ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-৬)
হালিমা রহমান
হানিফ পরিবহনের বাসটা দাঁড়িয়ে আছে শ্যামলী বাস স্টেশনে।সাদা রঙের বাসের নরম সিটে মাথা এলিয়ে দিয়েছে তথা।চোখের পাতা দুটো বন্ধ।ডান হাতে তিনটে কদম ফুল।ফুল তিনটে এখনো সতেজ।তথা চোখ খুলে একবার তাকায় ফুলগুলোর দিকে।হলদে- সাদা ফুলে সবুজ পাতার সংমিশ্রণ। দেখতে মন্দ নয়। কদম ফুল অনেকের বাড়াবাড়ি রকমের পছন্দ হলেও তথার খুব বেশি একটা ভালো লাগে না।তথার পছন্দ কলমি লতার ফুল।আদুরে ফুলগুলো দেখতে বেশ সুন্দর হলেও ঘ্রাণ নেই।তথা জানালার পাল্লা খুলে দেয়।জানালার পাশের সিটে বসেছে সে।বাস ছাড়বে সাড়ে নয়টায়।অল্প কিছুক্ষণ সময় আছে আর।কেউ কেউ এসেছে।আবার কিছু কিছু সিট এখনো খালি।ডিরেক্টর, খোকন,শাফিন,পুনম —এরা কেউ আসেনি এখনো।যারা এসেছে তারা বেশিরভাগই জুনিয়র আর্টিস্ট। সবাই নতুন।একগাদা অচেনা মুখের মাঝে বসেও অস্বস্তি হচ্ছে না তথার।বাসের বেশিরভাগ যাত্রী মেয়ে।কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না,একে অন্যের সাথে পরিচিত হচ্ছে না।মাথা ঝুকিয়ে মোবাইলের দিকে চেয়ে আছে।তথার পাশের মেয়েটার নাম সোনালী।মেয়েটা তথার চাইতে ছোট হবে।সেও বসে বসে মোবাইল দেখছে।তথা জানালার বাইরে মাথা বের করে।রাস্তার কোল ঘেষে স্বল্প পরিচিত বাইকটা এখনো দাঁড়ানো।মানুষটা নেই কেবল।তথা মাথা ভিতরে নিয়ে আসে আবার।ইরফানের আচরণগুলো কেমন যেন পাগলাটে।সরাসরি প্রত্যাখানের পরেও কেউ এমন করে?এরকম নির্লজ্জ মানুষ আর কোথাও দেখেনি তথা। একটু আগে কি কান্ডটাই না করলো! ইরফান যখন এক আকাশ আবেগ নিয়ে ফিসফিস করে প্রণয়কথা বলছিল,তথা তখন বিস্মিত চোখে চেয়ে ছিল মানুষটার দিকে।যেভাবে কথা বলেছিলো মনে হচ্ছিল যেন ইরফান এখন কেঁদেই দিবে।ইরফানের আক্ষেপের শেষেই তথা ব্যস্ত পায়ে দু’পা পিছিয়ে যায়।কাজটা আরো আগেই করা উচিত ছিল। কিন্তু অবাকের রেশ কাটিয়ে, কর্তব্য পালনে মনোযোগ দেওয়ার মতো মন-মানসিকতা ছিল না তথার।তথা রাস্তার আশে-পাশে দ্রুতগতিতে চোরের মতো নজর বুলায়।কোনোভাবে কাকা আবার দেখে ফেললো না তো?
—” তথা,সারাদিন তোমাকে মনে পড়বে আমার।তোমার অজান্তেই তোমাকে অনুসরণ করতাম।অভ্যাসগুলো পোড়াবে খুব।সাবধানে থেকো,ভালো থেকো।কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার সাথে আর দেখা হবে না।এতোদূরে না গেলে হয় না?”
—” আপনি কি পাগল,ইরফান ভাই?আর এসবের মানে কি হ্যাঁ? কাজ নেই আপনার?আপনাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।আত্মসম্মানে লাগেনি একটুও?আপনার মতো ভয়াবহ নির্লজ্জ আর কোথাও দেখিনি। “—– তথার কন্ঠে ঝরে পড়ে তীব্র আক্রোশ ।
ইরফান মুচকি হাসে।এক ভ্রু উঁচু করে বলেঃ ” আত্মসম্মান থাকলে আবার প্রেম যুদ্ধে নামতে পারতাম?তুমি জানো না,প্রেম আর আত্মসম্মান পরস্পর বিপরীতমুখী? এরা কখনো সমানতালে এক পথে চলে না।”
—” ছিঃ! কতটা আত্মসম্মানহীন আপনি।একবার চিন্তা করে দেখেছেন?আত্মসম্মান যার না থাকে সে আবার মানুষ হয় নাকি?”
—” তোমার চিন্তা- ভাবনা আমার সাথে মিলে না।আমার কথা তুমি বুঝতে চাও না,তোমার কথাও আমি বুঝতে পারি না।তাই সব বাদ দাও।তোমার জন্য একটা গিফট এনেছি।নিতেই হবে।না নিলে যাব না এখান থেকে।”
—” আপনি এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাবেন।আমি প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছি। বুঝতে পারছেন না কেন,বলুন তো।”
—” আমিও এতোবার বলছি ভালোবাসি,তুমি কেন বুঝতে চাইছো না বলো তো?”
—” এই একঘেয়ে প্যানপ্যানানি বন্ধ করুন।বিরক্ত লাগছে এখন।অসহ্য!”
—” দয়া-মায়াহীন পাষাণ নারী একটা।অসহ্য!”
তথা কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকে। প্রেমের প্রস্তাব তার জন্য পুরোনো হলেও এরকম পাগলামি তার জন্য একদম নতুন। এসব পাগলামি আকর্ষণ নয় বিরক্ত করছে তাকে। রাস্তার পাশ থেকে আস্ত ইটটা নিয়ে ইরফানের মাথায় ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে করছে তথার। এ মানুষ নয়, এ যেন জীবন্ত ফেবিকল আঠা।পিছু লেগেছে তো লেগেই আছে,ছাড়াছাড়ির নাম নেই।
—” তোমার জন্য তিনটে কদম এনেছি।আমার সবচেয়ে পছন্দের ফুল।এখন কদম ফুল পাওয়া
খুব কঠিন ব্যাপার, বুঝলে।বহু কষ্টে খুঁজে খুঁজে বের করেছি।”
ইরফানের হাতের আকর্ষণীয় ফুলগুলো তথার মনোযোগ কাড়তে পারে না।তার মনোযোগ এখন কেবল ইরফানের দিকে।এতোদিন ইরফানের অনুভূতিগুলো যেন শক্ত কোনো চাদরে মুড়ে ছিল।আজকাল বন্যার পানির মত হুড়মুড় করে বাড়ছে।আগেই তো ভালো ছিল।কথা-বার্তা বলতো না,সামনে দাঁড়াতো না।কিন্তু এখন? তথার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে একদম।
—“এই নেও। এই ফুলগুলো তোমার।দারুন না দেখতে?”
—‘ আপনি বললেই আমি নিয়ে নেব?অযথা চেষ্টা করছেন,ইরফান ভাই।আপনি খুব ভালো একজন মানুষ। আপনার মূল্যবান সময়গুলো আমার পিছনে নষ্ট করবেন না প্লিজ।অন্যকারো পিছনে সময় দিন।যে আপনাকে গুরুত্ব দিবে,ইচ্ছাকে সম্মান করবে,আপনার অনুভূতিকে বুঝতে পারবে, কদর করবে।আমার দ্বারা এসব হবে না।আশা করছি আপনি আমার কথা বুঝতে পারছেন।দোয়া করি আপনি যাতে সঠিক মানুষকে চিনতে পারেন।পাগলামিগুলো তার জন্য তুলে রাখুন।আমার মতো ভুল মানুষের জন্য পাগলামি করবেন না,প্লিজ।ভালো থাকবেন,আসছি।”
যে ধিক্কার অথবা তাচ্ছিল্যে পরিবর্তন হয় না,তাকে ঠান্ডা মাথায় বুঝাতে হয়।ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে পুরোটা পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিতে হয়।ঠিক সেই পথটাই ধরলো তথা।আশা করা যায়, এখন ইরফান বুঝতে পারবে।অকারণে তাকে আর বিরক্ত করবে না।
ইকবাল মিয়া পাঁচ মিনিটের কথা বলে, দশ মিনিট পরে ফিরলেন।তার হাতে কিছু শুকনো খাবার।তিন প্যাকেট চিপস,এক প্যাকেট চানাচুর আর দুই প্যাকেট নোনতা বিস্কিট। বাইরের এই খাবারগুলো খুব পছন্দ করে তথা।যাত্রাপথে কিছু শুকনো খাবার না হলে তার চলেই না।ইরফান ও তথাকে একসাথে দেখে খুব অবাক হলেন ইকবাল মিয়া।ইরফান খুব পরিচিত তার। কাউন্সিলরের ছেলে হিসেবে ছোট -বড় সবাই তাকে চিনে।এই ছেলেটা এখানে কি করছে? তথার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কেন?মনে একগাদা প্রশ্ন নিয়ে দ্রুতপায়ে এগিয়ে যান ভাতিজির দিকে। মেয়ের দিকে হাতের খাবারগুলো বাড়িয়ে দেন।অনুতাপের সুরে বলেনঃ” অনেকক্ষণ দাঁড় করায়া রাখছি এই রোইদের মাঝে।কাজের সাইড থেকা ফোন আসছিলো,তাই কথা শেষ করতে দেরি হইছে।”
—” সমস্যা নেই, কাকা।এতো খাবার কিনতে গেছ কেন?আমি একা এতোগুলো খাব নাকি?”
—” রাইখা রাইখা খায়ো।তা ইরফান বাবা, তুমি এই জায়গায় যে?”
—” এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম,এখানে এসে তথার সাথে দেখা।রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে তাই ভাবলাম কোনো সমস্যা হলো নাকি।তাই দাঁড়ালাম, আরকি।”
—” ওহ।তা শ্যামলীতে কোনো কাজ আছে নাকি তোমার?”
—” আমার বড় আপুর শ্বশুরবাড়ি শ্যামলীতে।ওর বাসাতেই যাচ্ছি।”
—” বুঝলাম।তথা মা, তাইলে আমি যাই এখন।ভাবসিলাম গাড়ি ছাড়লে তারপর যামু।কিন্তু, কাজের সাইডে এহন না গেলে চলব না।তুমি ভাল থাইকো।নিজের যত্ন নিয়ো আর কোন সমস্যা হইলে ফোন কইরা জানায়ো।ঠিক আছে?”
—” আচ্ছা, কাকা।তোমরাও ভালো থেকো।কাজের ফাঁকে কল দেব।একমাসেরই তো ব্যাপার।চিন্তা করো না।আমি শীঘ্রই ফিরে আসব।”
পরম স্নেহে মেয়ের মাথায় বার দুয়েক হাত বুলিয়ে দেন ইকবাল মিয়া।মেয়েকে রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না তার।মেয়েটাকে কষ্ট করে বড় করেছেন।এতোদিনের জন্য অচেনা জায়গায় একলা ছাড়তে কষ্ট তো হবেই।
—” আপনি এখনো যাননি! ”
—” উঁহু,ইচ্ছে করছে না।”
ইরফানের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তথা।একে আর বুঝিয়ে লাভ নেই।তারচেয়ে গাড়িতে যেয়ে বসে থাকাই ভালো।তথা গাড়ির দিকে দু-পা এগোতেই এক অভাবনীয় কান্ড ঘটায় ইরফান। দ্রুত গতিতে তথার পাশে যেয়ে তথার হাতে ফুল গুজে দেয়।তথা বাঘিনীর মতো গর্জে উঠার আগেই চাপা ধমক দেয় ইরফান।
—” খবরদার,বাড়াবাড়ি করবে না।আমার সাহস দেখার দুঃসাহস করো না।তোমার জন্য কষ্ট করে ফুলগুলো এনেছি।অন্তত আমার কষ্টের মূল্যটুকু দাও।”
তথা আর কথা বাড়ায় না।মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাড়াবাড়ি না করাই ভালো।সামান্য ফুলই তো।তথা গাড়িতে উঠে যায়।একবারের জন্যও পিছু ফিরে দেখে না ইরফানের মুখ।
***
—” আপু, আপনার কাছে পানি হবে?আমি আসলে পানি আনিনি।”
সোনালীর বিনয়ী প্রশ্নে কল্পনার সুতো কাটে তথার।মুচকি হেসে বলেঃ” হ্যাঁ, হবে।দাঁড়াও দিচ্ছি।”
সোনালীকে পানি দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও দিতে পারে না তথা।সেও ভুলে পানি আনেনি।ইকবাল মিয়া অনেক খাবার কিনে দিলেও পানি দেননি।হয়তো তিনিও ভেবেছিলেন,তথার কাছে পানি আছে।তথা অপারগতা প্রকাশ করে সোনালীর কাছে।
—” সোনালী,আমিও পানি আনিনি।পানির আনার কথা বেমালুম ভুলে গেছি।”
মিষ্টি হাসে সোনালী।
—-” সমস্যা নেই আপু।আমি ম্যানেজ করছি।”
—” এই তথা,তথা….”—- জানালার কাচে ঠকঠক আওয়াজ তুলে ইরফান।সে এখনো যায়নি।তথা আড়চোখে একবার সোনালীর দিকে তাকায়।সে বেশ আগ্রহ সহকারে উঁকি দিচ্ছে এদিকে।না চাইতেও ইরফানের ডাকে সাড়া দেয় তথা।যে তাচ্ছিল্য বোঝে না,অপমান বোঝে না,নিষেধাজ্ঞা মানে না,উপদেশ কানে নেয় না—তার সাথে আর কি করা যায়? ঢাকায় থাকা অবধি ইরফানের কবল থেকে বাঁচা যাবে না, তা বেশ বুঝে গেছে তথা।তথা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কোন কুক্ষণে যে ইরফানের নজরে পড়েছিল।তথা জানালার পাল্লা দিয়ে সামান্য মুখ বাড়ায়। চোখে পড়ে ইরফানের চিন্তিত,বিষাদগ্রস্ত চেহারা।যেন এখুনি ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দেবে।ইশ! ছেলেদের মন এতো নরম হয়?
—” আবার কি হলো,ইরফান ভাই?”
—” এই নেও।”
খোলা জানালা দিয়ে একটা পলিথিন এগিয়ে দেয় ইরফান।স্বচ্ছ পলিথিনের ভিতরে এক বোতল পানি আর তেঁতুলের আচার চোখে পড়ে তথার।নির্লিপ্ত গলায় প্রশ্ন করে সেঃ” এখনি চলে যাবেন নাকি আরো বিরক্ত করবেন?”
—” এমন করো কেন?গাড়ি ছাড়লেই চলে যাব।”
—” আপনি খুব আবেগী।একটা কথা মনে রাখবেন,হাজী সাহেব কখনো নিজের ছেলের বউ হিসেবে একজন অভিনেত্রীকে মেনে নিবেন না।”
—” ভয়টা তো এখানেই।এই জন্যই তোমাকে যেতে নিষেধ করছি।তোমার পছন্দের পেশা আমি মেনে নিলেও আমার পরিবার কখনো মানবে না।”
—” নিজের বাবার পছন্দকে সম্মান করতে শিখুন।ভবিষ্যতে যা হবে না তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করা বন্ধ করুন।”
ইরফান খুব বিরক্ত হয় তথার কথায়।মেয়েটার কোনো কান্ডজ্ঞান নেই।ইরফানের খুব খারাপ লাগছে —এটা যেন সে বিশ্বাসই করতে চাইছে না।আজব! জানালার কাছ থেকে সরে যায় ইরফান।নিজেকেই নিজে ধিক্কার দেয়।এতোটা পাগল হওয়া কি উচিত? আত্মসম্মান ইরফানেরও আছে।কিন্তু কেন যেন তথার কথাগুলো আত্মসম্মানে বাধে না।হয়তো তথার প্রতি ইরফানের অত্যধিক দুর্বলতাই এক্ষেত্রে দায়ী।এজন্যই মেয়েটা এতো কথা শোনাতে পারছে। নাহয় কার সাধ্য ইরফানকে এতো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলে!
—” উনি কি আপনার হাজবেন্ড?”
—“উঁহু, প্রণয় ভিক্ষুক।”
—” সত্যি! ভাইয়া কিন্তু খুব কেয়ারিং।আপনি চাইলেই তার সাথে রিলেশন করতে পারেন।”
সোনালীর কথায় খুব বিরক্ত হয় তথা।মেয়েটা খুব ইঁচড়েপাকা। সবকিছু বেশি বুঝে।তথা সোনালীর দিকে পানির বোতল এগিয়ে দেয়।সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে।উত্তেজনায় কাল রাতে ঘুম হয়নি ঠিকভাবে।ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে।তথার বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠে একটি বিষাদগ্রস্ত পুরুষের মুখ।মনে মনে খুব অবাক হয় তথা।ইরফানের পাগলামিগুলো মনের কোথাও দাগ কাটলো নাকি?অজান্তেই ইরফান নামক প্রেমিক পুরুষটা মনের এককোনে হাত-পা ছড়িয়ে আসন গাড়লো নাকি?
***
ইউসুফ এখন পঞ্চগড়ে।তার স্থায়ী কোনো আবাস নেই,পরিবার নেই, বন্ধন নেই।বংশের অংশ হিসেবে শরীরে রক্ত ও জমিদার বাড়িটাই আছে।এই বাড়িটা খুব ভালো লাগে ইউসুফের।কতো কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে।ইউসুফের জন্মের আগে তাদের পরিবারটা এখানেই ছিল।ছোট-খাটো পরিবার নয়।একান্নবর্তী পরিবার। ব্রিটিশ আমল থেকে তাদের আধিপত্য এখানে।আধিপত্য ধ্বংস হল মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে।ধ্বংসের শুরু ইউসুফের জন্মের আগেই।ইউসুফের জন্ম হয়েছে পাকিস্তানের করাচীতে।তার মা ছিল পাকিস্তানি। বাবা বাংলাদেশী।এই দম্পতির তৃতীয় সন্তান সে।তবে ইউসুফের কোনো ভাই-বোন জীবিত নেই।প্রথম দুজন পৃথিবীতে আসার আগেই মারা গেছে।আহমেদ সফিউর ও বিবি জুলেখার বিয়ে হয়েছিলো একাত্তরের শুরুর দিকে।প্রেমের বিয়ে। জুলেখার বাবার বাড়ি শুরুতে মেনে নেয়নি তাদের বিয়ে।তবে একটা মেয়ে হওয়ায় পরে ঠিকই মেনে নিয়েছে।যুদ্ধের শেষে, জুলেখার বাবার বাড়িতেই আশ্রয় নেয় এই দম্পতি।যুদ্ধের পরে বহু কষ্টে দেশ থেকে পালিয়েছে তারা। এসব বাবার মুখে শুনেছে ইউসুফ।নিজের দেশে প্রথম পা রেখেছে দশ বছর বয়সে।তার আগে সে পাকিস্তানেই ছিল।
—” গাড়ী চলে এসেছে, স্যার।গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।আপনি কি নিচে যাবেন?”
মামুনের প্রশ্নে উঠে দাঁড়ায় ইউসুফ।ঘাড় নেড়ে বলেঃ
” হ্যাঁ, যাব।চলো।”
ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে একবার আয়নায় চোখ বুলায় ইউসুফ।স্টাডি রুমের পশ্চিম দিকের দেয়ালে বিশাল বড় এক আয়না আছে।আপাদমস্তক দেখা যায় তাতে।দুই দেশের রক্তের সংমিশ্রন ইউসুফ।চেহারার আদল বেশিরভাগ মায়ের মতো। বাঙালি নয়,অনেকটাই পাকিস্তানীদের সৌন্দর্যের ছাপ পড়ে তার চেহারায়।ইউসুফ অগোছালো চুলগুলো হাত দিয়ে পিছনে ঠেলে দেয়।তার কামিনী ফুলটা দোরগোড়ায়। শুভ্র ফুলের সামনে যাওয়ার আগে একবার পরিপাটি হওয়ার দরকার ছিল।
তথা গাড়ি থেকে নেমে হাত-পা ঝারা দেয়।সেই কখন গাড়িতে উঠেছিল! হাত-পা লেগে গেছে একদম।তার পাশে সোনালী এসে দাঁড়িয়েছে।আসতে আসতে বেশ ভাব হয়েছে দুজনের মাঝে।সোনালীর বয়স সবে আঠারো।বয়সের আগেই পেকে গেছে মেয়েটা।পাকা পাকা কথা বলে।তথা লোহার গেটের দিকে তাকায়।বিশাল গেটের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে ভিতরের অভিজাত প্রাসাদটা দেখা যাচ্ছে।আখতার সাহেবের মুখে শুনেছে, এটা নাকি সেই ব্রিটিশ আমলের প্রাসাদ।ব্রিটিশ আমল।মানে সেই দুইশ বছর আগের কাহিনী। দুইশ বছর আগের এক প্রতাপশালী বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছে,ভাবতেই শরীরে শিহরণ জাগে তথার। বাড়ির পথে দুজন ব্যক্তির অবয়ব দেখা যায়।লোহার গ্রিলগুলো ফাঁকা ফাঁকা। তাই ভিতরের দৃশ্য স্পষ্ট দেখা যায়। কিছুক্ষণের মাঝেই খুলে যায় ভারী গেটটা।দুইজন পুরুষের মাঝে একজনের দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে যায় তথার। কয়েক সেকেন্ড অপলক তাকিয়ে থাকে সে।বাড়ির সামনে মৃদু আলোর বাতি জ্বলছে। সেই আলোতে মানুষটার চেহারা স্পষ্ট চোখে পড়ে।এরকম বলিষ্ঠ সুপুরুষ আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি তার।চেহারার আগে চোখদুটো নজর কাড়ে।চোখের মনিদুটো কটকটে সবুজ রঙের ।মনি নয় যেন শ্যাওলা মিশ্রিত পানি ভরে রেখেছে চোখের ভিতর।পাশ থেকে সোনালী ফিসফিস করে তথার কানের কাছে।
—” তথা আপু,এটা বাড়ির মালিক নাকি?পুরাই হটপেটিস।আহ! ব্যাটা কি বিদেশি? এতো সুন্দর ক্যান?চোখ দুইটা খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।পুরাই রসগোল্লা, তাই না?”
চলবে