হৃদয়েশ্বরী #লেখিকা- সাদিয়া মেহরুজ দোলা #পর্ব–১৬

0
102

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা- সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব–১৬

-‘ তখন আমায় বয়স ১২। সাইকেল চালাতে গিয়ে ভুলবশত এক্সিডেন্ট হয় আমার। তারপর থেকেই হাঁটুর ব্যাথার যন্ত্রণা। আম্মু প্রায়শই ঔষধ বলে আমায় একটা ইনজেকশন দিতো। ছোট ছিলাম তখন। ভেবে নিয়েছিলাম ঔষধই হবে।কিন্তু নাহ। আম্মু সেদিন থেকেই ঔষধের নাম করে আমায় ড্রাগ দিতো। ড্রাগের বিষয়টা জানতে পারি এইচএসসি পরিক্ষা যখন দিচ্ছিলাম। আম্মু ফোনে কারো সাথে বলছিলো আমায় ড্রাগ দেয়ার কথা। লুকিয়ে শুনে নিয়েছিলাম। লম্বা সময় নিয়ে ড্রাগ দেয়ার জন্য আমি নিজের মাঝে থাকতাম না। আমার মস্তিষ্ক ছিলো তখন আম্মুর দখলে। যখন আম্মু আমায় যা করতে বলতো তাই করতাম। উশান! ভাই, তোকে যে দুই দুইবার ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চেয়েছি আরো অনেক ভাবে আহত করতে চেয়েছি সব আম্মুর কথায়। নিজেকে তখন আমি কন্ট্রোল করতে পারতাম না। ড্রাগ নিতে নিতে আমার শরীর প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলো। কাওকে কিছু বলতে পারতাম না। বলতে গেলে আম্মু শিকল দিয়ে পেটাতো। তারপর একদিন শুনলাম আম্মু আমায় বিক্রি করে দেয়ার চিন্তা – ভাবনা করছে। দেহ ব্যাবসায় এলিয়ে দিতে চাইছে। সেদিন খুব সাহস করে, নিজের মস্তিষ্কের সাথে যুদ্ধ করে পারি দিলাম কলকাতা। আমার কাছে টাকা ছিলো না। জীবনে প্রথমবার জান, ইজ্জত বাঁচাতে সোনা, টাকা নিয়ে পালিয়ে গেলাম। তখন আমার মস্তিষ্কে ছিলো না কাওকে কিছু বলা উচিত। শুধু মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশ ছাড়তে হবে। এই নরক থেকে বের হতে হবে৷ কলকাতায় হোটেলে কাজ করতাম। ছোট একটা বাসা ভাড়া করে থাকতাম। শরীর, মন, মস্তিষ্ক যখন সুস্থ হলো তখন মনে হলো বাংলাদেশে ফেরা উচিত। ফিরে শুনি আম্মু সবার কাছে রটিয়েছে আমি এক ছেলের সাথে পালিয়েছি। কিছু বলিনি। মুখ বুজে সহ্য করে তোর ঠিকানা জোগাড় করেছি।তারপর এখানে আসা। আমায় মাফ করে উশান। আমি সত্যিই তোকে কখনো নিজ ইচ্ছেতে প্রাণে মেরে ফেলতে চাইনি। ‘

উমাইশা হু হু করে কেঁদে উঠলো। উপস্থিত ছয় জন ব্যাক্তি তখন নিস্তব্ধ। অন্তরাত্মা কাঁপছে। মস্তিষ্কের অবস্থা বেহাল তাদের। নিজের আপন জন্মদাত্রী মা কখনো সন্তানের সাথে এতোটা কলুষিত আচরণ করতে পারে? একজন মানুষ, একজন মা হিসেবে কতোটা ভয়ংকর ঊষা তা আবারও প্রমাণিত হলো! প্রতিটা সন্তানের প্রশ্রয়স্থল, স্বস্তির স্থান, ভরসাযোগ্য ব্যাক্তি এবং সকল ঝামেলা থেকে শান্তি প্রদানের অন্যতম ব্যাক্তি হয় ‘ মা ‘। দিনশেষে সেই মা যদি এতোটা কুৎসিত মনের হয় তাহলে সন্তানের কি হাল হবে? তীব্র কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,

-‘ ঊষা..! ইনি না একজন মা, না মানুষ। সে একজন নরপিশাচ। মায়ের জাতকে কলুষিত করেছে। ‘

উশান সবসময়কার মতো শান্ত। সর্ব পরিস্থিতিতে শান্ত থাকা তার একান্ত ব্যাক্তিত্ব। উজানের মতো রাগী নয় সে। নির্বিকার রূপে উশান এসে বসলো বোনের পাশে। আদুরে হাতে স্পর্শ করলো এক গুচ্ছ কৃষ্ণকালো কেশ। উমাইশা ক্রন্দনরত অবস্থায় উশানের বক্ষঃস্থলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে ক্রন্দনের পরিমাণ দ্বিগুণ হচ্ছে। মীরা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,

-‘ আপু কাঁদবেন না প্লিজ। আপনার ক্ষতি হবে অনেক। এমনিতেই আপনি অনেক দূর্বল। ড্রাগ এফেক্ট আপনার হার্ট দূর্বল করে দিয়েছে। ‘

মীরা উশানকে ইশারায় উমাইশা কে শান্ত করাতে বলল। উশান কয়েকবার বলল বোনকে চুপ হতে, শান্ত হতে। কিন্তু উমাইশার অবস্থা বেগতিক। শেষে তপ্তশ্বাস ফেলে উশান দক্ষ হাতে উমাইশার কাঁধে ইনজেকশন পুশ করে দিলো। তৎক্ষনাৎ ঘুমে কাতর হয়ে পিছনে হেলে পড়লো উমাইশা। বোনকে সঠিক ভাবে শুইয়ে দিয়ে উঠে আসে উশান। সঙ্গে সঙ্গে দিগন্ত বলে উঠে,

-‘ স্যার? ম্যামকে এখন কোথায় রাখবেন? উমাইশা ম্যামের প্রাণ শঙ্কা রয়েছে। আর, ডাক্তার না বলল ম্যামকে স্বাভাবিক করতে খোলামেলা জায়গায় নিয়ে যেতে? ‘

উশান নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলল,

-‘ মীরার সাথে আমরাও চট্রগ্রাম যাচ্ছি।আমার চার দিনের ছুটি আছে। প্রস্তুতি নাও সবাই। আপুকে ছদ্মবেশে নিয়ে যাবো। ঊষা তো ঢাকায়। চট্টগ্রাম নিয়ে আপুর মাইন্ড ফ্রেশও সহজে করা যাবে। ‘

উজান তৎক্ষনাৎ ফোড়ন কেটে বলল,

-‘ তোরা যা ভাই। আমি আসতে পারবো না। থানায় জরুরি কাজ আছে। আমি বরং তোদের সাথে সিক্রেট দু’জন পুলিশ দিয়ে দিবো। তোদের সর্বক্ষণ সুরক্ষা দিবে। ‘

-‘ পুলিশ দরকার নেই। গার্ড আছে আমার। ‘

-‘ অহ! তাহলে তো হলোই। আজ থাকছি। কাল সকালে যাবো। ‘

-‘ রেষ্ট কর। ঘুমিয়ে পড়তে পারিস সবাই। আমি জেগে আছি। আপুকে আমি দেখবো। ‘

সকলে সম্মতি জানায়। শুধু মীরা বাদে। সে জেদ ধরেছে উমাইশার পাশে থেকে আজ রাত নির্ঘুম কাটাবে। কয়েকবার চোখ রাঙানি দিলেও মীরা উশানকে তোয়াক্কা করেনি। পরিশেষে সকলে আলাদা রুমে চলে যায় ঘুমোতে। মীরা বেলকনিতে আসে। অতঃপর তার কিছুক্ষণ পর সেখানে উপস্থিত হয় উশান। এসেই গা এলিয়ে দেয় সে বেতের সোফায়। মীরা ভ্রু’কুটি কুঁচকে নিয়ে বলল,

-‘ আমার বানানো কফি খেতে পারেন না, তো এখন আমার বাসায় স্বাচ্ছন্দে থাকছেন কিভাবে? ‘

জবাব এলো খানিকক্ষণ বাদে। উশান ভরাট কন্ঠে বলল,

-‘ এটা শুধু তোর বাসা না মীরা। এটা রুহির ও বাসা।রুহিকে আমি নিজের ছোট বোনের মতো দেখি। ছোট বোনের বাসায় স্বাচ্ছন্দেই তো থাকা উচিত রাইট?’

মীরা ঠোঁট বাঁকিয়ে বহির্ভাগে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে। লোকটা চালাক বেশ! সব প্রশ্নের উত্তর যেনো ঠোঁটের ডগায় থাকে।কখনোই সে উশানকে ঠিক মতোন কথার প্যাচে ফেলে কাবু করতে পারলো না। ব্যার্থতা! উশান অনায়াসে নেত্রযুগল বন্ধ করে নিয়েছে সেই কখন। যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়।

আশপাশ দেখায় ব্যাস্ত মীরা এক পলক উশানের পানে দৃষ্টি ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে থমকানো অনুভূতি অনুভব হলো তার। বহু বছর পর আজ আবারও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার ইচ্ছে হলো পাথর মানবটাকে। উশানের গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের। সহজ বর্ণনায় তাকে হলুদ ফর্সা বলা চলে। বাদামী রঙের চুল। ঘন কালো নেত্র উপরের ভ্রু যুগল। প্রতিদিন কড়া নিয়মে শারীরিক ব্যায়াম করার ফলস্বরূপ ফিটফাট বডি। লম্বায়ও বিশাল। পাঁচ ফুট নয় তো হবেই মীরার বোধগম্য হলো। তবে কয়েকদিন ধরে মুখের সেই প্রাণোচ্ছল, সতেজতা নেই। মুখোশ্রী শুকিয়ে কাঠ। লালচে, বাদামী সংমিশ্রণের ওষ্ঠাধর যুগল শুষ্কতায় চৌচির। গালের চাপ দাঁড়ি বেড়েছে অনেক। শীতল অনিল শা শা শব্দে এসে বাদামী রঙা একগাছি কেশ উশানের মুখোশ্রীর ওপর এসে পড়লো। তবুও নেত্রযুগল উন্মুক্ত করার কোনো তাড়না নেই উশানের মাঝে। ঘুমিয়ে কুপোকাত নাকি?

দৃষ্টিপাত, গভীর চাহনি সরিয়ে অন্যত্রে ছুঁড়ে ফেলে মীরা। লোকটাকে দেখলে শ্বাস রুখে আসে। যদিও তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই উশানের মুখোশ্রীতে। তবে চেহারায় উপচে পড়া মায়া আছে শতগুণ। এই দিকটা! মীরাকে পদে পদে আকৃষ্ট করে। দূর্বল করে ফেলে।

-‘ কাছে আয় তো মীরা। ‘ ভরাট কন্ঠ!

মীরা চমকিত হয়ে পিছনে ফিরলো। উশান তখন তার একহাত দিয়ে মাথার ঘন কালো কেশে হাত ডুবিয়ে চুল জোরে জোরে টানছে৷ মীরা চমকে বলে উঠলো,

-‘ কেনো? কিসের জন্য? কি কারণে? ‘

-‘ আয় আগে। তারপর বলছি। ‘ উশানের কন্ঠে যন্ত্রণার আভাস।

মীরা নিভলো। বক্ষঃস্থল কেমন চিনচিন করছে হুট করেই। লোকটার কন্ঠ এমন শোনালো কেনো?ত্রস্ত পায়ে এগোল মীরা। উশানের পাশের বেতের সোফায় গিয়ে বসলো সে। উদ্বেগ নিয়ে বলল,

-‘ আর ইউ ওকে? ‘

উশান নেত্রযুগল উন্মুক্ত করলো। নেত্র জোড়ার সাদা অংশ রক্তিম। টলমলে চাহনি। মীরা ভড়কালো। কি আশ্চর্য! এর আবার কি হলো? উশান কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

-‘ আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে মীরা। চারদিকের এতো এতো ঘটনা আমি আর নিতে পারছি না। একটা, একটা রিকুয়েষ্ট রাখবি? ‘

-‘ বলুন। ‘

-‘ একটু মাথা চেপে দিবি? শুধু চুলগুলো টানলেই হবে। স্পর্শ করতে না চাইলে করার বিন্দুমাত্র দরকার নেই। ‘

উশানের কন্ঠে আকুতি প্রকাশ পেলো। মীরা মনে মনে ভাবলো, ‘ আপনি এমন আকুতি – মিনুতি করে না বলে আমায় আদেশ স্বরূপ কথাটা বললেও আমি পালন করতাম আপনার আদেশ উশান। ‘

তন্মধ্যে কিয়ৎক্ষণ চুপ রইলো মীরা। তারপর উঠে চলে গেলো। উশান তপ্তশ্বাস ফেলে নেত্রযুগল ফের বন্ধ করে নিলো। এমনটাই প্রাপ্য সে। কম কষ্ট তো দেয়নি মেয়েটাকে। এখন কেনো আবার মীরা তাকে সাহায্য করবে?
কিয়ংদাশে বাদে! উশান তখন বদ্ধ আঁখিতে মাথার তীব্র যন্ত্রণা সহন করতে ব্যাস্ত। শীতল হাতের কোমল স্পর্শ তীব্রতর ভাবে সে টের পেলো নিজের কপালে। অতীব শীতল, ঠান্ডা, জ্বলুনি অনুভূত হলো তারপর স্বস্তি। মীরা মাথা ব্যাথা কমানোর জন্য মুভ আনতেই গিয়েছিলো ভিতরে। মাথায় ধীরস্থির হাতে তরল প্রলেপ লাগিয়ে আস্তে আস্তে চেপে দিতে থাকলো। উশান নেত্রপল্লব উন্মুক্ত করলো না। উন্মুক্ত করলেই বিপদ! তার চোখ কথা বলে, হাসে, কাঁদে, রাগ প্রকাশ করে, দুঃখ বিলাপ করে! আরও কত কি অনুভূতি প্রকাশ করে ফেলে।মনোযোগ দিয়ে দেখলে বোঝা যায় চোখের ভাষা তবে মনোবিজ্ঞানী ছাড়া স্পষ্টত কেও এই চাহনি সম্পর্কে সঠিক ধারণা রপ্ত করতে পারবে না। এদিকে মীরা তো মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী। আপাতত যে অনুভূতি ফুটে উঠেছে তার নেত্র পাতায়। তা সে দেখাতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছুক নয়৷

তারপর ঘোর নীরবতা পালন। মীরা মৌনতা ভেঙে বলল,

-‘ তূর্শীর সাথে আপনার সম্পর্ক কি বলুন তো? ও আপনাকে জ্বেলে কেনো পাঠালো তাও মেন্টালি হ্যারেজ করার মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে। ‘

উশান ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। মৃদু কন্ঠে বলল,

-‘ জেনে গেছিস তাহলে। ওয়েল, সো! তূর্শী আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড ছিলো। ‘

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here