#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_৩১
#আ_মি_না
প্রাশান্ত মহা সাগরের বুক চিরে, উত্তাল ঢেউয়ের সাথে লড়াই করে সামনে এগিয়ে চলেছে একটি সুপার ইয়ট। ইয়ট টির তৃতীয় ডেকে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে আসওয়াদ, চোখ জোড়া তার সমুদ্রের সাদা ফেনা তোলা নীল ঢেউ এর দিকে, ঘাড় বাবরি ঝাকড়া, কিঞ্চিৎ কোকড়া চুল গুলো বাতাসে উড়ছে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সালিম। সে তাকিয়ে আছে তার থেকে লম্বায় চওড়ায়, জ্ঞানে, বুদ্ধিতে এগিয়ে যাওয়া কনিষ্ঠ ভ্রাতা টির দিকে। কিছুক্ষণ আসওয়াদের দিকে তাকিয়ে থেকে সালিম প্রশ্ন করলো,
— ওখানে পৌঁছানোর পর আমাদের সেখানে কতদিন থাকতে হবে আসওয়াদ?
— আ’ম নট শিও’ বা’ সিক্সটি ইয়া’স, অ্যাপ্রকসিমে’লি, ভাইজান।
সালিমের দিকে এক পলক তাকিয়ে কথা টা বলে আবার সমুদ্রের নীল রাশীর দিকে মনোযোগ দিলো আসওয়াদ।
— আম্মাজান আমার জন্য নিজে বেছে বেছে জনা দশেক দাসী পাঠিয়েছেন৷ কিছু কিশোরী, আর কিছু বাচ্চা! যদিও আমার উপযুক্ত বয়স হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের ছোয়া নিষেধ! কিন্তু আর তো মাত্র দুইটা বছরই। তারপর আমি চল্লিশে পা দেবো। ততদিনে মেয়ে গুলো আর একটু বড় হয়ে যাবে। আর বাচ্চা গুলোকে আরও দশ বছর পর কাজে লাগানো যাবে৷ কিন্তু তোমার কি হবে আসওয়াদ? তুমিও তো আর দশ টা বছর পর চল্লিশে পড়বে। কিন্তু তখন আর দাসী পাবে না!
কথা গুলো বলে দাঁত কেলিয়ে হাসলো সালিম। আসওয়াদ কিঞ্চিৎ শব্দ করে হেসে সমুদ্রের দিক থেকে ফিরে সালিমের দিকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
— চাচি জান একটা বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন৷ নইলে তোমার ফ্রি টাইম টুকু তুমি আমার মাথাটা খারাপ করতে কাজে লাগাতে। এখন যেমন করার চেষ্টা করছো। ভালো লাগছে এটা ভেবে যে আমার পেছনে না লেগে অন্তত কিছু একটা নিয়ে তুমি ব্যাস্ত থাকবে! খুবই ভালো, টাটকা কিছু নিয়ে! পারলে একসাথে তিন চার জন কে সাথে নিও, সময় টা আরও ভালো কাটবে৷
শেষের কথাগুলো নিচু স্বরে ঠোঁট টিপে হেসে বলল আসওয়াদ। সালিম আসওয়াদের দিকে মাথা টা সামান্য ঝুকিয়ে বলল,
— শুনলাম আমার চাচিজানও নাকি তোমার জন্য দাসীর অফার করেছিলেন, কিন্তু তুমি রিজেক্ট করেছো! তোমার যন্ত্রপাতি সব ঠিক ঠাক আছে তো? নাকি কাজ করে না?
নাক মুখ কুচকে খিকখিক করে হাসলো সালিম। আসওয়াদ নিজেও এবার সালিমের মতো করে সালিমের দিকে একটু ঝুকে মৃদু হেসে বলে উঠলো,
— আমার ম্যানলিনেস এর ওপর প্রশ্ন তুলোনা ভাইজান, নইলে কিন্তু তোমার দাসী একটাও আস্ত থাকবে না! তখন তোমার দিন গুলো খুব পানসে যাবে, যা আমি চাইনা।
আসওয়াদের কথা শেষ হতেই আসওয়াদ আর সালিম দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে চাপা সুরে হেসে উঠলো।
.
সাত দিনের মাথায় মাঝ রাতের পর আসওয়াদ দের ইয়ট টা এসে থামলো সেন্ট্রাল আমেরিকার এল সালভাদর রিজিওনের ‘লা লিবার্তা’ পোর্টে৷ ইয়টের ক্রু মেম্বার আর সালিমের বাচ্চা দাসী গুলোকে ইয়টে রেখে বাকি দাসী গুলোকে নিয়ে ইয়ট থেকে বেরিয়ে পড়লো সালিম আর আসওয়াদ৷ ইয়টে প্রায় পনেরো বছরের মতো খাদ্য মজুদ আছে। ক্রু মেম্বার আর অন্যরা বেশ ভালোভাবেই পনেরো ষোল টা বছর এখানে আরাম আয়েসে কাটিয়ে দিতে পারবে৷
ইয়ট থেকে বেরিয়ে ইয়টের বহির্ভাগ টা এক বিশেষ প্রযুক্তির সাহায্যে আড়াল করে দিলো আসওয়াদ, বাইরে থেকে দেখলে সেটাকে একটা পুরোনো আমলের জাহাজ ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। সব কিছু ঠিক ঠাক করে, সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমেরিকাকে খুটে খুটে দেখার উদ্দ্যেশ্যে বেরিয়া পড়লো ওরা।
.
বহির্বিশ্ব এখনো প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক খানি পিছিয়ে আছে। এখানে এখনো টেলিভিশনই আবিষ্কার হয়নি। এল সালভাদর থেকে প্রথমেই ওরা চলে গেলো সোজা ওয়াশিংটন ডিসি তে। তারপর সেখানেই থাকার মতো একটা জায়গা নিয়ে আসওয়াদ আর সালিম ঢুকলো সেখানের লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে। প্রায় বছর দুয়েক ওখানেই থেকে লাইব্রেরি টাকে তামা তামা করে প্রচুর পড়াশোনা করলো আসওয়াদ আর সালিম। আর সেই সাথে ঘুরলো পুরো আমেরিকা মহাদেশ টা।
এরপর ওরা চলে গেলো ইউকে তে। সেখানে গিয়ে আসওয়াদ, সালিম দুজনেই অ্যাডমিশন নিলো অক্সফোর্ডে। আসওয়াদ নিলো বায়োকেমিস্ট্রি, আর সালিম নিলো ফিজিক্স। প্রচুর পড়াশোনার ফাকে ফাকে ঘুরে বেড়ালো পুরো ইউরোপ কান্ট্রি টা। আর তার কিছু বছর পরই গ্রাজুয়েট হয়ে অক্সফোর্ড থেকে বের হয়ে এলো দুজনে।
এরপর আসওয়াদের শখ হলো ও মানব শরীর নিয়ে পড়াশোনা করবে। শখ পূরণ করতে ইংল্যান্ডেরই অন্য একটা কলেজে গিয়ে ভর্তি হলো ও অ্যানাটমি তে, আর সেই সময় টা সালিম নাচানাচি করে কাটালো।
কিছু বছর পর অ্যানাটমি তে গ্রাজুয়েশন নিয়ে বের হয়ে ইউরোপ ছেড়ে ওরা আবার ফিরে এলো আমেরিকাতে; এল সালভাদরে, তাদের ইয়টের নিকট। সেখানে ইয়টের ক্রু মেম্বার দের কে আগামী পনেরো বছরের জন্য রেশন দিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়লো আবারও।
এরপর সিটিতে ফিরে দুজন মিলে সময় নিয়ে ফ্রেঞ্চ আর স্প্যানিশ ভাষা শেখা শুরু করলো। আর সেই সাথে দাদাজানের কথা মতো শিখলো ব্রাজিলিয়ান জু জিৎসু। ক্রাভ মাগা আসওয়াদের আগে থেকেই শেখা ছিলো, সেই কিশোর বয়সে দাদাজান নিজ দায়িত্বে তাকে মাস্টার রেখে ক্রাভ মাগা শিখিয়ে ছিলেন৷ তাই এইটা শিখতে তার বেগ বেশি পেতে হলো না। কিন্তু সালিমের এর আগে কোনো মার্শাল আর্ট শেখা না থাকার কারণে বেচারা কে খুব কষ্ট করতে হলো।
এদিকে নিজের শারীরিক শক্তি যথা সম্ভব কম ব্যাবহার করার চেষ্টা করেও মার্শাল আর্ট একাডেমিটির সব গুলো বাঘা বাঘা স্টুডেন্ট কে কুপোকাত করে ফেললো আসওয়াদ। শেষ পর্যন্ত এমন হলো যে কেউ ওর সাথে অনুশীলন করতেও চাইতো না। সেখানের শিক্ষক গুলোও আসওয়াদ কে এড়িয়ে এড়িয়ে চলতো। তাই বাধ্য হয়ে সালিম কেই আসওয়াদের সাথে অনুশীলন করতে হতো, আর সালিমের বারো টা বাজতো!
প্রচুর ভাষা চর্চা করে, মার্শাল আর্ট শিখে, সব জায়গায় অনেক অনেক বার করে ঘোরাঘুরি করে ওরা এবার চলে এলো রাশিয়া তে। সেখানে এসে দুজনে মিলে সময় নিয়ে রাশিয়ান এবং জার্মানি ভাষা শিখলো। আর সেই সাথে মেম্বারশিপ নিলো রাশিয়ার স্টেট লাইব্রেরি তে৷ জানা অজানা বই গুলো রাত দিন এক করে পড়তে শুরু করল আসওয়াদ। সালিমের দ্বারা ওসব হতে চায় না। ও আরাম প্রিয় মানুষ! আসওয়াদের সাথে লাইব্রেরি তে আসে ঠিকই কিন্তু বেশির ভাগ সময় টা সে বই সামনে নিয়ে ঘুমায়! তাতে আসওয়াদের সুবিধাই হয়! কারণ সালিম যতক্ষন জেগে থাকবে ততক্ষণ আসওয়াদের সাথে ফাজলামি করে গোমড়ামুখো আসওয়াদ কে হাসাতেই থাকবে, হাসাতেই থাকবে!
বেশ কয়েক বছর রাশিয়াতে থেকে, প্রচুর ঘোরাঘুরি আর পড়াশোনা করে দুজনে আবার ফিরে এলো আমেরিকা তে। এরপর আমেরিকাতে আরও একটা বছর কাটিয়ে ওরা ফিরলো এল সালভাদরের পোর্টে, ওদের ইয়টের নিকট।
এরপর আমেরিকা কে বিদায় জানিয়ে, নিজেদের ইয়ট টা নিয়ে, পানামা ক্যানাল হয়ে সোজা চলে গেলো ইস্ট এশিয়াতে। এরপর সেখানে গিয়ে চায়নার নর্দান পোর্ট ওব দালিয়েনে ইয়ট টা রেখে, ইয়টের ক্রু মেম্বার দের কে আরও পনেরো বছরের রেশন দিয়ে, ওরা আবারও বের হলো ভ্রমণে৷
চায়নাতে এসে আসওয়াদ গিয়ে ভর্তি হলো সাংহাই এর জিয়াউ তোং ইউনিভার্সিটি তে, ম্যাথম্যাটিকসে। সালিম কে সেখানে পড়তে বললে সালিম বলল তাকে দিয়ে আর পড়াশোনা হবে না। সে আপাতত প্রকৃতিবিদ হতে চায়। আসওয়াদ ও আর তাকে জোর করলো না৷ সে নেচে বেড়ালেই বরং ভালো থাকবে! পড়ার কথা বললেই সালিমের মুখ কালো হয়ে যায়! তার চাইতে হাসি খুশি থাকুক, প্রকৃতি দেখুক, এইটাই ভালো!
পড়াশোনার পাশাপাশি সালিমের সাথে রোজ প্রকৃতি দেখা আর বিভিন্ন প্রানী নিয়ে গবেষণা করতে করতে দিন পার হতে লাগলো আসওয়াদের। সেই সাথে ও অ্যাডমিট হলো সেখানের কুংফু একাডেমি তে। ম্যাথ আর কুংফুর পাশাপাশি সেখানের লাইব্রেরি গুলোতে ঢূ মারা ছিলো ওর অন্যতম কাজ৷ সময় পেলেই দুজনে মিলে চলে যেতো লাইব্রেরি তে।
সারাক্ষণ একসাথে থাকতে থাকতে ওদের দুজনের ভেতর কার সিনিয়র জুনিয়র ফারাক টা একসময় নাই হয়ে গেলো! বন্ধুর মতো সম্পর্ক হিয়ে গেলো দুজনের পুরোপুরি। কিন্তু সালিম হয়ে গেলো দুষ্টু! মাঝে মাঝেই দুষ্টু সালিম দুষ্টু দুষ্টু ম্যাগাজিন এনে আসওয়াদের পড়ার সময় ওর সামনে এনে ধরতো আর বলত কাছে তো দাসী পাবি না, ফিল নে! আর আসওয়াদ যেত চটে! সালিম ওকে আরও বেশি চটাতো! দুজনে মিলে এসব নিয়ে যখন তখন কুস্তিতে মেতে উঠতো, আর আসওয়াদ সুযোগ বুঝে নিজের শেখা বিভিন্ন মার্শাল আর্ট প্রয়োগ করতো সালিমের ওপর, আর সালিম আসওয়াদের কেলানি খেয়ে চিৎপটাং হয়ে থাকতো!
.
চায়না তে বেশ কয়েক বছর কাটিয়ে, গ্রাজুয়েশন শেষ করে ওরা দুজনে চলে এলো জাপানে। একাডেমিক পড়াশোনা আসওয়াদের এখানেই শেষ। যত গুলো সাবজেক্ট পড়ার শখ ছিলো সব গুলই পড়া হয়েছে। আর না! এখন শুধু ঘোরাঘুরি।
জাপানে এসে জাপানি ভাষা শিখলো ওরা দুজন মিলে। প্রচন্ড রকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জাপান বিমোহিত করলো ওদের। কিন্তু শিরো মিদোরির ওপরে কোনো কিছুই নয়! জাপানে কিছু বছর কাটিয়ে প্রচুর ঘোরাঘুরি করে, এরপর এলো কোরিয়া তে। সেখানে তায়কোয়ানডোর ক্লাসে ভর্তি হলো দুজন। সালিম কিছু দিন ক্লাস করে হাল ছেড়ে দিলো। এতসব কষ্ট করা ওর দ্বারা আর হচ্ছে না। কিন্তু আসওয়াদ হাল ছাড়লো না৷ বেশ কিছু বছর সেখানে কাটিয়ে তায়কোয়ানডো টা ভালোভাবে রপ্ত করে, কোরিয়া থেকে বিদায় নিয়ে ওরা চায়না ফিরে গিয়ে ইয়টে থাকা ক্রু মেম্বার দের জন্য আরও দশ বছরের রেশন দিয়ে এবার রওনা দিলো দক্ষিণ এশিয়ার উদ্দ্যেশ্যে। সেখানে গিয়ে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ ঘুরে, সব গুলো দেশের ভাষা শিখে, প্রচুর ঘোরাঘুরি করে, সেখানের সংস্কৃতি গুলো রপ্ত করে এবার শেষ বারের মতো ফিরলো চায়না তে। তারপর রওনা দিলো নিজেদের ইয়ট টা যেখানে রাখা আছে সেখানে।
.
রাতের প্রায় একটা। অনেক ক্ষণ ধরে গাড়িতে এক ভাবে বসে থেকে থেকে কোমর লেগে গেছিলো সালিমের। তাই ড্রাইভার কে বলে গাড়ি টা থামালো ও। এরপর বাইরে বের হয়ে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করতে থাকলো। ওর দেখাদেখি আসওয়াদ ও নেমে এলো৷ ততক্ষণে সালিম গাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই চলে গেছে। হঠাৎ করেই সেই দূর থেকেই চিৎকার করে আসওয়াদ কে ডাক দিলো সালিম। আসওয়াদ তখন দুই হাত আকাশে তুলে আড়মোড়া ভাঙছিলো। সালিমের চিৎকারে সেদিকে এগিয়ে গেলো ও। তারপর সালিমের কাছে গিয়ে পৌছালে সালিম ওকে বলল,
— কিছু শুনতে পাচ্ছিস তুই?
আসওয়াদ কিছুক্ষণ কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলো, হ্যাঁ, থেকে থেকে একটা বাচ্চার তীক্ষ্ণ কান্নার চাপা আওয়াজ ভেসে আসছে কোথা থেকে যেন! ভ্রু জোড়া কুচকে গেলো আসওয়াদ সালিম দুজনেরই। তড়িঘড়ি করে দুজনে খুজতে লেগে গেলো এই ফাকা রাস্তার মধ্যে বাচ্চা কোথায় কাঁদছে! কিছুক্ষণ শব্দ কে অনুসরণ করে হাটার পর আসওয়াদের হঠাৎ চোখ পড়লো রাস্তার পাশে থাকা একটা বড়সড় ডাস্ট বিনে। আসওয়াদ উচ্চস্বরে ডাক দিলো সালিম কে। তারপর এগিয়ে গিয়ে ডাস্ট বিনের মুখ টা আলগা করলো।
সেই মুহুর্তে সালিম ও এসে পৌছালো সেখানে৷ আসওয়াদের দৃষ্টি অনুসরণ করে ডাস্টিবিনের মধ্যে তাকালো সে নিজেও৷ কালো রঙা পলিথিনে মোড়ানো একটা ফুটুফুটে নবজাতক। বাচ্চা টা এখন আর কাদছে না। চোখ বুজে শুয়ে আছে। গায়ে রক্ত মাখানো, নাভির সাথে এখনো লম্বা নাড়ি লেগে আছে। হয়তো কয়েক ঘন্টা আগেই কেউ ফেলে রেখে গেছে এখানে৷ ক্লান্তিতে গলা দিয়ে আর কান্না বের হচ্ছে না তার।
সালিম তড়িঘড়ি করে বাচ্চা টাকে উঠিয়ে নিলো হাতে৷ বাচ্চাটার শরীরে কিছু কিছু জায়গায় আঘাতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে৷ সালিম মুখ থেকে আফসোস সূচক শব্দ করলো। তারপর বলল,
— এটা কেমন অমানুষিক কাজ! একটা জলজ্যান্ত বাচ্চাকে এইখানে এইভাবে রেখে চলে গেলো! এদের কি কোনো মনুষ্যত্ব বোধ নেই!
আসওয়াদ বাচ্চাটির চোখ বোজা মুখের দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করলো,
— নো নেগেটিভিটি, অনলি পজিটিভিটি!
তারপর সালিম কে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
— এগুলো সব অবৈধ সম্পর্কের ফসল। মজা নেওয়া শেষে নিষ্পাপ বাচ্চা গুলোকে এইভাবেই এরা ডাস্ট বিনে ফেলে রাখে। এদের প্রোটেকশন ইউজ করতে কিসে সমস্যা হয় জানিনা! জাহান্নামে যাবে সবগুলো!
সালিম আর আসওয়াদ সেই গাড়িতে করেই অসুস্থ বাচ্চা টিকে নিয়ে পাশের একটি হাসপাতালে গেলো। আর এরপর বাচ্চাটির চিকিৎসার ব্যাবস্থা করে, রাত টা হাসপাতালে কাটিয়ে পরদিন সিকালে বাচ্চা টাকে সহ পোর্টে রওনা দিলো। এরপর নিজেদের ইয়টে করে আবার প্রশান্ত মহাসাগরের বুক বয়ে রওনা দিলো পঞ্চদ্বীপের উদ্দ্যেশ্যে।
.
দেমিয়ান প্রাসাদে বাদশাহ হুজায়ফা আদনানের কামরার পাশে থাকা বিশাল কামরাটির বিরাট ব্যালকনির লতাপাতার নকশা করা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে আসওয়াদ৷ বাষ্পাবিভূত চোখ জোড়া ওর শূন্যে।
ওরা প্রাসাদে ফিরেছে আজ দশ দিনের মতো। এসেই যে খবর টা সবার আগে আসওয়াদের কানে এসেছে সেটা হলো এলানরের মৃত্যু। আজ থেকে পয়ত্রিশ বছর আগেই এই ধরণীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। তার ভ্রমণের মাঝেই যে মায়ের মৃত্যু হবে এটা জেনেই সে ভ্রমণে গিয়েছিলো৷ পঞ্চদ্বীপে ফেরার সময় মানসিক ভাবে মা কে আর কখনো দেখতে না পাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই ও ফিরেছিলো। কিন্তু প্রাসাদে পা রাখার পরই এক অসাড়তা পেয়ে বসেছে ওকে৷ মাথার ভেতর শুধু একটা কথাই ঘুরছে, মা নেই, মা নেই!
মায়ের কামরা টার দিকে যেতেও সাহস হচ্ছে না। পুরোনো স্মৃতি গুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠে ওর রাতের ঘুম হারাম করে দিবে হয়তো! সেখানে হয়তো এখন নতুন কেউ নিজের আস্তানা গেড়ে নিয়েছে। তার মা তো ছিলো সামান্য এক দাসী। তার অনুপস্থিতিতে কারো হয়তো কিছু যাবে আসবে না! কিন্তু তার তো ওই মা টাই ছিলো সব!
আসওয়াদের ভাবনার মাঝেই সালিম এসে উপস্থিত হলো সেখানে। আসওয়াদ কে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে এসে পাশে দাড়ালো। তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো,
— জঙ্গল থেকে ঘুরে আসি চল, তোর ভালো লাগবে৷
— কোনো কিছু করতে মন সায় দিচ্ছে না ভাইজান!
জঙ্গলের দিকে চোখ রেখে বলল আসওয়াদ। কন্ঠ রোধ হয়ে আসতে শুরু করেছে ওর! সালিম কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আবার বলল,
— তাহলে দাদাজানের সাথে গল্প করবো, চল!
আসওয়াদ সালিমের কথা টা উপেক্ষা করে পালটা প্রশ্ন করলো,
— বাচ্চা মেয়েটা কেমন আছে এখন?
— ভালো আছে। ক্ষত গুলো প্রায় সেরে উঠেছে৷ ওর জন্য আমি একজন দুধ মা রেখেছি। সেই ওকে দুধ খাওয়াচ্ছে এখন৷ শরীর স্বাস্থ্য এখন একটু ভালোর দিকে গেছে তার। মেয়েটা কে দেখলেই কি যে মায়া মায়ে লাগে বলে বোঝাতে পারবো না তোকে!
— নাম রেখেছো?
— হ্যাঁ, ইনায়া। ওকে মুসলিম হিসেবেই বড় করবো।
আসওয়াদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। বাচ্চা টা ভালো আছে শুনে ভালো লাগছে এখন একটু। সালিম আবার বলল,
— হিসাব মতে আর পনেরো বিশ বছরের ভেতরেই একজন শেহজাদী আসতে চলেছেন। তার আগে পিছেও হতে পারে! হয়তো সে হবে আমাদের বোন, আর নয়তো আমাদের যে কারো সন্তান; তোমার, আমার নয়তো ইলহামের। ভাবতেই ভালো লাগছে! একজন শেহজাদী আসবে! কত আদরেরই না হবে সে সবার! মেয়ে বাচ্চা মানেই একটা অন্যরকম কিছু!
উচ্ছসিত হয়ে উঠলো সালিম। আসওয়াদ ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— মেয়েটা আল্লাহ তা’য়ালা তোমাকে দিন।
— আমিন, সুম্মা আমিন!
বলে উচ্চস্বরে হাসলো সালিম, আসওয়াদও তাল মেলালো ওর হাসিতে। এমন সময় ওদের পেছন থেকে ভেসে এলো একটি গম্ভীর কন্ঠস্বর,
— আসওয়াদ!
সালিম চমকে তাকালো পেছনে। আসওয়াদ না চমকালেও অবাক হলো। কারণ ওই গাম্ভীর্য পূর্ণ কন্ঠস্বর টির মালিক তার বাবা! জীবনে প্রথম বারের মতো তার বাবা তার কাছে এসে তার নাম ধরে ডেকেছে। এতে আসওয়াদের খুশি হওয়ার কথা থাকলেও কেন যেন ও খুশি হতে পারলো না। সালিমের উপস্থিতিতে যে বিষাদ ওর মন থেকে চলে গেছিলো বাবাকে দেখে সেটা আবার দ্বিগুণ হয়ে ভর করলো ওর শরীরে৷ মৃদু হাসি মাখা মুখ টা থেকে হাসি মিলিয়ে গেলো মুহুর্তেই।
সালিম তার চাচাজান কে দেখে সালাম বিনিময় করে পিতা পুত্র কে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। আর আরহাম এগিয়ে এসে দাড়ালেন ব্যালকনির রেলিঙের ধার ঘেঁষে তার দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা আসওয়াদের দিকে৷ এই প্রথম নিজের সন্তান কে ভালো করে দেখলেন তিনি!
আসওয়াদ কি করবে ভেবে পেলো না। বাবাকে আজ দেখে তার কেন জানি প্রচন্ড রাগ হচ্ছে! এই লোকটি তার জন্মের পর তার মুখ দেখার পর থেকে আর একটি বারের জন্যও তার কাছে আসেননি, তাকে জন্ম দেওয়ার অপরাধে তার মায়ের কাছেও আর আসেননি! মা বেচে থাকাকালীন যতবারই আসওয়াদ মায়ের কাছে গিয়েছে ততবারই মায়ের চোখে দেখেছে প্রিয় মানুষ টাকে না পাওয়ার হাহাকার, ঠিক তার মতো!
কিছুক্ষণ বাবার দিকে নির্বিকার চোখে তাকিয়ে ব্যালকনির মাঝ বরাবর থাকা নকশাদার সোফায় বাবাকে সসম্মানে বসতে বলল আসওয়াদ৷ আরহাম সেখানে গিয়ে বসলে আসওয়াদ নিজেও বসলো বাবার বিপরীতে। তারপর বাবার দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,
— জ্বি বলুন, কেন এসেছেন আপনি এখানে?
আরহাম কিছুক্ষণ চুপ থেকে ছেলেকে দেখলেন। লম্বা চওড়া, বলিষ্ট পুরুষালি দেহের একজন পূর্ণবয়স্ক যুবক। ধারালো, শক্ত চোয়াল দ্বয় তার ইস্পাত-দৃঢ় ব্যাক্তিত্বের জানান দিচ্ছে প্রকট ভাবে। উজ্জ্বল শাণিত চোখ জোড়া তার দৃঢ়চেতা মানসিকতার চিহ্ন হয়ে যে কোনো মানুষের সম্পুর্ন মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম। মাথার ঝাকড়া, কিঞ্চিৎ কোকড়া চুল গুলো ঘাড় বাবরি। মুখে খোচাখোচা দাড়ির আভাস। নিঃসন্দেহে একজন সুন্দরী রমনীর হৃদয় এক মুহুর্তে হরণ করতে এই চেহারাটা, এই অ্যাপিয়ারেন্স টা যথেষ্ট।
আরহাম মুখ খুললেন, ধীর গলায় বললেন,
— আমি জানি তুমি তোমার মা কে অনেক ভালোবাসতে। সময়ের কাছে হেরে গিয়ে সে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। আল্লাহ তাকে জান্নাত নসিব করুন। এলানরের মৃত্যুতে তুমি মানসিক ভাবে অনেক আঘাত পেয়েছো, জানি! এটা নিয়ে আর মন খারাপ করো না। নিজেকে কাজে ব্যাস্ত রাখো, তাহলে আর মা কে মনে পড়বে না।
— জ্বি।
ব্যাস এতটুকুই। এতুটুকু বলেই আসওয়াদ চুপ করে রইলো। তার সামনে বসা ব্যাক্তিটি তার জন্মদাতা পিতা। কিন্তু এই মুহুর্তে এই লোকটিকে তার একদমই পছন্দ হচ্ছে না! বিরক্তিতে ছেয়ে যাচ্ছে বুক। নিজের অজান্তেই ভ্রু জোড়া কুচকে উঠলো আসওয়াদের৷ আরহাম সেটা খেয়াল করে মৃদু হেসে বললেন,
— আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ করো না। পছন্দ না করারই কথা! বাবা হিসেবে আমার যে দায়িত্ব ছিলো তোমার প্রতি তা আমি পালন করিনি, বা করতে ব্যর্থ হয়েছি!
কথা বলার এই পর্যায়ে উঠে দাড়ালেন আরহাম, তাকে সম্মান জানিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে আসওয়াদ ও উঠে দাড়ালো। আরহাম তখন আবার বললেন,
— তবে এইটা ভেবো না যে আমি তোমাকে পুরোপুরি অবহেলা করেছি! তুমি কবে কোথায় কি করেছো না করেছো সবই আমার জানা! হয়তো সরাসরি আমি তোমার খেয়াল রাখতে পারিনি। কিন্তু তোমার আড়ালে আমি ঠিকই রেখেছি। এতে অনেক উপকার হয়েছে তোমার! তুমি যে শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছো তাতে তোমাকে প্রচুর শক্ত থাকতে হতো, যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হতে হতো, যা তুমি হয়ে গেছো! এখন আমার আর কোনো চিন্তা নেই।
শেষোক্ত কথা টা বলে আসওয়াদের দিকে এক টুকরো মৃদু হাসি নিক্ষেপ করে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন আরহাম। আর আসওয়াদ বাবার যাওয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে আবার চোখ রাখলো শিরো মিদোরির জঙ্গলের ওপর।
.
উপযুক্ত বয়স হওয়া সত্বেও আসওয়াদ প্রাসাদের দাসী দের কে নিজের সেবায় নিযুক্ত করার প্রস্তাব টা প্রত্যাখ্যান করেছিলো। তাই এখন হুজায়ফা আদনান খুজে খুজে সবচেয়ে সুন্দরী, অল্পবয়স্কা দাসী গুলোকে নিজের নাতির সেবায় নিযুক্ত করলেন। কিন্তু এখানেই বাধলো বিপত্তি……
চলবে…….
( ভুল ভ্রান্তি থাকতে পারে অনেক, একটু মানিয়ে নিয়ে পড়বেন সবাই 💙)