#মেহেরজান
লেখনীতে – #সোহামণি
পর্ব ১৭
আয়াশ ভীষণ ক্লান্ত।সবে বাসার রান্না শেষ করে বিশ্রামের জন্য খাটে গা এলিয়ে দিলো। ভার্সিটি থেকে এসেই বাসার সব কাজ করা শুরু করেছে।আমেনা বেগনের পায়ের গোড়ালিতে ব্যাথা সেজন্য বেশি হাটাচলা করতে পারেন না। আরিশা পাব্লিকে পড়াশোনা করছে।হলে থাকে।শুক্রবারে আসে শুধু বাসায়। আর অনিমা!সে তো দিব্বি নিজের বেপরোয়া জীবন কাটাতে ব্যস্ত।আজ নাকি বোন বান্ধবীর পার্টিতে গিয়েছে।সেখান থেকে এখনও ফেরে নি।আয়াশ ভেবে পায় না এত তাড়াতাড়ি বান্ধবী কোত্থেকে পেলো সে।অনিমার ফ্যামিলি বিদেশে স্যাটেল। আয়াশের জন্যই সে বাংলাদেশেই পড়ে আছে বলে অনিমার অভিযোগ।এসব তথ্য হিসেবে করলে আয়াশ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না এই মেয়ের এতো তাড়াতাড়ি বন্ধুবান্ধব জুটলো কিভাবে?অবশ্য বিদেশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী অনিমা।এসব কিছুই না।আয়াশ হতাশার শ্বাস ফেলে শুধু। মনে মনে ভাবে খাটি সোনা চিনতে ভুল করেছে সে।এই জীবনে আর এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারবে না।ক্লান্ত শরীর কোনোরকম টেনে তুলে রুমের বাইরে এলো। তার মায়ের রুমের সামনে গিয়ে আমেনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“মা খেতে এসো।”
দরজা ঠেলে ভেতরে একবার পরখ করে। আমেনা বেগম শুয়ে আছেন।আমেনা বেগমকে দেখলে আয়াশ ভীষণ কষ্ট পায়। মায়ের শরীরও বেশি ভালো নেই।আয়াশ মায়ের পায়ের কাছে গিয়ে বলল,
“আম্মা খাবে চলো।”
আমেনা বেগম কোনোভাবে উঠে বসেন। ছেলেকে একবার দেখেন।কয়েকদিনেই ছেলেটা কেমন রোগা-সোগা হয়ে গেছে। ফ্যাকাসে মুখ।আমেনা বেগম ছেলেকে বলেন,
“বাবারে আমরা অনেক বড় ভুল করেছি কি?”
ধ্বক করে ওঠে আয়াশের বুক।ভেসে ওঠে রাউশির মুখটা।নিজেকে যথাসম্ভব সংযত রেখে কথা ঘুরিয়ে জবাবে বলল,
“আম্মা তোমার শরীর খারাপ।খেয়ে দেয়ে ঔষধ খেয়ে নাও।কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।”
আমেনা বেগমকে তুলে উঠালো আয়াশ। আয়াশকে ধরে ডাইনিং টেবিল পর্যন্ত নিয়ে গেলো।চেয়ার টেনে বসালো।পাতে খাবার বেড়ে দিলো মাকে।আমেনা বেগম বেশি খেতে পারলেন না।কয়েক লোকমা খেয়েই উঠে গেলেন।পা টিপে টিপে আস্তে আস্তে চলে গেলেন নিজ রুমে।আয়াশও মায়ের এমন অবস্থাতে বেশি খেতে পারলো না। এঁটো প্লেটগুলো ধুয়ে ঘড়িতে সময় দেখে ১০টা বেজে যাচ্ছে প্রায়।আর অনিমা এখনও এলো না।আয়াশ মায়ের রুমে গিয়ে ঔষধগুলো খাইয়ে গায়ে কাথা টেনে দিয়ে দরজা ভিড়িয়ে নিজের রুমে চলে এলো। অনিমার উপর রেগে অনিমার নাম্বারে কল করে আয়াশ।অনেকবার কল দিয়েও কল রিসিভ করলো না অনিমা।তখনই আবার অনিমার নাম্বার থেকে কল ব্যাক আসলো। আয়াশ কল রিসিভ করে শক্ত গলায় বলল,
“কোথায় তুমি?বাসায় আসার নাম নেই কোনো?তুমি তো এখানের কাউকে চেনো না তাহলে কিভাবে এতো ঘোরাঘুরি করছো?তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি বেশিই করে ফেলছো?”
আয়াশের কথা শেষ হতেই অনিমার বদলে অন্য কন্ঠের একটি মেয়ে জবাবে বলল,
“অনিমা ড্রাংকড হয়েছে বেশি।আমার বাসায় এসেছে।আজ বাসায় যেতে পারবে না মনে হচ্ছে।আগামীকাল আসবে।”
রেগে গেলো আয়াশ।চোয়াল শক্ত করে বলল,
“ওকে আজকেই বাসায় আসতে হবে।ঠিকানা বলুন আমি নিতে আসছি।”
মেয়েটি ঠিকানা দিয়ে দিলো মেসেজে। আয়াশ বেরিয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেলো।লোকেশন অনুযায়ী একটি বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়।অনিমার নাম্বারে আবারও কল করতেই সেই মেয়েটি কল রিসিভ করে বলে,
“কাইন্ডলি চারতলার বাম পাশের ফ্ল্যাটে আসতে পারবেন প্লিজ?”
আয়াশ দাতে দাত চেপে কল কেটে দিয়ে উদ্যত হয় যাওয়ার জন্য।কথামতো সেই ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে যায়।ভেতরে তাকিয়ে দেখে অনিমা কিছু ছেলের সাথে ডলাডলি করছে মাতাল অবস্থায়।ছেলেগুলো অনিমার গায়ের ওপর পড়ছে।আরও বেশি রেগে গেলো আয়াশ।দরজা খুলে দেওয়া মেয়েটাকে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকে অনিমার কাছে গিয়ে অনিমাকে সপাটে চড় মারলো সবার সামনেই।সেখানে কয়েকজন ছেলেমেয়ে ছিলো।অনিমা এদের সাথেই অবাধ ঘোরাফেরা করছে।মাতাল অনিমা তাল সামলাতে না পেরে সোফা থেকে ফ্লোরে পড়ে যায়।ছেলেগুলো আয়াশের দিকে তাকালো।আয়াশ অনিমার হাত ধরে টেনে বের করে নিয়ে গেলো।মনে মনে ঠিক করলো এই মেয়ের একটা ব্যবস্থা করতে হবে তাকে।
.
“এই রাউশি!”
চেনা পরিচিত আওয়াজে নিজের নাম শুনে পেছনে ফিরে তাকালো রাউশি।মিলিকে এখানে দেখতে পেয়ে নিজেও চমকালো কিছুটা।এদিকে মিলি তো নিজেও চমকিত। রাউশি এখানে কি করছে?ব্যস্ত মিলি বোনকে খোঁজার জন্য যাচ্ছিলো তখনই রাউশির মতো কাউকে দেখে পিছু নেয়।আর যখন ভালোভাবে দেখলো যে এটা আসলেই রাউশি তখন ডাক দিলো।মিলি রাউশির কাছে এসে বলল,
“আমি কল্পনা করতে পারি নি যে তোমাকে পেয়ে যাব।”
রাউশি হাসলো।বলল,
“আমিও।”
দুজনের কথার মাঝে সেখানে একটি ছেলে আসলো।ছেলেটি মিলিকে একবার তো রাউশিকে একবার দেখলো।এরপর মিলির কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আহা, বিয়েবাড়িতে শত লাল গোলাপের মাঝে গিয়ে আজ আমার চোখ গিয়ে পড়লো একদম অন্যরকম সবুজ গোলাপের ওপর। তা মিলি এই সবুজ লাবণ্য গোলাপটি কোন কাননের?”
মিলি হেসে উঠলো বড় ভাইয়ের কথা শুনে। কাঁধ থেকে হাতটা সড়িয়ে দিয়ে বলল,
“এই সবুজ গোলাপটি যেই কাননেরই হোক তোমার ধরাছোঁয়ার বাইরে বুঝলে।”
মুখ ভেংচালো রাওনাফ।রাউশি তাদের কথাই শুনছিলো।রাওনাফ এবার রাউশির দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনার নামটা কি জানতে পারি মিস?”
রাউশি আড়চোখে একবার আশেপাশে তাকালো।উত্তর দিলো,
“মৌরিন খান রাউশি।”
“ওয়াও!হোয়াট এ নেইম।”
তখনই সেখানে আগমন ঘটে মেহরানের। সোজা রাউশির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।মিলি দেখে চিনলো মেহরানকে।রাওনাফ চিনতে পারলো না।মিলি হেসে জিজ্ঞাসা করলো,
“ভাইয়া কেমন আছেন?আমি রাউশির বান্ধবী মিলি।”
মেহরান হাসিমুখেই জবাবটা দিলো,
“আলহামদুলিল্লাহ। আশা করি তুমিও ভালো আছো মিলি।”
মিলি মাথা নাড়ালো।মেহরান রাউশির দিকে তাকালো আর বলল,
“তোর মা ডাকছে তোকে।”
রাউশি বুঝলো লোকটার নিশ্চিত সহ্য হচ্ছে না রাওনাফ এখানে থাকায়।রাউশি মিলির হাত ধরে নিজের দিকে টেনে বলল,
“ঠিক আছে আমি আর মিলি যাচ্ছি।”
মিলিকে নিয়েই হাঁটা ধরলো রাউশি।মেহরান তাকিয়ে থাকলো সেদিকে।রাওনাফ কিছুটা হলেও আন্দাজ করলো বিষয়টা হেসে মেহরানকে বলল,
“তাহলে__”
মেহরান রাওনাফের দিকে তাকালো।এই ছেলেটাকে একটু আগে দেখেছে সে। পাত্রের চাচাতো ভাই।অনেক্ষণ যাবৎই রাউশিকে ফলো করতে দেখেছে মেহরান। তাইতো কিছুটা জেলাস হয়েই এলো এদিকে।রাওনাফের কথা শেষ করার আগেই জবাব দিলো,
“সবুজ এই গোলাপটা আমার কাননের অতি সযত্নে বেড়ে ওঠা ফুল।”
কথাটা বলেই চলে গেলো মেহরান। রাওনাফ হাসলো।মেহরান নুজাইশের কাছে গেলো। ছেলেটা সিগারেট খাচ্ছে। মেহরানকে দেখে মেহরানের দিকে একটি সিগারেট এগিয়ে দিলো।মেহরানও হাত বাড়িয়ে নিলো।এপাশে মানুষজন নেই। জায়গাটা সুনসান, নিরব।এইপাশটায় আঁধারেরা রাজত্ব করছে নির্ধিদ্বায়।মেহরান সিগারেটটা মুকজে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“এই অভ্যাস কবে থেকে?”
নুজাইশ সহসা বলল,
“যেদিন থেকে পছন্দের মানুষের আসল পরিচয় জেনেছি।”
মেহরান সিগারেটে এক টান দিয়ে ঠোঁট উচিয়ে ধোঁয়া নিঃসৃত করলো,
“বাড়ির বাগানে যেদিন একটি গোলাপ ফুঁটলো সেদিন আমিই বেশি খুশি হয়েছিলাম।ছোট থেকেই মনে একটা ধারণাই পুষে রেখেছিলাম ফুলটা বড় হলে একান্তই আমার নিজের মৃত্তিকায় রোপণ করে রাখবো একদম সমূলে ।তবে সেই আশায় জল ঢেলে দিলো গোলাপ গাছটার মালিক।আমি অন্যত্র যাওয়ার পর মালিক চাড়াসহ তুলে অন্যত্র দিয়ে দিলো।আমার সমস্ত আশায় ঢেলে দিলো এক বালতি পানি।নিরাশায়, হতাশায় দিন কাটছিলো আমার।তুই নিজেও সাক্ষী।তবে সেই হতাশার মাঝে আমার অন্ধকারত্ব একটা সময় আলোর সমীপে আসলো।গোলাপের চাড়াটা সুস্থসমেত আবারও বাড়ির আঙ্গিনায় রোপণ করা হলো।একবুক আশা নিয়ে দেখলাম চাড়াটা। তখনও কত তরতাজা আর কাটায় ভর্তি।তবে ধীরে ধীরে বাড়ির আঙ্গিনা থেকে মনের আঙ্গিনায় আসতে শুরু করেছে।”
নুজাইশের কাঁধে হাত রাখলো,
“এখন বল আমি কোনো ভুল করেছি?”
নুজাইশ পুরো কথাটা শুনেছে মন দিয়ে।সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে বলে,
“আসলে গোলাপ এতই আকর্ষণীয় যে সবার নজরেই পড়ে যায়।শালা সাবধানে রাখতে পারিস না?”
মেহরান হেসে উঠলো।নুজাইশ আবার বলল,
“আমি নাহয় ছ্যাকাটা খেয়ে সাধু হয়ে গেলাম অন্যদের থেকে সাবধান।”
মেহরান সিগারেটে আরেক টান দিয়ে বলল,
“মেহরানের সম্পদ মেহরান আগলে রাখতে জানে।”
চলবে……
(কেমন আছেন সবাই? আমি এখন ভালো আছি।অনেকদিন পর গল্প দিচ্ছি।তবে মনে হচ্ছে কতবছর পর গল্পটা দিচ্ছি।এবার থেকে প্রতিনিয়ত দেওয়ার চেষ্টা করবো।রিচেইক দেওয়া হয় নি।ভুলক্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
নিয়মিত নতুন রাইটারদের গল্প পেতে যুক্ত থাকুন আমাদের গল্পকথন গল্পের গ্রুপে
https://facebook.com/groups/348681567718045/