ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-২৫) হালিমা রহমান

0
12

ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-২৫)
হালিমা রহমান

ইউসুফের খুব বিশ্বাসী মানুষটার নাম মামুন।বিশ্বাসী বলতে একদম বিশ্বাসী।দরজার এপাশে দাঁড়িয়েই মামুন চিনতে পারে গলার স্বর। বুঝতে পারে বাইরে এতোক্ষণ ফিসফিস করে কথা বলছিলো শাফিন ও তথা।খুব বড় ষড়যন্ত্র চলছে এখানে।মামুন দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।তথা তখন শাফিনকে স্টেপ নেওয়ার কথা বলল।তার মানে শাফিনও সোনালীর মতো গোয়েন্দা।আর তথা নিজেও সব জানে।ইউসুফের সাথে তার ভালো ব্যবহার অথবা এতো ঘনিষ্টতা সম্পূর্ণ অভিনয়।দুয়ে-দুয়ে চার মেলাতে খুব কষ্ট হয় না মামুনের।সবকিছু পরিষ্কার হতেই পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়।এতো ছলনা! ছিঃ! ইউসুফ যেমনই হোক, তথার বিষয়ে সে একদম স্বচ্ছ।তথাকে সে সত্যিই খুব পছন্দ করে।প্রতাপশালী আহমেদ ইউসুফের দূর্বলতা বলতে যদি কিছু থেকে থাকে তবে সেটা একমাত্র তথা।তথার বিরুদ্ধে একরাশ ঘৃণা জমে মামুনের মনে।হয়তো ইউসুফের কাজ-কর্ম সম্পর্কে সে সবকিছু জেনে ফেলেছে।কিন্তু তাতে কি? ইউসুফের গন্ডি থেকে বাইরে বেরোতে পারবে সে? ইউসুফের নাকের ডগা দিয়ে ঢাকা যাওয়ার ক্ষমতা আছে তথার? উঁহু, কখনোই নেই।আর শাফিনের সাথে বন্ধুত্ব করেছে ওই বোকা মেয়ে।মামুন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।সোনালীও অফিসার, শাফিনও অফিসার।সোনালীকে সে ইউসুফের বিরুদ্ধে কখনোই কোনো পদক্ষেপ নিতে দেবে না।প্রয়োজন হলে অজ্ঞান করে ঘরে শুইয়ে রাখবে।তবুও ইউসুফের মুখোমুখি হতে দেবে না। আর বাকি রইলো শাফিন।ও আর এমন কে? গলায় দুটো আঙুল চেপে ধরলেই হবে।ওই একটিখানি ছেলেটার প্রাণ বের করা খুব কষ্ট নাকি?
বন্ধ দরজার এপাশে দাঁড়িয়েই পুরো পরিকল্পনা সাজায় মামুন।কিভাবে কি করতে হবে, কিভাবে চলতে হবে –সব।তথাও এখন ইউসুফের বিরুদ্ধে।এতো বড় খবরটা ইউসুফকে জানাতে হবে না? মামুন ইউসুফের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দরজা খোলে।বসার ঘরে কতগুলো মেয়ে বসে বসে গল্প করছে।একপাশে ডিরেক্টরকেও দেখা যায়।মামুন আঁতিপাঁতি করে সোনালীকে খোঁজে।চোখের সামনে পেলেই ঠাটিয়ে চড় মারবে।নিশ্চয়ই কালকে অভিযানে বেরিয়েছিল। আগেরবার মামুন দেখে ফেলেছিল বলেই হয়তো কাল অজ্ঞান করে রেখে গেছে।কত সাহস! মেয়ের সাহস দেখে অবাক না হয়ে পারে না মামুন।সোনালীকে না দেখলেও চোখে পড়ে তথা। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইউসুফের সাথে কথা বলছে।মুখে তার মিষ্টি হাসি।ইউসুফের মুখেও হাসি।কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছে দুজনে! মনে হচ্ছে একটি সুখী দম্পতি একান্তে সময় কাটাচ্ছে।ইউসুফের হাসি দেখে কষ্ট হয় মামুনের।মানুষটা জানে না একজন সফল অভিনেত্রীর অভিনয় চলছে ওখানে।তথার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায় মামুন।ওকে দেখতে ইচ্ছে করছে না। ওই মেয়ের সবটা জুড়েই কেবল ছলনা আর ছলনা। মামুন হাম্মামখানার দিকে পা বাড়ায়।হাত-মুখ ধুয়ে কিছু খেতে হবে আগে।তারপর নাহয় ইউসুফের কাছে যাওয়া যাবে।ততোক্ষণ মন ভরে আরেকটু অভিনয় করুক তথা।
***
_” আমার কামিনী ফুলটা আজকে একটু বেশিই খুশি।”
_” হ্যাঁ, একটু না এই এতোখানি খুশি।”– দু-হাত প্রসারিত করে প্রসন্নতার মাত্রা বোঝায় তথা।
_” এতো খুশির কারণ?”
_” বসন্ত বাতাসের খোঁজ পেয়েছি।আমি খুশি না হলে কে খুশি হবে?”
ইউসুফ বারান্দার রেলিঙে পিঠ ঠেকায়।এক ভ্রু তুলে বলেঃ” বসন্ত বাতাস! সেটা আবার কি জিনিস? এখন তো শীতের হাওয়া বইছে। ”
_” এগুলো আপনি বুঝবেন না।এগুলো বুঝতে হলে ঠিকঠাকভাবে প্রেমে পড়তে হয়। আমি তো পড়েছি,তাই এসব বুঝি।”— বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে উত্তর দেয় তথা।
ইউসুফ মৃদু হাসে।তথার দিকে মাথা ঝুকিয়ে বলেঃ” আমি প্রেমে পড়িনি? ”
_” উঁহু, একটুও না।”
_” কে বলল?”
_” আমিই বললাম।প্রেমিকের চোখ দেখলেই বোঝা যায় সে প্রেমে পড়েছে।অথচ আপনার চোখ আমি বুঝতেই পারি না।আপনার চোখের দিকে তাকালেই কেমন যেন লাগে। আপনার মতো আপনার চোখও অন্যরকম।”
_” সেটা কি আর আমার দোষ? আপনাদের মতো কালো মনি আল্লাহ আমায় দেয়নি। এখন আমি আর কি করতে পারি।কিন্তু আমার এই ভিন্নরকম চোখের উপরেই সেকেন্ডে কত মেয়ে ক্রাশ খায় তার হিসাব জানেন? আপনার সাহেবের রূপটাও তো সহজ নয়।”— চুলগুলোকে পিছনে ঠেলে দেয় ইউসুফ।
তথা ভালোভাবে একবার নজর বুলায় ইউসুফের উপর।হ্যাঁ, এটা মানতেই হবে।ইউসুফের মতো এমন রুপ সহসা চোখে পড়ে না।এরকম কাটকাট বডি অথবা নজরকাড়া স্টাইল শুধু গুটিকয়েক নায়কের মাঝে দেখেছে তথা।যেকোনো মেয়েকে আকর্ষণ করার তীব্র ক্ষমতা আছে আহমেদ ইউসুফের। তথা চোখ ফিরিয়ে নেয়।শারীরিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ হলেও মনের সৌন্দর্য কি আছে? উঁহু, একট নেই।সবাই তো আর তথার মতো ভিতরের খবর জানে না। তথার ভালো লাগে না ইউসুফকে।একটুও ভালো লাগে না।তার তো ভালো লাগে ওই পুরান ঢাকার ছেলেটাকে।যার একজোড়া চোখ টলটল করে প্রেয়সীর প্রস্থানে,যে ভীষণভাবে নির্লজ্জ, রাস্তা-ঘাটে কানের কাছে যে ভ্যানভ্যান করে প্রেমের কথা বলে,যার যন্ত্রণায় শান্তিতে রাস্তায় বেরোতে পারে না তথা,যে প্রেতাত্মার মতো সকাল-বিকাল অনুসরণ করে — তাকে খুব ভালো লাগে তথার।কিভাবে কি হয়ে গেল জানা নেই।তবে এখানে আসার পর কাকা-কাকি,রুবি,মাহাদী এই চারজনের পর যদি আর কারো কথা মনে পড়ে তবে সে একমাত্র ইরফান। বাস স্টেশনে ইরফানের পাগলামিগুলো প্রায়ই মনে পড়ে তথার।অজান্তেই তথার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে ওঠে। আসলেই একটা পাগল লোকটা।
_” কামিনী ফুল ”
_” হুম।”
_” আমরা বিয়ে করব কবে?”
তথা হাসে।শান্ত গলায় বলেঃ” এতো তাড়া কীসের? আস্তে-ধীরে হোক সবকিছু।এখন তো আমি প্রেমিকা।বিয়ে হলেই বউ হয়ে যাব।তখন সবকিছুতে খবরদারি করব। হয়তো তখন আর ভালো লাগবে না আমাকে।আমি শুনেছি ছেলেদের বউয়ের চাইতে প্রেমিকা বেশি পছন্দ।”
_” এসব ফাউল কথা-বার্তা কে বলে আপনাকে? আমার বউও চাই, প্রেমিকা চাই। প্রেমিকাকেই বউ হিসেবে চাই।আমরা বিয়ের পর লাহোর চলে যাব, ঠিকাছে?”
ইউসুফের চোখ একরাশ স্বপ্ন দেখে।তবে ইউসুফের কথা শুনে তথার চক্ষু চড়কগাছ। কত সাহস হারামজাদার! লাহোরে যাবে! হুহ,মামা বাড়ির আবদার।
তথা মুখ ভোঁতা করে বলেঃ” মোটেও না।আমরা এখানেই থাকব। ডাহুক নদীর তীরের এই বাড়িতেই থাকব।এই জায়গাটা খুব পছন্দ আমার।বিয়ের পর বউ নিয়ে লাহোর যেতে হলে অন্য মেয়ে খুঁজে নিন।লাহোর-টাহোর যেয়ে থাকতে পারব না আমি।”
_” এখানেই থাকবেন?”
_” হুম,এখানেই থাকব।”
ইউসুফ তথার দিকে একপা এগিয়ে যায়।অপলক চোখে প্রেয়সীর দিকে চেয়ে বলেঃ” আচ্ছা,ঠিকাছে।আমার বেগম যা বলছে তাই হবে।আমরা এখানেই থাকব।এই বাড়িটাকেই নতুন করে সাজাব।বাড়ির সামনে উঠানটুকুতে ফুলের বাগান করব।হরেক রকম ফুল ফুটবে এখানে।আর আমি সতেজ ফুলগুলো যত্ন করে তুলে বেগমের খোঁপায় গুজে দেব। আমার বেগম প্রতিদিন শাড়ি পড়ে রান্নাঘরে লেপ্টে বসে রান্না করবে আর আমি দু-চোখ ভরে দেখব।বিকালগুলো কাটাব এক কাপ চা ভাগাভাগি করে।অথবা কখনো নদীর তীরে ঘুরতে যাব।সন্ধ্যাগুলো আরো রোমাঞ্চকর হবে।আমার বেগম মৃদু আলোয় সন্ধ্যার নাস্তা বানাবে, আমি পাশে বসে সাহায্য করব।সে যেদিকে যাবে আমিও আঁচল ধরে তার পিছু পিছু যাব। একদম বাধ্য স্বামীর মতো।আমি কিন্তু খুব বেশি বাংলা পড়তে জানি না।আমাকে ওই মোটা মোটা উপন্যাসের বই পড়ে শোনাতে হবে।অথবা আমরা কচ্ছপের মতো এক কাঁথার নিচে শরীর লুকিয়ে মুভি দেখব।ঠিকাছে?”
তথা ফাঁকা ঢোক গিলে। কত কত স্বপ্ন তাকে ঘিরে! একটা নির্দয় অপরাধীর চোখেও এতো স্বপ্ন থাকতে পারে? তথা আশ্চর্য না হয়ে পারে না।ইউসুফের কাছ থেকে একটু দূরে সরে বলেঃ” আগে আগে এতো চিন্তা-ভাবনা করা উচিত না।ভবিষ্যতের ভাবনাগুলো ভবিষ্যতের উপরেই ছেড়ে দিন।আমিও পালিয়ে যাচ্ছি না, আর আপনিও আছেন।তাহলে আগে-ভাগেই এতো পরিকল্পনা করে লাভ আছে?”
ইউসফ খানিক বিরক্ত হয়।কপাল কুঁচকে বলেঃ” সবকিছুর আগেই প্ল্যানিং করা উচিত।একটু রোমান্টিক হতে শিখুন, কামনী ফুল।আমি তো ভাবছি ফ্যামিলি প্ল্যানিংটাও সেড়ে রাখব এখনি।আগামী বছরেই ইনশাআল্লাহ কামিনী ফুলের কলি আসবে আমার ঘরে।আমার কামিনী ফুলের মতো সেও একদম মিষ্টি একটা ফুল হবে।ছোট দুটো হাত থাকবে,দুটো পা থাকবে।আমি এভাবে দু-হাতে আঁকড়ে ধরব। আমাকে বাবা ডাকবে, আপনাকে মা। উফ! আমার ভাবতেই ভালো লাগছে।কত দিনের শখ আমার।জানেন আমার কিন্তু বাচ্চা খুব পছন্দ।বছর ঘুরতেই আবার আরেকটা কলি আসবে, তারপর….”
_” স্যার”
মামুনের কন্ঠ পেয়ে কথা থামিয়ে দেয় ইউসুফ।বিরক্ত চোখে তাকায় মামুনের দিকে।কোনো সময় -জ্ঞান নেই ছেলেটার।কত ভালো সময় কাটাচ্ছিল ইউসুফ।মামুনের দিকে চেয়ে বিরক্ত চোখে বলেঃ” কিছু বলবে,মামুন?”
_” জ্বি,স্যার।”
_” স্টাডি রুমে যেয়ে বসো।আমি দু-মিনিটে আসছি।”
_” ওকে স্যার।”
তথার দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে মামুন।অভিনয় কাকে বলে, এবার তা হাড়ে হাড়ে টের পাবে এই মেয়ে।গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে স্টাডি রুমের দিকে পা বাড়ায় মামুন।
_” আসছি, কামিনী ফুল।আধ-ঘন্টার মাঝেই আবার ফিরে আসব।আপনি অপেক্ষায় থাকুন।”
তথার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্টাডি রুমের দিকে চলে যায় ইউসুফ ইদানিং নিজেকে খুব সুখী সুখী লাগে।মনে হয় যেন না চাইতেই সব পেয়ে গেছে।এতো সহজে এতোকিছু হবে তা কল্পনাও করেনি ইউসুফ।মাঝে মাঝেই এখন তীব্র আফসোস হয় তার।তথার সাথে আর দশ বছর আগে কেন দেখা হলো না? তাহলে ইউসুফের পৃথিবীটা আরো আগেই রঙিন হতো।
***
সমীর,মলয়,শাফিন ও আরিফকে অশ্বত্থ গাছের কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল সৌরভ।চারজনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কি যেন বলছে।সৌরভ এগিয়ে যেতেই সমীরের কন্ঠ কানে আসে তার।সে বেশ জোর দিয়ে শাফিনকে বলছেঃ” স্যার,ম্যাম কালকে বলেছিলেন তিনি প্রমাণ পেলেই ঢাকায় চলে যাবেন।এমনও তো হতে পারে, ম্যাম ঢাকা চলে গেছেন।সেখানে পৌঁছে আমাদেরকে খবর দেবেন।”
শাফিন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় সমীরের কথা। হাত নেড়ে বলেঃ” অসম্ভব।সোনালী কোনো আপডেট না দিয়ে কেন যাবে? আর যাবেই বা কীভাবে? এতো রাতে গাড়ি কোথায় পাবে ও?”
মলয় বলেঃ ” শাফিন, সোনালীর জামা-কাপড়ও পাওয়া যাচ্ছে না।হতেই পারে সে আমাদেরকে জানানোর সময় পায়নি।আগেই চলে গেছে।ঢাকা পৌঁছে আমাদেরকে আপডেট দেবে।”
শাফিন দু-আঙুলে কপাল চেপে ধরে।ধরা গলায় বলেঃ” সব আমার দোষ।কাল কেন যে ওকে একা যাওয়ার অনুমতি দিলাম! সোনালীর ঢাকা যাওয়ার কথাটা একদম বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।তাছাড়া এই চিঠিটাও ভুয়া।এটা মোটেও সোনালীর লেখা না।তাই চিন্তা আরো বেশি হচ্ছে।”
এতোক্ষণে মুখ খোলে সৌরভ।শাফিনকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করেঃ” কি হয়েছে, শাফিন?”
_” সোনালীকে খুঁজে পাচ্ছি না সকাল থেকে।কাল রাতে অভিযানে বেরিয়েছিল। তারপর থেকেই আর কোনো খোঁজ নেই।”
_” রাতে তোমাদের সাথে কোনো কথা হয়নি ওর?”
_” হয়েছিল স্যার।ম্যাম আমাদেরকে বলেছিল,কোনো প্রমাণ পেলেই ঢাকা চলে যাবে।কিন্তু স্যার এই কথাটা মানতেই চাইছে না।”— সৌরভের প্রশ্নের উত্তর দেয় সমীর।
সৌরভ আবার কিছু বলার আগেই আরিফ বলেঃ” আমারও তোমার কথা মানতে কষ্ট হচ্ছে সমীর।ও কি পেলো না পেলো তা জানাবে না কাউকে! সোনালী এতোটা কান্ড-জ্ঞানহীন নয়।”
_” এক্সাক্টলি। ঠিক এই কথাটাই বুঝাতে চাইছি আমি।”— আরিফের কথায় যেন প্রাণ ফিরে পায় শাফিন।মলয়ের দিকে চেয়ে বলেঃ” বুঝতে পারছো মলয়? আমি এই কথাটাই বলছি আমি।”
মলয় কয়েক সেকেন্ড ভাবে।তারপর ভাবুক স্বরে বলেঃ” তাহলে আমাদেরও একবার বাড়ির পিছনে যাওয়া উচিত। এমনও হতে পারে ওখানে কিছু পেতেও পারি।”
আরিফ তার চশমার ফ্রেমটাকে উপরের দিকে ঠেলে বলেঃ” তবে এক কাজ করি।আমি যাই শুধু।সবার একসাথে যাওয়ার কি দরকার? তোমরা এদিকে খেয়াল রাখো,আর আমি ওদিক দিয়ে সুযোগ পেলেই চলে যাব। গোডাউনটা যেন কোথায় শাফিন?”
_” অর্জুন গাছের সামনে।তবে ঘরের পিছনেও একটা দরজা আছে,সেদিক দিয়েই ঢুকতে হয়।চাবি ছাড়া ঢুকতে পারবে না কিন্তু।চাবি ইউসুফ ও মামুনের কাছে আছে।ঢুকতে হলে ওখান থেকে চাবি কালেক্ট করতে হবে।বুঝতে পেরেছো?”
আরিফকে সবটা বুঝিয়ে দেয় শাফিন। অস্থিরতা কাজ করছে খুব। সকাল থেকে এ নিয়ে চৌদ্দবার পুরো বাড়ি খোঁজা শেষ। কোথায় নেই সোনালী।
—” সোনালী যেন ঢাকায় চলে যায়।ওকে ভাল রেখো খোদা”–সৃষ্টিকর্তার কাছে আরেকবার প্রাণ ভরে দোয়া করে শাফিন।কেন যে কালকে একা ছাড়লো সোনালীকে? এত বড় ভুলটা না করলেই হতো।অনুশোচনায় ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে শাফিনের।বোনকে সঙ্গ না দিয়ে ঘুমানোর অপরাধে দেয়ালে মাথা ফাটিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।এতো বড় ভুল কি করে করতে পারলো শাফিন?
***
মামুনের দিকে একগোছা চাবি ছুঁড়ে মারে ইউসুফ।বেতের চেয়ারে বসতে বসতে বলেঃ” শরীর কেমন এখন?”
মামুন এক নজর তাকায় চাবির দিকে।এটা তো মানিব্যাগে ছিল।এখানে কি করে এলো?
বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করেঃ” এটা আপনার কাছে কি করে এল স্যার?”
_” উদ্ধার করেছি।কাল সোনালী তোমার ঘর থেকে চুরি করেছিল এটা।আমি ওর পিছু নিয়েছিলাম।”
মামুন ফাঁকা ঢোক গিলে।অস্থির লাগছে খুব।সোনালী গোডাউন পর্যন্ত চলে গিয়েছিল! আর ইউসুফ তার পিছু নিয়েছিল মানে? ইউসুফ কি সব জেনে ফেললো?
মামুন ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করেঃ” ছোট্ট মেয়ে এখন কোথায় আছে স্যার?”
_” যেখানে আগে গনকবর ছিল সেখানে।গোডাউনে রক্তমাখা কতগুলো ছুঁড়ি আছে।ওগুলোর কোনো একটা ব্যবস্থা করো তো।রক্ত হয়তো শুকিয়ে গেছে।সময় করে ফেলে দিও একসময়।আরে মামুন,কোথায় যাচ্ছ? মামুন…”
হতভম্ব ইউসুফকে পিছনে ফেলে পাগলের মতো বেরিয়ে গেল মামুন।তার দমটা আঁটকে আছে।ইউসুফের কথা শোনার সময় কোথায় তার? তাকে এখন ছুটতে হবে।একছুটে চলে যেতে হবে তার প্রাণপ্রিয় প্রিয়তমার কাছে।
***
জমিদার বাড়ির পিছনে বিশাল অর্জুন গাছের পাশেই জমিদার বংশের মানুষদেরকে গনকবর দেওয়া হয়েছিল।তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। কবরের উঁচু মাটি নিচু হয়ে গেছে।মামুন কতবার এই জায়গার উপর দিয়ে হেঁটে গেছে তার ইয়ত্তা নেই।গনকবরের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কখনোই গা কাঁপেনি মামুনের।কিন্তু এখন কাঁপছে। উঁচুু মাটির স্তূপের দিকে চেয়ে তীব্রভাবে শরীর কাঁপছে মামুনের। হাত-পা কাঁপে থরথর করে।হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে মামুন।কিভাবে এ অবধি এসেছে তা জানা নেই।বুকের ভিতর তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে।মনে হচ্ছে কেউ যেন অনবরত ছুঁড়িকাঘাত করছে। মাছের মত ঘোলা চোখে আশেপাশে তাকায় মামুন।গাছের পাতা ঝরে পড়েছে কবরের উপর।মাটিতেও জুতোর ছাপ।এবড়োখেবড়ো মাটিতে বড় কালো পিঁপড়েদের আনাগোনাও চোখে পড়ে। মামুনের প্রাণপ্রিয় রমনী খুব অযত্নে শুয়ে আছে এখানে।মামুনের শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।আশেপাশে মনে হচ্ছে অক্সিজেনের খুব অভাব।শ্বাসকষ্টের রোগীদের মতো থেমে থেমে শ্বাস নেয় মামুন।যন্ত্রণার স্বাদ এতো তেতো? মনে হচ্ছে মামুন মরে যাচ্ছে।হামাগুড়ি দিয়ে বহু কষ্টে কবরের কাছে এগিয়ে যায় মামুন।উঁচু -নিচু মাটির এ মাথা- ও মাথা সযত্নে হাত বুলিয়ে দেয়।পারলে বুকের সব প্রেম ঢেলে দিত মামুন।টুপটুপ করে ঝরে পড়ে মামুনের চোখের জল।মাথা এলিয়ে দেয় কাঁচা কবরটার উপর। একটুখানি মাটির উপর ঠোঁট বুলায়।ফিসফিসিয়ে বলেঃ” আমি এসেছি প্রিয়তমা।আপনার ব্যর্থ প্রেমিক হয়ে এসেছি।আপনি কি শুনতে পারছেন?”
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here