#মেহেরজান
লেখনীতে – #সোহামণি
পর্ব ২০ (প্রথম অংশ)
গাড়ির সামনে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে রাউশি।সবাই যাতে একগাড়িতে করেই যেতে পারে তাই একটি মাইক্রো বাস নেওয়া হয়েছে।রাউশি ভেবেছিলো সে আজ তার মায়ের সাথে যাবে তবে তার পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার পথে।রাউশিকে মুর্তির মতো গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নাহিন এসে ধমকে বলল,
“তোকে এখানে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকার জন্য বলা হয়েছে নাকি?সড় যা।”
রাউশি চোখ গরম করে তাকালো নাহিনের দিকে।পরক্ষণেই মনে পড়লো ‘ওহ আমি তো চশমা পড়ে আছি।’ এটা ভেবে নিজেকে নিজেই গালি দিলো একটা।গাড়িতে উঠে পড়লো।সবার সামনের সিটটাই বসতে চেয়েও বসলো না।বরং দেখতে লাগলো নাহিন কোন সিটে বসে।নাহিন গিয়ে সবার পেছনের সিটের আগের সিটে বসেছে। রাউশিও নাহিনের পাশে গিয়ে বলল,
“এই নাহিন সড় আমি তোর পাশে বসবো।”
নাহিন বিনাবাক্য ব্যয়ে জানালার পাশে বসলো।রাউশি এখানে জানালার কাছে বসতে চেয়েও বসলো না কারণ জানালার কাছের সিটটাই বসলে মেহরান যেকোনো মুহুর্তে এসে নাহিনকে সড়িয়ে সেখানে বসতে পারে। তাইতো এই পরিকল্পনা করে নিজেই বাঁকা হাসলো।একে একে সবাই উঠে পড়লো।বড়রা সামনের সিটগুলোতে বসলো স্বামী স্ত্রী মিলে।আর ছেলেমেয়েরা পেছনের দিকে আসা শুরু করলো।মাইশা কানে হেডফোন গুজে সামনের সিটে হাটু ভর দিয়ে কেমন অদ্ভুতভাবে বসে ছিলো।মাইশাকে ধাক্কা দিয়ে জানালার পাশের সিটে ফেলে তানজিম সেখানে বসে পড়ে।মাইশা হেডফোন সড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“এটা কি হলো?”
তানজিম উত্তর দিলো,
“যা হওয়ার হলো।”
“আমি তোমার পাশে বসবো না।”
“কিন্তু আমি তো তোর পাশেই বসবো।”
মাইশা উঠে যাওয়ার জন্য রেডি হতেই তানজিম ওর হাত ধরলো আর জোর করে বসিয়ে মাইশার পাশে একটু চেপে গিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
“একদম ওঠার চেষ্টা করবি না। নয়তো ফল খারাপ হবে।”
উজান পাশ দিয়েই যাচ্ছিলো।ওদের তানজিম আর মাইশাকে একসাথে দেখে হেসে ফেললো।তানজিমের কাঁধে চাপড় মেরে বলল,
“ভালোই তো চলছে মামা।টেম্পু কতদূর গেলো আমাকেও জানিও মাঝেসাঝে। সবারই হয় শুধু আমারই হয় না।”
বলে আফসোস করতে করতে রাউশির বিপরীত পাশের সিটে গিয়ে বসে পড়লো। রাউশি উজানকে দেখে হাসলো।উজানও মিষ্টি হাসি উপহার দিলো।উজান রাউশির পাশে থাকা নাহিনকে দেখে আফসোসের সুরে বলল,
“হায় আল্লাহ।আজ যে নাহিনের কি হবে আমি সেটাই ভাবছি?”
কথাটা শুনে তড়িৎ বেগে উজানের দিকে তাকালো নাহিন।চোখেমুখে খেলে গেলো বিস্ময়।জানতে চাইলো,
“কি হবে?”
উজান এখন কিভাবে বলবে যেখানে রাউশিই বসে আছে।এই নাহিনও না অনেক বোকা।এই ছেলেকে বললেও বুঝবে না।চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করে সিটে হেলান দিয়ে বসে পড়লো।নাহিনও আর পাত্তা না দিয়ে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।রাউশি সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।মেহরান এখনও উঠে নি।পাশ ফিরে উজানকে দেখে কানে হেডফোন গুজে গান শুনছে আর হেলান দিয়ে বসে আছে।আবারও সামনে তাকাতেই রাউশি চমকে গেলো।মুখ ফুটে আওড়ালো,
“এই লোক এখানে কি করছে?”
নুজাইশ বাসে উঠতেই চোখ গেলো সর্বশেষে থাকা রাউশির দিকে।রাউশিকে দেখা মাত্রই হাত নাড়ালো নুজাইশ।রাউশি চশমা পড়ে থাকাই বুঝলো না কোনদিকে তাকিয়ে আছে।মাহবুব খানকে সালাম জানালো নুজাইশ।মাহবুব খান বললেন,
“তোমাকে আশা করি নি।”
“আসলে আঙ্কেল বাসায় একটা বড়সড় সমস্যা হয়েছে আমাকে নিয়ে।বাঁচার জন্য মেহরানের থেকে পরামর্শ চেয়ে মেহরান আমাকে আপনাদের সাথে সিলেট যাওয়ার কথা বললো।আমিও রাজী হয়ে গেলাম।”
মাহবুব খান বললেন,
“ভালো করেছো।আমাদের সাথে ঘুরে ফিরে এসো কয়েকদিন মন ভালো হয়ে যাবে।আর তোমার বাড়ির পরিস্থিতিও ভালো হয়ে যাবে।”
“থ্যাংকস আঙ্কেল।”
নুজাইশ সামনে এগিয়ে গেলো।তার বাবা মায়ের তার আর মিলির বিয়ের ব্যাপারটা শুনেছিলো নুজাইশ।আজ রাতেই যে তার মা তাকে এই বিষয়ে বলে কয়ে রাজী করানোর গোপন প্ল্যান করেছেন সেটা জেনে নুজাইশ মেহরানের থেকে সাহায্য চাইলে মেহরান তাদের সাথে যাওয়ার জন্য বলে।নুজাইশও এক পায়ে রাজী হয়ে যায়।মিলি ভালো মেয়ে তবে নুজাইশের পক্ষে দ্বিতীয় কাউকে জীবনে আনা সম্ভব নয়।সে একা থাকতে চায় আজীবন।রাউশিকে পায় নি তো কি হয়েছে তাই বলে যে খুব সহজেই ভুলে যাবে এমনটাও নয়।তবে পাওয়ার আশা বা আকাঙ্ক্ষাও যে করবে এমনটাও নয়।প্রিয় বন্ধুর হবু স্ত্রী রাউশি তার দিকে তাকাতেও কেমন দ্বিধা হলেও এক পাক্ষিক একটা অনুভুতি সেটা আজীবন রয়ে যাবে নুজাইশের মাঝে।নুজাইশ হতাশ নয় বরং খুশি যে রাউশি অন্তত ভালো বাকি জীবনে খুব সুখী হবে।এমন একটা পর্যায়েই থাকবে যেখানে ভালোবাসা যাবে না,আশা রাখা যাবে না তবে দূর থেকে শুধু দেখা যাবে। নুজাইশ মনে মনে ভাবে এটাই থাকুক। এতেই নুজাইশ সুখী হবে।তবুও জীবনে কাউকে আনা সম্ভব নয় তার পক্ষে।
নুজাইশের পেছন পেছন মেহরানও উঠলো গাড়িতে।প্রথমেই চোখ গেলো নাহিনের পাশে বসা রাউশির দিকে।নুজাইশ রাউশির কাছে আসতেই জিজ্ঞাসা করলো,
“এই রাউশি কেমন আছো?”
রাউশি সৌজন্য হেসে জবাবে বলল,
“ভালো আছি স্যার।আপনি কেমন আছেন?”
“ভালো ছিলাম না।তবে খান পরিবারের সাথে সিলেট যেতে পারবো তাই এখন ভালো আছি।”
রাউশি হাসলো।নুজাইশ কথা না বাড়িয়ে পেছনে গিয়ে বসলো।মেহরানও আসলো। আড়চোখে রাউশির দিকে একবার তাকালো।রাউশি চশমা পড়ে থাকাই দেখলো তা তবে মেহরান রাউশির চাহনী দেখতে পেলো না।মেহরান গিয়ে নুজাইশের পাশে বসলো।নুজাইশ ফোনটা হাতে নিয়ে কিছু একটা করলো।মেহরানও নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।রাউশি পড়েছে বেকায়দায়।এখানে এত ছেলের মাঝে সে একা পড়েছে।সামনে দেখতে থাকে কোথায় সিট খালি আছে?তখনই চোখ যায় তানিয়ার দিকে।তানিয়ার পাশের সিটটা খালি।রাউশি শুকনো ঢোক গিলে উঠে দাঁড়িয়ে তানিয়ার পাশের সিটে গিয়ে বসে পড়ে।তবে এদিকে নাহিন ব্যাথায় কুকড়ে ওঠে।রাউশির পা দ্বারা ভুলবশত নাহিনের পা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। নাহিন চোখমুখ কুঁচকে বলে,
“তুই তো হাতি রে।এই শরীর নিয়ে চলিস কিভাবে?”
রাউশি মুখ ভেংচালো নাহিনকে।পেছনে বসা নুজাইশ হাসলো।উজানও হাসলো।তবে মেহরান গম্ভীর ভঙ্গিতে ফোন চালাতেই ব্যস্ত। যেন এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এখন ফোন চালানো।রাউশি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফোন হাতে নিলো।তখনই একটি মেসেজের নোটিফিকেশন আসলো তার ফোনে।রাউশি সেখানে ক্লিক করতেই দেখলো মেহরানের মেসেজে।একপলক পেছনে তাকিয়ে দেখলো মেহরান স্বাভাবিক ভাবেই বসে আছে।আবারও ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেহরান মেসেজে লিখেছে,
“তোর এমন বাজে কাজের জন্য, সিলেট পৌঁছানোর পরপরই গুরুতর একটি শাস্তি দেব তোকে।”
রাউশির পিলে চমকে উঠলো।কি বাজে কাজ করেছে রাউশি ভাবতে লাগলো। রাউশি এটাও চিন্তা করতে লাগলো কিভাবে এই লোকটার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবে। পরমুহুর্তেই মনে পড়লো সিলেটে গেলে রাউশি সবসময়ই তার মায়ের পিছু পিছু থাকবে।তাহলে তো হলোই।রাউশি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সিটে হেলান দিলো।রাত নয় তবুও রাউশির খুব ঘুম পাচ্ছে।সিদ্ধান্ত নিলো এখন কিছুক্ষণ ঘুমাবে।তানিয়া নিজমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।রাউশি সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো। এখন কিছুক্ষণ ঘুমানো জরুরি তার।চোখ বুজতেই ঘুমিয়ে গেলো রাউশি।
রাউশির ঘুম ভাঙলো গাড়ির হর্নের শব্দে। ঢুলুঢুল চোখ খুলতেই আগে পাশে ফিরে দেখলো সে গাড়ির জ্যাম রাস্তায়।তাদের গাড়িটাও এই জ্যামের কবলেই পড়েছে। রাউশি আবারও চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়লো। রাউশির নাকে পরিচিত একটি পারফিউমের ঘ্রাণ ভেসে আসলো।এই পারফিউমের ঘ্রাণ তার খুব পরিচিত।রাউশির মস্তিষ্ক জাগ্রত হলো মুহুর্তেই।চোখ খুলে পাশে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো গম্ভীর মুখে চোখ বন্ধ করে বসে থাকা মেহরানকে।এটা দেখেই চমকে উঠলো রাউশি।রাউশি দেখলো সে জানালার কাছে বসে আছে আর মেহরান তার পাশেই বুকে দুহাত গুজে চোঝ বুজে বসে আছে।রাউশি মাথা উঁচিয়ে দেখলো সামনে পেছনে।তানিয়াকে দেখলো নাহিনের পাশে বসে ঘুমাচ্ছে।এমনকি গাড়ির সবাই ঘুমাচ্ছে।শুধু পেছনে নুজাইশকে জাগ্রত অবস্থায় বসে থাকতে দেখলো রাউশি। রাউশি হাতের নখ কামড়ানো শুরু করলো। ভাবছে কিভাবে কি করবে?
“এভাবে নখ কামড়াচ্ছিস কেন?ক্ষুদা লাগলে বল খাবার দিচ্ছি।কিন্তু নখ কামড়ে কি বোঝাতে চাইছিস তোকে ঠিকমতো খাবার দেওয়া হয় না বাড়িতে?”
চলবে…..
(পর্বটা ছোট হলেও কিছু করার নেই।আমি ইদানীং খুবই ব্যস্ত।তবুও ফাকফোকর পেলেই গল্পটা লেখার চেষ্টায় থাকি।আশা করি সকলে বুঝবেন।ভুলক্রুটি হলে ক্ষমা করবেন।।)