#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকাঃ সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব-২৭.
____________________
রজনীর কালচে অন্তরীক্ষ বর্তমানে মেঘাবৃত। মেঘ বলছে বৃষ্টি নামবে। কিয়ৎক্ষণ পর হলোও তাই। অম্বর হতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি আছড়ে পড়লো পৃথিবী পৃষ্ঠে। বৃষ্টির মিষ্টি সুর চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ঈষৎ বাদে নিষ্ঠুর, জোরালো আর্তনাদে ফেটে পড়ছে অম্বর। ঝিলিক দিচ্ছে বারংবার। ক্ষীণ বাদে বৃষ্টির তেজ বাড়লো। উশান সিক্ত হয়ে টইটুম্বুর।খানিকটা এগোতেই নেটওয়ার্ক কানেকশন ডিসকানেকটেড হয়ে যায় ব্লুটুথ থেকে। জোড়াল শ্বাস ফেলে বাইক থামায় উশান। চার – পাঁচটা হাচি দেয় পরাপর।সে জানতো নেটওয়ার্ক কানেকশন ডিসকানেকটেড হয়ে যাবে। তাই আগে থেকেই পূর্ণ ব্যাবস্থা গ্রহণ করে এসেছে। তবে তার কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য তেজস্বী বর্ষণের থামার দরকার। কিন্তু বর্ষণ যে থামার নামই নিচ্ছে না। এদিকে হাতে সময়ও খুব সীমিত।
পনেরো মিনিট পর বৃষ্টি থামলো পুরোপুরি। তবে অম্বর হতে আসা গর্জন জানান দিয়ে রাখছে বর্ষণ আসবে আবারও। উশানের পরনের শার্টটা খুলে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে। তার গায়ে এখনো এঁটে সেঁটে রয়েছে পাতলা কালো রঙের টিশার্ট। উশান নিজের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট ব্যাগ করলো। অতঃপর ওষ্ঠাধর দু’টো গোল করে শিষ বাজালো। একবার, দুইবার, তিনবার..! সিক্ত মাটিতে পড়ে থাকা শুষ্ক ঝড়ে পড়া পাতায় মচমচ শব্দ প্রতিফলিত হয় উশানের কর্ণকুহরে। মৃদু হাসে উশান। আসছে তাহলে! ঈষৎ বাদে জঙ্গলের বাম দিক হতে লেজ নাড়াতে নাড়াতে বেড়িয়ে আসে এক নেড়ি কুকুর। উশান হাঁটুগেড়ে বসে ইশারায় কুকুরটাকে ডাকলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘ মিস মি লিও? ‘
চেঁচিয়ে উঠলো লিও। উশান তার হাতে থাকা মাংসের প্যাকেট লিওর সামনে দেয়। তৃপ্তি সহকারে খাওয়া শুরু করলো লিও।
লিও উশানের এককালীন পোষা কুকুর। ফারদিনের বাসায় থাকার সময় উশান লিওকে পুষতো। তবে ঢাকায় চলে যাওয়ার পর আর লিও’র সাথে তার যোগাযোগ ছিলোনা। উশান চলে যাওয়ার পরপর লিও জঙ্গলের ঠিক এই জায়গাতেই বসবাস করে। উশান জানতো তা! ঠিক এই জায়গায় এসে উশান চির-পরিচিত শিষ বাজালে লিও ছুটে আসতো তার প্রিয় মনুষ্য ব্যাক্তির নিকট।
লিও’র খাওয়া শেষ। উশান ব্যাগ থেকে পলিথিনে মোড়ানো প্যাকেট’টা আনলো। লিও এগিয়ে আসে ছুটে। উশান কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে বলল,
-‘ উঁহু! এটা তোর খাবার না। পিছে সর!
লিও বুঝলো হয়তো উশানের কথা। সে পিছু হটলো।পলিথিন থেকে মীরার পোশাক বের করে উশান। আসার পথে রুহির থেকে নিয়ে এসেছিলো সে।লিওর নাকের কাছে মীরার পোশাক ধরলো উশান। গন্ধ শুঁকে লিও। তারই মধ্যে লিও’র গলায় উশান একটা লোহার চেইন লাগিয়ে পিঠে নিজের ব্যাগ ঝুলিয়ে নেয়। লিও’কে বলে,
-‘ চল লিও! ওকে আমাদের খুঁজতে হবে। ‘
লিও ছোটা শুরু করলো। লোহার চেইনটা শক্ত করে ধরে উশানও ছুটছে লিওর পিছন। জঙ্গলের মাঝে যাচ্ছে তারা। লিওর ছুটে চলার গতী বাড়ছে ক্ষণে ক্ষণে। উশান এতোটা ছুটে ক্লান্ত হলোনা। অভ্যাস আছে তার। তাছাড়া, মাদকতা যখন অন্যত্রে পড়ে, তখন ক্লান্তিরা আর কিভাবে ভর করে দেহে?
লিও গন্ধ শুঁকে শুঁকে থামলো পরিত্যাক্ত তেলের গোডাউনের সামনে। উশানের ধারণা ছিলো মীরাকে এখানেই নিয়ে আসা হয়েছে। লিও গেলো সিক্ত এক বস্তার নিকট। সেখানে দাঁড়িয়ে সে জিহ্বা বের করে শ্বাস টানছে। উশান এগোল। তার বোধগম্য হলো মীরাকে এই বস্তায় করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।তবে একটা বিষয়ে খটকা লাগে উশানের। বাহিরে কোনো পাহারাদার নেই কেনো?অদূরে কাওকে দৃশ্যমান হচ্ছে না। তাহলে কি শুভ্র মীরাকে অন্যত্রে সরিয়ে ফেলেছে?
লিওর গলা থেকে লোহার শিকলটা খুলে ফেললো উশান। লিওকে মুক্ত করে কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,
-‘ ফিরে যা লিও। এবার ঢাকা যাওয়ার পথে তোকে নিয়ে যাবো সাথে। এটা তোর আমায় হেল্প করার গিফ্ট!’
লিও লেজ নেরে অসম্মতি জানালো। উশান দম ফেলে৷ আদেশের সুরে বলে,
-‘ যেতে বলেছিনা আমি তোকে? ‘
ক্ষেপাটে উশানকে এই পশুটাও বোধহয় ভয় পায়। সে উশানের হাতে গাল ঘষে জঙ্গলের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেলো। জোড়াল শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো সে।অন্তঃকরণ হুহু করছে! মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ তখন ছটফটে। সামনে এগোল উশান। আস্তে করে সদর দরজা খোলার পর দর্শন হয় তার চক্ষু সম্মুখে ২ জন ব্যাক্তিকে। তারা দু’জন আপনমনে খেজুরে আলাপে তুমুল ব্যাস্ত। সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলটা হাতে নিলো উশান৷ দ্বিতীয় হাতে তার ধারালো ছু’রি। সর্বপ্রথম গুলি ছুড়লো সে এক লোকের মাথায় এবং দ্বিতীয়বার সেকেন্ডের মাঝেই অপর লোকটিকে চেঁচানোর সুযোগ না দিয়ে তার হৃদপিণ্ড বরাবর ছু’রি ছুঁড়ে মারলো। দু’জন একসাথে পড়ে গেলো ভূমিতে। প্রাণহীন দেহ! উশান দু’জনের হাত ধরে সদর দরজার বাহিরে ফেলে রেখে ভিতরে প্রবেশ করে।
আশপাশে বড়সড় তেলের ড্রাম। এসব ছাড়া বাদ বাকি অন্য কিছু দর্শন হচ্ছেনা উশানের। উশান নিম্ন সুরে আনমনে বলল,
-‘ হোয়ার আর ইউ মীরা? হোয়ার আর ইউ?’
উশান আরো অন্তরালে প্রবেশ করে। হাতে তার র’ক্ত মাখো মাখো ছু’রি আর পিস্তল। ক্ষীণ বাদে ফের দৃশ্যমান হয় চারজনকে মেশিনগান হাতে নিয়ে পাহারা দিতে। উশান আড়ালে দাঁড়িয়ে ছক কষে কিভাবে এদের সামলাবে। পরিশেষে সে উপস্থিত লোক ৪ জনের চক্ষু আড়ালে এক তেলের ড্রামের পাশে গিয়ে দাড়ালো। লোক ৪জন হাঁটছে। দুইজন উশানের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে নিলেই উশান ২ হাতে দু’জনের মুখ চেপে আড়ালে এনে নিঃশব্দে ঘাড় বাঁকিয়ে মেরে ফেলে দু’টোকে। বাকি দুজনকে পিস্তল দিয়ে গু’লি করেই মা’র’লো। অতঃপর সেই কাঙ্খিত স্থান! শুভ্র বসে মাথার চুল মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে। তার পাশে দাঁড়িয়ে জবুথবু অবস্থায় তিনজন। উশান পাশে চেপে দাঁড়ায়। শ্রবণ করার প্রয়াস চালায় তারা কি কথা বলছে৷ নীরবতা ধ্বংস করে শুভ্র প্রলয়কারী হুংকার দিয়ে বলল,
-‘ তোরা এতো জন এখানে থাকা অবস্থায় ঐ মীরা কেমনে গায়েভ হইলো?কি করতাছিলি তোরা? অপদার্থের দল! মীরা’রে যেখান থ্যাকা পারোস খুঁজে আন যা।’
চিন্তাগ্রস্ত হয় উশানের অন্তরাল। মীরা নেই? তবে কি পালিয়েছে? পালাতেই পারে। মেয়েটার সাহস আছে অনেক। বুদ্ধিমতীও৷ কিন্তু সে এখন কি করবে?আগে মীরাকে খুঁজবে নাকি শুভ্রের দলবল কে ধরবে? তার অফিসিয়াল কার্যক্রম হিসেবে তাকে এখন শুভ্রদেরই ধরা উচিত। এদিকে দায়িত্বে হেলাফেলা করা তার কষ্নিকালেরও পছন্দ না।সে কাজ প্রেমী মানুষ। দোটানায় থাকাকালীন প্রকৃতিই বলে দিলো তার কি করা উচিত! শুভ্রকে দেখে ফেলেছে উশানকে। তাকে দেখে হাসতে হাসতে করতালি দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। শুভ্র কুটিল হেঁসে জিজ্ঞেস করলো,
-‘ এসে পড়লেন? এতো জলদি! বাহ! প্রেমিকার প্রতি এতো ভালোবাসা? ‘
উশান পিস্তল সন্তপর্ণে পিঠের পিছে গুঁজে পকেটে হাত দিয়ে হেলতে- দুলতে সামনে আসে। শুভ্র হতে তার দুরত্ব চার ফিট দূরে দাঁড়ায়৷ তাচ্ছিল্যের কন্ঠে শুধালো,
-‘ কি কিডন্যাপ করিস যে একটা মেয়ে তোদের এতো গুলো লোকের চোখের ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেলো? লজ্জা লাগেনা? ‘
-‘ মেয়েটার ওপর ইন্টারেস্ট থাকলে তো আমি তারে আঁটকায় রাখতাম কড়া সিকিউরিটি দিয়ে। আমার তো তাকে না তোকে চাই!তোমারে মেরে তারপর নিজে মরবো। ‘
ফিচেল হাসলো উশান৷ একহাত পিছে নিয়ে গুঁজে রাখা পিস্তল বের করে ক্ষনিকের মধ্যে তিনটে ছেলের চক্ষু আড়ালে তাদের হৃদপিণ্ড বরাবর গুলি করে৷ নিষ্প্রাণ দেহ তৎক্ষনাৎ প্রাণহীন রূপে ভূমিতে আছড়ে পড়ে। শুভ্র বিচলিত হয় কিঞ্চিৎ। পরবর্তীতে নিজেকে সামলে নিয়ে হালকা হেঁসে বলল,
-‘ জিনিয়াস হাহ্! ‘
-‘ তোর মতো বেকুব নাকি সবাই? তোর বাবা কতো শতো পাপ কাজ করেছে। এমনকি তোর মাকে অব্দি নিজের চামচাদের দিয়ে ধ’র্ষ’ণ করিয়ে তারপর মে’রে’ছে। তুই কিনা সেরকম এক ব্যাক্তির মৃত্যু প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছিস!ষ্টুপিড! ‘
শুভ্রকে দারুণ আশ্চর্য দেখালো। চঞ্চল নেত্রযুগল প্রশ্ন ভরা। বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-‘ মা..মানে? কিসব বলছেন? ‘
পকেট থেকে নিজের ফোন বের করে কাঙ্খিত কিছু বের করে সে শুভ্রের পানে ছুঁড়ে দিলো। ফোন ক্যাচ ধরে শুভ্র। উশান ইশারায় বলল, ফোন দেখতে। শুভ্র মনোযোগী হয় সেদিকে। ঘাড় কাত করে বাম দিকে তাকাতে নিবে তৎক্ষনাৎ তড়িৎ বেগে মীরা কোথা হতে যেনো ছুটে আসলো। এসেই ঝাপটে ধরলো উশানকে। ভীষণ শক্ত করে উশানকে আঁকড়ে ধরে মুখ লুকালো উশানের বক্ষঃস্থলে। উশান হতবিহ্বল! আস্তেধীরে সেকেন্ড খানেকের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে মীরাকে আগলে নিলো তার উষ্ণ আলিঙ্গনে। বলল,
-‘ মীরা? ঠিক আছো? কোথায় লুকিয়ে ছিলে? ‘
মীরা ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। দাঁত দিয়ে ওষ্ঠ চেপে ধরে কোনোমতে বলল, ‘ আপনি সত্যিই এসেছেন নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি? ‘
উশান মৃদু হাসলো। শেষে নিচু হয়ে মীরার কানের পিঠে হিসহিসিয়ে বলল,
-‘ আ’ম হেয়ার! আই উইল অলওয়েজ বি হেয়ার। ফিল ইট গার্ল! ‘
মীরা ফুপাতে ফুপাতে আলিঙ্গন নিবিড়, শক্ত, দৃঢ় করলো আরেকটু। উশানের উষ্ণ বক্ষ পিঞ্জরে নাক ঘসলো। ইশ! মেয়েটা যদি হুঁশে থাকতো। তাহলে লজ্জায় মারা যেতো নিশ্চিত। উশানের ব্যাস্ত নেত্র যুগল তখন পরখ করছে মীরাকে। শুভ্রের প্রতি তার খেয়াল নেই। মীরা’র উপরিভাগে আঘাত লেগেছে কিনা কোনো তা দেখতে ব্যাস্ত তার নেত্র জোড়া। সঙ্কোচ পায়ে ঠেলে মীরার ঘাড়ের কাছের ওড়নাটা সরায় উশান। সেখানে বেশ কয়েকটা ফুটো। যেমনটা ইনজেকশন পুশ করলে হয়ে থাকে। মস্তিষ্কের শান্ত স্নায়ু দপ করে অস্থিতিশীল হলো তার। শুভ্রের প্রতি দৃষ্টি ফেলে গর্জে উঠে জিজ্ঞেস করলো,
-‘ ওকে কিসের ইনজেকশন দিয়েছিস? ‘
শব্দহীন ক্রন্দনে ব্যাস্ত ছিলো শুভ্র। উশানের হটাৎ গর্জনে কেঁপে উঠে ফোন থেকে দৃষ্টি সরালো। হাতের ফোন ফেলে দিলো পাশে। অতঃপর নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলল,
-‘ প’য়ে’জন! টেক টু হার হসপিটাল আর্লি। ‘
অনুভূতিশূন্য মস্তিষ্ক। নিষ্প্রভ নেত্রে মীরার প্রতি দৃষ্টি ফেলার পর খেয়াল করলো মীরা তখন অচেতন। পিছনের পোশাক রক্তে মাখামাখি। মেয়েটাকে কি তবে সে হারাতে চললো? ‘
চলবে..