বাদশাহ_নামা #পর্বসংখ্যা_২৬ #আ_মি_না

0
3

#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_২৬
#আ_মি_না

৪৬. কেটে গেছে প্রায় দু তিন দিন। অ্যানা এখনো কিমেলাবেই আছে, ফ্যালকন আর লিন্ডার সাথে। সেরাতে নামীর চলে যাওয়ার পর থেকেই ওর ভয়ানক জ্বর। যদিও এখন বেশ অনেক খানিই সুস্থ। কিন্তু দুর্বলতা এখনো কাটেনি। ওর হাতে আছে আর মাত্র দু দিন। দুদিন পরেই আবার শিরো মিদোরি তে ফিরতে হবে৷ তারপর আবার শুরু হবে ব্যাস্ততা। ভালোই হবে, কাজের চাপে মাথা থেকে মীরের চিন্তা টাকে সরিয়ে রাখা যাবে৷

ভোর সকালে ওরা তিনজন হাটতে বেরিয়েছিলো। পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে বেশ অনেক খানিই হেটে এখন ওরা রিসোর্টে ফিরছে। লিন্ডা অ্যানার কোলে, সে একটু করে নামছে আবার কোলে উঠছে। একবার অ্যানার কোলে তো আর একবার ফ্যালকনের কোলে৷
অ্যানা আর ফ্যালকন লিন্ডার বয়স হিসাব করতে করতে আসছে। ঠিক কত টা বয়স হলে লিন্ডা নিজের হিউম্যান ফর্মে কনভার্ট করতে পারবে সেটা নিয়েই আলোচনা চলছে ওদের মাঝে। লিন্ডা টা দিনে দিনে খুব আইলসা হচ্ছে, সারাক্ষণ শুধু কোলে উঠে বসে থাকতে চায়৷ বিড়ালের যা কাজ আর কি! হিউম্যান ফর্মে চলে আসার পর সারাদিন ওকে খাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অ্যানা আর ফ্যালকন৷ আর ওদের এই আলোচনা শুনে অ্যানার কোলে বসে বসে রাগে ফুলে ফুলে উঠছে লিন্ডা৷

ওরা যখন রিসোর্টে এসে পৌছালো তখন ঘড়ির কাটা নয়টা ছাড়িয়ে দশটার দিকে এগোচ্ছে। ফ্যালকন আগে আগে ঢুকলো আর অ্যানা পেছন পেছন। গেইট খুলে ভেতরে ঢুকতেই ফ্যালকনের চোখে পড়লো সম্পুর্ন অচেনা কাউকে। সুইমিং পুলের পাশে থাকা ডাইনিং টেবিলের চেয়ার গুলোর একটিতে বসে আছেন তিনি৷ কাঁচা পাকা চুল, মুখে চাপ দাঁড়ি। পরণে স্যুট ব্যুট, মেদহীন ছিপছিপে গড়ন৷ চেহারায় বয়সের ছাপ ফুটে উঠেছে স্পষ্ট ভাবে৷ কিন্তু যৌবনে যে তিনি অসম্ভব সুদর্শন ছিলেন সেটা তার চেহারার জৌলুশ দেখলেই টের পাওয়া যাচ্ছে৷

ফ্যালকন এই সম্পুর্ন নতুন কাউকে দেখে কি করবে বুঝতে না পেরে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো অ্যানার অপেক্ষায়। তার পরমুহূর্তেই গেইট ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো অ্যানা। আর এরপর সুইমিংপুলের পাশে নজর পড়তেই আনন্দে চিৎকার করে উঠলো ও৷ তাড়াহুড়ো করে উচ্ছাসের সাথে লিন্ডা কে কোল থেকে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে ও ছুটে গেলো সে অচেনা মানুষ টির নিকট। ওকে ছুটে আসতে দেখে সে লোকটিও একরাশ মমতা মাখা হাসি দিয়ে উঠে দাড়ালো চেয়ার থেকে। আর সে উঠে দাঁড়ানো মাত্রই অ্যানা গিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো তার বুকে। তারপর অতি আদুরে গলায় বলে উঠলো,

— চাচা জান!

অ্যানার মুখ থেকে চাচা জান শোনা মাত্রই ফ্যালকন বুঝলো ইনি কিমালেবের কন্ট্রোলার জায়ান সাদি। ভদ্রলোকের চেহারায় ও কিছুটা রাজকীয় ভাব৷ হাজার হলেও কোনো না কোনো ভাবে তো তারা দেমিয়ান ব্লাডের সাথে কানেক্টেড, টাইটেল টা দেমিয়ান না হলেও৷

অ্যানা জায়ান সাদি কে ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে বসতে বলে নিজেও অতি উৎসাহের সাথে অন্য একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,

— আপনাকে কে বলল যে আমি এখানে আছি?

— কে বলতে পারে! হিজ ম্যাজেস্টি ছাড়া! সেদিন রাতে এসে আমাকে বলে গেলেন আমি যেন আপনার পরিপূর্ণ খেয়াল রাখি। আপনি যেদিন এখানে এসেছিস সেদিন থেকেই এই পুরো এরিয়া টিতে জেড ক্যাটাগরির গার্ড মোতায়েন করে রেখেছেন তিনি৷ তারপরও স্থীর থাকছেন না, আবার আমাকে বলে গেলেন আপনার দিকে খেয়াল রাখতে। কিন্তু দূর থেকে আপনার খোজ খবর নিলেও নানান ব্যাস্ততার কারণে সশরীরে আসতে পারিনি, তাই আজ চলে এলাম।

অ্যানা কিছুটা মুখ বেকিয়ে নামীরের উদ্দ্যেশ্যে নিচু গলায় বলে উঠলো,

— সবসময় বেশি বেশি! হুহ!

তারপর আবার জায়ান সাদিকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,

— চাচা জান, উঠুন, পোশাক খুলে হালকা পোশাক পরে ফ্রেশ হয়ে আসুন। ভেতরে ঢুকে বা দিকের ওয়াল আলমিরাতে দেখুন ছেলেদের অনেক পোশাক রাখা আছে। ডানদিকের কম্পার্টমেন্টে মীরের পোশাক, ও জায়গাতে হাত দিবেন না। ওর বাদিকে যে পোশাক গুলো রাখা আছে ওর থেকে যেটা খুশি পরে নিন। আমরা এখনো কেউ সকালের খাবার খাইনি, এখন খেতে বসবো, আপনিও খাবেন আমাদের সাথে৷

তারপর উঠে চলে গেলো কিচেনের দিকে। অ্যানার সুক্ষ্ম আদেশে জায়ান সাদি আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে উঠে চলে গেলেন ফ্রেশ হতে।

.

ডাইনিং টেবিলের জায়গাটায় রোদ এসে পড়েছে৷ সুইমিং পুলের অন্য পাশে, বড়সড় একটা নাম না জানা গাছের ছায়ায় কালো সাদা মিশেলের একটা নকশাদার ম্যাটের ওপর বসে আছে অ্যানা, জায়ান আর ফ্যালকন। লিন্ডা অ্যানার কোলে বসে বসে ঝিমুচ্ছে আর গরগর শব্দ করছে। তিনজনেই নিরব।

নিরবতা ভেঙে জায়ান অ্যানা কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,

— হিজ ম্যাজেস্টির সাথে আপনার ঝামেলা এখনো ঠিক হয়নি?

— এসব আর কখনো ঠিক হবে না চাচা জান। আর ঠিক করতেও আমি চাইনা।

অন্য দিকে তাকিয়ে লিন্ডার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে অভিমানী সুরে বলল অ্যানা৷ তারপর কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে উঠলো,

— আচ্ছা! মীরের যে একটা টুইন ব্রাদার আছে সেটা আপনি জানেন?

— কেন জানবো না! আমাদের সামনেই তো ওরা বেড়ে উঠেছে।

— তাহলে আপনিও জানেন? সবাই জানে? তবে আমি কেন জানিনা? আমাকে কেন বলা হয়নি?

বড়বড় চোখ করে গলা সামান্য চড়িয়ে বলে উঠলো অ্যানা৷ জায়ান এক পলক অ্যানার দিকে তাকিয়ে আনুগত্যের সাথে উত্তর দিলো,

— আপনাকে জানানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে শেহজাদী, তাই আপনাকে কেউ জানায়নি। তাছাড়া এমন আরও অনেক অনেক বিষয় আছে যেগুলো আপনার জানা নেই।

— এমন কেন? আমি কি আপনাদের কেউ না? নাকি আমাকে কিছু বললে আপনাদের রাজনৈতিক কোনো সমস্যায় পড়তে হবে? নাকি আপনারা আমাকে বিশ্বাস করেন না? কোনটা?

ফুসে উঠে বলল অ্যানা৷ জায়ান থতমত খেলো, অ্যানা ফুসলে ব্যাপার টা মোটেও ভালো হবে না। এ মেয়েকে রাগানো মানে ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা করা। নিজেকে যথাসম্ভব নমনীয় রেখে জায়ান বলল,

— আসলে ব্যাপার টা তেমন না……

— তো কেমন?

ভ্রু কুচকে বাঘিনীর ন্যায় তাকিয়ে বলে উঠলো অ্যানা। জায়ান শুকনো ঢোক গিললো একটা। তারপর বলল,

— আসলে, উনি চাননি যে এই সমস্ত রাজনৈতিক বিষয়, বা ওনার জন্মের সময়কার বিষয় গুলো আপনি জানেন আর এ গুলো নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করে আপনার মাথায় চাপ দেন৷ তাই তিনি নিজেও আপনাকে কিছু জানাননি আর আমাদের কেও জানাতে দেননি। সে যা-ই হোক, আপনার আর ওনার সম্পর্কে এত ঝামেলা হচ্ছে কেন? আপনাদের ঝামেলা তো এতদিন ধরে কখনো গড়ায়নি এখনও পর্যন্ত! আপনাদের যদি মনে হয় কোনো আপনাদের ভেতরে কোনো অভিভাবকের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন তবে আমাকে নির্দ্বিধায় জানাতে পারেন।

— কোনো প্রয়োজন নেই। ঠিক হওয়ার হলে আমরা নিজেরাই ঠিক করে নিতে পারবো। আমাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপারে অন্য কারো হস্তক্ষেপ আমি বা মীর কেউই পছন্দ করি না৷

গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর করলো অ্যানা৷ তারপর আবার বলল,

— কেউ নেই আমার, মীর ছাড়া। বাবা, মা, দাদা কেউই না। বাবা মারা গেলেন জন্মের আগে, মা মারা গেলেন জন্মের সময়, দাদা খুন হলেন মীরের হাতে। আমার আপন বলতে আর কেউ নেই! আজ যদি আমার বাবা বেচে থাকতেন তবে কি আমার এই দিন দেখা লাগতো? উনি নিশ্চয় নিজের মেয়েকে এমন খারাপ অবস্থায় দেখতে চাইতেন না। নিশ্চয় কোনো না কোনো স্টেপ নিতেন! আজ আমি এতিম বলে আমার সাথে এত কিছু হচ্ছে। কেউ নেই আমার!

কথা শেষ করার সাথে সাথেই অ্যানার চোখ থেকে পানি পড়লো দুফোটা। কিমালেবের আকাশে মেঘ করলো সাথে সাথেই। আর সেই সাথে শুরু হলো ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। কিন্তু কেউ কারো জায়গা ছেড়ে উঠলো না৷ জায়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো,

— হিজ ম্যাজেস্টির এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বিশ্বস্ত যদি কেউ থেকে থাকে তবে সেটা আপনার বাবা, সালিম আরাবি দেমিয়ান। আর উনি যেদিন খুন হন সেদিন মৃত্যুর আগ মুহুর্তে আপনার দায়িত্ব তিনি হিজ ম্যাজেস্টির হাতেই অর্পণ করে দিয়ে যান। সে দায়িত্ব পালনে উনি কখনো অবহেলা করেছেন বলে আমার মনে পড়ে না!

— খুন মানে! আমার বাবা খুন হয়েছিলেন?

বিস্ফোরিত নয়নে প্রশ্ন করলো অ্যানা। সে জানতো তার বাবা সালিম কোনো রোগের কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন, কিন্তু তিনি যে খুন হয়েছেন সে কথা অ্যানা ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি।

জায়ান নিজের কপাল চাপড়ালো। এতদিন ধরে লুকায়িত কথাটা মুখ থেকে বেফাস বেরিয়ে গেছে। এ কথা আসওয়াদের কানে গেলে সে তাকে কি করবে তা কেউ জানে না। জায়ান এখন কি করবে বুঝতে পারলো না৷ জায়ানের নিরবতা দেখে অ্যানা মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— কিভাবে খুন হয়েছিলেন উনি? কে খুন করেছিলো ওনাকে?

জায়ান ভড়কালো, একটা ঢোক গিলে বলে উঠলো,

— আমি এসব কিছুই বলতে পারবো না শেহজাদী! আমাকে ক্ষমা করুন, আমি ভুল করে বলে ফেলেছি। হিজ ম্যাজেস্টি যদি জানেন আমি আপনাকে কিছু বলেছি তবে উনি আমাকে জানে মেরে ফেলবেন!

— আপনাকে সবকিছুই বলতে হবে! কে মেরেছিলো আমার বাবাকে? সত্যি করে বলুন! কেন মেরেছিলো? কি দোষ ছিলো আমার বাবার?

অ্যানা নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো। জায়ান পড়লো বিপদে। এখন যদি ও সবকিছু বলে দেয় তবে আসওয়াদ তাকে আস্ত রাখবে না। আর যদি শেহজাদী কে কিছু না বলে তবে শেহজাদী ওকে আস্ত রাখবে না! ও এখন কি করবে। শুকনো একটা ঢোক গিলে ও বলে উঠলো,

— শেহজাদী, আমি কিছুই বলতে পারবো না আমাকে ছেড়ে দিন। আমি চলে যাচ্ছি, আমাকে আমার কর্মক্ষেত্রে ফিরতে হবে।

বলেই উঠতে গেলো জায়ান। কিন্তু তার আগেই অ্যানা তার পাশে বসে এতক্ষন তাদের কথা হা করে শোনা ফ্যালকনের দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো,

— ফ্যালকন!

অ্যানার বজ্রকন্ঠের ডাক শোনা মাত্রই ফ্যালকন তড়িৎ গতিতে সাড়া দিলো। অ্যানা ওর দিকে তাকিয়ে রিসোর্টের গেইটের দিকে ইশারা করলো। আর অ্যানা ইশারা করা মাত্রই ফ্যালকন ঝড়ের গতিতে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে বিশেষ ভাবে নিজের হাত ঘুরিয়ে গেইটের উদ্দ্যেশ্যে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,

— আলটিমেট লক!

আর সাথেই সাথেই ওশান ব্লু রঙা দৃশ্যমান বিদ্যুৎ খেলে গেলো সে গেইট সহ পুরো প্রাচীরে। জায়ান সেদিকে তাকিয়ে হা হয়ে রইলো। তারপর অ্যানার দিকে তাকিয়ে কন্ঠে অবাকত্ব ফুটিয়ে বলে উঠলো,

— আপনি ওদের ম্যাজিক শিখিয়েছেন!

— হ্যাঁ, শিখিয়েছি।

নির্বিকার গলায় বলল অ্যানা। অ্যানার দিকে কিছুক্ষণ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জায়ান। এখন সে চাইলেও কোনো ভাবে বের হতে পারবে না সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পারলো, আর অ্যানাও যে তাকে সহজে যেতে দিবে না সেটাও টের পেলো৷ বাধ্য হয়ে আবার নিজের জায়গায় ঠিকঠাক ভাবে বসলো ও। তারপর নমনীয় সুরে বলল,

— অ্যানিম্যাল পার্সোনেজ দের কে ম্যাজিক শেখানো নিষিদ্ধ হওয়ার পর ও আপনি কেন শিখিয়েছেন? এখন যদি ভালো মন্দ কিছু হয়ে যায়!

— কিছু হলে সেটা আমি বুঝবো৷ আমার সন্তান্দের আমি কিভাবে বড় করবো সেটা আমার ব্যাক্তিগত বিষয়। এসব নিয়ে ভাবার জন্য আমি আছি। আপনি এখন আমাকে সব বলবেন। কথা ঘোরানোর চেষ্টা করবেন না। আপনি আমার চাচাজান, আপনার কাছে আমি সব সত্যি শোনার আশা রাখি। আশা করি আপনি আমাকে আশাহত করবেন না। আর মীরের ব্যাপারে ভয় পাবেন না। আপনার সিকিউরিটি আমি নিশ্চিত করবো। আপনি আমাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন৷ মীরের জমজ আর আমার পরিবারের মৃত্যু রহস্য খুলে না বলা পর্যন্ত আমি আপনাকে ছাড়ছিনা। আর আপনি নিশ্চয় জানেন আমি চাইলেই মানুষের মন পড়তে পারি, তবে সেটা মানুষের জন্য মৃত্যুসম বেদনার হয়। আপনাকে আমি ব্যাথা দিতে চাই না। তাই ভালো হয় আপনি নিজে নিজেই সবটা বলুন।

শক্ত গলায় কথা গুলো বলল অ্যানা। ওর মনের মধ্যে এক সুক্ষ্ম সন্দেহের তীর কোথাও খচখচ করছে, কিন্তু ও মনে প্রাণে চায় সে সন্দেহ টা যেন সত্যি না হয়! সন্দেহ টা মিটিয়ে ফেলার জন্য প্রথমেই অ্যানা গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— আমার বাবাকে কে মেরেছিলো?

জায়ান কিছুক্ষণ ইতস্তত করে উত্তর দিলো,

— আপনার দাদাজান।

জায়ানের উত্তর শুনে অ্যানার চোখ কপালে ওঠার উপক্রম! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ও জিজ্ঞেস করলো,

— দাদাজান! আমার দাদাজান! উনি নিজের সন্তান কে কেন খুন করতে চাইবেন! আপনি মিথ্যা বলছেন আমাকে? মিথ্যা বলে সত্যি টা লুকাতে চাইছেন?

— আমি বলেছিলাম যে হিজ ম্যাজেস্টি আপনার নিকট এই সমস্ত রাজনৈতিক আর পারিবারিক চ্যাপ্টার টা গোপন রাখতে বলেছেন, আর তার এইটাই কারণ৷ আপনি কিছুই বিশ্বাস করতে চাইবেন না, আর না কিছু মেনে নিতে পারবেন! শুধু শুধু আপনার ওপর প্রেশার ক্রিয়েট হবে৷ দয়া করে আমাকে যেতে দিন শেহজাদী! আমি এসব বলতে পারবো না!

নতমুখী হয়ে বলল জায়ান৷ অ্যানা নিজেকে শক্ত করে নিলো, তারপর নিজের কন্ঠস্বর স্বাভাবিক করে নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,

— দাদাজান কেন বাবাকে মেরেছিলেন?

— উনি শুধু আপনার বাবাকেই না, হিজ ম্যাজেস্টির বাবাকেও খুন করেছেন। আর আপনাকে এবং হিজ ম্যাজেস্টি আর জাযীব ইলহান দেমিয়ান কেও হত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে হিজ ম্যাজেস্টি সময় মতোই ওনার সমস্ত কারসাজি ধরে ফেলেন, আর তারপর আপনার পোষ্য সন্তান, হাইনার বাবা আর তার দলবল দিয়ে ওনাকে জীবন্ত খাইয়ে দেন।

— কেন মেরেছিলেন উনি?

অ্যানা শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো আবারও। জায়ান কিছুক্ষণ সময় নিয়ে উত্তর দিলো,

— হিজ ম্যাজেস্টির জন্ম এবং আপনার দাদাজানের খুন সবকিছুই একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই বলতে হলে আমাকে সবকিছুই বলতে হবে, প্রথম থেকে।

— বলুন, আমি শুনতে চাই, সবকিছু।

নিজেকে শক্ত করে নিয়ে জায়ানের দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলল অ্যানা। জায়ান অ্যনাকে সবকিছু জানাতে স্মৃতীর পাতায় ডুব দিলো……

৪৭. শিরো মিদোরির পরাক্রমশালী বাদশাহ হুজায়ফা আদনান দেমিয়ানের ছিলো দুই পুত্র সন্তান৷ জ্যেষ্ঠ পুত্র শান আরহাম দেমিয়ান এবং কনিষ্ঠ পুত্র সাদ আজলান দেমিয়ান।

সাদ আজলানের এক মাত্র পুত্র সন্তান, সালিম আরাবি দেমিয়ান যখন সাত বছরে পা দিয়েছে তখনও শান আরহামের কোনো সন্তান হয়নি। আরহামের দাসীরা কেউই সন্তান ধারণ করতে পারছিলো না। গর্ভসঞ্চার হওয়া মাত্রই কোনো এক অজানা কারণে দাসী গুলো একের পর এক মৃত্যু বরণ করছিলো।

দেমিয়ান বংশের রীতি অনুযায়ী লাইফ ট্রি দ্বারা নির্ধারিত শেহজাদাই পরবর্তীতে বাদশাহ হিসেবে নির্বাচিত হন। আর লাইফ ট্রি একজন শেহজাদার যোগ্যতা, ক্ষমতা, শক্তি আর পরবর্তী বংশধর দেখেই বাদশাহ নির্বাচন করে। হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা এই সিস্টেম ভঙ্গ করার সক্ষমতা এখনও পর্যন্ত কারো হয়নি। কারণ লাইফ ট্রি এই পঞ্চদ্বীপের ভিত্তি।
লাইফ ট্রির উৎপত্তি কিভাবে আর কোথা থেকে সেটা কারোরই জানা নেই। তবে এই লাইফ ট্রি দুই থেকে তিন হাজার বছর পর পর জন্মানো দেমিয়ান বংশের শেহজাদী দের সাথে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে কানেক্টেড থাকে, এবং সেই সাথে পঞ্চদ্বীপের সমস্ত ইকোসিস্টেম চলে যায় সেই শেহজাদীর হাতে৷ এর কারণ এবং রহস্য কোনোটাই কারো জানা নেই। হাজার বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে।

আরহামের কোনো সন্তান না হওয়ায় আজলান খুশি ছিলেন। কারণ আজলান আরহামের ন্যায় যোগ্য ছিলেন না। তার অনেক বেশিই খুত ছিলো। যার কারণে লাইফ ট্রি তাকে কখনোই বাদশাহ হিসেবে নির্বাচিত করতো না৷ কিন্তু আরহামের যদি কোনো সন্তান না হয়, তবে যোগ্যতার খাতিরে আজলানই উপরে উঠে যাবেন, এবং তাকে বাদশাহ হওয়া থেকে তখন আর কেউই আটকাতে পারবে না। কিন্তু তখনই বাধে বিপত্তি৷

আজলান জানতে পারেন আরহামের একজন দাসী সন্তানসম্ভবা, এবং সেটা নাকি ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে। নিজের বাবা হওয়ার খবর টি নিরাপত্তার স্বার্থে সবার থেকেই গোপন করে রেখেছিলেন আরহাম।

কিন্তু সেটা আজলানের কানে যেতেই ক্ষোভে ফুসতে থাকেন তিনি। সাম্রাজ্য হাতের মুঠোয় এসেও হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ব্যাপার টা তিনি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না। আবার আরহামের কড়া নিরাপত্তার কারণে কিছু করতেও পারছিলেন না৷ বাধ্য হয়ে সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে গেলেন।

কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে আরহামের সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর পরই ভয় পেয়ে যান আজলান। শুধু তিনিই নন, ভয় পেয়ে যান দেমিয়ান বংশের সকলেই।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here