#হৃদয়েশ্বরী – ৪৩
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
পুবাকাশে লাল আভা ফুটেছে মিনিটখানেক হয়নি। বাতাবরণ এখন স্নিগ্ধ, সতেজ। প্রশান্তিদায়ক প্রভাত বিরাজমান। রাতে এক পশলা বৃষ্টি নামার পর মিনিট দশেক পূর্বে বৃষ্টির তেজ কমেছে। মেঘলা অন্তরীক্ষে তখন ধূসর মেঘের পায়চারি। পূর্ব দিকে বহু কষ্টে কালশিটে মেঘ সরিয়ে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। নাম না জানা হরেক রকমের পাখির গুঞ্জনে মুখোরিত তখন বাতাবরণ।শীতল, প্রাণ জুড়ানো সমীরে তখন ভেজা মাটির ঘ্রাণ দমকে ছুটছে। পুরো মহল্লা হিমশীতল আবহাওয়া পেয়ে তন্দ্রায় বিভোর। নির্ঘুম ছটফটে, উড়ন্ত পাখিদের সাথে তখন বোধহয় জেগে কেবল উশান। মুখোশ্রীতে তার চরম ব্যাস্ততা। একবার কল দিচ্ছে কাওকে। তো আরেকবার দ্রুত হাতে টাইপিং করছে ট্যাবে। ল্যাপটপ স্ক্রিনে ভাসা শত শত ছোট্ট অক্ষর গুলোর প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে মাঝেমধ্যে আবার অবিন্যস্ত ধোঁয়া ওড়া কফির মগে অধর ছোঁয়াচ্ছে।
উজান হেলেদুলে হাঁটছে। আচানক এই ভোরবেলা তাকে উশান জরুরি তলবে ডেকে পাঠিয়েছে তীব্রের মাধ্যমে। পদচারণ কালীন বারংবার ঘুম কাটানোর প্রয়াসে দু’হাত দিয়ে চোখ ডলছে। উশানের কামড়া আরেকটু দূরে। উজান লম্বা কদম ফেললো এবার। ভাই যা বলে তা চট করে শ্রবণ করে ফের রুমে এসে ঘুম দিবে।
-‘ ডেকেছিলি ভাই? ‘
উজান অপ্রতিভ। উশানকে হটাৎ করে গম্ভীর রূপে দেখে সে সকাল সকাল দারুণ ভড়কেছে! উশান তো শান্ত মানুষ। তার মুখে গাম্ভীর্যতা কেনো?নিশ্চিত
গুরুতর কিছু হয়েছে। উজানের অন্তঃকরণ ভীষণ ছটফটে, উচাটন হলো লহমায়। উশানকে মৌন দেখে ফের প্রশ্ন করল,
-‘ ভাই? ‘
-‘ সিয়াকে চিনিস কি করে? কবে থেকে তোদের পরিচয়? ‘
ভরাট কন্ঠস্বর এবং পিছে ফেলা আসা নিজের আবেগকে নিয়ে প্রশ্ন শুনে উজান চমকালো একটু। সে চাইছিল না সিয়াকে নিয়ে আর কোনোরূপ প্রশ্ন বা ঐ মেয়েটা সম্পর্কিত কোনোকিছুই শ্রবণ করতে৷ উজান গিয়ে তীব্রর পাশে বসলো। তীব্রও তখন তার ভাইয়ের মতো গম্ভীর হয়ে।
-‘ সিয়ার প্রসঙ্গ টানছিস হটাৎ। তুই কি করে জানলি ওর কথা?’
উশান বিরক্তবোধ করলো। কড়া দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে সে শুধালো,
-‘ যা জিজ্ঞেস করেছি, তার উত্তর দে! ‘
-‘ সিয়ার সাথে আমার পরিচয় মীরা ভাবীর মাধ্যমে। সিয়া একটা কেস নিয়ে আমার কাছে এসেছিলো।ও ঢাকার একজন দায়িত্ববান পুলিশ অফিসার খুঁজছিল যে ওর হেল্প করতো। তখন হয়তো মীরা ভাবীর সাথে ওর কথা হয়েছে আর ভাবী আমার নাম সাজেস্ট করেছে। পরিচয় সাতমাস ধরে। তবে কথা হতো মাঝেমধ্যে। ‘
-‘ কেস কতদিন ধরে চলছিলো?’
-‘ এক সপ্তাহ। তেমন মেজর ইস্যু ছিলো না তাই তাড়াতাড়িই সল’ভ হয়ে গেছে। ‘
-‘ কেস যদি এক সপ্তাহেই শেষ হয় তাহলে পরিচয় ৭ মাস ধরে কেনো? মাঝে তোদের কি নিয়ে কথা হতো?’
তীব্রর প্রশ্নে উজানের অবস্থা করুণ। সে এই বিষয়ে কিছুতেই কথা বলতে চাচ্ছিলো না। বিষয়টা থামাচাপা দেয়ার প্রয়াসে উজান শুধালো,
-‘ হটাৎ এসব প্রশ্ন কেনো? তোমরা আমাকে সি.আই.ডি অফিসারদের মতো জেরা কেনো করছো? ‘
উশান নিজের কাজে ব্যাস্ত হলো। নেত্র ইশারায় তীব্র কে বলল কিছু। পরপর তীব্র কর্কশ কন্ঠে বলল,
-‘ শালা গর্দভ! এতকিছু হইতেছে তার খবর রাখস না তুই। সিয়া কাল এসে উশানকে আঘাত করে গেছে। ও আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন ও নিয়ে গেছে! সিয়া রাহনুমার লোক। ইভেন রাহনুমার মেয়ে সিয়া। আমরা এতদিন ধরে যার পিছনে পড়ে আছি, যেই সন্ত্রাসী দলটাকে খুঁজতে এতো কষ্ট, এতো পরিশ্রম তারই লোক তোর সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়ালো তুই টের পেলি না? ‘
উজান চরম আশ্চর্য! অবাকতার রেশ তার রঞ্জে রঞ্জে প্রবাহিত হলো। অন্তঃস্থলের কোথাও মৃদু যন্ত্রণা অনুভূত হলো তার। পরক্ষণেই নিজেকে সামাল দিয়ে বলে উঠলো,
-‘ রাহনুমার মেয়ে সিয়া! জানলে কি করে? ‘
-‘ উশান জেনেছে। ‘
-‘ আমি আসলে এতোটা জানতাম না তবে এটা জানতে পেরেছিলাম সিয়া ঊষা অথবা রাহনুমার লোক। পদক্ষেপ নিতে গিয়ে দেখি ও গায়েভ। তার কয়েকদিন পর ওর দেখা পেয়েছিলাম। থানায় এসে আমার পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো ওকে বাঁচাতে ওকে কেও নাকি ধ’র্ষ’ণ করেছে। তারপর সেভাবেই কাঁদতে কাঁদতে সেন্সলেস হলো। ডাক্তার কাছে নিয়ে আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলার জন্য কেবিন থেকে বাহিরে গিয়েছে পাঁচ মিনিটের মাথায় ফিরে আসতেই দেখি ও নেই। খোঁজার চেষ্টা করেছি এতোদিন। খুঁজে পেলাম না। ‘
মিনিটখানেক সময়ের ঘোরতর মৌনতা বিস্তার। উজান হাসঁফাসঁ করছে কেমন তবে তা উপস্থিত দু’জন ব্যাক্তির অগোচরে। তীব্র মনোযোগ সহিত ভাবছে কিছু। উশান ব্যাস্ত ল্যাপটপে। কয়েকপল সেভাবেই কাটল। অতঃপর ল্যাপটপ স্ব- শব্দে বন্ধ করে উশান ভরাট কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘ সিয়া রাহনুমার মেয়ে। রাহনুমা সিয়ার বাবাকে আঁটকে রেখেছি। ক্লিয়ার করে বললে ধরা হয় তাকে কিডন্যাপ করে রেখেছে। সিয়ার বাবা ভালো ছিলো না। বিয়ের পর থেকে রাহনুমা আর সিয়াকে মারধর, অত্যাচার – নির্যাতন করতো। রাহনুমার এ নিয়ে আক্ষেপ ছিলো। তবে কিছু বলতে পারেনি। সুযোগ বুঝে তাকে আঁটকে ফেলেছে যখন থেকে সে সন্ত্রাসী দলটায় যুক্ত হলো। সিয়া কোনো এক কারণে বাবা তাকে এতো অত্যাচার করার পরও সে বাবাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। রাহনুমা প্রতিনিয়ত সিয়াকে দিয়ে খু’ন করায়। টাকার বদলে!ব্লাকমেইল করে সিয়ার বাবাকে দিয়ে। সিয়া টাকার বদলে মানুষ খু’ন না করলে সিয়ার বাবাকে মে’রে ফেলবে এরূপ হুমকি – ধামকি দেয়। মা’ফিয়া টিমটা চলার জন্য বেশ অনেক টাকা লাগে। মোটা অঙ্কের টাকা। তাই ঐ টিমে যারা যুক্ত তারা মূলত এভাবেই নিকট আত্মীয়কে ব্লাকমেইল করে টাকা জোগাড় করে। নয়তো দেখা যায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, টাকার বদলে মানুষ খু’ন এসব করে টাকা উপার্জন করে। ‘
উজানের শিরায় প্রবাহিত রক্তের স্রোতে কে যেনো মরিচ ডলে দিয়েছে বোধহয়। তার হটাৎ করেই উশানের কথা শ্রবণ মাত্র পুরো শরীর জ্বলছে।হাতের রগ ফুলে ফেপে উঠছে। ‘ রাহনুমা ‘ নামক ব্যাক্তিটা কে গলা চেপে কঠিন মৃ’ত্যু দেয়ার প্রবল ইচ্ছে উদয় হয়েছে মনের অন্দরমহলে। সে যথাসম্ভব নিজেকে সামলালো। তীব্র অবাকের লেশ নিয়ে বলল,
-‘ তুই এতোকিছু আসতে না আসতেই জানলি কি করে ভাই? ‘
-‘ লেফটেন্যান্ট কি আমি ঘাষ কেটে হয়েছি? ‘
গলায় শব্দ করে হেসে ফেললো তীব্র। উজান নিশ্চুপ তখন। সে ভাবছে সিয়ার কথা। গভীর মনোযোগ সহিত।
___
মীরার মাস্টার্স প্রায় শেষের পথে। ফাইনাল এক্সাম তার সামনের সপ্তাহ থেকে শুরু। তারপরই তার মাস্টার্স কমপ্লিট। আগেই শেষ হতো। সে এখন তার জুনিয়রদের সাথে ক্লাস করছে। তার সহপাঠীরা বহু আগেই মাস্টার্স শেষ করে এখন চাকুরীরত। মাঝে ৬ মাসের জন্য সে কোমায় যাওয়াতে সবটা এলোমেলো হয়েছে। নয়তো এতোদিনে তার মাস্টার্স শেষ হয়ে যেতো।চোখের পলকে কিভাবে দুই বছরের বেশি সময় সমাপ্ত হয়ে গেলো তার হিসাবনিকাশ মিলাতে পারছে না কিছুতেই সে।
-‘ ভাই জীবনটাই রঙহীন। কোনো বিনোদন নাই।এই জীবনে কি করলাম? ‘
রুহির হতাশ কন্ঠস্বর। এই কথাটা সে সকাল হতে বলছে। কেনো বলছে? তা জানা নেই মীরার। তবে সে আশঙ্কা করেছে হয়তো রুহির ব্রেকআপ হয়েছে আবার। তাই এসব উদ্ভট কথা বলছে বারংবার।
-‘ মীরা? দোস্তও! আমার দিকে একটু তাকা না? ‘
মীরা ঘুরে বসলো। হাতের কলম শব্দ করে রাখলো টেবিলে। জিজ্ঞেস করল,
-‘ চড়াবো ধরে বেয়াদব! কি সমস্যা? ‘
-‘ লাল মুরগীর সাথে আমার ব্রেকআপ হইছে জান।’
‘ লাল মুরগী ‘! উদ্ভট শব্দ দু’টো শুনে মীরার উচিত এখন শব্দ করে হাসা। কিন্তু সে হাসলো না। গম্ভীর রইল। গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘ লাল মুরগী কে? তোর বয়ফ্রেন্ড? ‘
-‘ এক্স! এক্স বয়ফ্রেন্ড। ‘
-‘ তোর কি আর কোনো কাজ নাই রুহি? কেনো এসব করিস? আর কতদিন! আর কতো গুলো দিন এভাবে চলবি? ‘
নিরুত্তর রুহি। জবাব আসলো না। বিড়বিড় করতে করতে সে প্রস্থান করলো কামড়া হতে। আপাতত প্রশান্তি! মীরা ঘুরে বসে পড়া শুরু করতেই তার মাথায় ‘উশান ‘ নামক পোকা গুলো আচানক চেচামেচি করে উঠলো। মীরা বুঝলো, এখন যদি সে উশানের সাথে কথা না বলে তাহলে সে শান্তি পাবে না কিছুতেই।
রিং বাজছে অনবরত। ফোন তুলছে না উশান। মীরা হতাশ হয়ে কান থেকে ফোন নামাতে নিবে তৎক্ষনাৎ অপাশ হতে ভেসে আসলো উশানের দূর্বল কন্ঠ,
-‘ বলো মীরা। শুনছি! এনিথিং সিরিয়াস? ‘
ভেবেচিন্তে মীরা জবাব দিলো কিছুক্ষণ পর।
-‘ সিরিয়াস কিছু ছাড়া কি তোমাকে ফোন করা যাবে না? নিষেধাজ্ঞা আছে? ‘
-‘ তা না মীরা। আচ্ছা লেট ইট বি! হটাৎ ফোন দিলে যে? ‘
-‘ আমার পড়াশোনা প্রায় শেষ উশান। সামনের সপ্তাহ থেকে এক্সাম তারপর ফুলফিল ফ্রী! আমি ঢাকায় ফিরবো। ‘
কিয়ৎক্ষণ বুক ধরফর করা মৌনতা চলল। আচানক অপাশ থেকে উশান রসিকতার সুরে বলল,
-‘ বাব্বাহ! আমার আদর পাওয়ার জন্য এতো উতলা? এক্সাম শেষ হতে না হতেই ফিরে আসার বার্তা জানাচ্ছো? ওকে, কাম টু মি জান! আই ওয়ান্ট টু লাভ ইউ। ‘
মীরা কপাট রাগ দেখিয়ে তৎক্ষনাৎ শুধালো,
-‘ এসব আজেবাজে কথা ছাড়া তোমার মাথায় কি কোনোকিছুই আর ঘুরেনা? আশ্চর্য! ‘
-‘ না তো। সবসময় এসবই ভাবি। মেইন কথা কি জানো? তুমি আপাদমস্তক মানুষটার কথা আমার মনে পড়লে শুধু আদর, ভালোবাসা পায়। বুঝেছো? ‘
চলবে~
[ রি – চেইক করিনি। সবাই রেসপন্স করবেন। ]
গ্রুপ- দোলমহল-|Stories Of Sadiya Mehruj |