মেহেরজান লেখনীতে- সোহা সূচনা পর্ব

0
95

দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে তিনবছর পর বাড়িতে ফিরলো আয়াশ।রাউশি শুধু স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে। তিনবছর আগে আয়াশ আর তার বিয়ে হয়েছে।তবে আয়াশ বিয়ের পর আর একমুহুর্তও সেখানে না থেকে কোথাও চলে গিয়েছিলো।শশুরবাড়িতে একাই থাকতে হয়েছে রাউশির।পরে খোজখবর নিয়ে জানা যায় আয়াশ জার্মানী চলে গিয়েছে।এরপর কেটে যেতে থাকে দিন।শশুরবাড়ির সকলেই রাউশিকে পছন্দ করতো শুধু আয়াশ বাদে।তিনবছরে একটিবারও রাউশির সাথে কথা বলার প্রসঙ্গ তুলে নি সে।রাউশি সবকিছু হাসিমুখে মেনে নিয়েছে।এইযে আজ নিজের স্বামীর পাশে তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে দেখে বুক ফেঁটে যাচ্ছে রাউশির।চোখে জল টলমল করছে। রাউশির শাশুড়ি আমেনা বেগম লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছেন।ছেলের এমন কাণ্ডে রায়হান সিকদারও লজ্জিত ভীষণ।একবার রাউশির দিকে তাকাতেই বুক ফেঁটে যাবার উপক্রম তার। রাউশি তার বোনের মেয়ে।বছর তিনেক আগে ছোট বোন রূপার কাছে তার ছেলের জন্য রাউশির হাত চেয়েছিলেন রায়হান সাহেব।প্রস্তাব পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়েছিলো যেন রাউশির মা।তবে মাহমুদ খান নারাজ ছিলেন এ বিষয়ে।স্ত্রীর কথায় তিনিও একটা সময় গিয়ে রাজি হন।ধুমধাম করে বিয়ে দিলেও সেদিনের আয়াশের ঘটনায় বেশ ক্ষিপ্ত মাহমুদ খান।রাউশি বাবাকে অনেক রিকোয়েস্ট করার পরই শান্ত হয়েছিলেন তিনি।রাউশিকে নিজ বাড়িতে থাকার কথা বললে রাউশি জোর করে শশুর বাড়ি থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।এতে আর কেউ দ্বিমত পোষণ করে না।সবই ঠিক চললেও আয়াশের কার্যকলাপ মোটেও ঠিক ছিলো না।এ নিয়ে অনেকবার বাবা ছেলের কথা কাটাকাটি হয়েছে। তবে এমন দিনও যে দেখতে হবে এটা মোটেও কারোর কল্পনায় ছিলো না।

“মা আমাদের কি দরজার সামনেই দাড় করিয়ে রাখবে নাকি?ভেতরে ঢোকাবে না?”

ছেলের কথা শুনে রায়হান সাহেব ছেলের নিকট গিয়ে জোরে একটি চড় মেরে বসেন।আয়াশ হতবম্ভ হয়ে যায়।সাথে তার সদ্য দ্বিতীয় স্ত্রী অনিমাও যেন ভড়কে যায়।আয়াশ হতবম্ভ হয়ে বলে,
“আমায় মারলে কেন?কি করেছি আমি?”

রায়হান সাহেব চেচিয়ে বলেন,
“তুই এখনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। তোর মুখও দেখতে চায় না আমরা।”

রাউশি তৎক্ষনাৎ রায়হান সাহেবের কাছে গিয়ে বলে,
“মামা এমনটা করো না।উনাকে ভেতরে আসতে দাও।আমিই একটু পর চলে যাব।প্লিজ কোনো সিনক্রিয়েট করো না।”

আয়াশের এমনিতেই মেজাজ চটে গিয়েছিলো রাউশির এমন কথা শুনে আরও বেশি রেগে যায়।কাছে এসে রাউশির গালে চড় মেরে বসে আয়াশ।আর বলে,
“তোর জন্য হয়েছে এসব কিছু।তোর জন্যই বাবা আমায় আজ চড় মারলো।তুই এখনই চলে যা এখান থেকে।”

আয়াশের কথা শুনে রায়হান সাহেব কিছু বলতে যাবে তবে রাউশি বাধা দেয়।আয়াশের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে,
“পছন্দ ছিলো না তিনবছর আগে বিয়ের দিন না করে দিলেই পারতে আয়াশ ভাই।এত কিছুর কোনো প্রয়োজন ছিলো না।যাই হোক আমি চলে যাচ্ছি।
সুখে থেকো।তোমার নতুন জীবন সুন্দর হোক আয়াশ ভাই।”

কথাটা বলে একদৌড়ে নিজের রুমে চলে যায় রাউশি।রাউশির কথা শুনে কানে হাত দেয় অনিমা। যেন খুবই বিরক্তিকর ছিলো।আয়াশ রেগে আছে। আমেনা ছেলের কাছে এসে বলেন,
“এমনটা করার আগে একটাবার ভাবলি না রে?”

“কি ভাববো?ভাববার সময় দিয়েছিলো তোমরা তিনবছর আগে?নাকি তোমরাও ভেবেছিলে?হুট করেই বিয়ে দিয়েছিলে তোমরা সেদিন, আমার অমত থাকা সত্ত্বেও।এটার প্রায়শ্চিত্ত করলাম আমি।সড়ো তো এমনিতেই ক্লান্ত আমি।রুমে যেতে দাও আমাদের।”

অনিমার হাত ধরে বাবা মাকে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে চলে যায় তারা।রায়হান সাহেব আর আমেনা হতবম্ভ হয়ে চেয়ে থাকেন শুধু ছেলের এমন ব্যবহার। ছেলে অনেক পালটে গিয়েছে,অনেক।বাবা মা হিসেবে খুবই লজ্জিত রায়হান সাহেব এবং আমেনা বেগম।

কিছুক্ষণ পর ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে রাউশি। রায়হান সাহেব এবং আমেনা বেগমের দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকায় একবার।আমেনা বেগম উঠে এসে জড়িয়ে ধরে রাউশিকে।উনি কাঁদছেন। রাউশিও কাঁদছে।রায়হান সাহেব মাথা তুলে তাকাতেও পারছেন না।সাহসে কুলাচ্ছে না আর।রাউশি বলে ওঠে,
“মামা আমি চলে যাচ্ছি।ভালো থেকো তোমরা। আয়াশ ভাইয়াকে কিছু বলিও না আবার।উনি ভালো থাকুক আজীবন এই দোয়ায় আল্লাহর কাছে করি।”

রায়হান সাহেবের চোখ বেয়েও দু এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে।তখনই ওপর থেকে নিচে নেমে আসে আরিশা।রাউশির কাছে এসে হাত দুটো ধরে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে ওঠে,
“এই রাউশি কোথায় চলে যাচ্ছিস তুই?তোকে ছাড়া আমার এক দণ্ডও থাকতে ভালো লাগবে না রে।”

রাউশি আরিশাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমাদের আবার দেখা হবে।তবে আমি আর এক সেকেন্ডও এই বাড়িতে থাকতে পারবো না রে আরিশা।তোরা ভালো থাকিস।আমি আসছি।”

খুব কষ্টে বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে আসে রাউশি।চোখ দুটো ভেজা।এদিকে ভেতরে আরিশা হাউমাউ করে কাঁদছে।রায়হান সাহেবের চোখেও জল।আমেন বেগম শাড়ির আঁচলে মুখ বুজে কাঁদছেন।মেয়েটা যে অনেক আপনজন হয়ে গেছিলো এই তিনবছরে।কিন্তু আজ কি থেকে কি হয়ে গেলো?

বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হাটা ধরে রাউশি।বাবার বাড়িতে যাবে কিনা চিন্তা করছে।তার বাবা তাকে বলে রেখেছিলেন তার বাবার বাড়ি তার জন্য সবসময়ই খোলা।এখন একমাত্র নিরাপদ স্থান সেটিই হতে পারে।একটা সিএনজি দাড় করায় রাউশি। ঠিকানা বলতেই সিএনজি ওয়ালাও রাজি হয়ে যায়। সিএনজিতে উঠে রাউশি চলে যায়।বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে আয়াশ।তবে তার মাঝে কোনো অনুতপ্ত নেই।
আধঘণ্টা পর বিশাল বড় বাড়িটির সামনে এসে থামে সিএনজিটি।ভাড়া মিটিয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে গেইটের সামনে যেতেই দারোয়ান রাউশিকে চিনতে পেরে হেসে বলে,
“আরে রাউশি মা!তুমি আইসো?যাও যাও আজকা তোমার কাকা,ফুপু সবাই আইসে বাড়িত।”

কথাগুলো শুনে রাউশি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায়।এতগুলো মানুষের সামনে পড়তে হবে এখন তাকে।মোটেও ভালো হবে না এটা।এদিকে না গেলেও এখন কোথায় যাবে রাউশি।না চাইতেও বাড়ির ভেতরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রাউশি।গেইট থেকে তাদের বাড়িতে যাওয়ার রাস্তাটা ভীষণ সুন্দর।রাস্তার পাশেই বাগানে ভরপুর।আস্তে ধীরে হেঁটে একটা সময় সদর দরজার সামনে দাঁড়ায়।ভেতর থেকে শোরগোলর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।রাউশি একবার উঁকি দিয়ে দেখে কে কে আছে?উঁকি দিচ্ছিলো সেসময়ে কেউ পেছন থেকে বলে ওঠে,
“এই মেয়ে কে তুমি?”

কথাটা শুনে চমকে ওঠে রাউশি।পেছন ফিরে তাকাতেই লম্বা চওড়া সুঠাম দেহী এক মানবকে দেখে ভড়কে যায়।শুকনো ঢোক গিলে কিছু বলার আগেই ভেতর থেকে রাউশির মা বলতে বলতে আসেন,
“কি হয়েছে?”

বাইরে আসতেই রাউশিকে এমন অবস্থায় দেখে রাউশির মার রূপা।মেয়েকে হেসে জড়িয়ে ধরেন। আর বলেন,
“রাউশি মা তুই?কখন এলি?”

রাউশি নামটা শুনে সেই মানুষটি ভ্রুকুটি কুচকে ফেলে।রূপা মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলে,
“মেহরান বাবা। ও আমাদের রাউশি।চিনতে পেরেছো?”

মেহরান ভালোভাবে তাকিয়ে দেখে।মেহরান আজই দেশে ফিরেছে আজ প্রায় ১৮ বছর পর।১৮ বছর আগে দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলো উচ্চ শিক্ষার জন্য।এখন দেশে ফিরেছে বাবা মাহবুব খানের ব্যবসা সামলানোর জন্য।মেহরান যখন ১২বছর বয়স রাউশি তখন ৩ বছরের ছোট্ট বাচ্চা।এখন সেই মেয়েটা কতবড় হয়ে গেছে।মেহরান রাউশির দিকেই তাকিয়ে থাকে।সে শুনেছিলো রাউশির বিয়ে হয়ে গিয়েছে।অথচ রাউশিকে মেহরান ছোটবেলায় কত আদর করতো আর ভালোবাসতো।বড় হওয়ার পর মেয়েটার চেহারা কখনো দেখেনি মেহরান।আজই দেখছে।গম্ভীর ভাব ফুটিয়ে রূপাকে বলে,
“চিনতে পেরেছি ছোট মা।গাধাটা বড় হয়ে গেছে।”

রূপা হেসে ওঠেন।তবে তিনি এখনও বুঝতে পারছেন না।মেয়ে হঠাৎ এখানে কি করছে না বলে কয়ে এসেছে আবার।রাউশি মেহরানের গাধা সম্বোধন শুনে রেগে যায়।এমনিতেই মন মেজাজ ভালো নেই।তারওপর এমন সম্বোধন মাথা খারাপ করার মতোই।মেহরান রাউশির দিকে একপলক তাকিয়ে চলে যায় বাড়ির ভেতরে।রাউশির লাল লাল চোখ দুটো দেখে রূপা হাসি থামিয়ে চিন্তিত স্বরে বলেন,
“কি হয়েছে মা তোর?”

রাউশি আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলে।বলার মতো ভাষা খুজে পাচ্ছে না রাউশি।মাকে জড়িয়ে ধরে বাহিরেই কেঁদে যাচ্ছে শুধু।

#চলবে

#মেহেরজান
লেখনীতে- সোহা
সূচনা পর্ব

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here