#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_২৯
#আ_মি_না
রেড জোনের ভেতরের একটি বিরাট অংশ জুড়ে, গাছগাছালির ফাক ফোকড় দিয়ে বসবাস করছে কয়েক হাজার বন্য মানুষ, এবং আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে তাদের সাথে পশুপাখিরাও বসবাস করছে, এবং সেগুলো সবই মাংসাশী প্রাণী। কিন্তু আসওয়াদের জানামতে রেড জোনে কোনো মানুষ বসবাস করে না৷ কিন্তু এইখানে এতগুলো মানুষ কে একসাথে থাকতে দেখে আসওয়াদ আর সালিম দুজনেই কিছুটা চমকালো।
এতক্ষণ ওরা দূর থেকে জায়গাটা পর্যবেক্ষণ করছিলো, কিন্তু এরপর ব্যাপার টা কি সেটা আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য আসওয়াদ উঠলো সেখানে থাকা একটি রেড উড গাছের মগডালে। সালিম উচ্চতা ভয় পেতো, তাই ও আর উঠলো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো নিচে৷ আসওয়াদ তরতর করে একেবারে গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালটাতে উঠে পড়লো, তারপর দেখার চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ। আর খানিকক্ষন পর্যবেক্ষণ করার পর ও টের পেলো এখানের সব মানুষই পশু, আর সব পশুই মানুষ। এরা চাইলে যেকোনো সময় নিজেদের পশু ফর্মে বা মানব ফর্মে ফিরতে পারে। আসওয়াদ মনে মনে এটার নাম দিয়ে ফেললো অ্যানিম্যাল টাউন৷
কিন্তু তার পর্যবেক্ষণের কিছু মুহুর্ত পরেই আসওয়াদের কানে ভেসে এলো একদল নেকড়ে আর হিংস্র হায়েনার ঝাকের তীব্র ঝগড়ার চিৎকার। গাছের ওপর থেকেই ও চারপাশ টাতে নজর বুলালো ব্যাপার টা কি দেখার জন্য। আর তার কিছুক্ষণ পরেই ওর চোখ আটকে গেলো অ্যানিম্যাল টাউনের পাশেই লড়াই রত একদল নেকড়ে আর হায়েনার দিকে। কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে দুই দলের ভেতর তুমুল লড়াই শুরু হয়েছে।
আসওয়াদ ব্যাপার টা দেখে, ভ্রু জোড়া কুচকে নিয়ে দ্রুতগতিতে গাছ থেকে নেমে এলো মাটিতে। তারপর মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা উৎসুক সালিম কে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
— চলো ভাইজান, মামলা মিটিয়ে আসি।
সালিম আসওয়াদের কথার আগামাথা কিছু না বুঝলেও দুম করে মামলা মেটানোর কথা বলে দ্রুত পায়ে সামনে এগিয়ে চলা আসওয়াদের পেছন পেছন চলা শুরু করলো।
অ্যানিম্যাল টাউনের বা দিক টা তখন পশু রূপী হায়েনা আর নেকড়ের তীক্ষ্ণ চিৎকারে ডুবে আছে। আশেপাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ তাদের ঝগড়া দেখে চলেছে মানুষ রূপি অন্যান্য প্রাণী গুলোর একাংশ। ঝগড়াটা ঠিক কি নিয়ে বেধেছে সেটা বোঝার উপায় নেই। দুই দল তারস্বরে চিৎকার করে যাচ্ছে। ঠিক সেই মুহুর্তেই তাদের ডান দিক থেকে ভেসে এলো একটি বজ্রকঠিন কন্ঠ,
— কি শুরু করেছো তোমরা?
আর এ কন্ঠ টা কানে যাওয়া মাত্রই থেমে গেলো হায়েনা আর নেকড়ের দলের সে ঝগড়া। তাদের মাঝে পিনপতন নিরাবতা নেমে এলো হঠাৎ করেই। ঝগড়া থামিয়ে হায়েনার দলের লিডার টি তার ডান দিকে তাকিয়ে সে বজ্রকন্ঠের মালিকের দিকে চাইলো।
কুচকুচে কালো রঙা বলিষ্ঠ শরীরের সাথে ধারালো চোয়াল বিশিষ্ট এক অতীব সুদর্শন কিশোর, যৌবনের পা দিতে চলেছে খুব শিগ্রই! জ্বলজ্বলে সোনা রঙা শাণিত চোখ জোড়ায় আধিপত্যের নিশানা। ভ্রু জোড়া প্রচন্ড বিরক্তিতে কুচকে আছে, যার জন্য চোখের দৃষ্টি টা আরও বেশি তীক্ষ্ণতা ছড়াচ্ছে। শক্ত চোয়ালের আড়ালে দাঁতে দাঁত চাপা যেন তার তীব্র ক্রোধের বহিপ্রকাশ!
আসওয়াদের সে কথাতে কেঁপে উঠলো সালিমও, পাশে দাঁড়িয়ে নিজের কনিষ্ঠ ভ্রাতার এমন ম্যাজেস্টিক চরিত্র মুগ্ধ হয়ে দেখতে লেগে গেলো সে৷ হায়েনা আর নেকড়ের দলের লিডার দুজন পশুরূপ থেকে নিজেদের হিউম্যান ফর্মে ফিরে এসে কুর্নিশ করলো আসওয়াদ কে। এই স্বর্ণ চোখের ছেলে টা কে চিনতে তাদের বেগ পেতে হয়নি৷ পঞ্চদ্বীপের যে প্রান্তেই সে যাক না কেন, তার পরিচয় প্রকাশ করতে তার এই দৃষ্টিই যথেষ্ট।
পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যাওয়া জায়গাটার এমন স্তব্ধতা ঘোচাতে হায়েনাদের লিডার মাথা তুলে এগিয়ে এসে আসওয়াদের সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়লো, তারপর মাথা টা সামান্য নত করে বলে উঠলো,
— শেহজাদা, ক্ষমা করবেন। আপনি আমাদের কে এমন কোন্দলরত অবস্থায় দেখেছেন তার জন্য আমি লজ্জিত।
আসওয়াদ কিছুক্ষণ লোকটির দিকে তাকিয়ে থেকে হাতের ইশারায় তাকে দাড়াতে বলল, সাথে সাথেই উঠে দাড়িয়ে গেলো সে৷ লোকটা দাঁড়ানোর পর আসওয়াদ তাকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
— কি নাম তোমার? আর তোমরা শিরো মিদোরির জঙ্গলে বসবাস করো সেটা আমি জানিনা কেন? বাদশাহ কি তোমাদের ব্যাপারে অবগত আছেন?
লোকটি চাপা শব্দে গলা খাকারি দিয়ে মাথা নত রেখে উত্তর দিলো,
— আমার নাম টোডো, শেহজাদা। আর আমাদের ব্যাপারে আপনি জানেন না কারণ শুধুমাত্র পঞ্চদ্বীপের বাদশাহ ছাড়া অন্য কাউকে আমাদের ব্যাপারে জানানো তে নিষেধাজ্ঞা আছে। কিন্তু সৌভাগ্যবসত আপনি জেনে ফেলেছেন। জঙ্গলের এতটা গভীরে কেউই কখনো আসেনি এর আগে।
টোডো কথা টা বলে নিশ্চুপ হয়ে গেলো। আসওয়াদের কুঞ্চিত ভ্রু জোড়া স্বাভাবিক হয়ে এলো। দু কদম টোডোর দিকে এগিয়ে এসে সে গুরুগম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— তোমরা ঝগড়া কেন করছিলে?
— শেহজাদা! ও আমাদের জন্য নির্ধারিত জায়গায় ঢুকে পড়েছিলো যেটা আইন বিরুদ্ধ। আমরা নেকড়েরা নিজেদের এরিয়ার ভেতরে অন্য কারো অস্তিত্ব পছন্দ করিনা জানা সত্বেও সে এই কাজ করেছে, যার জন্য ঝামেলাটার সূত্রপাত।
নেকড়েদের দলনেতা টা মাথা নত রেখে নরম কন্ঠে উত্তর দিলো। আসওয়াদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তারপর টোডোর দিকে তাকালো। টোডো যে আসলেই দোষী সেটা তার চোখে মুখেই ফুটে উঠছে৷ আসওয়াদ এবার নেকড়ের লিডার টির দিকে দৃকপাত করে বজ্রকন্ঠে বলে উঠলো,
— এই মুহুর্তে তোমাদের ভেতরের সব প্রানীর দলনেতা কে আমার সামনে হাজির হতে বলো।
আসওয়াদের আদেশের সাথে সাথেই টোডো সহ বাকিরা কয়েকজন কে পাঠিয়ে দিলো বাকি লিডার দের তলব করতে। আর কিছু মুহুর্ত পরে প্রানীদের লিডার গুলো সবাই একে একে সেখানে হাজির হওয়ার পর আসওয়াদ ওদের সবার উদ্দ্যেশ্যে বলিষ্ঠ, উচ্চকন্ঠে বলল,
— আমি, শেহজাদা নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান! তোমরা কখনো কোনো শেহজাদাকে দেখোনি বা তাদের আদেশেও চলোনি৷ কিন্তু তোমরা এখন থেকে আমার আদেশে চলবে৷ তোমাদের ভেতর থেকে অনেক ভালো কিছু বের হবে বলে আমার বিশ্বাস৷ এখন থেকে তোমরা নিজেদের ভেতর ঝগড়া ঝামেলা করবে না। যদি করো তবে তোমাদের কে কঠিন সাজা দেওয়া হবে৷ এবং এমন সাজা দেওয়া হবে যা তোমরা কখনো ভাবনাতেও আনোনি! তোমরা যদি আমার কথা মতো চলো তবে আমি তোমাদের ওয়্যেলব্যিইং এর জন্য উদ্যোগ নিবো। আর যদি না চলো তবে এই জায়গাটার কোনো অস্তিত্ব রাখবো না। শিরো মিদোরি কোনো অসভ্য দের জন্য নয়! এখন থেকে তোমরা আমার হয়ে কাজ করবে। কি কাজ করবে সেটা সময় হলেই বুঝতে পারবে। তোমরা এখন থেকে মিলেমিশে থাকবে, কেউ কারো এরিয়াতে গিয়ে ঝামেলা বাধাবে না৷ তোমাদের কে আমি আগামী কাল থেকে প্রশিক্ষণ দিবো। স্যো বিহ্যেইভ ইয়্যোরসেলভস! অ্যান্ড দ্যাটস অ্যান অর্ডার।
পশুদের সব ক্লানের লিডার গুলো আসওয়াদের কথা চুপচাপ মেনে নিলো। আর এদের কে ঠান্ডা করে আসওয়াদ সালিম কে নিয়ে ফিরে এলো প্রাসাদে৷ কিন্তু নিজের এই আবিষ্কারের কথা কাউকে জানালো না, দাদাজান কেও না৷
.
আসওয়াদ রোজকার কাজ শেষ করে চলে যেতো জঙ্গলে, এরপর পশুদের সব গুলো ক্লানের ভেতর থেকে বেছে বেছে কিছু শক্ত পোক্ত নারী পুরুষ কে নিয়ে গঠন করলো ব্যিস্ট স্কোয়াডস৷ রোজ এদের কে নিজের শেখা সব ধরণের ফাইটিং এর ট্রেইনিং দিতো সে৷ সৌর্ড ফাইট থেকে শুরু করে বন্দুক চালনা এবং ক্রাভ মাগা পর্যন্ত।
আর তার কিছু বছর পরই আসওয়াদের সময় হয়ে গেলো উচ্চশিক্ষা গ্রহণের। হুজায়ফা আদনান নিজের দুই নাতিকে কুরো আহমারের স্বনামধন্য ভার্সিটিতে অ্যাডমিশিন করাতে চাইলেন। কিন্তু ইলহাম অ্যাডমিট হলেও আসওয়াদ রয়াল ফ্যামিলির ট্যাগ গায়ে বসিয়ে অ্যাডমিট হতে চাইলো না। সে চাইলো পুরোপুরি স্বতন্ত্র এবং সাধারণ কেউ হয়ে সেখানে অ্যাডমিট হতে। হুজায়ফা আদনান প্রথমে দ্বিমত করলেও পরবর্তিতে নাতির কথা টা বিবেচনা করে মেনে নিলেন। তার নাতি যে কোনো উদ্দ্যেশ্য এবং কারণ ছাড়া কিছু করবে না সেটা তিনি ভালোভাবেই জানতেন৷ আর তারপর আসওয়াদ কে তিনি অনুমতি দিলেন একজন অর্ডিনারি পার্সন হয়ে ভার্সিটি তে অ্যাডমিশন নেওয়ার।
এরপর থেকে আসওয়াদ এবং ইলহাম দুজনে দুই ভাবে ভার্সিটি তে যেতে শুরু করলো। ইলহাম গেলো প্রাসাদের রাজকীয় বিলাসবহুল গাড়িতে, শ খানেক বডিগার্ড সহ। আর আসওয়াদ নিজের স্বর্ণোজ্জল চোখ জোড়া লেন্সের সাহায্যে আড়াল করে ভার্সিটি যেতে শুরু করলো শুধুমাত্র একটা বাইক নিয়ে, উইদাউট এন্যি গার্ডস৷
ভার্সিটি তে ইলহাম থাকতো সাধারণের ভেতরে অসাধারণ দের কাতারের সামনের সারিতে, যেখানে কারো ঘেঁষার অনুমতি ছিলো না। আর অপরদিকে আসওয়াদ নিজেকে মিশিয়ে নিলো সাধারণ দের সাথে, জুটিয়ে নিলো গুটি কয়েক বন্ধুবান্ধব৷
ইলহাম খুব দ্রুতই নিজের নাম কামিয়ে নিলো, পড়াশোনায় এগিয়ে গেলো সে অনেক, প্রত্যেক সেমিস্টার কাপিয়ে দিতে লাগলো সে৷ কিন্তু আসওয়াদের মাথায় ঘুরলো অন্য কিছু। একাডেমিক পড়াশোনা কে ততটা গুরুত্ব দিলো না সে৷ রেজাল্টের কেতায় আগুন দিয়ে পুরোপুরি ঢুকে পড়লো ভার্সিটির লাইব্রেরি তে। দাদাজানের বুকস কালেকশনের বাইরে থাকা সমস্ত বই গুলো একে একে পড়া শুরু করলো। এবং সেই সাথে নজর দিলো কুরো আহমারের আইন ব্যাবস্থার দিকে। তার দাদাজানের আদেশ এবং শিরো মিদোরির আইনের বাইরে কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে সেটা পর্যবেক্ষণ করা হয়ে উঠলো তার অন্যতম দায়িত্ব।
রোজ ভার্সিটি শেষে ইলহাম ফিরে আসতো প্রাসাদে, কিন্তু আসওয়াদ ফিরতো না। দুই তিন দিন ধরে সে গায়েব থাকতো। কুরো আহমারের সমস্ত অলিতে গলিতে ঢুকে কুরো আহমার কে পরিদর্শন করা হয়ে উঠলো তার দৈনন্দিন রুটিনের একাংশ৷ আর ওদিকে শিরো মিদোরির জঙ্গলে গড়ে উঠতে থাকলো তার অত্যান্ত অনুগত এবং পুরোপুরি ব্যাক্তিগত শক্তিশালি সৈন্যদল, যেটা সম্পর্কে সালিম ছাড়া আর অন্য কেউই জানতো না৷
সুদর্শন ইলহাম, তার ওপর শেহজাদা হওয়ার কারণে মেয়েরা ছেকে ধরতে চাইতো তাকে। কিন্তু গার্ড দের কারণে তার কাছে কেউ ঘেঁষতে পারতো না, শুধুমাত্র কিছু মার্কা মারা অতিসুন্দরী ছাড়া। তাদের কে কাছে ঘেঁষতে ইলহামই অনুমতি দিয়েছিলো।
আর ওদিকে উজ্জল শ্যমলা, কিন্তু ধারালো মুখশ্রীর আসওয়াদ হয়ে উঠলো বাইরের সাধারণ দের ভেতরে অন্যতম নজর কাড়া সুপুরুষ। সাধারণ দের তুলনায় অতিরিক্ত হাইট আর পেশিবহুল শক্তিশালী শরীর হওয়ার কারণে অনেকেই ভয় পেতো তাকে। ছোটখাট সাইজের ছেলে গুলো ওর ধারে কাছে ঘেঁষতো না৷ নিজের তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া দিয়ে যার দিকেই তাকাতো সে আর দ্বিতীয় বার ফিরে তাকাতো না ওর দিকে৷ মেয়েগুলো দূর থেকেই দেখতো ওকে। ওর আকর্ষণীয় শরীর টা যেন চোখ দিয়েই গিলে খাওয়ার চেষ্টা করতো তারা৷
দেড় টা বছর এইভাবে যাওয়ার পর হঠাৎ করেই কুরো আহমারের খুনের পরিমাণ বেড়ে গেলো প্রচন্ড ভাবে। কিন্তু শূণ্যে নেমে এলো অন্যান্য অপরাধের সংখ্যা৷ শহরের যেখানে সেখানে পড়ে থাকতে দেখা গেলো বিভিন্ন অপরাধী দের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন লাশ৷ এবং তাদের শরীরে কেটে লেখা থাকতো তাদের করা অপরাধের কথা। অপরাধী রা অপরাধ করতে নিজের শরীরের যে অংশ ব্যাবহার করতো সেই অংশ টা মিসিং থাকতো বরাবর! রেপিস্ট দের জেনিট্যালস, সনামধন্য অসৎ আইনজীবীদের জিহবা, নামকরা চোর ডাকাত দের হাত! কিন্তু কিলার কে সেটা কেউ কোনো ভাবেই ধরতে পারতো না৷ লাশ গুলোর জঘন্য অবস্থা দেখে কখনো মনে হতো কোনো পশু খুন গুলো করেছে, আবার কখনো মনে হতো মানুষ! কিন্তু পশু খুন করলে তো আর এইভাবে গায়ে লিখে দিয়ে যাবে না, ওরা তো আর লেখা পড়া করে না! কিন্তু খুনের ধরণ দেখলে সেটা কোনো মানুষের কাজ বলে মনে হতো না! খুনি কে খুজে বের করতে গিয়ে কুরো আহমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘুম হারাম হয়ে গেলো।
আর কুরো আহমারের সব নিরাপত্তা সিস্টেম কে কাঁচকলা দেখিয়ে তাদের চোখের সামনে দিয়ে এ সমস্ত অপরাধী কে খুন করে চলে যেতো আসওয়াদ সহ তার বিশেষ ট্রেইনিং প্রাপ্ত ব্যিস্ট স্কোয়াডস। খুনের সামান্য তম নিশানাও কোথাও কেউ রেখে যেতো না!
কুরো আহমারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কন্ট্রোলার নিজেও হিমশিম খাচ্ছিলেন খুনি কে সেটা খুজে বের করতে৷ এদিকে কুরো আহমারের সমস্ত অপরাধী দের কে একটা একটা করে ধরে ধরে শাস্তি দেওয়ার কারণে খু্শি হয়ে উঠলো সেখানে বসবাসরত নাগরিকেরা। আর এই ইনভিজিবল কিলার কে কুরো আহমারের জনগণেরা ভালোবেসে নাম দিলো ‘টেরর’।
টেররের হাতে খুনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই সমস্ত কুরো আহমারে প্রচন্ড ভাবে কমে গেলো অপরাধের সংখ্যা। কেউ কোনো ধরণের ক্রাইম করার কথা স্বপ্নেও আর ভাবতো না৷ ক্রমে ক্রমে সাধারণ মানুষ দের বুকে নেমে এলো স্বস্তি। সবাই একটা দুঃশ্চিন্তা বিহীন সুন্দর লাইফ লিড করতে শুরু করলো৷
কুরো আহমার কে রিফর্ম করে আসওয়াদ এবার নজর দিলো ভার্সিটির দিকে। ভার্সিটি তে ‘লিডিয়াং’ নামধারী কিছু বিশেষ শ্রেনীর এক দল স্টুডেন্ট অন্যায়ভাবে সবখানে নিজেদের ক্ষমতা দেখাতো প্রতিনিয়ত। প্রতিনিয়ত তাদের দল ভারী হচ্ছিলো। কিন্তু কুরো আহমারের দেখাশোনা কারী কন্ট্রোলার বা রাজকর্মচারী দের নিকট এসব খবর কখনোই পৌছাতো না। সাধারণেরা ভয় পেয়ে চুপ থাকতো, কেউ তাদের কথা বাইরে বলতো না, যেটা আসওয়াদ খুব দ্রুতই ধরতে পেরেছিলো। কিন্তু এরপর সে আর গোপনে কিছু করলো না৷ প্রকাশ্যে একজন অর্ডিনারি স্টুডেন্ট হিসেবে ক্রমে ক্রমে যেখানে সেখানে লিডিয়াং দের অন্যায় কাজ কর্মে সরাসরি প্রোটেস্ট করা শুরু করলো।
শীতল দৃষ্টিতে তাকানো, শক্ত কন্ঠের আসওয়াদের প্রোটেস্টের মাত্রা ক্রমে ক্রমে বেড়ে চললে সেটা লিডিয়াং এর ছাত্রদলের কাছে এক সময় প্রকাশ্য হুমকিস্বরূপ দেখা দিলো। ইতোমধ্যে আসওয়াদের সাথে সাধারণ ছাত্ররা একজন দুজন করে যোগ হতে শুরু করলো। ভার্সিটির শিক্ষক রাও একটু একটু করে জানতে শুরু করলেন আসওয়াদের কথা৷ ক্লাসে এসে গম্ভীর রাশভারী, তীক্ষ্ণ দৃষ্টির আসওয়াদ কে অদ্ভুত ভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন তারা। আর তাদের সে পর্যবেক্ষণ রত দৃষ্টির দিকে নির্বিকার চিত্তে তাকিয়ে থাকতো আসওয়াদ। শিক্ষকরা কোনো এক অজানা আনুগত্যে চোখ নামিয়ে নিতেন। ওই চোখে চোখ মেলানো যেন ছিলো এক বিরাট দূরুহ কাজ৷
আর আসওয়াদ এইভাবে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে ফেলার পরই লিডিয়াং এর লিডার সিদ্ধান্ত নিলো আসওয়াদ কে সরিয়ে দেওয়ার, এবং আসওয়াদের পেছনে পাঠালো তাদের পোষা কিছু বখাটে গুন্ডার একটি দল।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আসওয়াদ কে সরিয়ে দিতে যাওয়া দলটি নিজেরাই নৃশংস হত্যার শিকার হলো, ঠিক কুরো আহমারে চলা হত্যাযজ্ঞের শিকার অপরাধী দের ন্যায়।
লিডিয়াং প্রথমে আসওয়াদ কে টেরর হিসেবে ভেবে নিয়ে ভয় পেলেও পরবর্তীতে এটাকে নিছক কো-ইনসিডেন্স হিসেবে উড়িয়ে দিলো। কিন্তু আসওয়াদ থামলো না। প্রতি পদে পদে যেখানে সেখানে লিডিয়াং কে তাদের অনৈতিক কাজে আরও বেশি বেশি বাধা দিতে শুরু করলো সে৷ আর প্রতিবারেই লিডিয়াং এর লিডার আসওয়াদ কে সরিয়ে দিতে কোনো দল কে পাঠানো মাত্র তারা নিজেরাই লাশ হয়ে ফিরতো। যেটা সামস্ত ভার্সিটির স্টুডেন্টস অ্যান্ড টিচার্স কারোরই অজানা ছিলো না!
ক্রমে ক্রমে লিডিয়াং গ্রুপের সাথে সাধারণ শিক্ষার্থী রাও বিশ্বাস করতে শুরু করলো তাদের আসওয়াদই সেই ‘টেরর’। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ জোগাড় করতে পারলো না কেউ। শহরের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গিয়েও কোনো সাহায্য পেলো না লিডিয়াং গ্রুপ টি।
এভাবে চলতে চলতে একে একে ভার্সিটি তে সব ধরণের দুর্নীতি বন্ধ হয়ে গেলো। লিডিয়াং গ্রুপের অস্তিত্বই নাই হয়ে গেলো এক সময়। কেউ আর কোনো ধরণের ক্রাইম করার কথা বলার সাহস টুকুও পেতো না। এর জন্য সাধারণ স্টুডেন্ট রা আসওয়াদের প্রতি প্রচন্ড কৃতজ্ঞ ছিলো। কিন্তু সে কৃতজ্ঞতা তারা দূর থেকেই প্রকাশ করতো কাছে আসতো না৷ আসওয়াদের বিশেষ কয়েক জন বন্ধু ছাড়া অন্য কেউ আসওয়াদের ধারে কাছেও ঘেঁষতো না৷
ভার্সিটি তে আসওয়াদ দের ফাইনাল ইয়ারের সময়ে আসওয়াদ নামক ‘টেরর’ এর কথা ঘুরতে ঘুরতে একসময় কানে গেলো কুরো আহমারের তৎকালীন কন্ট্রোলারের। ঘটা করে একদিন লোকজন নিয়ে এসে আসওয়াদ কে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গেলেন তিনি ভার্সিটি থেকে, সমস্ত সাধারণ শিক্ষার্থী দের সামনে থেকে৷
কিন্তু তার ঠিক আধ ঘন্টার ভেতরে নিজের কালেকশনের সবচেয়ে দামি গাড়িটা দিয়ে আসওয়াদ কে আবার ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন ভার্সিটি তে। এই আধ ঘন্টায় ঠিক কি হলো সেটা সবারই অজানা! সবাই শুধু এতটুকু জানে যে, কুরো আহমারের কন্ট্রোলার নিজের কর্মস্থল থেকে আসওয়াদের পেছন পেছন বের হতে হতে দৃঢ় পায়ে হেটে চলা আসওয়াদের হাতে পায়ে ধরে কুর্নিশ করছিলেন, যেটার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে মুহুর্তেই ছড়িয়ে পড়েছিলো। এবং তখনই তারা বুঝেছিলো তাদের ‘টেরর’ আসওয়াদ অর্ডিনারি কেউ নয়। সে এক্সট্রা অর্ডিনারি কেউ!
সেবার ভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে বের হওয়ার আগে তাদের বিদায়ী কালচারাল প্রোগ্রামের সময়ে এতদিনের রাশভারী, গম্ভীর মুখো, বজ্রকন্ঠের আসওয়াদ সবাইকে চমকে দিয়ে ভারী, দৃড় পায়ে স্টেজে উঠে মাইক নিয়ে তার শক্ত চোয়াল দ্বয়ের সাথে কুঞ্চিত ভ্রু জোড়ার মিশেলে, সমস্ত কুরো আহমারের উদ্দ্যেশ্যে বজ্রকঠিন কন্ঠে গেয়ে উঠেছিলো,
— কারো আদেশ মানিনা আমি চির স্বাধীন!
আমি না মানি আইন, আমি না কারো অধীন!
যেন আমিই শ্রেষ্ঠ, শুধু আমিই সঠিক!
কেবল আমিই সত্য, পুরা দুনিয়া বেঠিক!
প্রলয় আমি, আমি করি ধ্বংস!
আমি শত্রু ঘায়েলে স্বদা হন্য
আমি শৃংখলা মানিনা, মৃত্যু চিনিনা
আমি জ্বলা আগুন শিখা, নিভিতে জানিনা!
তোমার দাসত্ব, আমার রাজত্ব!
ধুকেফুকে মর, ওহে বিশ্বাসঘাতক!
আমারই আদালত, আমিই বিচারক!
হত্যা করি, কাপি না মানি স্বর্গ মর্ত!
ভার্সিটির সমস্ত টিচার এবং স্টুডেন্ট রা সেদিন দেখেছিলো আসওয়াদের এক অদ্ভুত নতুন রূপ। তার দৃঢ় মানসিকতা আর আধিপত্য বিস্তারের অসাধারণ ক্ষমতার নিকট নিজেদের কে শিশু সদৃশ মনে হয়েছিলো তাদের। গ্রাজুয়েশন শেষে ভার্সিটি থেকে চিরতরে প্রাসাদে ফেরার দিনেই আসওয়াদের জন্য এসেছিলো বিলাশবহুল রয়্যাল কার, আর নিজের চোখের লেন্স জোড়া খুলে সে গাড়িতে উঠে আসওয়াদের ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়েই সকলে জানতে পেরেছিলো যে তাদের সাথে এতদিন মিশে থাকা, তাদের কে সমস্ত অন্যায় অবিচারের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসা ব্যাক্তিটা আর কেউ নন, স্বয়ং শেহজাদা নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান!
চলবে……..