বাদশাহ_নামা #পর্বসংখ্যা_৪৯ #রানী_আমিনা

0
78

#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_৪৯
#রানী_আমিনা

৭১. রাতের এখন তৃতীয় প্রহর। ঘুমিয়ে পড়েছে প্রায় সকলে, প্রাসাদের কিছু কিছু কামরায় এখনো টিমটিম করে বাতি জ্বলছে।

রাতের নিস্তব্ধতা কে ভেঙে দ্রুত পায়ে দাসী দের প্রধান নিয়ন্ত্রক হুমায়রা তাইরের কক্ষের দিকে ছুটছে আফিয়া। চোখে মুখে তার উদভ্রান্ত ভাব, মাঝে মাঝে কোনো অজানা কারণে তার মুখে হাসির রেশ দেখা যাচ্ছে৷ শেহজাদী প্রাসাদে ফিরে আসায় তার আনন্দে একটু ভাটা পড়েছিলো, কিন্তু আজ দুদিন হলো তিনি নেই, কোথায় চলে গেছেন কেউ জানে না। তাই মেজাজ টা আজ ওর বেশ ফুরফুরা।
যতক্ষন পর্যন্ত ওই হোয়াইট উইচ টা প্রাসাদে থাকে ততক্ষন পর্যন্ত ওদের সবার দম আটকে আসে যেন, নিজেদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে ওরা। এখন সে নেই, এখন নিঃশ্বাস নিয়েও যেন শান্তি।

হুমায়রা তাইরের কক্ষের দরজায় দুবার মৃদু করাঘাত করলো আফিয়া। ভেতর থেকে প্রশ্ন এলো,

— কে?

— তাইর চাচি, আমি আফিয়া বলছি।

আফিয়ার গলা শুনে কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে বের হয়ে এলেন হুমায়রা। বের হয়েই কন্ঠে সামান্য বিরক্তি মিশিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

— এত রাতে এসে ডাকছো কেন? কি হয়েছে?

— হিজ ম্যাজেস্টি ফিরেছেন, সেই মেয়েটিকে নিয়ে!

আফিয়ার চোখে খুশির ঝিলিক। আফিয়ার কথা শুনে এবার দরজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা হুমায়রা বেরিয়ে এলেন সম্পুর্ন, তারপর অবিশ্বাস্য গলায় বললেন,

— হিজ ম্যাজেস্টি ফিরে এসেছেন? তুমি মেয়েটিকে দেখেছো? কেমন দেখতে? সুন্দরী?

— শেহজাদীর মতো সুন্দরী না হলেও আমাদের এখানের গতানুগতিক দাসী গুলোর থেকে সে অনেকটাই এগিয়ে আছে চাচি! মেয়েটার মাথায় লাল রঙের চুল, শেহজাদীর চুলের মতো অতোটা লম্বা চুল না হলেও বেশ অনেক খানিই লম্বা৷ চোখ জোড়া নীল। আর যে দারুন করে সে হাসছে, আমিই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি! হাসলে আবার তার গালে টোলও পড়ে!

— এবার যদি শেহজাদীর দেমাগটা একটু কমে! স্বামী নিয়ে তার যে আহ্লাদ ছিলো এখন তো আর তার কিছুই থাকবে না!
তার জন্য প্রাসাদের কোনো দাসী কখনোই সুযোগ পায়নি হিজ ম্যাজেস্টির নিকটে যাওয়ার। আমাকেই দেখো না! আজ যদি সে না থাকতো তবে আমি নিশ্চিতভাবে হিজ ম্যাজেস্টির সন্তানের মা হতাম! জীবন আমার কাটতো রানীর হালে, আমিও ঘুমোতাম শেহজাদীর কামরার বিছানার ন্যায় মোলায়েম বিছানায়। হিজ ম্যাজেস্টির সোহাগ পেতাম যতদিন আমার যৌবন থাকতো! কিন্তু সেসবের কিছুই হয়নি!

— আপনি আর এসব নিয়ে মন খারাপ করবেন না চাচি, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এগুলো মনে রেখে কি লাভ বলুন! এখন আপনি চলুন, মেয়েটিকে তার কামরা দেখিয়ে দিতে বলেছেন হিজ ম্যাজেস্টি।
কিন্তু তিনি এসেই শেহজাদীর খোজ করেছেন। আমি বলে দিয়েছি আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানিনা, ইয়াসমিন জানতে পারে।
এখন উনি ওনার কামরার দিকে যাচ্ছেন, নিশ্চয় শেহজাদীকেও খুজবেন, আর যখন পাবেন না তখন নিশ্চিতভাবে প্রাসাদ মাথায় তুলবেন, সাথে ইয়াসমিনকে ভালো মতো ধুয়ে দিবেন, কারণ বহির্বিশ্বে যাওয়ার সময় শেহজাদীর দায়িত্ব তিনি ইয়াসমিন কে দিয়ে গেছিলেন৷ শেহিজাদী ফিরে আসায় ওর খুব বাড় বেড়েছিলো।এবার ওর ডানা কেটে পড়বে। আমার যা খুশি লাগছে না চাচি, কি বলবো তোমাকে!

হুমায়রা তাইর আফিয়ার কথায় কিঞ্চিৎ সায় জানিয়ে মৃদ্য হেসে কামরার ভেতরে ঢুকলেন তৈরি হওয়ার জন্য। আফিয়াও ঢুকলো তার পেছন পেছন৷ হ্যমায়রা আলমিরা থেকে পোশাক বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,

— হিজ ম্যাজেস্টির মন কেমন বুঝলে, মেয়েটাকে তিনি কিভাবে গ্রহণ করেছেন, টের পেয়েছো কিছু?

— জানেনই তো উনি কেমন, মনের ভাব মুখে প্রকাশ করেন না। তাই বুঝতে পারিনি কিছু। তবে মেয়েটার বুদ্ধি আছে যা বুঝলাম, সে যতক্ষন হিজ ম্যাজেস্টির কাছাকাছি ছিলো ততক্ষণ ওনার দিকেই অপলকে তাকিয়ে ছিলো৷ হিজ ম্যাজেস্টি খেয়াল করেছেন কিনা আমি জানিনা।

— হিজ ম্যাজেস্টির দিকে অপলকে তাকায়নি কে বলোতো! তুমিই বলো ওনাকে প্রথম দেখে তুমি থমকে ছিলে কিনা!

হ্যমায়রার কথায় মৃদু শব্দ করে হাসলো আফিয়া, তারপর বলে উঠলো,

— আমি প্রথমবার ওনাকে দেখে সত্যিই থমকে গেছিলাম! প্রথম প্রথম প্রাসাদে এসেছিলাম তখন৷ শেহজাদীর কামরায় খাবার দিতে গেছিলাম আমি সেদিন, হিজ ম্যাজেস্টি সেখানেই ছিলেন! শুধু একটা ট্রাউজার ছাড়া ওনার পরণে আর কিছুই ছিলো না। শেহজাদী তখন কামরায় ছিলেন না, আর আমি ওনার দিকে বলদের মতো তাকিয়ে ছিলাম! সেদিন উনি আমাকে এক ধমকে কামরা থেকে বের করে দিয়েছিলেন!

শেষোক্ত কথাটা মুখ নামিয়ে বলল আফিয়া। হুমায়রা পোশাক পরতে পরতে হাসলো ওর কথায়। আফিয়া আবার বলে উঠলো,
— তবে মেয়েটা যদি হাত ধুয়ে লেগে পড়ে তবে হিজ ম্যাজেস্টির মন জয় করে নিতে পারবে আমার ধারণা। আর তাছাড়া ওনাদের তো বিয়ে হবে! বিয়ে হলে না চাইতেও একটা মায়া এসে যায় দম্পতি দের ভেতরে, সুতরাং হিজ ম্যাজেস্টিরও আসবে! আর যদি সে হিজ ম্যাজেস্টির সন্তানের মা হতে পারে তবে তো কথাই নেই! নিজের সন্তানের মা কেই তো তিনি বেশি আগলে নিবেন তাই না?

— কিছুই বলা যায়না আফিয়া! ওই সাদা রঙের ডাইনিটার ক্ষমতা কত তুমি জানো না! এখন যদি সে এসব মান অভিমান ভুলে একবার হিজ ম্যাজেস্টির কাছে আসেন, আর ওনার ওই অদ্ভুত চোখ দিয়ে তাকান, তবে হিজ ম্যাজেস্টি এমনিতেই গলে যাবেন। বাকি সব তো পড়েই রইলো ওদিকে। আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় ডাইনিটা নিজের সাথে সারাক্ষণ ব্লাক ম্যাজিক নিয়ে ঘোরে কিনা!

হ্যমায়রার কথায় হাসলো আফিয়া, তারপর নিজেদের ভেতর আরও কিছুক্ষণ শেহজাদী কে নিয়ে সমালোচনা করে বের হলো নতুন মেয়েটির কাছে যাওয়ার উদ্দ্যেশ্যে।

৭২. সূর্যের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এই মুহুর্তে মীরের কামরার সামনের বিশাল বারান্দাটায় মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তিনটা প্রাণী। ইয়াসমিন, কোকো আর ফ্যালকন। তাদের সামনে চোখে মুখে ভয়ানক ক্রোধ নিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে দাঁড়িয়ে আছে মীর৷ চোখ জোড়া দিয়ে যেন আগুন ঝরছে ওর! ওর শক্ত হয়ে যাওয়া চোয়ালদ্বয় দেখে ভয়ে বুকের ভেতর হাতুড়িপেটা শুরু হয়েছে সকলের।

— তোদেরকে বিশ্বাস করে তোদের ওপর আমি আমার শিনজোর দায়িত্ব দিয়ে গেছিলাম! অথচ আজ দুদিন ধরে আমার শিনু নিখোঁজ! রেড জোনের ভেতরে আহত অবস্থায়, খেয়ে না খেয়ে মেয়েটা পালিয়ে বেড়াচ্ছে, আর তোরা এখানে হাত গুটিয়ে বসে আছিস!

দাঁতে দাঁত পিষে হিসহিসিয়ে কথা গুলো বলল মীর৷
অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে রাখা কোকো কোনোমতে সাহস সঞ্চয় করে মৃদু স্বরে বলতে নিলো,

— ইয়োর ম্যাজেস্টি, আম্মা হঠাৎ করেই ছাদ…..

কিন্তু কথাটা শেষ করতে পারলো না ও, তার আগেই মীরের বজ্রকন্ঠে কেঁপে উঠলো ও,

— স্টপ দ্যিজ ননসেন্স! ও ছাদ থেকে লাফ দিলো আর তোরা কি করছিলি? বসে বসে তামাসা দেখছিলি? ওর কাছেই তো বসে ছিলি! তবে ও কিভাবে পালালো! কিভাবে?

মীরের ক্রোধের চিৎকারে কেঁপে উঠলো যেন পুরো প্রাসাদ টা! কোকো মাথা নিচু রেখে ঢোক গিললো একটা। চোখ জোড়া ওর লোনাপানিতে ভর্তি হয়ে আসছে! ওর পাশে দাঁড়ানো ফ্যালকন পুরোপুরি নিস্তব্ধ। একটা শব্দও মুখ থেকে বের করছে না ও। চুপচাপ তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। ওদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ানো ইয়াসমিন থেকে থেকে ফোপাচ্ছে, নিঃশব্দে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে ওর শরীর টা৷

মীর ওদের দিকে আর এক বার শকুনি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বড় বড় পা ফেলে গটগটিয়ে চলে গেলো নিজের কামরায়৷ তারপর বাইরের পোশাক ছেড়ে একটা পাতলা ঢিলাঢালা রোব আর একটা ট্রাউজার পরে নিলো, আর এরপর বেরিয়ে এলো বাইরে৷ এসেই গটগটিয়ে যেতে নিলো প্রাসাদের বাইরে যাওয়ার পথের দিকে৷
কোকো ফ্যালকন বুঝলো মীর ঠিক কোথায় যেতে চলেছে। ওরা দুজনও মীরের পেছন পেছন হাটা শুরু করলো নিঃশব্দে।

.

রেড জোনের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দ্রুত পায়ে হেটে সামনে এগিয়ে চলেছে মীর। ওর স্বর্ণালী আভা ছড়ানো চোখ জোড়া দিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকে নজর বুলিয়ে এগোচ্ছে ও৷
ওর পেছনে, কিছুটা দুরত্ব নিয়ে এগোচ্ছে কোকো আর ফ্যালকন।
গত দুন দিন ধরে ওরা সকলে মিলে সমস্ত রেড জোন চষে বেড়িয়েছে, তারপরও অ্যানাকে খুজে পায়নি! সে যেন বাতাসের সাথে মিশে হারিয়ে গিয়েছে!

মাঝ রাতের পর মীর প্রাসাদে এসে ইয়াসমিন কে দেখা মাত্রই অ্যানার খোজ করলে ইয়াসমিনের দেওয়া উত্তর শুনে প্রচন্ড রেগে যায় ও। তারপর থেকে ওর ক্রোধ যেন আর থামছেই না! ভয়ানক রাগ হচ্ছে ওর ইয়াসমিন আর কোকো ফ্যালকনদের ওপর।
এতবার করে সবাইকে সাবধান করে দিয়ে গেলো ও, যেন অ্যানাকে ওরা দেখে রাখে, পূঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ওর খেয়াল রাখে। একটুও যেন এদিক ওদিক না হয়। কিন্তু এরা কি করলো!
সমস্ত রাতটা মেয়েটাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দিলো, তাকে কেউ নিচে নামিয়ে আনতে পারলো না! আর এরপর কিনা এত গুলো মানুষের চোখের সামনে দিয়েই সে পালিয়ে গেলো! আর এরা কিছুই করলো না, ওর পালিয়ে যাওয়া টা চেয়ে চেয়ে দেখলো শুধু! রাগে মীরের শরীরের ভেতর রিরি করছে!

দ্রুত পায়ে এদিক ওদিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাটিতে হাটতে হঠাৎ করেই পেছন থেকে কোকোর ডাকে থেমে গেলো মীর৷ প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে পেছন ফিরে তাকালো ও। কোকো ফ্যালকন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে৷ ওকে ফিরে তাকাতে দেখে কোকো বলে উঠলো,

— ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপনাকে না জানিয়ে আমরা একটা কাজ করে ফেলেছি!

মীর এবার সোজা হয়ে ফিরলো ওদের দিকে, তারপর এক ভ্রু উচু করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কোকোর দিকে। কোকো এক পলক মাথা উচিয়ে মীরের চেহারা টা দেখে নিয়ে সাথে সাথে চোখ নামালো আবার, তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,

— আপনার আর আম্মার সন্তানের কথা আমরা আম্মা কে বলে দিয়েছি! আম্মাকে কোনোভাবেই মানানো যাচ্ছিলো না, তাই জন্য!

কোকোর কথা কানে আসা মাত্রই থমকে গেলো মীর। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলো যেন ওর!
এবার কি হবে! শিনু, ওর শিনজো এটা কিভাবে মেনে নেবে! ও তো ট্রমাটা থেকে কোনো রকমে বেরিয়ে আসতে পেরেছে ! কিন্তু ওর শিনু কিভাবে মেনে নেবে এটা! এরা এটা কিভাবে করতে পারলো! শিনু কে ওদের মৃত সন্তানের কথাটা ওরা কিভাবে বলে দিতে পারলো! এত এত বার নিষেধ করা সত্বেও, কিভাবে……!

ওর শিনজো কি ভাববে এবার! শিনু তো ভাববে ওর অনুভূতির কোনো তোয়াক্কা না করেই মীর নিজের সন্তান তৃষ্ণা মেটানোর জন্য এগুলো করছে! শিনুকে ও এবার কিভাবে বোঝাবে যে ও চেষ্টার বিন্দুমাত্র কমতি রাখেনি! কোনো আর্টিফিশিয়াল পদ্ধতি ব্যাব৬করতে ও বাদ রাখেনি! কিন্তু কোনো কিছুই ওদের কোনো কাজে আসেনি! কিভাবে বোঝাবে ও!
ও তো নিজের ঔরসজাত সন্তান টা পেয়েই ওর শিনু কে বাচ্চাটা বুঝিয়ে দিতো! শিনু কে তার মা করে ও হতো বাবা! কিন্তু এখন কি হবে! এত বড় একটা সত্য ওর শিনুর থেকে লুকানোর পর ও ওর শিনুর সামনে গিয়ে কিভাবে দাঁড়াবে?

মীর হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো কোকোর দিকে। তারপর অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো,

— তুই এটা কিভাবে করতে পারলি কোকো! ওই ঘটনা যারাই জানতো তাদের সবাইকে আমি আদেশ করেছিলাম যেন এই কথা ঘূর্ণাক্ষরেও আমার শিনুর কানে না যায়! আর তুই কিনা……

কোকো অপরাধবোধে মাথা নিচু করে যেন কুকড়ে গেলো আরও। কোনো রকমে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো,

— ক্ষমা করবেন ইয়োর ম্যাজেস্টি! আমি ভেবেছিলাম আম্মা হয়তো আপনার আর তার সন্তানের জন্য করা আপনার স্ট্রাগলের কথা শুনলে মন নরম করবেন!

— সেটা হলে তো আমি নিজেই ওকে বলতাম! ওর কিসে রাগ হয়, কিসে অভিমান হয়, ও কিসে কষ্ট পায়, কিসে খু্শি হয়, কিসে ওর মন খারাপ হয়, কিসে ও খিলখিলিয়ে হাসে এসব আমি জানি, শুধুমাত্র আমি! আর অন্য কেউ না! ওর মনটা খোলা বই এর মতো পড়তে পারি আমি! ওর চেহারা দেখলে আমি বলে দিতে পারি ও কি ভাবছে, ওর কি খেতে মন চাইছে, ওর কি করতে মন চাইছে! সেই আমি যখন বললাম ওকে তোরা এই কথাটা জানাবি না, তোরা সেটা শুনতে পারলি না! তোরা ওকে বলেই দিলি!
তুই কি জানিস ও বাচ্চা কতটা ভালোবাসে? তোদের কোনো ধারণা আছে ওর নিজের একটা সন্তানের জন্য চব্বিশটা ঘন্টার ভেতরে কতটা হা-হুতাশ করে! তোদেরকে ও কেন পেলেছে? কিসের জন্য? এমনিতেই? তোদেরকে নিজের সন্তান মনে করে বুকে টেনে নিয়েছে ও কেন! ওর একটা বাচ্চার কতটা শখ সে সম্পর্কে তোদের কোনো ধারণা আছে?
তোদেরকে ও চিনতোনা জানতোনা, তবুও মাটি থেকে কুড়িয়ে ও কেন নিজের কাছে রেখেছে? নিজের সন্তানের অভাব পূরণ করতে! কি ভাববে ও এখন! ও ভাববে আমি ওর জন্য ভাবিনা! আমি শুধু নিজের টা ভাবি! ওকে এখন আমি এসব কিভাবে বোঝাবো! কিভাবে ফেরাবো ওকে নিজের কাছে?

শেষোক্ত প্রশ্নগুলো মীর উচ্চস্বরে ছুড়ে দিলো কোকো ফ্যালকনের দিকে। আর এরপর ওদের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ধীরে ধীরে ও হাটু গেড়ে বসে পড়লো মাটিতে! চোখ মুখ দিশেহারা হয়ে উঠলো ওর! উদভ্রান্তের ন্যায় অসহায় চোখে চারদিকে তাকাতে লাগলো ও। চোখ জোড়া জ্বালা করছ ওর, বুকের ভেতর টা পুড়ছে তুষের আগুনের মতো!

ফ্যালকন চেয়ে দেখলো একবার মাটিতে বসে পড়া মীর কে। শক্তপোক্ত, কঠোর মানুষ টা সর্বহারা মুসাফিরের ন্যায় অসহায় মুখে বসে আছে মাটিতে!
এসব কি হচ্ছে ওদের সবার জীবনে! কিছুদিন আগেও তো ওরা কত ভালো ছিলো! কত হাসিখুশিই না ছিলো ওরা সকলে! ওদের জীবন গুলো হঠাৎ করেই এত জটিল হয়ে গেলো কেন! কান্না পেলো ওর ভিষণ! ভ্রু জোড়া কুচকে ঠোঁট চেপে কান্নাটাকে আটকানোর চেষ্টা করলো ও, কিন্তু পারলো না। না চাইতেও শব্দ করে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো!

ফ্যালকন কে কাঁদতে দেখে কেঁদে ফেললো কোকো নিজেও! ঠোঁট উলটে ফুপিয়ে উঠে ফ্যালকন কে বুকে টেনে নিলো ও। কোকোর বুকে ঠাই পেয়ে ফ্যালকনের কান্নার বেগ আরও বাড়লো! আর্তনাদের সুরে ও বলে উঠলো,

— তোকে আম্মা ডাকতে শেহজাদী নিষেধ করে গেছে কোকো! তুই আর আম্মা ডাকিস না তাকে! নইলে শেহজাদী রাগ করে আর ফিরবেন না!
শেহজাদী কিভাবে বলতে পারলো এমন কথা! কিভাবে বলতে পারলো তোদের শেহজাদী মরে গেছে! আমার শেহজাদী আমদের ফেলে কোথায় চলে গেলো রে কোকো!

কোকো ঢোক গিকে ফ্যালকনের পিঠে মৃদু চাপড় দিতে দিতে বলে উঠলো,

— কাঁদিস না আর, আম্মা ফিরে আসবেন! তার সন্তান দেরকে এভাবে মাতৃহারা করে আম্মা কখনোই দূরে থাকবেন না! আমাদের আম্মা এতটা কঠিন মনের নন! আর কাঁদিস না তুই!

মীর ওর সামনে ক্রন্দনরত বাচ্চা দুটোর দিকে তাকালো একবার। তারপর মুখ দিয়ে জোরে সোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে নিজের মনে বলে উঠলো,

— ইয়া রব! ধৈর্য দিন আমাকে! এত চাপ আমি আর নিতে পারছিনা! আপনি ঠিক করে দিন সবকিছু! আমার শিনু কে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন আবার! আমাকে ওর অভিমান ভাঙানোর মতো ক্ষমতা দিন! ক্ষমা করুন আমাকে!

আরও কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে সৃষ্টিকর্তার সাথে নিজের মনের কথাগুলো বলে নিয়ে উঠে দাড়ালো মীর। তারপর সামনে দাঁড়ানো কোকোর দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে প্রশ্ন ক্রলো,

— আমাদের সন্তানের কবরের লোকেশন দিয়েছিলি আমার শিনু কে?

— জ্বি দিয়েছিলাম, ইয়োর ম্যাজেস্টি!

কোকোর উত্তর শুনে মীর আবার পা বাড়ালো জঙ্গলের ভেতরের দিকে। কোকো আর ফ্যালকন সেখানেই দাড়িয়ে রইলো।

৭৩. শিরো মিদোরির পশ্চিম কোণায় থাকা অর্কিডে পরিপূর্ণ গাছপালার মাঝের একটি ছোট্ট, সুন্দর, ঝকঝকা কবরের পাশে বসে আছে অ্যানা৷

মাঝে মাঝে কবরটির ওপর নিজের হাত বুলিয়ে নিয়ে চলেছে ও। কবরটার চারপাশে ফুটে আছে রঙ বেরঙের জংলি ফুল, কিন্তু এগুলো রেড জোনের জঙ্গলের নয়, প্রাসাদের। মীর লাগিয়ে রেখেছিলো হয়তো!

কবরের ওপরের মাটিটা খুব সুন্দর মসৃণ করে রাখা, দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেউ প্রায়শই কবরটিকে খুব যত্ন সহকারে পরিষ্কার করে দিয়ে যায়! অ্যানা এসে কবরটির ওপর এক গুচ্ছ শুকনো পাতা পড়ে থাকতে দেখেছিলো, এতক্ষণ বসে বসে সেগুলো হাতে করে পরিষ্কার করেছে ও।
এতক্ষণ ও বসে বসে হাটুতে মাথা রেখে কবরটার ওপর হাত বুলিয়ে চলছিলো। কিন্তু এবার কবরের পাশেই নরম ঘাসের ওপর শুয়ে পড়লো ও৷ তারপর একটা হাত বাড়িয়ে কবরটির ওপর রাখলো।

এই বাচ্চাটা ওর, ওদের! ওর আর মীরের ভালোবাসার ফসল! কিন্তু কোথায় সবাই? কোথাও কেউ নেই আর! চারদিকটা ফাকা, নিস্তব্ধ! কারো আওয়াজ নেই কোথাও! যেন পৃথিবী মূক হয়ে গেছে! নাকি অ্যানা বধির হয়ে গেলো!
এই যে সমস্ত জঙ্গল জুড়ে পাখিরা কলতান করছে, অদ্ভুত অদ্ভুত ছোট্ট ছোট্ট জীব গুলো মাটিতে শব্দ করে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে, কখনো কখনো অ্যানাকে ছুয়ে দিয়ে যাচ্ছে, গাছের শুকনো পাতা গুলোতে বাতাসের স্পর্শে শন শন শব্দ বয়ে যাচ্ছে, এ সবকিছুই তো ও শুনছে, কিন্তু তবুও এত নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে কেন?
বধির তো ও হয়নি, হয়েছে ওর মনটা! সে এখন আর কিছুই শুনতে চায় না! কোনো শব্দই আর ওর মনের তলানিতে পৌছচ্ছে না!

চোখ জোড়া বন্ধ করলো অ্যানা। একটা বাচ্চার কত শখ ছিলো ওর! মীরের সাথে কাটানো প্রথম ঘনিষ্ঠ রাতে সে মীরের কানে ফিসফিসিয়ে বলেছিলো ওর বাবু চাই, অনেক গুলো! মীর ওর চোয়ালে নাক ঘষে দিয়ে বলেছিলো রোজ আল্লাহর কাছে চাইবে ওর বউ কে যেন এক গাদা বাচ্চা দেয়! যাদের কে সামলাতে সামলাতে ওর বউ আর দম ফেলানোর সময় পাবে না! কিন্তু পরক্ষণেই মত পালটে বলেছিলো অতগুলো বাচ্চার কোনো দরকার নেই, বেশি বাচ্চা হলে মীরকে দেওয়া অ্যানার সময়, আদর সোহাগের ভাগাভাগি হয়ে যাবে! এটা ও মানতে পারবে না!

অতীত স্মৃতিচারণ করতে করতে মৃদু হাসলো অ্যানা। ওর মীর তো আর ওর নেই! অন্য কারো হয়ে গেছে! ওর চেনা মীরের সাথে এই মীরের তো কোনো মিল নেই! ওর চেনা মীর তো ওকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না! এই মীর তো সেই মীর নয় যে কিনা হুটহাট সাম্রাজ্যের কাজে ফাকি দিয়ে চলে আসতো ওর কাছে, আদর নিতে; যে কিনা প্রতিটা মুহুর্ত ওর চিন্তায় মগ্ন থাকতো; যে ছিলো জেলাসিতে ভরপুর! যে ওকে প্রাসাদের দাসীদের সামনেও ঢিলাঢালা পোশাক পরতে বাধ্য করতো যেন ওর শিনুর মোহনীয় শরীরটার দিকে তাকিয়ে ওরা ওর শরীর নিয়ে আলোচনায় না বসে প্রতিনিয়ত! এই মীর তো সেই মীর নয় যে অ্যানা সামান্য কাশলেও সমস্ত রাত জেগে থাকতো তার শিনুর কোনো কষ্ট হচ্ছে কিনা দেখতে! এ মীর তো অন্য মীর! এ মীর তো ওর মীর নয়!

চোখ জোড়া বন্ধ করে এসবই ভেবে চলেছিলো অ্যানা, ঠিক তখনি ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিলো ওর চিরচেনা মানুষটির উপস্থিতি! সে আসছে!

চলবে…….

( আমার শরীর টা ভালো নেই, ঠান্ডা গরমের কারণে খুব বিপদে আছি, তাই বড় পর্ব দিতে পারিনি। পর্ব টা হয়তো এলোমেলো হয়েছে কিছুটা, আপনারা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন 💙)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here