হৃদয়েশ্বরী – ৩৮ সাদিয়া মেহরুজ

0
25

#হৃদয়েশ্বরী – ৩৮
সাদিয়া মেহরুজ দোলা

টুইঙ্কেলের ঘুম ভেঙেছে আধাঘন্টা হলো। তার কাছে কেও নেই। একা শুয়ে বসে টুইঙ্কেল তার হাতে করা ক্যানুলা খোলার প্রয়াস চালাচ্ছিলো। তবে ক্যানুলা ধরে টান দিতেই তার অনুভূত হয় অসীম যন্ত্রণা। ব্যাথায় ঠোঁট উল্টে ছোট্ট ছোট্ট আঙুল দ্বারা নিজের অধর জোড়া চেপে ধরে সে। নিম্ন কন্ঠে ক্রন্দনরত কন্ঠে বলে,

-‘ হোয়ার আর ইউ পাপা? আই মিস ইউ সো মাচ।’

একা একা বিনাশব্দে ক্রন্দনকালীন টুইঙ্কেল টের পেলো তার ভীষণ খিদে পেয়েছে। সাথে প্রাকৃতিক ডাকও এসেছে। লহমায় তার অবস্থা এলোমেলো, অবিন্যস্ত হয়ে পড়লো। পায়ে এমন মোটা ব্যান্ডেজ, তার ওপর হাতে লাগানো ক্যানুলা! এভাবে করে সে ওয়াশরুমে যাবে কি করে? খাবার বা চাইবে কার কাছে? কেও তো নেই আশপাশে। অনেকবার হাঁক ছেড়ে সে ডেকেছিলো ইফরাদকে, উশানকে। কেওই সাড়া দেয়নি। খুদা সহন করতে পারে না টুইঙ্কেল। সে ফের ভাঙা গলায় ডাকলো ইফরাদকে। আসলো না কেও। ঠোঁট ভেঙে ডুকরে কেঁদে উঠলো টুইঙ্কেল।অস্ফুটস্বরে বলল,

-‘ বাবা! তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছো? আমি কি কোনো দুষ্টুমি করেছি? কেনো আসছো না তুমি আমার কাছে? আই প্রমিজ বাবা আমি আর দুষ্টুমি করবো না। তুমি একটু আমার কাছে আসো। হাতে ব্যাথা করছে আমার, ফু দিয়ে দাও না।খুদা পেয়েছে বাবা। একটু খেতে দাও৷ ‘

গুমোট, নিস্তব্ধ কক্ষটায় টুইঙ্কেলের বক্ষপিঞ্জর ভাঙা আর্তনাদ ছিটকে গিয়ে ছড়ালো চারপাশে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়লো ক্রন্দনের গতি। কারো দেখা নেই তবুও। তীব্র ক্ষুধার চোটে, অনাকাঙ্ক্ষিত অদৃশ্য এক কষ্ট ছাপ নিয়ে টুইঙ্কেল তুলতুলে সেই বিছানায় পড়ে রইল অনেকক্ষণ দূর্বল রূপে।

____

উজান আজকাল বিশেষ ভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর একটা জিনিস উপলব্ধি করেছে আর তা হচ্ছে সিয়া! সিয়ার ব্যাপারটা। সিয়া ইদানীং খুব বেশি তার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছে। জানার আগ্রহ প্রকাশ করছে তার ব্যাক্তিগত জীবন সম্পর্কে। সিয়ার আরো কিছু ব্যাবহার এবং আচরণ উজানকে দিনকে দিন নানাবিধ প্রশ্নের সামনে ঠেলে দিচ্ছে। সিয়াকে তার নিকট সুবিধার ঠেকছে না। একটুও না! গন্ডগোল আছে বিশাল আকৃতির। সে কয়েকদিন আগেই জানতে পেরেছে রাহনুমা, সেই তুখোড় সন্ত্রাসী দল, তারা উশান, উজানের পিছে লোক লাগিয়েছে। উজানের সন্দেহ গাঢ় হচ্ছে।তার বারবার মনে হচ্ছে সিয়া সেই সন্ত্রাসী দলের সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত রয়েছে। তার আচরণ – কর্ম তাই পেশ করছে।
ল্যান্ডলাইন কানে ধরে রাখা। মুক্ত হাতটা দ্বারা ব্যাস্ত হাতে টেবিলে রাখা স্যান্ড ক্লক উল্টালো উজান। মুখোশ্রীতে আচানক রাজ্যের ব্যাস্ততা ফুটে উঠেছে। অন্তঃস্থল বারংবার কু ডেকে বলছে হিসাব মিলেছে!তার সন্দেহটাই সঠিক৷

কড়মড় ধ্বনি তুলে উশানের কামড়ায় কেও আসছে তখন। ল্যান্ডলাইন কান থেকে নামিয়ে রেখে সম্মুখে দৃষ্টিপাত স্থির করলো উজান। তার চক্ষু সম্মুখে তখন দাঁড়িয়ে সিয়া। অদ্ভুত বেশে। এলোমেলো পায়ে ছুটে আসলো সে।উজানের নিকটবর্তী দাঁড়িয়ে টলমলে নেত্রে তাকালো। উজান ভড়কায়! কন্ঠে স্বাভাবিকতা বজায় রেখে প্রশ্ন ছুঁড়ে,

-‘ আপনি এখানে! ‘

প্রতিত্তুর পাওয়া গেলো না। তবে তৎক্ষনাৎ ভীষণ অদ্ভুত এক দৃশ্যের দর্শন মিললো। সিয়া হাঁটুগেড়ে বসলো ভূমিতে। আচানক, শব্দ করে! উজানের দুই পা জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলল,

-‘ আমাকে বাঁচান! আ..আমাকে বাঁচান দয়া করে।ওরা,..ওরা আমাকে বাজে ভাবে ছুঁইয়ে দিচ্ছে, ব্যাথা দিচ্ছে। আমার সম্মানে কলঙ্ক এঁটে দিচ্ছে। দয়া করে আমাকে বাঁচিয়ে নিন। ‘

কাঁপাটে, ভীতিগ্রস্ত কন্ঠস্বর। উজানের অন্তর্ভাগ উলোট-পালোট হলো। সিয়া তখন হুঁশে নেই। সে নিজেকে লুকাতে ব্যাস্ত। টেবিলের নিচে গিয়ে হাটুঁ ভেঙে গুটিশুটি মেরে বসলো। তার মাঝে হিতাহিত জ্ঞান নেই আপাতত। সিয়ার মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করছে সেই দশ বছর আগের রাত্রিকালীন লহমা। যেদিন তাকে নিষ্ঠুর, পাষণ্ডিক ভাবে নির্যাতন করা হলো। রক্তা’ক্ত করে ফেলে রাখা হলো। সেই মন – প্রাণ ধ্বংস করা কটু, তিক্ত লহমা তার নিউরন জুড়ে বিচরণ করছে আপাত ক্ষণে।
বলা হয়! দুঃখের সময় নাকি নিতান্তই ক্ষনিকের। অল্প পরিসরের।দুঃখের পর সুখ আসে এটাই নাকি প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু সিয়ার গোটা জীবনটা জুড়েই যে কষ্ট, দুঃখে ভরা। তাহলে এ কথার মিল হলো কোথায়?

_____

মীরার মেডিক্যাল রিপোর্ট হাতে নিয়ে উশান বসে ছিলো একাকী। নিষ্প্রাণ, নির্জীব নেত্র যুগলের স্থির দৃষ্টি তখন আবদ্ধ রিপোর্টের গোটা কালো অক্ষর দিয়ে লিখা শব্দগুলোর প্রতি। শব্দ গুলো বিষাক্ত! বিষে ভরা তিক্তপূর্ণ বাক্য। এই রিপোর্ট মীরার মাথার গুরুতর আঘাত পাওয়ার জন্য করা হয়েছে। রিপোর্ট এ্যাবনরমাল, নেগেটিভ। মীরা সুস্থ নেই! একটুও না। এমনিতে ছোট সময়ে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত ছিলো তার ওপর আবার নতুন করে এই আঘাত সংযুক্ত হলো। সৃতিজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। নয়তো মীরার পাগল হয়ে যাওয়ার চান্স আছে। সৃতি শক্তি জনিত সমস্যাটার ইতিমধ্যে দর্শন মিলেছে। মীরার জ্ঞান ফেরার পর উশান ছাড়া আর কাওকেই সে চিনতে পারেনি। উশানের সঙ্গ পেলেও তার ব্যাবহার ছিলো উদ্ভটতম।

খামের ভেতর রিপোর্ট ঢুকিয়ে উশান হাঁটা ধরলো মীরার কেবিনের উদ্দেশ্যে। থেমে থেমে অন্তঃকরণ থেকে বেড়িয়ে আসলো জোড়াল দীর্ঘ নিঃশ্বাস।এই দিনটাই বোধহয় অভিশপ্ত। তাই সবকিছু খারাপ হচ্ছে। ডাক্তারের সাথে কথা বলেছে উশান। তাদের বক্তব্য দীর্ঘ সময় নিয়ে মীরার চিকিৎসা করতে হবে। তাহলে মীরার সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়াটা হয়তো দেখা যাবে।

মীরা ঘুমোচ্ছে। উশান আসার পরপরই ঘুমিয়ে পড়েছে সে। উশান নিঃশব্দে এগোল মীরার নিকট। ফিরে যেতে হবে তাকে ক্যাম্পে। বারংবার ফোন আসছে। মীরার পাশে বসে উশান মীরার মুখোশ্রী দর্শন করলো সময় নিয়ে। অবিন্যস্ত কোঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদু রূপে ওষ্ঠাধর ছোঁয়ালো মীরার ললাটে৷ ঘুমন্ত মীরা নড়েচড়ে উঠলো। হুঁশে থাকলে এতক্ষণ নিশ্চিত নিজের গাল দু’টো লাল করে ফেলতো। মেয়েটা লাজুক! মাত্রাতিরিক্ত। মীরার কানের পিঠে আঙুল ছুঁইয়ে কন্ঠের খাদ নামিয়ে উশান বলে উঠলো,

-‘ দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠো মীরাবতী। তোমাকে এই দূর্বল রূপে দেখতে আমার ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। ‘

যাওয়ার পথে উশান ঠিক করলো টুইঙ্কেলের সাথে সে দেখা করে তবেই যাবে। টুইঙ্কেল আর রুহির দেখাশোনার জন্য উশান চারজন নার্স ঠিক করেছে।তারা সর্বসময় টুইঙ্কেল এবং রুহির দেখভাল করবে।এমনিতে এ পরিস্থিতিতে সে কখনোই যেতো না তবে ট্রেনিং দেয়ার সময়কাল প্রায় অন্তিমের কাছাকাছি। ২ বছর বলা হয়েছিলো তাকে ট্রেনিং দিতে। সময় শেষ প্রায় শেষই বলা যায়। আর মাত্র কয়েকটা মাস।

টুইঙ্কেলের কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই উশান দেখলো মেয়েটা অতি দ্রুততার সাথে খাবার খাচ্ছে। আশপাশে কোনো দিকে ধ্যান নেই তার। অত্যান্ত তাড়াহুড়ো করে খাওয়া শেষ করছে। উশান মৃদু হেঁসে এগোল। টুইঙ্কেলের পাশে বসে ওকে টেনে নিজের কোলে বসালো। অতঃপর বলল,

-‘ আস্তে খাও প্রিন্সেস। গলায় খাবার আঁটকে যাবে তো। ‘

মেয়েটা শুনলো বলে মনে হলো না। সে নিজের মতো করে খাচ্ছে। খাওয়া শেষ ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি শেষ করে হাত ধুয়ে নিলো একজন নার্সের সাহায্যে। পরিশেষে সে উশানের গলা জড়িয়ে ধরে উশানের চওড়া কাঁধে মাথা রাখলো। নম্র গলায় জিজ্ঞেস করলো,

-‘ পাপা কোথায় চাচ্চু? আমি পাপার কাছে যাবো। নিয়ে চলো না। ‘

উশান অপ্রতিভ হলো। পাথর বুকটা তার থেমে থেমে কেঁপে উঠলো। বেফাঁস হলো স্বাভাবিকতা। ধৈর্য নিয়ে ভাবলো কিছু। শেষে গাঢ় কন্ঠে বলল,

-‘ প্রিন্সেস! তোমাকে আমি কিছু কথা বলি। মনোযোগ দিয়ে শুনবে। ওকে? ‘

-‘ ওকে চাচু। ‘

-‘ তোমার মাম্মার কথা মনে আছে? সে যেভাবে স্কাই এর স্টার হয়ে গিয়েছে। সেভাবে তোমার বাবাও স্কাই এর স্টার হয়ে গিয়েছে আম্মু। তোমার মাম্মা খুব ভয় পেতো না একা থাকতে? তাই বাবা তার ভয় কাটাতে তোমার মাম্মার কাছে গিয়েছে। বুঝেছো?’

টুইঙ্কেল অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালো। গাঢ় গোলাপি অধর জোড়া তার কম্পমান। ফুঁপিয়ে উঠে সে বলল,

-‘ বাবা কি আর আসবে না চাচু? ‘

-‘ নো প্রিন্সেস। ওখান থেকে আরো ফিরে আসা যায় না। ”

টুইঙ্কেল মায়ের প্রতি বড্ড বেশি দূর্বল। মায়ের জন্য সে সবকিছু করতে পারে। নিজের ভালোলাগা ত্যাগ করতে পারে। এইযে উশান যখন বলল তার মা একা থাকতে পারেনা তাই বাবা তাকে সঙ্গ দিতে তার নিকট গিয়েছে! সে ব্যাপারটা বুঝলো। টুইঙ্কেল জানে তার মা একদমই একা থাকতে পারে না। মা’র কথা মনে করে ইফরাদের তাকে ছেড়ে চলে যাওয়াটা নিয়ে সে যে ভীষণ কষ্ট পেলো, তা প্রকাশ করলো না। অন্তর্লীন করে রাখলো দুঃখ টুকু। উশান জানতো মায়ের কথা টানলো টুইঙ্কেল লক্ষী বাচ্চার মতো নিশ্চুপ হয়ে যাবে। তাই সে কায়দা করে এই কথাটা বলেছে।

কয়েকপল কাটলো মৌনতায়। খানিকক্ষণ বাদে টুইঙ্কেল ভীষণ মন খারাপ নিয়ে বলল,

-‘ বাবা কেনো আমাকে একা ফেলে গেলো চাচু?আমি এখন কার কাছে থাকবো? ‘

উশান টুইঙ্কেলকে আঁকড়ে ধরে গালে ঠোঁটের স্পর্শ আঁকে। অতঃপর মিষ্টি কন্ঠে শুধায়,

-‘ আমার সাথে থাকবে প্রিন্সেস। তোমার মিষ্টি আর আমার সাথে। আমরা একসাথে থাকবো। ঠিক আছে?’

কিয়ংদশের হৃষ্টচিত্ততা লক্ষ্য করা গেলো টুইঙ্কেলের মুখোশ্রী জুড়ে। তবে তা ক্ষনিকের। উশান তার থেকে বিদায় নিয়ে নার্স দু’জনকে কড়া গলায় শাসিয়ে গেলো যাতে টুইঙ্কেলকে চোখের দৃষ্টি আড়াল না করে। উশান বেড়িয়ে যেতেই নার্স দু’টো টুইঙ্কেল কে শাসালো। ধমক দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তারা দু’জন প্রস্থান করলো কক্ষ হতে। টুইঙ্কেল তখন সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ।
রজনী নামতেই সে কেবিনের জানালার কপাট উন্মুক্ত করে অন্তরীক্ষে দৃষ্টিপাত ফেলে। অভিযোগ ছুঁড়ে দেয় অম্বরে। মৃদু স্বরে বলে,

-‘ তোমরা পঁচা বাবা, মা! আমাকে কেনো নিয়ে যাওনি তোমরা? ‘

একাকীত্বের প্রহর বিচরণকালীন টুইঙ্কেল বুঝলো তার পাশে কেও নেই। কেওই নেই৷ ধীর – স্থির রূপে, সময়ের তালে তার ক্রন্দন বাড়লো। মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে সে কান্না শুরু করলো। বারংবার অস্ফুটস্বরে বাবা, মার নাম ধরে চেঁচাতে লাগল৷ সে।

চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here