#হৃদয়েশ্বরী – ৩৭
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
_______________________________
মীরা পাগলের ন্যায় আচরণ করছে। কখনো নিজের চুল টানছে তো কখনো নিজেকেই অত্যান্ত বাজে ভাবে আঘাত করছে।নার্স তাকে ঘুমের ঔষধ দিতে আসায় দেখা গেলো মীরা তাকেও আঘাত করে বসলো। কেবিনে উপস্থিত ডাক্তার দু’জন অতিষ্ঠ। তাদের মতানুসারে, মেয়েটার মাথায় এতোটা গভীর ক্ষতের ফলস্বরূপ তার ব্যাথায় ক্ষণে ক্ষণে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কথা। আর এই মেয়েকে দেখো! একটু যদি শান্ত হতো। তীব্র দৌড়ে আসলো পরপরই। এসে মীরার অবস্থা দর্শন করে শুকনো ঢোক গিললো। কেবিনের এক কোণে ডাক্তার দু’জনকে নিজেদের মধ্যে আলাপচারিত করতে দেখে তার মাথায় রক্ত উঠে গেলো মূর্হতেই।উশান এসময় এখানে উপস্থিত থাকলে ডাক্তার দু’জনের মাথা ফাটিয়ে দিতো বোধহয়।
-‘ পেশেন্টকে এভাবে বাজে অবস্থায় রেখে আপনারা ওখানে কি কিসের পিরীতের আলাপ করছেন?’
পরপর বাজে দুই তিনটা গালি ছুড়লো তীব্র নিম্ন সুরে। যা ডাক্তার দু’জন শুনতে পেলো না। তবে তাদের যে অতি সুন্দর বার্তাও ছুঁড়ে দেয়া হয়নি তা তারা তীব্রের মুখোশ্রী দর্শন করা মাত্রই বুঝেছে। ডক্টর. ফারহা এগিয়ে এলো বিরক্তি সহিত। তীব্রের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল,
-‘ মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ! স্পিক ইন এ লো ভয়েজ।’
তীব্রের ইচ্ছে হলো ফারহার মাথা ফাটিয়ে দেয়। সে যথাসম্ভব নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
-‘ মীরা এমন করছে কেনো? কি হয়েছে ওর? ‘
-‘ ও কাওকে চাচ্ছে! যার কারণে ওকে আমরা শান্ত করতে পারছিনা। নার্স ঘুমের ঔষধ দেয়ার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু ও নার্সের ওপর হামলা করেছে। আঘাত করেছে। আপাতত মনে হচ্ছে না ওকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে বশে রাখা যাবে না। ওর মাথা ঠান্ডা রাখা প্রয়োজন। চিন্তামুক্ত থাকতে হবে। তাই সে যাকে চাচ্ছে তাকে আসতে বলুন। ‘
-‘ কাকে চাচ্ছে? কারো নাম বলেছে? ‘
ফারহা নিজের ভ্রু’দ্বয়ের মাঝখানে ভাজ ফেললো। মনে করার চেষ্টা করলো সে এতক্ষণ যাবৎ কি শ্রবণ করেছে। কাঙ্ক্ষিত বার্তা স্বরণে আসতেই শুধালো,
-‘ ও বলছে ‘ উশান! ও কি ঠিক আছে?’ এটাই বলছিলো বারবার। উশান কে? আপনি? ‘
তীব্র দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।মীরার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে জবাব দিলো,
-‘ উশান হার হ্যাজবেন্ড। আই এ্যাম নট উশান। ‘
-‘ ওহ! হোয়ার ইজ হি? ডিড হি ডাই ইন দ্যাট এক্সিডেন্ট? ‘
তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত ছুড়লো। ফারহা অপ্রতিভ হয়। আচানক এরূপ চাহনির অর্থ তার বোধগম্য হলো না। তীব্র শক্ত কন্ঠে প্রতিত্তুর করলো,
-‘ হি ইজ এলাইভ। ‘
মীরা কান্না শুরু করেছে।তীব্র বারবার করে বোঝানোর চেষ্টা করেছে তাকে, যে উশান ঠিক আছে।সুস্থ আছে। তবে মীরা মানছেই না৷ ফারহা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে উশানকে মীরার কাছে না আনা পর্যন্ত তাকে শান্ত করা যাবেনা কিছুতেই। তীব্র হতাশ হয়! উশান তাকে পাঠিয়েছিলো মীরা রুহি আর টুইঙ্কেলের দেখভাল করার জন্য। রুহি, টুইঙ্কেল সুস্থ আছে।তারা ঘুমে বিভোর। আঘাত বেশি পেয়েছে মীরা। তার মাথায় স্টিচ লেগেছে। হাত ভেঙেছে, পা মচকে গিয়েছে।উশান আপাতত এক্সিডেন্ট স্পটে আছে।ইফরাদের লাশ খোঁজা হচ্ছে। ছেলেটার শরীরের এক টুকরো মাংসও খুঁজে পাওয়া যায়নি। গাড়ি বিস্ফোরণের সাথে সাথে ইফরাদের পুরো শরীর শত খন্ডে বিভক্ত হয়েছে।দেহ ছিন্ন – বিচ্ছিন্ন হয়ে পানির অতল গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছে। গাড়ি সড়ক ছিটকে পড়েছিলো নদীর ভেতর৷
তীব্র কল করে উশানকে।দুই, একবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ হয়। ওপাশ থেকে ভেঙে ভেঙে আসে উশানের জলদগম্ভীর কন্ঠ,
-‘ কি হয়েছে? ‘
-‘ মীরার অবস্থা ভালো না উশান। ও অদ্ভুত আচরণ করছে। বারবার তোকে দেখার জন্য আকুতি মিনুতি করছে। আমাকে চিনছেই না ঠিকমতো। ডাক্তার বারবার করে বলছে ও যাকে চাচ্ছে তাকে যেনো এখনি ওর সামনে হাজির করা হয়। নাহলে বিরাট সমস্যা হবে। তুই একটু আসবি?আমি নাহয় ওদিকটা দেখি। ‘
মিনিট দুয়েকের নীরবতা।তীব্র ভাবলো, হয়তো সংযোগ বিছিন্ন হয়েছে। তাই সে বেশ কয়েকবার উশানের নাম ধরে ডাকলো। অতঃপর আচানক ওপাশ হতে নিজের স্বভাবগত কন্ঠে বলল,
-‘ আসছি আমি। ‘
মীরার পানে অবলোকন করে স্বস্তির শ্বাস ফেলে তীব্র। তবুও কোথায় যেনো কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভীতি জমে। মীরার অবস্থা ভালো না। ক্লিওরার সাথে কথা বলে সে জানতে পেরেছে। টুইঙ্কেল কে সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে মীরা নিজেতে ধ্যান দিতে পারেনি। তার মাথা গিয়ে বাড়ি খেয়েছে পাথরের ওপর। কিছু ঘটনা সে ভুলে যাবে বলে আশঙ্কা করছে ক্লিওরা।সে বলেছে এই আঘাত ভবিষ্যতে খুব সমস্যায় ফেলতে পারে মীরাকে৷
____
-‘ আম্মু! আমাদের তো যথেষ্ট পরিমাণে টাকা আছে, তবুও কেনো তুমি আমায় প্রতিনিয়ত টাকার জন্য মানুষ খু’ন করতে বলছো?আমার আর এসব ভালো লাগেনা আম্মু। আমাকে তুমি মুক্তি দাও! বাবাকে ফেরত দাও। ‘
রাহনুমা পানি খাচ্ছিলো। সিয়ার কথা তার কর্ণপাত হতেই হাতের কাঁচের গ্লাসটি সে সিয়ার পায়ের দিকে ছুঁড়ে মারে স্ব-শক্তিতে। অস্ফুট আর্তনাদ বেড়োয় তৎক্ষনাৎ সিয়ার ওষ্ঠাধর প্রসারিত হয়ে। পায়ের দিকে অবলোকন করতেই দর্শন হয় কাঁচের গ্লাসের প্রতেকটি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র টুকরো তার পায়ের নরম মাংস ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। শুষ্ক ভূমিতে ক্ষণেই রক্তিম তরল পদার্থ দ্বারা সিক্ত হয়। রাহনুমা দ্রুত পদে এগোল সিয়ার সন্নিকটে। সিয়ার নিকটবর্তী পৌঁছে সে বাজখাঁই কন্ঠে বলল,
-‘ বাপ! বাপ আর বাপ! ঐ ফ’কি’ন্নি, তোর বাপ তোর আর আমার সাথে কি করছে মনে নাই তোর? সব ভুলছস? আর টাকা থাকুক! তবুও আমি যাই বলমু তোরে তা করতে হইবো। বুঝছস? নাইলে তোর বাপ কে আমি কাইট্টা এই সাগরে ভাসামু। ‘
অস্থির পদচারণের শব্দে মুখরিত হলো চারিপাশ। সিয়া এক প্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে আসলো রুম থেকে। এখানে থাকা মানে স্বেচ্ছায় নরক যন্ত্রণা উপভোগ করা।এই স্থানটা তার সবকিছু কেঁড়ে নিয়েছে। তার মা, তার বাবা,তার সম্মান, ইজ্জত! সুন্দর একটা জীবন! সবকিছুই কেঁড়ে নিয়েছে।অতি অল্প বয়সে হয়েছে সে ধ’র্ষি’তা এই স্থানটায়।বাবাকে শেষ দেখেছে এখানে।রাহনুমাকে স্বচ্ছ মানুষ থেকে জা’নো’য়া’রে রূপান্তর হতে দেখছে এখানটাতেই। সিয়া অস্থির পায়ে দৌড়ানো আরম্ভ করলো।থামার নামগন্ধ নেই তার মাঝে। আশপাশে অনেকে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলো।সিয়াকে দৌড়ে যেতে দেখে তারা শালীন পোশাক দ্বারা আবৃত সিয়ার দেহে লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে ভুললো না। সমুদ্র পৃষ্ঠ এবং পুরোপুরি নির্জন, জনমানবহীন এক স্থানে আস্তানা গেঁড়েছে এই তুখোড় সন্ত্রাসী দল। তারা তাদের আস্তানা এমনই এক জায়গায় তৈরি করেছে দেখা যায় এখানে অনেক সময় সূর্যের রশ্মি অব্দি পৌঁছায় না। বাহিরে আসার পর সিয়া ফ্লাশ লাইট অন করলো ফোনের। দিন হলেও রশ্মি নেই এখানকার বাতাবরণে। প্রায় দুই ঘন্টার মতো হেঁটে সমুদ্রের দেখা মিললো তার। এলোমেলো, অবিন্যস্ত কদম ফেলে সিয়া মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো ভূমিতে৷ সমুদ্রের লবনাক্ত পানি তৎক্ষনাৎ তার পুরো দেহ স্পর্শ করে আবারও পূর্বের স্থানে ফিরে গেলো চট করেই। নিভু নিভু নেত্রে সে সম্মুখে দৃষ্টি ফেলে। এই স্থানটা তার চির-পরিচিত। যেদিন তাকে প্রথম ধ’র্ষণ করা হলো, ধ’র্ষ’ণ শেষে তাকে এখানেই ফেলে গিয়েছিলো। বয়স বড়জোর তার কত ছিলো তখন?নয় কি দশ! লবনাক্ত পানি গলাধঃকরণ করা মাত্র তার আঁখি জোড়া বদ্ধ রূপে রূপ নিলো। অপরাহ্নের সেই অলস লহমায় তার দেহ বালির ওপর পড়ে রইল নিষ্প্রাণ রূপে।
___
-‘ উঠবেনা? ‘
মীরা জড়োসড়ো হলো। আরেকটু নিবিড় করলো বন্ধন। দুরত্ব ঘুচালো মধ্যকার। উশানের বক্ষঃস্থলে ঘন ঘন মুখে ঘষেঁ বুক ভরে শ্বাস টানলো। মিষ্টি এক ঘ্রাণ তার নাসারন্ধ্র দ্বারা তরতর করে প্রবেশ করলো অন্তর্ভাগে। পুরুষালি ঘ্রাণ!উশানের গা থেকে মৃদু রূপে আসছে। প্রায় চার, পাঁচ মিনিট পর মৌনতা কাটালো মীরা। অভিযোগের স্বরে বলল,
-‘ আপনি খারাপ। বেয়াদব, অসভ্য! ‘
উশান হেঁসে উঠলো। হাসি থামলো মিনিটখানেক পর। গাঢ় কন্ঠে সে বলল,
-‘ আচ্ছা? লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে শেহজাদা কিন্তু আপনিই বলেন ম্যাডাম। বাহিরে এসব আমাকে দেখিয়ে অসভ্য, বেয়াদব বলে লাভ নেই। ‘
স্থির মুখোশ্রীতে ত্রপা এসে আক্রমণ করে বসলো। মেদহীন,শ্যাম বর্ণের গাল দু’টো হলো লাল।অন্তঃস্থল প্রশ্ন ছুড়লো, লোকটা জেনে গিয়েছে তাহলে?
-‘ আমাদের বিয়ে হয়েছে। এই ব্যাপারটা আগে পরিস্কার করে বললে কি হতো আপনার? হাত – পা ভেঙে, ফকির হয়ে রাস্তার ভিক্ষুক হয়ে যেতেন? ‘
-‘ ফকির তো হতাম না ম্যাডাম তবে এখন যে আপনাকে সামলাতে এটাই কাজে দিলো। আগে বললে এই ট্রিক’স কাজে লাগতো? উঁহু! ‘
কথাটা সঠিক বৈকি। মীরার অস্থির, আনচান অবস্থা স্থির করতে উশানের বলা মাত্র একটি বাক্য অস্থির মীরাকে চির নিস্তব্ধ করেছে। শিথিল করেছে মীরার পাগলামি, ছোটাছুটি! মীরা এখন থেকে উশানের বউ। তাদের বিয়ে হয়েছে। বাকদ্ব্যয় শ্রবণ করা মাত্র মীরা মৌনতায় ধাপ টেনেছিলো নিজের মাঝে।
উশান মীরাকে গভীর, সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে নিলো পুরো লহমা জুড়ে৷ তার চাহনি বেফাঁস, একটু অন্যরকম। মীরার পিঠে নিজের হাত শক্তপোক্ত করে স্থাপন করে মীরাকে কাছে টানলো সে।কন্ঠের খাদ নামিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
-‘ এভাবে লজ্জা পাচ্ছেন কেনো ম্যাডাম? আমি কি আপনাকে দুষ্টু আদর দিয়েছি? ‘
চমকিত নেত্রে মীরা মাথা ওপর করলো। দৃষ্টি একত্রিত হলো দু’জনের। উশানের নেত্রে বজায়মান অদ্ভুত, উচাটন অনুভূতি পড়ে শিরশিরিয়ে উঠলো তার সর্বাঙ্গ। উশান নিয়ন্ত্রণহীন হলো ক্ষনেই৷অস্থির কন্ঠে শুধালো,
-‘ কাঁপাকাপিঁ থামান ম্যাডাম। আমি কন্ট্রোলেস হয়ে পড়ছি৷ ‘
উশান থামলো। কিয়ৎ পর আচানক বলে উঠলো,
-‘ তোমাকে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে মীরা। ক্যান আই?’
অনুমতি চাইলো ঠিকই তবে উচাটন অন্তঃকরণ অনুমতির অপেক্ষায় আর রইল না। উশান নতজানু হয়ে ওষ্ঠাধর ছোঁয়ালো মীরার ললাটে। একবার, দুইবার, পরাপর তিনবার উত্তাপ অধর ছুঁইয়ে সে বেড়িয়ে আসলো কেবিন থেকে৷ ওখানে আপাত লহমায় উপস্থিত থাকা মানেই বিপদ। নিশ্চিত মীরা এখন লজ্জায় লাল, নীল হবে। তা দর্শন করা মাত্র উশানের অবস্থা আরো বেহাল হবে। অনর্থ করতে মন চাইবে। তার চেয়ে বরং মীরার থেকে আপাতত দূরে থাকাই ভালো।
উশান করিডরে আসলো। ফোন বের করে তার আর ইফরাদের বহু পুরাতন ছবিটা স্ক্রিনে মেলে ধরলো। অধর জোড়া তার প্রসারিত হয়ে বের হয়ে আসলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস। বিড়বিড়িয়ে আপনমনে বলল কিছু। অতঃপর দৃষ্টি ফেললো সম্মুখে। সূর্য ডুবো ডুবো প্রায়। বিদায় নিচ্ছে মেদিনী হতে। উশানের আচানক মনে হলো, ইফরাদ সেই সূর্যটার সহিত আস্তে ধীরে পৃথিবীর অনিল, সৃতিচারণ, বাতাবরণ হতে পূর্ণ রূপে বিদায় নিচ্ছে। বক্ষঃস্থল ভার হয়ে এলো তার।নিম্ন কন্ঠে বলল,
-‘ হাশরের ময়দানে যেদিন আমাদের দেখা হবে আবার সেদিন তোকে আমি কখনোই মাফ করবো না ইফরাদ। নিজের ইচ্ছেয় মৃত্যু গ্রহণ করলি। একবারও টুইঙ্কেলের কথা ভাবলি না।ওকে এখন কিভাবে সামলাবো আমি? ‘
চলবে…