হৃদয়েশ্বরী #লেখিকাঃ সাদিয়া মেহরুজ দোলা #পর্ব-১৭

0
8

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকাঃ সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব-১৭
_______

উশান, তূর্শীর প্রেমের সম্পর্কটা ছিলো দুই বছর পাচঁ মাসের। বেশ দীর্ঘ সময়! উশান এবং তূর্শী দু’জনের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে হসপিটালে। বেসামাল রূপে বাইক চালাতে গিয়ে উশান এক্সিডেন্টের শিকার হলে তূর্শী তাকে মূর্মূর্ষ অবস্থাতে হাসপাতালে ভর্তি করে। সেদিনিই প্রথম সাক্ষাৎ দু’জনের। তূর্শী মাকে নিয়ে ঢাকাতেই থাকতো। উশানের বিল্ডিং এর পাশে ছিলো তার বাসা।ছাঁদ থেকে প্রায়সই চোখাচোখি হতো দু’জনের। কখনো কথা বলতো না উশান। তূ্র্শী আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসলে সে এড়িয়ে চলতো। নারী সঙ্গ পছন্দ না তার। যার দরুন এই কর্ম।

ব্যাবসার কাজে দেশের বাহিরে থাকা আয়মান একদিন হুট করেই উশানের ফ্লাটে এসে চমকে দেন।সাথে চমকপ্রদ বার্তার সাথে ছুঁড়ে দেন, তূর্শীর সাথে উশানের বিয়ে ঠিক করার ব্যাপারটা৷ উশান সর্ব প্রথম বাবার সিদ্ধান্তে ঘোর মতবিরোধ করার পরও কাজ হয়নি। তেমন কোনো জোর দিয়ে বাবাকে বলতে পারেনি বিয়ে করবো না। আয়মানের কথার খেলাপ করা উশানের পক্ষে সম্ভব নয়। তোরশার সাথে আলাপ করে ঠিক করেন উশান, তূর্শী নিজ পায়ে দাঁড়ালে তবেই তাদের বিয়ে হবে। বিয়ের ব্যাপারটা ওখানেই স্থগিত হলো। আয়মান ফিরে গেলো নিজের কর্মস্থলে। তারপর হতে উশান না চাইতেও তূর্শীকে ইগনোর করতে পারেনি। তরুণী তূর্শীর চঞ্চলতা, ম্যাচিউরিটি, চমৎকার সৌন্দর্য সব মিলিয়ে উশান নারী জাতির প্রতি বোধহয় সেইবার বহু বছর পর একটুখানি নম্র হলো। প্রণয়ের বাঁধনে একটু একটু করে আটকা পড়লো। দুই পরিবারের পক্ষ হতেই ‘ ম্যারিটিয়াল কোর্টশিপ ‘ এর অনুমতি ছিলো। ব্যাস! এখন আর বাঁধা কিসের? দু’জনে জরীয়ে পড়লো প্রণয়ের সম্পর্কে। আশেপাশের সকলের কাছে তখন তারা প্রেমিক – প্রেমিকা।উশান এর দিক থেকে প্রেমটা ছিলো পবিত্র, শুদ্ধতম। তবে তূর্শীর দিকটা ধোঁয়াশা কেবল।

উশান, তূর্শী নিয়ম করে প্রতিদিন সময় বের করে ঘুরতে যাওয়া। পার্কে হাত ধরে হাঁটা- হাঁটি, একসাথে শপিং করা, লেট নাইট লং ড্রাইভ! আরও কত কি। কিন্তু সময় বহমানের সহিত উশান খেয়াল করলো তূর্শীর বিশাল পরিবর্তন। ‘ ছলনা ‘ বলে এক নতুন শব্দ তার সাথে যুক্ত হলো বোধহয়। বছর দুয়েক পার হতেই তূর্শী সম্পর্কে আনমনা। উশানের সাথে পদে পদে অকারণে ঝগড়া, রাগারাগি প্রকাশ। হুট করে এমনটা হওয়ার কারণ উশান খুঁজে পেলো না। পাঁচ মাস পেরুতে না পেরুতেই মিললো তূর্শীর পরিবর্তনের কারণ। সম্পর্ক ভাঙার জন্য তার কত কি উদ্ভট বক্তব্য! উশান বেকার। উশানের পরিবার নিম্নতর৷ কথা গুলো যখন তূর্শী ক্যাফেতে বসে বলল, উশান চরম মাত্রার রেগে সেই প্রথমবার কোনো নারীর গায়ে আঘাত তুললো। থাপ্পড় মে’রে বসলো পরাপর দু’টো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে। কড়া কয়েক কথা, অপমান করে সে চিরতরে সরে আসলো তূর্শী থেকে। তার কয়েক দিন পর। সকালে তার ফ্লাটে তূর্শী পুলিশ নিয়ে হাজির হয়। অভিযোগ করে তাকে মেন্টালি হ্যারেজ করছে উশান কয়েকমাস সম্পর্ক ভাঙার জন্য। তাকে কাল রাতে ফ্লাটে ডেকে জবরদস্তি করার চেষ্টা করেছে। মিথ্যা কথা বলা শেষে ইডিটেড এক ভিডিও প্রদান করে তূর্শী। সেই ভিডিওতে ছিলো প্রথম সে যেদিন উশানের ফ্লাটে এসেছিলো সম্পর্কে থাকাকালীন সেদিন ইচ্ছে বসতই উশানের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে। সেটাকে ইডিট করে বিশ্রি বানিয়েছে। উশানের পাশের ফ্লাটের মানুষদের দ্বারা মিথ্যা বক্তব্য পেশ করে উশানকে সে সেদিন জেলে ঢোকাতে সফল হয়েছিলো বটে। তার কয়েক মাস পর! উপযুক্ত প্রমাণে বেড়িয়ে আসে জেল থেকে উশান। তারপর আর কোথাও তূর্শীর হদিস পায়নি সে। জানতে পারেনি কেনো সে এমনটা করলো? মিথ্যা অভিযোগ করে জেলে পাঠানোর কারণটা আজও খুঁজে পায়নি উশান। তূর্শীকে খুঁজেছে, কিন্তু পায়নি! দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলো তূর্শী।
শেষে কয়েকদিন পূর্বেই দিগন্ত দ্বারা বার্তা মিলেছে, তূর্শীর বর্তমান অবস্থান যশোরে।সে সি.আই.ডি অফিসার পদে অন্তর্ভুক্ত আছে।

মীরা এই নিয়ে দ্বিতীয়বার কথাগুলো স্বগতোক্তি করলো। তার অন্তঃকরণের দশা বেহাল প্রায়।এই তবে কারণ তার প্রপোজাল রিজেক্ট করার?তূর্শী উশানের প্রেমিকা ছিলো! উশান ভালোবাসতো তূর্শী কে। এই কথাগুলো যতবার স্বগোতক্তি করেছে মীরা ততবারই কষ্টে তার বক্ষঃস্থল কেঁপে কেঁপে উঠেছে। ইশ! এক তরফা ভালোবাসার এতোটা কষ্ট কেনো?

-‘ মীরা! আমি আসছি।কাজ আছে। সেই কাজ শেষ করে তবেই ফিরবো। আপুকে দেখে রেখো কষ্ট করে। আমি আসার পরই একসাথে চট্টগ্রামের জন্য বের হবো। ‘ উশানের ভরাট কন্ঠ!

মীরা চমকে ডিভান থেকে উঠে সটান হয়ে বসলো। উশান দাঁড়িয়ে। তার পিছনে ঘুমে ঢুলছে তীব্র, উজান, দিগন্ত! উঠে দাঁড়িয়ে উশানের নিকটবর্তী আসলো মীরা। জিজ্ঞেস করলো,

-‘ ব্রেকফাস্ট না করেই চলে যাচ্ছেন কেনো? বসুন!আমি ব্রেকফাস্ট দিচ্ছি। ‘

-‘ উঁহু! তার দরকার নেই। অলরেডি লেট হয়ে গেছে অনেক। কোনো দরকার পড়লে ফোন দিও। ‘

চারজন দ্রুত পদে বের হলো। মীরা তপ্তশ্বাস ছেড়ে দরজা লাগিয়ে পূর্বের ন্যায় ডিভানে এসে বসলো। উশান তাকে এখন আর ‘ তুই ‘ করে সম্মোধন করে না। ‘ তুমি ‘ বলেই সম্মোধন করে। মীরা কারণ জিজ্ঞেস করেছিলো। উশানের প্রতিত্তুর ছিলো এরূপ কিছুটা, ‘ তোমার এবং আমার মাঝে তেমন কোনো আত্নীয়তা নেই। কাজিন নয় যে তোমাকে আমার ‘ তুই ‘ বলার অধিকারটা থাকবে। তাই তুমিই বলবো। এতদিন ‘ তুই ‘ বলার জন্য সরি। ‘

মীরা আহত হয়! উশান কি তাকে একটুও আপন মনে করে না? উশানের মুখে ‘ তুমি ‘ ডাকটা ভীষণ মিষ্টি লাগে বৈকি। তবে তবুও! কোথায় যেনো এক শূন্যতা থাকেই।

____

গোধূলি বেলা। বিকেলের শেষাংশ চলছে মেদিনীতে।বাতাসে বহমান আমের মুকুলের মিষ্টি সুঘ্রাণ। পশ্চিমে হেলে পড়েছে হলদেটে সূর্য। জানান দিচ্ছে তার বিদায় বার্তা৷ নামবে ঘোরতর আঁধার কিয়দংশ এর মাঝেই। বহির্ভাগ হতে দৃষ্টি সরিয়ে মীরা ব্যাস্ত হয় ব্যাগ গুছাতে। তাকে সাহায্য করছে উমাইশা। মেয়েটা স্বাভাবিক হয়েছে বেশ খানিক। মীরা,রুহি দু’জনের সাথেই হেঁসে কথা বলছে। মীরা স্বস্তি পায় এতে কিছুটা। সে ভেবেছিলো ঘুম থেকে ওঠার পর উমাইশা হয়তো অনেকটা অস্বাভাবিক আচরণ করবে। উমাইশার মুখোশ্রীতে হটাৎ ক্লান্ততা ফুটে উঠে। মীরা তা খেয়াল করে চটপট বলল,

-‘ আপু তোমার আর হেল্প করা লাগবে না। তুমি বসে রেস্ট করো আমিই পারবো। ‘

উমাইশা বিরোধিতা প্রকাশ করে বলল,

-‘ না! তা কি করে হয়? এতো কাজ একা হাতে সামলাতে তোমার কষ্ট হবে মীরা। ‘

-‘ একটুও কষ্ট হবেনা। বসো তুমি! আমি নাহয় রুহির থেকে হেল্প নিবো। ‘

উমাইশা অনিচ্ছা সত্বেও বসলো। মীরা উঁচু কন্ঠে রুহিকে দুই একবার ডাক দেয়ার পর কক্ষে হাজির হয় রুহি। তার মুখোশ্রী ফ্যাকাশে, বিবর্ণ! ওষ্ঠাধর শুকিয়ে চৌচির! কালো ঘন কেশের দল সম্পূর্ণ এলোমেলো। মীরা, উমাইশা দু’জনেই চমকে উঠলো রুহির বেশভূষা দেখে। কিয়ৎ বিচলিত কন্ঠে মীরা বলে উঠলো,

-‘ তোর আবার কি হলো? এমন পাগলের বেশভূষায় ঘুরতেছিস যে। ‘

রুহি স্বশব্দে বসলো ভূমিতে। মুখোশ্রীতে কৃত্রিম ক্রন্দন ভাব টেনে বলল,

-‘ দোস্ত..! ব্রেকআপ হয়ে গেছে আমার। ‘

মীরা ফিক করে হেঁসে দিয়ে বলল, ‘ এই নিয়ে কত নাম্বার ব্রেক-আপ হলো তোর? ৬ নাকি ৭? ‘

রুহি নাক টেনে বলল, ‘ ৭! আর খবরদার মীরা হাসবি না। আমি কষ্ট পাইতেছি আর তুই হাসতেছিস? ‘

-‘ একশোবার হাসবো! তুই আমার সামনে যতক্ষণ থাকবি ততবারই হাসবো। ‘

-‘ চুপ কর মীরা..! ব্রেকআপ এর থেকে আমার বেশি কষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে আমি এখন সিঙ্গেল। তুই ভাবতে পারতেছিস? সিঙ্গেল আমি এখন! আহ্! জীবনে এতো কষ্ট কেনো আমার? ‘

মীরা হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মনোযোগী হলো সে। রুহির দিকে ধ্যান দিয়ে আপাতত লাভ নেই। এই মেয়ের অহেতুক আহাজারি প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে চলবে।আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে কক্ষ থেকে প্রস্থান করলো রুহি। উমাইশা তখনও হতভম্ব! কি থেকে কি হয়ে গেলো বুঝলো না সে। মীরাকে স্বাভাবিক দেখে তার কৌতূহল বাড়লো। তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন ছুড়লো,

-‘ এটা কি ছিলো মীরা? রুহি এমন কেনো করলো?যতদূর বুঝলাম ব্রেকআপ হয়েছে দেখে এমনটা করলো কিন্তু ৬,৭ নাম্বার মানে? ‘

মীরা ম্লান হেঁসে বলল, ‘ রুহির ব্রেকআপ হওয়া নতুন কিছু নয় বুঝলে আপু? ও এর আগে আরো ছয়টা রিলেশনে ছিলো। দুই, তিন মাস পরপরই ব্রেকআপ করে ফেলে। সি ইজ এ প্লে গার্ল! ‘

উমাইশা বিস্মিত কন্ঠে বলল, ‘ এমনটা করার কারণ নাকি অযথাই?’

-‘ উঁহু! আছে কারণ। অন্য একদিন বলবো তোমায়।’

উমাইশা খেয়াল করলো মীরার মুখোশ্রীতে সুপ্ত পরিবর্তন।অদৃশ্য যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ কি?
মীরা ঘড়িতে সময় দেখলো। উশান তাকে দুপুরে ফোন করে বলেছিলো তিন জন কে তৈরি হয়ে থাকতে বলেছে। রাতে ফিরে এসেই রওনা দিবে বিলম্ব দেরী না করে।

___

রজনীর দ্বিতীয় প্রহর। ঘড়ির কাটা তখন বারোটা ছুঁই ছুঁই! ট্রেনে ওঠার বিশ মিনিট পেরুতে না পেরুতেই কেমন শ্বাস রুখে আসছে মীরার। বাধ্য হয়ে উঠে দাঁড়ালো কেবিন থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে। উমাইশা এবং রুহি দু’জনেই ঘুমে মগ্ন। এই কেবিনে শুধু তারা তিনজন। পাশের কেবিনে উশান, তীব্র আর দিগন্ত বুক করেছে।

মীরা বিড়াল পায়ে বিনাশব্দে এসে দাঁড়ালো ট্রেনের দরজার নিকট। দমকা শীতল হাওয়া তৎক্ষনাৎ তার সর্বাঙ্গ মিষ্টি করে ছুঁয়ে গেলো। মীরা নেত্র যুগল বন্ধ করলো। টেনে নিতে লাগলো সতেজ অনিল। অনিলে বহমান বুনো ফুলের সুমিষ্ট ঘ্রাণ। কিয়ৎক্ষণ বাদে আনমনা হয়ে নেত্রযুগল বন্ধ থাকা অবস্থায় অস্থিতিশীল পায়ে কাত হয়ে ট্রেনের দরজা দিয়ে বাহিরে পড়ে যেতে নিতেই আৎকেঁ উঠে মৃদু শব্দে ‘আল্লাহ ‘ বলে চেঁচিয়ে উঠতেই হাতে হেঁচকা টান অনুভূত করলো সে। স্পষ্টত উপলব্ধি করলো তার কো’মড়ের পিছন বজায় শক্তপোক্ত এক বলিষ্ঠ হাত। ঘাড়ের কাছে আরেক হাত আগলে ধরে রয়েছে তাকে। মীরা চমকে নেত্রজোড়া উন্মুক্ত করলো। সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যমান হলো তার উশানের রুষ্ট চাহনি। তড়িৎ বেগে উশান ছিটকে সরে দাঁড়ালো। বিরক্তমাখা সুরে বলল,

-‘ মারা যেতে ইচ্ছুক হলে মারা যাবি সুন্দর ভাবে। এভাবে ট্রেন থেকে ছিটকে পড়ে গিয়ে মরে মজা আছে নাকি? ‘

মীরা হকচকিয়ে তাকালো। আশ্চর্য! লোকটা পাগল হলো নাকি? বিষ্ময়কর দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে মীরা বলে উঠলো,

-‘ আশ্চর্য তো! আমি মরতে যাবো কেনো? মাথা খারাপ হয়েছে আপনার? ‘

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here