#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহামণি
পর্ব ১৫
রাত্রি পেরিয়ে প্রভাতের মিষ্টি আলো জানালা দিয়ে এসে মুখে পড়ছে রাউশির।বিরক্তির জন্য ঘুমের ঘোরেই কপাল কুঁচকে যায়। তবুও চোখ খুলে না রাউশি।ইচ্ছে আছে আজ অনেক্ষণ ঘুমাবার তবে তা আর হয়তো হয়ে ওঠে না। তানিয়া এসে চেঁচাতে থাকে আর বলে,
“এই রাউশিপু, রাউশিপু!!”
রাউশি মাথায় হাত দিয়ে চোখ খুলে তাকায়। মাথা ব্যাথা করছে।রাতে জ্বর এসেছিলো। তবে এখন কিছুটা সুস্থ অনুভব করছে।মধ্য রাতে জ্বরে যখন গা কাঁপছিলো তখন কপালে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে যখন চোখ খুলে তাকিয়েছিলো ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় মেহরানের মুখ দেখে থমকে গিয়েছিলো রাউশি।মেহরান তার শীতল হাত দিয়ে রাউশির গায়ের তাপমাত্রা চেক করছিলো তখন।ভালোভাবেও তাকাতে পারছিলো না রাউশি চোখব্যাথায়।ঘুমে ঢুলুঢুলু আর তীব্র জ্বরাক্রান্ত চোখে মেহরানের চিন্তান্বিত মুখশ্রীটা কিছুটা হলেও আন্দাজ করেছে রাউশি।মেহরান অস্থির হয়ে আদুরে স্বরে যখন বলল,
“রাউ,তোর তো প্রচুর জ্বর! দাড়া কপালে জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছি।”
তীব্র জ্বরের ঘোরেও রাউশির প্রচুর ভালো লাগে।মেহরান হন্তদন্ত হয়ে উঠে গিয়ে একটি ছোট বালতিতে পানি আর পরিষ্কার কাপড় এনে ভিজিয়ে রাউশির কপালে জলপট্টি দিতে থাকে।রাউশি কিছুটা আরামবোধ করেছিলো তখন।সেই জ্বরের মাঝেও রাউশির আলাদা অনুভুতিতে খুবই ভালো লাগছিলো।মন চাচ্ছিলো সময়টা যদি সেখানেই থেমে যেতো নতুবা বার বার যদি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো তবে হয়তো খুব একটা খারাপ হতো না।কিয়ৎক্ষণ মাথায় জলপট্টি আর পানি ঢেলে দিয়ে টাওয়ালে দিয়ে মাথা মুছে দেয়।প্রবল মাথা ব্যথায় রাউশি চোখ বুজে রয়েছে আর জ্বরের ঘোরে ছোট্ট আওয়াজে কিছু বলে যাচ্ছে।মেহরান সেসব শুনে।বেশিরভাগ কথায় নিজের অতীত জীবনের।মেহরান রাউশিকে আবারও ভালোভাবে শুইয়ে দিয়ে রান্নাঘরে যায় স্যুপ বানাতে।রূপা বেগমকে ডাকবে কিনা একবার ভাবে পরক্ষণেই আবার মনে পড়ে উনি নিজেও আজ উদাসীন ছিলেন সারাদিন।আর এখন সবাই ঘুমাচ্ছে ডাকাটা উচিত হবে না।তাই নিজ দায়িত্ব স্যুপ বানিয়ে এনে রাউশিকে আধশোয়া করে খাওয়ানোর চেষ্টা করে।তবে রাউশি খেতে না চাইলে মেকি ধমক দেয়।ডান গালে বাম হাত রেখে বলে,
“রাউশি, খেয়ে নে তাড়াতাড়ি।রাগ উঠলে কিন্তু ভালো হবে না।”
রাউশি বাধ্য মেয়ের মতোই পরবর্তীতে খেয়ে নেয়।এরপর জ্বরের ঔষধি খাইয়ে আবারও বিছানায় শুইয়ে দেয় রাউশিকে।মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
“ঘুমানোর চেষ্টা কর।”
রাউশি মেহরানের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।মানুষটাকে যেমন গম্ভীর আর দৃঢ় ব্যাক্তিত্বের দেখায় তবে আড়ালে থেকে ভীষণ যত্নশীল আর নরম মনের মানুষ।যেটা রাউশি রাতেই বুঝতে পেরেছে আর এখন তো আরও প্রখর।রাউশিকে এভাবে নিজের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই বলল,
“আমাকে দেখার আজীবন পড়ে আছে। এখন ঘুমা।”
রাউশি তড়িৎ বেগে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা চালায়।অবশ্য সফলও হয়।ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দেওয়ার পর আর কিছুই মনে থাকে না তার।
রাউশিকে ভাবনায় মশগুল দেখে তানিয়া বলে,
“এই রাউশিপু শুনলাম তোমার রাতে জ্বর উঠেছে?এখন কেমন আছো?বড় মা,মেজো মা তোমায় নিয়ে ভীষণ চিন্তিত।”
রাউশি এখন মোটামুটি সুস্থ তবে মাথা ব্যথা আছে এখনও।এক চোখ খুলে আর অপর চোখ বন্ধ অবস্থায় তানিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“চিন্তা করার দরকার নেই আমি এখন ভালো আছি।”
“তুমি তো আজ ভার্সিটি যেতে পারবে না তাই না?”
রাউশি ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর ঠিকমতো ক্লাসই করতে পারছে না আজকে এই ঝামেলা তো কালকে ওই ঝামেলা। মামার মৃত্যুর কথা মনে পড়তেই আবারও চুপসে যায় রাউশি।তবুও ভাঙ্গা গলায় উত্তর দিলো,
“যাব।কয়টা বাজে?”
“যাওয়ার দরকার নেই আপু।আজ আমরা কেউই যাব না।আজ নাকি মেহরান ভাই কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবে আমাদের।”
ললাটে ভাজ পড়ে রাউশির।মিহি স্বরে জানতে চাইলো,
“কোথায় আর কেন?”
“সেটাতো জানি না।তবে সকালে উজান ভাই বললো।”
“আচ্ছা মেহরান ভাই কোথায় এখন?”
“ভাইয়া তো রুমে ঘুমাচ্ছে।”
“আজ অফিসে যাবে না?”
“উজান ভাইয়া বললো যাবে না।”
রাতে ঘুম হয়নি এখন ঘুমানোরই কথা।রাউশি আর ঘাটায় না।বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ফ্রেশ হওয়ার জন্য।
রাতে ঘুম না হওয়ায় এখন ঘুমাচ্ছে মেহরান। এগারোটা বেজে গেছে।মেহরান এতো দেরি পর্যন্ত কখনোই ঘুমায় না।এই স্বভাব নেই।সর্বোচ্চ ৮টা পর্যন্ত এর বেশি নয়।নিয়মমাফিক কাজ তার পছন্দ।গতকাল রাউশিকে ঘুমা পারিয়ে অনেক্ষণ পর্যন্ত মেয়েটার পাশে বসে ছিলো।টানা আড়াই ঘণ্টা রাউশির বেডের পাশের সোফায় বসে বসে বই পড়েছে।ভোর পাঁচটা বাজতেই উর্মিলা বেগম যখন ঘুম থেকে ওঠেন। বাড়ির রান্নাবান্না সমস্ত কাজ বাড়ির গিন্নিরাই করে থাকেন।উনার ওঠার পরপরই যখন রূপা বেগম ঘুম থেকে ওঠেন মেয়েকে একবার দেখার জন্য মেয়ের দোতলায় যেতেই রাউশির রুমের দরজা খোলা দেখে কিছুটা ঘাবড়ে যান।রুমে গিয়ে মেহরানকে সোফায় বসে থাকতে দেখে রূপা বেগম চিন্তিত হয়ে বলেন,
“মেহরান বাবা, তুমি এখানে?”
ইতস্ততবোধ করলেও মেহরান উত্তরে বলল,
“মেজো মা মধ্যরাতে রাউশির রাতে জ্বর এসেছিলো প্রচুর।আমি পানি খাওয়ার জন্য উঠেছিলাম তখন গোঙানির আওয়াজ শুনে রাউশির রুমে ঢুকে দেখি মেয়েটা জ্বরে কাঁপছে।তোমরাও ঘুমাচ্ছিলে তাই আর তোমাদের ডিস্টার্ভ করিনি।”
রূপা বেগমের ভীষণ মায়া হলো মেহরানের জন্য,
“বাবা আমায় ডাকতে পারতে।তোমার কষ্ট হয়ে গেলো না।”
মেহরান ঘুমন্ত রাউশির দিকে তাকায়। শীতল গলায় ছোট করে বলল,
“এমন কষ্ট আমি আজীবন করতে রাজী যদি কারণটা হয় রাউশি।”
রূপা বেগম রাউশির পাশে গিয়ে মেয়ের শরীরে হাত দিয়ে দেখছিলেন তাই মেহরানের ছোট্ট আওয়াজে বলা কথা কর্ণগোচর হয় না।রূপা বেগম মেহরানের দিকে তাকিয়ে সোহাগী গলায় বললেন,
“বাবা যাও তুমি ঘুমাতে যাও।এখন আমরা আছি।”
মেহরান রাউশিকে কয়েকপলক দেখে নিয়ে চলে যায় নিজের রুমে।ভেবে নেয় আজ বাড়ির ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঘুরতে যাবে কোথাও।তাই আগে থেকেই উজানকে মেসেজ দিয়ে বলে দেয়।
.
আজ ক্লাসে এসে রাউশিকে চোখে পড়ে না আয়াশের।প্রায় অনেকদিন হলো ভার্সিটি মিস দিচ্ছে বলেই গতকালই মাকে নিয়ে তারাও ঢাকায় চলে এসেছে আর আজ ভার্সিটিতে ক্লাস নেওয়ার জন্যও এসেছে।মনে মনে একরাশ আশা নিয়ে এসেছিলো রাউশিকে একবার দেখার।কেমন আছে?একটা সরি বলা যায় কি?সরি বলে সরিকে অপমান করা হবে ভেবে দমে যায় আবারও।তবে রাউশিকে গতদিন দেখে আয়াশের নিজেরই খুব খারাপ লাগছিলো। কেমন যেন দমবন্ধ লাগছিলো নিজের।রাউশিকে কখনো ভালোভাবে তাকায় নি পর্যন্ত আয়াশ।তবে গতকাল খুব নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে রাউশিকে।মুখটা ফ্যাকাসে ছিলো মেয়েটার,চোখমুখে অঢেল বিষণ্ণতা।রাউশির কথা মনে পড়তেই অনিমার কথা মনে পড়ে আয়াশের।অনিমাকে ভালোবাসে আয়াশ তবে অনিমার ব্যবহার দিন দিন বাজে থেকেও বাজে হয়ে যাচ্ছে।আয়াশ তার মা-কে রাজশাহী থেকে ঢাকায় এনেছে বলে অনেক কথা কাটাকাটি পরবর্তীতে তুমুল ঝগড়াও হয়েছে তাদের মাঝে।অনিমার গায়ে হাত তুলতেই যাবে তখন অনিমাই আয়াশের হাত ধরে ফেলে।এতে আয়াশ হতবম্ভ হয়ে যায়।রাগ দেখিয়ে খুব তাড়াতাড়িই বাসা থেকে বেরিয়েছে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।ক্লাস শেষে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসে নুজাইশ স্যারের মুখোমুখি হয় আয়াশ।হেসে কুশল বিনিময়ের জন্য কথা বলে। নুজাইশও মুচকি হেসে জবাব দেয় তবে আগের মতো প্রানবন্ত মনে হলো না আজ মানুষটাকে।আয়াশ ভাবে হয়তো উনারও পার্সোনাল কোনো সমস্যাই হবে। আয়াশ চলে যায় নুজাইশও ক্লাসে ঢুকে পড়ে। ক্লাসে ঢুকতেই আগে একবার পুরো ক্লাস পরখ করে নজর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাঙ্ক্ষিত নারীকে খোজে।কিন্তু দেখা মেলে না তার।আজ আসে নি কেন?কিছু কি হয়েছে?ক্লাসে টপিক বোঝানোর সময় বারবার মৌরিনের কথা মনে পড়ছিলো।টালমাটাল মন নিয়ে থাকতে না পেরে তৃষ্ণার্ত কাকের মতো বলে উঠলো,
“আপনাদের ক্লাসের মৌরিন আজ আসে নি কেন? কেউ কি জানেন?”
পেছন থেকে রুনা হাত তুলে উঠে দাঁড়ায়,
“স্যার রাউশি অসুস্থ।”
নুজাইশের মন ধ্বক করে ওঠে।অসুস্থ মানে?এই মেহরান নিজের প্রেমিকার খেয়াল রাখতে পারে না নাকি?মেহরানের ওপর খুব রাগ হলো নুজাইশের। নুজাইশ রুনাকে বসতে বলে।রুনাও বসে পড়ে। হাসিব পাশ থেকে বলে,
“আমরা না আসলে তো জীবনেও জিজ্ঞাসা করে না।”
মিলি কথাটা শুনতে পায়।ভালো লাগে না তার কথাটা।অন্যরকম ইঙ্গিত।তাই বলে,
“নুজাইশ স্যার রাউশির ভাইয়ের বন্ধু।তাই হয়তো।”
চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/