#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_৩৬
#আ_মি_না
৫১. পরদিন সকাল বেলা অ্যানা ওর হাতে দুইটা বড়সড় প্যাকেট নিয়ে ওর মাঞ্জার থেকে বের হয়ে এলো মিটিং জোনে। দিনের আলো ফুটলো কেবল। ওয়ার্কিং জোন এখন জেগে উঠতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। কিচেনের ওদিক টা থেকে থেকে ধোয়া উড়ছে। মাঝে মাঝে সেখান থেকে রান্নার সুঘ্রাণ ভেসে আসছে মৃদুমন্দ বাতাসের সাথে সাথে৷ ওয়ার্কার্স রা যে যার কাজে লেগে পড়েছে ইতোমধ্যে।
শার্লট ডাইনিং এরিয়া পরিষ্কার করছিলো। খানিক বাদেই খেতে বসবে সবাই। এমন সময় অ্যানা কে দুইটা প্যাকেট হাতে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে শার্লট কাজ থামিয়ে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্যাকেট গুলোর দিকে। অ্যানা কাছাকাছি এলে প্যাকেট দুটোর দিকে নির্দেশ করে বলল,
— কি আছে রে এতে অ্যানা?
অ্যানা প্যাকেট দুটোর ভেতর থেকে একটা শার্লটের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
— নিজেই দেখে নে।
শার্লট দ্বিধাভরা দৃষ্টিতে একবার অ্যানার দিকে তাকিয়ে অ্যানার হাত থেকে প্যাকেট টা হাতে নিয়ে প্যাকেট টির মুখ খুললো। খুলেই অবাক হয়ে গেলো ও। বিস্মিত দৃষ্টিতে অ্যানার দিকে একবার তাকিয়ে উচ্ছসিত হয়ে আবার প্যাকেটের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাড়াহুড়ো করে পোশাক টি বের করলো প্যাকেটের ভেতর থেকে। বের করতেই মেরুণ রঙা টি লেঙ্গথ এর অফ শোল্ডার গাউন টা এক দমকে ফুলে ফেপে ফ্লাপি হয়ে ঝুলে রইলো শার্লটের হাতে।
গাউন টি দেখে শার্লটের খুশি আর ধরে না! উচ্ছসিত হয়ে মুখ থেকে কয়েকটা আনন্দ সূচক ধ্বনি বের করে ও বলে উঠলো,
— এইটা আমার জন্য?
অ্যানা মৃদু গতিতে ওপর নিচে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো। সেটা দেখে শার্লট খুশিতে আত্মহারা হয়ে পোশাক টা নিজের গায়ে ধরে লাফিয়ে নেচে নিলো খানিক, তারপর পোশাক টার উপরিভাগে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মুগ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো,
— ড্রেস টা কত্ত সুন্দর! কি দারুণ কালার! মনে হচ্ছে খেয়ে ফেলি! এটা সত্যিই বেগমের?
শেষের কথা টা অ্যানার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল শার্লট। অ্যানা আবারও আগের মতো মাথা নাড়ালো। অ্যানার থেকে কনফার্ম হয়ে শার্লট আরও বেশি খুশি হলো যেন! হাতে ধরা পোশাক টা নাকের কাছে ধরে বুক ভরে সেটার ঘ্রাণ নিয়ে আবার বলল,
— ইশ, কি দারুন পারফিউমের ঘ্রাণ এতে! ব্রায়ান ভাইয়া বলছিলো পুরো প্রাসাদ জুড়ে নাকি এত্ত সুন্দর, এত্ত দারুণ স্মেল পাওয়া যায়, যে মনে হয় সারাক্ষণ নাক লাগিয়ে রাখি!
শার্লটের কথায় মজা পেয়ে হেসে উঠলো অ্যানা। তারপর বলল,
— পছন্দ হয়েছে তোর?
— হবে না মানে! আলবাত হয়েছে! এটা তো এক্কেবারেই নতুন দেখা যায়। কিন্তু তুই এটা কিভাবে জোগাড় করলি বলতো? কে আছে তোর প্রাসাদে?
পোশাক টা নিজের গায়ে ধরে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করলো শার্লট। অ্যানা চোখে হেসে বলে উঠলো,
— বলেছিলাম না আমি বিবাহিতা! আমার ভা….. মানে আমার বর ওখানের কর্মচারী। সে-ই এসব এনে দেয়।
— কাল থেকে তোর কি হয়েছে বলতো! কথায় কথায় বিবাহিতা বিবাহিতা করছিস! সমস্যা কি তোর? মোটেও মজা করবিনা আমার সাথে বলে দিলাম! তোকে আমি আমার ভাবি বানাবো, তাই এসব অলুক্ষুণে কথা বলবি না আমার সামনে।
কিছুটা রেগে ভ্রু কুচকে বলে উঠলো শার্লট। অ্যানা ওর রাগি মুখ খানার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। তারপর বলল,
— সত্যি কথাই বললাম, বিশ্বাস করা না করা তোর ব্যাপার।
— চুপ থাক তুই, কথা কবি না।
বলে শার্লট আবার পোশাক টা দেখতে লেগে গেলো। মেরুণ রঙা ফ্লাপি গাউন টার সমস্ত শরীর জুড়ে বসানো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেরুণ রঙা স্টোন গুলো রোদে চকমক করছে, সেগুলোই বার বার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে শার্লট। আর অ্যানা দেখছে শার্লটের এই বাচ্চামি কান্ডকারখানা। কিছুক্ষণ পর শার্লট আনমনে বলে উঠলো,
— ইশ, আমি যদি বাদশাহর বেগম হতে পারতাম! বেগম না হোক, অন্তত দাসী হতাম! তবে এমন সুন্দর সুন্দর পোশাক পেতাম রোজ রোজ।
শার্লটের কথা শুনে অ্যানা বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
— পুরান পাগল ভাত পায় না, আবার নতুন পাগলের আমদানি!
.
বর্তমানে লিলির মাঞ্জারের কামরায় বসে আছে শার্লট আর অ্যানা৷ লিলি উচ্ছসিত মুখে ওর কামরার আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে অ্যানার দেওয়া পোশাক টা নিজের গায়ে ধরে বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। চোখে মুখে আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠছে ওর। তা দেখে শার্লট আর অ্যানা মাঝে মাঝেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। লিলি আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখতে দেখতেই উচ্ছসিত কন্ঠে বলে উঠলো,
— গাউন টা কত্ত সুন্দর! বিয়ে উপলক্ষে তোমার থেকে এত্ত সুন্দর একটা উপহার পাবো তা আমি কখনোই ভাবিনি অ্যানা! এটা কোথায় পেয়েছো তুমি?
অ্যানা কিছু বলার আগেই শার্লট পাশ থেকে বলে উঠলো,
— প্রাসাদে অ্যানার এক কাল্পনিক জামাই থাকে, সে-ই দিয়েছে। জামাই ইন হার ডেলুলু।
অ্যানা শার্লট কে পেছন থেকে একটা চাটি মেরে থামিয়ে দিলো। তারপর লিলি কে বলল,
— প্রাসাদে আমার একজন ক্লোজ রিলেটিভ আছে, তার মাধ্যমেই আনিয়েছি।
— অনেক ধন্যবাদ তোমাকে অ্যানা! তুমি যে আমাকে কতটা খুশি করে দিয়েছো তা তুমি নিজেও জানো না! আমার বিয়ে টা কে বলতে গেলে তুমি পরিপূর্ণতা দিয়েছো, তোমাকে ধন্যবাদ!
অ্যানা লজ্জা পেলো, সামনের পরে কেউ এভাবে বললে ওর লজ্জা লাগে প্রচন্ড। রক্তিম গাল নিয়ে নাকটা কিঞ্চিৎ কুচকে ও বলে উঠলো,
— আরে নাহ! ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। কেউ কাউকে কোনো উপহার দিলে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে হয় না। আর তাছাড়া এটা তোমার বিয়ে, বিয়েতে তো সবকিছুই পারফেক্ট হওয়া চাই! আর তাছাড়া এটা তো একেবারেই নতুন পোশাক নয়, ব্যাবহৃত পোশাক। এ আর এমন কি!
— এটাই আমার কাছে হাজার খানা নতুন পোশাকের থেকেও বেশি দামী অ্যানা! আমি যে কত্তটা খুশি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না!
অ্যানার দিকে কৃতজ্ঞতা সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল লিলি।
লিলির সাথে আরও কিছুক্ষণ বিয়ে নিয়ে আলাপ করে ওরা দুজন বের হয়ে আসলো সেখান থেকে। তারপর মাঞ্জারের ভেতর কার সরু রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে এগোলো মিটিং জোনের দিকে। শার্লট অ্যানার সাথে বকবক করে যাচ্ছে, আর অ্যানা মাঝে মাঝে হু হা করে তার উত্তর দিচ্ছে। এমন সময় শার্লটের চোখ গেলো অ্যানার হুডির গলার কাছ টাতে। অ্যানা মাস্ক পরেনি আজও, কিন্তু মাথায় হুডির হুড তুলে দিয়েছে। আর তার ফাক দিয়েই শার্লটের চোখ গেছে অ্যানার গলায়।
ফর্সা, মোলায়েম গলাটার ওপর থেকে গোটা করে একটা মেরুণ রঙা ছোপের সামান্য অংশ স্পষ্ট ভাবে উকি দিচ্ছে। শার্লট সেদিকে দৃষ্টি রেখে কিছুটা আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলো,
— অ্যানা! তোর গলায় কি হয়েছে?
অ্যানা প্রথমে ভেবে পেলো না, বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে শার্লটের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে নিজের গলা টা দেখার চেষ্টা করলো একবার, যে কি হয়েছে। আর হুডির ভেতর দিয়ে গলা আর বুকের দিকে উকি দিয়ে ছোপ ছোপ দাগ গুলো দেখা মাত্রই ওর মনে পড়ে গেলো কাল রাতের কথা। মীর ফাজিল টা এই কাজ করেছে কাল। অসভ্য টার হুস থাকে না কোনোদিন! মীর কে মনে মনে কয়েকটা সভ্য গালি দিয়ে গলা থেকে চোখ সরিয়ে শার্লটের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকালো অ্যানা। তারপর বলল,
— আরে ও কিছু না! কাল রাতে কামরায় এক বড়সড় অসভ্য মশা ঢুকেছিলো। সেইটাই মনে হয়ে কামড়ে কামড়ে এই অবস্থা করেছে। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, টের পায়নি কিছু।
— আচ্ছা দেখি, ভাইয়াকে বলে তোর জন্য একটা মশার স্প্রে আনিয়ে দিবো, তাহলে আর তোকে মশা কামড়াবে না।
বলতে বলতে সামনে হাটতে লাগলো শার্লট। অ্যানা মনে মনে বলল,
— এ মশা যদি স্প্রে মারলে চলে যেত রে, তাহলে তো আমি নিজেই শ খানেক সাথে নিয়ে ঘুরতাম!
৫২. কেটে গেলো প্রায় এক সপ্তাহ। লিলি আর পিটারের বিয়ে আজ। সকাল থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। অ্যানা ওর মাঞ্জারে যথারীতি নিজের হুডি আর ট্রাউজার পরে রেডি হচ্ছিলো আর মনে মনে কাবাবের রেসিপিটা মনে করছিলো। কাবাব রান্নার ভার টা আজ ওর ওপর।
এমন সময় ওর দরজায় এসে কড়া নাড়লো শার্লট। অ্যানা তো পুরোপুরি অপ্রস্তুত! ওর চোখে এখনো লেন্স লাগানো হয়নি। দ্রুত গতিতে ধবধবে সাদা রঙা চুল গুলোকে এক ঝটকা দিয়ে কুচকুচে কালো তে পরিণত করলো ও, তারপর ছুটে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা লেন্স জোড়া পরে নিলো চোখে। তারপর ধীরে সুস্থে এসে দরজা খুললো। অ্যানা দরজা খুলেতেই শার্লট হুড়মুড়িয়ে ঢুকে গেলো কামরায়৷ তারপর লাফাতে লাফাতে খাটের ওপর বসে পড়ে বলল,
— তুই আজ কি ড্রেস পরবি দেখালি না তো!
অ্যানা দরজা টা আবার লাগিয়ে দিতে দিতে শার্লট কে বলল
— বিয়ে হচ্ছে লিলির, কিন্তু তুই যেভাবে লাফালাফি করছিস, মনে হচ্ছে বিয়েটা তোরই হচ্ছে! ব্রায়ান কে বলে ব্যাবস্থা করবো নাকি?
— আমার ব্যাবস্থা পরে কইরো, আগে তোমরা তোমাদের ব্যাবস্থা করো, তোমাদের বিয়ে না দেখে আমি কোথাও যাচ্ছিনা।
অ্যানা এবার শক্ত হলো। হাসি হাসি মুখটা কঠোর করে নিয়ে শক্ত গলায় বলল,
— এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে শার্লট। একই মজা বার বার করলে কিন্তু ব্যাপার টা মোটেই ভালো দেখায় না৷ এরকম কথা দ্বিতীয় বার বললে কিন্তু আমি তোদের দুজনের সাথেই সব ধরণের যোগাযোগ একেবারেই কমিয়ে দেবো।
অ্যানার ধমকে চুপসে গেলো শার্লট। মন টা বিষাদে ছেয়ে গেলো ওর। অ্যানা মাঝে মাঝে কত ভালো ব্যাবহার করে ওর সাথে, একেবারে অমায়িক ব্যাবহার! আবার মাঝে মাঝে প্রচন্ড কঠোর হয়ে যায়। এরকম টা অ্যানা ঠিক কেন করে ও বুঝে উঠতে পারিনা। মন খারাপ করে শার্লট বলল,
— ঠিক আছে, আর বলবো না!
তারপর কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে আবার জিজ্ঞেস করলো,
— তুই কোনটা পরবি বললি না তো!
— বিয়েতে যাচ্ছি না আমি, আর তাছাড়া রান্না বান্না করতে হবে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় পাবো না। তোরা যা, এনজয় কর।
— আচ্ছা, দিনের অনুষ্ঠানে না যাস, রাতের অনুষ্ঠানে তো যাবি! রাতে প্রচুর ধুমধাড়াক্কা নাচাগানা হবে, তুই সেখানে চল অন্তত, নাকি সেখানেও যাবি না?
— এসব এখন আর ভালো লাগে না আমার, তবুও চেষ্টা করবো যাওয়ার। তুই গিয়ে বিয়ের জন্য রেডি হ। আমি বেরোবো এখন, নইলে দেরি হয়ে যাবে আমার।
অ্যানার কথা শুনে একটা ছোটো খাটো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে চলে এলো শার্লট। ওর পিছু পিছু অ্যানাও বের হলো, তারপর শার্লট গেলো ওর মাঞ্জারের দিকে আর অ্যানা এগোলো কিচেনের দিকে। অনেক অনেক কাজ আজকে।
৫৩. দুপুরের আগে আগে ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেলো লিলি আর পিটারের। লিলি কে সাদা রঙা বল গাউন টায় অপরূপা দেখাচ্ছে। স্টোন গুলো রোদ পড়ে ঝিলিক দিয়ে উঠে গাউন টার সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে কয়েক গুণ৷ লিলির মুখ খানা মিষ্টি হাসিতে টইটুম্বুর হয়ে আছে। ভালোবাসার মানুষ কে নিজের করে পাওয়ার আনন্দ চোখে মুখে ফুটে উঠেছে ওর। স্যুটেড ব্যুটেড পিটার কেও আজ প্রচ্চুর হ্যান্ডসাম লাগছে। সর্বক্ষণ চুপচাপ থেকে কাজ করে যাওয়া পিটার যে কবে কিভাবে লিলির প্রেমে পড়ে গেছে এটা একটা রহস্য! মানুষ প্রেমে পড়লে তো তার হাব ভাব দেখে একটু হলেও বোঝা যায়, কিন্তু ছুপা রুস্তম পিটার কোনোদিন কাউকে এসব বুঝতেই দেয়নি। লিলিও না। হুট করে এসেই বলে বিয়ে করতে চায়! অথচ বোঝা যেত বেচারা ভাজা মাছ টা উলটে খেতে জানে না!
শার্লট ওর মেরুণ রঙা গাউন টা পরে আছে। খুশি ওর চোখে মুখে আর ধরছে না। বরাবরই আবেগপ্রবণ শার্লট লিলির খুশিতে নিজেও বাচ্চাদের মতো লাফাচ্ছে। ব্রায়ান তাকিয়ে দেখছে শার্লট কে। বোনের বেড়ে ওঠাটা আজ চোখে পড়ছে ওর। শার্লট কে এতদিন সেই ছোট্ট বোনটি ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি ওর, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে বোনটা ওর বড় হয়ে গেছে অনেক। অপরূপা শার্লটের দিকে থেকে আজ চোখ সরানোই দায়।
অ্যানা এখনো কাজ করছে কিচেনে। ওর সাথে কাজ করতে থাকা অন্যদেরকে বিয়ের অনুষ্ঠানে ঠেলে ঠুলে পাঠিয়ে দিয়ে ও নিজেই সব কাজ একা হাতে করছে। রান্না বান্না সব শেষ, ইতোমধ্যে ওদিকে ভুরিভোজ ও শুরু হয়ে গেছে হয়তো। এখন শুধু কিচেন টা পরিষ্কার করা বাকি। এগুলো কোনো ব্যাপারই না। বলতে গেলে এক চুটকি তে হয়ে যাবে। শুধু শুধু ছেলে মেয়ে গুলোকে খাটানোর কোনো মানে হয় না৷
কিচেনের দরজা টা বন্ধ করে দিয়ে কাজ করছিলো অ্যানা। ওর কাজের ভেতরেই কে যেন এসে কড়া নাড়লো দরজায়। কাজ ফেলে, ঘর্মাক্ত চেহারা নিয়ে এসে দরজা খুললো ও। খুলতেই দেখতে পেলো থিয়োডর কে। থিয়োডর হা হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
কিমালেব থেকে ফিরে আসার পর এই প্রথম ওর থিয়োডরের সাথে দেখা হলো। থিয়োডর আজকাল নিজের মাঞ্জারে বেশি থাকে না। সেদিনের সেই দুর্ঘটনার কারণে এখন আউটসাইডার্স দের রেসিডেন্স এরিয়াতেই বেশি থাকা পড়ে ওর। যার জন্য অ্যানার চেহারাটা দেখার সৌভাগ্য ওর এখনো হয়ে উঠেনি। তাই আজ, এই মুহুর্তে অ্যানার শুভ্র, কিঞ্চিৎ রক্তিম অসাধারণ সৌন্দর্যমণ্ডিত চেহারাটা দেখে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো থিয়োডর। একটা মানুষ এতটা সুন্দর কিভাবে হয়!
থিয়োডর অপলক চোখে তাকিয়ে আছে অ্যানার টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়ার দিকে। মোলায়েম ঠোঁট জোড়া যেন একটু খানি টোকা দিলেই গলে পড়ে যাবে মাটিতে! সরু নাকের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম হীরককণার ন্যায় চমক দিচ্ছে। কালো রঙা হরিণী চোখ জোড়াতে এক রাশ জিজ্ঞাসা।
থিয়োডর কে এমন কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের ন্যায় তাকিয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হয়ে গলা খাকারি দিলো অ্যানা। সাথে সাথেই ধ্যান ভাঙলো থিয়োডরের। অ্যানার দিকে এইভাবে তাকিয়ে থাকার কারণে লজ্জা পেলো ও। মাথাটা সামান্য নিচু করে নিয়ে গলা খাকারি দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— তুমি এখনো এখানে কাজ করছো কেন অ্যানা? ওদিকে এত আয়োজন করা হয়েছে, সেখানে অ্যাটেন্ড না করে তুমি এখনো কাজ করে চলেছো! গরমের ভেতরে এভাবে কিচেনের দরজা জানালা বন্ধ করে কেউ কাজ করে? লাল হয়ে গেছো দেখো! বের হয়ে আসো, অন্য কেউ করে দেবে ও কাজ। তোমাকে করতে হবে না৷
শেষোক্ত বাক্য গুলো কিছুটা হুকুমের ন্যায় শোনালো অ্যানার কাছে। বিরক্ত হলো ও প্রচন্ড। থিয়োডর কি ওর ওপর অধিকার ফলাতে চাইছে?
থিয়োডরের কথার জবাবে নিজের কন্ঠস্বরটা যথাসম্ভব নরম রাখার চেষ্টা করে অ্যানা বলল,
— কাউকে না কাউকে তো কাজ গুলো করতেই হতো, তো আমি করলে অসুবিধা কোথায়? আর তাছাড়া বিয়ের ফাংশনও শেষের দিকে। এখন অ্যাটেন্ড করেই বা কি, আর না করেই বা কি! আপনি গিয়ে ওদিক টা দেখুন থিয়োডর। আমি এদিক টা আমার মতো করে সামলে নিচ্ছি।
বলে এক প্রকার থিয়োডরের মুখের ওপরেই ধাম করে দরজা টা বন্ধ করে দিলো অ্যানা। অ্যানার এমন আচরণে থিয়োডর অবাক হওয়ার থেকে বেশি কষ্ট পেলো। মন খারাপ করে ফিরে এলো ও মিটিং জোনের দিকে।
৫৪. বিয়ের কালচারাল প্রোগ্রামটা শুরু হয়েছে ঘন্টা তিনেক আগে। মাঝখানে রাতের খাবারের জন্য কিছুটা বিরতি ছিলো। এরপর আবার সবাই নতুন উদ্যমে দ্বিতীয় দফা নাচাগানা শুরু করে দিয়েছে।
অ্যানা বসে আছে ওর কামরায়। ও শুধু রাতের খাবারটা খাওয়ার জন্যই যা একটু বাইরে বেরিয়েছিলো। এছাড়া আর বের হয়নি। রাতের ইভেন্টেও ও যায়নি। শার্লট এসে অনেকবার পিড়াপিড়ি করেছে, তবুও ওকে নড়াতে পারেনি। শেষ মেশ হাল ছেড়ে দিয়ে শার্লট একা একাই চলে গেছে সেখানে।
সন্ধ্যার পর ইভেন্ট টা কালচারাল থাকলেও এখন আর কালচারাল নেই। বাইরে, মিটিং জোনে ব্রায়ানের জোড়াতালি দেওয়া অসহায় সাউন্ডবক্সটায় বিকট শব্দে রক মিউজিক বাজছে। সেই মিউজিকের তালে তালে অন্ধকারের ভেতর আবছা পার্টি লাইটে পার্টি ড্যান্স দিচ্ছে সকলে। মিউজিকের সাউন্ড ছাড়া আর অন্য কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
অ্যানা ওর কামরায় বসে বসে উচ্চস্বরে বেজে চলা মিউজিক থেকে নিজের মন অন্যদিকে নিতে একটা বই পড়ার চেষ্টা করছিলো। কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পরই হঠাৎ দূরের কোনো এক জায়গা থেকে ওর কানে এসে বাড়ি খেলো শার্লটের কন্ঠস্বর!
সচকিত হয়ে উঠলো অ্যানা। মিউজিকের সাউন্ড টাকে পাশ কাটিয়ে ও শোনার চেষ্টা করলো আসলেই শব্দটা সত্যি ছিলো, নাকি ওর মনের ভুল! কিছুক্ষণ কান পেতে থাকার পরই ওর কানে আবারও এসে ঠেকলো শার্লটের চাপা আর্তনাদ। মুহুর্তেই শব্দের উৎসের দিক টা পরিষ্কার হয়ে এলো অ্যানার কাছে। মাঞ্জারের একেবারে শেষের দিকে, ব্লু জোন যেখানে শুরু হয়েছে শব্দ টা সেদিক থেকেই আসছে।
এমন সময় নিজের কামরার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেলো অ্যানা। সেই সাথে ভেসে এলো ফ্যালকনের আতঙ্কিত কন্ঠস্বর,
— শেহজাদী!
অ্যানা দ্রুতগতিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে দরজা খুলে দিলো। অ্যানাকে দেখা মাত্রই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্যালকন আতঙ্কিত গলায় বলল,
— শেহজাদী! আপনার সাথে যে মেয়েটা সর্বক্ষণ থাকে, শার্লট না কে, ওই মেয়ে টা আর ওর ভাই ব্রায়ান কে কারা জানি মাঞ্জারের পেছন দিকটাতে টানা হ্যাচড়া করতে করতে নিয়ে গেছে! আমি ওদের কে সাহায্য করতে গিয়েও করিনি। আমাকে ওরা কখনো এর আগে এদিক টাতে দেখেনি। এখন দেখলে সন্দেহ করতে পারে ভেবে আমি আর সেখানে যাইনি। সোজা আপনার কাছে চলে এসেছি!
কথা গুলো এক দমে বলে দম ফেললো ফ্যালকন। চোখ মুখ ওর উদ্ভ্রান্ত। বোঝাই যাচ্ছে খুব দ্রুত গতিতে এসেছে। জোরে জোরে দম ফেলছে ও।
ফ্যালকনের থেকে এমন কথা শোনা মাত্রই অ্যানার চোয়াল জোড়া শক্ত হয়ে এলো। এই কাজ কারা করতে পারে সেটা বুঝতে বেগ পেতে হলো না ওর। আর তার পরমুহূর্তেই দ্রুত পায়ে হেটে কামরার ভেতর ঢুকে গিয়ে নিজের বিছানার তলা থেকে বের করে নিয়ে এলো একটা ধারালো, চকচকা রাম দা। আর এরপর চোখে মুখে ভয়াবহ হিংস্রতা নিয়ে নিজের মাঞ্জার থেকে বের হয়ে ক্ষীপ্র গতিতে এগিয়ে চলল ব্লু জোনের সীমানার দিকে।
চলবে…….