দের ডাইনিং এরিয়া সাফ করছে শার্লট। কিন্তু কাজে ওর মন নেই একটুও৷ মুখ খানা ভার হয়ে আছে। চোখ জোড়া ছলছলে। ধীর গতিতে হাত চালিয়ে কাজ করে চলেছে ও। ফাতমা ডাইনিং টেবিল থেকে এঁটো বাসন গুলো একটার পর একটা সাজিয়ে রাখছে ভেতরে নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করার জন্য।

শার্লটের অমনোযোগী ভাবটা ওর কয়েকদিন ধরে চোখে পড়ছে। কিন্তু শার্লট কেন এমন মন খারাপ করে আছে সেটার কূলকিনারা করে পারছে না ও৷ এক পর্যায়ে হাতের কাজ রেখে ফাতমা এগিয়ে এলো শার্লটের কাছে। তারপর শার্লটের কাধে হাত রাখলো।
ফাতমা হাত রাখতেই চমকে উঠলো শার্লট। নিজের ভাবনায় ও এতটাই ব্যাস্ত ছিলো যে ফাতমা কে ও লক্ষ্যই করেনি।

শার্লট কে এভাবে চমকাতে দেখে ফাতমা বুঝলো কিছু একটা ঠিক নেই। শার্লট কে নিজের দিকে আলতো হাতে ঘুরিয়ে ও শুধালো,

— কি হয়েছে রে তোর? সারাক্ষণ দেখছি কেমন মনমরা হয়ে থাকছিস! কোনো অসুবিধা? কিছু হলে নির্দ্বিধায় বল আমাকে। আমাদের অ্যানার মতো চুটকিতে সমাধান দিতে না পারলেও সময় নিয়ে হলেও দেওয়ার চেষ্টা করবো!

ফাতমার মুখে অ্যানার কথা শুনে এবার শার্লটের এবার সত্যি সত্যি কান্না পেলো। ঠোঁট উলটে কেঁদে ফেললো ও৷ হঠাৎ ওকে কেঁদে উঠতে দেখতে অপ্রস্তুত হলো ফাতমা। তড়িঘড়ি করে চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠলো,

— একি রে! কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে তোকে?

শার্লট দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো, কান্নার দমকে কথা বের হলো না ওর মুখ থেকে। ব্রায়ান নিজের মাঞ্জার থেকে বেরিয়ে, হাতে একটা শাবল নিয়ে শক্ত মুখে আগাচ্ছিলো কিচেনের পেছন দিকে থাকা ওর করা শাকসবজীর বাগান টার দিকে। শার্লটের কান্নার শব্দ কানে আসতেই ও ফিরলো এদিকে। তারপর হাতের শাবল টা মিটিং জোনের ওদিকটায় রেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো ওদের দিকে। ফাতমা ব্রায়ান কে দেখে হাঁফ ছাড়া ভঙ্গিতে বলে উঠলো,

— দেখুন না মিস্টার উইলসন! শার্লট তখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু কিছু বলছেও না কেন কাঁদছে!

ব্রায়ান ত্রস্ত ভঙ্গিতে শার্লটের কাছে এসে ওকে দুহাতে আগলে নিয়ে ফাতমার উদ্দ্যেশ্যে বলল,

— আমি দেখছি ফাতমা। তুমি বাসন গুলো ভেতরে নিয়ে যাও।

ফাতমা বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে শার্লটের দিকে এক পলক তাকিয়ে বাসন গুলো নিয়ে চলে গেলো কিচেনের দিকে৷ ফাতমা যেতেই ব্রায়ান ডাইনিং টেবিলের পাশে থাকা একটা চেয়ার টেনে সেখানে বসালো ফুপিয়ে কেঁদে চলা শার্লটকে। তারপর নিজেও একটা চেয়ার টেনে বসলো ওর মুখোমুখি।
ভুল করে ফেলেছে ব্রায়ান। অ্যানা যাওয়ার আগে ওকে বলে গেছিলো শার্লটকে যেন ওই ব্যাপারে কিছুই না জানায়, কিন্তু ব্রায়ান অ্যানার কথা রাখতে পারেনি। শার্লটের বারংবার জেরার মুখে মুখ ফসকে বলে দিয়েছে। আর তারপর থেকেই কেঁদে বুক ভাসিয়ে চলেছে শার্লট।

ব্রায়ান ক্রন্দনরতা শার্লটের চোখের লোনা পানিটা আঙুল দিয়ে মুছে দিয়ে নরম গলায় বলে উঠলো,

— অ্যানা আমাকে বলেছিলো তোকে যেন কিছুই না বলি। কিন্তু আমি ওকে দেওয়া ওয়াদা ভঙ্গ করে তোকে সব বলে দিয়েছি। এই ব্যাপারে পুরো ওয়ার্কিং জোনে শুধু মাত্র আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ জানে না৷ এখন তুই যদি এরকম করিস তবে সবাই অ্যানার ব্যাপার টা জেনে ফেলবে শার্লট! সারাক্ষণ এরকম মন খারাপ করে থাকিস না! আর বারবার অ্যানার কামরার দিকে গিয়ে বসে থাকিস না।
আমি আর থিয়োডর সবাইকে বলেছি যে অ্যানাকে কর্তৃপক্ষ বিশেষ ছুটি দিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজের জন্য, কবে আসবে সেটা কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে জানায়নি। এখন তুই যদি বার বার অ্যানার মাঞ্জারের সামনে গিয়ে এভাবে বসে থাকিস তবে সবাই ব্যাপার টা সন্দেহের চোখে দেখবে!

— আমি কি করবো ভাইয়া! অ্যানা চলে যাওয়ার আগে আমার সাথে একটাবার দেখা করে গেলো না! ও কোথায় আছে, কি করছে, কি খাচ্ছে, বেচে আছে নাকি ওরা ওকে মেরে ফেলেছে সেটাও জানিনা! ওর জন্য আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া, আমি রাতে ঘুমাতে পারছিনা এক ফোটাও!

ফুপিয়ে কেঁদে কেঁদে ব্রায়ানের হাত ধরে কথা গুলো বলল শার্লট৷ ব্রায়ানের চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো! ওরও তো মন চাইছে শার্লটের মতো করে নির্দ্বিধায় একটু কাউকে জড়িয়ে ধরে এইভাবে কাঁদতে! বুকের ভেতর টা যে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে ওর, কিন্তু কাকে বোঝাবে ও!
শার্লটটা নিজেই ভেঙে পড়েছে, সেখানে ওও যদি এখন ভেঙে পড়ে তবে কে সামলাবে ওদেরকে!
শার্লটকে সব সমস্যা থেকে আগলে নেওয়া সে অ্যানাই তো আর নেই! কে এখন শার্লটকে বোঝাবে, কে থামাবে ওর কান্না!
ব্রায়ান একটা ঢোক গিলে ঝুকে এসে শার্লটের মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিলো। শার্লট ভাইয়ের বুকে স্থান পেয়ে আরও জোরে কেঁদে উঠলো। ব্রায়ানের চোখ থেকেও দুফোটা লোনা পানি নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়লো শার্লটের চুলের ওপর, কিন্তু সেগুলোকে ও সন্তর্পণে লুকিয়ে নিলো, যেন নিজের মস্তিষ্ক কেও বুঝতে দিলো না যে ওরও কষ্ট হচ্ছে।

যারা দেখলো তারা এটাকে নিছক দু ভাইবোনের মনোমালিন্য পরবর্তী সখ্যতা হিসেবে ধরে নিলো, কিন্তু কেউ জানতেও পারলোনা একটা মায়া ভরা বুকের অধিকারী রমণীর জন্য দুজনেরই হৃদয় পুড়ছে।

৬৪. বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো, তবুও মীরের কোনো খবর নেই। অ্যানা হাতে ফোন টা ধরে চিন্তিত মুখে কামরার এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। সকাল থেকে এখনো পর্যন্ত কতবার যে মীরের ফোনে কল লাগিয়েছে তার হিসাব নেই, কিন্তু কালাভুনা টার কোনো হদিস নেই। না তুলছে ফোন, না দিচ্ছে টেক্সট। চিন্তায় চিন্তায় মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে অ্যানার৷

ফ্যালকনের কাছেও কয়েকবার ফোন দিয়েছে, কিন্তু মীরের মতো সেও লাপাত্তা। কারো কোনো খোজ নেই! ক্রমে ক্রমে অস্থির হয়ে উঠছে অ্যানা। কয়েকবার ইয়াসির নামক ক্যাস্ট্রেটেড গার্ড টার কাছে খোঁজ নিয়েছে, কিন্তু সেও কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি৷

শেষ মেশ অ্যানা পায়চারী বাদ দিয়ে স্থীর হয়ে বসলো বিছানায়। মাথার ভেতরের দুঃশ্চিন্তা টা এবার রাগে রূপ নিতে শুরু করেছে ওর। কালাভুনা টার এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ কর্মের জবাব চাইবে আজ ও৷
কি এমন জরুরি কাজ পড়েছে তার যে ফোন টা তোলা যাবে না, টেক্সট এর রিপ্লাই দেওয়া যাবে না! যত্তসব!
ওই ফ্যালকন টাকেও দেখে নেবে অ্যানা। ফাজিল ছেলে! একটাবার কল রিসিভ করে তো বলে দেওয়া যায় যে আমরা এই কাজে বিজি আছি এখন কথা বলার সময় নেই! সেটুকুও করতে পারছে না!

সময় গড়ালো আরও খানিক। অ্যানা নিজের বিছানা ছেড়ে উঠে চলে গেলো কামরার ব্যালকনিতে। ব্যালকনিটা জঙ্গলের দিকে মুখ করা। একটা কেদারা টেনে সেখানে বসে জঙ্গলের দিকে ফিরে মুখ ভার করে বসে রইলো অ্যানা। একজন দাসী এসে ওকে এক কাপ কফি দিয়ে গেলো। সেটাতে ছোট্ট ছোট্ট করে চুমুক দিতে দিতে জঙ্গলটাকে দেখতে শুরু করলো ও।
জঙ্গল জুড়ে অন্ধকার নেমে এসেছে, কিন্তু জেগে উঠতে শুরু করেছে হরেক রকমের আজগুবি জীবজন্তু। যেখানে সেখানে একটু একটু করে আলোকরশ্মি জ্বলে উঠছে বারে বারে। গাছপালা গুলো জুড়ে হুটোপুটি করে বেড়াচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট কিছু ফ্লাপি কাঠবেড়ালি। গায়ের পশমগুলো ওদের জ্বলজ্বল করছে।

শিরো মিদোরির জঙ্গলের গাছপালা সহ সমস্ত জীবজন্তুরই এটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য। রাত হলেই জঙ্গল জুড়ে আলোকরশ্মিগুচ্ছ খেলা করে বেড়ায় তাদের শরীর জুড়ে। পৃথিবীর অন্য সকল স্থানের জীবজগৎ থেকে সম্পুর্ন ভিন্ন এই জীবজগৎ কখন, কিভাবে বেড়ে উঠেছে সে সম্পর্কে কারোরই জানা নেই!

অ্যানা সেদিকে তাকিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গাছপালাগুলো জুড়ে ছুটে বেড়ানো ছোট্ট ছোট্ট কিউট কিউট পিচ্চি গুলোকে দেখছিলো। এমন সময়ে ইয়াসমিন সেখানে এসে উপস্থিত হয়ে ব্যালকনিতে ঢোকার দরজায় দাঁড়িয়ে ডেকে উঠলো,

— শেহজাদী!

অ্যানা জঙ্গলের দিকে দৃষ্টি রেখেই অমনোযোগী কন্ঠে উত্তর করলো,

— বলো ইয়াসমিন।

ইয়াসমিনের পেছন থেকে দুজন দাসী র‍্যাপিং পেপারে মুড়িয়ে রিবন দিয়ে বাধা একটা বড়সড় বক্স এনে রাখলো অ্যানার সামনে, তারপর নিজেদের পেছন দিকে হেটে আবার বেরিয়ে গেলো বাইরে। অ্যানা বক্স টার দিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ইয়াসমিনের দিকে। ইয়াসমিন মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠলো,

— হিজ ম্যাজেস্টি পাঠিয়েছেন আপনার জন্য!

অ্যানা একবার গিফট বক্স আর একবার ইয়াসমিনের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বিস্ময়াভিভূত হয়ে লাফিয়ে চেয়ার থেকে নেমে দাঁড়ালো। কালাভুনার বাচ্চা টা সারাদিন নকশা মেরে এখন গিফট বক্স পাঠিয়েছে! আসুক আজকে প্রাসাদে, ওর গিফট ওকে ভর্তা করে খাওয়ানো হবে৷

অ্যানা কপট রাগ দেখিয়ে বক্সটার রিবন ফিতা টা খুলতে নিলো। তখনি দেখলো রিবন ফিতাটির নিচে অসাধারণ সুন্দর নকশা করা একটি ছোট্ট চিরকুট। অ্যানা কপাল কুচকে চিরকুট টা হাতে নিয়ে মেলে ধরলো সামনে। সেখানে মীরের হ্যান্ডরাইটিংএ গোটা গোটা করে লেখা,

“ হ্যাপি ফিফটি এইটথ অ্যানিভার্সারি, মা’ বিয়্যুটিফ্যুল অর্কিড”

চলবে……..

( আজ দিতে চাইছিলাম না, তবুও দিলাম। 😒 আগামী দুদিন আর দিতাম নাহ। অনেক পড়া বাকি, সেগুলা কমপ্লিট করতে হবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here