হৃদয়েশ্বরী #লেখিকা-সাদিয়া মেহরুজ দোলা #পর্ব__০৬

0
63

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা-সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব__০৬

ঘড়ির কাঁটার অবস্থান তখন রাত দশটায়। নিঃশব্দ, নির্জনতা বিরাজমান আশপাশে। কোলাহলের ছিটে ফোঁটা অব্দি নেই। ফিনাইলের কটু গন্ধ নাক দ্বারা অন্তরালে প্রবেশ করে নিভৃত বিষিয়ে তুলছে উশানের। পাশে থাকা বদ্ধ কেবিনগুলো থেকে ভেসে আসছে আর্তনাদ ভরা চিৎকার। অদূরে নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে কয়েকদল তরুণ, তরুণী। স্তব্ধ হসপিটাল করিডর ধীরেধীরে কোলাহলে পূর্ণতা পেতে নিলেই ওয়ার্ড বয় এসে পরিবেশ সামাল দিয়ে স্বাভাবিক করে তুললো তৎক্ষনাৎ।

উশান লম্বা লম্বা শ্বাস টানে। হাসপাতালের পরিবেশ তার অন্তঃকরণ কাঁপিয়ে তুলছে ক্রমশ। হৃদপিণ্ডের অস্বাভাবিক স্পন্দন শুরু হয়েছে মাত্রই। অস্থির, অস্থির লাগছে কেমন ভেতরটা। তবুও সে নিজ স্থানে অনড়! এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে তার সামনে বসে থাকা রমনীর প্রতি৷ মীরার বিধ্বস্ত রূপ তাকে ক্রমশ উলোট-পালোট করে তুলছে। কেনো হচ্ছে এমন কারণটা সম্পর্কে তার অন্তঃকরণ ভাবনা শূন্য।
মীরা ঊষার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে নিষ্প্রভ চাহনি ফেলে রেখেছে বিলাসবহুল হাসপাতালের মেঝেতে।লহমায় ঊষা তার আদুরে স্পর্শ একে দিচ্ছে মীরার ঘন কেশে। মীরা অনুভূতি শূন্য! সবকিছু নিষ্প্রাণ লাগছে তার। উশান এবার ধৈর্যহারা হয়ে গলা ঝেড়ে বলল,

‘ এখানে কেও মারা যায়নি যে এমন অনুভূতিহীন মূর্তির মতো বসে থাকতে হবে। ‘

মীরা তার চিবুক হতে থুতনি তুলে সম্মুখে নিষ্প্রাণ দৃষ্টি ফেললো। তৎক্ষনাৎ তার নজরে এলো উশানের নির্নিমেষ চাহনি। ঘন নেত্রপল্লবের স্থিরতা। অচঞ্চল নেত্রজোড়া পুরোপুরি শান্ত, নম্র। দু’জোড়া নেত্রের শান্ত, স্থিরতা হতে হুঁশে আনলো ঊষা। শক্ত কন্ঠে বলল,

‘ এটা কেমন কথা উশান? মীরার ভাই অসুস্থ ওর মন খারাপ থাকবেই। তোমার মতো তো আর হার্টলেস না ও যে ভাই – বোনের জন্য দরদ থাকবে না। ‘

উশান নিজের রূপে ফিরলো চটপট। সেই আগের মতো চেহারায় ফুটিয়ে নিলো ছন্নছাড়া, ঝাঁঝ মেশানো চাহনি। কড়া তাচ্ছিল্যতা! অধর কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে উঠে দাঁড়ায় সে। এমন ভাব, যেনো ঊষার কথা কানেই যায়নি তার। মীরা একটু ভড়কে যায়। এই মা, ছেলের সম্পর্কটা তাদের কাছে ভীষণ অদ্ভুত এবং রহস্যজনক ঠেকে। উশান ঊষার সাথে যেই স্বভাবগত ব্যাবহার করে তার পিছনে যে আরেক রুষ্টপূর্ণ ব্যাবহার আছে তা জানে মীরা।এর পিছনে কারণটা মীরার জানা নেই।ঊষা ছেলেকে নিয়ে যেই দরদ পেশ করেন সেই মায়া, মমতা যে কৃত্রিম তা মীরা ঢের বুঝতে পেরেছে এবার চট্টগ্রাম গিয়ে।

উশান উঠে দাঁড়িয়ে জনমানবহীন এক স্থানে এসে দাঁড়ায়। তপ্তশ্বাস ফেলে অন্তরীক্ষে তাকাতে নিলেই তার চোখে পড়ে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মাহদিকে। মনমরা হয়ে বেঞ্চিতে বসে তিনি। উশান শ্রান্ত পায়ে সেদিকে এগোলো। মাহদির পাশে বসে কাঁধে হাত দিয়ে আশ্বাস ভরা কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ কাঁদছেন আংকেল?কাঁদবেন না প্লিজ। মায়ান ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তার বললো না? জ্ঞান ফিরে আসবে জলদিই। ‘

উশান থামে। মাহদি কথা বলতে নিলেও পারেন না।কন্ঠনালি জমাট তার। আদরের ছেলের এই অবস্থার জন্য সে নিজেকেই দায়ী করেন। মায়ান কাল দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে বন্ধুদের নিয়ে সাইকেল নিয়ে বেড়িয়েছিলো। সাইকেল চালিয়ে রোডে আসতেই পিছন থেকে গাড়ি এসে ধাক্কা দেয় সজোরে। মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে লালচে রক্ত দ্বারা আশপাশ রাঙায়িত করে। হাসপাতালে নেয়ার পর প্রাথমিক চিকিৎসায় মোটামুটি ভালো হওয়ার পর মায়ান জেদ ধরে মীরার কাছে ফিরবে। তার জেদের কাছে হেরে মাহদি ঊষার সাথে ঢাকা আসে। ঠিক সেখানেই বিশাল বিপত্তি! সবেমাত্র হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাওয়া মায়ান ভ্রমণ পথেই মাত্রাতিরিক্ত অসুস্থ হয়ে পড়ে। রক্তবমি করে সেই যে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে আছে ঢাকায় এসে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার পরও একই অবস্থা। জ্ঞান ফিরেনি। ডাক্তার বলেছে দ্রুতই জ্ঞান ফিরে আসবে।

মাহদি অপরাধী কন্ঠে বলল,

‘ মীরার কাছে আমি মুখ দেখাই কি করে বলো তো বাবা। মেয়েটা আমার ছোট হওয়া সত্বেও মায়ানকে কতো সুন্দর করে সামলেছে, আগলে রেখেছে। আর আমি?বাবা হয়ে কতটুকুই বা করতে পারলাম সন্তান এর জন্য। ‘

‘ মীরা মায়ানকে নিয়ে একটু বেশিই পজেসিভ মেবি।ওকে অনেক ভেঙে পড়তে দেখলাম। ‘

‘ হুম! মীরা মায়ানের প্রতি বহু আগ থেকেই ভীষণ দূর্বল।মায়ানকে জন্ম দিতে গিয়ে যখন আফরা মারা গেলো সেদিন থেকেই মীরা শক্ত হয়ে পুরো পরিবার সামলালো। মায়ানকে কোলেপিঠে করে মানুষ করলো। একদম ছোট সময়ে, মায়ান যখনই কান্না করে দিতো তখন মীরাও কান্না করতো। মায়ানের জ্বর আসলে মীরার মায়ানের চিন্তায় আরো বেশি জ্বর আসতো। মায়ানের কিছু হলে নিজেকে সামলাতে পারে না মীরা। একদম ভেঙে পড়ে বাবা।’

উশান নিঃশব্দে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। বলে উঠলো,

‘ চিন্তা করবেন না আঙ্কেল। আপনার এই অবস্থা হলে মীরা, মায়ান তো আরে ভেঙে পড়বে। টেনশন ফ্রী থাকুন। আপনার হার্টের সমস্যা আছে। ক্ষতি হবে তো। ‘,

মাহদি ঘাড়ের স্থিরতা হতে গতি প্রদান করে সায় জানায়। উশান স্বভাবগত হুটহাট হাসতে জানে না৷ তবুও কোনোরকম কৃত্রিম হাসির রেশ অধর কোণে ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাহদির দৃষ্টিসীমার বেশ খানিক দূরে চলে যায়।

_______________________

শীতল রজনী। রজনী গহীনে রূপ নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতের প্রবণতা যেনো হুর হুর করে বেড়ে দ্বিগুণে পরিণত হলো। হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসে মীরা শীতে প্রকোপে ঠকঠক করে কাঁপুনি দিচ্ছে। কিন্তু তার মুখোশ্রীতে ভাবলেশহীনতা বজায়।সেই আগের মতোই খোলা জানালার নিকট বসে কেঁপে যাচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে জানালা বন্ধ করার মতোন ইচ্ছাশক্তি তার নেই এমন মনোভাব ফুটে উঠেছে মুখোশ্রীতে।

উশান দূর থেকে দাঁড়িয়ে মীরাকেই পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিলো। বিরক্তিমাখা দৃষ্টি তার। মাহদি বারবার করে বলেছিলো একটু মীরাকে চোখের সামনে রাখতে।অথচ তাকে ফিরে যেতে হতো তার কর্মস্থলে। কোনোমতে আজকের রাতটা সে ম্যানেজ করেছে। উশান বিতৃষ্ণায় ওষ্ঠাধর ‘ চ ‘ আকৃতির ন্যায় করলো। লম্বা লম্বা পা ফেলে সে এগিয়ে গিয়ে মীরার পাশে থাকা জানালা দু’টো ‘ ঠাস ‘, ‘ ঠাস ‘ শব্দে বন্ধ করতেই মীরা কেঁপে উঠলো কিয়ৎ। হকচকিয়ে বলল,

‘ এমন করছেন কেনো?আস্তে বন্ধ করুন। ‘

উশান নিরুত্তর। পরনের কালচে জ্যাকেট নিজের গা থেকে খুলে মীরার হাতের দিকে ছুঁড়ে ফেলে বলল,

‘ উইদাউট এ ওয়ার্ড! দ্রুত জ্যাকেট পড় মীরা। ‘

মীরা তার অধর জোড়া প্রসারিত করে কিছু বলবে তার পূর্বেই উশান চোখ গরম করে তাকায়। ইশারায় বলে, বিনাবাক্যে চটপট জ্যাকেট’টা পড়তে। মীরা প্রথমত ইতস্তত বোধ করলো। অতঃপর বিনাবাক্যে, উশানের কথা অনুযায়ী জ্যাকেট পড়ে নিলো। শীত শীত লাগছে প্রচন্ড। নতুবা অন্য সময় হলে সে এই জ্যাকেট উশানের চেহারার বরাবর ছুঁড়ে মারতো। উশানের অন্তঃকরণ ও নড়বড়ে হলো। ত্যাড়া মেয়েটা আজ এতো শান্ত? এতো পরিবর্তন তার মাঝে? ভাইয়ের চিন্তা মীরাকে তাহলে এতোটা কাবু করে রেখেছে।

উশান নিঃশব্দে বসে পড়লো মীরার পাশে। আঁখি যুগল বন্ধ করে মাথা এলিয়ে দিলো তুলতুলে সোফার একাংশে। হাতজোড়া ভাজ করে বক্ষঃস্থলের নিকট গুটিয়ে নিলো। ক্লান্ত লাগছে ভীষণ! ঘুমাতে পারলে শান্তি মিলতো। কিন্তু মীরা! তার পাশে বসা ছটফটে স্বভাবের মেয়েটা কখন কি করে বসে তার কোনো ঠিক আছে?মাহদি তাকে ভরসা করে দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছে। দায়িত্বে হেলা ফেলা করা উশানের পছন্দ নয়।

.
রাত ২ টার দিকে জ্ঞান আসলো মায়ানের। মাহদি এবং মীরার উপচে পড়া খুশির জোয়ার। ছেলেকে বুকে জরীয়ে, মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে মাহদি চলে যান সেই রাতেই। ঊষাও চলে গিয়েছে।রয়েছে শুধু উশান, মীরা আর মায়ান। মায়ানকে সকালবেলা হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।ডাক্তারের আদেশ অনুসারে আজ রাতটা হাসপাতালে থাকতে হবে মায়ানের।

মায়ানের পাশে আধশোয়া হয়ে একধারে কথা বলে যাচ্ছে মীরা। মায়ানও বোনকে পেয়ে আপ্লুত বেশ। সে যে অসুস্থ তার ধ্যান মাত্র নেই। উশান আঁড়চোখে পরখ করে নিলো দু’জনকে। শেষে ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে সোফায় বসে ফোনে ব্যাস্ত হলো। কিয়ৎ বাদে মায়ান উঁচু কন্ঠে বলল,

‘ উশান ভাইয়া! এদিকে আসো তো একটু।

উশান ফোনে কথা বলছিলো। মায়ানের কথায় সে তার হাতের দু’টো আঙুল দেখিয়ে ইশারায় বলল, দুই মিনিট অপেক্ষা করতে। শেষে দুই মিনিটের জায়গায় দীর্ঘ বিশ মিনিট কথা বলার পর উশান এসে বসলো মায়ানের পাশে। শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলল,

‘ হেই চ্যাম্প?ফিলিং বেটার নাউ?মাথা ব্যাথা করছে নাকি?’

মায়ান বাচ্চাসুলভ হাসলো। মায়ানের কেনো যেনো উশানকে বড্ড বেশি ভালো লাগে। উশান তার কাছে ম্যাজিকাল পার্সন! ম্যাজিকের মতো কিভাবেই যেনো তার সকল দুঃখ চট করে অনিলে মিশিয়ে উধাও করে দেয়। মায়ান একগাল হেঁসে বলল,

‘ একটুও মাথা ব্যাথা করছে না। কিন্তু পিঁপড়ার কামড় দেয়ার মতো একটু ব্যাথা করছে। ‘

মায়ানের কথা এবং বলার ভঙ্গি দেখে উশান, মীরা দুজনেই কিঞ্চিৎ হাসে৷ মায়ান তার প্রিয় দু’জন ব্যাক্তিকে একসাথে হাসতে দেখে নিজে বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ে।হটাৎ মীরা গম্ভীর হয়ে বলে উঠলো,

‘ অনেক বাঁদরামি হয়েছে মায়ান। এখন ঘুমা একটু।ডাক্তার রেস্ট করতে বলেছে না?’

মায়ান বিজ্ঞদের মতো মাথা নাড়লো। চোখে নিজের ছোট ছোট আঙুলের অধিকারী হাত দু’টো রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু, কি আশ্চর্য! ঘুম আসছে না। শেষে ফট করে চোখ খুলে সে উশান এবং মীরার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। ঘটনায় আকস্মিক উশান বিছানায় শুয়ে পড়তে বাধ্য হয় সাথে মীরাও৷ মায়ান ফটাফট চোখ বন্ধ করে বলল,

‘ আমি তোমাদের দু’জনের হাত এভাবে ধরেই ঘুমাবো নয়তো আমার ঘুম আসবে না। ‘

উশান, মীরা দু’জনেরই চোখে তুমুল অস্বস্তির দেখা মিললো। তবুও হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না কেউই। ডাক্তার মায়ানকে ঘুমাতে বলেছে। এখন হাত সরিয়ে ফেললে ঘুম থেকে উঠে যাবে সে। তখন আবার ঘুম পাড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে। মীরা কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

‘ আপনি বালিশে মাথা দিয়ে একটুখানি শুয়ে থাকুন।ওর ঘুম গাঢ় হলেই উঠিয়েন। ‘

উশান মীরার কথা পালন করলো। বালিশে মাথা দিয়ে তাকায় মায়ানের পানে। মীরা ক্লান্ত হয়ে নিজেও শরীর এলিয়ে দেয় তুলতুলে বিছানায়। ভয় হচ্ছে! এই ভেবে তাদের তিনজনের ভার নিতে পারবে কিনা এই বিছানা৷ ঘুমকাতুরে মীরা চোখ বন্ধ করতেই ঘুমিয়ে পড়ে। উশানের কেমন দমবন্ধ হয়ে আসছে। সন্তপর্ণে সে নিজের হাত মায়ানের হাতের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সোফায় গিয়ে নিজের ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে,

‘আমার পক্ষে সম্ভব নয় তোমাকে খুন করা মীরা। আমি পারবো না এটা। ক্ষমা করো আমায় পৃথিবী। আমি আমার দেয়া প্রতিটা ওয়াদা বাক্য ফিরিয়ে নিচ্ছি। ‘

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here