হৃদয়ে_রক্তক্ষরণ #পর্বঃ৬ #লেখিকাঃমেহের_আফরোজ

0
88

#হৃদয়ে_রক্তক্ষরণ
#পর্বঃ৬
#লেখিকাঃমেহের_আফরোজ

[কঠোর থেকে কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য।]

“সেটা দেখে নিধি আরও জোরে চি**ৎকার দিয়ে বললো,
‘আ আ আমার মোবাইলের ১৪টা বেজে গেলো গো…”

“নিধির চি**ৎকার শুনে তোহা সেদিকে তাকিয়ে
দেখলো,নিধি নদীর পার থেকে একটু ঢালে পড়ে গেছে।নিধি কে এই অবস্থায় দেখে তোহা দৌঁড়ে সেখানে গেলো।কিন্তুু তোহা পৌঁছানোর আগেই, সেখানে পৌঁছে গেলো নির্জন।”

“নিধি যখন পানিতে ডুবে যাওয়া মোবাইলটি তুলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছে, তখনই ওর কর্ণকুহরে ভেসে এলো এক গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠস্বর।”

“নিধি কন্ঠস্বরটি অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখলো, স্বয়ং নির্জন নিধির দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।নিধি এই জায়গায় নির্জন কে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গেলো।হা করে তাকিয়ে বললো,’আপনি এখানে এলেন কিভাবে?”

“নির্জন চশমা টি খুলে একবার আশেপাশে তাকালো।তারপর হ্যান্ড ওয়াচটি দেখলো।দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চললো।ঘড়ির কাটায় বেলা ৪টা ছুঁইছুঁই।আশেপাশে অনেক লোকজনের আনাগোনা চলছে।অনেকেই নিধি এবং নির্জনের দিকে তাকিয়ে আছে এবং নিজেদের মধ্যে কথপোকথন করছে।তোহা নির্জনের পেছনে দাঁড়িয়ে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।নির্জন কে এখানে দেখে তোহাও বেশ চমকে গেছে।”

“নির্জন নিধির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গম্ভীর কন্ঠে বললো,’এভাবে নদীর ঢালে বসে শুটিং করবেন?নাকি আমার হাত ধরে উঠবেন?”

“নিধি ভাবলো,’এই ওভার স্মার্ট ব্যাটার হাত ধরে আমি কখনোই উঠবো না।কিন্তুু এই লোক কিভাবে এখানে এলো?দিগন্ত ভাইয়ার সাথে আসে নি তো?উফফ,এই নাদিয়ার চুলগুলো কে**টে যদি শাক ভাজি করে খেতে পারতাম, তাহলে খুব শান্তি পেতাম।আর আমি এই লোকের হাত ধরে কখনোই উঠবো না।বাই দ্য ওয়ে আমায় ধাক্কা দিলো কে?”

“নিধির ভাবনার মাঝেই নির্জন গমগমে কন্ঠে আবার বলে উঠলো,’উঠবেন নাকি টেনে তুলবো?”

“নিধি পিটপিট করে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করে বললো,’নিজেকে কি নায়ক ভেবেছেন,যে আপনি হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসে হাত বাড়িয়ে দিবেন,আর আমি আপনার হাত ধরে উঠবো?হুহ..আমার হাত-পা সম্পূর্ণ ঠিক আছে।আমি নিজেই উঠতে পারবো।আপনার হেল্প লাগবে না,সরুন।’বলে নিধি উঠতে চাইলো।কিন্তুু দেখলো, কোমরে আর পায়ে ব্যথা পাওয়ার কারণে শরীর সাপোর্ট করছে না।নিধি তাকিয়ে দেখলো, তোহা নির্জনের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।”

“নিধি কটমটিয়ে বললো,’আমি এখানে পড়ে আছি আর তুই কি ওখানে দাঁড়িয়ে নাটক দেখছিস?আমাকে ধরে ওঠা।”

“তোহা এখানে নির্জন কে দেখে মনে হয় ঘোরে চলে গিয়েছিলো।নিধির রুক্ষ স্বরে কথাগুলো শুনতেই, তোহা ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো।তড়িৎ গতিতে নির্জনের পাশ কাটিয়ে গিয়ে নিধির হাত ধরে টেনে তুলতে সাহায্য করলো।”

“নিধি চোখ-মুখ কুঁচকে নির্জনের দিকে তাকিয়ে বললো,’হেল্প করতে আসার জন্য থ্যাংক’স।কিন্তুু এরপর আর ভুলেও আমাকে হেল্প করতে আসবেন না।আমার হেল্প করার জন্য মানুষের অভাব নেই।”

“নিধির মুখে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনে নির্জনের পুরুষালি বলিষ্ঠ শরীর রাগে শক্ত হয়ে এলো।কিন্তুু চেহারায় সেটা প্রকাশ না করে চশমাটি ঠিকঠাক ভাবে পড়ে মুচকি হেসে বললো,’নিজেকে কখনো নায়ক ভাবি না,ভিলেন ভাবি।আর আপনার বলা কথাগুলো ভালোভাবে মনে থাকবে।হ্যাপি জার্নি।”

“নিধি এবং তোহা ধীর পায়ে সেখান থেকে প্রস্থান করতেই,নির্জন নদীতে বয়ে চলা উঠন্ত-পড়ন্ত ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,’তোমার বুদ্ধিমত্তার তারিফ করতে হয় ডার্ক কুইন।একটুর জন্য কোমর ভাঙা থেকে বেঁচে গেলে।ভাগ্যিস আমার একটু-আকটু মায়া-দয়া আছে।তাই ধাক্কা টা আস্তে করে দিয়েছি।আর এখন যদি আমার হাত টা ধরে উঠতে যেতে,তাহলে এখন নিশ্চিত হসপিটালের বেডে শুয়ে মেডিসিনের কড়া স্মেল গায়ে মাখতে হতো।সত্যি তোমার ভাগ্যটা খুবই ভালো।’কথাগুলো একমনে বলে নদীর দিকে তাকিয়ে নিজের সরু ঠোঁট জোড়ায় আঙ্গুল দিয়ে বললো,’হুশশ..তোরা কিন্তুু কিচ্ছু শুনিসনি,মনে থাকে যেনো।’বলেই সেখান থেকে বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো।”

————
“এদিকে দিগন্ত কিছুক্ষণ যাবৎ নাদিয়ার গালে একটা কিস করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।কিন্তুু কঠোর মনের নাদিয়া কিছুতেই দিগন্ত কে কিস করতে দেবে না।”

“দিগন্ত আবারও আদুরে কন্ঠে বলে উঠলো,’দাও না হানি..একটা কিস করবো,জাস্ট ঠোঁট ছোয়াবো,আর কিছু করবো না প্লিজ।দেখো তুমি একবার বলাতেই কত জার্নি করে কতটা পথ পাড়ি দিয়ে,তোমার প্রেমের টানে ছুটে এসেছি।অথচ তুমি শুধু আমার হাত ধরে বসে আছো।”

“নাদিয়া মুখ ভেং*চি কে**টে বললো,’ইশশ আমার প্রেমিক পুরুষ আসছে…হাত ধরতে দিয়েছি এটাই অনেক।তোমার সাথে আমার বিয়ে হবে কিনা সেটা এখনও অনিশ্চিত।খামোখা কয়েক সেকেন্ডের জন্য তোমার চুমু খেয়ে আমার পবিত্র গাল টা কে অপবিত্র করতে চাই না।এইসব ছলাকলা বিয়ের পর যতো ইচ্ছে করবে,আমি বাঁধা দেবো না।আর বেশি জোরাজুরি করলে এই হাত টাও ধরতে দেবো না।সো বিয়ের আগে ‘নো চুম্মাচুম্মি।”

“অনেক বার রিকোয়েস্ট করার পরও যেহেতু নাদিয়া নারাজ,তখনই দিগন্ত রেগেমেগে বললো,’তোমার থেকে তো আফরিন অনেক ভালো ছিলো।নিজে থেকেই গাল এগিয়ে দিতো আমার কিউট ঠোঁটের চুমু খাওয়ার জন্য।কিন্তুু তখন আমি অ্যাটিটিউড নিয়ে ওকে ফিরিয়ে দিতাম।সত্যি আমি দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝিনি। আর তুমি তো পুরোটাই নিরামিষ।”

“দিগন্তের মুখে আফরিনের নাম শুনে নাদিয়ার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।দিগন্তের কাছ থেকে হাত সরিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,’মানে তোমার আগে গার্লফ্রেন্ড ছিলো?কই আমাকে তো রিলেশনের আগে বলেছিলে,তুমি পিউর সিঙ্গেল।তোমার জীবনে নাকি প্রথম রূপবতী নারী একমাত্র আমি,আরও কত কি..এগুলো সব মিথ্যা ছিলো?”

“দিগন্ত ভেবেছিলো,’একটু রাগ দেখিয়ে কথা বললে,নাদিয়া রাজি হয়ে যাবে।কিন্তুু এতো দেখি হিতে-বিপরীত হয়ে গেলো।এই রে আমি তো ভুল করে আফরিনের কথা
বলে ফেললাম।এইজন্যই তো বাঘিনী এভাবে গ**র্জন করে উঠেছে।উফফ! আমার তো দেখি মেয়েদের থেকেও বেশি ঠোঁট পাতলা।কোনো কথা পেটে হজম করতে পারিনা।সকালে নির্জন কে ঘুমঘুম চোখে গড়গড় করে সত্যি কথা বলে দিলাম।আর এখন আবার আফরিনের কথা।আফরিন যে আমার ৩নাম্বার গার্লফ্রেন্ড,এটা জানলে নিশ্চিত নাদিয়া আমাকে এই চলনবিলের নদীটিতে ফেলে দিবে।না না এখন থেকে মুখের ভাষা সংযম করতে হবে।’ভেবে দিগন্ত নাদিয়ার দিকে ভীতু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘দেখো হানি ওই আফরিন আমার কেউ না।আমি আসলে এমনি বলছিলাম..

‘কিসের হানি?কার হানি?আমি কারো হানি-টানি না।আপনার ঐ নোং**রা মুখ দিয়ে, ভুলেও আমাকে এই নামে ডাকবেন না।’

“দিগন্ত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,’একি তুমি আমায় আপনি করে বলছো কেন?”

“আমি রেগে গেলে আমার প্রিয় মানুষদের ‘আপনি’ করে বলি।তবে আজ থেকে আপনি আমার অপ্রিয়র তালিকায় চলে গেলেন চিরদিনের মতো।আর কখনো আমার সামনে আসবেন না।সব জায়গা থেকে আপনাকে ব্লক করে রাখবো।আমি কোনো মিথ্যাবাদী,ধোকাবাজ পুরুষ কে ভালোবাসতে চাই না।আর ভুলেও আমার পিছু নিবেন না।আমি যদি এখানে আমার ধারে-কাছেও আপনাকে দেখি, তাহলে সেটাই হবে আপনার শেষ দিন।’আঙ্গুল উঠিয়ে একাধারে কথা গুলো বলে কাঁদতে কাঁদতে নদীর পার থেকে চলে গেলো নাদিয়া।”

“দিগন্ত অসহায় দৃষ্টিতে নাদিয়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ভাবলো,’ইচ্ছে করছে এখনই নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে জীবন টা উৎসর্গ করে দেই।কিন্তুু মৃ**ত্যুর মতো ভ**য়াবহ সত্য কে তো আমি ভীষণ ভ**য় পাই।তার ওপর আ**ত্ম*হ**ত্যা তো মহাপাপ।ধুর এইসব বাদ দিয়ে নাদিয়া কে কিভাবে নতুন করে পটানো যায় সেই চিন্তা করি।’ভেবে দিগন্ত নির্জন কে ফোন দিলো।নির্জন ফোন রিসিভ করতেই, দিগন্ত কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া সব কাহিনী নির্জন কে বললো।সবকিছু শুনে নির্জন যেখানে অবস্থান করছে, সেখানে দিগন্ত কে যেতে বললো।দিগন্ত ফোন রেখে হন্যে হয়ে নির্জনের নিকট ছুটে গেলো।”

———-
“বিকাল ৫টা।সূর্য রশ্মির ছিটেফোঁটাও এখন নেই।ধরনীর আকাশে র**ক্তিম লাল আভা ফুটে উঠতে শুরু করেছে।নদীর পারে দাঁড়িয়ে নিধি এবং তোহা নদীর ঢেউয়ের কলকল ধ্বনির আওয়াজে বারবার মুগ্ধতা খুঁজে বেড়ায়।নদীতে শতশত পর্যটক নৌকায় ভেসে বেড়াচ্ছে,কেউ কেউ ভাটিয়ালি গান গাইছে।নিধি কুসুম রঙা সূ্র্যের অস্ত যাওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুণছে।বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ।এই নদীর পারে দাঁড়িয়ে কত কবিরা তাদের অবচেতন মনের বিভিন্ন অমূল্য বানী কুড়িয়েছেন।এই নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তরঙ্গে কবিগণ খুঁজে পেয়েছেন নাম না জানা হাজারো শব্দচয়ন।তাদের সুপ্ত মেধা গুলো কে কাব্যমালায় রূপান্তর করে অকাতরে বিলীন করেছেন সাধারণ জনগণের মাঝে।সত্যি নদীর স্নিগ্ধ পরিবেশ নিমিষেই মানব মনে জায়গা করে নিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকে।এই যে নিধিও নদীর পানে তাকিয়ে ৪লাইন কবিতা আবৃত্তি করলো,

“ওগো নদী কি এমন আছে
তোমার ঐ বিশাল বক্ষ মাঝে?
তোমার ঢেউয়ের সুরের প্রতিধ্বনি
যে আমার কানে বাজে…”

~মেহের আফরোজ~

“নিধির কবিতা শুনে তোহা বললো,’আপু তুমি তো মচৎকার কবিতা আবৃত্তি করেছো।”

“তোহার কথা শুনে নিধি কটমটিয়ে বললো,’হ্যা রে বাঁকামুখী তুই উল্টা কমেন্ট করলি কেন?কবিতাটা কি ভালো হয় নি?”

“তোহা দুষ্টু হেসে বললো,’সরি আপু।তোমার কবিতাটা চমৎকার হয়েছে হিহিহি।
আচ্ছা তোমার কোমর ব্যথা কমেছে?”

‘হুমম তখন মনে হয়েছিলো খুব ব্যথা পেয়েছি।কিন্তুু ধীরে ধীরে কমে গেছে।ব্যথা টা হয়তো গভীরে লাগে নি।’

” নিধি এবং তোহার কথার মাঝেই নাক টেনে কেঁদে উঠলো নাদিয়া।নিধি বিরক্তিকর দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে বললো,’এই পেঁচামুখী সেই কখন থেকে দেখছি ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কেঁদে যাচ্ছিস।আর এই নদীর পানিতে টিস্যু ফেলছিস।কত করে জিজ্ঞেস করলাম,কি হয়েছে।সেটাও বললি না।এইসব ন্যাকা কান্না না করে,কি হয়েছে সেটা বল।”

“নাদিয়া মনের কথা আর চেপে রাখতে পারলো না।গড়গড় করে দিগন্তের সাথে ঘটে যাওয়া সব কাহিনী বলে আবারও ম**রা কান্না জুড়ে দিলো।”

“নিধি এগুলো শুনে হো হো করে হেসে উঠলো।তোহা তো ঠোঁট টিপে মিটমিট করে হাসছে।নিধি বললো,’আরে এটা কোনো কাহিনী হলো?দিগন্ত ভাইয়া তোকে মিথ্যা বলেছে বলে এতো কান্না করার কোনো মানে হয়?আমি হলে তো কখনোই কাঁদতাম না।আমি আবার খুব শক্ত মনের মানবী।আর ছেলেরা প্রেম করার আগে ওইরকম অনেক মিথ্যা কথা বলে,নইলে তো তোকে পটাতে পারতো না তাই না?আর এই যুগে পিউর ছেলে-মেয়ে পাওয়া আর স্বপ্নের মধ্যে হাতে চাঁদ পাওয়া একই ব্যাপার।আমরা সবাই এক নায়ের মাঝি বুঝলি?হয়তো আমি প্রেম করি না।কিন্তুু রাস্তায় কোনো কিউট চকলেট বয় দেখলে, মনে মনে ঠিকই ক্রাশ খেয়ে উল্টেপাল্টে পড়ে যাই।তাছাড়া আমার মনে হয় দিগন্ত ভাইয়া খুব ভালো ছেলে,তার ঐ চশমিস বন্ধুটার মতো অহংকারী না।তুই ভাইয়া কে ভুল বুঝিস না।নিজেদের মধ্যে ঝামেলা মিটিয়ে নে।”

“নাদিয়া নাক টেনে কেঁদে বললো,’দেখি কি করা যায়।তবে এতো সহজে আমার অভিমান ভাঙবে না।”

“নাদিয়া এবং নিধির কথপোকথনের মাঝেই হঠাৎ করে তোহা মাথায় এক হাত দিয়ে বলে উঠলো,’আপু তোমার মনে আছে,বাবা-মা তো বলেছিলো আমরা যেনো বিকালের মধ্যে বাসায় ফিরে যাই।কিন্তুু আমরা তো দেরি করে রওনা হলাম, আর চলনবিলের ভূত বাবাজি তোমাকে পানিতে ধাক্কা দেওয়াতে আমাদের ডুব সাঁতারও কা**টা হলো না,আর পিকনিকও করা হলো না।সব প্ল্যান ভেস্তে গেলো।এইজন্যই গুরুজন রা বলে,’কোনো কিছু নিয়ে বেশি আশা করা অনুচিত।’
চলো আপু বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেই।যেতে যেতে প্রায় ৩-৪ঘন্টা লেগে যাবে।এমনিতেও রাত হয়ে যাবে।”

“নিধি মুখে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বললো,’বাবা বলে আমি নাকি দস্যি মেয়ে।সত্যি আমি দস্যি মেয়ে।আজ সেটা প্রমাণ করে দেখাবো।এখন রওনা করলে এমনিতেও পৌঁছাতে প্রায় সাড়ে ৯টা বাজবে।আজ যেহেতু কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলো না।তাই এখন আমরা পুরো চলনবিলের নদীতে একটা চক্কর দিবো।তারপর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হবো।”

“তোহা চোখজোড়া গোল গোল করে বললো,’কিভাবে?”

“নিধি হাসিমুখে বললো,’তোর মাথায় দেখছি গোবর ঠাঁসা।আমরা নৌকায় পুরো নদীটা ভ্রমণ করবো।যদিও নদীটি সুবিশাল।কিন্তুু আমরা নৌকায় এই পার থেকে ওই পারে যাবো।”

“তোহা বাচ্চাদের মতো হাতে তালি দিয়ে বললো,’ওকে আপু চলো যাই।নিধি নাদিয়া কে বললো,’ওই পেঁচামুখী এখানে দেবদাসীর মতো বসে না থেকে চল,নদী ভ্রমণ করবো।’নাদিয়া আর কথা বাড়ালো না।নিধি এবং তোহা কে অনুসরণ করে ওদের পিছু হাঁটতে থাকলো।নিধি এইবার আর আগের মতো ভুল করলো না।নিধি পেছনে গিয়ে নাদিয়ার হাত মুঠোয় নিয়ে হাঁটতে থাকলো।তারপর নাদিয়া কে মুচকি হাসি উপহার দিয়ে বললো,’এইবার আর তোমার লুমান্তিক বয়ফ্রেন্ডের কাছে তোমাকে যেতে দেবো না হুহ..”

———–
“নিধি,তোহা এবং নাদিয়া ৩জন একটা নৌকা ভাড়া করেছে।নিধি নৌকা চালক কে একটু ঘুরিয়ে তারপর ওপারে যেতে বলেছে।নৌকা চালক সায় জানিয়ে নৌকা চালাতে শুরু করলো।নিধি মুগ্ধ নয়নে পশ্চিমাকাশে সূর্যাস্ত দেখলো।এদিকে তোহা নাদিয়া কে সাথে নিয়ে এদিক-সেদিক পোজ দিয়ে সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।”

” অপরদিকে নির্জন এবং দিগন্ত নাদিয়া কে ফলো করে নৌকাতে উঠলো।কিন্তুু ওরা নৌকা চালক কে তাড়াতাড়ি করে ওপারে যেতে বললো।দিগন্ত পণ করেছে, আজ যেভাবেই হোক নাদিয়ার রাগ ভাঙাবে।এদিকে নদীর ঢেউয়ের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে, নির্জনের মাথায় তখন জটিল কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে।নির্জন এবং দিগন্ত খুব দ্রুত ওপারে চলে গেলো।”

“এদিকে নিধি এখনও নৌকা চালক কে ধীরে চালাতে বলছে,যেনো নদীর অপরূপ সৌন্দর্য ভালোভাবে উপভোগ করতে পারে।চলনবিলের তীরে দানবাকৃতির সারি সারি গাছ-পালা নদী থেকে ভেসে আসা স্নিগ্ধ বাতাসে বারংবার হেলদোল খাচ্ছে।সূর্য অস্ত যাওয়ার পর থেকে সন্ধ্যার মৃদু আলোয় কেমন গা ছমছমে ভাব এবং সেই সাথে রোমাঞ্চকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।নিধি হেয়ার ব্যান্ড খুলে চুলগুলো মুক্ত করে, দুই পাশে দুই হাত মেলে দিয়ে নদীর অপরিসীম তরঙ্গের স্নিগ্ধ বাতাসে গা ভাসিয়ে দিলো।”

“হঠাৎ তোহার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো।তোহা নিধি কে বললো,’আপু তুমি তো বলেছিলে, এই চলনবিলের কি যেন একটা ভুতূড়ে ইতিহাস আছে।প্লিজ এখন বলবে?আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে।”

“তোহার কথা শুনে নাদিয়াও বললো,’নিধি ভূতূড়ে ইতিহাস টা বল।শুনে যদি আমার অশান্ত মন টা একটু পরিবর্তন হয়।”

“নিধি মুচকি হেসে বললো,’আচ্ছা বলছি…

“তোহা নিধি কে বলতে না দিয়ে তড়িঘড়ি করে বললো,’ এই আপু এভাবে বলো না।তোমার মোবাইল টা তো পানিতে পড়ে নষ্ট হয়ে গেলো।তুমি এক কাজ করো,আমার ফোনে তোমার আইডি লগ ইন করে লাইভে গিয়ে চলনবিলের ভিডিও সবার সাথে শেয়ার করো।আর সবাই কে এই সম্পর্কে বর্ণনা দাও।যারা এখানে বসবাস করে তারা হয়তো জানে।কিন্তুু যারা জানে না, তারা নতুন করে জানবে।সেই সাথে তোমার ফ্যান ফলোয়ার্স আরও বাড়বে।বুঝতেই তো পারছো,ফ্যান্টাসি টাইপ গল্পের প্রতি মানুষের ঝোঁক একটু বেশি থাকে।আর তোমার তো একটা ইউটিউব চ্যানেলও আছে।এই ভিডিও টা আপলোড করলে দেখবে তোমার ভিউয়ার্স এবং সাবস্ক্রাইবার ঝড়ের গতিতে বৃদ্ধি পাবে।সেই সাথে পজিটিভলি পরিচিতিও পাবে।”

“নিধি তো তোহার কথাগুলো শুনে খুব অবাক হলো।খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,’তোর তো মাথায় বুদ্ধিতে ভরপুর হয়ে গেছে।এই না হলে আমার মিষ্টি বোন।এইবার ঢাকা গিয়ে পুরো হানি নাটস তোকেই খাওয়াবো,আমি একটুও খাবো না,কথা দিলাম।’বলেই নিধি তোহাকে একটা ফ্লাইং কিস দিলো।তারপর নিধি নিজের আইডি তে লগ ইন করে ফেইসবুক লাইভে গিয়ে নদীর দিকে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইট অন করে একটু পোজ দিয়ে বললো,’হ্যালো গাইস..আমি নিরুপমা ইসলাম নিধি।আমরা এখন অবস্থান করছি সিরাজগঞ্জের চলনবিলে।অনেকেই হয়তো এই ভুতুড়ে বিলের সম্পর্কে জানেন।তবে যারা জানেন না,তাদের কে আজকে বিষয়টি নিয়ে বর্ণনা দেবো। লাইভ টি কে কে কোন জেলা থেকে দেখছেন, একটু কমেন্ট করে জানাবেন প্লিজ।”

“নিধি লাইভে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় ১হাজার+ মানুষ দেখতে শুরু করলো।সবাই কৌতুহল নিয়ে কমেন্ট করতে থাকলো।নিধি তো খুশি তে পারলে উড়ে যায়।তারপর নিধি একটু ভাব নিয়ে চুলগুলো ঠিকঠাক করে পোজ নিয়ে বলতে শুরু করলো,

~চলনবিল~
“বাংলাদেশের ভৌতিক স্থানের বিচারে শোনা যায় চলনবিলের কথা। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত সবচেয়ে বড় বিল চলনবিল; নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা এই তিন জেলা জুড়ে যার বিস্তৃতি। আমাদের এই ভূতুড়ে কাহিনীর মূলবিন্দু আপাতত সিরাজগঞ্জ। আরো ভেঙে বললে তাড়াস উপজেলা। শোনা যায়, চলনবিলের এই এলাকায় অনেক আগে একজন জমিদারের বাস ছিল। এই জমিদার অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। একদিন রাতে হঠাৎ করে জমিদার মা**রা গেলে, সেই রাতের ভেতরেই সেখানে রাতারাতি তিনটি মন্দির গড়ে ওঠে বলে শোনা যায়, যার একটি আবার পরদিনই নিজ থেকে ভেঙ্গে পড়ে।”

“এই তিনটি মন্দির ও মধ্যবর্তী বিলের এলাকা ভূতুড়ে বলে প্রচলিত। এছাড়াও চলনবিলে জ্বীনের প্রভাব আছে বলেও বিশ্বাস প্রচলিত আছে। বিশেষ করে রাতের বেলা চলনবিল পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকেই জ্বীনের আছরের শিকার হয়েছেন বলে শোনা যায়। এমনকি অনেক পথিকও অশরীরির উপস্থিতি আঁচ করতে পেরেছেন বলে জনশ্রুতি আছে।”

“একাধারে কথাগুলো বলে ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছাড়লো নিধি।এদিকে লাইভে কমেন্টের জোয়ার বয়ে গেছে।এটা দেখে তোহা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো।পাশ থেকে ফিসফিস করে বললো,’আপুরে দেখবে,এইবার তোমার ফলোয়ার্স হুরহুর করে বেড়ে যাবে।নিধি তো এটা শুনে ফুলে বেলুন হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে।নিধি আরও কিছুক্ষণ কথা বললো,তারপর ক্যামেরা ঘুরিয়ে চলনবিলের চারিদিক দেখালো।চলনবিলের তীরে কিছুটা দূরে জঙ্গল আছে সেটাও দেখালো।তারপর সবার থেকে ভদ্রতার সহিত বিদায় নিয়ে লাইভ শেষ করলো।”

“তোহা খুশি হয়ে বললো,’আপু তোমার খুশিতে আমিও খুশি।সেই খুশিতে একটা গান গাই।নাদিয়া আপু তুমি চুটকি বাজাও,আমি গান করি বলেই উচ্চস্বরে গেয়ে উঠলো,

🎶ফাগুন মাসে কাঁচা বাঁশে
গুনগুনিয়ে ভ্রমর আসে,
হায় ফাগুন মাসে কাঁচা বাঁশে
গুনগুনিয়ে ভ্রমর আসে,
প্রেমের লাগি বুকটা করে আ আ উ…🎶

দুষ্টু কোকিল ডাকে রে কুক কুকু, কুক কুকু
মনে বাঁশি বাজে রে কুক কুকু, কুক কুকু…”

তোহার গানের মাঝেই পেছনের নৌকা থেকে একটা পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে এলো,

🎶নদীর বুকে চর
আমি কি তোর পর,
আকাশ ভরা চাঁন্দের আলোয়
বাঁধবো সুখের ঘর..(২)

নিধি,তোহা এবং নাদিয়া সেই কন্ঠ অনুসরণ করে সন্ধ্যার আবছা আলোয় নৌকাটির দিকে তাকিয়ে দেখলো, ৪জন যুবক মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে ওদের দিকে ঘুরিয়ে গান গাইছে।”

পাশ থেকে আরেকজন গেয়ে উঠলো,

🎶তুমি কোন শহরের মাইয়া গো
লাগে উরা ধুরা..
তোমারে যে দেখলে পরে
পুরা মাথা ঘুরায় গো,
লাগে উরা ধুরা,

তুমি কোন শহরের মাইয়া গো
লাগে উরা ধুরা🎶

পাশ থেকে আরেকজন যুবক বললো,’আরে ব্যাটা ‘তুমি হবে না তোমরা হবে।’বলেই ব্যঙ্গ করে গেয়ে উঠলো,

🎶তোমরা ডানা কাটা পরী,
তোমরা ডানা কাটা পরী🎶

“যুবকগুলোর কন্ঠে এমন ইভটিজিং টাইপ গান শুনে খুব ভ**য় পেয়ে গেলো নিধি,তোহা এবং নাদিয়া।নিধি শুকনো ঢোক গিলে ভাবলো,’বাবা ঠিকই বলেছে,সন্ধ্যার পর চলনবিলে বখাটেদের উৎপাত বেড়ে যায়।ইশশ!দস্যিপনা দেখাতে গিয়ে,কেনো যে বাবা-মায়ের কথা শুনলাম না।বিকালে চলে গেলে এই ঝামেলায় পড়তে হতো না।এখন কিভাবে এদের থেকে বাঁচবো?এইজন্য বাবা-মায়েদের ইতিবাচক নির্দেশগুলো সন্তানদের মেনে চলা উচিত।’কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই যুবকদল তাদের নৌকা থেকে নিধিদের নৌকায় চলে এলো।”

#চলবে…
(প্রিয় পাঠকমহল আজ অনেক বড় করে পর্ব দিয়েছি।কিছু পাঠক যখন আমার সবচেয়ে অপছন্দের কমেন্ট (Next) লিখে, তখন বুক ফেটে কান্না আসে।আমি তো এটা না বললেও গল্প দিবো।তারপর কিছু পাঠক যখন (Next এর সংক্ষিপ্ত করে N লিখে,তখন ঐ চলনবিলে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করে।মানে সংক্ষিপ্ত করার একটা লিমিট থাকে।আমি তো সবার কমেন্টের রিপ্লাই দেই।তবুও কেনো এমন অদ্ভুত কমেন্ট করেন,বুঝি না।শুধু যারা গঠনমূলক মন্তব্য করে শুধু তাদের জন্যই গল্প কন্টিনিউ করি।তাদের জন্য আমার ভালোবাসা অপরিসীম।আমি জানি,এগুলো হাজার বার বলার পরেও ঝড়ের গতিতে সবাই Next কমেন্ট লিখবে। তবুও আর কিছু বলার নাই।হ্যাপি রিডার্স।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here