#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকাঃ সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
#পর্ব-২৫
________________
পূর্ব আকাশে সবেমাত্র সূর্য উদয় হয়েছে। চারিপাশে ক্ষীণ কুয়াশা পড়েছে। বসন্তের প্রথমাংশ হওয়াতে শীতের রেশটা কাটেনি এখনো পুরোপুরি। গাছের কিশলয়ে জমে রয়েছে বিন্দু বিন্দু শিশির কণা। হালকা রোদে ঝলমল আশপাশ। ব্যাস্ত সড়ক দিয়ে হটাৎ দানবীয় আকৃতির ট্রাক শা শা করে বিকট, কর্কশ শব্দে হর্ণ দিয়ে গেলো। সেই কর্কশ ধ্বনি কর্ণপাত হয়ে ধ্যান ফিরে মীরার। ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তার বহু বছরের। প্রভাতের আগমন মেদিনীতে ঘটতেই তার ঘুমের রেশটা অভ্যাসবশত কেটে যায়। মীরার হাতে ধোঁয়া উড়ন্ত কফির মগ। এলোমেলো আকৃতির ধোঁয়া বের হচ্ছে মগ দিয়ে। উত্তপ্ত কফির কাপে অধর ছোঁয়ায় মীরা। অদূরে দৃষ্টি দিতেই সে কিয়ৎক্ষণ থমকালো! চমকালো! স্থির রূপে দাঁড়িয়ে রইল।
মীরার বাসা থেকে তিনটা বিল্ডিং পর উশানের দাদুর বাড়ি। মাঝখানের তিনটা বিল্ডিং তূলনামূলক কম তলার হওয়াতে উশানের দাদু বাড়ি মীরার বাসার ছাদ থেকে স্পষ্টতই দেখা যায়। অদূরে ছাঁদে উশান উদাম গায়ে পুশ-আপ করছে। এতদূর থেকে, চশমার তীক্ষ্ণতার জোড়ে মীরা স্পষ্টত দেখতে পারছে উশানের পেশিবহুল, বলিষ্ঠ দেহ। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে বলিষ্ঠ, সুঠাম দেহ এখন ঘেমে একাকার। মীরা নির্লজ্জের মতো উশানকে পরখ করলো সুক্ষ্ম নজরে। শেষে হুঁশে ফিরে নিজের গালে চড় মেরে বসলো। ইতস্তত কন্ঠে আপনমনে বলল,
-‘ ছিহঃ মীরা! শেইম অন ইউ। ‘
উশানের আশপাশের কোনো দিকে ধ্যান নেই। সে ব্যাস্ত তুমুল নিজের কাজে। মিনিট বিশেক বাদে উঠে দাঁড়ালো সে।শুভ্র তোয়ালে দিয়ে শরীরে অবশিষ্ট ঘামটুকু মুছে নিলো দ্রুত। উশানের থেকে ঠিক তিন ফিট দূরে দাঁড়ানো তীব্র।দাঁড়িয়ে ঘুমে ঢুলছে। দিগন্ত ব্যাস্ত হাতে উশানের দেয়া তার ওপর আরোপিত কাজ গুলো সম্পূর্ণ করছে। উশান ওয়াটার বোতলে অধর স্পর্শ করার আগ মূর্হতে শক্ত কন্ঠে বলল,
-‘ দিগন্ত? ইজেন্ট ইট ডান? ‘
দিগন্ত দ্রুত গলায় বলল,
-‘ স্যার আরেকটু সময় দিন। হয়ে যাবে। ‘
– ‘ ডু ইট ফার্স্ট! ‘
-‘ ইয়েস স্যার। ‘
উশান তোয়ালে ফেলে টিশার্ট পড়লো। সে একটু খেয়াল করলেই হয়তো দেখতে পেতো অদূরে কেও তাকে স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে৷ তবে উশান আজ আর আশপাশ দেখলো না। তার মুখোশ্রীতে কঠোরতা! বহুদিন বাদে গম্ভীরতার ছাপ পড়েছে। দ্রুত পায়ে তীব্রের পাশে দাঁড়িয়ে ঝাঝ মেশানো কন্ঠে বলল,
-‘ কালকের থাপ্পড় মনেহয় কাজে লাগেনি? কাজ ফেলে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? ‘
তীব্র হাই তুলে অলসতা ছাড়ালো। আঁড়চোখে তাকালো উশানের দিকে। ছেলেটাকে কঠোর দেখাচ্ছে ভীষণ। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। গুরুতর কিছু। অতীব গুরুতর কোনো কিছু হলে উশান তার অফিসিয়াল রূপ প্রদর্শন করে। যেমনটা সে কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করে থাকে। তীব্র বিরস কন্ঠে বলল,
-‘ কোথায় কালকের হটাৎ থাপ্পড় মারার জন্য সরি, টরি বলবি তা না! এখন বলছিস থাপ্পড় কাজে লাগেনি? তুই আসলেই মানুষ না শা’লা! তোর মন- প্রান, হৃদয় সব পাথরের। ‘
উশান থমথমে দৃষ্টিতে তাকালো। তীব্র তটস্থ হয়। বলে,
-‘ কি হয়েছে? এভাবে তাকাস ক্যানো? ‘
-‘ কালকের থাপ্পড় মারার যথেষ্ট কারণ ছিলো। ‘
-‘ হাহ্! যথেষ্ট কারণ ছিলো..! কাল যা বলছি আমি তা সত্যি না এটা তুই অস্বীকার করতে পারবি?সত্যি বললেই দোষ। ‘
-‘ ফাইল রেডি কর। ৩০ মিনিটের মধ্যে আমার চাই। ‘
ছাঁদ থেকে প্রস্থান করলো উশান। তীব্র দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। ছেলেটা অদ্ভুত ভীষণ! এভাবে নিজের শুদ্ধ, পবিত্র, প্রেমময় অনুভূতি গুলো গোপণ করে সে আসলে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছে? তা বলা মুশকিল বটে। এত বছরের বন্ধুত্ব উশানের সাথে তীব্রের। তবুও কিছু কিছু বিষয়ে সে উশানকে বুঝতে পারেনা একদমই। উশান যেনো পুরোটাই একটা রহস্য। তীব্র অলসতা ফেলে এগোলো সম্মুখে। দিগন্তের নিকট। যাওয়ার পথে অদূরে দৃশ্যমান হলো মীরাকে৷ তপ্তশ্বাস ছাড়লো সে। বিড়বিড় করে বলল,
-‘ মেয়েটাকে আর কষ্ট দিস না উশান। নয়তো এর ফল তোকে প্রকৃতি দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দিবে। ‘
____
ফেব্রুয়ারীর এক অলস দুপুর। শুনশান নীরবতা বজায় চারিপাশে৷ মীরা সচেতন দৃষ্টিতে আশেপাশ দেখতে দেখতে এগোচ্ছে। এক বিশেষ কাজে সে এসেছিলো পাহাড়ের এদিকের জঙ্গলে। জঙ্গলের ওপর প্রান্তে মূলত ছিলো তার কাজ। হাসপাতাল ছিলো সেখানে। পায়ের ব্যান্ডেজ চেইঞ্জ করিয়ে কিছু ঔষধ নিয়ে এসেছে। আজকাল পায়ে চিনচিন ব্যাথা করে তার। ব্যাথা উঠলে সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে।দুপুরের দিকে ফের ব্যাথা ওঠায় একাই বেড়িয়েছিলো সে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। মাথার ওপর কড়া রোদ্দুরের তাপ। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে চৌচির তার। ক্ষীণ দূরে যাওয়ার পর হটাৎ তার মনে হলো তার পিছন পিছন কেও আসছে। শুকনো, ঝড়ে পড়া পাতায় পা ফেলায় মড়মড় শব্দ হচ্ছে।
মীরা সচেতন হয়। আলগোছে ব্যাগে হাত দিয়ে ছোট ধারালো ছু’রিটা সে হাতের মুঠোয় নেয়। পদচারণ থামিয়ে হুট করে পিছনে ঘাড় কাত করে তাকাতেই তার সম্মুখে দৃশ্যমান রোগা ধরনের এক কম বয়সী তরুণকে। ছেলেটা বোধহয় তার থেকেও ছোট হবে। মীরা কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে কঠিন কন্ঠে বলল,
-‘ কে আপনি? আমার পিছু নিচ্ছেন কেনো? ‘
ছেলেটা হাসলো। অদ্ভুত, গা শিরশির করা হাসি।ক্ষীণ কেঁপে উঠে মীরা। ভীতি ভাব অন্তরালে পুরে রেখে ধমকে উঠে জিজ্ঞেস করে,
-‘ কি সমস্যা? ‘
-‘ কোনো সমস্যা না। জাস্ট কিছু জিজ্ঞেস করার ছিলো। মে আই? ‘
-‘ বলুন! ‘ কাঠ কাঠ গলায় জবাব দেয় মীরা।
-‘ থ্যাঙ্কিউ! আমি শুভ্র। এখানে নতুন। ভুলবশত রাস্তা গুলিয়ে ফেলে এখানে এসে পড়েছি। আমাকে একটু লোকালয় সম্পর্কে ধারণা দিতে পারবেন? আর কত দূরে সেটা? ‘
-‘ সোজা হাঁটবেন। বিশ মিনিট পরই লোকালয়। ‘
-‘ আপনি বুঝি সেখানেই যাচ্ছেন? ‘
মীরা জবাব দিলো না। সোজা হাঁটা শুরু করলো। কিছু তো একটা গড়বড় আছে। শুভ্রের ব্যাবহার, চাহনি! তার ভালো লাগেনি। উদ্ভট ঠেকছে কেমন। দ্রুত হাঁটা ধরলো মীরা। হাতের মুঠোয় ছোট্ট ছু’রিটা ধরেই রাখলো। খেয়াল করে দেখলো শুভ্র তার পিছনেই আসছে। হেলেদুলে, আস্তেধীরে। মীরা পদচারণের গতি বাড়িয়ে দেয়। তবে কিয়ৎক্ষণ বাদে তার সন্দেহ দূর হয়। সে যখন দৌড়াতে শুরু করলো। শুভ্র তখন প্রায় ছুটে আসলো। এসেই শক্ত করে ধরলো তার হাত। মীরা ছিটকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। চেঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
-‘ আপনার সাহস কি করে হয় আমাকে স্পর্শ করার? ‘
শুভ্র অদ্ভুত ইঙ্গিত দিলো নেত্র যুগল দ্বারা। মীরার বুঝতে বেগ পেতে হলোনা এই ইঙ্গিতের। এই ছেলের সাথে আর ভালোভাবে কথা বলার কোনো মানেই হয়না। ব্যাগের পকেট থেকে ছু’রিটা ব্যাগ করে মীরা শুভ্রের হাতে শক্ত করে ঢুকিয়ে দিয়ে বের করে নিলো। পা দিয়ে সজোরে লাথি মারলো শুভ্রের স্পর্শকাতর স্থানে। ছু’রিটা দিয়ে সে দ্বিতীয় আঘাত করলো শুভ্রের ঘাড়ে। ছিটকে আর্তনাদ করে উঠলো শুভ্র। ব্যাথায় যন্ত্রণার সহিত বলল,
-‘ ইউ ব্লা’ডি বি’চ! ‘
মীরা উল্টো ঘুরে দৌড়ানো শুরু করে। শুভ্র তার আহত হাত দিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে তার দলের কয়েকটা ছেলেকে ফোন করে সেখানে উপস্থিত হতে বলে জলদি। শেষে ফোন কেটে দিয়ে পিছু নেয় মীরার। লোকালয়ে পৌঁছাতে আরেকটু সময় বাকি। মীরা অন্তঃকরণে নিজেকে ধাতস্থ করলো। সাহস দিলো! তবে বিপদ বুঝি তখনও তার পিছু ছাড়েনি। ক্ষীণ দূর যেতেই তিনটে ছেলে এসে উপস্থিত হয় তার সম্মুখে। মীরা ভড়কালো। প্রশ্ন করলো,
-‘ কি চাই? ‘
উপস্থিত একজন বিশ্রী হেঁসে বলল, ‘ তোমারে! ‘
দ্বিতীয়জন ক্রোধ নিয়ে বলল, ‘ আমার ভাইরে মেরে ভাগতে চাও? এতো সহজ? আজকে তোমারে খা’ই’ছি ফুলটুসি। ‘
মীরার বোধগম্য হয়। শুভ্রের দলবল এরা। পিছন ফিরে তাকানোর পর এবার দমিয়ে রাখা আতঙ্কটা তার বেড়ে গেলে হু হু করে। মাথায় চাড়া দিয়ে উঠলো নানান রকমের চিন্তা। বারংবার অন্তঃকরণে সে প্রার্থনা করছে যেনো খারাপ কিছু না হয়৷ মীরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো উপস্থিত তিনজনকে দমানোর জন্য। ছু’রি দিয়ে আঘাত করলো অব্দি তবে কাজ হলো না। আঘাত করার ফলস্বরূপ তাকে পাল্টা থাপ্পড় মারা হলো। অধর চুইয়ে তরল র’ক্ত গড়িয়ে পড়লো এক ফোটা, দুই ফোটা অবিরত! মীরা আকুতি স্বরে বলল,
-‘ প্লিজ ছেড়ে দিন আমায়। যেতে দিন। আল্লাহর দোহাই লাগে। ‘
চারটে ছেলের নিষ্ঠুর, নিকৃষ্ট, পাষাণ হৃদয় মীরার ব্যাকুলতা, কাতরতা মেশানো আকুতি শুনলো না। লোলুপ দৃষ্টিতে তাকালো তারা। তাদের মুখোশ্রীতে বজায় মান অদ্ভুত চাহনি দেখে মীরা বুঝে গেলো তার সাথে ঠিক কি হতে যাচ্ছে। অন্তঃকরণে নাজেহাল অবস্থা তার। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। শেষ মূর্হতে আকুতি স্বরে বিড়বিড়িয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছে সে। হৃদপিন্জর চাইছে, উশান আসুক! একবার আসুক। তিন চারটে ছেলের সাথে পেরে উঠলো না মীরা। পালাতে চেয়েও পারলো না। শুভ্র মীরার হাত পা বেধে নিয়ে বলল,
-‘ ওরে বস্তায় ঢুকা জলদি। জঙ্গলের ভিতর নিয়া যাই। ‘
মীরার মুখে এক দলা পুরোনো কাপড় ঢোকানো। কিছু বলার প্রয়াসে কন্ঠ দ্বারা শব্দ করলো হলো না তা সম্ভব। মীরাকে বস্তায় ভরে নেয় দু’জন। তার পূর্বে সে দু’জন ভীষণ বাজে ভাবে মীরার স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করে। নেত্র যুগল বন্ধ করে মীরা অস্ফুটস্বরে বলল,
-‘ কিচ্ছু হয়নি! ওরা ব্যাড টার্চ করেনি। সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। ‘
বস্তায় ভরে বস্তার মুখ বন্ধ করে টানতে টানতে মীরাকে জঙ্গলের ভেতর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠছে সে ক্ষণে ক্ষণে। বর্তমান অবস্থা দেখে অন্তরাল হুহু করছে। আদও কি সব ঠিক হবে?
চলবে…