ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-২৭)
#হালিমা রহমান
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলো ইরফান।হাঁটুতে ব্যাথা,কনুইয়ে ব্যাথা,কাঁধে এক বিশাল ট্রাভেল ব্যাগ।ক্লান্ত দুপুরের নিস্তব্ধ রাস্তায় একাকি হাঁটছে সে।অখ্যাত এক অজপাড়া গাঁয়ের কাঁচা রাস্তায় হাঁটতে ভালো লাগছে না ইরফানের।শরীরের সাথে সাথে মনের অসুখ চেপে ধরেছে একদম। ইরফানের উদ্দেশ্য বাস স্টেশন। স্টেশনে যাবে তারপর ঢাকার বাস ধরবে। এখানে আসার আগে বেশ উত্তেজনা ছিল ছেলেটা মাঝে।ভেবেছিল তথার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, তার মানে নিশ্চিত তথা বিপদে আছে।ইরফান ঢাকা থেকে বীরপুরুষের মতো আসবে,বুক ফুলিয়ে ডাহুক নদীর তীরের জমিদার বাড়িতে যাবে,রূপকথার রাজাদের মতো তার রানীকে উদ্ধার করবে। তারপর পরম নির্ভরতায় হৃদয় রানীর হাত আগলে বলবেঃ” আর কোনো ভয় নেই , প্রিয়তমা।আমি আছি তো ।” আহ! রূপকথার গল্পের মতো সুন্দর সমাপ্তি।
কিন্তু বাস্তবে কি হলো?এখানে আসার পর এক্সিডেন্ট, তারপর শাফিনের মুখে শুনতে হলো তথার প্রনয় গাঁথা। সাংঘাতিক অপরাধী আহমেদ ইউসুফের সবচেয়ে পছন্দের মানুষটির নাম তথা এবং তথার বীরপুরুষটির নাম আহমেদ ইউসুফ।তাদের সুন্দর প্রেম কাহিনীতে ইরফান সাদিক নিতান্তই অনাহূত একজন। সহজ বাংলায় বলতে গেলে সে ইউসুফ ও তথার মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি। ‘ তৃতীয় ব্যক্তি ‘ শব্দটা মাথায় আসতেই হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে ইরফানের। কি ভেবেছিল আর কি হলো। জীবনটা যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে ইরফান।এখানে আসার আগে রাফায়েত বারবার নিষেধ করেছিল। কিন্তু ইরফান শুনলোই না। সে প্রেমিক পুরুষ।হাজার নিষেধাজ্ঞা পায়ে ঠেলার ক্ষমতা ও সাহস তার আছে। সুতরাং আরেক ছেলের কথা শুনে কি হবে? ইরফান সেটাই করবে যেটা তার মনে ধরবে।তবে এখানে আসার পর এসব তত্ত্ব কথা ফুরিয়ে গেছে।এবার ঢাকা যেয়ে রাফায়েতের পা ধোয়া পানি খাবে। রাফায়েত সবসময় ভালো বুদ্ধি দেয়।ওর কথা মতো এখানে না এলেই ভালো হতো। আর যাই হোক, তথার প্রেম কাহিনো তো আর নিজের কানে শুনতে হতো না।
রাস্তার পাশে এক বিরাট বটগাছ।গাছের সাথে হেলান দিয়ে ছায়ায় দাঁড়ায় ইরফান। কেন যেন খুব অস্থির লাগছে। ওই যে কোনো খারাপ খবর শুনলে মানুষের যেমন অস্থির লাগে, ঠিক তেমন।অসুস্থতার কারণে এমন হচ্ছে বোধহয়। ইরফান কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে পাশে রাখে।পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে আধ-বোতল পানি খেয়ে নেয় ইরফান।চোখে-মুখেও খানিক পানি ছিটিয়ে দেয়। পকেট থেকে ফোন বের করে নজর বুলায় একবার।এখনো শাফিনের কোনো খোঁজ-খবর নেই। কাল রাত থেকে শাফিনের একটা কলের জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করেছে ইরফান। কিন্তু শাফিনের কোনো খবরই পেলো না।এই ছেলের উপরও রাগ জমে ইরফানের। এটাই পালের গোদা। ও যদি ইউসুফের সব জারিজুরি তথার কাছে ফাঁস করে দিতো,তবে তথা কি এতো খারাপ একটা লোকের প্রেমে পড়তো?
ইরফান মোবাইল পকেটে পুরে নেয়। ঢাকা তো চলেই যাবে কিন্তু তার আগে একবার জমিদার বাড়িতে গেলে ভালো হতো না? তথার জন্যই তো এতোদূর ছুটে আসা।একবার চোখের দেখা না দেখলে একটুও শান্তি পাবে না ইরফান।একবার নাহয় যাওয়াই যাক।দূর থেকে দেখেই চলে আসবে।ইরফান কাঁধে ব্যাগ তুলে নেয়।দু’পা এগিয়েই আবার থমকে দাঁড়ায়।একটু বেশিই নির্লজ্জতা হয়ে যাচ্ছে না? তথা ভালো আছে,জমিয়ে প্রেম করছে। তাহলে ইরফান কেন চিন্তা করছে? যা করছে তা করুক। ইরফান আবার দাঁড়িয়ে থাকে। সে এখান থেকে বাস স্টেশনেই যাবে।তথা- টথা বাদ। ইরফান বড় এক দম নেয়।তথার কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে।” তথা কেউ না,তথার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই”– মনে মনে নিজেকে বুঝায় ইরফান। তবে ইরফান তো একটু বেশিই নির্লজ্জ, তাই মনের এককোনে একটু খচখচানি ভাব রয়েই যায়। একটু ভাবে ইরফান। একবার দেখে গেলে কি এমন ক্ষতি হবে? আর যাই হোক তথা তো আর ভালো মানুষের সাথে প্রেম করছে না।প্রেমে পড়েছে এক হতচ্ছাড়া শয়তানের। কখন কি ঘটে যায়।দূর থেকেই এক নজর দেখে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয় ইরফান।তথার ব্যাপারেই সে সবচেয়ে বেশি নির্লজ্জ, সবচেয়ে বেশি আত্মসম্মানহীন।আরেকটু নির্লজ্জ হলে ক্ষতি কী?
***
ইউসুফের হাত দুটো মনে হচ্ছে তথার প্রাণ কেড়েই নেবে। একহাত গলায় চেপে আছে, আরেক হাত তথার ডানহাতে।তথার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।প্রচন্ড যন্ত্রণায় দম বন্ধ হয়ে আসে।চোখ উল্টে যায়।তথা কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু স্বর ফুটে না গলায়।কেবল গড়গড় শব্দ হয়।বাম হাতে ইউসুফের বুকে মৃদু ধাক্কা দিতেই গলা থেকে হাত সরিয়ে নেয় ইউসুফ। তথার হাত ছেড়ে দিয়ে দু-হাতে কপাল চেপে ধরে।
তথা বসে পড়ে।ঘন ঘন শ্বাস নেয়।ডানহাতটা মনে হয় অসার হয়ে গেছে। বামহাতে একবার নিজের গলা ছুঁয়ে দেয় তথা।একটানা কয়েক মিনিট কাশি দেয়। গলা শুকিয়ে কাঠ। জ্বিভের আশেপাশে পুরো খরা চলছে।একটু পানি না পেলে বোধহয় মরেই যাবে তথা।তথার চোখ জ্বলে,টুপটুপ করে দু-ফোটা অশ্রু ঝরে পড়ে।
_” পানি খান, কামিনী ফুল।”
ইউসুফও হাঁটু ভেঙে বসে পড়েছে তথার সামনে।তার হাতে একগ্লাস পানি।এদিক-ওদিক তাকায় না তথা। ইউসুফের হাত থেকে থাবা দিয়ে পানির গ্লাস নিয়ে একঢোকে পানি খেয়ে নেয়। আল্লাহ বাঁচিয়েছে।মনে হচ্ছে মৃত্যুর দুয়ার থেকে জানটা ফিরে এসেছে। চোখ বন্ধ করে রাখে তথা।ইউসুফের দিকে তাকানোর সাহস তার নেই।
_” কামিনী ফুল,চোখ খুলুন।চোখ খুলুন বলছি।”
ইউসুফের কথা শোনে না তথা।আগের মতোই চোখ বন্ধ করে রাখে। তবে তথার এই অবাধ্যতা হয়তো পছন্দ হলো না ইউসুফের।সে আবারো দু-আঙুলে তথার দু-গাল চেপে ধরে।নিজের হাতের সমস্ত জোর ঢেলে দেয় তথার গাল দুটোতে। যন্ত্রণায় বাধ্য হয়ে চোখ খোলে তথা। কথা বলার সামর্থ্য নেই তার।দু-চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে কেবল। ঘোলাটে চোখে ইউসুফের দিকে তাকায় তথা।আশ্চর্য! ইউসুফের সবুজ মনির চোখ দুটোও ছলছল করছে। পানিতে টইটম্বুর চোখ দুটো।লোকটা সত্যি কাঁদছে নাকি সবটাই তথার চোখের ভুল?
_” এখন কাঁদছেন কেন,কামিনী ফুল? আমার সম্পর্কে সবকিছু জানার পরেও কেন এতো বড় ভুলটা করলেন? একবারও মনে হয়নি,আমি জানতে পারলে কপালে দুঃখে আছে?”
উত্তর দিতে পারে না তথা।মুখের ভিতরের নরম চামড়াগুলো মনে হচ্ছে দু-পাটি দাঁতের সাথে কেটে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় অস্ফুট শব্দ বেরোয় মেয়েটার মুখ থেকে।ইউসুফের হয়তো কষ্ট হয়। তথার দু-গাল একটু জোরে টিপে দিয়ে হাত সরিয়ে নেয়।
_” আপনাকে খুব সহজ মৃত্যু দেব, কামিনী ফুল।এখানে আসার আগে ভেবেছিলাম খুব সময় নিয়ে, খুব কষ্ট দিয়ে মারব আপনাকে। কিন্তু এখন দেখছি এ সাধ্য আমার নেই।আপনার চাইতে আমার বেশি কষ্ট হয়। ”
এতোক্ষণে স্বর ফুটে তথার গলায়।ক্ষীণ স্বরে বলেঃ” আপনি ভুল ভাবছেন ইউসুফ।আমি, আমি..”
তথার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দেয় ইউসুফ। নরম গলায় বলেঃ” মিথ্যে বলছেন কেন,কামিনী ফুল? মরার আগেও কেউ মিথ্যা বলে? আপনার আর আমার মাঝে লুকোচুরির কিছু নেই।আমার সব আপনি জানেন,আপনার সব আমি জানি।”
_” আমার কথাটা শুনুন একটু।আপনি ভুল ভাবছেন ইউসুফ।”— জীবন বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলে তথা।ফাঁকা ঢোক গিলে সে। ইউসুফের কথায় মনে হচ্ছে প্রাণটাই বেরিয়ে যাবে।
_” আপনি আর কি বলবেন কামিনী ফুল? নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন নিশ্চয়ই। কোনো লাভ নেই।আপনার অভিনয়গুলো আমার চোখে দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল। ইরফান কি আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসে?”
বোকার মতো চেয়ে থাকে তথা।ইরফানের কথাও জানে ইউসুফ! তথার হৃৎপিণ্ডের গতি তীব্র হয়।মনে মনে আরো কয়েক বছরের আয়ু প্রার্থনা করে পরম দয়ালু সৃষ্টিকর্তার কাছে।
তথার দৃষ্টি দেখে উদভ্রান্তের মতো হাসে ইউসুফ। ঠেস দিয়ে বলেঃ” বয়ফ্রেন্ডের নাম কানে যেতেই কথা বন্ধ হয়ে গেল? সেদিন রাতে নদীর পাড়েও খুব সুনাম করেছিলেন এই ছেলের।তখনই বুঝা উচিত ছিল আমার,ইরফান কোনো সাধারণ ছেলের নাম নয়।”
একটুও শব্দ করে না তথা।ইউসুফের কথা তার সব জোর শুষে নিয়েছে।কয়েক সেকেন্ড প্রেয়সীর মুখের দিকে চুপচাপ চেয়ে থাকে ইউসুফ। উদাস গলায় বলেঃ” আপনি প্রতারণা না করলেই পারতেন কামিনী ফুল।প্রতারণায় খুব এলার্জি আমার।আমার বাবাও এরকম চিট করেছিল মায়ের সাথে।আমার দেখা সবচেয়ে খারাপ মানুষ। বহু নারীতে আসক্ত ছিলেন তিনি। আমার বয়স যখন আঠারো, তখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠলাম। রিভলবার তাক করে গুনে গুনে তিনটে বুলেট পুরেছি বাবার বুকে।একদম স্পট ডেড। নিজের বাবাকে মারতে একফোঁটা কষ্ট হয়নি।কিন্তু আপনাকে মারার সময় হাত কাঁপছে আমার। হাত-পা ভেঙে আসছে।আপনি নিশ্চিত জাদুকরী, কামিনী ফুল।”
_” আমাকে ছেড়ে দিন ,প্লিজ। আমি ঢাকা চলে যাব,কাউকে কিছু বলব না।কসম, আপনার সম্পর্কে একটা কথাও আমার মুখ দিয়ে বেরোবে না।”
তথার কথায় আবারো হাসে ইউসুফ।কপালের দু-পাশে লেপ্টে আছে তথার চুল।ইউসুফ আলতো হাতে তথার চুল গুছিয়ে দেয়।
_” বাঁচার আশা এখনো আছে? কি আশ্চর্য! আমি নিজেই আর বাঁঁচব কি না সন্দেহ। আমার বাড়িতে অনেকগুলো গোয়েন্দা পুলিশ এসেছে।তাদের একজনকে মেরে ফেলেছি কাল রাতে। কাজটা একটুও ঠিক হয়নি।মনে হয় না এই কাজের পরেও গোয়েন্দারা আমাকে ছেড়ে দেবে।আমি নিশ্চিত ওরা আমাকে এবার মেরেই দম নেবে ।”
তথার গলা কাঁপে। কাকে মেরেছে ইউসুফ? কাল রাত থেকে শুধু সোনালীকেই দেখা যাচ্ছে না।তবে কি সোনালী? না,না সোনালী নয়।ও তো একটুখানি মেয়ে।ও কি করে গোয়েন্দা পুলিশ হবে?
তথা কাঁপা গলায় বলেঃ” আপনি কাকে মেরেছেন কাল?”
_” সোনালী আহমেদকে।মেয়েটা ভীষণ সাহসী ছিল।কাল রাতে একচোট লড়াই করেছে আমার সাথে।আমার হাঁটুতে দুটো লাথি দিয়েছে,বুকেও একবার লাথি দিয়েছে। এরপর পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে আমার দিকে তাক করলো।ভাবতে পারেন কত সাহস! ”
তথা দু-চোখে অন্ধকার দেখে। ইউসুফ কি নাম বললো? সোনালী? তার মানে সোনালী ঢাকায় যায়নি।তাকে ইউসুফ মেরে ফেলেছে! দু-চোখ বন্ধ করে ফেলে তথা। মানসপটে ভেসে উঠে সোনালীর মিষ্টি হাসিমাখা একটা মুখ।আহ,সোনালী! মেয়েটা খুব ভালো ছিল।
_” এরপর আমি কি করলাম জানেন কামিনী ফুল? গোডাউনে ছুঁড়ি ছিল। সোনালী কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর হাত লক্ষ্য করে একটা ছুঁড়ি ছুড়ে মারলাম।তারপর আরেকটা। আমি খুব সুন্দর ছুঁড়ি চালাতে জানি। সোনালীর রক্তাক্ত হাত থেকে রিভলবার পড়ে গেলে। আরো দুটো ছুঁড়ি নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। ওর চুলের খোঁপা মুঠোতে পুরে হাঁটুতে লাথি দিলাম।সোনালী হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মাটিতে।আর আমি এক ছুঁড়ি ওর গলায় চালিয়ে দিলাম,আরেকটা পেটে। দু-বার লাথি দিলাম ওর পেটে।ব্যাস,সোনালী শেষ।”
তথা দু-হাতে কান চেপে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে বলেঃ” চুপ করুন,আল্লাহর দোহাই লাগে চুপ করুন।”
ইউসুফ মৃদু হেসে তথার হাত নামিয়ে দেয়।
_” শেষটুকু শুনেই নিন, কামিনী ফুল।এরপর মাটি চাপা দিলাম সোনালীকে। তবে আমি তো আর কবর করতে জানি না।তাই কোনোরকম করে একটুখানি মাটি খুঁড়েই সোনালীকে শুইয়ে রেখেছি। দূর থেকে বোঝাই যায় না, ওখানে কেউ শুয়ে আছে।মনে হয় যেন এমনিই মাটি উঁচু করে রেখেছে কেউ। তারপর আমার ঘরে গেলাম।সোনালীর হয়ে একটা চিঠি লিখলাম। চিঠিটা নিয়ে আপনার ঘরে গেলাম।দরজা খোলাই ছিল।টেবিলের উপর চিঠি রেখে, আলমারি থেকে সোনালীর জামা-কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম।তারপর সোনালীর মৃতদেহের মতো তার ব্যাগটাও লুকিয়ে রাখলাম। সব কাজ শেষ করতে করতেই ভোর হয়ে গেল।”
তথা নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকে।কতটা নির্লজ্জ হলে মানুষ নিজের পাপের গল্প শোনাতে পারে! এই লোকের শরীরে কি মানুষের রক্ত বইছে?
ইউসুফ তথার দিকে একপলক চেয়ে পকেটে হাত ঢুকায়।কয়েকি সেকেন্ডের মাঝেই পকেট থেকে বের করে আনে চকচকে রিভলবার।বন্দুকের নল তথার কপালে ঠেকায়।একফোঁটা পানি ইউসুফের চোখ বেয়েও গড়িয়ে পড়ে।ভাঙা গলায় বলেঃ” ভেবেছিলাম এই কপালে শুধু ঠোঁট ছোঁয়াব।কিন্তু আমার ভাগ্যই খারাপ। এই নিয়ামতটুকুও কপালে জুটলো না।আমার কামিনী ফুল স্বচ্ছ নয়,নির্মল নয়।আমার ফুলের মাঝে পোকার বসবাস।”
_” আমাকে ছেড়ে দিন, প্লিজ।”
_” উঁহু, কোনো ছাড়াছাড়ি নেই।আপনাকে খুব সহজ মৃত্যু দেব কামিনী ফুল।প্রথম বুলেটে আপনি মরবেন,দ্বিতীয় বুলেটে আমি। আমার দিনও ফুরিয়ে এসেছে।এখান থেকে বেরোনোর রাস্তা নেই।ধরা এবার পড়তেই হবে।তবে আহমেদ ইউসুফ এতোটা সহজলভ্য নয়।প্রয়োজনে আমি আত্মহত্যা করব।যেন আমি মরার পরেও গোয়েন্দা বিভাগ আফসোস করে। হাতের কাছে পেয়েও মনমতো শাস্তি না দিতে পারার আফসোস তাদের রয়েই যাবে।”
একটু থামে ইউসুফ।একটু নাক টেনে নেয়।তথা আবারো সেই একই অনুরোধ করে।হাত জোড় করে বলেঃ” একটু দয়া করুন,ইউসুফ।আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ।প্লিজ ইউসুফ।আপনার পায়ে পড়ি।”
_” যে পৃথিবী আমার নয়,সেখানে আপনি থেকে কি করবেন কামিনী ফুল? তারচেয়ে চলুন একসাথে জড়াজড়ি করে মরে যাই।তাছাড়া বেঁচে থেকেই কী করবেন? আপনার তো যাওয়ার জায়গা নেই।আপনার চাচাও আমার এজেন্ট। আপনাকে এখানে নিয়ে আসার পিছনে আপনার চাচার অবদান কম নয়।অবশ্য আমাকেও খরচা করতে হয়েছে। গুনে গুনে দশ লাখ খরচ হয়েছে আপনার পিছনে।”
তথা বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে থাকে। কান দুটোতে মনে হচ্ছে গরম সীসা ঢেলে দিয়েছে কেউ।বেঁচে থাকার ইচ্ছেই মরে গেছে। নিজেকে ঠিক পন্য ম্নে হচ্ছে।তথার বোধশক্তি লোপ পায়,হাত-পা ভেঙে আসে।ইউসুফের হাত দুটো ধরে ভাঙা গলায় বলেঃ” আমাকে মেরে ফেলুন ইউসুফ, দয়া করে মেরে ফেলুন।”
চোখ বন্ধ করে তথা।থেমে থেমে শ্বাস নেয়।চোখের উপর ভেসে উঠে রুবির হাসিমাখা মুখ,মাহাদীর মুখ,মাতৃসম কাকির মুখ ও ইরফানের বিষাদগ্রস্ত মুখ।
***
একের পর এক পাতা উল্টে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে যায় শাফিন।অনেকগুলো এগ্রিমেন্ট পেপারের কপি স্টেপলার করা। পুরো কাগজে নজর বুলিয়ে বুঝতে পারে এগুলো আহমেদ ইউসুফের ব্যবসায়িক চুক্তিপত্র। শাফিন এদিক-ওদিক নজর বুলায়।টেবিলের উপর কে রাখলো কাগজগুলো? কাগজগুলো মুড়িয়ে পকেটে রাখে শাফিন।আর সময় নষ্ট করার দরকার নেই।প্রয়োজনীয় প্রমাণ এসে গেছে হাতে।সবাইকে দেখাতে হবে।ইউসুফকে গ্রেফতার করে ঢাকা নিয়ে যেতে হবে।হতচ্ছাড়াটাকে বুঝাতে হবে বিখ্যাত ডিম থেরাপি কাকে বলে।দ্রুত হাতে দরজা খুলতেই আরেক দফা অবাক হয় শাফিন।বসার ঘরে ইরফানকে দেখা যাচ্ছে। এদিক-ওদিক নজর বুলিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে সে।শাফিন এক প্রকার উড়ে যায় ইরফানের কাছে।হতভম্ব গলায় বলেঃ” তুমি কি পাগল, ইরফান? এখানে এসেছ কেন? কেউ দেখেনি তো?”
_” না কাউকেই দেখলাম না।দরজা খোলা পেয়ে চলে এলাম।তথার সাথে একটু দেখা করিয়ে দেও না প্লিজ।এক নজর দেখেই চলে যাব।”
শাফিন কপাল চাঁপড়ায়।ইরফানের হাত টেনে দরজার কাছে যেতে যেতে বলেঃ” পাগলামি করো না।বাড়ি চলে যাও। আমরাও আজকের মাঝেই ঢাকা যাব।তখন দেখো।”
_” কিন্তু শাফিন…
তীব্র আওয়াজে ইরফানের কথা বন্ধ হয়ে যায়।উপর থেকে ভেসে এলো গুলির আওয়াজ।একবার নয় দুইবার।ইরফান ও শাফিন দুজনেই চমকে যায়।ইরফান হতভম্ব গলায় বলেঃ” শাফিন ওটা..
ইরফানের কথা থেমে যায় শাফিনের মুখ দেখেই।শাফিনের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।ইরফানেট হাত ছেড়ে ক্ষীণ স্বরে বলেঃ” ওহ নো,ওপাশে তো তথার ঘর।শব্দটা তো ও ঘর থেকেই এলো।”
একছুটে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায় শাফিন।ইরফান বজ্রাহতের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ।শাফিনের কথা বুঝতে ঠিক দশ মিনিট সময় লাগে তার।তবে যেই মুহূর্তে শাফিনের কথা মাথায় ঢুকে তখনই কাঁধের ব্যাগ ফেলে দেয়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটার বদলে একছুট দেয়।কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই পৌঁছে যায় প্রেয়সীর ঘরের দরজায়।
***
গুলির শব্দ কানে আসতেই একটুখানি মাথা তুলে মামুন।কবরের উপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়েছিল সে।দোতলা থেকে গুলির শব্দ এলো মাত্র।তার মানে তথা মরেছে।শাফিনের কাছে এগ্রিমেন্ট পেপারগুলো পৌঁছে দেওয়া শেষ।এবার ইউসুফ মরবে। মামুন বাঁকা হাসে।দু-দুটো খুনের শাস্তি নিশ্চয়ই ইউসুফ পাবে।কবরের মাটিতে একটূ ঠোঁট ছোঁয়ায় মামুন।অস্ফুটস্বরে বলেঃ” আমি আসছি,প্রিয়তমা।”
পকেট থেকে একটা ছুঁড়ি বের করে মামুন।ছুঁড়িতে টকটকে লাল রক্ত শুকিয়ে আছে।মামুন চোখ বন্ধ করে।দু-ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে চোখ বেয়ে।মামুন চোখ মুছে কবরের উপরে আবার শুয়ে পড়ে।কাঁপা হাতে রক্তাক্ত ছুঁড়িটা চালিয়ে দেয় নিজের গলায়।
চলবে