হৃদয়েশ্বরী #লেখিকাঃসাদিয়া মেহরুজ দোলা #পর্ব-২১+২২

0
55

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকাঃসাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব-২১+২২
______

তখন সবেমাত্র দুপুরবেলা।শুভ্র রঙে রাঙায়িত অন্তরীক্ষ। ধূসর বর্ণের পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে অম্বর জুড়ে। অনিলে বুনো ফুলের সুভাস। গাঢ় সবুজ পাতা গুলো থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে বর্ষণের স্নিগ্ধ পানি। ভূমি হতে ভেসে আসছে বর্ষণ সিক্ত মাদকতার ন্যায় সুমিষ্ট ঘ্রাণ। হীম অনল! শীত শীত আবহাওয়া। বসন্তের প্রথম বর্ষণ আজ বর্ষিত হয়েছে মেদিনীতে। কৃষ্ণচূড়া ফুলে পানি জমে রয়েছে বিন্দু বিন্দু। মেঘের আড়াল হতে সূর্য কিরণ নিক্ষেপ করলো মেদিনীতে। তৎক্ষনাৎ ঝলমলে রূপে রূপান্তর হলো চারিপাশ। বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা পানিতে সূর্যের কিরণ এসে আছড়ে পড়ে চকচক করে উঠলো।

হটাৎ রোদ্দুরের আগমনে খুশিতে গদগদ রুহি৷মন বিষন্ন ছিলো তার এতক্ষণ অম্বরের মেঘলাটে রূপ দেখে। ভীষণ মনোযোগ সহকারে সে এবার ব্যাস্ত হলো জঙ্গলের নাম না জানা পুষ্পের দল দর্শন করতে। রুহির পাশেই মীরা। বর্ষণ সিক্ত ভূমিতে লম্বা পা ফেলে জামা উঁচু করে হাঁটছে যেনো কাঁদা না লেগে যায়। জামাকাপড় নোংরা হলে তার গা গুলিয়ে আসে। উমাইশা মীরার এক হাত চেপে ধরে হাঁটছে। দীর্ঘ শ্বাস টেনে উপভোগ করছে অনিলে বহমান মিষ্টি ঘ্রাণ।
মেয়ে তিনটের পেছনে অলস ভঙ্গিতে হাঁটছে তীব্র, দিগন্ত। তীব্র দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে হেলে-দুলে হেঁটে সামনে এগোচ্ছে। দিগন্ত শিষ বাজিয়ে তার প্রিয় গানের সুর তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এবং সবশেষে! উশান! সে দাম্ভিকতা নিয়ে সবার সামনে বকের মতো লম্বা কদম ফেলে হাঁটছে। হাতে তার ধারালো ছু’রি। সামনে গাছপালার কোনো লম্বা ডাল এসে পড়লে তা কে’টে ফেলে পিছনের মানুষ পাঁচ জনের সুবিধা, শান্তি মতোন আসার পথ করে দিচ্ছে। উশান বাদে বাকি সবার অগোচরে আসছে দুইজন গার্ড। উশানের আদেশে। সবার নিরাপত্তা জোরদার করছে গার্ড দু’জন।

আরো কিছু দূর যেতেই হাঁপিয়ে উঠলো রুহি। পা দু’টো তার ব্যাথায় টনটন করছে। দাঁড়িয়ে পড়লো সে। ক্লান্তি নিয়ে বলল,

-‘ আরও কত হাটতে হবে উশান ভাইয়া? ‘

উশান পদচারণ বহাল রাখলো। তারই মাঝে ঘাড় কাত করে পিছন ফিরে প্রতিত্তুর করলো,

-‘ আরেকটু দূর। ‘

রুহি হাঁটা শুরু করলো। নিজের দুই গালে তার দুইটা থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছে করছে সজোরে। কেনো যে জেদ করেছিলো সিঁড়ি দিয়ে যাবে না। পাকা সিঁড়ি দিয়ে গেলে এতোটা কষ্ট হয়তো অনুভূত হতো না। রুহি, মীরা, উমাইশা! এই তিনজন জেদ ধরেছিলো সিড়ি দিয়ে পাহাড়ে উঠবেনা। জঙ্গলের আঁকাবাকা মাটির রাস্তা দিয়েই চলবে ওপরে। ছেলেরা বারবার বুঝিয়েছিলো তাদের ওভাবে গেলে অনেক কষ্ট হবে কিন্তু মেয়ে তিনজন নাছোড়বান্দা! শেষে বাধ্য হয়ে উশান’রা জঙ্গল দিয়েই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

রুহি মীরার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। ফিসফিস করে বলল,

-‘ বেইব! আমাকে একটু কোলে নিবা প্লিজ? খুউব পা ব্যাথা করতেছে। আমাকে এখন কোলে নিলে আমি তোমাকে আসার পথে কোলে তুলে উড়ে উড়ে আসবো। কাটাকাটি! ‘

রুহির বেআক্কেল কথায় মীরা ক্ষেপাটে দৃষ্টিতে তাকালো। রুহি আমতা আমতা করে চটজলদি মীরার থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ বাদে মীরা জবাব দেয়,

-‘ নতুন একটা রিলেশন করলেই পারতি। বয়ফ্রেন্ড কে নিয়ে আসলে তোকে কোলে তুলে নাচতে নাচতে পাহাড়ে চড়তো। ‘

রুহি দুঃখী দুঃখী চেহারা বানিয়ে শুধালো,

-‘ ধুরো..! আবার মনে করাইলি আমি এখন সিঙ্গেল। জার্নিটাই আমার এখন বাজে যাবে। হাট্ট! আমাকে হু-হুতাশ করতে দে। আমি সিঙ্গেল! ইয়া আল্লাহ..!এসব মানা যায়?’

মীরা ঠোঁট টিপে হাসলো। সাথে উমাইশাও। দুই বান্ধবীর মিষ্টি আলাপ তার কর্ণকুহরে এসে পৌঁছেছে।

অতঃপর প্রায় বিশ মিনিট পর সবাই এসে পৌঁছালো পাহাড়ের ওপর৷ মনো মুগ্ধকর দৃশ্য। আহাজারি করা রুহি থমকে গেলো প্রায়। সকলের রাশ রাশ ক্লান্তি মিটে গেলো নিমিষেই।
সবুজের সমরোহ চারিপাশে। নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ প্রকৃতি। ডান পাশে ঝর্ণা। সেখান থেকে পানি পড়ার মিষ্টি শব্দ কর্ণকুহরে এসে পৌঁছুতেই ঝংকার তুলছে। রিনরিনে সুর! হীম হীম আবহাওয়া। গা জুড়ানো সতেজ ঘ্রাণ। অদূরে সমুদ্রের জলরাশি। অন্তরীক্ষে বহাল ধূসর মেঘের দলের অস্থির আনাগোনা। পুষ্প রাজের সুমিষ্টতা। পাখির কিচিরমিচির শব্দ। সব মিলিয়ে অন্তঃকরণ শীতল করার মতো পরিবেশ। মীরা হৃষ্টচিত্তে চারপাশে নজর বুলাচ্ছে। রুহি বিভিন্ন এঙ্গেলে সেলফি তুলছে। তীব্র, দিগন্ত, উমাইশা এক স্থানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। উশান সবার সামনে। বুক ভরে প্রানবন্ত শ্বাস নিচ্ছে। একেকজন একেকভাবে পাহাড়ে সৌন্দর্য বিলাসে ব্যাস্ত। জাগতিক ধ্যান নেই কারো মাঝেই। ডুবে আছে সকলে প্রকৃতির চমৎকার সৌন্দর্যের মাঝে।

-‘মীরা, উমাইশা আপু আসো না ছবি তুলি? ‘

রুহির উচ্চ স্বর। মীরা, উমাইশা এগোলো। তীব্র, দিগন্ত সহ সকলেই বেশ কয়েকটা ছবি তুললো। ফটোগ্রাফিতে যুক্ত হলো না শুধুমাত্র উশান। সে নিজের মতো আশপাশ দেখতে ব্যাস্ত। সকলে বারংবার বলেও কাজ হয়নি। মীরা ঠোঁট বাঁকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে,

-‘ হুহ! ঢং যত তার। ইচ্ছে তো করে পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিই। ‘

প্রায় তিন ঘন্টার মতো পাহাড়ের ওপর কাটিয়ে নিচে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করলো সবাই। এখন বিকেল! দ্রুত নিচে গিয়ে লোকালয়ে ফিরতে হবে। সায়াহ্নের প্রহর নামলে সমস্যা। সবাই আস্তে ধীরে নামতে শুরু করলো। উশান বরাবরের মতোই সামনে। পথিমধ্যে আসতেই বিপত্তি সৃষ্টি হয় মীরার ক্ষেত্রে। পায়ে কাটা ঢুকেছে তার। গোলাপের কাটা!গোলাপ গাছের শুকনো ডালে পা পড়েছে ভুলবশত। ব্যাথায় মৃদু চেঁচিয়ে মীরা আর্তনাদ করে উঠলো। তবে আর্তনাদ এর শব্দ করলো অতীব মৃদু মাত্রায়। যেনো কেউ শুনতে না পায়। রক্তাক্ত পা নিয়ে সেভাবেই হাঁটা শুরু করে মীরা। তবে কিয়ৎ দূর যেতেই রুহি তার আঘাতপ্রাপ্ত স্থান দেখে ফেলে। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠে রুহি তৎক্ষনাৎ।

-‘ ওহ আল্লাহ! মীরা তোর পা থেকে তো রক্ত পড়ছে অনেক। আঘাত পেলি কি করে? ‘

সকলের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এসে পড়লো মীরার পায়ে। শুধু উশান বাদে। তার পদচারণ থেমেছে বৈকি তবে তার সম্পূর্ণ দৃষ্টিপাত বহির্ভাগে নিবদ্ধ।
উমাইশা চিন্তিত কন্ঠে বলল,

-‘ মীরা? এ হাল কি করে হলো? বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে তাই না? ‘

মীরা ব্যাথা, যন্ত্রণা দমন করে প্রতিত্তুর করলো,

-‘ নাহ আপু। তেমন একটা ব্যাথা হচ্ছে না। চলো আমরা সামনে এগোই। ‘

তীব্র এবার ফোড়ন কেটে বলল,

-‘ তোমার পা থেকে যেই পরিমাণে রক্ত বের হচ্ছে মীরা। আর তুমি বলছো যন্ত্রণা হচ্ছে না? এভাবে তো হাঁটা যাবেনা। রক্ত পড়া বন্ধ করতে হবে। ‘

-‘ দরকার নেই ভাইয়া। এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে রক্তক্ষরণ। ‘

মীরার কথায় কর্ণপাত করলো না উপস্থিত কেওই। সকলে ব্যাস্ত হলো পায়ের ক্ষত স্থান হতে রক্ত পড়া কিভাবে বন্ধ করা যায় তা নিয়ে। দিগন্ত কিছুক্ষণ ভেবে উশানকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো,

-‘ স্যার আপনার কাছে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ আছে না? আপাতত এটা দিয়ে রক্ত পড়া আঁটকে রাখা যেতে পারে। ‘

বাম পকেটে হাত ঢুকিয়ে উশান কয়েকটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ এগিয়ে দিলো রুহির দিকে। রুহি ব্যান্ডেজ মীরার পায়ে লাগিয়ে শেষে নিজের ওড়নার শেষাংশ ছিঁড়ে পায়ে বেঁধে দেয়। উঠে দাঁড়িয়ে মীরার কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলে,

-‘ ব্যাথা মনে হয় বেশি করছে তাই না?’

মীরার নেত্র যুগলের শুভ্র অংশ রক্তিম প্রায়।ব্যাথায় নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে। সামান্য একটা কাটার সুচালো আঘাতে এতো তীব্র যন্ত্রণা কেনো হচ্ছে? বোধগম্য হলো না তার। জঙ্গলের গাছপালা। বিষ থাকলেও থাকতে পারে। পা যেনো অবশ প্রায়। মুখোশ্রী যন্ত্রণার প্রভাবে নীলচে হয়েছে। উমাইশা উদ্বেগ নিয়ে বলল,

-‘ ইশ মীরা! তোমার অবস্থা তো খুব খারাপ হচ্ছে। হাঁটতে পারবে? ‘

মীরা হার মানলো। কঠিনতার খোলস থেকে বেড়িয়ে আসল যন্ত্রণা প্রকাশ করলো। আর্তনাদ জরানো কন্ঠে বলল,

-‘ মনেহয় না আপু। খুব ব্যাথা করছে। ‘

-‘ উশান কোলে নিক তবে? তোমার অস্বস্তি হবে ভীষণ?’

এতক্ষণ মৌনতা বজায় রাখা উশান তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

-‘ হাহ্! কোলে ওঠার ছল! এতটুকু কাঁটায় কেও এতোটা দূর্বল হয়ে পড়ে? ‘

আত্নসম্মান বড়ই অদ্ভুত এক জিনিস। আত্মসম্মানে কেও আঘাত হানলে মানুষ তাকে খুন করার অব্দি চিন্তা করে এমনকি করেও ফেলে। মীরা নম্রতা হলেও তার আত্নসম্মানবোধ প্রবল। প্রণয়, দূর্বলতা, প্রিয় প্রেমিক পুরুষ সবকিছু মূর্হতেই ভুলে গেলো মীরা। উশানের মাত্র বলা কথা তার মস্তিষ্কে অনলের উৎপত্তি ঘটিয়েছে। পায়ের যন্ত্রণা দূরে ঠেলে সে লম্বা কদম ফেলে এগোলো। হাত উঁচু করে পরাপর দু’টো থাপ্পড় লাগালো উশানের গালে। রুষ্ঠ চাহনি! আঁখি দু’টো রাগের প্রকোপে এখন রক্তিম। উপস্থিত সকলে হতভম্ব হলেও নিশ্চুপ। থাপ্পড় দেয়ার যথোপযুক্ত কারণ আছে। তীব্র বিড়বিড় করে শুধালো,

-‘ একদম ঠিক করেছে।বেয়াদব টাকে আরো চার, পাঁচটা থাপ্পড় মারা উচিত ছিলো। ‘

দিগন্ত এমন পরিস্থিতিতেও ঠোঁট চেপে হাসলো। বলল,

-‘ আস্তে বলুন স্যার। উশান স্যার শুনলে আপনার খবর আছে। ‘

নারী হাতের প্রথম চড়! আশ্চর্যজনক বিষয় উশান চড় খাওয়ার পর মুচকি হেঁসেছে। মীরা ভড়কালো না। তেজি কন্ঠে বলল,

-‘ আজ শুধু আমি বলে হয়তো দু’টো চড় দিয়েছি। অন্য কোনো মেয়ে হলে আপনার গলা চেপে ধরতো। কি ভাবেন নিজেকে? আপনার কোলে ওঠার জন্য আমি দাপাতে দাপাতে মরে যাচ্ছি? পা দু’টো আমার শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেলেও আমি কখনো কোনো পর-পুরুষের কোলে উঠতাম না। আর রইল এতটুকু কাটা না? কাটা টাকে আপনার পায়ে ঢুকাই?বিষধর কাটার যন্ত্রণা কেমন হয় উপভোগ করুন। ‘

মীরা কিয়ৎক্ষণ চুপ রইলো। দীর্ঘ করে দু’বার শ্বাস টেনে পিছন ফিরে পদচারণ শুরু করলো গহীন জঙ্গলে। উমাইশা আঁতকে উঠে বলল,

-‘ মেয়েটা ওদিকে কই যাচ্ছে? আর উশান তুই? ছিহ্! এতো খারাপ তোর চিন্তা ভাবনা? তুই আদও কি আমার ভাই? ‘

উশান চটজলদি বলল, ‘ আমি মীরাকে নিয়ে আসছি। তীব্র তুই ওদের নিয়ে চলে যা। সন্ধ্যা হয়ে আসছে এখানে থাকা সেইফ না। ‘

বিন্দুমাত্র দেরী না করে উশান ছুটলো মীরার পিছে। মীরার ধ্যান – ধারণা নেই চারপাশের। সে অশ্রুকণা আঁটকে রেখে প্রাণপণে ছুটছে সামনে। উশানও একই তালে ছুটছে। দুইজনের মধ্যে কারোরই খেয়াল নেই তারা আস্তে আস্তে করে হারিয়ে যাচ্ছে গহীন জঙ্গলে। গহীন হতে গহীনে প্রবেশ করছে।

মীরা আঁটকে রাখা অশ্রুকণা ছেড়ে দেয়। নির্মেদ গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে তারা। উশান এক নিকৃষ্ট মানব। সবথেকে বাজে লোক সে! পিছন ছুটে আসা উশান আপনমনে আওড়ালো,

-‘ এতোভাবে অপমানিত করার পরও তোমার চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা কেনো দেখতে হয় আমার মীরা? কবে তুমি আমায় ঘৃণা করবে? কবে?’

নিজেকে সর্বোচ্চ আশ্বস্ত করার পর মীরা দৌড়ানো বন্ধ করে দেয়।দুই হাত দিয়ে গালে জমে থাকা পানি টুকু মুছে ফেলে খেয়াল করে আশেপাশে। খানিক বাদে সে উপলব্ধি করে, কতোটা গহীন জঙ্গলে এসে পড়েছে। গা শিরশির করে উঠলো তার। উশান আসলো মীরা থেমে যাওয়ার কিয়ংদশ পর। চমকে উঠে মীরা। চটে যায় ফের। রুষ্ট কন্ঠে বলে,

-‘ আপনি এখানে কি করছেন? আমার পিছু কেনো নিয়েছেন? আমায় একা পেয়ে সুযোগ নিতে চাচ্ছিলেন? ‘

উশান মীরার ইঙ্গিত বুঝলো। তবুও রাগলো না। বরং সে অতীব শান্ত। শীতল কন্ঠে বলল,

-‘ আই এ্যাম সরি মীরা! এক্সট্রিমলি সরি এগেইন। মাত্রাতিরিক্ত বলে ফেলেছি। ট্রাস্ট মি মীরা! মন থেকে কথা গুলো বলতে চাইনি।’

মীরা সম্মুখে দৃষ্টিপাত ফেললো। উশান যে কথা গুলো মন থেকে বলেনি জানে সে। উশান চাইছে সে তাকে ঘৃণা করুক। সেদিন বেলকনিতে উশানের গান শুনে যাওয়ার পর সেদিনও কঠোর অপমান করেছিলো এই লোক। আজও তাই! মীরাকে দূরে সরানোর ফন্দি। একটুখানি মনোযোগ দিয়ে ভেবে এটাই আবিষ্কার করেছে সে। মীরা কঠিন হলো! এই ব্যাক্তি তার মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা ডিজার্ভ করে না। কিছুতেই না! মীরা আর উশানের প্রতি দূর্বলতা প্রকাশ করবে না। স্বগোতক্তি করলো মীরা। হাঁটা ধরলো সামনে। অজানা গন্তব্যে! উশান পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল,

-‘ ওদিকে নয় এদিকে আসো মীরা। এদিকে পাহাড়ের ওপর কিছু ঘরবাড়ি আছে। এখানে আজ রাতটা থাকা যাবে। ‘

মীরা মাত্র খেয়াল করলো মেদিনীতে সায়াহ্নের আগমন ঘটেছে। আপত্তি করলো না সে। একা একা এই জঙ্গলে কোথায় ঘুরে বেড়াবে?চট্টগ্রাম তার জন্মস্থান হলেও এখানকার কিছু তেমনভাবে রপ্ত করতে পারেনি মীরা। থাকতোই বা এখানে কতদিন?১ সপ্তাহ, ২ সপ্তাহ বাবার কাছে থেকে আবার চলে যেতো ফুপির বাসায়।ওখানে থেকেই পড়াশোনা করতো।তাছাড়া এখন ফিরে যাওয়া সম্ভব না। আঁধার নামলে জঙ্গলে চলাফেরা বিপদজনক।
উশানের ব্যাস্ত পদচারণ। গার্ডদেরও সে পাঠিয়ে দিয়েছে তীব্রদের সাথে। সামনেই কাঠ দিয়ে তৈরি একটা ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের মতো বাড়ি দেখেছে উশান। সেদিকেই আপাতত তার যাত্রা। যদি রাতটা থাকা যায়৷

মীরার গলা শুকিয়ে চৌচির। তৃষ্ণার দূর্বলতা তার ওপর পায়ের জখম! নাজেহাল অবস্থা মীরার। দ্রুত হাঁটা ধরলো সে। উশান সেই কুঁড়ে ঘরটার সামনে এসে দরজায় কড়াঘাত দিয়ে বলল,

-‘ কেও আছেন? ‘

মিনিট খানেক পর প্রবীণ এক লোক বেড়িয়ে আসলো। সঙ্গে পিছন আসলো দু’জন নারী। তাদের দু’জনের মধ্যে একজন কিশোরী আরেকজন মধ্য বয়সী নারী। প্রবীণ লোকটা উশান, মীরাকে ভ্রু কুঁচকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,

-‘ কারা আপ্নেরা? ‘

-‘ চাচা একটু সাহায্য প্রয়োজন। পাহাড়ে উঠেছিলাম আমরা দু’জন। কিন্তু সন্ধ্যা নামাতে আর বাসায় ফিরতে পারিনি। একটু যদি আজকের রাতটা আশ্রয় দিতেন। ‘

-‘ তোমরা দুইজনে কি হও? ‘

-‘ ভাই বোন! ‘ মীরার করা প্রতিত্তুর।

উশান চমকালো। তবে চমকের রেশ কেটে গেলো মূর্হতেই। মীরা তাহলে তাকে ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এটাই তো তার চাওয়া ছিলো। কিন্তু কি অদ্ভুত! কষ্ট অনুভব হচ্ছে যে অন্তঃকরণে।

প্রবীণ লোকটার নাম হাশেম। তার স্ত্রী রোজি আর তার মেয়ে পাখি। তাদের নিকট বিনীত অনুরোধ করে বহু কষ্টে রাতটা থাকার অনুমতি পেলো দু’জন।শুরুতে যতটা তিক্ত ব্যাবহার করেছিলো হাশেম আর রোজা। লহমায় তাদের তিক্ততা উধাও। আপ্যায়নে ব্যাস্ত হলো তারা। উশান, মীরা ভড়কে গিয়েছিলো একটু। তবে তা ক্ষণমাত্র। চট্টগ্রামের লোকজন আপ্যায়ন প্রেমি। তারা তা জানে। রাতের আহারে খাদ্য হিসেবে দেয়া হলো সামুদ্রিক মাছ এবং সবজি। কলা পাতায় খেতে দেয়া হয়েছে দু’জনকে। উশান, মীরা স্বাচ্ছন্দে খাবার শেষ করলো।

রাতের আহারের পর তাদের দু’জনকে একই রুম থাকতে দেয়া হবে। কক্ষে ছিলো দু’টো চকি। মীরা খাওয়া শেষে বাহিরের মাচায় বসে আকাশ দেখছিলো। তখনি তার ফের ভয়ংকর তৃষ্ণা জাগ্রত হয়। উঠে দাঁড়িয়ে রান্নাঘরে এসে কলসি থেকে পানি ঢেলে খেয়ে তৃপ্তি পায় সে। তবে পানির স্বাদটা ছিলো ভীষণ অদ্ভুত। বিশেষ পাত্তা দিলোনা তাতে মীরা।

-‘ উফ শিট! মীরা এটা কি করলে? ঐটা পানি না ভাং (ম’দ বিশেষ.) । ‘

মীরা পিছন তাকালো। উশান মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। ভ্রুকুটি এক করলো সে। আকস্মিক মনে হলো তার চারিপাশ সহ পুরো পৃথিবী ঘুরছে। সামনে থাকা দাঁড়িয়ে থাকা উশানও৷ মীরা ছুটে গেলো। উশানের হাত শক্ত করে ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল,

-‘ আপনি এভাবে ঘুরছেন কেনো?থামুন..!’

উশানের মাথায় হাত। নিশ্চিত প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকালো সে। মীরা তখন উশানের পায়ে ভর দিয়ে উশানের চুল মুঠো করে ধরেছে। অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করে উশান বলল,

-‘ ইয়া আল্লাহ! মীরা চুল ছাড়ো। মাবুদ! এই মেয়েকে এখন আমি সামলাবো কি করে?’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here