#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_৪৮
#রানী_আমিনা
৭০. নির্জনতা আর নরম বাতাসে ঘিরে আছে শিরো মিদোরি। সূর্য ধীরে ধীরে সমুদ্রের ওপরে উঠে আসতে শুরু করেছে। আঁধারে নিমজ্জিত আকাশটা ক্রমে ক্রমে হালকা গোলাপি থেকে কমলা রঙ ধারণ করতে শুরু করেছে। সমুদ্রের নীল পানির ঢেউ গুলো মৃদুমন্দ গতিতে এসে আছড়ে পড়ছে তীরে, প্রকৃতি যেন তার নিজ সুরে মগ্ন হয়ে আছে।
রেড জোনের ভেতর থেকে পাখিদের কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে থেকে থেকে৷ সমুদ্রের পাড়ের ভেজা বালির ওপর সূর্যের সোনালি কিরণ পড়ে স্বর্ণের ন্যায় চিকচিক করছে, যেন সূর্যের সাথে কোনো দুষ্টু খেলায় মেতে উঠেছে তারা। মৃদুমন্দ বাতাস সমুদ্রের পাড়ে থাকা গাছ গুলোর পাতায় ঝিরিঝিরি শব্দ তুলে বয়ে চলেছে, যা প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিচ্ছে সমস্ত তনুমন কে৷ ভোরের এই নিস্তব্ধতা যেন মিশে গেছে হৃদয়ের সাথে।
অ্যানা সন্ধ্যারাতে ঠিক যেভাবে ছাদের ওপর শুয়ে ছিলো, এখনো ঠিক সেভাবেই শুয়ে আছে। এক ফোটাও নড়েনি। চোখ জোড়া ওর লাল! বৃষ্টি তে ভিজে ঠান্ডার চোটে প্রায় নীল বর্ণ ধারণ করেছে ওর ঠোঁট জোড়া আর নাকের ডগাটা। ফর্সা গাল দুটোতে গোলাপি রঙা আভা ফুটে উঠেছে৷ গলা টা বসে গেছে, ঢোক গিলতে গেলে কষ্ট হচ্ছে ওর।
রোদ বের হলো বেশ কিছুক্ষণ পর। সুউচ্চ প্রাসাদের ছাদের ওপর ভিজে জবজবে হয়ে শুয়ে থাকা অ্যানার শরীরের ওপর এসে পড়লো ভোরের মিষ্টি রোদ। রোদের উষ্ণ আদুরে ছোয়ায় শিউরে উঠলো ওর সমস্ত শরীরটা। মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে কিছু একটা বলে উঠলো ও৷
ছাদের দরজার কাছে, সিড়িতে বসে ছিলো ইয়াসমিন। তার শেহজাদীকে একা ফেলে যাওয়ার মতো সাহস ওর হয়নি। তাই সমস্ত রাত টা ও সেখানে বসে বসেই কাটিয়ে দিয়েছে।
হঠাৎ অ্যানাকে অস্ফুটস্বরে কিছু বলতে শুনে হকচকিয়ে উঠে সেদিকে পা বাড়ালো ইয়াসমিন। কিন্তু ওকে নিজের দিকে আসতে অনুভব করেই দূর থেকে অ্যানা ওর বা হাত টা উঁচু করে সতর্ক বানী দিলো, ওর কাছে কেউ গেলেই তাকে ও শেষ করে দিবে!
ইয়াসমিন থমকে দাঁড়িয়ে গেলো৷ আর এগোলো না। তার শেহজাদী কাল থেকে কিছুই খায়নি, ভেজা কাপড় টা গায়ে জড়িয়ে আছে, রাতভর ঘুমায়নি, অথচ হিজ ম্যাজেস্টি বলে গেছিলো তার শিনু কে যথাসম্ভব আগলে আগলে রাখতে। এখন ও সারাটাক্ষন জেদ খাটাবে, রাগ দেখাবে; তবুও যেন শিনু কে ওরা এক মুহুর্তের জন্যেও একা না ছাড়ে!
কিন্তু ইয়াসমিন হিজ ম্যাজেস্টি কে দেওয়া কথা রাখতে পারেনি৷ শেহজাদী যদি রেগে যেতেন, ভাঙচুর করতেন, তাহলে তাকে শান্ত করতে পারতো ইয়াসমিন, কিন্তু যার ঝড় তোলার কথা সে তো পাহাড়ের ন্যায় নিশ্চুপ, নিশ্চল হয়ে আছে! তাকে ও কিভাবে মানাবে?
ইয়াসমিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা! কি থেকে কি হয়ে গেলো সবার জীবনে! ভালোই তো ছিলো ওরা, ভালোই তো ছিলো ওর শেহজাদী! কেন এরকম টা হলো? সে কি কোনো ভাবে শেহজাদীর ওই সুখী মুখ টা দেখে নজর দিয়ে ফেলেছে? শেহজাদী আর হিজ ম্যাজেস্টির ওই দুষ্টু মিষ্টি মুহুর্ত গুলোয় তৈরি হওয়া সুখ মিশ্রিত অস্ফুটধ্বনি গুলো শুনে কি ও কোনোভাবে কখনো হিংসা করে ফেলেছে!
কই? এমনটা তো ও কখনোই করেনি! তবে কার নজর লাগলো ওর শেহজাদীর ওপর?
ইয়াসমিনের চোখ ফেটে কান্না এলো এবার। ঠোঁট চেপে চোখ থেকে নিঃশব্দে পানি ছেড়ে দিলো ও! তারপর আবার গিয়ে বসে পড়লো নিজের জায়গায়।
.
সূর্য এখন প্রায় মাথার ওপরে৷ আকাশে মেঘের ঘনঘটা, সূর্যের সাথে লুকোচুরি খেলে বারবার পৃথিবীপৃষ্ঠে পতিত হতে থাকা সূর্যালোককে বাধা দিয়ে চলেছে তারা।
অ্যানার ভেজা শরীর টা শুকিয়ে গেছে পুরোপুরি। ছাদের ওপর শুয়ে শুয়ে চোয়ালদ্বয় শক্ত করে, চোখ জোড়া বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে চলেছে ও একমনে। ঠান্ডা লাগায় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। থেকে থেকে ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ আলগা করে শ্বাস নিচ্ছে ও জোরে জোরে।
উঠতে ইচ্ছা করছে না ওর এখান থেকে৷ বুক ভরা যন্ত্রণা, নরম রোদ আর মৃদু বাতাসে ওর আলসেমি পেয়ে বসেছে। মাঝে মাঝেই নড়া চড়া করে উঠছে ও।
এমন সময় ছাদের প্রবেশমুখে দেখা গেলো কোকো আর ফ্যালকন কে৷ চুপিচুপি পায়ে সেখানে এসে দাঁড়ালো ওরা, যেন অ্যানা টের না পায়।
কিন্তু ওদের শরীরের গন্ধে অ্যানা ঠিকই বুঝলো বাচ্চা গুলো ওর কাছে এসেছে। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না ও! ডান হাত টা মাথার তলায় দিয়ে চোখ বুজে পড়ে রইলো।
ফোস করে দম ফেললো একটা। তলপেটে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে ওর। মাসের বিশেষ সময়টা শুরু হয়েছে কিনা! কিন্তু বুকের যন্ত্রণাটাকে ছাপিয়ে পেটের যন্ত্রণা টা আর ওকে ছুতে পারছে না৷
কোকো আর ফ্যালকন ইয়াসমিনের সাথে মৃদুস্বরে কথা বলল কয়েকটা, তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বসলো অ্যানার পাশে, দুজনেই।
অ্যানা ওদেরকে বাধা দিলো না, কিন্তু চোখ জোড়া খুলে একটা বারের জন্যেও চেয়ে দেখলো না ওদের কে। যেভাবে ছিলো সেভাবেই পড়ে রইলো।
— আম্মা! কামরায় ফিরে চলুন আম্মা! আপনার শরীর খারাপ করবে অনেক, চলুন আম্মা!
কাতর কন্ঠে, অনুরোধের সুরে বলল কোকো। কিন্তু অ্যানা কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না ওর কথায়৷ চোয়াল শক্ত করে ও পড়ে রইলো।
কোকো বুঝলো তার আম্মাকে এই মুহুর্তে নড়াতে পারে এমন কেউ এখনো এই পৃথিবীতে জন্মেনি, হিজ ম্যাজেস্টি ছাড়া৷
কোকো এক পলক তাকালো পাশে বসা ফ্যালকনের দিকে৷ তাকিয়ে চোখে চোখে প্রশ্ন করলো কিছু। ফ্যালকন ওর সে প্রশ্নের উত্তরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই কোকো নড়েচড়ে বসলো ছাদের মেঝেতে। তারপর গলা খাকারি দিয়ে মৃদুস্বরে বলে উঠলো,
— আম্মা, আপনার কিছু বিষয় সম্পর্কে জানা খুব প্রয়োজোন। যা আপনাকে হিজ ম্যাজেস্টি কখনোই জানতে দেননি, এবং তিনি চানওনি যে আপনি কখনো সেগুলা জানুন! কারণ আপনি জানলে কষ্ট পাবেন অনেক!
কোকো বিরতি নিলো, ফ্যালকনের দিকে অসহায় চোখে তাকালো আর একবার। শেহজাদী কোনো প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন না। নির্লিপ্ত হয়ে আছেন! ফ্যালকন কোকোর ইশারা বুঝে মুখ খুললো এবার,
— আপনার মনে আছে শেহজাদী, আজ থেকে প্রায় ছ বছর আগে আপনি একটা গুরুতর অ্যাক্সিডেন্ট এর জন্য প্রায় দু বছরের স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিলেন! হঠাৎ করেই একদিন উঠে আপনি আপনার বিগত দুবছরের কোনো স্মৃতিই মনে করতে পারছিলেন না! হিজ ম্যাজেস্টি আপনাকে বলেছিলেন যে অ্যাক্সিডেন্টের কারণে আপনি আপনার স্মৃতির কিছু অংশ হারিয়ে ফেলেছেন!
কিন্তু ব্যাপার টা সত্যি নয়। আপনি ওই দুবছরের স্মৃতি হারাননি, আপনার কোনো অ্যাক্সিডেন্ট ও হয়নি। আপনি ওই দুইটা বছর সম্পুর্ন কোমাতে ছিলেন!
ফ্যালকনের কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই চোখ মেলে তাকালো অ্যানা।
ও কোমাতে ছিলো মানে কি! মীর তো ওকে বলেছিলো ওর ভয়াবহ অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিলো! তবে কি মীর ওকে মিথ্যা বলেছিলো!
কিন্তু কেন? কি কারণে এমন একটা মিথ্যা বলল ওকে মীর!
অ্যানাকে চোখ মেলতে দেখে কোকো ফ্যালকন এবার একটু সাহস পেলো যেন! কোকো একটা ঢোক গিলে আবার বলতে শুরু করলো,
— আপনার ওই কোমায় যাওয়ার পেছনে একটা গুরুতর কারণ ছিলো শেহজাদী!
আপনার মনে আছে কিনা জানিনা, আজ থেকে প্রায় আট নয় বছর পূর্বে আপনি হঠাৎ করেই একদিন প্রচন্ড বমি করেছিলেন! আমরা সবাই ভেবেছিলাম আপনার ফুড পয়জনিং হয়েছে! বমি করতে করতে আপনি কাহীল হয়ে গেছিলেন! হিজ ম্যাজেস্টি আপনাকে কোলে তুলে নিয়ে রেড জোন থেকে ছুটে গেছিলো প্রাসাদে, মেডিক্যাল জোনে!
আপনি নেতিয়ে পড়েছিলেন, গায়ে শক্তি পাচ্ছিলেন না! কিন্তু সেদিন আপনার ফুড পয়জনিগ হয়নি! সেদিন আপনার কি হয়েছিলো জানেন! আপনি মা হতে চলেছিলেন! আমরা একটা ভাই পেতে চলেছিলাম!
কোকোর কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই অ্যানা চমকে তাকালো ওর দিকে। ও মা হতে চলেছিলো? কিভাবে? ও তো কিছুই টের পায়নি! কি হয়েছিলো তবে ওর সাথে?
কোকো কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে শুরু করলো,
— সেদিন প্রাসাদের যে হেকিম আপনার ট্রিটমেন্ট করেছিলো সে আপনাকে এই খবর টা দেয়নি! সে আপনার থেকে খবর টা পুরোপুরি চেপে গিয়ে হিজ ম্যাজেস্টি কে আগে বলেছিলো! কারণ সে জানতো দেমিয়ান বংশের ভেতরে সন্তান ধারণ করা এক প্রকার অসম্ভব, কিন্তু কেন সেটা জানতো না! সে হিজ ম্যাজেস্টির নিকট এসেছিলো আপনার গর্ভে আসা ভ্রুণটিকে ঠিক কি করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করতে!
কিন্তু হিজ ম্যাজেস্টি সে ভ্রুণটাকে হত্যা করতে চাননি! উনি হেকিম কে বলেছিলেন ব্যাপারটা আপনার থেকে সম্পুর্ন চেপে যেতে, আর যেহেতু আপনার প্রেগন্যান্সি সিম্পটমস একদমই স্বাভাবিক প্রেগন্যান্সির মতোই ছিলো তাই উনি ভেবেছিলেন হয়তো সৃষ্টিকর্তা আপনাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন! উনি নিজেও সেদিন খবরটি আপনাকে জানাননি, কারণ আপনার যে গর্ভসঞ্চার হয়েছে সে খবরটা যেন আপনিই তাকে প্রথম দেন! তিনি যেন আপনার মুখ থেকে বাবা হওয়ার সুসংবাদ শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান! আপনি যেন মাতৃত্বের স্বাদের প্রতিটা ফোটা তৃপ্তির সাথে অনুভব করেন!
কিন্তু উনি কাউকে না জানালেও আমাদেরকে এই খবরটা জানিয়েছিলেন, আর জানিয়েছিলেন কিমালেবের কন্ট্রোলার জায়ান সাদি কে!
আমরা সেদিন দেখেছিলাম উনি কতোটা খুশি! বাবা হওয়ার খবরে শিশুদের ন্যায় হেসেছিলেন তিনি সেদিন! ওই শক্ত কঠোর মানুষ টা যে বাবা হওয়ার সংবাদে এতটা খুশি হবে সেটা আমরা কেউই ভাবিনি!
কিন্তু তার সে সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ের ন্যায় আনন্দের উচ্ছাস স্থায়ী হলো না বেশিদিন! আপনি যে অন্তঃসত্তা সেটা আমরা জানার প্রায় সপ্তাহ খানেকের মাথায় হঠাৎ করেই ঘটলো এক দুর্ঘটনা! আপনি যে মা হতে চলেছেন সেটা টের পাওয়ার আগেই আপনি জ্ঞান হারালেন, হঠাৎ করেই!
এটাকে নিছকই প্রেগন্যান্সির সময়ে ঘটা অসুস্থতা হিসেবে ধরে নিলেন হিজ ম্যাজেস্টি৷ আপনাকে দ্রুত মেডিক্যাল জোনে পাঠিয়ে দিয়ে উনি অপেক্ষা করছিলেন বাইরে, যদি জ্ঞান ফেরার পর আপনি কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে তাকে তার বাবা হওয়ার খুশির খবর টা দেন!
কিন্তু সেদিন হিজ ম্যাজেস্টির সমস্ত বুকটাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে আপনি আর বের হলেন না! আপনার পরিবর্তে বেরিয়ে এলো হেকিম। সে এসে জানালো এক ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ!
তিন সপ্তাহ বয়সী ভ্রুণটা দুই মাসের ভ্রুণের ন্যায় বেড়ে উঠেছিলো! কিন্তু সে কোনো স্বাভাবিক মানুষ ছিলো না! সে ছিলো অন্য কিছু, যা আপনার শরীরের সমস্ত রক্ত শুষে নিচ্ছিলো ভেতর থেকে! রক্তপিপাসু কোনো প্রাণীর ন্যায় সে আপনার খাওয়া খাবারের বদলে খেয়ে নিচ্ছিলো আপনার রক্ত! প্রচন্ডরকম রক্তশূন্যতায় ভুগছিলেন আপনি! কিন্তু সেটা আমরা কেউই বুঝতে পারিনি! হিজ ম্যাজেস্টি ও না! এমনকি আপনিও না!
কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে! সেই ভ্রুণটির প্রভাবে ভেতর থেকে ভেঙে পড়েছিলো আপনার শরীর! আর তারপর আর পেরে না দিয়ে ঢলে পড়েছিলো কোমাতে!
এমন আকস্মিক বিপর্যয়ে হিজ ম্যাজেস্টি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন! একদিকে আপনি অন্যদিকে আপনার গর্ভে তার সন্তান, যে কিনা রক্তপিপাসু! প্রচন্ডরকম হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়লেন তিনি। আর সেদিনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আপনার অ্যাবর্শনের!
সেদিনই অপরশেন হলো আপনার! ভ্রুণটাকে ছিড়ে নিয়ে আসা হলো আপনার গর্ভ থেকে! হিজ ম্যাজেস্টি সেই অপরিপক্ক ভ্রুণটাকে সেদিন দেখলেন অনেক অনেক ক্ষণ ধরে। আর তারপর তাকে কবরে শায়িত করে দিয়ে আসলেন! কিন্তু এই ঘটনায় প্রচন্ড কষ্ট পেলেন তিনি! বাবা হতে গিয়েও না হতে পারার যন্ত্রণায় নিশ্চুপ হয়ে গেলেন!
কিন্তু এতসব যেন তার জন্য যথেষ্ট ছিলো না! সৃষ্টিকর্তার আরও পরিকল্পনা ছিলো তাকে নিয়ে!
আপনি তখনো হসপিটালাইজড! আপনার জ্ঞান তখনো ফেরেনি! আমরা ভেবেছিলাম আপনি হয়তো কিছু দিনের মধ্যেই সুস্থ সবল হয়ে উঠবেন। আর তখনি সিদ্ধান্ত হয়েছিলো সন্তানের বিষয়টা আপনার থেকে পুরোপুরি গোপন রাখা হবে! কিন্তু কয়েকটা দিন, এরপর কয়েকটা সপ্তাহ কেটে গেলো, তবুও আপনি আর জাগলেন না!
আর এরপর একদিন হেকিম এসে খবর দিলো আপনি ডিপ কোমাতে চলে গেছেন! ওমন শারীরিক অসুস্থতার ওপর ওই সার্জারি আপনার দুর্বল শরীর নিতে পারেনি! আপনার মস্তিষ্ক ঘুমিয়ে পড়েছে পুরোপুরি!
আপনার জ্ঞান কবে ফিরবে সে ব্যাপারে হেকিম কিছুই বলতে পারলেন না! শুধু একটা কথাই বললেন, আপনার জ্ঞান ফিরলে যেকোনো দিন ফিরতে পারে, হয়তো আজই বা হয়তো দশ বছর পর! বা আপনি হয়তো কোমা থেকে আর কখনো বেরই হবেন না! কোমাতে থেকেই নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন!
আর হেকিমের থেকে এই খবর টা শোনার পর থেকে হিজ ম্যাজেস্টি যে কি হয়ে গেয়েছিলেন সেটা শুধুমাত্র আমরা, আপনার এই সন্তান গুলো জানে! আর জানে হিজ ম্যাজেস্টির কামরা, তার বালিশ, ওই রেড জোন, ওই লাইফ ট্রি, আর আপনাকে অবজারভেশনে রাখা কামরাটা!
ওই দুইটা বছর তিনি সাম্রাজ্যের কোনো কাজ করতে পারেননি দিন রাতের চব্বিশটা ঘন্টার ভেতরে আঠারোটা ঘন্টাই তার কাটতো আপনার পাশে! কখনো বা শুয়ে, কখনো বা বসে, কখনো বা আপনার সাথে আনমনে কথা বলে!
মানসিক ভাবে প্রচন্ড বিধস্ত হয়ে পড়েলেন তিনি! আর সেই সাথে তার আরও একটা সমস্যা দেখা দিলো! একটা সন্তানের জন্য হাহাকার!
উনি কেমন যেন হয়ে উঠলেন! আপনার সাথে সময় কাটিয়ে বাকি যে সময়টুকু থাকতো সে সময়টুকু তিনি আলোচনা করে কাটাতেন হেকিম দের সাথে!
যত রকমের কৃত্তিম জন্মপদ্ধতি আছে সবকিছুই ট্রাই করার চেষ্টা করলেন তিনি।
আপনি হয়তো জানেন, দেমিয়ান বংশের শেহজাদাদের কৃত্তিম পদ্ধতিতে সন্তানের বাবা হওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে৷ কিন্তু হিজ ম্যাজেস্টি শুনলেননা সে কথা!
তার সন্তান ধারণের জন্য প্রাসাদের দাসীদের ভেতর থেকে শক্তিশালী একজন কে বেছে নেওয়া হলো। কিন্তু বিপত্তি বাধলো অন্য জায়গায়! দাসীটির ওভাম নিষিক্তের জন্য যখন হিজ ম্যাজেস্টির স্পার্ম সংগ্রহ করা হলো তখন বিস্ময়কর ভাবে অদৃশ্য হয়ে গেলো তার সমস্ত স্পার্ম, যেন বাতাসে মিলিয়ে গেলো সেগুলো! হেকিমরা এরপর আরও অনেকবার চেষ্টা করলেন, বাতাসের সংস্পর্শে না এনেও চেষ্টা করে দেখলেন, তবুও কোনো লাভ হলো না! সেগুলো কিভাবে কিভাবে জানি অদৃশ্য হয়ে গেলো প্রতিবারই! কোনোভাবেই সেগুলোকে ধরে রাখা গেলো না! কিন্তু এর পেছনের কারণ উদঘাটন করতে পারলো না কেউ!
কিন্তু এরপর হিজ ম্যাজেস্টি যেন আরও উন্মাদের ন্যায় হয়ে উঠলেন! একদিকে আপনি হারিয়ে যেতে চলেছেন তার জীবন থেকে, অন্যদিকে নিজের সন্তান হারানোর যন্ত্রণা, বাবা হতে না পারার যন্ত্রণা তাকে মানসিক ভাবে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে লাগলো যেন! প্রচন্ড খিটখিটে মেজাজের হয়ে পড়লেন তিনি! নিজের কাছে কাউকে ঘেঁষতে দিতেন না! দিনে দিনে হিংস্র হয়ে উঠতে শুরু করলেন, ঠিক আপনার জন্মের আগে তিনি যেমন ছিলেন, তেমন! অনুভুতি শূন্য, দয়ামায়া হীন!
একসময় বাধ্য হয়ে কাউন্সিলিং শুরু করলেন তিনি, যেন নিজের এই ফেলে আসা স্বভাবকে আবার তিনি গ্রহণ না করে ফেলেন! কিন্তু যে হেকিম তার কাউন্সিলিং করলেন, তিনি বললেন হিজ ম্যাজেস্টির একটা সন্তানের প্রয়োজোন, কিছু আপন মানুষের প্রয়োজন তার চারপাশে! আর এই কথাটাই কিভাবে কিভাবে জানি মস্তিষ্কে বসে গেলো ওনার।
আর এরপর থেকেই নিজের একটি সন্তানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন তিনি! এই সাম্রাজ্যের জন্য, নিজের জন্য তার একটা সন্তান চাইই চাই!
রোজ তিনি দেখতে যেতেন আপনাদের অনাগত মৃত সন্তানটিকে, যাকে তিনি কবর দিয়ে এসেছিলেন শিরো মিদোরির পশ্চিম কোণায় থাকা অর্কিডে পরিপূর্ণ গাছপালার মাঝে! আমরা সকলে মিলে তাকে সেখানে আর না যেতে পরামর্শ দিলেও তিনি শুনতেন না! এমনকি এত গুলো বছর পরেও তিনি প্রায়ই সেখানে যান! বেশ খানিকটা সময় কাটান!
আর তার এই অনাগত সন্তানের সাথে রোজ দেখা করতে যাওয়া টা তার সন্তানের চাহিদা টাকে আরও ট্রিগার করলো! নিজের হাতে মাটির তলায় রেখে আসা নিজের অংশটাকে তিনি ভুলতে পারলেন না কোনোভাবেই!
এরপর আপনার কোমায় চলে যাওয়ার প্রায় বছর দুয়েক পর হঠাৎ করেই একদিন জ্ঞান ফিরলো আপনার৷ হিজ ম্যাজেস্টি তখন পুরোপুরি পাগলপ্রায়! সাম্রাজ্য উচ্ছন্নে! কোনো কিছুরই কোনো শৃঙ্খলা নেই, সব স্থানে বিশৃঙ্খলা, হিংস্রতা! কিন্তু হিজ ম্যাজেস্টির সেই বিক্ষিপ্ত মানসিক অবস্থায় আপনার কোমা থেকে বেরিয়ে আসা হয়ে উঠলো মরুর বুকে এক পশলা বৃষ্টির মতো!
আমি জানিনা আপনার মনে আছে কিনা! আপনি যেদিন জেগে উঠে বলছিলেন প্রাসাদের সবকিছু আপনার কাছে অন্যরকম লাগছে, এমনকি হিজ ম্যাজেস্টি কেও, সেদিন হিজ ম্যাজেস্টি আপনাকে বুকে নিয়ে ভীড়ের ভেতরে পরিবারের থেকে ছুটে যাওয়া ছোট্ট বাচ্চাটির ন্যায় চিৎকার করে কেঁদেছিলেন!
আপনি ছিলেন হিজ ম্যাজেস্টির মানসিক শান্তি, আর সেদিনের পর থেকে আপনি হয়ে উঠলেন ওনার স্বাভাবিকতা আর অস্বাভাবিকতার ভেতরের ব্যালান্স! সেদিনের পর থেকে আপনাকে না দেখতে পেলে তিনি পাগলের মতো হয়ে উঠতেন!
কিন্তু আপনাকে ফিরে পেয়েও সেই সন্তানের খেয়াল ওনার মাথা থেকে সরলো না! দিনরাত একটি সন্তানের প্রয়োজনীয়তা কুরে কুরে খেতে শুরু করলো ওনাকে, আর এরপর থেকেই তিনি আবার শুরু করলেন দাসীদের কে ব্যাবহার করা!
আপনার জন্মের পর ওই সর্বপ্রথম উনি কোনো দাসী কে স্পর্শ করলেন! কিন্তু তিনি জানতেন আপনি কষ্ট পাবেন, তাই আপনার থেকে ব্যাপারটাকে পুরোপুরি গোপন করে গেলেন তিনি! কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আপনার চোখ ফাকি দিতে পারলেন না!
বারে বার চেষ্টা করতে থাকলেন তিনি। আর প্রতিবারই আপনি তার দাসীদের কে খুন করলেন, তিনি আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিকেন তিনি!
কিন্তু যে বার আপনি তার দাসীর গর্ভে আসা সাত মাসের সন্তানটিকে দাসীটা সহ হত্যা করলেন সেদিন তিনি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না!
আপনার দৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রেখে তিনি তার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চলেছিলেন, কিন্তু শেষ মুহুর্তে এসে জেনে গেলেন আপনি! আর নিজের ক্রোধ সামলাতে না পেরে হত্যা করলেন দাসীটিকে!
আর সেদিনই নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারালেন তিনি! আপনাকে শাস্তি প্রদান করে প্রাসাদে নিষিদ্ধ করে দিলেন, আর পাঠিয়ে দিলেন ওয়ার্কিং জোনে!
কথাগুলো বলে কোকো থামলো এবার। কোকোদের দিক থেকে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে এতক্ষণ ধরে ওদের কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকা অ্যানার চোখ জোড়া দিয়ে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোটা লোনা পানি! নিজের অজান্তেই ডান হাতটা চলে গেলো ওর তলপেটের ওপর, যেখানে কয়েকটা সপ্তাহের জন্য বেড়ে উঠেছিলো ওর আর মীরের সন্তান!
কয়েকবার পেটের ওপর হাত বুলিয়ে এবার হঠাৎ করেই উঠে বসলো অ্যানা। মেঝের ওপর ছড়িয়ে থাকা চুল গুলো ঝরঝর করে পিঠের ওপর এসে পড়লো। উঠে বসে আকাশের দিকে তাকালো ও একবার!
মীরের সন্তান প্রয়োজন, খুবই প্রয়োজোন! ওর সাম্রাজ্য, দেমিয়ান বংশের ভবিষ্যৎ, ওর সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ উত্তরসূরী, ওর মানসিক শান্তি সবকিছুর জন্যই একটা সন্তানের প্রয়োজন মীরের। কিন্তু মীরের সন্তান অন্য কারো গর্ভে বেড়ে উঠবে এটা ও কিভাবে সহ্য করবে! ও কি কখনো সহ্য করতা পারবে? না, সম্ভব না, কোনোভাবেই না!
তবে? মীরের যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হবে! হয়তো ওকে, নয়তো ওর অন্য নারীর গর্ভে বেড়ে ওঠা সন্তান কে!
ও কি করতো? মীরের জায়গায় আজ ও থাকলে কি করতো!
আকাশের দিকে চোখ তুলে ভাবলো অ্যানা। হ্যাঁ, ও ওর সন্তানকেই বেছে নিতো। একটা সন্তান যে প্রয়োজন! খুব প্রয়োজন! মীরের প্রয়োজন, সাম্রাজ্যের প্রয়োজন! তবে ওর কি হবে? ও কি করবে?
ও থাকবে না মীরের জীবনে, একদম থাকবে না। কোন অধিকারে থাকবে? আর ও চলে গেলেই বা কি! মীর তো স্ত্রী পাবে, সন্তান পাবে! তবে? মীরের কিসের অভাব থাকছে? কোনো কিছুরই না।
একটি প্রিয়তমা স্ত্রী, কয়েকটি সন্তান; কিছু বছর পরে প্রাসাদ জুড়ে যাদের মিহি কন্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয়ে বেড়াবে প্রতিটা পাথরের সাথে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে!
ওর স্থান তবে কোথায় সেখানে? কোথাও না! কোথাও না!
কি হবে ও না থাকলে? মীর শেষ বয়সে একা থাকবে? নাহ, থাকবে না! ওর তো দাসী থাকবে অনেক, তারা সঙ্গ দিবে ওকে! ওর পূর্বপুরুষেরা তো এভাবেই জীবন কাটিয়ে এসেছে! মীর ও না হয় ওভাবেই নিজের জীবন কাটিয়ে দেবে, যে জীবনে অস্তিত্ব থাকবে না শিনু নামের কারো!
কতদিন মীরের মনে থাকবে ও? হয়তো কয়েকটি বছর শিনু নামটা এসে ধাক্কা খাবে মীরের মস্তিষ্কের ভেতর, তারপর? হয়তো কয়েক বছর পর পর একদিন! হয়তো কোনো তারাভরা রাতে বা কোনো বৃষ্টি ভেজা সকালে! তারপর?
বিলীন হয়ে যাবে ওর অস্তিত্ব মীরের মন, মস্তিষ্ক থেকে। আর তারপর একদিন এ পৃথিবী থেকেও! এই তো জীবন! আর কি চাই?
মীর টা ভালো থাকুক। স্ত্রী সন্তান নিয়ে প্রচন্ড খুশি থাকুক, কামরা টা ভরিয়ে হো হো করে হাসুক, ওর উচ্ছাস মিশ্রিত হাসিতে মাতোয়ারা হয়ে উঠুক এই ধবধবে প্রাসাদ টা!
দম আটকে আসতে লাগলো অ্যানার! প্রচন্ড শব্দ করে বুক ভরে বাতাস নিলো ও! আর তারপর দম ছেড়ে শান্ত করে নিলো নিজেকে পুরোপুরি।
আকাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ধীর গতিতে কোকো ফ্যালকনের দিকে তাকালো ও। তারপর দুর্বল কন্ঠে বলে উঠলো,
— খঞ্জর আছে তোদের কারো কাছে? চিন্তা করিস না, মরবো না আমি! এত সহজে আমি মরছিনা।
কোকো ফ্যালকন তাকালো একবার একে অপরের দিকে। তারপর কোকো নিজের পোশাকের পেছন থেকে একটা ছোট, ধারালো খঞ্জর বের করে দিলো অ্যানার হাতে, কিন্তু সতর্ক রইলো পুরোপুরি, যেন অ্যানা কোনো দুর্ঘটনা ঘটানোর আগেই অ্যানাকে আটকে ফেলতে পারে।
অ্যানা খঞ্জর টা হাতে নিয়ে খুলে ফেললো তার সোনায় মোড়ানো খাপটি, তারপর মৃদু স্পর্শে নিজের ডান কাঁদের ওপর থেকে সরিয়ে দিলো মেরুণ রঙা পোশাকটির অংশ, উন্মুক্ত হয়ে পড়লো ওর ফর্সা কাঁধ, আর এরপর কোকো ফ্যালকন কিছু বুঝে ওঠার আগেই খঞ্জর টা দিয়ে নিজের কাধের ওপর ক্ষীপ্র গতিতে আঘাত করলো অ্যানা, আর তারপর খুচিয়ে বের করে নিয়ে এলো ওর শরীরে সেট করে রাখা ট্র্যাকার টা!
মাংসের সাথে প্রায় মিশে যাওয়া ট্র্যাকার টি খুলে ফেলতেই অ্যানার কাঁধের ক্ষতস্থান থেকে ফিনকি দিয়ে বের হতে শুরু করলো রক্ত।
আতঙ্কিত হয়ে উঠলো কোকো আর ফ্যালকন। ইয়াসমিন দৌড়ে এলো সিড়ির প্রবেশ মুখ থেকে, কিন্তু ইয়াসমিন অ্যানার কাছে এসে পৌছানোর আগেই কোকো ফ্যালকনকে হতবাক করে দিয়ে চোখের পলকে বসা থেকে উঠে, দৌড়ে ছাদের কিনারে গিয়ে, ছাদ থেকে লাফ দিয়ে রেড জোনে ঢুকে পড়লো অ্যানা। আর তারপর মুহুর্তের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেলো ঘন জঙ্গলটির ভেতর!
চলবে…….
( অনেক দেরি হয়ে গেলো, ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন 💙)