#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা- সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব__৩০.
_______________
‘ After Thunder Come’s Rain. ‘
আপাত লহমা দর্শন করার পর উশানের এই বাক্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা মনে হলো। সে যে এই মাত্র বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটালো! কই? মীরার আঁখি দ্বারা তো এক ফোঁটা আনন্দ অশ্রুও বর্ষিত হলো না। বরং মীরা এখন ঠায় দাঁড়িয়ে। কেমন নির্জীব,নিষ্প্রাণ নেত্রে তাকিয়ে আছে।সে ভেবেছিলো মীরা কাঁদবে।খুশির জোয়ারে ভেসে কেঁদে দিবে। কিন্তু তা তো হলোনা।মেয়েটার কান্না ভারী মিষ্টি, সুন্দর!উশান ভেবেছিলো এবার বুঝি আরো একবার মীরার গুপ্ত ক্রন্দন কালীন সৌন্দর্য দেখতে পাবে। তবে তা আর হলো কই? ‘ আচানক অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু পেয়ে খুশির জোয়ারে আত্মহারা রূপে নিস্তব্ধ।’ মীরার ক্ষেত্রে এটাই ঘটেছে বলে মনস্থির করলো উশান।
অচঞ্চল নেত্রযুগল। স্থির, নড়চড় বিহীন পুরো দেহ। নির্মেদ গাল দু’টো মাত্রাতিরিক্ত শীতল হয়ে আসছে ক্ষণে ক্ষণে। হৃদয়স্পর্শী বার্তা গুলো মীরা স্বগোতক্তি করলো পরপর দুইবার, তিনবার! মীরার শান্ত বক্ষঃস্থলে প্রশান্তির অনিল ছুঁয়ে গেলো। মুখোশ্রীতে তার তুমুল হৃষ্টচিত্ত বজায়। তবে তা বুঝি ক্ষনিকের জন্য। কিয়ৎক্ষণ বাদে যখন সে তার জীবনের চরম সত্য মনে করলো, তখন তিক্ততায় অন্তঃকরণ ছাড়ঁখাড়ঁ, এলোমেলো হলো। নিজেকে সামলালো সে। নিষ্প্রাণ কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,
-‘ আমার এটা কেনো মনে হচ্ছে উশান? যে আপনি আমায় দয়া দেখাচ্ছেন। ‘
চমকালো উশান! অবাক হয়ে বলল,
-‘ আশ্চর্য! এখানে ‘ দয়া ‘ শব্দটা কেনো আসলো মীরা?’
-‘ আসার কথা নয় কি? যেখানে আমি একদিক দিয়ে অসম্পূর্ণ! কখনো মা হতে পারবো না।আপনাকে কখনো বাবা ডাকার জন্য কাওকে এনে দিতে পারবো না। আমার ভবিষ্যত যেখানে এই অক্ষমতার কারণে বিয়ে হওয়া সম্পূর্ণ অনিশ্চিত সেখানে আপনি হটাৎ আমায় গ্রহণ করছেন? এতদিন আমি আপনার পেছনে ঘুরলাম আর এই সময়টাতেই মনে হলো আপনার আমাকে গ্রহণ করা উচিত? ‘
উশান থমকালো, ভীষণ চমকালো! নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো,
-‘ তুমি জানলে কি করে? আঙ্কেল বলেছে এটা? ‘
মীরা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। নেত্র কার্নিশে অদৃশ্য অশ্রুজল ধীরে ধীরে দর্শন দিচ্ছে। দৃষ্টি নত করে মীরা জবাব দিলো,
-‘ না। বাবা বলেনি। আমিই জেনেছি। শুভ্র যখন ১ম বার আমায় সিরিঞ্জ দিয়ে ইনজেকশন পুশ করেছিল তার পূর্বে যেই শিশি থেকে তরল পদার্থ নিয়েছিলো সেই শিশিতে লিখা বাক্য গুলো আমি দেখেছিলাম চশমা ছাড়াই! প্রথমে লিখা গুলো বিশ্বাস করিনি কিন্তু যখন ও আমায় কোমড়ের পাশে পুশ করলো ইনজেকশন তখন ধীরে ধীরে নিশ্চিত হয়েছিলাম ও কোন ইনজেকশন পুশ করেছিলো৷যে ড্রাগ(ঔষধ) শুভ্র আমার ঘাড়ে পুশ করেছে সেগুলে করেছে যাতে প’য়ে’জ’ন এর এফেক্ট জ’রা’য়ু ছাড়া অন্য কোথাও ছড়িয়ে না পড়ে। হাসপাতালে যখন প্রথম জ্ঞান আসলো তখন পেটের অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে আমার সন্দেহ গাঢ় হয়েছিলো বাকিটা ডাক্তার রাহির কাছ থেকে জেনেছি।’
তার কন্ঠে স্বাভাবিকতা। কন্ঠনালী কাঁপলো না বিন্দু মাত্র।কেমন কাঠ কাঠ গলায় জবাব! মীরা কঠিন মনের মেয়ে। সকল পরিস্থিতি দারুণ ভাবে সামলাতে জানে। উশান গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো তাকে। পরিশেষে ভাবনা বদলালো। অনেক কিছু বলার আছে তার।
-‘ তোমায় আমি আগে বলেছিলাম কিছু কথা মীরা। তা ভুলে গেছো? নাকি বিশ্বাস করোনি? ‘
অদ্ভুতুরে শোনালে উশানের কন্ঠস্বর। তার নেত্রে হতাশা বজায়! সুপ্ত ব্যার্থতা ফুটফুটে অবস্থায় নজর কেঁড়ে কিছু বলছে যেনো। মীরা খেয়াল করলো তা। কন্ঠে প্রগাঢ়তা টেনে বলল,
-‘ মনে আছে! শুভ্র আপনাকে মারতে না পেরে তখন আপনার নিকটবর্তী আপনজনদের ক্ষতি করা শুরু করেছিলো৷ তাই আপনি আমায় দূরে রাখতেন সর্বদা।অপমান করতেন পদে পদে যাতে আপনাকে আমি ভুলে যাই। এটা বুঝলাম কিন্তু বাকিদের কথা? যারা এ মূর্হতে আপনার সাথে আছে? তাদের সেফটির দরকার ছিলো না?শুধু আমিই কেনো? ‘
-‘ দে আর ট্রেইন’ড! উজান পুলিশ অফিসার,তীব্রের কথা অবশ্যই বলা লাগবে না?দাদু একসময় পুলিশ অফিসার ছিলেন। সবাই নিজেকে সেইফটি দিতে, সেইফ রাখতে জানে। আর কার কথা বলছো তুমি? বাবা? বাবা দেশের বাহিরে থাকে। আপু?সে কয়েকদিন হলো আমার কাছে ফিরে এসেছে।আপু আমার কাছে আসার পর তাকে যথেষ্ট সেফটি দিচ্ছি আমি। ‘
তপ্তশ্বাস ছাড়ার মৃদু শব্দ।তার অধীর দৃষ্টি পড়লো মীরার ওপর। মীরা অন্যত্রে তাকিয়ে। এক দৃষ্টিতে! তার রাগ লাগল একটু।মেয়েটা এমন অন্যমনষ্ক, মনমরা রূপে কেনো? তার কথা গুলো কেনো সে মনোযোগ সহিত শ্রবণ করছে না?
উশান থেমে যাওয়ার পর মীরা মুখ খুললো।জমাট কন্ঠনালী দ্বারা শব্দগুচ্ছ বের করলো,
-‘ আপনার চোখে আমি কখনো নিজের জন্য ভালোবাসা দেখিনি উশান। হটাৎ তাহলে এভাবে কোনো কারণ ছাড়া আমায় এক্সেপ্ট করার মানে কি? ‘
কঠোরতায় ছেয়ে থাকা মুখোশ্রীতে এতক্ষণ পর হাসি ফুটে উঠলো। সে ধরতে পারলো মীরার লক্ষ। ধীরস্থির হাতে উশান মীরার গাল স্পর্শ করলো।অতি কোমলতার সহিত! মীরা ইতস্তত বোধ করলো ফের।লোকটা আজ তাকে এমন আদুরে, মায়াময় স্পর্শ করছে কেনো?
তারপর কয়েকপল! আলগোছে মীরার এলোমেলো কেশের দলকে কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে প্রতিত্তুর করলো,
-‘ কে বলেছে তোমায় আমি ভালোবাসি?ভালোবাসা কি এতো সহজে, এতো কম সময়ে হয়? তুমি আমার জন্য অন্যকিছু! আমার মাদকতা তুমি। এক বিশেষ মাদকতা। যাকে ছাড়া এক দন্ড শান্তিতে শ্বাস নেয়া দায়! কষ্টকর ভীষণ! ‘
স্থির দু’জনের নেত্র। চোখে চোখে কাটলো কয়েকপল। উশান পল্লব ঝাপটালেও মীরা পলক ফেলতে ভুলে গেলো যেনো। ওষ্ঠাধর কোণে মৃদু হাসির রেশ ফুটে উঠলো।ভারী কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘ চোখের পলক ফেলুন ম্যাডাম। পানি এসে জমেছে। এভাবে তাকিয়ে থাকলে চোখে জ্বালা করবে। ‘
ঝটপট নেত্রপল্লব দুই, তিনবার ফেলে মীরা ছিটঁকে সরে দাঁড়ালো৷ স্থিরচিত্তে আঁড়চোখে একবার উশান কে দর্শন করলো। উশানের বলা প্রতিটা বাক্য তার অনেকদিনের আকাঙ্খিত ছিলো। কিন্তু আজ!আজ যখন আকাঙ্খিত চাওয়া পূর্ণ হলো তখন তার মনে হচ্ছে উশানকে নিজের জীবনের সাথে জরানো’টা ভুল হবে? সে যে অক্ষম! উশানের তো কোনো দোষ নেই। তাহলে সে কেনো ‘ বাবা ‘ হওয়া হতে বঞ্চিত হবে? মীরা সিক্ত কন্ঠে শুধালো,
-‘ আমার সাথে জরিয়ে অযথা নিজের জীবনটা নষ্ট করছেন। আমি অক্ষম! কখনো বাবা হতে পারবেন না আপনি। ভেবে দেখুন। ‘
উশান এগিয়ে গেলো। ফের আগের মতো করেই মীরাকে কাছে টেনে নিলো। অতঃপর ফিসফিস করে বলল,
-‘ বাবা হতে চাইনা!হ্যাজবেন্ড হতে পারলেই চলবে তবে তা শুধুমাত্র তোমার হ্যাজবেন্ড। আমার তুমি হলেই চলবে মীরা।আমার আর কাওকে চাইনা।কাওকে না! আমরা দু’জনই যথেষ্ট! ‘
মীরা হটাৎ তাড়া দেখিয়ে অস্থিরপ্রায় হয়ে বলল,
-‘ আই নিড টাইম! আসছি।’
-‘ ও.কে! টেক ইউর টাইম। বাট এন্সার পজিটিভ চাই ম্যাডাম। নয়তো আপনাকে কিডন্যাপ করে তুলে আনতে আমি দ্বিধা করবো না। মাইন্ড ইট! ‘
দ্রুত পদে সিঁড়ির পেছন হতে বেড়িয়ে আসলো মীরা। আসার মাঝে, পথিমধ্যে হটাৎ থেমে গিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,
-‘ কম কষ্ট দেননি উশান। আপনাকে নাকানিচুবানি না খাইয়ে আমি আপাতত কোনো কিছুই জানাচ্ছি না। ইউ হ্যাভ টু ফিল মাই পেইন! হাহ্! ‘
____
রজনীর তৃতীয় প্রহর। ঘুমন্ত নগরীতে মাঝেমধ্যে ডেকে উঠছে তিন, চারটে নেড়ি কুকুর। সময় সাপেক্ষে ফের তারা মৌন রূপ ধারণ করছে।অনিলে বইছে বিভিন্ন পুষ্পের মিষ্টি সুঘ্রাণ। কৃষ্ণপক্ষের শেষ তিথির রজনী আজ। কৃত্রিম রশ্মি ব্যাতীত চন্দ্রের দর্শন পাওয়া মুশকিল! ভোর হয়ে এলো বলে এখনি, গাছের ডালে বসে থাকা পক্ষী দল ডেকে উঠলো মৃদু শব্দে। সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো চারপাশে ঘোর নীরবতা ধ্বংস করে।
চার দেয়ালের কক্ষটায় শীতলতা বজায়।ওয়াশরুম থেকে থেমে থেমে আসছে গুমোট ক্রন্দনের বিষন্ন সুর। ডুকঁরে কেঁদে উঠছে মীরা। সাওয়ারের নিচে এলোমেলো রূপে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে সে শুয়ে রয়েছে শুভ্র রাঙা ভূমিতে। সাওয়ার থেকে পানি পড়ছে ঝমঝম শব্দ করে। এই শব্দ তার ক্রন্দনের ধ্বনি বহির্ভাগে যাওয়া হতে রুখে দিচ্ছে ক্রমাগত। মীরা শপিং মল থেকে আসার পর সেই যে সাওয়ার নিচে শুয়ে কাঁদছে, এখন প্রায় আট ঘন্টা হতে চললো ওর কোনো হেলদোল নেই। শরীরের তাপমাত্রা ইতিমধ্যে কমতে শুরু করেছে। মুখোশ্রী ফ্যাকাশে, বিবর্ণ তার! হাত- পা, সর্বাঙ্গ অতি মাত্রায় শীতল, হীম। বিড়বিড় করে মীরা কিছুক্ষণ পর পর বলছে,
-‘ আমি কখনো ‘ মা ‘ ডাকটা শুনতে পাবোনা আম্মু। ওরা আমার মা হওয়ার ক্ষমতা কেঁড়ে নিয়েছে।আমাকে বাজে ভাবে ছুঁইয়ে দিয়েছে। আমাকে তোমার আঁচলের নিচে লুকিয়ে নাও আম্মু। আমার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে! যন্ত্রণা হচ্ছে! আমি আর পারছিনা। পারছিনা ভালো থাকার কৃত্রিম নাটক করতে। আমি তোমার কাছে যাবো আম্মু। আমাকে নিয়ে যাও তুমি। ‘
অতঃপর ভারী ক্রন্দন! কান ফাটা আর্তনাদময়ী কান্না ছাপিয়ে পড়লো চার দেয়াল জুড়ে। কিয়ৎক্ষণ বাদে মীরা আবছা দেখলো তার মা’কে আরশির মাঝে।নীল শাড়ী পরিহিত তিনি। তার দিকে চেয়ে মুচকি হাসছে। হাসলো সে! মিষ্টি হাসি। হাত বাড়িয়ে দিলো মায়ের দিকে। অতঃপর সবকিছু অন্ধকার..! নেত্রযুগল অনায়াসে বন্ধ হয়ে এলো তার।
চলবে..