বাদশাহ_নামা #পর্বসংখ্যা_৪১ #আ_মি_না

0
88

#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_৪১
#আ_মি_না

মাঝারি আকৃতির জাহাজ টা এখন শিরো মিদোরি থেকে বেশ অনেক খানি দূরে চলে এসেছে। এখান থেকে শিরোমিদোরি কে দেখে মনে হচ্ছে ছোট্ট একটা মুকুট, যেটার নিচের অংশ সমুদ্রের তীরের বালু রাশির ওপর সূর্য কিরণ পড়ে সাদা রঙ ধারণ করেছে, আর ওপরের অংশ জঙ্গলের ঘন গাছপালার কারণে গাঢ় সবুজ রঙে রাঙিয়ে আছে। বেঞ্জামিন ছেলেটা জাহাজের পেছনের অংশে দাঁড়িয়ে ফেলে আসা শিরো মিদোরির সৌন্দর্য উপভোগ করছে। অন্যরা জাহাজের সামনের দিক টাতে উচ্চস্বরে আড্ডা দিতে ব্যাস্ত।

পাটাতনের ডান দিক টাতে জাহাজের রেলিঙের কাছে থাকা একটি কাঠের চেয়ারের ওপর পিছনে হাত বেধে বসিয়ে রাখা হয়েছে অ্যানা কে। অ্যানা নির্বিকার চিত্তে সাগরের বুক চিরে আসা জাহাজের পেছন দিকের ফেনা তোলা জলরাশির দিকে তাকিয়ে আছে। ফেনার সাথে সেখানে খেলা করে বেড়াচ্ছে কিছু ডলফিন, সাদা রঙা ফেনা কে ধরার চেষ্টা করছে ওরা কিন্তু পেরে দিচ্ছে না। অ্যানা সেদিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে ডলফিন গুলোর কান্ডকারখানা দেখে হাসছে আর হাই তুলছে ঘন ঘন। কালাভুনা টার কারণে ওর আজকাল রাতে ঘুম হচ্ছে না, তার ইমপ্যাক্ট পড়ছে এখন, চোখ ছোট ছোট হয়ে আসছে, আর হাই উঠছে বার বার।

ওর থেকে কিছুটা দূরেই পাটাতনের মেঝেতে সারি সারি বসে আছে বেশ কয়েকটি যুবক ছেলে, চোখগুলো ওদের অ্যানার দিকে। হা হয়ে অ্যানাকে দেখে চলেছে ওরা। আসার সময় হুডির হুড টা অ্যানার মাথা থেকে সরিয়ে দিয়েছে বেঞ্জামিন, আলগা হয়ে আছে ওর নিতম্ব ছাড়ানো ঘন কালো চুল। চুলের বাহারে স্নো হোয়াইটের ন্যায় উজ্জ্বল অ্যানাকে অপ্সরার ন্যায় দেখাচ্ছে। টেরাকোটা রঙা তুলতুলে ঠোঁট জোড়া বার বার হাই তোলার কারণে মুভ করছে, ছেলেগুলো সে দৃশ্যটা বারবার চকচকে চোখে গিলে চলেছে।

এমন সময় মধ্যবয়সী হেনরি এলো সেখানে। অ্যানা নামক মেয়েটা যে এত সুন্দরী হবে তা ও কল্পনাতেও আনেনি। বেঞ্জামিন অবশ্য ওকে বলেছিলো যে এমন সুন্দরী মেয়ে হেনরি কখনোই দেখেনি, কিন্তু হেনরি বেঞ্জামিনের এহেন কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলো। তার কাছে শতশত সুন্দরী মেয়ে আছে যাদের বাহুডোরে ওর রাত গুলো কাটে, হেনরি অ্যানাকে ওই মেয়েগুলোরই প্রথম সারির সুন্দরী গুলোর মতো ভেবেছিলো। কিন্তু অ্যানা নামক মেয়েটা যে বুক ফাটানো সুন্দরী হবে তা হেনরির জানা ছিলো না।
হেনরি ভেবেছিল মেয়েটা ওর সাথে কাজ করতে রাজি না হলে সমুদ্রে কেটে ভাসিয়ে দেবে, কিন্তু এমন আদুরে মেয়েকে ও কিভাবে আঘাত করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। মেয়েটাকে দেখলেই তো গাল দুটো টিপে দিয়ে আফর করতে ইচ্ছা করছে! মেয়েটির সামনে দাড়ালেই কেমন যেন বুক হালকা হয়ে আসছে ওর, খুব আদর আদর পাচ্ছে। এমন বেড়ালের বাচ্চার মত বাচ্চা একটা মেয়েকে নিয়ে ও কি করবে সেটা ভেবে পাচ্ছে না। মেয়েটার মুখের দিকে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করছে ওর, ওই স্নিগ্ধ মুখশ্রীর দিকে তাকালেই চোখ জোড়াতে শীতল শান্তির স্রোত বয়ে যাচ্ছে যেন!

হেনরি ধীর পায়ে ওর গাবদাগোবদা শরীর টা নিয়ে এগিয়ে এলো অ্যানার দিকে, তারপর অ্যানার সামনে, পাটাতনের মেঝেতে হাটু ভাজ করে বসে নরম গলায় বলল,

— তোমার নাম অ্যানা তাই না?

অ্যানা তখনও জাহাজের পেছন দিকের ফেনা তোলা জলরাশির দিকে তাকিয়ে ছিলো। হেনরির কথায় মুখ ফিরিয়ে তাকালো ও। অ্যানার টানা টানা কালো রঙা চোখ জোড়ার সে চাহনিতে হেনরির হার্টবিট মিস হলো যেন। অ্যানা হেনরির করা প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না, মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চোখ ঘুরিয়ে আবার আগের জায়গায় স্থাপন করলো। হেনরি সেটা দেখে আহত হলো যেন, নতুন উদ্যাম নিয়ে ও আবার আগের মতো করে বলে উঠলো,

— শুনেছি তুমি নাকি ফাইটিং এ অনেক স্কিলড। আমি আমার গ্রুপে সবসময় এমন স্কিল্ড একজন কে চেয়েছি যে কিনা যেকোনো পরিস্থিতিতে সব সমস্যার সমাধান এক তুড়িতে করে দিতে পারবে। এখন আমি তোমাকে একটা অফার দিতে চাই, তুমি অফার টিতে রাজি হলে আমি খুশি হবো, আমি বলছিনা যে তোমাকে রাজি হতেই হবে, কিন্তু হলে খুশি হবো।

একটু বিরতি দিয়ে হেনরি আবার বলা শুরু করলো,

— আমি তোমাকে আমার পার্সোনাল সেক্রেটারি পদে নিযুক্ত করতে চাই অ্যানা। তুমি যদি চাও তবে আমি আমার এই বিশাল গ্রুপের ভারও তোমার ওপর দিয়ে দেবো, তুমি যেভাবে চাও সেভাবে আমার গ্যাং চলবে, তুমি যা বলবে আমার ছেলেরা তাই শুনবে। কেউ তোমার কথার বিন্দুমাত্র বিরোধিতা করবে না, রানীর হালে থাকবে তুমি৷ তোমার সমস্ত প্রয়োজন আমি মেটাবো, তোমার নিজের থেকে একটা নেইটও খরচ করা লাগবে না, তোমার জন্য পুরোটাই আমি প্রোভাইড করবো আমার পকেট থেকে।
আমার কোনো স্ত্রী সন্তান নেই, আমাকে কারো পেছনে নেইট ওড়ানো লাগে না। তাই খরচ করার মতো কাউকে পেলে আমি খুবই খু্‌শি হবো। ভেবোনা যে আমি তোমাকে ভোগ করার জন্য এসব কথা বলছি, তোমাকে আমি আমার মেয়ের মতো করেই দেখবো। এখন শুধু তুমি একবার রাজি হয়ে যাও।

হেনরির শেষোক্ত কথা গুলো শুনে অ্যানা মুখ ফিরিয়ে হেনরির দিকে তাকালো আবার, তারপর কিছুক্ষণ হেনরির গোলগাল খোচাখোচা দাড়ী যুক্ত চেহারাটা পরখ করে নিয়ে প্রশ্ন করলো,

— তোমার মান্থলি ইনকাম কত, হেনরি?

— থ্রি হান্ড্রেড ব্লু কয়েন্স, মিনিমাম।

গর্ব ভরে উত্তর দিলো হেনরি। শিরো মিদোরিতে এক কিলোগ্রাম পিউর গোল্ডের প্রাইস সমান একশত ব্লু কয়েন। সেই হিসেবে হেনরি হেব্বি পয়সা ওয়ালা। অ্যানাকে নিজের ইনকামের কথা টা জানাতে পেরে গর্বে যেন বুকটা ফুলে উঠলো হেনরির। তার ব্লাক মানি প্রচুর, তার ব্লাক মানি যদি হোয়াইট মানি হতো তবে সে হয়তো কুরো আহমারের দ্যা মোস্ট রিচেস্ট পারসন হতো।

হেনরির উত্তরে অ্যানা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। অ্যানার নিরবতায় হেনরি মনে মনে ভেবে নিলো অ্যানা ইজ ইমপ্রেসড। যার মান্থলি ইনকাম মিনিমাম থ্রি হান্ড্রেড ব্লু কয়েন তার কাছে যে কোনো মেয়ে অনায়াসে চলে আসবে, আসতে বাধ্য।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে হেনরির দিকে নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অ্যানা এবার প্রশ্ন করলো,

— আমার গায়ে যে হুডি আর ট্রাউজারের সেট টা দেখছো, এটার প্রাইস কতো জানো হেনরি?

— কত?

আগ্রহভরে অ্যানার দিকে তাকিয়ে শুধালো হেনরি। অ্যানা আগের মতো করেই বলে উঠলো,

— ওয়ান হান্ড্রেড অ্যান্ড স্যাভেন্টি ফাইভ ব্লু কয়েন্স।

অ্যানার কথা শুনে মুহুর্তেই তব্দা খেয়ে গেলো হেনরি। মুখ নেমে গেলো ওদের পাশে বসে অ্যানাকে এতক্ষন হা করে দেখতে থাকা ছেলে গুলোরও। বলে কি এ মেয়ে! এই হুডি ট্রাউজারের প্রাইস নাকি ওয়ান হান্ড্রেড অ্যান্ড স্যাভেন্টি ফাইভ ব্লু কয়েন্স! কিভাবে সম্ভব! হাউ ইজ দিজ পসিবল!

হেনরি কে তব্দা খেয়ে যেতে দেখে অ্যানা আবারও বলল,

— আমার একটা পোশাকের দামই তোমার মান্থলি ইনকামের অর্ধেকের চাইতে বেশি। আর এছাড়া আমি যে বিউটি প্রোডাক্টস অ্যান্ড স্কিন কেয়ার প্রোডাক্টস ইউজ করি সেগুলো প্রোভাইড করতে হলে তোমাকে তোমার পুরো মাসের ইনকাম টাই আমার পেছনে ঢালতে হবে। পারবে?

হেনরি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অ্যানার দিকে। এটা কোন ফ্যামিলির মেয়ে! এত আভিজাত পরিবার কোথায় আছে আর! কুরো আহমারে যতগুলো অভিজাত পরিবার আছে তাদের সবাইকে হেনরি ভালো ভাবেই চেনে, এই মেয়েটা তো তাদের কেউ না! আর তাছাড়া তাদের কেউ হলেও এত এক্সপেন্সিভ লাইফস্টাইল তাদের কোনো মেয়ে লিড করার মতো ক্ষমতা রাখে না। তবে এই মেয়ে টা কোন পরিবারের?

হেনরির ভাবনার মাঝেই অ্যানার কপালে এসে বসলো একটা মশা, অ্যানা সেটাকে সরাতে নিজের অজান্তেই তার পেছনে বাধা হাত জোড়া সামনে নিয়ে এলো, সাথে সাথেই কচাত করে দড়ি ছিড়ে যাওয়ার শব্দ হলো, কিন্তু অ্যানার তাতে সামান্যতম বিকারও দেখা গেলো না। ও নির্বিকার চিত্তে মশা টা কপাল থেকে হাত দিয়ে বাতাসে ঢেউ খেলানোর ভঙ্গিতে তাড়িয়ে দিলো, কিন্তু তখনি ওর মনে পড়লো ওর তো হাত বাধা ছিলো! হেনরির দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হেসে ও বলে উঠলো,

— ওহ, আমার তো হাত বাধা ছিলো, ভুলে গেছিলাম!

কিন্তু হেনরির অ্যানার কথার দিকে কোনো খেয়াল নেই, ওর মাথায় ঘুরছে অ্যানার বিন্দুমাত্র চেষ্টা ছাড়াই দড়ি ছিড়ে হাত সামনে নিয়ে আসার দৃশ্য টা। বেঞ্জামিনের কথা মতো সতর্কতা অবলম্বনের জন্য অ্যানার হাত জোড়া ও ডেনিম রোপ দিয়ে বেধেছিলো, আর এমন গিট দিয়েছিলো যেন কোনোভাবেই সেটা খোলা না যায়। আর এই মেয়েটা কিনা এত শক্তিশালী দড়িটা কোনো বিকার ছাড়া এক টানেই ছিড়ে ফেললো! এটা কিভাবে সম্ভব! এই মেয়েটা আসলে কে! এতটা শক্তিশালী মেয়ে মানুষ কিভাবে হয়!
হেনরির এবার যেন ভয় করতে লাগলো কিছুটা। সে কি আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো বড় ধরণের ভুল করে বসলো!

এমন সময় মাঝসমুদ্রের আকাশে শোনা গেলো একটি বাজপাখির তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর। হেনরি চমকে তাকালো তার মাথার ওপরে, দূর আকাশে রাজকীয় ভঙ্গিতে পাখা মেলে দিয়ে শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে একটি বিশালাকার ফ্যালকন পাখি।
কিন্তু ওরা সমুদ্রের যতটা গভীরে তাতে এদিকটায় পাখি আসার সম্ভাবনা খুবই কম। তাহলে এই শিকারী পাখি টা এই ভরদুপুরে এইখানে কি করছে।
হেনরির এসব ভাবনার মাঝেই ওর সামনে বসা অ্যানা আফসোসের সুরে বলে উঠলো,

— আ’ ফ্যিল সর‍্যি ফ’ ইয়্যু হেনরি!

হেনরি চমকালো আবারো, কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,

— কে-কেন?

অ্যানা মৃদু হেসে নিজের ডান ভ্রু টা সামান্য উঁচু করে উত্তর দিলো,

— কজ, কালাভুনা ইজ অন ফায়ার!

হেনরি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো অ্যানার দিকে, তারপর একটা শুকনো ঢোক গিলে ভীতসন্ত্রস্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

— তুমি কোন বংশে বিলং করো অ্যানা?

হেনরির প্রশ্নের উত্তরে অ্যানা মৃদুস্বরে ছোট্ট করে উত্তর দিলো,

— দেমিয়ান।

আর ঠিক সেই মুহুর্তেই জাহাজের পেছন সাইডে প্রচন্ড শব্দ তুলে বিদ্যুৎ গতিতে আছড়ে পড়লো কিছু একটা, সাথে সাথেই জাহাজের পেছন দিকটার কাঠের অংশটা শব্দ করে ভেঙে গুড়িয়ে গিয়ে কয়েক হাত পানির নিচে চলে গেলো, আর সামনের দিক টা ভার সামলাতে না পেরে সমুদ্র পৃষ্ট থেকে উঠে গেলো দু হাত ওপরে, তারপর আবার গিয়ে আছড়ে পড়লো পানিতে। সমুদ্রের বুক ছলকে এক ঝটকা পানি এসে পড়লো জাহাজের পাটাতনের ওপর।

সচকিত হয়ে উঠলো সকলে। জাহাজে হামলা হয়েছে ভেবে সকলেই অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে তৈরি হওয়ার জন্য এলোপাথাড়ি ছোটাছুটি শুরু করলো। কিন্তু হেনরি ঠাই বসে রইলো অ্যানার দিকে তাকিয়ে। অ্যানার মুখ থেকে দেমিয়ান শব্দ টা শোনা মাত্রই ওর গলা বুক সব শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, চাতক পাখির ন্যায় খুজেও গলা ভেজানোর জন্য একফোটা লালাও হেনরি খুজে পেলোনা তার মুখের ভেতরে। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা শুরু হয়েছে ওর, হৃদপিণ্ড টা যে গতিতে লাফাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে বুকের খাচা ভেদ করে সেটা লাফিয়ে বের হয়ে আসবে যে কোনো মুহুর্তে! উঠে দাড়ানোর মতো শক্তিও যেন আর খুজে পাচ্ছে না হেনরি। ওর সমস্ত শক্তি, বুদ্ধি যেন মুহুর্তেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

ঠিক তখনি এতক্ষণ জাহাজের পেছন সাইডে থাকা বেঞ্জামিন হন্তদন্ত হয়ে, সমস্ত মুখে হতভম্বতা আর ভীতি নিয়ে ছুটে আসলো সেখানে। হেনরির কাছে এসে দাঁড়িয়ে ও হতভম্ব চোখে তাকিয়ে হাফালো কিছুক্ষণ, তারপর নিজের হতভম্বতা সামান্য কাটিয়ে উঠে হাঁফাতে হাঁফাতে বিস্ফোরিত নয়নে দম হারানো গলায় আতঙ্কিত হয়ে বলে উঠলো,

— বস, বাদশাহ! বাদশাহ!

হেনরি যেন শরীরে আর এক ফোটাও জোর পেলো না। তার দৃষ্টি এখনো অ্যানার দিকে। হতভম্বতা আর অসহায়ত্ব এসে গ্রাস করে ফেলেছে ওকে। হেনরির আর বুঝতে বাকি রইলো না তার সামনে বসা মেয়েটি ঠিক কে। এই মেয়েটি পঞ্চদ্বীপের একমাত্র শেহজাদী, এবং বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানের বিবাহিতা স্ত্রী, আনাবিয়া ফারহা দেমিয়ান।

হেনরি এবার ভেঙে পড়লো একেবারে। ভারী শরীর টা লুটিয়ে দিলো অ্যানার পায়ের কাছে, তারপর কাঁদোকাঁদো কন্ঠে, আর্তনাদের সুরে বলে উঠলো,

— ক্ষমা করুন শেহজাদী! আমার ভুল হয়েছে শেহজাদী, এই অধম কে আপনি ক্ষমা করুন, দয়া করুন। এমন টা আর কখনো হবে না শেহজাদী! আমি সব কিছু ছেড়ে দেবো শেহজাদী, আমার সমস্ত নেইট আমি গরীব দুঃখী দের কে দান করে দিবো শেহজাদী! আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন! হিজ ম্যাজেস্টির ক্রোধ থেকে আমাকে বাচান শেহজাদী, পায়ে পড়ি আপনার।

ততক্ষণে সমস্ত জাহাজ টা জুড়ে চাউর হয়ে গেছে স্বয়ং বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান তাদের জাহাজে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পাটাতনের ওপরে এসে জড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জাহাজের সমস্ত কর্মি! আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাসে তারা যেন জমে গেছে। পালানোর কথা এক প্রকার ভুলেই গেছে ওরা! নিঃশব্দে ঠাই হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা সকলে।
সমস্ত জাহাজ জুড়ে পিনপতন নিরবতা, কেউ কোনো টু শব্দটি করছে না। শুধুমাত্র হেনরির কাকুতি মিনতি ছাড়া আর কোনো শব্দই কোনো দিক থেকে কানে আসছেনা কারো।

কিন্তু তখনি সমস্ত নিরবতাকে ভেদ করে, হেনরির আর্তনাদের শব্দটাকে ছাপিয়ে শোনা গেলো জাহাজের কাঠের পাটাতনের ওপরে কারো শক্ত বুটের ভারী পদশব্দ, যার প্রতিটা ধীর গতির পদক্ষেপে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো সম্পুর্ন জাহাজ টা।
আর এই পদধ্বনি শোনা মাত্রই আতঙ্কিত হয়ে গেলো হেনরি। থেমে গেলো ওর আর্তনাদ। অ্যানার পায়ের কাছ থেকে মাথা টা উঠিয়ে নিয়ে ও বসলো পদধ্বনি ধ্বনিত হওয়ার দিকে ফিরে। আর তার কিছু মুহুর্ত পরেই নিরবতায় ডুবে যাওয়া পরিবেশ টাকে পুরোপুরি স্তব্ধ করে দিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হলো সেই ভারী পদধ্বনির মালিক, নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান।

কুচকুচে কালো রঙা, লম্বা চওড়া, সুঠামদেহী, বলিষ্ঠ শরীরের অধিকারী, ঘাড় বাবরি ঝাকড়া চুলের স্বর্ণচোখি পুরুষটির ইস্পাত-দৃঢ় ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন চেহারাটা দৃষ্টি গোচর হওয়া মাত্রই হেনরি সহ সেখানে উপস্থিত সমস্ত লোকগুলো আনুগত্যের সাথে মাথা নিচু করে কুর্নিশ জানালো তাকে।

কিন্তু পরক্ষণেই তাদের অন্তরাত্মা কে কাঁপিয়ে দিয়ে শক্ত, ধারালো চেহারার ব্যাক্তিটি বজ্রকঠিন কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,

— আমার শাসন তলে থেকে, আমার দ্বীপে এসে আমারই চোখের সামনে দিয়ে আমার স্ত্রীকে অপহরণ করার স্পর্ধা তোদেরকে কে দিয়েছে?

হেনরি পাটাতনের ওপর বসা অবস্থাতেই একপ্রকার হামাগুড়ি দিয়ে কয়েক কদম এগিয়ে গেলো মীরের দিকে তারপর মাথা নত করে মিনতির সুরে বলল,

— ক্ষমা করে দিন, ইয়োর ম্যাজেস্টি! আমরা বুঝতে পারিনি, চিনতে পারিনি ওনাকে! আমরা যদি ওনাকে চিনতাম তবে কখনোই এমন দুঃসাহস দেখাতাম না! ক্ষমা করে দিন ইয়োর ম্যাজেস্টি! আমাদের প্রাণ নেবেন না! ক্ষমা করে দিন! এমন টা আমরা আর কখনোই করবো না। সব পাপ কাজ ছেড়ে দেবো, ক্ষমা করে দিন!

হেনরির কথায় মীর অত্যান্ত অবজ্ঞার সাথে বাঁকা হাসলো, তারপর তাচ্ছিল্যের সুরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো,

— ক্ষমা! এই নামে কোনো শব্দ আমি চিনি না।

আর তার পরমুহূর্তেই মীরের ডান হাতের কব্জির ঠিক ওপরে থাকা যান্ত্রিক মেটালিক আর্মরের অংশটার ভেতর থেকে ধাতব শব্দ করে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে এলো একটা স্বর্ণের নকশা দেওয়া কালো রঙা হাতলের ঝা চকচকা সৌর্ড। এবং পরক্ষণেই কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্থীর হয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা মীর নিজের ডান হাতে থাকা সৌর্ড টির হাতল তড়িৎ গতিতে স্পিন করে ওর ডানদিকে, বেশ খানিকটা দূরত্বে দাঁড়ানো লোকগুলোর দিকে আড়াআড়ি ভাবে ছুড়ে দিলো, আর ছুড়ে দেওয়ার সাথে সাথেই ধারল সৌর্ড টা সেখানে দাঁড়ানো লোকগুলোর ডান দিক থেকে তীব্র গতিতে স্পিন করতে করতে ঢুকে গেলো লোকগুলোর শরীরের ভেতর, আর এরপর খ্যাচ খ্যাচ শব্দ তুলে সেখানে থাকা সমস্ত শরীর গুলোকে বিদ্যুৎ গতিতে ফালা ফালা করে দিতে দিতে সর্বশেষ লোকটিকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে বা দিক থেকে বেরিয়ে স্পিন করতে করতে আবার চলে এলো মীরের কাছে। মীর সেটাকে হাতে নিয়ে নিজের তর্জনী আর মধ্যমা দ্বারা দক্ষ ভঙ্গিতে দুবার দুদিকে স্পিন করতেই সৌর্ডের ধারালো অংশের ওপর থেকে উধাও হয়ে গেলো তাতে লেগে থাকা লাল রঙা তরল।

হেনরি এতক্ষণ বিস্ফোরিত নয়নে মীরের পায়ের কাছে বসে দেখছিলো এ দৃশ্য। ওর যে কোনো ক্ষমা নেই সেটা বুঝতে ওর আর বাকি রইলো না। অথর্বের ন্যায় পাটাতনের মেঝেতে বসে রক্তের সমুদ্র বয়ে যাওয়া লাশের স্তুপের দিকে তাকিয়ে রইলো ও৷ এবার যে ওর পালা সেটা বুঝতে পেরে, নিজের শেষ পরিণতি মেনে নিয়ে মীরের সৌর্ড চালানোর অপেক্ষায় মাথা পেতে বসে রইলো ও।

কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে মীর চলে গেলো ওর পেছন দিকে, অ্যানার নিকট। অ্যানার কাছে গিয়ে নিজের বা হাত খানা অ্যানার পিঠের ওপর দিয়ে নিয়ে ওর অপরপাশের বাহুতল টা আকড়ে ধরে অ্যানাকে চেয়ার থেকে উঁচু করে উঠিয়ে নিজের বুকের ওপর নিলো। অ্যানা মীরের বুকের সাথে লেগে দুহাতে মীরের গলা জড়িয়ে ধরে দু পা দ্বারা মীরের কোমর টা আকড়ে ধরলো, আর তখনি মীর জাহাজের পাটাতন থেকে উঠে গেলো শূণ্যে। তারপর জাহাজ থেকে উপরের দিকে বেশ খানিক টা গিয়ে স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ও। ওদের চারপাশে তীক্ষ্ণ স্বরে ডেকে উড়ে বেড়াতে লাগলো ফ্যালকন।
হেনরি ভেবে পেলোনা এরা ঠিক কি করতে চাইছে ওর সাথে। এরা কি জাহাজ টাকে অকেজো করে দিয়ে এই লাশের স্তুপের সাথে ওকে এইখানে একা ফেলে রেখে চলে যাবে? না অন্য কিছু করবে?

অ্যানাকে বুকে নিয়ে শূণ্যে ভেসে থাকা মীর তার মুখের অতি নিকটে থাকা অ্যানার মুখ খানার দিকে তাকালো একপলক, তারপর কিছু একটা ইশারা করতেই অ্যানা মৃদু গতিতে মাথা নাড়ালো। আর তার পরমুহূর্তেই মীর ওকে নিয়ে ঝড়ের গতিতে ভেসে এলো জাহাজের চারপাশের সমুদ্রপৃষ্ঠের দিকে। আর এরপর সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছ ঘেঁষে জাহাজের চারপাশটা প্রচন্ড দ্রুত গতিতে চক্কর দিতে শুরু করলো, আর সেই সাথে সাথে অ্যানা ওর মুখ থেকে বের করলো তিমি মাছের কণ্ঠনিঃসৃত শব্দের ন্যায় অদ্ভুত এক শব্দ। আর তার কিছুক্ষণ পরেই বিশালাকার কিছু একটা এসে পানির নিচ থেকে ধাক্কা দিলো জাহাজ টাকে।
সাথে সাথেই প্রচন্ড গতিতে দুলে উঠলো জাহাজ টা। সেই সাথে জাহাজের চারপাশ ঘিরে সমুদ্রতল থেকে উঠে এলো ঝাকে ঝাকে নিলতিমি। তাদের কণ্ঠনিঃসৃত হাড়হিম করা অদ্ভুত শব্দে বুক কেঁপে উঠলো হেনরির।

পরক্ষণেই সে বিশালাকৃতির নীলতিমি গুলো অ্যানার ইশারায় জাহাজের চারপাশে একে একে গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করে দিলো, আর তাদের এই ঘূর্ণণের কারণে সেখানে ক্রমে ক্রমে সৃষ্টি হলো বিশাল এক জল ঘূর্ণির, আস্তে আস্তে জাহাজ টা সেই জল ঘূর্ণির সাথে তাল মেলাতে শুরু করলো। হেনরি প্রমাদ গুনলো! সমুদ্রের ভেতরের ওই বিশাল জল ঘূর্ণি দেখে ওর আত্মা উড়ে গেলো যেন! তাকে তবে জীবন্ত অবস্থাতেই সলিল সমাধি দেওয়া হবে!

জল ঘূর্ণির চারপাশে বিশালাকার নীলতিমি গুলো উৎসব করে বেড়াচ্ছে। কয়েকটা হোয়াইট শার্ককেও দেখা যাচ্ছে সেখানে, জাহাজ থেকে চুইয়ে পড়া রক্তের গন্ধে উন্মাদ হয়ে এদিক ওদিক ছটফটিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে ওরা।
জাহাজ টা পানির ঘূর্ণনের সাথে এবার পুরোপুরি তাল মেলালো, হেনরি ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করলো। বার বার করে ক্ষমা চাইতে লাগলো মীর আর অ্যানার কাছে, যেন শেষ মুহুর্তে এসে হলেও তাকে ওরা বাঁচিয়ে নেয়। কিন্তু শেষ রক্ষা ওর হলো না। জাহাজটা ঘূর্ণির সাথে প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে একসময় মিলিয়ে গেলো সমুদ্রের অতল গহ্বরে, সেই সাথে চিরকালের জন্য সমুদ্রের বুকে মিলিয়ে গেলো হেনরির আর্তচিৎকার।

আর জাহাজের চিহ্ন পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হতেই অ্যানাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে কোলে নিয়ে ঝড়ের বেগে সোজা প্রাসাদের দিকে উড়ে চলল মীর৷

চলবে……..

( তাড়াহুড়ো করে লিখেছি, এলোমেলো হয়ে গেছে হয়তো। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন 💙)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here