বাদশাহ_নামা #পর্বসংখ্যা_৩০ #আ_মি_না

0
3

#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_৩০
#আ_মি_না

গ্রাজুয়েশন শেষে প্রাসাদে ফেরার পর হুজায়ফা আদনান একদিন রাতের বেলা আসওয়াদ কে তার দেহরক্ষীকে দিয়ে ডাকালেন নিজের কামরায়। আসওয়াদ তখন গোছ গাছ করে অ্যানিম্যাল টাউনের উদ্দেশ্যে বের হতে নিচ্ছিলো। দাদাজান ডেকেছেন শুনে আসওয়াদ যাত্রা ভঙ্গ করে হুজায়ফা আদনানের খাস কামরার দিকে এগোলো।

খাস কামরার সামনে দাঁড়ানো দ্বাররক্ষক দরজা খুলে দিলে আসওয়াদ কামরায় ঢুকে দেখলো দাদাজান তার কামরার টেবিলে খুব মনোযোগ দিয়ে একটা মোটা সোটা কালো মলাটের বই পড়ছেন, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। আসওয়াদের ঢোকার শব্দ হতেই বই থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালেন তিনি। তারপর আসওয়াদ কে দেখে নিজের সামনের চেয়ার টিতে বসতে বললেন।

আসওয়াদ বসার পর দাদাজানের আদেশের অপেক্ষায় রইলো। দাদাজান তাকে রাতের বেলা সাধারণত ডাকেন না৷ ডেকেছেন যখন তখন নিশ্চই কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আসওয়াদ তার প্রাণপ্রিয় দাদাজানের কথা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে দাদাজানের মুখপানে চেয়ে বসে রইলো।

হুজায়ফা আদনান নিজের সামনের বই খানা বন্ধ করে পাশে রেখে দিলেন৷ তারপর মোটা ফ্রেমের চশমার ভেতর দিকে জহুরি দৃষ্টিতে নাতির দিকে চাইলেন। তার সেই ছোট্ট, তুলতুলে, সকলের কাছে অবহেলিত নাতি টা আজ এক সুদর্শন পুরুষে পরিণত হয়েছে, দৃঢ় মুখের কাঠামোর সাথে তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি তার প্রখর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় না চাইতেও প্রকাশ করে দেয়।

কিছুক্ষণ নাতির দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি ধীর গলায় বলে উঠলেন,

— আসওয়াদ, আমার প্রাণপ্রিয় নাতি! তোমাকে নিয়ে আমি গর্বিত। কেন জানো?

হুজায়ফা আদনান বিরতি দিলেন, চুপ করে রইলেন কিছু সময়। আসওয়াদ আগ্রহের সাথে চেয়ে রইলো দাদাজানের পানে, তাকে নিয়ে গর্বিত হওয়ার কারণ জানতে। হুজায়ফা আদনান বললেন,

— আমি এত দিনে যেটা পারিনি সেটা তুমি করে দেখিয়েছো। শুধু আমি নই, এর আগে কোনো বাদশাহই এই কাজ করার চেষ্টাও করে দেখেনি, দু একজন চেষ্টা করলেও সফল হতে পারেনি। আমি যদিও চেষ্টা করেছি কয়েকবার, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু তুমি একজন শেহজাদা হয়েই সেটা করে দেখিয়েছো। জঙ্গলের ওই মানুষ রূপী পশু পাখি গুলোকে তুমি সিভিলাইজড করতে সক্ষম হয়েছো৷

আসওয়াদ চমকালো। দাদাজানের থেকে এই ব্যাপার টা সে পুরোপুরি লুকিয়ে গেছে। নিজের এই গোপনীয় এবং নিষিদ্ধ কাজের কথা কাউকে জানাতে চায়নি। কিন্তু দাদাজান জেনে গেছেন, এবং জানার পরও তিনি কিছুই বলেননি আসওয়াদ কে। তাকে তার কাজ চালিয়ে যেতে দিয়েছেন। আসওয়াদ অপরাধীর ন্যায় চুপ চাপ বসে রইলো নিচের দিকে তাকিয়ে। নিজের অপরাধবোধ থেকে অনুতপ্ত হয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই হুজায়ফা আদনান নরম গলায় বলে উঠলেন,

— নিজেকে দোষী ভাবার কোনো কারণ নেই আসওয়াদ। তুমি জঙ্গলের যে পর্যন্ত পৌছেছো এত গুলো দিনে সে পর্যন্ত কেউ যাওয়ার সাহসও করেনি। এমনকি আমি নিজেও না। আমি একজন বাদশাহ। বাদশাহ হওয়ার পর লাইফ ট্রি আমাকে বিশেষ বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করেছে। কিন্তু তুমি বাদশাহ না হয়েও সেসব ক্ষমতার অনেক কিছুই জন্ম থেকেই পেয়ে গেছো। এবং এটা একটা অত্যাশ্চর্য ব্যাপার৷ তুমি ভেবোনা তোমার এই অ্যাডভেঞ্চারের কারণে আমি রাগ করেছি তোমার ওপর। বরং আমি খুশি হয়েছি। আমি নিজেও তোমার মতোই সবকিছু এক্সপ্লোর করতে ভালোবাসি। কিন্তু কেন জানি রেড জোনের ভেতরের পুরো টা এক্সপ্লোর করতে সাহসে কুলায়নি। এই শিরো মিদোরির জঙ্গলের এমন অনেক রহস্য আছে যেগুলো কেউই জানে না, শুধুমাত্র দেমিয়ান বংশের শেহজাদী গুলো ছাড়া। কিন্তু তুমি যে এই বিশাল জঙ্গলটির পুরোটাই এক্সপ্লোর করে ফেলেছো এতে আমি খুবই খুশি হয়েছি আসওয়াদ। এবং আমি মনে করি তুমি একদিন এই পঞ্চদ্বীপের একজন যোগ্য বাদশাহ হয়ে নিজেকে প্রমাণ করবে৷

আসওয়াদ দাদাজানের এমন প্রশংসায় একটু লজ্জা পেলো যেন। চোখ জোড়া নিচে নামিয়ে কিঞ্চিৎ রক্তিম হয়ে ওঠা চোয়াল দুটোকে দাদাজানের দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে চাইলো। তখন হুজায়ফা আদনান আবার বললেন,

— তোমাকে আমি এখন ডেকেছি অন্য কারণে৷

বলে তিনি তার টেবিলের ড্রয়ার টা টান দিয়ে খুলে সেখান থেকে একটা মানচিত্র বের করলেন তারপর সেটা টেবিলের ওপর বিছিয়ে আসওয়াদের দিকে তাকিয়ে বললেন,

— তোমার শিরো মিদোরি এক্সপ্লোর করা শেষ, এখন বহির্বিশ্ব কে এক্সপ্লোর করার পালা।

আসওয়াদ দাদাজানের কথায় কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে দাদাজানের দিকে তাকিয়ে টেবিলে পাতানো মানচিত্রের দিকে দৃষ্টি দিলো। হুজায়ফা আদনান পৃথিবীর মানচিত্রটির প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝ বরাবর নিজের তর্জনি দ্বারা নির্দেশ করে বললেন,

— এই মুহুর্তে তুমি আছো এখানে, যেটা বহির্বিশ্ব থেকে পুরোপুরি ভাবে বিচ্ছিন্ন এবং অদৃশ্য।

এরপর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে আঙুল সরিয়ে অন্যান্য ভুখন্ডের দিকে নির্দেশ করে তিনি বললেন,

— এখন তোমাকে যেতে হবে বিশ্ব ভ্রমণে। বহির্বিশ্ব থেকে যতটা সম্ভব জ্ঞান তোমাকে আহরণ করতে হবে। সেখানে আছে জ্ঞানের ভান্ডার, হাজার রকমের শিক্ষা, চিকিৎসা, শাসন, সংস্কৃতি, মানুষ এবং তাদের আচার ব্যাবহার, প্রযুক্তি এবং ফাইটিং স্কিলস। এই সবকিছু সম্পর্কে তোমার জানা প্রয়োজন৷ তবে হ্যাঁ! বহির্বিশ্ব টা অনেক পজিটিভ উপাদান দিয়ে তৈরি হলেও সেখানে নেগেটিভিটির পরিমাণ পজিটিভিটির থেকে তুলনামূলক ভাবে অনেক খানি বেশি। তাই তোমাকে প্রতিমুহূর্তে সচেতন থাকতে হবে যে তুমি কি করছো, কোন পথে যাচ্ছো, কোন শিক্ষা টা গ্রহণ করছো। তুমি একজন বুদ্ধিমান ছেলে, আমি জানি তুমি কখনো ভুল পথে হাটবে না, তবুও তোমাকে সতর্ক করছি কারণ এটা আমার দায়িত্ব। এখন তুমি বহির্বিশ্ব ভ্রমণের প্রস্তুতি নাও, তুমি চাইলে যেকাউকে তোমার সাথে নিতে পারো, আর চাইলে নাও নিতে পারো। সেটা একান্তই তোমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। বুঝেছো?

আসওয়াদ মানচিত্র থেকে চোখ সরিয়ে হুজায়ফা আদনানের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো সে বুঝেছে, তারপর আবার নজর দিলো মানচিত্রের দিকে। পূর্ণ মনোযোগের সাথে সে দেখতে থাকলো মানচিত্র টা। হুজায়ফা আদনান আসওয়াদের পর্যবেক্ষণের মাঝেই আবার বললেন,

— তোমার যেখানে যেখানে যাওয়া প্রয়োজন সে জায়গা গুলো আমি মার্ক করে দিয়েছি, আর কোন কোন শিক্ষা টা তোমার জন্য মাস্ট লার্নড সেটা মানচিত্রের অপর পাতায় লিখে দিয়েছি। এর বাইরে তুমি যদি আরও কিছু শিখতে চাও তবে শিখতে পারো, শুধু নেগেটিভ পজেটিভের ব্যাপার টা খেয়াল রাখবে। তবে হ্যাঁ, কুরো আহমারের মতো যেন বহির্বিশ্ব কে রিফর্ম করতে যেয়ো না। ওরা যেমন আছে ওদের কে সেভাবেই থাকতে দিবে। ওদের টা ওরা দেখে নিবে। ওদের বর্বরতা দেখে ওদের কে রিফর্ম করতে যাওয়া মানেই নিজের মূল্যবান সময় টা নষ্ট করা, এ ছাড়া আর কিছুই না৷

আসওয়াদ দাদাজানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসলো। দাদাজান সবই জানতেন, কিন্তু আসওয়াদ কে ঘুর্ণাক্ষরেও বুঝতে দেননি। দাদাজানের প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালো আসওয়াদ, তারপর বলল,

— দাদাজান, আপনি অনুমতি দিলে আমি সালিম ভাইজান কে আমার সাথে নিতে চাই। সে ছাড়া অন্য কোনো সঙ্গিকে আমি বিশ্বাস করিনা। আর আপনার যদি অনুমতি থাকে তো আমি আগামী মাসেই বহির্বিশ্বের উদ্দ্যেশ্যে রওনা হবো।

— নিশ্চই, তুমি যাকে নিতে চাও নাও, যখন যেতে চাও যাও।

মানচিত্র টা গুটিয়ে রাখতে রাখতে বললেন হুজায়ফা আদনান। তারপর গোটানো মানচিত্র টা আসওয়াদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে তিনি বললেন,

— আমার কথা গুলো মাথায় রাখবে, নো নেগেটিভিটি, অনলি পজিটিভিটি।

আসওয়াদ নিঃশব্দে হেসে ওপর নিচে মাথা নাড়ালো। তারপর মানচিত্র টা হাতে নিয়ে একপলক সেদিকে তাকিয়ে দাদাজানের উদ্দেশ্যে মৃদু কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

— দাদাজান! বহির্বিশ্ব থেকে সুশিক্ষা নিয়ে ফিরে আসলে কি আমার বাবা আমাকে নিজের সন্তান হিসেবে মেনে নিবেন? নাকি আমার নিজেকে আরও প্রমাণ করতে হবে?

হুজায়ফা আদনানের হাসি মুখ প্রশস্ত হলো। তিনি প্রশ্ন করলেন,

— তোমার কি এখনো আক্ষেপ আছে আসওয়াদ?

হুজায়ফা আদনানের প্রশ্নে মুচকি হেসে আসওয়াদ উত্তর দিলো,

— না দাদাজান, আক্ষেপ নেই। শুধু একটা প্রশ্ন আছে, কেন?

.

শিরো মিদোরি ছেড়ে বহির্বিশ্ব ভ্রমণের উদ্দ্যেশ্যে বের হওয়ার আগে সালিম আর আসওয়াদ প্রথমেই দাদাজানের থেকে বিদায় নিলো। এরপর সালিম গেলো ওর পরিবারের থেকে বিদায় নিতে। আর আসওয়াদ এলো সোজা অন্দর মহলে। মা ছাড়া বিদায় নেওয়ার মতো অন্য কেউ তো তার নেই। বাবা তার সাথে এখনো পর্যন্ত কখনো কথা বলেননি, তাকে কখনো দেখতেও আসেননি। তার সাথে জন্মানো ভাইটির সাথেও তার কখনো ব্যাক্তিগত ভাবে কথা হয়নি। তাদের কাছে আসওয়াদ একজন অপরিচিত ব্যাক্তি। আসওয়াদ নিজে থেকেও কখনো তাদের কাছে যায়নি। যারা তাকে চায়না তাদের থেকে দূরে থাকাটাই তার কাছে শ্রেয়।

এলানর বসে ছিলেন নিজের কামরার জানালার ধারের সোফায়। চোখ জোড়া তার বাইরের দিকে। উদাস চোখে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি৷ বাদামী রঙা চুল গুলোতে পাক ধরেছে। চোখের দৃষ্টি এখন ধুসর। চোখের কোণের চামড়া গুলো কুচকে গেছে। বয়স টা যে এখন পঞ্চাশের কোঠায়!

এমন সময়ে অন্দর মহলে ঢোকার দরজার পাশের দেয়ালে লাগানো এক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি থেকে একটি ফিমেইল এআই ভয়েস বলে উঠলো,

— অ্যাটেনশন, শেহজাদা নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান।

ভয়েস টি ছড়িয়ে গেলো সমস্ত অন্দর মহল জুড়ে। দাসীরা ত্রস্ত ভঙ্গিতে যে যার কাজ ফেলে রেখে নির্দিষ্ট নিয়মে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে গেলো অন্দরমহলের বারান্দার দু পাশ জুড়ে। কামরার ভেতর থেকে এলানর শুনতে পেলেন নিজের সন্তানের রাজকীয় নাম টি। উচ্ছসিত হয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে এসে কামরার দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি।

আর তখনি অন্দর মহলের দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো আসওয়াদ৷ তাকে দেখা মাত্রই সমস্ত দাস দাসী গুলো মাথা নিচু করে কুর্নিশ করে রইলো, আর এলানর আসওয়াদের সুশ্রি মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে খুশিতে কেদে ফেললেন। দাসী গুলো আড়চোখে দেখতে লাগলো আসওয়াদ কে। এই বলিষ্ঠ শরীরের পুরুষ টিকে আর কিছু বছর পরেই তারা সেবা দিতে পারবে ভেবেই তাদের শরীর মন পুলকিত হয়ে উঠছিলো। বুকের ভেতর বেজে চলছিলো দামামা।

আসওয়াদ মায়ের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে মুচকি হাসলো, তারপর হাত দুইটা পেছনে বেধে, ধীর, ভারী পা ফেলে এগোলো মায়ের দিকে। এলানর নিজেও দ্রুত পায়ে ছুটে এলেন ছেলের দিকে, তারপর আসওয়াদ কে জাপটে নিলেন নিজের সাথে।

তার শেহজাদা এখন বড় হয়েছে। মায়ের কাছে আসার সময় কই? সারাক্ষণ পড়াশোনা, কাজ কর্ম আর ফাইটিং নিয়ে সে ব্যাস্ত। শেষ কবে তার সাথে দেখা করতে এসেছে তা মনে পড়ে না এলানরের, হয়তো ছ মাস হয়ে গেছে। এলানর আসওয়াদ কে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কাদলেন। আসওয়াদ মাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে হেটে হেটে চলে এলো মায়ের কামরায়। তারপর জানালার ধারের সোফা টায় মাকে বসিয়ে নিজেও পাশে বসে মায়ের চোখ জোড়া মুছিয়ে দিয়ে নরম গলায় বলে উঠলো,

— এভাবে কান্না করতে হয় না আম্মা, আপনার শরীর ভালো না, কান্না করলে শরীর আরও খারাপ করবে!

— তুমি চুপ থাকো, আমার কথা তো তোমার মনেও পড়ে না! আমিও যে একটা মানুষ সেটা তুমি ভুলেই যাও! আমার কি আমার সন্তান কে কাছে পেতে ইচ্ছা করে না? তিন বেলা খাবার, আর দাসদাসী দিয়ে চারপাশ ভরিয়ে রাখলেই কি একটা মানুষের সব দুঃখ দূর হয়ে যায়!

ফুপিয়ে উঠে বললেন এলানর। আসওয়াদ মায়ের এমন অভিমানে হেসে উঠলো। তারপর নিজের দুহাত দারা এলানরের চোয়াল দ্বয় ধরে এলানর কে মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকলো।
বয়স হয়ে গেছে তার মায়ের, চুল গুলো আধা পাকা, চামড়া কুচকে গেছে মুখের, চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আছে। শরীরের শক্ত বাধুনী আলগা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। সময় ফুরিয়ে আসছে তার!

মা কে দেখতে দেখতে গলা ধরে এলো আসওয়াদের। বুকের ভেতরে একটা চিনচিনে ব্যাথা সাপের মতো ছোবল দিয়ে উঠলো। মায়ের চোখ জোড়াতে তাকিয়ে আসওয়াদ ধরা গলায় বলে উঠলো,

— আমার সোনা আম্মা! আমার যদি ক্ষমতা থাকতো তবে আমি কখনোই আপনাকে নিজের থেকে আলাদা করতাম না আম্মা! কখনোই আপনাকে আমার থেকে দূরে যেতে দিতাম না। আমি যদি জানতাম আমার স্বল্প আয়ুর মায়ের কোলে আমি দীর্ঘায়ু নিয়ে জন্মাবো তবে আমি কখনোই জন্মগ্রহণ করতাম না! আপনি, সালিম আর দাদাজান ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার আপন বলতে আর কেউ নেই আম্মা। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে খুব দ্রুতই আমি আমার আপন মানুষ দের দুজন কে হারাতে চলেছি!

এলানোর সিক্ত দৃষ্টিতে আসওয়াদের দিকে তাকালেন, তারপর হুড়মুড়িয়ে আছড়ে পড়লেন আসওয়াদের বুকে।

— আমার বাবা! আমার কলিজার টুকরা বাবা! তোমার মা যেখানেই যাক না কেন সর্বদা তোমার সাথেই থাকবে। তোমার মায়ের দু’য়া সবসময় তোমার সাথেই থাকবে বাবা!

ফুপিয়ে উঠে বললেন এলানর। আসওয়াদের চোখ জোড়ায় বাষ্প ঘনীভূত হলো, মায়ের মাথায়, চুলের ওপর দিয়ে চুমু খেলো ও একটা। এলানর আবার বললেন,

— তোমার কাউকে প্রয়োজন হবে না বাবা! তুমি আমার চোখে দেখা সবচেয়ে যোগ্য ব্যাক্তি। তোমার চেয়ে যোগ্য কেউ এই পঞ্চদ্বীপের কোথাও নেই! তবে আমি দু’য়া করি, তোমার জীবনে একদিন এমন কেউ আসুক যে আমার থেকেও তোমার বেশি আপন হবে, জাগতিক কোনো কষ্ট তোমাকে সে ছুতে দিবে না। তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসবে, আমার থেকেও বেশি! তোমার সমস্ত দুঃখের স্মৃতি, পাওয়া না পাওয়ার কষ্ট সে তোমাকে ভুলিয়ে দেবে, যাকে দেখা মাত্রই তোমার অন্তর প্রশান্তিতে ছেয়ে যাবে! আমি দুয়া করি, সবসময়!

এলানরের কান্নার বেগ বাড়লো। নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তান কে এই অনুভূতি শূন্য প্রাসাদে তিনি কার কাছে রেখে যাবেন, কে তার সন্তান কে তার মতো করে আগলে আগলে রাখবে, তার দুঃখ গুলোকে সযত্নে তার সন্তানের থেকে দূরে রাখবে সেটা ভেবেই তার বুক টা ছিড়ে যেতে লাগলো।

অনেক অনেক ক্ষন কেটে গেলো এভাবে। এক সময় এলানরের কান্নার বেগ থেমে গেলো ধীরে ধীরে। আসওয়াদের বুকে মাথা রেখে মাঝে মাঝে ফোপাচ্ছেন তিনি এখনো। আসওয়াদ মায়ের আধা পাকা চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কিছু সময় পর মায়ের মুখ টা নিজের বুকের ওপর থেকে সামনে তুলে এনে আসওয়াদ বলল,

— আম্মা, আমি আপনাকে একটা খবর জানাতে এসেছি।

এলানর চোখ মুছে ছেলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আসওয়াদ কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে বলে উঠলো,

— দাদাজানের আদেশে আমি বিশ্ব ভ্রমণে বের হচ্ছি আম্মা। সেখানে আমি কত গুলো বছর কাটাবো জানিনা। আপনাকে দ্বিতীয় বার দেখার সুযোগ হবে কিনা সেটাও জানিনা। আমি আপনার থেকে দু’য়া নিতে এসেছি আম্মা। আপনার কাছে যেন আবার সহিহ্‌ সালামতে ফিরে আসতে পারি তার জন্য দু’য়া দিয়ো আমাকে।

এলানর থমকালেন কিছুক্ষণের জন্য। অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে তাকালেন আসওয়াদের মুখ পানে। মায়ের মনের অবস্থা টের পেয়ে আসওয়াদ আবার বলল,

— নিজেকে এই সাম্রাজ্যের জন্য যোগ্য করে তুলতে এই বিশ্ব টা ভ্রমণের খুবই প্রয়োজন আম্মা! আমার এই পৃথিবী কে জানা প্রয়োজন। ন্যায় অন্যায় এর ভেতরে বিভেদ খুজে নেওয়ার জন্য এই পৃথিবীতে বিদ্যমান সমস্ত জ্ঞানের অল্প কিছু হলেও আহরণ করা আমার জন্য খুবই প্রয়োজন আম্মা! আপনি মন খারাপ করবেন না আম্মা!

এলানর সিক্ত দৃষ্টিতে আসওয়াদের দিকে এক পলক তাকিয়ে, তার থেকে বেশ অনেক খানি উচ্চতায় থাকা আসওয়াদের কপালে শরীর টা উঁচু করে একটা চুমু খেলেন, তারপর বললেন,

— বাবা আমার! তুমি পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাও না কেন তোমার মায়ের মন সারাক্ষণ তোমার সাথেই থাকবে। আমি শুধু তোমাকে একটা কথাই বলতে চাই, নিজের ভেতরের পশু সত্বা টাকে কাবুতে রেখো। তুমি কুরো আহমারে কি করেছো সেটা সবাই জানে, আমিও জানি। সবাই তোমার এমন কাজের প্রশংসা করছে। সবার মুখেই তোমার নাম। কিন্তু যে কোনো কাজ করার আগে তার ফলাফল কি হতে পারে সেটা ভালোভাবে ভেবে নিবে। তোমার ভেতরে একটা হিংস্র শিকারী বাঘের বসবাস৷ সে শিকার চাইবে, তুমি যদি তাকে শিকার করতে না দাও সে ক্ষুধার্ত হয়ে উঠবে, তার হিংস্রতার পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। আর তুমি যদি তাকে মাত্রার অতিরিক্ত শিকার দাও তবে সে হয়ে উঠবে লোভি। তাকে সামলানো তখন তোমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠবে। তাই তাকে কিভাবে বশে রাখতে হবে সেটা তোমাকে শিখতে হবে। নইলে তুমি কোনো না কোনোদিন চরম বিপদে পড়ে যাবে। আমার এই কথা গুলো মনে রেখো বাবা! তোমার মায়ের দু’য়া সবসময় তোমার সাথে আছে।

আসওয়াদ এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো মায়ের কথা শুনছিলো। এলানরের কথা শেষ হলে আসওয়াদ তার সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে এরপর এলানরের থেকে বিদায় নিয়ে অন্দর মহল থেকে বেরিয়ে এলো। আর এলানর অন্দরমহলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চেয়ে রইলেন ছেলের যাওয়ার পানে, এটাই হয়তো তার প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানের সাথে তার শেষ দেখা৷

চলবে…..

( তাড়াহুড়ো করে লিখেছি, ভুল ভাল থাকতে পারে অনেক। সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন 💙)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here